তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-১৮

0
895

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখনী – মুনিরা সুলতানা।
পর্ব – ১৮।

————-*
দিনগুলো যেন ঝরের গতিতে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। প্রচন্ড গরম পরেছে। বৃষ্টি দর্শন নেই কতদিন। দিনের বেলায় কাজকর্মের সময় ঘেমে নেয়ে একাকার হতে হয়। আর বাইরে গেলে তো কথাই নেই। গাড়ির ভিতরে এসি চললেও যখনই বাইরে বের হতে হয় তখন মনে হয় আগুনের হল্কা ছুঁয়ে যায়। প্রাণ আইঢাই করে ওঠে। মানুষের দিন এর মাঝেই এগিয়ে চলে। আমাদেরও তাই চলছে। কদিন ধরে প্রায়ই মার্কেটে যেতে হয়েছে। তিয়ানা আরও কিছু কাপড় কিনেছে। শাড়িও কেনা হয়েছে সবার জন্য। সেগুলোর ব্লাউজ সহ কাপড়গুলো আবারও দর্জিবাড়ি গিয়ে সেলাইয়ের জন্য দিয়ে আসা হয়েছে।
অবশেষে রহমতের মাস রোজাও শুরু হয়ে গেছে। বাসায় সবাই নামাজে নিয়মিত না হলেও রোজা শুরু হতেই বেশ নামাজ রোজা সব কিছুই মন দিয়ে করছে। বাড়ির পরিবেশ তাই বেশ অন্য রকম বরকতময় শান্তিপূর্ণ থাকে। কামরান এমনিতেই বাসায় যখন থাকে নামাজ আদায় করে। আগে ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠতে দেখিনি। তবে আমি উঠার পর টের পেলে ও উঠে নামাজ পড়ত। প্রথম দিকে সংকোচ করে আমি নিজে থেকে ডাকতাম না। যখন মাঝে মধ্যে উঠতে দেখে এরপর থেকে আমিই প্রতিদিন ডেকে দিতাম। আর এখন তো রোজার মাস। শেহরির সময় এমনিতেই সবাই উঠে পরে। আগামীকাল শাশুড়ী মায়েরা আসবে। নতুন অতিথি তাসমিয়ার বাচ্চাদের প্রথম আগমন হবে এই বাড়িতে। দুই মামা দেখেশুনে খুব সুন্দর দেখে একটা দোলনা কিনে এনেছে ভাগ্নে ভাগ্নীদের জন্য। আবার এই সপ্তাহেই কামরান লন্ডন যাবে এক্সিবেশন এবং সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে। রোজার মধ্যেও শপিংএ ছোটাছুটি করতে করতে কাহিল অবস্থা। তিয়ানা পারেও বাবা। ঈদের সময় আমরাও শপিং করতাম। কিন্তু তিয়ানার মত নয়। আজকেরও বের হয়েছি শপিংয়ে। সাথে কামরান আরমান দুজনেই আছে। কামরান কিছুতেই আসতে চাইছিলনা। এই কদিনেও ওরা দুই ভাই একদিনও শপিংয়ে যায়নি। আমরা দুজনেই সামলেছি। কিন্তু তিয়ানার জিদের কাছে হার মানতে হয়েছে আজ। কারন আজ মুলত ওদের জন্যই শপিং করা হবে। আর আরমান তো সকালেই বেরিয়েছিল ওর মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্যে। মাঝখানে আমাদের সাথে জয়েন করলো। মগবাজারে আড়ংয়ে এসেছি। পাঞ্জাবি কেনার উদ্দেশ্যে। ঘুরে ফিরে ওদের জন্য পাঞ্জাবি সাথে তাসমিয়ার জামাই অর্থাৎ দুলাভাইয়ের জন্যও কেনাকাটা করা হচ্ছে। বাচ্চাদের জন্যও কাপড় চোপর খেলনা এসব কেনা হলো। আরও কিছু কুর্তি অন্যান্য টুকিটাকি কেনা হয়ে গেলে তিয়ানা আরমানের সাথে চলে গেল। ওর নাকি ভার্সিটিতে যেতে হবে। আরমান বাইক এনেছে। ওকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে যাবে। ওরা চলে গেলে কামরান শাড়ি দেখতে লাগলো। কেনাকাটা তো হয়ে গেছে। ও শাড়ি দেখছে কার জন্য? এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

” সব কিছুতো কেনা কমপ্লিট। সবার জন্য অনেকগুলো শাড়িও কেনা হয়েছে। আপনি আবার শাড়ি দেখছেন কেন?”

কামরান বললো, ” দরকার আছে। ” তারপর একটা মিষ্টি পেঁয়াজি রঙের জমিনে ছাই রঙের পাড়ে সোনালী জোরি দিয়ে কারুকাজ করা শাড়ি দেখিয়ে বললো, ” এটা কেমন দেখতো?”

আমি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” কার জন্য? ”
” আহা এতো প্রশ্ন কর কেন? তুমি কেবল বল এটা কেমন?”

” বারে কার জন্য নিচ্ছেন না জানলে কি করে বলবো এটা কেমন? তাকে মানাবে কিনা কিভাবে বুঝবো? ”

কামরান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ” মানাবে কিনা আমি বুঝবো। তুমি শুধু পছন্দ কর। ব্যাস। ”

আমিও আর কথা বাড়ালাম না। শাড়িটা ভালো করে দেখলাম। দামটা অনেক বেশি। তবে খুব সুন্দর তাই ঐটাই পছন্দ করে বললাম, ” হ্যা এটা সুন্দর। আপনার এই কালারটা প্রিয় কালার বুঝি? ”

কামরান এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে আবার শাড়িটার দিকে ফিরে বললো, ” হুম। তা বলতে পারো। তোমার পছন্দ হয়েছে? শিওর? ”

আমি মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বললাম, ” শিওর। ”

শাড়িটা সহ আরও অন্য কিছু শাড়ির ফ্রেশ কপি দিতে বললো। কামরান আমাকে ঘুরে ফিরে দেখতে বলল। যদি কিছু পছন্দ হয়। দেখতে দেখতে কিছু ডেকোরেশন পিস, মোমবাতি ডোপিস কিছু কুশন কভার এইরকম টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে ফেললাম। এই ধরনের শপিং মলে এসে যত দেখব ততই হাবিজাবি শপিংয়ের পরিমাণ বাড়তেি থাকবে। কামরানও কিছু বলেনা। আরও বলে যাচ্ছে,

” আরও দেখনা। পার্স, জুয়েলারি এসব দেখলেনা?”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ” অনেক শপিং হয়েছে। এবার দয়াকরে বাসায় চলেন। ”

কামরান হাসতে হাসতে বললো, ” আমার বউয়ের দেখি শপিংয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট কম। মেয়েদের তো শপিংমলে ছেড়ে দিলে হুসই থাকেনা। তিয়ানাকে দেখছনা? কিন্তু তোমাকে ঠেলে ঠুলে শপিং করাতে হচ্ছে। তুমি দেখছি অন্য মেয়েদের থেকে একটু আলাদা। ”

” আমি এমনই। তাছাড়া এতোদিন সেভাবে কেনাকাটা করা হয়নিতো তাই অভ্যাস নেই। কেন অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা বলে কি আপনার আমাকে ভালো লাগছে না?”

কামরান আবারও হেঁসে উঠলো, ” মেয়েদের যে কমোন ব্যাপার এক লাইন বেশি বোঝা সেটা কিন্তু একই আছে। ”

আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম। ও হাসতে হাসতে বললো, “তাছাড়া এতে তো আমারই লাভ। আমার সেভ হলো। যেখানে অন্য পুরুষেরা মেয়েদের অতিরিক্ত শপিং বাতিক দেখে অতিষ্ঠ সেখানে ভাগ্যক্রমে এমন লক্ষ্যি বউ পেয়েছি আমি সেখানে তোমাকে ভালো না লাগার কোন কারন থাকতে পারে? বল। ঠিক আছে সব কেনাকাটা শেষ যখন বিলটা পে করে আসি। চল।”

কেনা সব জিনিস গুলো নিয়ে কাউন্টারের দিকে গেলাম। সেখানে দেখি লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। আমি অবাক হয়ে কামরানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

” এখানে এত বড় লাইন কেন? ”

কামরান হেসে উঠে বললো, ” এখন ঈদের শপিংয়ের সময় এমনই লাইন ধরে বিল পে করতে হয়। দেখছনা কেমন মানুষের ঢল নেমেছে। তুমি বরং এক জায়গায় দাঁড়াও নয়তো ঘুরে ফিরে দেখতে পার। ”

আমি মাথা দুলিয়ে সায় জানালাম। ওখানে ভিড় না বাড়িয়ে আশেপাশের জিনিসগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখে চেনা চেনা লাগতে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। মেয়েটার পরনে আকাশি রঙের সালোয়ার কামিজ। ভালো করে দেখে চিনতে পেরেছি। আমার কলেজে পড়াকালীন বান্ধবী সোমা। এইচএসসি পাশ করেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারপর প্রথম দিকে বাড়ি গেলে মাঝে মধ্যে দেখা হত। কিন্তু গত দুই বছর বলতে গেলে কোন যোগাযোগ নেই। আমি ওর দিকে উচ্ছসিত হয়ে এগিয়ে গেলাম। ততক্ষণে সেও আমাকে দেখে এগিয়ে এসেছে। আমার কাছে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরল সোমা। ওর কান্ডে আমি প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম। মুহুর্তের মধ্যে সামলে নিয়ে আমি বললাম,

” কতদিন পরে দেখা হল বলতো? তুইতো একদম লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলিস। রাজশাহীতে আর যাইস নাই নাকি?”

সোমাও ততক্ষণে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে বললো, “গত দুবছরে আর যাওয়া হয়নাই। সেই যে মা মারা যাওয়ার পর গেছিলাম। আব্বার যখন মন চায় এসে দেখে যায়। আর কি করব বল? আমি যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে আছি বাবার সাথেই মাসে দুয়েকবার কথা হয়। তাও বাবাই ফোন করেন। তাই তোদের কারও সাথে চাইলেও যোগাযোগ রাখতে পারিনাইরে। ”

সোমার কথা শুনে ওর শশুর বাড়ির মানুষ গুলোর উপর খুব রাগ হলো আমার। কেমন মানুষ ওরা? আশ্চর্য! ওকে শুধলাম, ” তোর শশুর বাড়ির সবাই এমন কেন? আর তোর বর সেকি একটুও বোঝে না? নাকি এখনও দেশে ফিরে আসেনি? কোথায় যেন থাকে? হ্যা ইটালিতেই তো থাকে? ”

সোমা মন খারাপ করে বললো,” হ্যা ও এখনো ফিরেনি। কিভাবে ফিরবে বল? আমার শশুর মারা যাওয়ার পর বড় ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব ওর উপরই পরেছে যে ছয় ভাই বোনেোরমধ্যে এক ননদের বিয়ে আমার শশুর দিয়ে গেছে। আরেক জনের বিয়ে ঠিক ও দিয়েছে। আরও দুই ননদ এখনও পড়াশোনা করছে। আর দেবরের পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে। তাই আমার শাশুড়ী ওকে আসতে মানা করছে। অন্তত যতদিন দুই বোনের বিয়েটা না হয়। তাই এটাকেই ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছি। ” কথা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোমা।

” তোকে নিয়ে যেতে পারেনা? ”

” ইটালিতে ফ্যামিলি নিয়ে থাকা খুব কঠিন। তাছাড়া আমার শাশুড়ি আমাকে যেতেও দিবেনা। ওনার ভয় আমাকে নিয়ে যাওয়ার পর ছেলে ওদের আর দেখবেনা। ” ম্লান হেসে বললো সোমা।

আমি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললাম, ” এটা কোন কথা হলো? তোদের দাম্পত্য জীবনের সুন্দর সময়গুলো তো এভাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তোরা বেবি কবে নিবি তাহলে?”

সোমা একটু লাজুক হেসে বললো মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পরে ও এসেছিল। সেবার মাসখানেক ছিল। এরপর আমাদের একটা ছেলে হয়েছে। ”

আমি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললাম, ” আলহামদুলিল্লাহ। যাক এইটা কাজের কাজ করেছিস। কিন্তু তোকে বাবার বাড়ি যেতে দেয়না কেন বলতো? ”

সোমা এইবার একটু ইতস্তত করে বললো, ” জানি নারে। আজ পর্যন্ত আমার নিজের বলতে কোন সংসারই তো হলো না। সব কিছু আমার শাশুড়ির আন্ডারে। টাকা পয়সা যা পাঠায় সব শাশুড়ি মা নিজের কাছেই রাখেন। আর এতো হিসেব করে চলেন। মোবাইলের টাকাটাও আমার আব্বা ভরে দেন। এইযে আজ শপিংয়ে এসেছি আমার ননদের সাথে। এখানেও আমার হাতে কিছুই নেই। ঐ দেখ বিল পে করতে গেছে আমার ননদ। ”

হাতের ইশারায় হলুদ কুর্তি পরা একটা মেয়েকে দেখিয়ে বললো ও। আমি সেদিকে তাকিয়ে আবার পাশের লাইনের দিকে তাকালাম। কামরান লাইনে দাঁড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আমি তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। জবাবে আমিও লাজুক হাসলাম। আর দু’জন বাকি আছে ওর আগের লাইনে। আমাকে ঐদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সোমাও আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকিয়ে শুধালো,

” তুই ঢাকায় কবে এসেছিস? এখানে কার সাথে আসছিস?”

আমি কিছুটা লাজুক ভঙ্গিতে বললাম, ” আমার হাসবেন্ডের সাথে আসছি। ”

সোমা উৎফুল্ল হয়ে বললো, ” ওয়াও সত্যি! তুই বিয়ে করছিস? কবে? শশুর বাড়ি কোথায়? ”

” বেশিদিন হয়নি। এইতো চারমাস চলছে। তবে এক্সামের কারণে সংসার জীবন শুরু করেছি মাত্র কিছুদিন হলো। শশুর বাড়ি এখানেই ঢাকায়। হাতের ইশারায় কামরানকে দেখিয়ে বললাম, ” ঐযে ব্রাউন কালারের শার্ট পরে লম্বা মত যে, আমার বর।”

সোমা সেদিকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ” ওয়াও তোর বর তো দেখি হ্যাভি হ্যাসন্ডসামরে? তোর সাথে কি দারুণ মানিয়েছে।”

আমি লাজুক হাসলাম, ” ধ্যাৎ কি যে বলিসনা। বাই দা ওয়ে ঢাকায় তুই কোথায় থাকিস বলতো?”

” আমি? শান্তিনগর থাকি। এখনতো তুইও ঢাকার বাসিন্দা। কোথায় বাসা? আমাদের বাসায় আয় একদিন। ”

” মালিবাগ। কাছাকাছি যখন যাওয়া আসা হবে ইনশাআল্লাহ। তোর ফোন নাম্বারটা দে। ”

আমরা পরস্পরের সেলফোন নাম্বার দেয়া নেয়া করলাম। এর মধ্যে কামরান বিল মিটিয়ে এসেছে। সোমার সাথে সংক্ষিপ্ত পরিচয় পর্ব সেরে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। গেটের সামনে এসে কামরান বললো,

” তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। গাড়িটা এপাশে নিয়ে আসি।”

” আমিও যাইনা আপনার সাথে। ”

” দরকার নেই। গাড়িটা ঘুরাতে হবে। দুই মিনিট দাঁড়াও। ”

দু’হাতে শপিং ব্যাগ সমেত কামরান সাবধানে দুপাশে নজর রাখতে রাখতে রাস্তা পার হলো। প্রচুর ভির থাকায় গাড়িটা এপাশে পার্ক করার জায়গা পাওয়া যায়নি বলে রাস্তার ওপাশে রাখতে হয়েছে। গাড়ির ওপাশে গিয়ে সারি বেধে গাড়ি গুলোর পাশ ধরে হেটে কিছুদুর গিয়ে পিছনের গেট খুলে ব্যাগগুলো রেখে দিল। তারপর গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে ওপাশে ড্রাইভিং সিটের সাইডে যেতে দেখলাম। কিন্তু বেশ কিছু সময় চলে গেল। গাড়ির নড়চড় নেই কোন। কি ব্যাপার ওপাশে করছেটা কি? দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি অধৈর্য হয়ে গেলাম। ভিতরে এসি থাকায় গরম টের পাওয়া যাচ্ছিলনা। কিন্তু বাইরে ভিষণ গরম। মধ্য দুপুর হওয়ায় সূর্যটা একেবারে মাথার উপরে। নির্লিপ্ত ভাবে গনগনে উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে ইট পাথরের ব্যাস্ত নগরীর বুকে। এই শহরে কোনকিছুর কমতি না থাকলেও সবুজ বনাঞ্চলের বড্ডই কমতি। তাই একটু বাতাসের অভাবে গরম আরও বেশি অসহনীয় মনে হয়। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে শেষে ধীর পায়ে রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওপাশে কামরানের গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই বরাবর এগিয়ে গেলাম। কিন্তু রাস্তার ওপাশে নজর পড়তেই আমার পায়ের নিচের মাটি টলে উঠলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছেনা। বোধহয় ভুল দেখছি। ড্রাইভিং সাইডে গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা খুব কাছে এই দিনে দুপুরে ভরা রাস্তার পাশে এভাবে নির্লজ্জের মত একটা মেয়ে একটা ছেলে এমন আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিল না। হ্যা ছেলেমেয়ে দুজন হলো কামরান আর পিউলি। রাস্তার পাশে তাও এই রোজার দিনে পিউলি কামরানকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। আমি হতবুদ্ধিভাব নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে আছি। কামরান আমাকে এভাবে ঠকালো? এই কদিনের ওর আচরণে আমি ভেবেছিলাম আমাদের বিয়েটা নিয়ে ও সিরিয়াস। কিন্তু এখন এসব কি দেখছি? যদিও আমাদের সম্পর্কটা আর দশটা দম্পতিদের মত স্বাভাবিক নয় তবুও ওর আচরণ আমার প্রতি সবসময় কেয়ারিং ছিল। কখনও এতটুকু খারাপ আচরণ করেনি। আমি ভেবেছিলাম হয়ত কামরান একটু বেশিই লাজুক এবং ইন্ট্রোভার্ট টাইপের। যত যাইহোক বিয়ে খুব ছোট্ট একটা শব্দ হলেও বিয়ে সম্পর্কটা অনেক ওজনদার। তানাহলে যুগযুগ ধরে বিয়ের মত পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কোটি কোটি মানুষ সুন্দর সাজানো সংসার বাধতে পারতো না। সামাজিক নিয়মে এবং ধর্মীয় মতে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা দুজন মানুষের কবুল পড়ানোর পরে হয়তো ঐশ্বরিক পরিকল্পনায় একটা শক্তপোক্ত অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়। সেই বাঁধনে ধিরে ধিরে মায়া মমতা সহানুভূতি, বন্ধুত্ব এরপর প্রেম তারপর ভালোবাসা গড়ে ওঠে বন্ধনটাকে আরও সুমিষ্ট করে তোলে। এইযে আমাদের বিয়েটা যেভাবে হুট করে হয়ে গেল আমার তো একদমই মত ছিলনা। অথচ কিভাবে কখন মানুষটা আমার হৃদয়পটে এভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে টেরই পাইনি। ভেবেছিলাম বোধহয় মানুষটির মনেও আমার জন্য একই রকম অনুভব আছে। কিন্তু আমার ভাবনা বোধহয় ভুল ছিল। এখন যে আমি সহ্য করতে পারছিনা এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা। আমার অজান্তেই বুনতে থাকা বাবুই পাখির মত ছোট্ট সাজানো সংসারটা তবে এখানেই তছনছ হয়ে যাবে? কিভাবে বাঁচব আ….। আচানক কিসের সাথে যেন প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর মাথা যন্ত্রণায় ঝিনঝিন করে উঠলো। দিন দুনিয়া ভুলে বেখেয়ালে, আনমনে চলতে চলতে আমি যে কখন রাস্তার মধ্যে চলে এসেছিলাম টেরই পাইনি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখ দুটো বুজে আসতে চাইছে। জোর করে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করছি। চারপাশে অনেক মানুষের হৈচৈএর শব্দ আমার বিরক্ত লাগছে। শরীরের যন্ত্রণা সাথে বুকের ভিতরের যন্ত্রণা সহ্য করে অনেক কষ্টে মাথা তুলে রাস্তার ওপাশে দেখার চেষ্টা করলাম। ঝাপসা চোখে দেখতে পাচ্ছি কামরান ছুটে এদিকেই আসছে। ওর পিছু পিছু পিউলি। কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। কেউ আমাকে তুলে ধরেও আছে। কষ্টেসৃষ্টে কোনরকমে সেদিকে ফিরতে দেখলাম সোমা উৎকন্ঠিত হয়ে কিছু বলছে। আমাকে ধরে দেখার চেষ্টা করছে বোধহয় আমার অবস্থা ঠিক কেমন? পুরুষ কন্ঠে হীবা ডাক শুনে নেতিয়ে পরতে পরতে সেদিকে তাকালাম। আমার মুখের উপর ঝুকে আছে কামরান। আমি আর চোখ মেলে থাকতে পারছিনা। চোখ দুটো বুজে আসতে আসতে টের পেলাম আমি শুন্যে ভাসছি। আমাকে পাঁজা কোল করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ও বারবার আমাকে চোখ বন্ধ করতে নিষেধ করছে। কিন্তু আমিতো পারছিনা চোখ মেলে তাকাতে। ধীরে ধীরে আমি যেন গভীর কোন খাদে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছি। আমার চোখের সামনে এবার নিকষকৃষ্ণ আঁধারের পর্দায় ছেয়ে গেল।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে