#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখা – মুনিরা সুলতানা
পর্ব – ১৭।
————*
কামরান থেকে দুরত্ব বজায় চলছি কদিন ধরে। যতক্ষণ সময় ও বাসায় থাকে আমি পারতো পক্ষে ওর ধারে কাছেও যাইনা। কেবল সংসারের প্রয়োজনে টুকরো টাকরা কথা যেগুলো না বললেই নয় শুধু ততটুকু কথাই বলতে হয়। এমনিতে কামরান সেইভাবে কাছাকাছি ছিলই বা কবে? সারাদিন বাইরে থাকে সন্ধ্যার পরেও কাজে কর্মে কিভাবে সময় পেরিয়ে যায় টেরই পাইনা। আমাদের নতুন বিবাহিত জীবন দেখে বোঝার উপায় নেই। মনে হয় বহু বছর ধরে সংসার করতে করতে অভ্যস্ত রুটিন মাফিক চলছে আমাদের জীবন। ওকে শাস্তি দেওয়ার উপায়ও বা কোথায়? তবে অবশেষে একটা উপায় আমি খুঁজে পেয়েছি। ভোর রাতে নামাজ পড়তে উঠার সময় নিজেকে প্রতিদিন কামরানের বাহুবন্ধনে আবিষ্কার করি। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ঘুমের ঘোরে বোধহয় আমরা এতো কাছে চলে আসি। বেশির ভাগ সময় ও অনেক রাত অবধি কাজ করে। ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পরি। একদিন তখনও আমি ঘুমাইনি। কামরান বোধহয় ভেবেছিল ঘুমিয়ে পরেছি। বিছানায় শুয়ে খুব সন্তর্পণে আলতো হাতে আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিল। আমি চমকিত, হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। কিন্তু বুঝতে দেয়নি যে আমি জেগে আছি। এরপরে আরও দুয়েক দিন ঘুমানোর ভান করে জেগে ছিলাম। একি কান্ড কামরানের। আমি বুঝতে পারছি না লুকিয়ে চরিয়ে আমার কাছে আসার মানেটা কি? আমি ওর বিবাহিতা স্ত্রী। অধিকার নিয়েই আমার কাছে আসতে পারে। এভাবে লুকোচুরি কেন করছে কিছুতেই ভেবে পাইনি। এইবার সুযোগ পেয়েছি ওর কর্মকাণ্ডের শাস্তি দিতে এবং লুকোচুরি করার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার। সেদিন রাতে শোবার আগে কাবার্ড থেকে এক্সট্রা বালিশ এনে আমাদের মাঝখানে দিয়ে শুয়েছিলাম। যথারীতি ঘুমানোর ভান ধরে ছিলাম। কামরান যখন শুতে এসেছিল মাঝে এমন বালিশের দেয়াল দেখে কতক্ষণ চুপচাপ বালিশের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। আমি ডিম লাইটের আবছা আলোয় হালকা চোখ মেলে ওর বোকার মতো চেহারা দেখে অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিলাম। কিছু সময় নিশ্চুপ রইল সে। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুয়ে পরেছিল। তবে সীমানা পার করেনি। তবে আমার বেশ লজ্জা করছিল এটা ভেবে যে এখন সে জানে আমি ওর লুকোচুরি ধরে ফেলে নিজেও লুকোচুরি করছিলাম।
এর মধ্যে তিয়ানার অর্ডার করা কাপড় গুলো হাতে পেয়ে দুজন গিয়ে সেগুলো দর্জিবাড়ি সেলাই করতে দিয়ে এসেছি। আমার দর্জির সেলাই একদম ভালো লাগে না। মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে। মনে মনে ভেবে রাখলাম। সুযোগ মত একটা সেলাই মেশিন কিনব। তখন আর দর্জিবাড়িতে সেলাই করতে হবে না।
আজ হঠাৎ কামরান বিকেলেই বাসায় ফিরেছে। আমি তখন আসরের নামাজ আদায় করছিলাম। নামাজ শেষে জায়নামাজ ঘুছিয়ে রাখছিলাম তখন কামরান বললো,
” আজ আমি ফ্রী আছি। চল তোমার মামার বাসা থেকে ঘুরে আসি। এই কদিন এতো ব্যাস্ত ছিলাম। নয়তো আরও আগেই যাওয়া উচিৎ ছিল। ”
ওর মাথায় এখনো মামার বাসায় যাওয়ার কথা আছে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তবে ওকে বুঝতে না দিয়ে বললাম, ” মাগরিবের নামাজ আদায় করে রেডি হই? বেশি দুরে নাতো। ”
” হ্যা শিওর। তোমার যেমন ইচ্ছে। ”
” আপনি এখন চা বা কফি কিছু খাবেন? আর অন্য কিছু খাবেন?”
” না এখন আর কিছু খাবনা শুধু কফি দাও।”
” আচ্ছা। ” বলে রুম থেকে বেরিয়ে এসে সোজা রান্নাঘরে গেলাম
সন্ধ্যার পরে ঝটপট রেডি হয়ে নিলাম। আজ আর শাড়ি পরিনাই। একটা এমব্রয়ডারি করা মেরুন রঙের সুতি সালোয়ার কামিজ পরলাম। চোখে গাঢ় করে কাজল দিলাম। সাজের মধ্যে এই কাজল পরতে আমার খুব ভালো লাগে। ঠোঁটে হালকা মভ কালারের লিপস্টিক পরলাম। মাথায় হিজাব পরে ওড়নাটা শালের মত করে দুপাশ থেকে সামনে ঝুলিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। কামরানকে দেখে আমি হতবাক। ও একটা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। একদম আমার সাথে ম্যাচিং। আমাকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও শুধালো,
” কি দেখছ ওভাবে? খারাপ দেখাচ্ছে? ”
আমি ঝটপট মাথা নেড়ে বললাম, ” নাহ্। খারাপ দেখাবে কেন? কিযে বলেন না।”
বের হওয়ার সময় তিয়ানাও টিপ্পনী কাটে, ” ওয়াও ভাবি ম্যাচিং ম্যাচিং! সুন্দর লাগছে দুজনকেই।”
আমি লাজুক হাসলাম কেবল। মামা মামি আমাদের দুজনকে একসাথে পেয়ে ভিষন খুশি হলো। কামরান প্রথমেই বলে উঠলো, ” আমি সত্যিই খুবই লজ্জিত সেদিন আসতে পরিনি বলে। এতো চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তবুও অনেক লেট করে ফেলেছিলাম। দুনিয়ার জ্যামও কেন যেন সেদিনই পরেছিল। এইযে আজ এলাম তবুও সেদিন না আসতে পারার আফসোস কোনদিন যাবেনা। সেদিনের জন্য সরি।”
কামরান কথাগুলো এমন ভাবে বলল মামা মামির দুজনকেই খুব বিব্রত দেখাচ্ছে। মামী হেসে বললেন,
” কি সরি সরি লাগিয়েছ। ভুলে যাও সব। মানুষের ব্যাস্ততা থাকতেই পারে। এইযে আজ সময় বের করে এসেছ। আমরা এতেই খুব খুশি হয়েছি। এসো বাবা নিজের বাসা মনে করে একদম ফ্রী হয়ে বসো। ”
মামাও খুব সযত্নে ওকে নিয়ে বসালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার সাথে বেশ আড্ডা জমিয়ে ফেললো। একসময় দেখি আমার মনের মেঘ কেটে গিয়ে সেখানে ভাললাগার ঝলমলে রোদ হেসে উঠেছে। সত্যি বলতে সেদিন এখানে এসেছিলাম ঠিকই। কিন্তু মনটাতো আমার এখানে ছিল না। আড্ডা, খাওয়া দাওয়া কোন কিছুতেই মন বসাতে পারনি সেদিন। কিন্তু আজকের শুধু মাত্র এই মানুষটার জন্য সম্পূর্ণ পরিবেশটা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। এই মানুষটা আমার মনের ভালো লাগা মন্দ লাগাকে এই ভাবে প্রভাবিত করতে পারে দেখে আমি যারপরনাই অবাক হলাম।
রাতে খাবার খেতে বসে তো আমার আরেক দফা অবাক হওয়ার পালা। আজও সেদিনের মতো আয়োজনে ডাইনিং টেবিল ভরা। আমার চেহারায় প্রশ্ন দেখে মামা নিজই বলে উঠলেন,
” কামরান বাবাজী সকালেই ফোন করে বলেছিল আজ তোকে নিয়ে আসবে। তুই জানতিস না মনে হচ্ছে। ”
কামরান হাসতে হাসতে বললো, ” না মামা ওকে আগে জানায়নি। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম ওকে। ”
মামি বললেন, ” বেশ করেছ। সেদিন হীবা ভালো করে খায়নি পর্যন্ত। যার জন্য সেদিন মন খারাপ ছিল আজ কিন্তু সে সাথে আছে। তাই আজ সেদিন এবং আজ মিলে ডাবল খেতে হবে বলে দিলাম।” পরের কথাটা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন মামি।
তামান্না উৎফুল্ল হয়ে বললো, ” সারপ্রাইজ কেমন লাগছে আপু? দুলাভাই বেশ হিউমার দেখছি। ”
আমি প্রথমত মামীর কথায় বিব্রতবোধ করছিলাম সেই সাথে লজ্জা ও অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। বেশ ভালো কাটলো সময়টা। আড্ডায় মুখরিত সময় কেটে যায় পলকে। বেশ রাত হয়ে গেল বাসায় ফিরতে।
রাত্রিবেলা রান্নাঘরের টুকটাক কাজ সেরে আমাদের কামরায় এলাম। রাত তখন বারোটা পেরিয়ে গেছে। টেবিল ল্যাম্পের নরম নীলচে আলো ছড়িয়ে সম্পূর্ণ কামরায় একটা রোমাঞ্চকর স্বর্গীয় আলো আঁধারির আবহ তৈরি করেছে। কামরার ভিতরে ভিষণ ঠান্ডা হওয়ায় গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। এসির দিকে তাকিয়ে দেখলাম টেম্পারেচার আঠারোয় দেয়া। কি অদ্ভুত লোকরে বাবা এতো ঠান্ডায় তার ঠান্ডা লাগছেনা? চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে হাতমুখ ধুয়ে এলাম। তখন বাসায় ফিরে কাপড় পাল্টে ওজু করে এশার নামাজ আদায় করে নিয়েছিলাম। তিয়ানাদের খাওয়া দাওয়া শেষে আসমাকে খাবার দিয়ে বিদায় দিয়েছিলাম। আয়নার সামনে বসে মুখে হাতে লোশন মাখলাম। চিরুনি হাতে নিয়ে চুল আচরাতে আচরাতে ঘুরে কামরানের দিকে ফিরে বললাম,
” শুনছেন? ”
” হু? ” কামরান ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই বললো।
” মাত্র কদিন আছে রোজা শুরু হতে। মা বলছিলেন রোজার জন্য দরকারি কেনাকাটা করে ফেলতে। ”
কামরান একপলক মুখ তুলে তাকালো আমার দিকে। তারপর আবার ল্যাপটপের দিকে ফিরে বললো, ” বেশতো কি কি কিনতে হবে সেগুলোর একটা লিষ্ট বানিয়ে ফেল। আমি কালকেই রুবেলকে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে যাব।”
” আপনি যাবেন? রুবেলকে পাঠালেই তো হয়।”
আবারও মুখ তুলে তাকিয়ে বললো সে,” কেন? আমি যেতে পারিনা? লন্ডনে থাকতে সব কাজ নিজের হাতেই করতে হত। আর তাছাড়া দাদা, আব্বা উনারাও বাজারে যেতেন। আব্বা চলে যাবার পর থেকে সবসময় না গেলেও মাঝে মধ্যেই যাই। কেন আমার যতে অসুবিধা কোথায়? ”
আমি একটু বিব্রতবোধ করতে লাগলাম। আসলে এত কাজের লোক থাকতে উনারা নিজেরাই বাজার সদাই করতে যাবে কেন যেন মাথায় আসেনি। ইতস্ততভাবে বললাম,
” না আসলে আপনাদের তো অনেক কাজের লোক আছে। তাই ভেবেছিলাম ওরাই এসব করে। কাঁচাবাজারে ওদেরকেই পাঠানো হয় কিনা। ”
” সেতো আমি সময় না পেলে ওঁরাই যায়। বিশেষ করে কাঁচাবাজারে। আর পরিচিত যায়গা থেকেই কেনাকাটা করা হয়। শুধু লিষ্টটা পাঠিয়ে দিলেই হয়। ”
” আচ্ছা বুঝলাম। ”
চুল আচরানো শেষে চুলগুলো উচু করে ধরে হাতখোপা করে নিলাম। একটা রাবার ব্যান্ড আটকে উঠে দাঁড়ালাম। বিছানার দিকে যেতে গিয়ে আবার কামরানের দিকে ফিরে বললাম,
” অনেক রাত হয়েছে। এখনো কাজ করছেন। ঘুমাবেন না?”
” তুমি ঘুমিয়ে পড়। একটু কাজ বাকি সেটা সেরেই আসছি।”
আর কিছু না বলে আমি বিছানার একপাশে শুয়ে পরলাম। কম্বলটা টেনে নিয়ে গায়ে দিলাম। শুয়ে শুয়ে সেলফোনে চোখ বুলাতে বুলাতে মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে দেখছি। ওর সেলফোনে বারবার টুংটাং শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ম্যাসেজ আসছে কারও। তারমানে নিশ্চয়ই কারও সাথে চ্যাট করছে। এই ওর কাজ করা হচ্ছে? মাঝরাতে চ্যাট করছে। রাগে আমার গা জ্বলে উঠলো। আর দশটা দম্পতির মত স্বভাবিক সম্পর্ক হলে তৎক্ষনাৎ কৈফিয়ত চাইতে পারতাম। কিন্তু এখন সেটাও সম্ভব হয়না। নিজেকে বোঝাতে চাইলাম। হয়তো কোন বন্ধু হবে। নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ভালো লাগছেনা। সেলফোন রেখে চোখ দুটো বুজে ফেললাম। একটু বাদেই টের পেলাম আমার গা থেকে সরে যাওয়া কম্বলটা টেনে গলা অবধি টেনে দিচ্ছে। তারপর এসিটাও বাড়িয়ে দিয়ে কামরান ওয়াশরুমে গেল। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকালাম। মানুষটার এইসব ছোট ছোট কেয়ার গুলোর কারনেই তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। দিনকে দিন প্রেমের চোরাবালিতে আরোও বেশি করে ডুবে যাচ্ছি। হঠাৎ টুং করে শব্দ হতেই তাকিয়ে দেখি বালিশের পাশে ওর সেলফোন রাখা। স্ক্রিনের আলো জ্বলছে। কৌতুহল দমাতে না পেরে খুব সন্তপর্ণে সেলফোনটা হাতে তুলে নিলাম। একবার ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম একটা ম্যাসেজ ভেসে আছে। সেখানে লেখা, ‘ তুমি লন্ডনে যাবা আগে বলবা তো। দেখো আমাদেরও যাওয়ার কথা সামনে। একসাথে যেতে পারত…’ হঠাৎ দরজায় শব্দ হতেই প্রায় ঝট করে স্ক্রিন অফ করে ফোনটা রেখে দিলাম। চটপট শুয়ে কম্বল মুড়ি দিলাম। বুকের মাঝে মনে হচ্ছে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে। ধরাস ধরাস করে হৃদপিণ্ড যেন লাফাচ্ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট লাগছে। চুড়ি করতে গিয়ে ধরা পরতে গিয়েও কোন রকমে বেঁচে গেছে ঠিক সেরকম অনুভুতি হচ্ছে। কিন্তু কামরান লন্ডন যাবে? কই আমাকে একবারো বললোনাতো? টেবিল ল্যাম্প বন্ধ করে কামরান বিছানায় এসে বসেছে বোধহয়। পাশেই ওর নড়াচড়ার খসখসানি শব্দ পাচ্ছি। হঠাৎ কম্বলে টান পড়তে আমি সচকিত হয়ে দেখি তাড়াহুড়ায় সম্পূর্ণ কম্বলটাই পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুড়িয়ে শুয়ে আছি আমি। কি আর করার! মুখের ওপর থেকে কম্বল নামিয়ে ঘুম ভেঙে যাবার ভান করলাম। ঠিক ঠাক করে গায়ে দিয়ে কম্বলের একপাশে ছেড়ে দিলাম। কামরান শুয়ে পরেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
” সরি তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম বোধহয়। ”
আমি বিচলিত গলায় বললাম, ” ঘুম আগেই ভেঙে গেছিল। টুংটাং শব্দে। ”
” ওহ সরি, আসলে দেখনা কাজ করছিলাম৷ অথচ এর মধ্যে পিউ বারবার ম্যাসেজ দিচ্ছিল। ”
ও আচ্ছা তাহলে ওটা পিউলি আপু ছিল। এতো রাতে ঐ শাঁকচুন্নি পিউলির সাথে এতো কিসের কথা? রাগে দুঃখে আমার চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। কিন্তু না এখন কাঁদলে চলবেনা। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
” অফিসের কাজ অফিসেই সেরে আসতে পারেননা? বাসায় এসে রিল্যাক্স করা উচিত। ”
কামরান হেসে উঠে বললো,” ঠিক অফিসের কাজ নয়। আমি এই মাসের শেষে লন্ডন যাচ্ছি। সেমিনার প্লাশ এক্সিভিশন আছে। সেই বিষয় কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিলাম।”
” রোজার মধ্যে যাবেন? কতদিন থাকবেন? ”
” সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই ফিরব। কি করব বল রোজার মধ্যেই পরে গেছে সময়টা। প্রবলেম নেই। অনেকগুলো বছর তো ঐ দেশেই থেকেছি। নিজের মত ম্যানেজ করে নেয়ার অভ্যেস আছে। ”
” ওহ্। ”
আর কি বলব শব্দ হাতরে কিছু বলার মত পেলামনা। মনটাও খারাপ হয়ে গেল। ঐ কটাদিন মানুষটাকে দেখতে পাবোনা। পিউলি ম্যাসেজে সাথে যাওয়া নিয়ে কিছু লিখেছিল। কামরান আর মোবাইল খুলে দেখেনি। চোখ মেলে দেখি কামরান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত আমার মন খারাপ ভাব ধরতে পেরেই বলে উঠলো,
” কি হলো চুপ হয়ে গেলে যে? যখন এখানে থাকব না আমাকে মিস করবে? ”
আমি চমকে উঠলাম। ওর দিকে তাকাতেই ডিম লাইটের আবছা আলোয় ওর চোখে চোখ পরে গেল। লাজুক হাসলাম। আমি নিশ্চিত আমার গালদুটোয় লালিমা ছোপ পরেছে। ভাগ্যিস আলোর স্বল্পতায় দেখা যাচ্ছে না। কোন রকমে বললাম,
” কি জানি? আপনি তো এমনিতেই সারাদিন বাসায় থাকেননা। ”
” এইযে এখন আছি। তখন রাতের বেলায় একা শুতে ভয় পাবেনা?”
” জিনা জনাব আমি এতো ভিতু নই। আমার একা থাকার অভ্যেস আছে। তবে খালি খালি লাগবে। ”
কামরান স্বশব্দে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বললো, ” ওটাই মিস করা বোকা মেয়ে। ”
আমারও খেয়াল হল আসলেই বোকার মতো কথা বলে ফেলেছি। লজ্জায় এখন কি বলি? কোনমতে বললাম,
” ধ্যাৎ, রাত অনেক হয়েছে। ঘুৃমানতো। তারপর মনে হতে শুধালাম, ” সাথে আর কেউ যাবে? ”
” নাহ্। একাই যাবো। হঠাৎ যেতে হচ্ছে বলে নয়তো তোমাকে নিয়ে যেতাম। নেক্সট টাইম বাইরে কোথাও গেলে তোমাকে সাথে নিয়ে যাবো। তোমার পাসপোর্ট করা আছে?”
পরেরবার আমাকে সাথে নিয়ে যাবে শুনে মনটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। তবে সেটা প্রকাশ না করে বললাম, ” নাহ্ কখনও বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তো। তাই পাসপোর্ট করাও হয়নি। ”
” নো প্রবলেম। দেশে ফিরে তোমার পাসপোর্ট করার ব্যাবস্থা করবো। ”
” সত্যিই আমাকে সাথে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাবেন? ”
” মানুষ তার ফ্যামিলিকে সাথে নিয়েই তো বেড়াতে যায় তাইনা। আর তুমি আমার ওয়াইফ, আমার ফ্যামিলি। এতে অবাক হওয়ার কি আছে?”
” তাহলে আপনার কাছে আমার আবদার পাসপোর্ট হয়ে গেলে সবার আগে আমাকে ওমরাহ করতে নিয়ে যাবেন। ”
কামরান হেসে বললো, ” তুমি চাইলে তোমাকে মেইন হজ্জেও নিয়ে যাবো। তবে তার জন্য একটু ওয়েট করতে হবে। আপাতত ওমরাহ করতে নিয়ে যাবো। আমাদের বিদেশ ভ্রমণ তাহলে প্রথমে ওমরাহ দিয়েই শুরু হবে। ”
আমার মুখেও হাসি ফুটে উঠল, ” ইনশাআল্লাহ একসময় মেইন হজ্জও করা হবে। আগে ওমরাহ করতে পারলেই আমি খুশি। অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমান।”
বলেই কম্বল মুড়ি দিয়ে চোখ বুঝলাম। কিন্তু কামরান কেমন উসখুস করছে। আমি ওর দিকে চোখ মেলে তাকাতে দেখি সে এখনো আমার দিকে তাকিয়েই আছে। ইতস্ততভাবে বললো,
” তুমি আমার উপর এখন আর রেগে নেই তো?”
কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমাদের মাঝে রাখা বালিশটাও আজ রাখিনি। স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলছি। তাও জিজ্ঞেস করছে? আমি মুখে কিছু না বলে মুচকি হেঁসে কেবল ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়লাম।
” আজ মাঝখানে বালিশ নেই যখন তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে দেবে?”
চমকে উঠলাম কামরানের কথা শুনে। সত্যি ও আজ লুকোচুরি না করে সরাসরি জড়িয়ে ধরার অনুমতি চাইছে? কিন্তু বিয়ে করা বউয়ের কাছে আসতে এত লুকোচুরি কেন, অনুমতি চাওয়াও কেন? লোকটা কি অতিমাত্রায় লাজুক? কথাতো স্বাভাবিক ভাবেই বলে। তাহলে এতো সংকোচ কেন? একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাম। লজ্জাও লাগছে। কি বলবো এখন। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি? এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে স্তিমিত স্বরে বললাম,
” এতোদিন যখন অনুমতি চাননি আজ চাইছেন কেন?”
কামরানের দৃষ্টিতে বিচলিত ভাব দেখা গেল। ধরা পরে যাওয়ায় বিব্রতবোধ করছে বোধহয়। লাজুক হাসি ছুঁয়ে গেল ওর ঠোঁটে। বলল,
” সরি। আসলে.. ”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ” আমি আপনার বউ। পারমিশন নিয়ে জড়িয়ে ধরতে হবেনা। নিজের অধিকারেই জড়িয়ে ধরতে পারেন। ”
লাজ শরমের মাথা খেয়ে কিভাবে যে কথাটা বললাম সে কেবলমাত্র আমিই জানি। বুকের ভিতর ধুকপুক করছে। সামান্য জড়িয়ে ধরতে চাইছে তাতেই আমার শরীরে অদ্ভুত কাঁপন টের পাচ্ছি। কামরান আস্তে করে আমার কাছে সরে এলো। আলতো হাতে আমাকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরতেই সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। ও আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
” গুডনাইট।”
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। আজ প্রথম সচেতন থেকে ওর এতো কাছে এসে কেমন অসার হয়ে গেছি। কেবল নিশ্চুপ থেকে কামরানের বুকে মুখ গুজে ওর অস্থির হৃদযন্ত্রের ধুকপুক শব্দ কান পেতে শুনতে শুনতে ঘুমানোর চেষ্টা করছি।
চলবে ইনশাআল্লাহ।