তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-১৫

0
934

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখাঃ – মুনিরা সুলতানা।
পর্বঃ – ১৫।

—————–*
রাত প্রায় এগারোটায় আমরা মামাদের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কামরানের অপেক্ষায় থেকে এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। মন মেজাজ খারাপ থাকায় সবকিছু মিলে মামাদের মুখোমুখি থাকতে ভিষণ সংকোচ ও বিব্রতকর লাগছিলো। আর শরীরটাও খারাপ লাগছে। ফাগুনের শেষে গরমটাও যেন জেকে বসেছে। এইসব ভারী শাড়ি গহনা এখন অসহ্যকর মনে হচ্ছে। আসলে মনের সাথে শরীরের একটা যোগসূত্র থাকে বোধহয়। তাই মন খারাপের হাত ধরে শরীর খারাপও শরীরটাকে আরও ক্লান্ত ও অবসন্ন করে তোলে। তার মধ্যে আবার আমার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। গরম ও টেনশনে মাথাটাও টনটন করছে।
গাড়িতে উঠে বসেছি। পিছনে আমি একা দেখে তিয়ানাও এসে আমার সাথে বসল। গাড়ি স্টার্ট দিবে ঠিক ঐ মুহুর্তে আরমানের সেলফোন বেজে উঠল। আমি জানি কামরান ফোন করেছে। একটু আগেই বের হওয়ার সময় আমার কাছেই কল দিয়েছিল। আমি ধরিনি। সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছি। এতো রাতে কল করার আর কোন দরকার আছে। আসছে কল করতে। আরমানের কথা শুনে সেদিকে মনযোগ দিলাম। আরমান বলছে,

” ভাইয়া তোমার কান্ডকারখানা দেখে না আমি জাস্ট ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এই তোমার দায়িত্ব বোধ? ”

ওপাশে কি বললো জানিনা। আরমান আবারও বললো,
” এসব কথা বলে এখন কি লাভ বল? আজ শুক্রবার তুৃমিতো সবসময় এইদিন বাড়িতেই থাকো। অথচ আজ ভাবির বাড়ির দিকের রিলেটিভের বাসায় প্রথম ইনভিটেশন ছিল। সেটা জেনেও কেন গেলে বল তে? ভাবিকে সেই সাথে আমাদেরও কতটা লজ্জায় পরতে হয়েছে কোন ধারণা আছে তোমার?”

আবারও চুপ থেকে ওপাশের কথা শুনে বললো, ” আমরা এখন অন দা ওয়ে। বাসায় গিয়ে কথা বলি? রাখছি।”

কল কেটে গাড়ি স্টার্ট দিল আরমান। গলি রাস্তা থেকে মেইন রাস্তায় উঠে আসলো। আমি আর কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,

” তোমার ভাই কি আজ ফিরবে নাকি ওখানেই থাকবে? ”

আরমান এক পলক ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে আবার ড্রাইভিংএ মনযোগ দিয়ে বললো, ” জানিনা। ভাইয়া জিজ্ঞেস করছিল আমরা এখন কোথায়? জানিয়ে দিলাম বাসায় ফিরছি। বাসায় ফিরে কথা হবে। ”

আমি আর কিছু বললাম না। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা তীব্র আকার ধারণা করছে। মাথাটা সিটে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঝলাম। তিয়ানা বললো,

” ভাইয়ের কাছে এমনটা আশা করিনাই। যদি বিজনেস রিলেটেড কিছু হত তাও মানা যেত। কিন্তু পিউলি আপুকে বুঝিয়ে আজকের দিনটা ক্যানসেল করতে পারতো না? চাইলেই করতে পারতো। ”

আমার এসব কথা আর ভালো লাগছে না। সব কিছুই কেমন বিরক্তিকর লাগছে। তাই সংক্ষেপে বললাম, ” ছাড়না এসব কথা। হয়তো কোন কারণ আছে তোমার ভাইয়ের কাছে। সেটা সেই বলতে পারবে। তাই না? বাদ দাও।”

তিয়ানা আর কথা বাড়ালো না। বাকি রাস্তা আর কেউ কোন কথা বলল না। আসলে সবাই মন মেজাজ ঘেটে আছে। আজকের দিনটা আনন্দমুখর হতে পারত অথচ একটা মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সবকিছু কেমন বিরক্তিকর হয়ে উঠলো। এখন মনে হচ্ছে ফিরে এসে কি ভুল করলাম? আমাকে মনে হয় সবকিছু নতুন করে ভাবতে হবে। রাতের রাস্তা অনেকটাই খালি থাকাই বেশ দ্রুতই বাসায় পৌঁছে গেলাম। বাসায় ঢুকে আমি তিয়ানাকে বললাম,

” আমার মাইগ্রেনের ব্যাথা শুরু হয়েছে। তোমার ভাইয়া যদি আসে আর রাতের খাবার খায়, তুমি প্লিজ খাবার গুলো একটু গরম করে দিতে পারবে? ফ্রিজে সব আছে। ”

” তুমি একদম টেনশন করো নাতো। আমি তো রাতে পড়তে বসব। জানোইতো এই কয়দিনে পড়াশোনায় অনেক গ্যাপ পরে গেছে। তাই রাত জেগে পড়তে হবে। তুমি বরং মাথা ব্যাথার ঔষধ খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। ভাইয়া এলে আমি সামলে নেব। তুমি যাও রাত না জেগে শুয়ে পর। ”

আমি স্মিত হেসে বললাম, ” থ্যান্কিউ ননদিনী। ”

তিয়ানাও মিষ্টি হেসে বললো, ” মাই প্লেজার ভাবিজান। ”

মাইগ্রেনের ঔষধ খেয়ে দ্রুত গতিতে শাড়ি পাল্টে একটা ঢোলা ঢিলা কুর্তি ও পালাজো পরে নিলাম। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একেবারে অজু করে এসে এশার নামাজ আদায় করে নিয়ে সোজা লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরলাম। মাথাটা আর খাড়া করে রাখতে পারছিনা। আলোও ভিষণ অসহ্য লাগছে। ঘুমাতে চেষ্টা করছি ঠিক সেই সময় ডিম লাইটের আবছা আলোয় কামরায় কাউকে ঢুকতে দেখলাম। পারফিউমের মিষ্টি সুবাসে বুঝতে পারছি কামরান এসেছে। অভিমানে চোখ দুটো বুজে ঘুমানের ভান করে ঘাপটি মেরে পরে রইলাম। সেই তো বাসায় ফিরে এসেছে। তাহলে আরেকটু আগে এলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত। একটা নতুন জীবন শুরু করেছি দুজনে মিলে। দুজনকেই সমান ইফোর্ট দিতে হবে যদি সংসারটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে হয়। কিন্তু কামরানের কাছে আমি কিংবা আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এদের কোন মুল্য আছে বলে মনে হচ্ছে না। সত্যি বলতে আমারই মুল্য আছে কি তার কাছে? ঘরের বউ মানছি নতুন বউ তবুও তার থেকে তার কাজিনের সম্মান রক্ষা করা বেশি জরুরি বলে মনে হয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসছে টের পেয়ে সেটাকে চেপে গেলাম। কামরান বোধহয় বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কি করছে দাঁড়িয়ে?মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ থাকলেও কেউ আশেপাশে থাকলে বা আমাদের দিকে চেয়ে থাকলে সেটা টের পাওয়া যায়। আমি একদম নিশ্চুপ শুয়ে আছি। একটু পরেই শব্দ পেলাম ওয়ালকাবার্ড খুলছে চোখ মেলে দেখলাম কাপড় বের করেছে। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে গেল সে। আমিও ঠিকঠাক হয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

————*
কামরার ভিতরে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ হাটাহাটি খসখসে আওয়াজে আমার ঘুম হালকা হয়ে গেল। কিন্তু চোখ দুটোতে যেন জন্মের ঘুম জড়িয়ে আছে। চোখের পাতা এতো ভারি লাগছে কেন? কিছুতেই চোখ মেলে তাকাতে পারছিনা। কয়টা বাজে এখন। ভোরবেলায় ফজরের নামাজ আদায় করে আবার শুয়েছিলাম। মাথাটা এখনও ভার হয়ে আছে। বোধহয় ঔষধধের প্রভাবে এমন হচ্ছে। অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকালাম। পাশে কামরান নেই। ও উঠে পরেছে। হায় আল্লাহ কয়টা বাজে? আমি ধরফর করে উঠে বসলাম। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সারে আটটা বাজে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আজ শনিবার। কেউ এত জলদি উঠবে না। কামরানও আস্তে ধীরে অফিসে যায়। আমারও খুব সকালে উঠে পরার অভ্যাস নেই। আমিও রাত জেগে পড়াশোনা করতাম। এছাড়াও সেলফোনেও আজাইরা সময় নষ্ট করেও রাতজাগা হত অযথা। কেবল সকালে ক্লাস থাকলে এলার্ম দিয়ে রাখতাম। এটা শশুর বাড়ি এখানে এত বেলা অব্দি বাড়ির বউ পরে পরে ঘুমাবে সেটা নিশ্চয়ই ভালো দেখায়না। তাই এখানে আসার পর থেকে এলার্ম দিয়ে রাখি। কারন সকালে আসমা আসে নাস্তা বানাতে। আজও বোধহয় কলিং বেলের শব্দে কামরানের ঘুমটা ভেঙে গেছে নিশ্চয়ই। ঔষধের প্রভাবে আমি টেরই পাইনি। বিছানা ছেড়ে নেমে এসে চুলগুলো ঠিক করে হাত খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে এসে বেলকনির দরজা খুলে দিলাম। বাথরুম থেকে পানি পরার শব্দে বুঝলাম ও ওয়াশরুমে আছে। জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে জানালাও খুলে দিলাম সকালের ঝলমলে আলো ও বাতাসে ঘরের গুমোট ভাব কেটে গেল। আমি ডাইনিংয়ে এসে কমোন ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে সোজা রান্নাঘরে গেলাম। আসমা রুটি বেলছিল। আমিও গিয়ে ওর সাথে হাত লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই কামরান টেবিলে এসে বসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম পেপার পড়ছে সে। আসমাকে দিয়ে রুটি, ডিম পোঁচ, সব্জি ভাজি পাঠিয়ে দিলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম কামরান বলছে,

” তোর ভাবি কোথায়? ”

” পাকের ঘরে। ” জবাবে বললো আসমা।

” ওকে পাঠিয়ে দে। আর হ্যা ব্লাক কফি দিয়ে যা। ”

” জ্বী ভাইজান, অহনি পাঠাইতাছি।”

আসমাকে আসতে দেখে আমি দ্রুত গতিতে ভিতরে চলে এলাম। কফির পানি ফুটে গেছে। একটা মগে কফি গুঁড়ো নিয়ে ফুটন্ত পানি ঢেলে নেড়ে মিশিয়ে নিলাম। কামরান সকালে কফি খেলে ব্লাক কফিই খাই। কিভাবে এই তোতো জিনিস খায় আল্লাহই জানে। আসমা এসেই বললো,

” ভাবি আপনারে ডাকে ভাইজান। ”

” হ্যা যাচ্ছি। কফি হয়ে গেছে। একেবারে নিয়ে যাই।”

কফি মগ তুলে নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়ালাম। মনের জমিনে অভিমান জমে আছে। সেই সাথে কিছু সন্দেহ জনিত অবিশ্বাস। সত্যি বলতে মানুষটার সাথে আমার একদমই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমাদের সম্পর্কে তেমন গভীরতাও নেই যার প্রেক্ষিতে অধিকার নিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কৈফিয়ত চাইবো। বরং সেটা আমার কাছে হ্যাংলামী মনে হচ্ছে। তাই নিরবতা পালন করাই এই মুহুর্তে শ্রেয় মনে হচ্ছে। কামরানের সামনে টেবিলের উপর মগটা রেখে সরে আসতে নিতেই কামরান বললো,

” তোমার চা কই? আর ব্রেকফাস্ট করলেনা? ”

” হ্যা খাব। তিয়ানা উঠুক একবারে ব্রেকফাস্ট করে তারপর চা খাব।”

” এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে খাকা ঠিক না। গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম হতে পারে। এখুনি বসে খেয়ে নাও আগে।”

কথা শেষ করে রুটি ভাজি মুখে দিল ও।

আমি বললাম, ” বললামতো পরে খাব আমার এখন খিদে নেই। ”

বলেই ঘুরে দাঁড়াতেই কামরান বললো, ” যাচ্ছ কেন। বসো এখানে। কথা আছে।”

অগত্যা আমিও কথা না বাড়িয়ে বসলাম। ও একটা প্লেটে রুটি এবং একটু ভাজি তুলে আমার সামনে রাখলো। আমি ভ্রুকুটি করে এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে তারপর প্লেটের দিকে তাকালাম। এখন এতো কেয়ার না করে লোক দেখানোর জন্য হলেও যদি গতকাল মামার বাসায় আসত সেটাই আমাকে বেশি খুশি করত। তাও একবার সরি বললেও তো হয়। কিন্তু আমার মনের মধ্যে যে সন্দেহের বিজ বপন হয়েছে সেটা কেবল একটা সরিতে যাবেনা।

” হীবা.. সরি। ”

কামরানের কথা শুনে চমকিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম বিস্ময়কর কন্ঠে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ” জ্বি? ”

ও আবারও ইতস্ততভাবে বললো, ” আএম রিয়েলি সরি কাল রাতের জন্য। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সময়মতো পৌঁছাতে পারিনাই। এমনিতেই একটু দেরী হয়েছিল রওনা দিতে আর কাল রাতেই কেন জানিনা এতো বেশি জ্যামও পরেছিল। এমনটা হবে আমি ভাবতেই পারিনাই। আমি কথা দিয়ে কথা রাখিনি এমনটা কখনো হয়নি। অথচ গতরাতে কথা রাখতে পারলাম না। এটা সত্যি আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। ”

” এত লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই তো। আর কৈফিয়ত চেয়েছি আমি? আপনার কাছে প্রায়োরিটি যেটা সেখানে কথা দিয়ে কথা রাখাটা ইম্পর্টেন্ট এবং আপনি সেটা রেখেছেন। যার তার ক্ষেত্রে কথা রাখাটা জরুরি নয়। পার্সন বাই পার্সন ম্যাটার করে কে আপনার প্রায়োরিটি। ”

কথাগুলো বলতে গিয়ে গলাটা ধরে আসায় কাঁপছে। এই কথাগুলো আমি বলতে চাইনি। তবুও হ্যাংলার মত এগুলোই মুখ ফোসকে বেরিয়ে গেল। এখন রিতিমত লজ্জাই লাগছে। মাথা নিচু করে খাবার নাড়াচাড়া করে যাচ্ছি। আমি না তাকিয়েও বুঝতে পারছি কামরান অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু সময় নিরবে কেটে গেল। ও মন দিয়ে কফি পান করল। তারপর ও আবার মুখ খুলল,

” তুমি ঠিক কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না। প্রায়োরিটির কথা আসছে কোথা থেকে? আমি জানতামই না ওদের ফটোস্যুটের জন্য গাজীপুরের একটা রিসোর্ট বুক করা হয়েছে। প্রথমে জায়গার কথা জানায়নি। পরে আমি নিজেই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। তবুও আমি ভেবেছিলাম বিকেলের মধ্যে কাজ সেরে রওনা দিব। কিন্তু সন্ধার আলো আধারেও স্যুট করতে হবে বলে থাকতে হলো। তারপর স্পেশাল খাবারের আয়োজন করেছে আমারই জন্য। বারবার রিকোয়েস্টের পর ফেলতেও পারলাম না। তাড়হুড়ো করে কোনরকমে খেয়েই রওনা দিয়েছি। ওরা রাতে ওখানেই থেকে গেছে। কিন্তু আমি চলে এসেছি। তাও রাস্তায় এতো জ্যাম পারলামইনা টাইমলি আসতে। ”

লল্বা কথা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কামরান। আমি মনে মনে ভাবছি, ‘ কত তাড়াহুড়ো করেছে সেটা ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কে আসতে বলেছে? ওদের সাথেই থেকে যেত। সব কথা ভুলে গেলেও সেই ছবিগুলো মাথা থেকে কিছুতেই বের করতে পারছিনা।

” দুপুরে খাবার আয়োজন ছিলোনা? ”

” হ্যা ছিল। কাজের চাপে প্রায় বিকেলে হালকা খেয়েছিলাম।”

” তাহলে রাতের খাবার খাওয়াটাকি জরুরি ছিল? আপনি ফ্যামিলি প্রোগ্রাম ছিল বলেননাই?”

” আসলে পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে মানুষের কাছে বলাটা ভালো লাগেনা। তাই… ”

আমি তাচ্ছিল্য হেঁসে বললাম, ” সেই, আমি কে আপনার যে আমার সাথে জড়িত কেনো কিছু আপনার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট হতে যাবে? ব্যাপার না। ভুলো যান। ওখানে আপনার দুই বেলা খাওয়া বেশী জরুরী ছিলো কিন্তু সেখানে আমার আত্মীয় বাড়িতে আসাটাই অহেতুক সময় নষ্ট ছিল তাই না? এখন নিশ্চয়ই আফসোস হচ্ছে রাতে কেন থেকে গেলেন না? তাইনা?”

কামরান হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। কিছু সময় নিশ্চুপ রইল তারপর বললো, ” হীবা দেখ, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ? আমি ভেবেছিলাম সময় মত পৌঁছে যাবো। যেই সময় রওনা দিয়েছিলাম স্বাভাবিক ভাবে টাইমলি পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু কাল একটু বেশিই জ্যাম ছিল। তুমি কিসব বলে যাচ্ছ বলতো। তুমি আমার বউ। অবশ্যই তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট অংশ, লাইফ পার্টনার। প্লিজ এতো রাগ করোনা। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। কথা দিচ্ছি এরপরে আর কখনও এমন হবেনা। ”

আমি ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেললাম। বললাম, ” বাদ দেন তো। যা হয়ে গেছে সেটা কি আর বদলানো যায়? সো যা হওয়ার হয়ে গেছে। সব ভুলে যান। অযথা একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন মানেই হয়না। ”

” সামান্য ব্যাপার হলে তুমি এতো রেগে আছ কেন? আগে তুমি মন থেকে আমার সরি এক্সেপ্ট কর। আমাকে ক্ষমা করে দাও। ”

‘ আচ্ছা নাছোড়বান্দা তো। একটা বিষয় মাথায় ঢুকলে সহজে বেরোয় না দেখছি। আমি জানি কামরান ইচ্ছেকৃত কিছু করেনি। আর পিউলি যে এগুলো ইচ্ছে করেই করেছে সেটাও ভালো করে বুঝতে পারছি। সেদিন ওর পেজে আমাকে এড করেছে নিশ্চিত এই কারনেই। তবুও কামরানের উপর রাগ হচ্ছে খুব। জেনেশুনে না করলেও দোষ ওর একদম নেই তাও নয়। তাই একই ভুল আবারও যাতে না করে সেই জন্য এটুকু শক্ত হতেই হবে। গোপনে নিশ্বাস ফেলে বললাম,

” আমি জানি আপনি ব্যাস্ত মানুষ। অবুঝের মতো অহেতুক মনে রাগ অভিমান পুষে রাখিনা আমি। আর তাছাড়া আপনিতো ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করেননি তাইনা? তবুও আপনি চাইলেই রাতের খাবার আগেই চলে আসতে পারতেন। এখানে তো ডিনারের জন্য ইনভিটিশন ছিল। তাহলে কোন যুক্তিতে ওখানে খেয়ে আসেন। এটাই আমি মানতে পারছিনা। আপনার যদি সত্যি আমাদের সাথে জয়েন হওয়ার ইচ্ছে থাকতো তাহলে অবশ্যই কাজ শেষ করেই রওনা দিতেন। কিন্তু আপনি তা করেননি। আর মামাকে যাব কিনা বলার আগে আপনার সাথে কথা বলতে বলেছি। যাতে আপনি সিচুয়েশন বুঝে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তখন কেন বললেন না। আমরা পরে অন্য কোন দিন যেতে পারতাম। তাই আমি সরি ব্যাপারটা আমার জন্য ভোলা এত সহজ নয়।”

কামরান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমার পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে তিয়ানা বলে উঠলো, ” আমিও ভাবির কথায় একমত। কাল তুমি যা করেছ একদম ঠিক করনি। ভাবির আত্মীয়ের বাসায় আমাদের এভাবে মাথা হেট না করলেও পারতো।”

আরমারনও এসে বসেছে ততক্ষণে। হাত বাড়িয়ে নিজেই খাবার তুলে নিয়ে খেতেও শুরু করে দিয়েছে।

কামরান আহত গলায় বললো, ” তোরাও বুঝতে চাইছিস না? কিভাবে বোঝাই বলতো জ্যাম না থাকলে ঠিকই চলে আসতাম সময়মতো। ”

আরমান ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠলো, ” তুমি ছোট বাচ্চা নয় যে বোকার মত কথা বলছ ভাইয়া। জন্ম থেকে ঢাকা শহরে বাস করছ এই শহরে প্রতিটি মানুষ জ্যামকে মাথায় রেখে সময় নিয়ে রাস্তায় বের হয়। কিন্তু তুমি তো রওনাই দিয়েছ দেরি করে। আমাদের আকডুম বাগডুম বোঝাতে এসো না। ”

” ঠিক আছে মানছি তো ভুল হয়ে গেছে। এখন কি করলে তোরা আমাকে এই অপরাধ বোধ থেকে রেহাই দিবি। ”

কেউ কিছু না বলে নিরবে খেতো লাগলো। কামরানই আবার বললো, ” ঠিক আছে আমি ঝামেল পাকিয়েছি আমিই ঠিক করবো। সমনে রোজা শুরুর আগেই আমি হীবাকে নিয়ে ওর মামার বাসায় নিজে গিয়ে মাফ চেয়ে আসবো।”

আরমান বললো, ” বেশ এটাই তোমার করা উচিত। ”

আমি আর কিছু বললাম না। চুপচাপ বসে আছি। কামরান নিরবে খাওয়া শেষ করে উঠলো। ও রুম থেকে চলে যেতেই আরমান আমার উদ্দেশ্যে বলল, ” শোন ভাবি নিজেকে শক্ত রাখবে নইলে ভুল করে এসে তোমার মাথায় উঠে নাচবে। তাই কোন মতেে কোনকিছুতে এতটুকু ছাড় দিবেনা। জীবনের নিজের মতামতগুলো শক্ত ভাবেই উপস্থাপন করতে হয় এবং সেটা একদম গোড়া থেকেই করতে হয়। নইলে জীবনের কিছু কিছু ভুলগুলো এমন ভাবে সময় অসময় গলা চে*পে ধরে তখন হাসফাস করা ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা। ”

আমি ভ্রুকুটি করে আরমানের দিকে তাকিয়ে ওর কথার ভাবার্থ বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু ওর কোন বিকার নেই। আপন মনে নাস্তা খেয়ে যাচ্ছে সে। একটা প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে