তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-১০

0
982

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখা – মুনিরা সুলতানা।
পর্ব – ১০।

—————–*
তিলোত্তমা নগরীর বুকে সদ্যই সন্ধ্যা নেমেছে। সূর্যালোকিত দিনের সমাপ্তি ঘটেছে একটু আগেই। ব্যাস্ত শহরের রাস্তায় হাজারও গাড়ি রিকশার ভিড়ে আমাদের মার্সিডিজ বেঞ্জের সাদা গাড়িটা একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে। আবার কোন কোন রাস্তায় ফাঁকা পেলে গতি বাড়িয়ে ছুটে চলেছে। রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন আকারের উঁচু নিচু দালানগুলোয় এখন নানা রঙের কৃত্তিম বাতি জ্বলে উঠেছে। রোড লাইটের আলোয় অবশ্য দিনের আলোর মতই ঝলমল করছে চারপাশে। আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে এই এতো রঙের খেলা আর সন্ধেবেলার রঙিন ঝলমলে ঢাকা শহরের দিকে অবাক হয়ে দেখছিলাম। সত্যিই এই শহর ভিষণ রঙিন। প্রাণস্পন্দনে ভরপুর। বিরামবিহীন গতিতে সবকিছুই কেবল ছুটে চলেছে। যেন কোন প্রতিযোগিতা চলছে। কেউ বিন্দু পরিমাণ গতি কমালেই যেন পিছিয়ে পরবে, হেরে যাবে।

” কি ভাবছ এত? ”

কামরানের প্রশ্ন শুনে আমি সচকিত হয়ে বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কামরানের দিকে ফিরলাম। মৃদু হেসে বললাম,

” কিছু ভাবছিনা। আসলে ঢাকা শহর দেখছিলাম।”

কামরান বোধহয় হালকা স্বরে হেসে উঠলো, ” ঢাকা শহর মানেই তো জ্যাম, পলিউশন, হয়রানি। ”

” হ্যা যেই ঢাকায় আসত ফিরে গিয়ে এই বিখ্যাত জ্যামের গল্প করতই। আজ নিজের চোখে দেখলাম। কিন্তু যাওয়ার সময় তো এমন অবস্থা ছিলনা। তাহলে এখন এতো….”

আমার কথা থামিয়ে দিয়ে ও বললো, ” আজ জুম্মার দিন। তাই দুপুর টাইমটা রাস একটু কম থাকে। কিন্তু বিকেল থেকে সেই একই চিত্রপট। কিছুদিন পরেই দেখ সব কিছু সয়ে যাবে। বাঙালির আর কিছু থাক না থাক কষ্ট সহ্য করার মতো অগাধ ধৈর্য্য শক্তি আছে। ”

” হুম। তা ঠিক বলেছেন। ”

কামরান মেইন রাস্তা ছেড়ে একটা গলিতে ঢুকে গাড়িটা পার্ক করল। তারপর গেট খুলে বেরিয়ে গেলো। আমি চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারছি এটা আমাদের এলাকা নয়। তাহলে এখানে কেন দাঁড়াল?

” কি হল গাড়িতেই বসে থাকবে নাকি। বেরিয়ে এসো।”

কামরান আমার দিকের গেট খুলে ধরে কথাগুলো বললো। আমি চুপচাপ বেরিয়ে এলাম ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

” এখানে থানলেন যে? আরও কোথাও যাবেন”

” হ্যা। এসো আমার সাথে। ”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওর পিছু চলতে লাগলাম। আবারও রাস্তা পার হওয়ার মুহূর্তে আমার বুকের ভিতর দুরুদুরু করতে লাগল। কিন্তু সেটা গোপন করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলাম। কিন্তু কামরান আবারও আমাকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে আনল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ওর এই কেয়ারিং রুপটা আমাকে অভিভুত করে তুলছে। রাস্তা পেরিয়ে কামরান আমার হাত ধরেই হাঁটতে লাগলো। আমিও ওর সাথে পা মিলিয়ে এগিয়ে গেলাম। কিছুদুর পর্যন্ত হেঁটে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ওর পিছু পিছু একদম ভিতরে কিনারের দিকে গিয়ে একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। হাতের ব্যাগগুলো পাশে রাখলাম। বেশ সুন্দর ডেকোরেশনের, ছিমছাম নিরিবিলি পরিবেশ। একদিকের দেয়ালে বেশ বড় একটা এলইডি টিভি চলছে। তাতে খেলার চ্যানেলে ক্রিকেট খেলা চলছে।

ওয়েটার এলো অর্ডার নিতে। কামরান আমার দিকে মেনু বুক এগিয়ে দিয় বললো, ” কি খাবে দেখ। ”

আমি একমুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে মেনুবুকটা হাতে নিলাম। খাবারগুলো বেশির ভাগ ইন্ডিয়ান। এবং বেশ দামী। আজ প্রথম মানুষটার সাথে বাইরে খেতে এসেছি। কেমন লজ্জা সংকোচ আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। এতো দামি খাবার অর্ডার করতে আমার কেমন হেজিটিশন লাগছে। ওয়েটার অপেক্ষা করছে। কামরানও অধীর হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি দ্রুত গতিতে চোখ বুলিয়ে একটা ইন্ডিয়ান আইটেম অর্ডার দিলাম। কামরানও একই জিনিস অর্ডার দিতে আমি স্বস্তিবোধ করলাম। কোল্ড ড্রিংক কোনটা জিজ্ঞেস করতে স্প্রাইটের কথা বললাম। ও সেটাই দিতে বললো। সাথে একটা আইসক্রিম ডেজার্ট অর্ডার করলো। ওয়েটার চলে গেলে আমরা টুকটাক কথা বলতে লাগলাম। খাবার দিতে সময় লাগবে। তাই অপেক্ষা করতে হবে। আমি চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। সেই সময় ক্যামেরার ফ্লাশের আলোর ঝলকানিতে আমি সামনে তাকালাম। কামরানের হাতে ওর সেলফোন। আমার ছবি তুলতে ব্যাস্ত। ও কখন পাশ থেকে উঠে ওপাশে গিয়ে ছবি তুলছে টেরই পাইনি। কামরানকে আজ বেশ অনেকবার ছবি তুলতে দেখেছি। কখনও আমার, আবার কখনও আশেপাশের কোন দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করে ফেলছে। ছবি তুলাটা বোধহয় ওর শখ। ও আমার পাশে এসে বসতেই আমি ওকে শুধালাম,

” আপনি কি শখের ফটোগ্রাফার? আজ আপনাকে দেখলাম অনেকগুলো ছবি তুলতে। ”

” হুম, ফটোগ্রাফার বলতেই পারো। তবে ফটোগ্রাফি আমার শখ নয় নেশা বলা যায়। ”

আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, ” সত্যিই! দারুন ব্যাপার তো। বেশ ইন্টারেস্টিং। ”

কামরান মাথা দুলিয়ে বললো, ” হ্যা ভিষন ইন্টারেস্টিং বটে।” হঠাৎ কিছুটা মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো সে, ” তবে এখন ব্যাস্ততার কারণে আর আগের মত সময় পাইনা। ” আবার প্রফুল্লচিত্তে বললো সে, ” জানো লন্ডনে থাকাকালীন প্রচুর ছবি তুলতাম। যদিও ওখানেও প্রচন্ড বিজি থাকতে হতো। তারপরও উইকেন্ডে যেদিকে দুচোখ যেতো বেরিয়ে পরতাম। ঘুরাঘুরি আর ফটোগ্রাফিতে আমার কোন ক্লান্তি নেই। তাই মন ভরে ছবি তুলতাম। ওখানে ফটোগ্রাফির উপর পড়াশোনাও করেছি। ” বলেই সুন্দর করে হাসলো সে।

আমি ভ্রুকুটি করে তাকালাম,” কিন্তু আপনিতো সিভিল ইন্জিনিয়ারিং পড়েছেন শুনেছিলাম।”

” হ্যা ঠিকই শুনেছ। আম্মার স্বপ্ন তার এক ছেলে ডাক্তার আরেক ছেলে ইন্জিনিয়ার হবে। আমার ভাগে ইন্জিনিয়ারিং পরেছে। কার ব্যাবসাটা আমাকে দেখতে হবে। আব্বাও ইন্জিনিয়ার ছিলেন। নিজেই বেশির ভাগ ডিজাইন গুলো করতেন এখন আমি করি। কিন্তু নেশা যেটায় সেটাকি এতো সহজে ছাড়া যায়? তাই ফটোগ্রাফিটাও সময় সুযোগ মতো চালিয়ে যাচ্ছি। ”

” কি ধরনের ছবি তুলেন? ”

” আমার আসলে নির্দিষ্ট কোন সাবজেক্ট নেই। চলতে ফিরতে যা ভালো লাগে ক্যামেরায় ক্যাপচার করে রাখি। হতে পারে কোন মানুষর মুখ। হতে পারে ফুল পাখি প্রকৃতি, আবার হতে পারে ব্যাস্ত শহরের ছবি আবার এমনও হতে পারে কোন ইট ভাটার মধ্যে একটা কচি চারাগাছের ডগা মাথা উচু করে বেরিয়ে আছে। সেই ছবিও আমার কাছে আছে। লন্ডন থেকে ফেরার পরে জমানো ছবিগুলো দিয়ে একটা এক্সিবিশনও করেছিলাম। চারাগাছের ছবিটা ব্যাপক সারা ফেলেছিল। ”

” ওয়াও! ছবিগুলো আমাকে দেখাবেন প্লিজ? ”

আমি উত্তেজনার বশে বেশ জোরেই কথাটা বলে ফেলেছি। আর ঠিক তখনই আমার লজ্জাকে দ্বিগুন করতে ওয়েটার খাবার নিয়ে হাজির। আমি চারপাশে আড় চোখে চোখ বুলিয়ে দেখলাম কেউ কেউ আমাদের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জিহ্বায় দাঁত কেটে দৃষ্টি নত করে নিলাম। ওয়েটার খাবার গুলো টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে বিদায় নিল। কামরান বললো,

” নাও শুরু কর।”

আমি চুপচাপ বিশাল আকারের দোসা থেকে একটু ছিড়ে নিয়ে ছোলার ঘুগনি দিয়ে মুখে দিলাম। অপূর্ব স্বাদ। কামরান খাওয়ার ফাঁকে বললো,

” তোমাকে দেখাব আমার তোলা ছবিগুলো।”

আমি খাবার চিবিয়ে গিলে নিয়ে বললাম, ” আমার আসলে বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন জায়গার ছবি দেখতে খুব ভালো লাগে। সেই সাথে বেড়াতেও ভালো লাগে। ফটোগ্রাফারদের কত মজা। তারা কত রকমের জায়গায় গিয়ে ছবি তুলতে পারে কত অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এইজন্য আপনার কথা শুনে একটু বেশিই এক্সাইটেড হয়ে এমন জোরে কথা বলে ফেলছিলাম। সরি।”

কামরান কোল্ড ড্রিংকসে চুমুক দিয়ে বললো, ” ইটস ওকে। আই আন্ডারস্ট্যান্ড। একচুয়েলি তোমার এক্সাইটমেন্ট দেখে আমার বরং ভালো লেগেছে। মানুষ কি চায় তার লাইফ পার্টনারের কাছে। তার পছন্দ অপছন্দ গুলোকে বুঝবে, তার স্বপ্নগুলোতে পাশে থেকে সাপোর্ট করবে, উৎসাহ যোগাবে। কিন্তু আমাদের দেশে এই ফটোগ্রাফিকে আজাইরা সময় নষ্ট কারী শখ হিসেবে দেখা হয়। এইজন্য খুব কম মানুষ প্রফেশন হিসেবে এই পেশাকে বেছে নিতে ভয় পায়। তাই আমার লাইফ পার্টনার হিসেবে তুমি যখন আমার ফটোগ্রাফার সত্তার সাথে পরিচিত হয়ে আগ্রহ দেখালে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগছে। ”

আমি কামরানের এই নাতিদীর্ঘ বক্তব্য শুনে খাওয়া ভুলে ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। এই আধো চেনা আধো অচেনা মানুষটাকে যত দেখছি, জানছি, চিনছি ততই চমকিত হচ্ছি। সত্যি মানুষকে কেবল দুর থেকে দেখে তার সম্পর্কে কোন ধারণা করলে সেটা ভুল হবার সম্ভাবনা বেশি। তাকে কাছ থেকে সময় নিয়ে চেনা জানার পরেই তার আসল ব্যাক্তিত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব। এই বাড়ির মানুষ গুলোকে আমি কি ভুলটাই না বুঝেছিলাম
গত দুদিনে আমি এই সত্যিটাই উপলব্ধি করলাম।

” এই হীবা, এই কি হলো? এমন ভাবে কি দেখছ? খাও।”

আমি সম্বিত ফিরে এসে বিব্রতবোধ করতে লাগলাম। কোল্ড ড্রিংকসএ চুমুক দিলাম। লাজুক হেঁসে মাথা ডানে বায়ে নেড়ে বললাম,

” আাসলে ভাবছিলাম। আপনার কথাগুলো শুনতে বেশ লাগল। তবে আপনার লাইফ পার্টনারের কাছে যে প্রত্যাশার কথা বললেন সত্যিই পরস্পরকে বুঝতে পারা এবং সাপোর্ট করা এটা সম্পর্কের ভীতকে মজবুত করতে খুব শক্তিশালী একটা বোধ। হয়ত অনেক সময় একে অপরকে বোঝা সম্ভব নাও হতে পারে। তবু্ও আমার মতে স্বপ্ন, আশা আকাঙ্খার মত কিছু সেনসিটিভ ব্যাপারগুলোতে লাইফ পার্টনারের পাশে থাকাটা জরুরি। ”

” তোমার এমন চিন্তাধারা দেখে ভালো লাগছে। থ্যান্কিউ। ”

আমাদের খাওয়া প্রায় হয়ে গেছে। ডেজার্ট খাচ্ছি ঠিক এই সময়ে কামরানের সেলফোনটা বেজে উঠল। ও ফোন রিসিভ করে কানে ধরল। ওপাশের কথা শুনে ওর ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে গেল।

” মানে কি? তুই জানিস বাসায় আমরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। তাহলে একটা ফোন না করে এভাবে এই সন্ধ্যা বেলায় কে আসতে বলেছিল তোকে? ”

কিছু সময় নিরবে ওপাশের কথা শুনে বললো সে, ” ঠিক আছে একটু ওয়েট কর। আমরা আশেপাশেই আছি। একটু পরই চলে আসছি। ”

কামরান কল কাটতেই আমি প্রশ্নবোধক চাহনিতে চেয়ে রইলাম। ও বললো,

” জলদি খাওয়া শেষ কর। এখনি যেতে হবে। বাসার সামনে পিউলি এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিলটা ক্লিয়ার করে আসছি। ”

বলেই কামরান উঠে দাঁড়াল। কাউন্টারের দিকে চলে গেল সে। আমার মনটা তিক্ততায় ভরে উঠলো। আজ সারাদিন এত সুন্দর একটা দিন কাটানোর পর দিন শেষে এই পাওনা ছিল কে জানতো? এই মেয়েটা এর আগে ঘর ভরা মানুষের সামনে সারাক্ষণ ওর পিছনে পরে থাকতো। কিন্তু এখন কেউ নেই। কোথায় দুজনে একান্তে কিছু সময় কাটাবো। তা না মেয়েটা কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হতে চলে এসেছে। যত্তসব! আমি বিরক্তসহকারে গ্লাসের বাকি আইসক্রিম টুকু দ্রুত গতিতে গিলে ফেললাম। গ্লাসটা টেবিলের উপর ঠক করে রেখে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালাম। তখনই কামরান এসে আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললো,

” এসো। ”

আমরা রেস্টুরেন্টে থেকে বেড়িয়ে এলাম। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। কোন কিছু ভালো লাগছে না আর। মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। এই এলাকায় বাড়ি। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। বাসায় ফিরে পিউলির মুখোমুখি হলে শুধু না বললেই নয় সেটুকু সৌজন্য বিনিময় করে সোজা নিজের কামরায় চলে এলাম । সারদিন এই শাড়ি পরে ঘুরাঘুরি করে কেমন গা কুটকুট করছে। ফাগুন মাসের শুকনো ধুলাময় দিনের কল্যানে এখন গোসল না করলেই নয়। ওয়াশরুমের গিয়ে গিজারটা চালিয়ে দিলাম। একটা সুতির ঢিলেঢালা কুর্তি ও ঢোলা প্লাজো নিয়ে আবারও ওয়াশরুম ঢুকলাম। উষ্ণ গরম পানির ছোঁয়ায় সারাদিনের ধুলো ময়লা ধুয়ে শরীরে ঝরঝরে সতেজতা ফিরে এলো। মাথায় গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে দেখি কামরান ওয়াল ক্লোজিটের সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় বের করছে। আমাকে দেখে ঘাড়ের উপর দিয়ে তাকিয়ে বললো,

” বাহ্ গোসল করেছ। তোমাকে এখন বেশ ফ্রেশ লাগছে? ”

আমি স্মিত হেসে বললাম, ” আপনিও গোসল করবেন নিশ্চয়ই? গিজার অন করা আছে। যান জলদি গোসল সেরে আসেন। ”

” হ্যা। তানাহলে রাতে ঘুম আসবেনা।”

আমি বেলকনির দিকে পা বাড়িয়ে আবারও পিছনে ফিরে বললাম, ” চা বা কফি কিছু খাবেন? আমি খাব তাই আপনিও যদি খান তো একবারেই বানিয়ে ফেলব। ওহ্যা পিউলি আপু কি খাবে জানেন? ”

কামরান বললো, ” আমার জন্য কফি মাস্ট। আর পিউ… এক মুহূর্ত ভেবে আবার বললো, ” কফিই খায় বোধহয়। আএম নট শিওর। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ। ”

” ঠিক আছে। ”

গামছাটা বেলকনিতে শুকোতে দিয়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে এসে চায়ের ডেকচিতে পানি বসিয়ে দিলাম। আমার কফি পছন্দ নয়। আমার জন্য চা করলাম। ওদের জন্য কফি।

রাতে বিরিয়ানি গরম করে পিউলি আপুকে খেতে দিয়েছি। সন্ধ্যায় যা খেয়েছি আমার খিদে পায়নি। কামরানও খেলনা। খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা দুজন লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছে আর গল্প করছে। আমি কিছু সময় বসে ছিলাম। কিন্তু মন বিক্ষিপ্ত থাকায় ওদের আড্ডায় মনোযোগী অংশীদার হওয়া সম্ভব না হওয়ায় ওখান থেকে চলে এলাম। তবে চোখের আড়ালে গেলামনা। ঐ মেয়েটার সাথে আমি আর কোনমতেই আমার বরকে একা ছাড়তে রাজি নই। তাই বইমেলা থেকে কেনা বইগুলো থেকে একটা বই নিয়ে ডাইনিং রুমের একপাশে দেয়াল ঘেঁসে রাখা ছোট্ট ডিভানটায় কুশনে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে বইয়ের পাতায় চোখ রাখলাম। যদিও বই পড়া যেনতেন কান খাঁড়া করে ওদের কথা শোনাতেই ব্যাস্ত। ওরা অবশ্য দুনিয়ার হাবিজাবি বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। অবশ্য বেশির ভাগই পিউলি বলছে, কামরান টিভিতে চলতে থাকা টেনিস খেলার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে কেবল হু হা করে যাচ্ছে।
হঠাৎ নিজেকে শুন্যে ভাসমান অবস্থায় পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম।তারপর বুঝতে পারলাম শুন্যে নয় আমি কারও কোলে। মানুষটার কাছে যাওয়ার খুব একটা সুযোগ না হলেও তার পারফিউম এবং শরীরের ঘ্রাণের মিশ্রণে একটা মাতাল করা ঘ্রান আমার নাকে এসে ধাক্কা দিল। নিমিষেই চিনতে পারলাম তাকে। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সে কোলে তোলার চেষ্টা করছিল তখনই। সারাদিনের ক্লান্তিকর দিনের অবসাদের জন্য কখন যে চোখ দুটো জুড়ে ঘুম জড়িয়ে ধরেছিল আমি টেরই পাইনি। এখন ঘুম ভাঙলেও ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে তার বুকের সাথে লেপ্টে রইলাম। কামরান আমাকে সোজা আমাদের বেডরুমে নিয়ে গিয়ে বেশ যত্ন সহকারে বিছানার একপাশে শুইয়ে দিল। তারপর ওয়াশরুমে গেলে আমি চোখ মেলে তাকালাম। খাটের পাশে সাইড টেবিলের উপর রাখা সেলফোন নিয়ে দেখলাম পৌনে বারোটা বাজে। দ্রুত গতিতে এলার্ম সেট করে ফোনটা রাখতেই ও বেরিয়ে এলো। আমি আবারও ঘুমানোর ভান করে শুয়ে পরলাম। কামরান লাইট নিভিয়ে দিয়ে আমার পাশে শুয়ে পরল। তারপর আমার গা ঘেঁষে শুয়ে আলতো হাতে আমাকে জড়িয়ে নিল। ওর এমন আকস্মিক কর্মকাণ্ডে আমিতো হকচকিয়ে গেলাম। বিছানার সাথে শক্ত হয়ে প্রায় দমবন্ধ করে কামরানের বাহু বন্ধনে মুখ গুঁজে পরে রইলাম।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে