তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-০১

0
1399

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখাঃ মুনিরা সুলতানা।
পর্বঃ ১।

————*
ট্রেন ছুটে চলেছে একের পর এক ষ্টেশন, শহর, গ্রাম, জঙ্গল, পথ,প্রান্তর পিছনে ফেলে। সেই সাথে আমিও পিছনে ফেলে এসেছি আমার ভুলে ভরা কিছু স্মৃতি, অপরিপক্ব ছেলেমানুষী ভাবনা থেকে করে ফেলা কিছু ভুল। সত্যিই কি বোকামি টাইনা করেছি আমি। দাদীর বলা প্রতিটি কথাই আজ আমার কাছে অমোঘ বানী বলে মনে হচ্ছে। এতটাই অবুঝ ও বোকা ছিলাম? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ট্রেনের কামরায় নজর বুলালাম। দুই সিটে একাই বসেছি। কারন আমার বড় ভাই রায়হান দুটো সিটই বুক করে দিয়েছে। যাতে অচেনা অজানা কারও সাথে বসে আমাকে অস্বস্তিতে পরতে না হয়। অপর পাশের সিটে একজোড়া মধ্য বয়সী দম্পতি বসেছে। উনারা নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। এরমাঝে ছোট একটা ঘুমও দিয়েছেন উনারা। বয়স হয়েছেতো। কি সুন্দর রসায়ন দুজনের। ট্রেনে উঠার পর থেকেই লক্ষ্য করছি দুজনেরই দুজনের প্রতি চমৎকার যত্নশীল আচরণ। আবারও মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এতো লম্বা জার্নি করতে আমার সাধারণত ভালো লাগেনা। কিন্তু হুট করেই ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি বলে প্লেনের টিকেট পাইনি। আর তাছাড়া এয়ারপোর্ট থেকে মালিবাগ অনেকটাই দুরে। সেই তুলনায় কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বরঞ্চ কাছে। যেহেতু আমি কাউকে না জানিয়ে ঢাকায় আসছি তাই কমলাপুর স্টেশন থেকে একাই বাসা অব্দি যেতে হবে। স্টেশন থেকে একা আসাটা অনেকটা সহজ মনে হয়েছে আমার কাছে। অবশ্য আমার মামার আমাকে নিতে আসার কথা। মামা উনার পরিবার নিয়ে বনশ্রীতে থাকেন। তিনি বলেছেন স্টেশনে আমাকে নিতে আসবেন। তারপর আমার শশুর বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিবেন।

শশুর বাড়ির কথা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুক চিরে। মাত্র তিনমাস বয়স আমার বিয়ের। কিন্তু হাতে গুনে মাত্র পাঁচদিন থাকা হয়েছে শশুর বাড়িতে। এই সময়টুকুতে কেবল মাত্র তিক্ত অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে আমার কোমল মন জুড়ে। যদিও মানবিক দিক থেকে দেখলে সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটাই ছিল আমাদের সবারই প্রতিকূলে। চাইলেও স্বাভাবিক ভাবে কোন কিছু আমাদের হাতে ছিলনা। কিন্তু তারপরও আমার মনে প্রশ্ন জাগে আসলেই কি আমি নিষ্ঠুরতম ও স্বার্থপরের মতো আচরণ করেছি? আমার মনের কোনে এখনও দ্বিধাদ্বন্দে জেরবার হয়ে আছে। নিজের দাদির দীর্ঘ জীবন থেকে অভিজ্ঞতা লব্ধ কিছু কথা আমাকে বাধ্য করেছে হুট করেই শশুর বাড়ির পথে রওনা দিতে। বলতে গেলে অনেকটা জেদের বসেই একাই রওনা দিয়েছি সবার মতে আমার বর্তমান জীবনের আসল ঠিকানার উদ্দেশ্যে। আমার আব্বা রাইসুল রহমান। আমার সাথে আসতে চেয়েছিলেন, নিজে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। এমনকি রায়হান ভাইয়াও চাইছিল আসতে। কিন্তু জেদি আমি কাউকে সাথে আসতে দেইনি। আমার এককথা, যদি আমি সত্যি কোন ভুল করেই থাকি তাহলে সেটা আমায় একাই শুধরাতে হবে। আমার জন্য নিজের বাবা ও ভাইকে কোনভাবেই ছোট করতে চাইনা আমি। তাছাড়া আমার শশুর বাড়ি থেকে শাশুড়ি আম্মা ফোন করে আমাকে জরুরিতলব করে যেতে বলেছেন। অথচ কেউ এসেও আমাকে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু না। কেউ আসেনি। এমনকি আমার স্বামী মহাশয়, সেওনা। তারা কেউ এখনো পর্যন্ত আমার বাবার বাড়িতে আসেইনি। তাই আমার আব্বা যখন আমার সাথে আসতে চেয়েছিলেন সেটা আমার আত্মসম্মানে লাগে বিধায় আমি তখনি নাকচ করে দিয়েছিলাম। ট্রেন ছুটে চলেছে। ঘন্টা দুই পেরিয়েছে মাত্র। এখনও অনেক লম্বা পথ যাওয়ার বাকি। কিছুক্ষণ সেলফোনে সময় কাটালাম। এরমধ্যে বাসা থেকে ফোন এলে কথা বললাম। কিন্তু ট্রেনের ভিতরে নেটওয়ার্কের বাজে অবস্থা। তাই সেটা ব্যাগে রেখে দিয়ে গল্প বই পড়তে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনটা কেমন অস্থির, বিচলিত হয়ে আছে। বইয়েও কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিনা। অবশেষে আনমনে বাইরের প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি রাখলাম। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের ভাবনার জগতে ডুবে যাচ্ছি।

আমার সামনে ভেসে উঠলো তিনমাস আগের সেই দিনগুলো। যেদিন গুলোয় হঠাৎই আমার রোজ কার স্বাভাবিক দিনলিপিতে বেশ বড়সড় ছন্দপতন ঘটেছিল। আচমকাই জীবনের মোড় ঘুরে সম্পূর্ণ নতুন অচেনা জায়গায় অজানা অচেনা একটা পরিবারের মাঝখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল আমাকে। আর আমি দিগ্বিদিক, হতবিহ্বল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা নিয়ে কেবলমাত্র অজানা স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলাম।

সেদিন মাত্র ভার্সিটি থেকে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলাম। শীত সেদিন রাজশাহী শহরে জাকিয়ে বসেছিল। শৈত্য প্রবাহের কারনে আকাশ সেদিন মুখ গোমরা করে রেখেছিল। প্রকৃতি ধোয়ার মতো কুয়াশায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল। কে জানত একটা খবরের মাধ্যমে হঠাৎ করেই শৈত্য প্রবাহের কুয়াশার মতো আমার জীবনটাকেও চেখের পলকেই কুয়াশায় আবৃত করে ফেলবে? অথচ তাই হয়েছিল। এবং এটাই আমার বর্তমান জীবনের চরম একমাত্র অমোঘ সত্যি।

সেদিন বাসায় এসে দেখি আমার আম্মু, দাদি কোথাও যাওয়ার জন্য ব্যাগ গোছগাছ করতে ব্যাস্ত। আমি অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব তার আগেই দাদি আমাকে দেখে বললেন,

” আসছ বুবু, এবার জলদি করে কাপড় চোপড় গুছাইয়া নে। হাতে একদম সময় নাই। রাতেই রওনা দেব। ”

আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ” কি বল দাদি? হঠাৎ কোথায় যাব? আর কেন? ”

আম্মু ওয়ারড্রব থেকে আমার কিছু কাপড় বের করে বিছানায় রাখতে রাখতে বললেন, ” ঢাকায় যেতে হবে আর্জেন্ট। পরে শুনিস। এখন যা কাপড় চোপড় বদলে নিয়ে কিছু খেয়ে নে আগে।”

” কিন্তু আগে বলবাতো হঠাৎ ঢাকায় কেন যেতে হবে? সামনে আমার পরীক্ষা ভুলে গেছ?”

আম্মু বললেন, ” বেশিদিন থাকতে হবেনা। এই কয়দিনে তোর পড়াশোনায় এমন কিছু ক্ষতি হবেনা। ”

এবার আমি অধৈর্য্য হয়ে পরলাম। বুঝতে পারছিনা কারনটা বললে এমন কি ক্ষতি হয়ে যাবে। আমিও নাছোরবান্দার মতো আবারও শুধালাম,

” কারও কিছু হইছে? মামা মামি সবাই ঠিক আছে তো?”

আমাকে হাল ছাড়তে না দেখে বোধহয় দাদি হার মেনে নিয়ে অবশেষে বললেন, ” তোর দাদার বন্ধু তৈয়ব ঢাকায় থাকে জানিসতো? তৈয়ব ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। যায়যায় অবস্হা। তাই… ”

দাদি কথার মাঝখানে থেমে ইতস্তত করতে লাগলেন। আমি ভ্রু দুটো কুঁচকে তাকিয়ে আছি, ‘ ডালমে কুছ কালা হেয়।’ আমি তাড়া দিয়ে বললাম,

” তাই কি দাদি? বল। তোমরা এতো রহস্য করছ কেন? ”

দাদি বললেন, ” তৈয়ব ভাইয়ের শেষ ইচ্ছে তার নাতবউ দেখে যাবে। তোর জন্মের পরে তোর দাদার সাথে উনারা দুই বন্ধু কথা দেয়া নেয়া করেছিল তোরা বড় হলে তোর সাথে উনার নাতির বিয়ে হবে।”

আমার মেজাজের পারদ এক লহমায় মাথার উপরে উঠে গেল। বিয়ে? আমি রুয়েটে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। কদিন পরেই ফাইনাল এক্সাম। এইসময়ে ওরা এমন আবদার করছেন কিভাবে? মাথার ঠিক আছে তো সবার? কয়েক সেকেন্ড আমি পাথরের মত জমে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। তারপর আমি নিজেকে সামলে নিয়ে অনেকটা রূঢ় কন্ঠে বললাম,

” তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? বলা নাই কওয়া নেই দুদিন বাদে আমার ফাইনাল এক্সাম, আর তোমরা আমার বিয়ে নিয়ে মাতামাতি শুরু করছ। আমার বিয়ে, অথচ আমার মতামত নেয়ারও প্রয়োজন মনে করলানা? বাহ কি চমৎকার! ”

আম্মু হাতের কাপড় রেখে আমার পাশে এসে বসলেন। শান্ত গলায় বললেন,

” দেখ হীবা, পরিস্থিতি বুঝে মানুষকে অনেক সময় এমন কিছু কাজ করতে হয় যাতে হয়তো ঐ মুহূর্তে মন সায় দেয়না। কিন্তু তবুও আমাদের সেটা করতে হয়। মানুষের জন্ম, বিয়ে, মৃত্যু এসব ক্ষেত্রে আমাদের মত অতি সাধারণ মানুষের হাতে কিছুই থাকেনা। সব আল্লাহর মর্জি মত হয়। দুনিয়ায় একটা পাতা পর্যন্ত তার ইশারা ছাড়া নড়েচড়ে না। নিয়তির কাছে আমরা বাঁধা পরে আছি। আল্লাহর মর্জি যেটা সেটা হবেই। আর সেটাতেই আমাদের কল্যান। তাই আল্লাহর মর্জি মত যা কিছু ঘটছে সেটাকেই ভাগ্য বলে মেনে নেয়া উচিত মা।”

আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আমি চেষ্টা করেও অশ্রুপাত আটকে রাখতে পারলামনা। দুচোখ ছাপিয়ে উষ্ণ জল গড়িয়ে পরল আমার গাল দুটো বেয়ে। এভাবে বিয়ে হয়? মানুষের নুন্যতম মানসিক প্রস্তুতির তো প্রয়োজন আছে। একজন অজানা অচেনা অদেখা মানুষকে হুট করেই সারাজীবনের জন্য নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়া কি এতটাই সহজ? আমার চিন্তা করার ক্ষমতা এই মুহূর্তে শূন্যতায় নেমে গেছে। আমি নিরবে কেঁদে চলেছি। আমার বাকরুদ্ধ কান্না দেখে দাদি স্বান্তনার সুরে বললেন,

” একজন মৃত্যু পদযাত্রী মানুষের শেষ ইচ্ছে পুরোন করতে হবে বুবু। তিনিযে বড় আশা করে আছেন। আমাদের আমলেও তো এমন না দেখেই বিয়ে হতো। তোর দাদাকেও আমি বিয়ে পড়ানোর পরেই দেখেছিলাম। আমরা কতগুলো বছর একসাথে সুখে দুঃখের সাথি হয়ে কাটিয়ে দিছি। দেখবি তুইও একদিন আমার মত তোর নাতি নাতনির কাছে গল্প করছিস। সব ঠিক হয়ে যাবেগো বুবু। আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের নিমিত্তেই করেন।”

আমি আর কিছু বললাম না। দাদির কথায় ভেজা চোখে চেয়ে হাসার চেষ্টা করলাম শুধু। এরপর মা ও দাদি দাদাদের বন্ধুত্ব ও ঐ বাড়ির সম্বন্ধে আমাকে আরও কিছু ধারণা দিলেন। যার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, আমার দাদা এবং পাত্র অর্থাৎ কামরানের দাদা ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন। উনারা একসাথেই পড়াশোনা করেছিলেন। পাশাপাশি এলাকায় থাকতেন। দেশভাগের আগে উনারা ইন্ডিয়ায় চব্বিশ পরগনার একটা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। দেশভাগের পরে চাকরি সুত্রে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন সপরিবারে। আমার দাদা রেলের চাকরির সুবাদে অবসরের সময় রাজশাহীতে ছিলেন। তাই এখানেই জায়গা কিনে বাড়ি করে এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছিলেন। আমার বাবারা দুই ভাই এক বোন। সবাই রাজশাহীতেই থাকেন। আমার ছোট চাচা আমাদের সাথেই থাকেন। আর আমরা দুই ভাই বোন। ঐদিকে কামরানের দাদা অনেকগুলো বছর ঢাকায় চাকরি করেছেন। সেই সময় ঢাকায় জমির দাম কম ছিল। তিনি সেই সুযোগে অল্প অল্প করে বেশ কিছু জমিজমা কিনেছিলেন। তিনি বিষয় আসয় সম্বন্ধে বেশ ঝানু ছিলেন। উনার ছেলেমেয়েদের জন্য তাই ঢাকার বুকে যথেষ্ট সয়-সম্পত্তি করেছেন। কামরানরা দুই ভাই দুই বোন। কামরানই সবার বড়। কামরানের বাবা চাকরি না করে ব্যাবসায় মন দিয়েছিলেন। ওদের নিজস্ব ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের ব্যাবসা আছে। কামরানের বাবা বছর খানেক আগে মারা গিয়েছেন। কামরান তখন লন্ডনে ছিল। পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করেছিল সবেমাত্র। সেই সময় বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে দেশে ফিরে আসে। বাবা মারা যাওয়ার পর সব দায়িত্ব তার উপর পরায় সে এই দেশেই থেকে যায়।

সেদিন রাতের ট্রেনে আমরা পুরো পরিবার একসাথে রওনা দিয়েছিলাম। ভোর বেলায় ঢাকায় পৌঁছে আমরা বনশ্রীতে মামার বাড়িতে উঠেছিলাম। জানিনা কিভাবে প্রায় আত্মীয় স্বজনরাও ঐ একদিনের ডাকেই মামার বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিল। সম্পূর্ণ বাড়ি নানা বয়সের মানুষের ভীড়ে গমগম করছিল। মামা মামির তো সেদিন নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার অবস্থা। কিভাবে যে সামলেছিলেন আল্লাহই জানেন। আমার তখন কোনদিকে মন নেই। কি ঘটছে, কে আসছে যাচ্ছে, কি বলছে কিছুই যেন আমার কানে ঢুকছিল না। আমি কেবল শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আমার বোধ শক্তিও যেন লোপ পেয়েছিল। কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে ডুবে ছিলাম। সময়ের সাথে যা ঘটে চলেছে আমি কেবল সেই স্রোতের সাথে বয়ে চলেছি। তার প্রমান আমার এখন সেই সময় গুলোর কথা ঠিক স্পষ্ট ভাবে মনে নেই। সব কেমন ধোয়াশার মাঝে আবছাভাবে চোখে ভাসে।

সারারাতের জার্নির পরে ক্লান্ত শরীরে মামির উদ্যোগে গোসলের আগে আমাকে হলুদ লাগানো হয়েছিল। যদিও আমার আব্বা বারন করেছিলেন। এসব এমনিতেও ঠিক নয়। তাই বাদ দিতে। কিন্তু মহিলারা যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের আনন্দ উৎযাপন করতে কোন কার্পণ্য করেনা। এক ফাঁকে ঠিকই আমার শরীরে হলুদ মাখিয়ে দিয়েছিল। একটা মেয়ের কত স্বপ্ন থাকে বিয়ের মতো এতো বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আনার জীবনে বিয়ের মত এতো বড় একটা ব্যাপার বিনা নোটিশে কোন প্রস্তুতি, আয়োজন ছাড়া ঝোড়ো হাওয়ার মতো হঠাৎই চলে এসেছিল। অচেনা অজানা এমনকি অদেখা সেই মানুষটার জন্য আমাকে বঁধুর সাজে সাজতে হল। অবশ্য গতানুগতিক ধারার বৌয়ের মত সাজার সৌভাগ্য আমার হয়নি। পাত্রপক্ষ থেকে আমার জন্য স্যুটকেশ এসেছে। শাড়ি গয়না সহ টুকটাক প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্রে সাজানো। জানিনা এমন পরিস্থিতিতে এতো অল্প সময়ের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে কে এসব কেনাকাটা করেছে। বিয়ের জন্য লাল বেনারসি কাতান শাড়ির সাথে সুতি সিল্ক মিলিয়ে আরও কয়েকটি শাড়ি ছিল। রেডিমেড ব্লাউজ পেটিকোট ছিল। একদিনে তো আর ব্লাউজ তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই এই ব্যাবস্থা।

আমি কেমন ঘোরের মাঝে চুপচাপ বসে আছি। আমার কাজিনদের মধ্যে কেউ আমাকে ঘরে বসেই সাজিয়ে দিল। ওদের দেয়া গহনার সাথে আমার জন্য আম্মার বানিয়ে রাখা গহনা গুলোও আমাকে পরিয়ে দেয়া হলো। আমার জন্য অনেক আগেই আম্মা গহনা বানিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলো দেখে মনে হলো সত্যিই আমার ভাগ্যে তাহলে এভাবেই বিয়েটা হওয়ার ছিল। সেজন্য গহনাও তৈরি করা ছিল। ভারি বেনারসি শাড়ি ও গহনায় জড়িয়ে বঁধু বেশে আমি কেমন ভাবলেশহীন, অনুভূতিহীন পুতুলের মতো নিশ্চল ও নির্বিকার হয়ে বসে ছিলাম।

অবশেষে যখন আমার কানে বর এসেছে কথাটা প্রবেশ করেছিল তৎক্ষনাৎ বুকের ভিতর হঠাৎ কেমন তোলপাড় করে উঠেছিল। এতক্ষণে খেয়াল হল আজ থেকে আমার জীবন সম্পূর্ণ বদলে যাবে। আজকের পরে আমাকে একদম নতুন অজানা জীবনের পথে চলতে হবে। বুকের ভিতর তখন কেমন অজানা অচেনা সুরে বেজে উঠেছিল। ছোট্ট হৃদযন্ত্রটা অনুভূতিতে প্রবল বেগে স্পন্দিত হতে শুরু করেছিল।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে