#তোমাতেই_বিমোহিত
#পর্বঃ২০💝💝(স্পেশাল পর্ব)💝💝
#লেখিকা আরোহি জান্নাত (ছদ্মনাম)
রাত ৯ টায় বাড়িতে ফিরল ইহান।সকালে বেরিয়ে যাওয়ার আগে এক্সট্রা চাবি নিয়ে গিয়েছিল। তাই কলিং বেল না চেপে নিজে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। সে জানে বাড়িতে আরোহি ছাড়া কেউ নেই। তবে ইহান মনে প্রাণে চাচ্ছে আরোহির মুখোমুখি না হতে। আজ বাদে কাল তো চলেই যাবে তাই এখন থেকে তার থেকে দূরে থাকবে ইহান। ইহান এর পরিকল্পনা নিরবে গেস্ট রুমে ঢুকে যাবে আর কালকে সকালে বের হবে।এইসব ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে গেল ইহান।
ড্রয়িং রুমে আরোহি নেই দেখে স্বস্তি পেল।হয়তো নিজের ঘরে আছে।ধীর পায়ে গেস্ট রুমে ঢুকে গেল সে।গেস্ট রুমে ইহানের জামা সহ সব প্রয়োজনীয় জিনিস থাকায় অসুবিধা হলো না ইহানের।বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে কারেন্ট চলে গেল ফ্লাটের। অবাক হলো ইহান।সচারাচর এমন সময় কারেন্ট যায় না কিন্তু আজ কি হলো! তবে বেশি ভাবলো না সে একটু পরেই আই পি এস চলে আসবে,তাই চিন্তার কিছু নেই।ফোনের ফ্লাস জ্বালিয়ে বসল ইহান।কিন্তু ৫ মিনিটের জায়গায় ১০ মিনিট হওয়ার পর ও কারেন্ট আসছে না।আরোহি ঘরে একা সেই জন্য একটু চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য ইহানের।এদিকে ১০ মিনিট পার হওয়া স্বত্তেও আই পি এস এলো না।আবার আরোহি ও কোনো সারা শব্দ করছে না। মেয়েটা কি ঘুমিয়ে গেছে। না হলে ড্রয়িং রুমে এসে তো মোমবাতি টা নিতো অন্তত। অনেক চিন্তা ঘুর পাক খাচ্ছে মাথায়।খুবই রাগ হচ্ছে ইহানের। যত এই মেয়েটার থেকে দূরে থাকতে চায় তত যেন বেশি কাছে যেতে হয়।
” নাহ এভাবে আর বসে থাকলে চলবে না।আর আরোহি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে গেছে তাই তো কারেন্ট না থাকা স্বত্তেও কোনো সারা শব্দ করল না।আচ্ছা হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তো ভয় পাবে মেয়েটা!”
বিরবির করে বলে উঠল ইহান।
ইহান সিদ্ধান্ত নিলো একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আরোহির ঘরে রেখে আসবে যাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ভয় না পায় আরোহি। আবার ক্যারেন্টর ব্যাপার টা ও দেখতে হবে।এসব ভেবে ফোন এর ফ্লাস লাইট জ্বালিয়ে রান্নাঘর থেকে একটা মোমবাতি নিয়ে জ্বালিয়ে ঘরের দিকে গেল ইহান।
দরজা লাগনো আছে তবে ভেতর থেকে লক করা কিনা বুঝতে পারছে না ইহান। আবার দরজার ফাক দিয়ে হালকা আলো আসছে বলে মনে হচ্ছে ইহানের। তবে কি আরোহি আলোর ব্যাবস্থা করেছে।অনেক চিন্তা ভাবনা করে শেষ পর্যন্ত দরজার লক ঘোরালো ইহান।দরজা খোলা আছে।তবে দরজা খুলে যে এমন কিছু দেখবে তেমনটা আশা করেনি সে।হাতের মোমবাতি টা কখন যে হাত থেকে পড়ে নিভে গেছে টের পেল না ইহান।
_______________________
সারা ঘরের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রিনি।আজ রাফসান এর কাছ থেকে এত বড় সত্যি জানবে ভাবতে পারেনি।একটা মানুষের জীবন এমন ও হয় ভেবেই আরো বেশি কান্না পাচ্ছে রিনির।
ফ্লাসব্যাক,
রাফসানের ফোনে রাফসান আর মায়ার ছবি দেখে রিনি বুঝে যায় যে রাফসান সত্যি বলছে।আর তাই না চাইতে ও রিনির চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে।রিনি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে রাফসানকে তখন জিজ্ঞেস করে,
” আপনার ওয়াইফ কোথায়? দেখছি না যে!”
রিনির এমন প্রশ্নে রাফসানের মুখ টা নিমিষেই কালো হয়ে যায়।বলে ওঠে,
“কয়েক মাস আগে আমার ছেলেকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। ”
রাফসানের শান্ত কন্ঠে যেন রিনি আরো ভেঙে পড়ে। আবার ও জিজ্ঞেস করে ওঠে,
“আর আপনার ছেলে?”
তাচ্ছিল্য হাসে রাফসান। তারপর তার জীবনে ঘটে যাওয়া অতীত টা বলতে থাকে রিনিকে।তবে ইহানের নাম না নিয়ে।
রাফসানের কথা শুনে অবাক এর শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায় রিনি। রাফসান নিজের স্ত্রীকে হারিয়েছে। একটা ছেলে ও আছে কিন্তু বাবার অধিকার নিয়ে নিজের ছেলের কাছে যাওয়ার উপায় নেই।
রাফসান তখন বলে ওঠে,
” জানো রিনি, আমি কিন্তু চাইলেই আয়ানকে মানে আমার ছেলেকে আমার কাছে আনতে পারি।হ্যাঁ মায়ার ভাই আমাদের বিয়ের সমস্ত প্রমান নষ্ট করে দিলে ও আয়ানের শরীরে আমার রক্ত বইছে। একটা ডি এন এ টেস্ট আর আয়ান আমার।এত কিছু করা ও লাগবে না যদি আমি একবার তাকে মানে মায়ার সেই স্বামীকে কে বলি আয়ানকে ফিরিয়ে দিতে সে বিনা বাক্যে দিয়ে দেবে।কিন্তু এতে যে আমার মায়া কলঙ্কিত হবে। সমাজের চোখে মায়া ইহানের স্ত্রী ছিল। কিন্তু সে আমার সন্তানের মা এটা জানলে যে সবাই মৃত্যুর পর ও মেয়েটাকে কথা শোনাতে কম করতো না। আজ যদি আমার কাছে আমাদের বিয়ের একটা প্রমাণ থাকতো তাহলে আমি আয়ানকে আমার কাছে নিয়ে আসতাম কিন্তু আমি নিরুপায়।”
কথাগুলো বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাফসান।আর রিনি হতভম্ব হয়ে রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটা প্রতি মুহূর্তে এতটা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
রাফসান তখন আবার ও বলতে শুরু করল,
“আমি চাইলেই নতুন কাউকে নিয়ে আমার জীবন টা আবার শুরু করতে পারি। কিন্তু সেটা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব না রিনি। আমি মায়াকে মন থেকে ভালেবাসি আর সারাটা জীবন ভালোবাসব।আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো, হয়তো ভালো ও বাসো কিন্তু এটার কোনো ভিত্তি নেই রিনি।এত সহজে মায়াকে ভুলে অন্য কাউকে আপন করা আমার পক্ষে সম্ভব না।তার থেকে তুমি ভালো কাউকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নাও।এতেই তোমার ভালো হবে। ”
ছলছল চোখে তাকালো রিনি।সত্যি কি ভালোবাসা ভুলে অন্য কাউকে এত সহজে আপন করা যায় তবে রাফসান কেন পারছে না।রিনি বলে উঠল,
” আজ থেকে আপনার কাছে কখনো প্রেমের দাবি নিয়ে যাবো না রাফসান। কথা দিলাম।তবে আপনাকে ভুলে অন্য কাউকে জায়গা দেওয়া আমার পক্ষে ও সম্ভব নয়।আমি কোনো টিন এজ এর মেয়ে না যে আজ একজনকে ভালো লাগল তো কাল আর একজন কে৷ আমি মন থেকেই আপনাকে ভালোবাসি।আর ভালোবাসা যে ভোলা যায় না সেটা আপনিই আমাকে বললেন। আমি অপেক্ষা করব রাফসান। মায়াকে ভোলার না।মায়ার জন্য বরাদ্দ জায়গায় পাশে যদি একটুখানি জায়গা পায় এই আশার।আমি কখনোই আপনাকে মায়াকে ভুলে যেতে বলব না তবে অপেক্ষায় থাকব যদি আমার ভালোবাসা দিয়ে আপনার মনের কোনে একটুখানি জায়গা করে নিতে পারি।
তার মানে এই নয় যে আজ থেকে সব সময় আপনার সাথে থাকব,পিছু ঘুরবো।যদি আমার ভালোবাসা সত্যি হয় তাহলে আমার অপেক্ষাই আপনাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে এটা আমার বিশ্বাস। ”
কথাগুলো বলেই সেখান থেকে চলে গেল রিনি।রাফসানের সামনে শক্ত থাকার চেষ্টা করলেও বাড়িতে এসে কান্নায় পড়েছে সে।আর রাফসান তো রিনির কনফিডেন্স দেখে অবাক!
_____________
ঘরে ঢুকে এমন কিছু দেখবে তা স্বপ্নে ও ভাবে নি ইহান।আরোহি আকাশি রঙের একটা পাতলা শাড়ি পরে সারা ঘরে মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। মুখে মেকাপ না থাকলে ও মোটা কাজল আর আইলাইনারের দারা নিজের চোখ দুটোকে সুন্দর করে সাজিয়েছে আরোহি।আর ঠোঁটের লাল লিপস্টিক যেন মোমের আলোতে জ্বলজ্বল করছে।আরোহিকে যেন মোমের আলোতে অপসরীর মতো লাগছে।ইহান আরোহি কে দেখায় এতো বিভোর ছিল যে আরোহি কখন ইহানকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে সেটা খেয়ালই হয় নি। যেন পাথর হয়ে গেছে সে। আরোহির চুটকির শব্দে ধ্যাণ ভাঙে ইহানের। তবে অবাকের রেশ কাটাতে পারে নি। মনে মনে ভাবতে থাকে,
“আরোহি এই রুপে কেন।আমার জন্যে নাকি অন্য কোনো কারণ!”
ইহানকে ভাবনার জগতে দেখে আরোহি আলতো করে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
“মেইন সুইচ তো অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছি, তাহলে এই ঘরে আসছিলেন না কেন?”
ইাহন এবার বুঝতে পারে কারেন্ট যাওয়ার রহস্য।তবে অবাক হয় আরোহির এমন কথায়। প্রশ্ন করে,
” আমি কখন ফিরেছি তুমি জানো?”
আরোহি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়।এবার ইহানের কাছে সব ব্যাপার পরিষ্কার। আর আরোহির এমন সাজের মানে ও।আরোহি যে সব টা ঠিক করতে চাইছে সেটা ও বুঝতে বেগ পেতে হলো না ইহানের। হঠাৎই আরোহির কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো ইহান।ইহানের এমন হঠাৎ আক্রমণে আরোহি অবাক হলে ও লজ্জা লাগছে তার।ইহান আরোহির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“হ্যাপি থার্ড মান্থ এনিভার্সিটি ওয়াইফি।”
শিউরে উঠল আরোহি। ইহানের মনে আছে আজকের দিনটা। ভাবতেই মনের কোনে ভালোলাগা ছেয়ে গেল। আরোহি ইহানের দিকে তাকালো তবে সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিল। কারণ আজ এই চোখেই তার মৃত্যু। তবে সে মৃত্যু আনন্দের। ইহান কিছু না বলেই আরোহিকে কোলে তুলে নিয়ে বেলকনিতে নিয়ে গেল। আরোহি ও কিছু বলল না।
দুজনে চুপ করে চাঁদ দেখতে লাগল।আরোহি ইহানের বুকে মাথা আর পিঠ ঠেকিয়ে চাঁদ দেখছিল কিন্তু তারপরই ভাবল ইহানকে সরি বলবে তাই একটু পরেই ইহানের দিকে ফিরে বলতে শুরু করল,
“আমি জানি ইহান আমি অনেক”
আরোহির কথা শেষ হতে দিল না ইহান।তার আগেই চুপ করিয়ে দিলো আরোহিকে। তারপর নিজ থেকে বলতে লাগল,
” কম বেশি আমরা দুজনেই অনেক দোষ করেছি আরোহি। সেটা জেনে অথবা না জেনে।তাই নো সরি। তবে আজ থেকে আমি একটা নতুন আরম্ভ চায় আরোহি। যেখানে কোনো অবিশ্বাস, মান অভিমান থাকবে না।পুরানো সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতে চায়।তাই আর অতীতটাকে টেনো না আরোহি।”
ইহানের কথা শুনে পরম শান্তিতে ইহানের বুকে মাথা রাখল আরোহি।সত্যি তো সরি যদি দুজনের মন থেকে আসে তাহলে সেটা মুখে প্রকাশের কি খুব দরকার।
অনেকক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর ইহান আরোহিকে নিজের দিকে ফেরালো।ইহানের চেখ কিছু বলছে সেটা বুঝতে পারল আরোহি।তাই মাথা নিচু নিলো সে।হাসল ইহান।এত বছর এর প্রেম! হয়তো কখনো প্রকাশ পায় নি তবে ছিলে তো! তারপর ও মেয়েটা লজ্জায় লাল হচ্ছে।
ইহান কানের কাছে আবার ও ফিসফিস করে কিছু বলল আরোহির।সারা মুখে রক্তিম আভা ফুটে উঠল আরোহির।
চারপাশ নিস্তব্ধ।মোমবাতির আলোগুলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। একটু একটু করে কমছে ঘরের আলো।এক সময় পুরো ঘরই আঁধারে ডুবে গেল।শুধু বেচে রইল দুই কপোত কপোতির প্রণয় আর উষ্ণ আলিঙ্গন।
চলবে,