#তোমাতেই_বিমোহিত
#পর্বঃ৮
#লেখিকা আরোহি জান্নাত( ছদ্মনাম)
শুরু হলো একটা নতুন দিন। একটা নতুন সকাল।আরোহিদের বাড়ি থেকে একটু আগেই নিজের বাড়িতে ফিরেছে ইহান।আতশি বেগম না খাইয়ে ছাড়েন নি ইহানকে।তবে ইহান একা ফিরেছে।আরোহি আর আয়ান পরে ফিরবে।ইহান ও কিছু বলতে পারেনি।কি বা বলবে! আরোহি তো কথাই বলে না ইহানের সাথে। একটা মানুষের সাথে থাকতে গেলে যতটুকু কথা না বললে নয় ততটুকুই কথা বলে আরোহি। ইহান ও জোর করে কথা বলার চেষ্টা করে না।ভাবে আরোহি যদি এতেই খুশি থাকে তাহলে থাকুক।মেয়েটা কে চোখের সামনে ই দেখতে পায়। এটাই অনেক।
আজ অফিসে যাওয়ার আগে রাফসানের সাথে দেখা করবে।কিভাবে সবটা বলবে সেটা ভেবেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে ইহান।
_______________________
জেলের মধ্যে মুখোমুখি বসে আছে ইহান আর রাফসান।রাফসান এর চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে।
একটু আগে ইহানের কাছ থেকে সব সত্যি শুনেছে সে।তার মায়া আর এ পৃথিবীতে নেয়,একথা শুনেই রাফসান এর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে অসহায় মনে হচ্ছে রাফসানের। আজ সে এক সন্তানের বাবা। অথচ একটু আগে অবদি এ কথা জানতো না সে।নিজের সন্তান কে একবারের জন্য চোখে ও দেখতে পেল না।আর পরিচয় তো অনেক দূর।
সেদিন রাতে ইহান আর মায়ার সাথে কথা হয় রাফসানের। রাফসান পরের দিনই ইহানদের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরের দিন ভোর বেলায় মায়ার ভাই পুলিশ নিয়ে হাজির হয় রাফসানের বাড়ি।মিথ্যা কেস দিয়ে জেলে পাঠায়।আর সেটার মেয়াদ ৩ বছর । মায়ার ভাই মুহিব এর থেকে ও বেশি দিন রাফসান কে জেলে রাখার পরিকল্পনা করে কিন্তু পারে না।মুহিব ভেবেছিল তিন বছর রাফসান জেলে থাকলে মায়া তাকে ভুলে যাবে।আর তাই এমনটা করে সে।
বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে ইহান বলে ওঠে,
“কালকে তোমার জামিন হয়ে যাবে রাফসান।আমি উকিল এর সাথে কথা বলেছি।তোমার কোনো সমস্যা নেই তো?”
“আপনি সত্যি আমার জামিন করাবেন মি. ইহান?”
অবাক হয়ে বলে ওঠে রাফসান।
“হুম।”(ইহান)
“আমাকে একবার আমার ছেলেকে দেখাবেন মি.ইহান।”
আবেগ জড়িত কন্ঠে বলে ওঠে রাফসান।সাথে নিজের ছেলেকে দেখার আকুতি।
“অবশ্যই। কালকেই তোমাকে নিয়ে যাবো আয়ানের কাছে।”
কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল রাফসান ইহান এর এর কথা শুনে।
___________
আজ অনেক দিন পরে নিজেকে বেঝা মুক্ত মনে হচ্ছে ইহানের। রাফসানকে সবটা জানাতে পেরে শান্তি লাগছে। সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে আজ আগে নিজের মায়ের ঘরে গেল ইহান। উদ্দেশ্য আগে আয়ানকে কোলে নিয়ে আদর করবে। ছেলেটা এতদিন পর নিজের আসল বাবাকে দেখতে পারবে ভাবতেই ইহানের ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠল। তবে নিজের মায়ের ঘরে গিয়ে হতাস হলো ইহান।অন্য দিন আরোহি আর আয়ান তার মা এর ঘরে থাকলেও আজ নেই। তবে কি ইহানের ঘরে ওরা।আরোহি কি একটু একটু করে ঘরটাকে আপন করে নিচ্ছে। তবে কি এক সময় ইহানকে ও আপন করে নেবে।এরকম হাজার জল্পনা কল্পনা করে নিজের ঘরে গেল ইহান। তবে আবার ও হতাস হলো। আরোহি নেই। তবে কি ঐ বাড়ি থেকে ফেরে নি ওরা।চিন্তা করতে করতে ফ্রেশ হয়ে নিলো ইহান।যদি ওরা না ফিরে থাকে তাহলে ওদের কে আনতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ও নিয়ে নিলো ইহান।
ড্রয়িং রুমে বসে আছেন ইহানের মা।ইহান ও পাশে বসে আছে।একটু আগে মায়ের কাছ থেকে শুনেছে ইহানের ধারণাই ঠিক।আরোহি আর আয়ান ফেরে নি ও বাড়ি থেকে। ইহানের ইচ্ছা করছে এক ছুটে গিয়ে আরোহি আর আয়ান কে নিয়ে আসতে কিন্তু মায়ের সামনে সেটা প্রকাশ করতে ইতঃস্তত করছে ইহান।
আরশি বেগম অনেকক্ষণ ধরে দেখছেন ইহান ছটফট করছে কিছু একটা বলার জন্য তবে বলতে পারছে না। ইহান কি বলতে চাইছে সেটা ও ভালো করে বুঝতে পারছেন তিনি। মুখ টিপে হাসলেন ছেলের এমন অদ্ভুত কান্ডে।আবার মনে মনে খুশি ও হলেন। তার ছেলে আর আরোহি যে স্বাভাবিক হচ্ছে। চর পাঁচজন স্বামী স্ত্রী এর মতো একে অপরকে সব সময় পাশে রাখতে চায়ছে।
“কিছু বলবি ইহান?”
আরশি বেগম স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করল ইহানকে।মায়ের প্রশ্নে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল ইহান। মুখ ফুটে যখনই ও বাড়িতে যেতে চাই বলতে যাবে তখনই খেয়াল করল তার মা মুখ টিপে হাসছেন। বিষয়টি বুঝতে সময় লাগল না ইহানের। এখন যদি মায়ের সামনে ও বাড়ি যাওয়ার কথা বলে তাহলে সেটা ইহানের জন্য খুবই অপ্রস্তুত একটা বিষয় হবে।সবটা বুঝে ভদ্র ছেলের মতো বলল,
“না মা কিছু না।কেনো বলো তো?”
ছেলের কথায় আর কিছু বললেন না আতশি বেগম। তার ছেলেকে যে এত সহজে অপ্রস্তুত করা যাবে না সেটা ও বুঝতে পারলেন।তাই নিজে থেকে বলে উঠলেন,
“ওরা তো ও বাড়িতে আছে। তোর খালামনি আসতে দেয় নি।তুই এক কাজ কর।ওদের কে গিয়ে নিয়ে আয়।”
মা এর কথাটা যেন গায়ে মাখল না ইহান। গা ছাড়া ভাব দিয়ে বলল,
“একটু পরে গিয়ে নিয়ে আসব, ঠিক আছে! ”
আরশি বেগম আর কথা বাড়ালেন না। টিভির দিকে মনোযোগ দিলেন।
আরোহিদের বাড়িতে এসেছে ইহান। আতশি বেগম আজ ও আপ্যায়ন এর কোনো ত্রুটি রাখলেন না। রাতের খাবার খেয়ে ও বাড়ি থেকে বের হলো আরোহি, আয়ান আর ইহান। কিন্তু মাঝপথে দেখা মিলল সেই ছেলের যে সকল এর সামনে আরোহি কে অপমান করেছিল।এমন কি আরোহিকে পতিতা-দের সাথে তুলনা করেছিল।তবে আজ আরোহিকে দেখেই ছেলেটি দৃষ্টি নামিয়ে রাখল। বারবার ঢোক গিলছে সে।কেমন যেন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরোহি একটু অবাক হলো কিন্তু কিছু বলল না।চুপচাপ ইহানের
সাথে বাড়ি ফিরে গেল।
রোজকার মতো আজ ও ইহানের সাথে কোনো কথা বলল না আরোহি। চুপচাপ ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। ইহান ও সোফায় শুয়ে পড়ল কোনো কথা না বলে।
তবে একটু বাদেই ইহান ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এটা খেয়াল করল আরোহি। টি টেবিলের উপর তাকিয়ে দেখল ঘরে পানি আছে তাহলে কোথায় গেল ইহান। প্রশ্ন জাগল আরোহির মনে। আয়ান ঘুমাচ্ছে তাই আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আরোহি। তবে মেইন দরজা খোলা দেখে আরো বেশি অবাক হয়ে গেল। ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো আরোহি। বাড়ি থেকে কিছু দূরে ইহান দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার পায়ের কাছে কেউ একজন।কিছু টা এগিয়ে গেল আরোহি। আড়ালে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল কি হচ্ছে এখানে।তবে ইহান এর পায়ের কাছে ঐ ছেলেটাকে দেখে অবাক হলো।এ তো সেই ছেলেটা যে আরোহি কে অপমান করেছিল। ভালো করে শুনতে চাইল আরোহি। এই ছেলেটির সাথে ইহান কি কথা বলছে। শুনতে পেল,
“ভাই বিশ্বাস করেন আমি আজ ভাবির দিকে বাজে নজরে দেখি নি।সেই দিন আপনি যে মার মেরেছেন আমার পুরো ২৭ হাজার টাকা ডক্টর খরচে চলে গেছে। শুধু ভাবি কেনো আমি এখন কোনো মেয়ের দিকেই তাকায় না বিশ্বাস করেন।আমাকে ছেড়ে দিন ভাই। এবার থেকে কখোনো ভাবিকে দেখলে সাথে সাথে চোখ বুজে নেব আমি, কিন্তু আমাকে আর মারবেন না।”
কাদোঁ কাঁদো স্বরে বলে উঠল ছেলেটি।
“আমি জানি আজ তুই আরোহির দিকে খারাপ নজরে দেখিস নি।কিন্তু তোকে আমি ঠিক বিশ্বাস করি না রে রাজ! তাই তুই কালকে সকালেই এই শহর ছেড়ে চলে যাবি।না হলে কি হবে সেটা তো তুই জানিসই ”
বাঁকা হেসে বলল ইহান।
“ঠিক আছে ভাই। তাই হবে। আমি কালকেই চলে যাবো আপনি শুধু আমাকে আর মারবেন না।”
বলল রাজ নামের ছেলেটি।
“হুম।তুই যা এখন।আর আমাদের মধ্যে যা কথা হয়েছে সেটা যেন কেউ না জানে।এই কথাগুলো বলতেই তোকে ডেকেছিলাম।”
“আচ্ছা ভাই। যায় তাহলে।”
বলে চলে যেতে যাচ্ছিল রাজ নামের ছেলেটি। তবে তার আগে ইহান ওকে আটকালো। কিছু টাকা দিয়ে বলল,
“এখানে ২০ হাজার টাকা আছে।জানি তোর আরো বেশি খরচ হয়েছে কিন্তু ওটা তোর শাস্তি। আসলে আরোহির সাথে ঘটা ঘটনা টা শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছিল। তাই রাগের মাথায় তোকে ওভাবে মেরেছিলাম।তবে এটা ভাবিস না আমি অনুতপ্ত।আমি যেটা করেছি একদম ঠিক করেছি আর ভবিষ্যতে প্রোয়োজনে আবার ও করব।”
শেষের কথাটা বেশ শাসিয়ে বলল ইহান।
ইহানের কথা শুনে আবার ও ভয় পেয়ে গেল রাজ।কোনো রকম টাকাটা নিয়ে এক প্রকার পালিয়ে গেল।
রাজ চলে যাওয়ার পর ইহান ও ফিরে এলো।ইহানকে ফিরতে দেখে আরোহি ও তারাতাড়ি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে আরোহি।একটু আগে কি শুনল ও।ইহান ছেলেটাকে ওর জন্য মেরেছে।ভাবতেই মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করতে লাগল আরোহীর। তবে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না।পরক্ষনেই মনে পড়ে গেল মায়ার কথা।এই মেয়েটা ইহানের জীবনে সব।আরোহি কিচ্ছু না।মায়া ইহানের সন্তানের মা হয়েছে। ইহান যেটা করেছে শুধু কর্তব্য আর কিছু না।এসব নিজেকে বোঝাতে বোঝাতে ঘুমে তলিয়ে গেল আরোহি।
চলবে,