গল্পের নামঃতোমাতেই পূর্ণ আমি ❤
পর্বঃ০৩
লেখিকাঃজিন্নাত চৌধুরী হাবিবা
রাতের আধারে লক্ষ-কোটি তারার মাঝে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে মিনি,মন খারাপ থাকায় ব্যালকনিতে এসেছে, কিছুক্ষণ আগেই ওর বাবা,মা,ভাই সবাই বাসায় ফিরে গেছে তাই মন খারাপ মিনি আর স্পর্শ কাল যাবে মিনিদের বাসায়।
মিনি কাল রাত থেকে একবারও ব্যালকনিতে যায়নি, এখন ব্যালকনিতে এসে ভারাক্রান্ত মনটা হালকা হলো
স্পর্শ ঘরে এসে দেখে পুরো ঘর ফাঁকা,মেয়েটা গেলো কই ওয়াশরুমের দরজা খোলা তারমানে ওয়াশরুমে নেই,ব্যালকনির দরজায় নজর দিতেই হালকা একটু চুল আর শাড়ির আঁচল দেখতে পেয়ে বুঝলো মিনি ব্যালকনিতেই আছে
স্পর্শ ফ্রেশ হয়ে ধূসর রঙের একটা টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার পড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে,চোখে ঘুম ধরা দিতেই কারো কড়া গলার স্বরে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে মিনি কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে।
স্পর্শ বিরক্তি কন্ঠে ভ্রু কুচকে মিনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,সমস্যা কি তোমার….?
সমস্যা আমার না আপনার (মিনি)
মিনির দিকে প্রশ্ন বোধক চাহনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো স্পর্শ,,,
মানে…?
মানে আপনি বিছানায় কেনো (মিনি)
স্পর্শ বিরক্তি কন্ঠে বলল,দেখো ঘ্যানঘ্যান করবা না ঘুম আসছে ঘুমাতে দাও
আশ্চর্য আমি কি আপনাকে আটকে রেখেছি নাকি আপনার ঘুম আসছে আপনি ঘুমান কিন্তু বিছানায় না(মিনি)
আমার ঘর, আমার বিছানা আর আমাকেই বিছানায় ঘুমোতে দিবেনা.,,,,,হাউ ফানি,,,,শোনো মেয়ে কাল আমি কোন সিনক্রিয়েট করতে চাই নি তাই চুপচাপ সোফায় ঘুমিয়েছি তাই বলে যে আজও সেরকম হবে এরকম ভেবে ভূল করো না
তাহলে আমি কোথায় ঘুমাবো আমি কিন্তু সোফায় বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারিনা ঘাড়,কোমর ব্যাথা হয়ে যায় মুখ ছোট করে বলল মিনি
মিনির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্পর্শ বলল,বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ো ভয় নেই আমি ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছুড়িনা।
তারপরও যদি তোমার সন্দেহ হয় তাহলে মাঝে কোলবালিশ দিয়ে রাখো বলে স্পর্শ নিজেই মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে দিলো,
মিনিও আস্তে আস্তে হেঁটে অপর পাশে শুয়ে পড়লো, সারাদিন দু’জনের উপর অনেক ধকল যাওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।
সকালে আগে মিনির ঘুম ভাঙে হাই তুলতে তুলতে পাশে তাকিয়ে দেখে মাঝের কোলবালিশ নেই স্পর্শ ওর খুব কাছে এসে ঘুমিয়ে আছে কিছু সময় যাবত স্পর্শকে পরোখ করে নিতেই মিনির টনক নড়ে উঠলো,এই বেডা আমার এত কাছে কি করে বলেই স্পর্শকে এক ধাক্কায় খাটের নিচে ফেলে দেয়।
খাট থেকে আচমকা পড়ে গিয়ে স্পর্শ ঘাবড়ে যায় পরোক্ষণে ও নিচে কি করে পড়লো বুঝতে পেরে মেজাজ প্রচন্ড বিগড়ে গেল, সকাল সকাল এরকম কিছু হলে কার না মেজাজ খারাপ হবে।
কোমরে অনেকটা ব্যাথা পেয়েছে একে তো বিয়ের দিন রাতে সোফায় ঘুমিয়েছে তারউপর এখন ধাক্কা খেয়েছে, রাগে চোখ লাল করে দাঁতে দাঁত চেপে উঠে মিনির দুবাহু শক্ত করে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো,সমস্যা কি তোমার…..?
বিয়ের দিন থেকে তোমার সবকিছু সহ্য করেছি,কিচু বলছিনা বলে মাথায় উঠতে চাইছো….?আমাকে ধাক্কা দিলে কেনো..?এনসার মি,,,, ড্যাম ইট,,
স্পর্শ বেশ শক্ত করেই মিনির বাহু চেপে ধরেছে মিনির মনে হচ্ছে এই বুঝি শরীর থেকে হাত দুটি আলাদা হয়ে গেলো কিন্তু কিছু বলতে পারলো না স্পর্শের ভয়ে,গত দুদিনে স্পর্শের এরকম রাগ দেখেনি মিনি,ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না
মিনিকে চুপ থাকতে দেখে স্পর্শের রাগ যেন কয়েকগুন বেড়ে গেলো মিনিকে জোরে ঝাকিয়ে চিংকার করে বলে উঠলো স্পর্শ কি হলো উত্তর দিচ্ছোনা কেন…?
মিনি এবার ভয় জড়ানো কন্ঠে মুখ খুলে তোতলানো স্বরে বলতে থাকলো,
আ,,,স,,,স,,,লে ঘু,,ম,,থ,,থ,,থে,,কে
এই চুপ একদম তোতলাবেনা সুন্দর করে কথা বলো যদি তোতলাতে দেখেছি তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না
আসলে ঘুম থেকে
উঠে দেখি মাঝে কোলবালিশটা নেই আর আপনি আমার পাশ ঘেষে ঘুমিয়ে আছেন তাই কিছু না বুঝেই ধাক্কা দিয়ে ফেলি চোখ মুখ খিচে একদমে বলে শেষ করলো মিনি।
স্পর্শ তাকিয়ে আছে চোখ মুখ খিচে তার সামনে দাড়িয়ে থাকা মিনির দিকে, স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লেগে আছে মেয়েটার মুখে, তৈলাক্ত চেহারা,এলোমেলো চুল, চোখ মুখ ফোলা তারউপর খিঁচে চোখ বন্ধ করে রেখেছে,স্পর্শ যেন অদ্ভুত এক ঘোরে চলে গেছে
মিনির ডাকে হুস ফেরে স্পর্শের
হাত ছাড়ুন, আমার লাগছে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল মিনি
মিনির কথায় হাতের বাধন হালকা করে স্পর্শ কিন্তু ছাড়ে না
কি বলছিলে তুমি মাঝে কোলবালিশ ছিলো না লুক কোলবালিশ তোমার সাইডে মানে তুমি সরিয়েছো আর বাকি রইলো কাছে ঘেষে ঘুমানো আমি না তুমি আমার কাছে ঘেঁষেছো যদি আমিই তোমার কাছ ঘেষতাম আর কোলবালিশ সরাতাম তাহলে বালিশ আমার পাশে থাকতো আর আমাকে ধাক্কা দেওয়াতে আমি খাটের ওই পাশেই পড়তাম
স্পর্শের কথা শুনে মিনি বুঝলো এটা তার নিজেরই দোষ বাসায় একা একা ঘুমাতো তাই খাটের এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করলেও কোনো সমস্যা হতো না কিন্তু এখনতো আর একা না তাই আমতা আমতা করে বলল, আ’ম সরি!
স্পর্শ কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে
মিনি বসে বসে ভাবতে থাকে কি করলাম এটা আমি, আমি সত্যি একটা ডাফার বলে মনে মনে নিজেকে হাজার খানেক গালি দিতে থাকলো
স্পর্শ বেরুতেই মিনি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে, ফ্রেশ হয়ে এসে রুম খালি দেখে নিচে চলে যায় মিনি।
রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে তাহমিনা বেগম ব্রেকফাস্ট রেডি করছে আর কাজের মেয়েটি সাহায্য করছে, শাশুড়ীর পিছনে দাড়িয়ে মিনি বলল আমি হেল্প করি…
পিছনে ঘুরে মিনিকে দেখে তহমিনা চৌধুরী বলল ওমা মামনি উঠে পরেছো, যাও ডাইনিং এ গিয়ে বসো আমি নাস্তা দিচ্ছি আর তোমাকে কোনো হেল্প করতে হবে না আমার রান্না শেষ।
আচ্ছা তাহলে আমি সব ডাইনিং এ নিয়ে যাই
তাহমিনা চৌধুরী তাকাতেই মিনি কিউট ফেস করে বলল,প্লিজ মা
মিনির কিউট ফেস দেখে তহমিনা চৌধুরী হেসে দিয়ে বললেন ঠিক আছে
উত্তরে মিনি ও খিলখিল করে হেসে ওঠে
মামুন চৌধুরী এতক্ষণ ঘরে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন এখন ডাইনিং এর দিকেই আসছেন
গুড মর্নিং মামনি
গুড মর্নিংবাবা
তারপর মাহিরা ও নেমে এলো।
মাইশা কাল রিসিপশনের পরপরই শশুর বাড়ি চলে গেছে ওর শাশুড়ী অসুস্হ শশুর নেই,বেশি আসতে পারে না পরশু বাবা-মায়ের অনেক রিকোয়েস্ট এর ফলে বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য হাসবেন্ড পারমিশন দিয়েছিলো তারপরও ভাইয়ের বিয়ের সুবাদে আরো একটা দিন থেকে গেলো,
মাইশার হাজবেন্ড ব্যাবসার সুবাদে কিছুদিন আগে ঢাকার বাইরে গিয়েছে যার দরুন একমাত্র সালার বিয়েতে থাকতে পারলোনা।
মিনি একে একে ডাইনিং এ সব নিয়ে এসেছে এর মাঝে স্পর্শ ও চলে এসেছে সবাই চুপচাপ খাচ্ছে কেউ কোনো কথা বলছেনা,ডাইনিং এ পিনপিনে নিরবতা শুধু চামচ নাড়ার শব্দ হচ্ছে যেন কথা বললেই মহাভারত অসুদ্ধ হয়ে যাবে
মিনি নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে আজ আর আশেপাশে তাকাচ্ছে না যা করেছে যদি স্পর্শের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়..? তাহলে তো লজ্জায় শেষ হয়ে যাবে বেচারি।
কিহলো মামনি খাচ্ছো না কেনো (মামুন চৌধুরী)
আমার খাওয়া শেষ
সেকি তুমিতো কিছুই খেলেনা ভাবি (মাহিরা)
আমি এরকমই খাই
তাই বললে কি হবে নাকি আমাদের বাড়িতে এসব চলবে না বলে তাহমিনা চৌধুরী খাবার তুলে মিনিকে খাইয়ে দিতে থাকলেন
আমি কি নদীর জ্বলে ভেসে এসেছি নাকি আমাকে ও খাইয়ে দাও (মাহিরা)
তাহমিনা চৌধুরী আর মিনি হেসে দিলো
তারপর মাহিরাকে ও খাওয়াতে লাগলো।
স্পর্শের খাওয়া শেষ ও রুমে চলে গেলো।
গাড়িতে বসে আছে মিনি আর স্পর্শ উদ্দেশ্য মিনিদের বাসা
কথা ছিলো আদিল এসে ওদের দুজনকে নিয়ে যাবে যেহেতু স্পর্শ কখনো মিনিদের বাসায় যায় নি তাই চেনার কথাও না।
আদিলের হসপিটালে কাজ থাকায় স্পর্শকে অ্যাড্রেস দিয়ে দিলো তাছাড়া মিনিতো চিনেই তাই কোনো সমস্যা হবে না।
দীর্ঘ একঘন্টা সময় পেরিয়ে গাড়ি এসে থামলো মিনিদের বাসার সামনে, আদিলের দেওয়া অ্যাড্রেস অনুযায়ী চলে এসেছে স্পর্শ তাই মিনিকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন পড়ে নি।
পুরো রাস্তা কেউ কারো সাথে কথা বলেনি।
গাড়ি থামতেই মিনি দরজা খুলে এক দৌড়ে বাসার সামনে গিয়ে কলিং বেল টিপ দিলো।মিনির কান্ডে স্পর্শ কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে থেকে নিজেও গেলো মিনির পেছন পেছন।
অনবরত কলিংবেল বেজেই চলেছে বিরক্ত হয়ে মিসেস জামান(মিনির মা)গেলো দরজা খুলতে,দরজা খুলতেই বিরক্তি চলে গিয়ে ঠোঁটের কোন প্রসারিত হলো।
মাকে জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করেই মিনি ঘরে ঢুকে গেলো কারণ ও জানে ওর মা এখন ওর চেয়ে স্পর্শকে পাত্তা দিবে বেশি, শুধু মিনির মা নয় বাঙালি নারীরাই এরকম তাই দাড়িয়ে থেকে নিজেকে অপমান করতে চায় না মিনি
স্পর্শ এতক্ষণ মা মেয়ের ভালোবাসা দেখছিলো
কেমন আছো বাবা….? ভেতরে এসো।
বাসার ভেতর ঢুকতে ঢুকতেই স্পর্শ জবাব দিলো ভালো আছি আন্টি আপনি কেমন আছেন…?
ভালো বলেই জামাইয়ের খাতির যত্নের কাজে লেগে পড়লেন মিনির মা।
বাসার ভেতর ঢুকতেই মিনির কাজিনরা ঝাপটে ধরলো একটুর জন্য বেচারি পড়েই যাচ্ছিলো।ওদেরকে ছাড়িয়ে মিনি সোজা বাবার ঘরে গেলো, আদিল হসপিটালে
স্পর্শকে দেখে এবার মিনির কাজিনরা ওকে ঘিরে ধরলো, স্পর্শ পড়লো মাইনকার চিপায়, অল্প সময়ের মধ্যেই স্পর্শ হাপিয়ে গেলো
ও মনে মনে বলতে লাগলো এদের চেয়ে তো মিনির দুষ্টমি গুলো সহ্য করাই ভালো
বাবার সাথে কথা বলে বেরিয়ে এসে মিনি হলরুমের দিকে তাকিয়ে দেখে
একমাত্র সোয়ামি ব্যাটেলিয়নদের কব্জায় আটকা পড়েছে আর তার একমাত্র সোয়ামি যে প্রচন্ড বিরক্ত সেটা তাহার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
হঠাৎ স্পর্শের নজর পড়লো মিনির উপর তাই মিনিকে ইশারা করে বোঝালো ওকে এখান থেকে উদ্ধার করতে কারন মিনিই শেষ ভরসা।
স্পর্শের আশায় এক বালতি পানি ঢেলে শয়তানি হাসি দিয়ে চলে গেলো মিনি।
স্পর্শ যখন হতাশ তখনই তার জন্য দূত হয়ে এলো তার শশুর মশাই, আসাদ জামান সবাইকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে স্পর্শকে মিনির ঘরে পাঠিয়ে দেন রেষ্ট নেওয়ার জন্য,,,,,,,
চলবে…….