তোমাকে বলার ছিল…….
নবম পর্ব
-এহ ! এত ছোট প্লেটে দেয় I বলে তিনজন খাওয়া যাবে কিন্তু যা কোয়ান্টিটি তাতে দুজনের ও হবে না I
নুডুলস আসার পর বেশ বিরক্ত কন্ঠে কথাগুলো বলল মামুন I তৃণা কোন জবাব দিল না I ওর মাথাব্যথা আরো বেড়েছে I উঠে যেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সেটা এখন সম্ভব না I মামুন প্রথমে নিজের প্লেটে নুডুলস নিল I অর্ধেকের বেশি বাটি খালি করে দিল I তারপর তৃণার দিকে তাকিয়ে বললো তুমিও নাও I তৃণা একটুখানি তুলে নিল I ওর খাওয়ার ইচ্ছা মরে গেছে I কত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হওয়া যায় সেই চিন্তা মাথায় ঘুরছে I একটুখানি নুডুলস নিয়ে নাড়াচাড়া করছে খেতে ইচ্ছা করছে না I তৃণা তাকিয়ে দেখল মামুন গোগ্রাসে গিলেই যাচ্ছে I বেশ অনেকক্ষণ পর যখন প্লেট প্রায় খালি তখন তার খেয়াল হল I তৃণার দিকে তাকিয়ে বলল
– আরে তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না I আরেকটু নাও I
– না আমি ঠিক আছি
– আচ্ছা তাহলে আমি বাকিটা নিচ্ছি I নষ্ট করে কি লাভ I
মামুন প্লেটের পুরোটাই ঢেলে নিতে গেল I তারপর কি একটা ভেবে খানিকটা ছেড়ে দিল প্লেটেই I দ্রুতই প্লেটের খাবার শেষ করে আয়েশ করে কোকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল
– তুই বাকিটা নিয়ে নাও
– না আমার খাওয়া শেষ
– তাহলে পার্সেল করে দিতে বলি ? বাসায় নিয়ে যাও I
তৃণা তাকিয়ে দেখল বড়জোর দুই টেবিল চামচ এর মতন নুডুলস পড়ে আছে I ও বলল
– বাসায় আরও লোক আছে I এইটুকু খাবার আমি নিয়ে যাব না I আমি বরং একটা পুরো অর্ডার দিচ্ছি I
মামুন ওয়েটারকে ডেকে প্লেটে পড়ে থাকা খাবারটা পার্সেল করে দিতে বললো I আর তৃণা আরেকটা নুডুলস অর্ডার দিল I অনেকক্ষণ থেকে তৃণার ফোন বাজছে I তৃণা ব্যাগের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখল হিয়া ফোন দিচ্ছে I এখন ধরা যাবেনা I তৃণা ছোট্ট একটা টেক্সট করে দিল
– একটু বিজি আছি I পরে ফোন দিচ্ছি
মেসেজ পাঠানোর পর খেয়াল করলো আরো একটা মেসেজ এসেছে সুজনের I ও লিখেছে
বিকেলে কি ফ্রি আছো I তোমাকে স্টেরিও কেমিস্ট্রির কয়েকটা স্ট্রাকচার বুঝিয়ে দিতাম I ফোনে দেখানো সম্ভব নয় I সামনা সামনি হলে ভালো হতো I ফোন দিও
তৃণা বুঝতে পারছে না I সুজন হঠাৎ ওকে পড়ানোর সময় এমন খেপে উঠল কেন I
– কোন সমস্যা তৃণা ?
– না আসলে আমার ফ্রেন্ড এর সঙ্গে লাইব্রেরীতে যাওয়ার কথা I ওই মেসেজ দিচ্ছে
– ও আচ্ছা তাহলে ওয়েটারকে তাড়াতাড়ি করতে বলি
মামুন ওয়েটারকে বিল নিয়ে আসতে বলল I ওয়েটার বিল আর পার্সেল দুটো এনে টেবিলে রাখল I বিল দেখে মামুনের ভূরু কুঁচকে গেল I ও বিরক্ত গলায় বলল
– আমার হিসাব অনুযায়ী তো 730 টাকা হওয়ার কথা I চৌদ্দশ 50 টাকা আসলো কোত্থেকে ? ওয়েটার বলল
– স্যার দুইটা নুডুলস আর দুইটা কোক
মামুন একগাল হেসে বলল
– ও, একটা নুডুলস ম্যাডামের I আমাকে শুধু একটা নুডুলস আর দুইটা কোকের বিল দিন
ওয়েটার এবং তৃণা দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেল I একটা মানুষ এতটা চক্ষুলজ্জাহীন কি করে হয় তৃণা ভেবে পেল না I ও ব্যাগ থেকে পনেরশো টাকা বের করে ওয়েটারকে দিল I তারপর হেসে বলল বাকিটা আপনার টিপস I এরপর পার্সেল হাতে নিয়ে ব্যাগ কাঁধে তুলে বেরিয়ে গেল I বাইরে এসে মনে হলো নিঃশ্বাস নিতে পারছে I মামুন হতদন্ত হয়ে পেছনে ছুটে এসেছে I
– তুমি বিল দিলে কেন ? আমিতো দিচ্ছিলাম
– সমস্যা নেই এবার না হয় আমি দিলাম
মামুন খুশি খুশি গলায় বলল
– ঠিক আছে I পরের বার কিন্তু আমাকে দিতে দেবে কেমন ?
তৃণা বললো
– আমি আজকে যাই I আমার একটু তাড়া আছে I
– চলো তোমাকে নামিয়ে দেই I আমি তোমাদের বাসার দিকে যাচ্ছি
– আমি বাসায় যাবো না উল্টো দিকে যাব লাইব্রেরীতে I শুধু শুধু আপনার রিক্সা ভাড়া বেশি খরচ হবে I
-তুমি তো কিছু বললেনা
– কি বিষয় ?
– এই আমাদের ব্যাপারে আর কি
তৃণা ক্লান্ত গলায় বলল
– মামুন ভাই I সামনে আমার পরীক্ষা I আপাতত এই বিষয়টা থাক
– হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে I পরীক্ষা শেষ হোক তারপর না হয় ঠান্ডা মাথায় বসা যাবে I
– আচ্ছা আমি যাই তাহলে
তৃষা জবাবের অপেক্ষা না করে একটা রিক্সায় উঠে গেল I টিএসসির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়লো আজকে তো ওদের ফাইনাল রিহার্সেল I পাঁচটার সময় I মনেই ছিল না I ফাইনাল গেটআপে আসতে বলা হয়েছে ঠিক যেমনটা প্রোগ্রামের দিন হবে I ওফ ! মনেই ছিল না এসব ঝামেলায় I তৃণা ঘড়ি দেখল I এখনো 2 ঘণ্টা আছে I যাক কিছুটা সময় পাওয়া গেল I
তৃণা রোকেয়া হলের সামনে এসে মিথিলাকে ফোন দিল I মিথিলা ওর কলেজ জীবনের বান্ধবী I সোসিওলজিত পড়ে I তৃণার কখনো হলে থাকতে হলে ওর রুমেই থাকে I মাঝে মাঝে দুপুরে এসে বিশ্রাম নেয় I গ্রুপের কোনো প্রোগ্রাম থাকলে এখান থেকেই রেডি হয়ে যায় I এখানে ওর এক সেট জামা আর কিছু শাড়ি রাখা আছে I কলেজ জীবনে মিথিলাকে নানান ভাবে সাহায্য করেছে তৃণা I মেয়েটা মনে রেখেছে I তৃণা এলে কখনো বিরক্ত হয়না I ভালোই আদর যত্ন করে I ফোন দিয়ে জানা গেল মিথিলার রুমেই আছে I
তৃণা ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেল I লম্বা সময় ধরে গোসল করলো I মাথাব্যথা অনেকটাই কমেছে I ভেজা চুল আচরে মুখে ক্রিম মেখে তৃণা শাড়ি গুলি নেড়েচেড়ে দেখছিল I সবুজ রঙের শাড়ি পড়তে হবে আজ I শুভঙ্কর নন্দিনীর একটা কথোপকথন করবে ওরা I এবার পিয়াস ভাই ওর সঙ্গে থাকবে শুভঙ্কর চরিত্রে I তৃণার একটু বিরক্ত লাগছে I আগামী সপ্তাহে প্রোগ্রামের পরে একটু ব্রেক নেবে ঠিক করল I পরীক্ষা চলে এসেছে I পরীক্ষা শেষ করে দেশে গিয়ে কিছুদিন দাদির সঙ্গে থাকবে I দাদির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না I সেদিন ফোনে কথা বলে মনে হলো মনটা অনেক দুর্বল হয়ে গেছে I এই পৃথিবীতে একমাত্র একজনই আছে যে ওকে সত্যিকারের ভালবেসে I
চারটা বেজে গেছে I তৃণা আস্তে আস্তে পোশাক পাল্টে শাড়ি পড়ে নিল I গাঢ় করে কাজল দিলে চোখে I এই সবুজ শাড়িটা ওকে হিয়া উপহার দিয়েছিল I হঠাৎ করেই হিয়ার জন্য খুব মন কেমন করতে লাগলো I এতবার ফোন দিচ্ছিল I কোন সমস্যায় পড়েনি তো ? তৃণা রেডি হয়ে হিয়াকে ফোন দিল I ফোন ধরে হিয়া বললো
– তুই কি আমার উপর এখনো রেগে আছিস ?
– নারে I একটু কাজে বিজি ছিলাম
-কী নিয়ে এত বিজি ?
– আজকে ফাইনাল রিহার্সেল I
-হলে থাকবি রাতে ?
– হ্যাঁ
– আমিও চলে আসি তাহলে I সারারাত আড্ডা দেয়া যাবে I মিথিলার রুমেই আছিস তো ?
– হ্যাঁ
– ঠিক আছে আসলে দেখা হবে তাহলে I আটটার পরে আসবো I
– আচ্ছা আয়
হিয়ার সঙ্গে কথা বলে মনটা খুব হালকা লাগছে I আবারও ফোন বাজছে I হিয়া হয়তো কিছু বলতে ভুলে গেছে I সব সময় এমন করে ও I ফোন ধরে তৃনা একটু অবাক হল I হিয়া নয় সুজন ফোন করেছে I
– তুমি আমার ম্যাসেজ পেয়েছো ?
– হ্যাঁ পেয়েছি I আজকে বোধ হয় আর বসা হবে না I আমার রিহার্সাল আছে I
– টিএসসিতে ?
– হ্যাঁ
– আমি কি তোমার রিহার্সাল দেখতে আসতে পারি ? আমি উল্টোদিকেই লাইব্রেরীতে আছি
– রিহার্সাল খুব বোরিং ব্যাপার I ফাইনাল প্রোগ্রাম এর দিন এস I আমার ঘন্টাখানেকের কাজ I শেষ হয়ে গেল তখন তোমাকে ফোন দেই I সময় থাকলে আমাকে একটু পড়াটা দেখিয়ে দিও I
– আচ্ছা I ফোন দিও আমাকে শেষ করে
– ওকে
বাংলা ডিপার্টমেন্টের চারুদি গ্রুপের বেশ সিনিয়র মেম্বার I তৃণাকে খুব স্নেহ করেন I ওকে ঢুকতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন
– তোকে আজকে যা লাগছে না I পিয়াস এর তো পুরো মাথা নষ্ট হয়ে যাবে I
– আহ ! চারুদি কি শুরু করলে
– দেখ তোর শুভঙ্কর কেমন সেজেগুজে এসেছে
তৃণার খুব অস্বস্তি হচ্ছে I রিহার্সালের সময়ে অস্বস্থি আরো বাড়লো I পিয়াস বারবার গা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে I রিহার্সাল শেষ করে কানের কাছে এসে বলল
– তুমি আমাকে সেদিন মিথ্যা কথা বললে কেন ?
– কি মিথ্যে ?
– তুমি যাকে তোমার বিশেষ বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিলে সে তো তোমার বান্ধবীর লাভার
তৃণার অসম্ভব মেজাজ খারাপ হয়ে গেল I এ ধরনের ব্যক্তিগত আলোচনা ওর একেবারেই পছন্দ না I তারপরে আবার এমন একজনের কাছ থেকে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব পর্যন্ত নেই I তৃনা ফোন বের করে সুজনকে টেক্সট করল
আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে I তুমি কি একটু ভেতরে আসতে পারবে ?
সাথে সাথে জবাব এলো আসছি
সুজন ভিতরে ঢুকে যে কাজটা করলো সেটার জন্য তৃনা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না I গ্রুপের সবাই তখন রিহার্সাল শেষ করে চা সিঙ্গারা আনিয়েছে I সুজন ভেতরে এসে সোজা তৃণার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরলো I তারপর বলল
– চলো যাই অনেক দেরি হয়ে গেছে
গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্যই তৃণার জুনিয়ার I ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে I ফাইনাল ইয়ারের চারুদি ও অবশ্য আছে I সবাই বেশ অবাক হয়ে গেল I সুজন সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে তৃণার দিকে ফিরে বলল
– তোমার গ্রুপ মেম্বারদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবে না
তৃণা ভেবে পাচ্ছেনা সুজন হঠাৎ এরকম আচরণ কেন করছে I বরাবরই ও মুখচোরা আর লাজুক স্বভাবের I তৃনা একটু অস্বস্তি নিয়ে সবার সঙ্গে সুজনের পরিচয় করিয়ে দিল I তাকিয়ে দেখল পিয়াস ভাইয়ের মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে আছে I জুনিয়ার একজন জিজ্ঞেস করল
– ভাইয়া আপনিও কি আবৃত্তি করেন ?
– না আমি কবিতা পড়ি আর শুনি I আবৃত্তি করি শুধু নিজের জন্যই
চারু দি বলল তোমার ভয়েস টোন কিন্তু খুব ভালো I তা আজকে আমাদের তৃণার জন্য কিছু শোনাও দেখি I
তৃনা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সুজন বলল
হ্যাঁ নিশ্চয়ই
তারপর বেশ আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে আবৃত্তি করল
‘সংকোচে জানাই আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার –
আজ দেখি অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে …’
তৃনা হতভম্ব হয়ে গেল I এসব কি হচ্ছে ?
চলবে……….
লেখনীতে
অনিমা হাসান
এই পর্বে যে কবিতাটা ব্যবহার করা হয়েছে তার নাম ‘স্নান’ লিখেছেন জয় গোস্বামী