তোমাকে ঠিক চেয়ে নিবো পর্ব-০৮

0
1562

#তোমাকে ঠিক চেয়ে নিবো
লেখা আশিকা জামান
পর্ব। ০৮

“প্রতিক্ষা কালসন্ধ্যেবেলায় দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে এ কেমন ধারা শোয়া? আলো জ্বালাস নাই কেন।”

শিউলি বেগম বেশ শব্দ করেই লাইটটা অন করলেন।
ঠাস ঠাস শব্দে জানালার গ্লাস খুলতে লাগলেন।

লাইটের তীক্ষ্ণ আলো প্রতিক্ষার চোখে পড়তেই চোখ ছোট হয়ে গেল। আস্তে আস্তে চোখ খুলতে লাগলো।
শোয়া থেকে মা ওকে টেনে তুললেন।
” নামাজ কালামের খবর নাই ভর সন্ধ্যেবেলায় হেডফোন কানে দিয়া শুয়ে আছে!”

” আম্মু আজান দিয়া দিছে? কখন শুনলাম নাতো?”

“শোনবা কেমনে হেডফোন কানে দিয়া রাখলে।”

শিউলি বেগম মেয়ের কান থেকে হেডফোন টান দিয়া খুলে নিলেন।
প্রতিক্ষা নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকলো যেন এই মূহূর্তে এটাই হওয়ার কথা ছিল।

” নামাজ পড়া শেষ করে রুমে আইসো তোমার আব্বু কথা বলবেন তোমার সাথে।”
কথাটা বলেই হন হন করে চলে গেলেন শিউলি বেগম।।

নামাজ পড়া শেষ করে প্রতিক্ষা আব্বু আম্মুর রুমে উকি দেয়। কি এক বিষয় নিয়া যেন ফিসফিস করে কথা বলছিলো। তেমন কিছুই শুনতে পাচ্ছিলোনা।
” পিউ দরজার আড়ালে কেন ভিতরে আসো।”
প্রতিক্ষা ভিতরে আসলে সোলাইমান সাহেব মেয়েকে কাছে নিয়া বসাললেন।

” আচ্ছা যা বলার জন্য ডেকেছিলাম। তোমাদের ডিপার্টমেন্ট এর রিজভী স্যারকে তুমি চেনো।”

প্রশ্নটা এতোটাই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো যে ও ঘাবড়ে গেল।
ওর চোখমুখে স্পষ্ট বিস্ময় ফেটে পড়লো। আচ্ছা বাবা হঠাৎ রিজভী স্যারের কথা জিজ্ঞাস করছে কেন?
ভাবনাটায় বেশিক্ষণ বুধ হয়ে থাকতে পারলো না। তার আগেই শিউলি বেগমের ধৈর্য্যের বাধণ ভেংগে যায়। চোখ উল্টিয়ে বলতে লাগলেন,
” কি হলো কথা বলিস না কেন।”

” হ্যা সপ্তাহে দুইদিন ওনার ক্লাস আছে। কিন্তু হঠাৎ ওনার কথা জিজ্ঞাস করছো কেন?”

” কারণ আছে তাই। তোমার আব্বু যা যা জিজ্ঞাস করবে ঠিকঠাক উত্তর দাও।”

” আচ্ছা দেখতে কেমন? স্বভাবচরিত্র কেমন?”

” দেখতেতো ভালোই। আর কার স্বভাব কেমন তা আমি কি করে বলবো। প্রায় সবারিতো বাহিরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট থাকে।”
প্রতিক্ষা বেশ উচ্চস্বরেই কথাটা বললো।

সোলায়মান সাহেব চুপ করে গেলেন। বরাবরের মতই তিনি খুব শান্তিপ্রিয় নীরিহ মানুষ।

” তোমাকেতো সবার কথা বলতে বলা হয়নি।
যেহেতু তোমার টিচার সেহেতু তার পারসোনালিটি সম্পর্কে কোন ধারণা তোমার থাকতেই পারে তাই এই কুয়েশ্চন করা।
তবে তোমার ধারণার উপর ভিত্তি করেই যে বাকী সিদ্ধান্তগুলোও নিবো এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। ”
গমগম করে কথাগুলো বলে দিলো শিউলি বেগম।

” মানে কি?
কিসের সিদ্ধান্ত? ”
ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিলো প্রতিক্ষা।

” তুমি বড় হয়েছো এখনতো আর ঘরে বসিয়ে রাখলে চলবেনা। বিয়ে শাদীতো দিতে হবে।
তোমার ওই স্যারের বাসা থেকে বিয়ের প্রপোজাল এসেছে। আমরা খোজ খবর নিয়েছি সব দিক থেকেই মাশ আল্লাহ পার্ফেক্ট। আর প্রিয়ম গিয়ে দেখেও আসছে রিজভীকে তার বেশ প্রছন্দ হয়েছে। আমাদের দিক থেকেও উত্তর পজিটিভ। এ বিষয়ে তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।”

প্রতিক্ষার মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়লো। এত কিছু কখন কি করে হলো ও কিছুই জানতে পারলোনা।
রিজভী স্যার তারমানে তলে তলে এই কয়েকদিনে এইগুলাই করেছে। ও ভেবেছিলো রিজভীর মাথা থেকে ওর ভুত বোধ হয় নেমেছে। কিন্তু ও যে ভুল সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
প্রতিক্ষা কোন কথা না বলেই দ্রুত ওখান থেকে চলে আসে।
সোলায়মান সাহেব খুবই অবাক এবং সাথে চরম আহত হলেন মেয়ের এই ধরনের ব্যাবহারে। পিউ বরাবরের মতই বাধ্য মেয়ে কথার মাঝখানে দুম করে উঠে যাওয়ার মতো মেয়ে ও নয়। হঠাৎ কি এমন হয়ে গেলো যার জন্য এই বেয়াদবিটা করতেই হলো। বিষয়টা তাকে খুবই ভাবাচ্ছে। তিনি স্ত্রীর দিকে ইশারা করলেন মেয়ের রুমে যাওয়ার জন্য।
স্বামীর দিক থেকে সিগন্যাল পেয়ে শিউলি বেগম প্রতিক্ষার রুমের দিকে যেতে লাগলেন।

রুমের অবস্থা দেখে চোখ কপালে উঠলো শিউলি বেগমের। বিছানা এলোমেলো, বালিশ, কাথা, বেডসিট সব মেঝেতে পড়ে আছে।
কাপড়চোপড় আলমারি থেকে বের করে ফ্লোরে ছড়ানো। কোন একটা ঝড়ের পূর্বাভাস সে খুব ভালোভাবেই আচঁ করতে পারছে।
প্রতিক্ষাকে রুমে না পেয়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায় ।
কোনকিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে চমকে উঠে শিউলি বেগম।
সামনে তাকাতেই ফ্লোরে ফোন পড়ে থাকতে দেখলেন। ফোনটা তুলে নিয়ে আলতো করে প্রতিক্ষার পিঠে হাত রাখলেন।
” নাও ফোন ধরো।”
প্রতিক্ষা নিঃশব্দে ফোনটা হাতে তুলে নেয়।
” কি সমস্যা তোমার?
যদি খুলে না বলো তাহলে বুঝবো কিভাবে। ”

” আমি আমি…”

“কি তুমি?”

আমি এখন বিয়ে করতে পারবোনা আম্মু।

“কেন?
সমস্যা কোথায়?”
রিজভীকে কি তোমার প্রছন্দ নয়?”

“ঠিক তা নয়।”
আমি এখন বিয়ে করার জন্য প্রিপেয়ার্ড নই আম্মু। বুঝতেছেনা কেন?”

শিউলি বেগমের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হলো এমন কথা সে জীবনে কোনদিনও শোনেনি।

” দেখ তোমাকে বিয়ে করতে বলা হচ্ছে। পরীক্ষা দিতে বলা হয়নি যে প্রস্তুতির দরকার পড়বে। তাছাড়া আমারোতো ক্লাস নাইনে থাকতে বিয়ে হয়েছে কই কোন প্রিপারেশন ঠিপারেশনের দরকারতো পড়েনি। এমনকি তোর বাপকে চিনতামও না। দিন দিন তোদের যতো সু্যোগ দেয়া হয় ততো অপব্যাবহার এর মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। লেখাপড়া শিখছো বলে যা নয় তাই করবা আর আমরা মেনে নিবো? ”

” আম্মু প্লিজ আমি এখন বিয়ে করতে পারবোনা লাস্ট বারের মত বলছি।”

” আচ্ছা তোর কি মনে হয় আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি। যদি এই বাড়ীর মেয়ে হয়ে থাকো তাহলে বেলাল্লাপনা চলবে না। বিয়ে করতে পারবানা প্রেম করতে ঠিকি পারবা তাইনা!”

” অদ্ভুত আমি কার সাথে প্রেম করলাম?”

” ও মা তুমিতো দেখি ভাজা মাছটাও উল্টিয়েও খেতে পারোনা।
তোমার আর রিজভীর যে কোন সম্পর্ক নেই এটা আমি কেন বিশ্বাস করবো মা জননী। এটা পুরাই অবিশ্বাস্য!
যাই হোক ছেলেটা ভালো তাই বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে।
আর তুমি!
এই তোমাদের যুগের মেয়েদের মত বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ করার নেশায় উন্মত্ত হয়ে আছো।
এইগুলা এইখানে এলাউ না।
শোন পরশুদিন রিজভীর ফ্যামিলি থেকে মানুষজন আসবে। সব ঠিকঠাক থাকলে বিয়েটাও ওইদিন ও হয়ে যেতে পারে।
মনে মনে প্রিপারেশন নিয়ে নাও। আর একটা কথা নো হাংকি পাংকি।”
শিউলি বেগম মেয়ের মাথায় আংগুল দিয়ে একটা গুতো মেরে সেখান থেকে চলে গেলেন।

প্রতিক্ষা ডুকরে কেঁদে উঠলো। ওর ইচ্ছে হচ্ছে রিজভীকে ফোন করে ইচ্ছেমত ঝাড়ি দিতে। কিন্তু আফসোস ও যে সেটাও পারে না। না পারে মনের কথা কাউকে বুঝাতে না পারে চুপচাপ সবকিছু মেনে নিতে। তাছাড়া কোন কারণতো নেই বিয়েটা আটকানোর। কেন বিয়েটা করবে না ও? প্র‍্যাক্টিকেলিতো করাই উচিৎ।

————————————

আজকে একরোখা জেদের বশেই প্রহর ফোনটা ধরেনি। আজকাল জেদটা ওর মধ্যে খুব প্রভাব ফেলছে। অবশ্য ওর ইগোতে খুব লেগেছিলো সেদিন।
খুলনা থেকে ময়মনসিংহ এসেছিল শুধু প্রতিক্ষার সাথে একসাথে বাড়ী ফিরবে এই আশায়। অন্তুত জার্নিতে ভালো সময় কাটবে। বরাবরের মতো বোরিং জার্নিটা হবে আনন্দময়। ওর প্রবল বিশ্বাস ছিলো ওর ডাকে প্রতিক্ষা ঠিক আসবে। কিন্তু না ওকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বেশ জোড়ালেভাবেই প্রতিক্ষা না করেছে।
কেন এই আবদারটুকু কি খুব অন্যায় আবদার হয়েগিয়েছিলো?
ও কি বাঘ না ভাল্লুক?
যেন আসলেই খেয়ে ফেলবো

সেই থেকে ও ভেবেই নিয়েছে প্রতিক্ষাকে আর জীবনেও ফোন করবে না।
হ্যা ও তা করেও দেখিয়েছে। এই কয়েকদিনে প্রতিক্ষার সাথে কোনরকম যোগাযোগই ও রাখেনি।

কিন্তু প্রতিক্ষার আসা ফোনকল যে ওকে এলোমেলো করে দিয়ে গেল। ওর গুছানো জীবনটা আবার এলোমেলো হতে লাগলো। মনটা বারবার আকুলিবিকুলি করতে লাগলো প্রতিক্ষার কথা শোনার জন্য।
প্রহর দুম করে ফোনটা করেই বসলো…

” ফোন দিয়েছিলে কেন? ”

” আপনি আমার সাথে একবার দেখা করতে পারবেন?”

” আমার সাথে দেখা করাটা কি খুব জরুরি?
তাছাড়া আমিতো আবার তোমাকে খেয়ে ফেলবো ।
শিকার বাঘের গুহায় নিজে থেকে ধরা দেয়া!
স্ট্রেঞ্জ! সাহসটা কি বেশি হয়ে যাচ্ছে না।”

” হয়তো?”

” বাট সরি টু সে আই হ্যাভ নো টাইম।”
প্রহর জাস্ট ওইদিনের রিভেঞ্জ নেয়ার জন্যই কথাটা বললো।”

” সময় না বড় অদ্ভুত। সবকিছু উলটপালট করে দেয়।
শুধু লাস্টবারের মতো আপনাকে দেখতে চেয়েছিলাম জাস্ট এটুকুই।
জানেনতো কালকের পর থেকে আপনাকে নিয়ে হয়তোবা আর ভাবোবার সময় পাবো না?
কিন্ত মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেলে ঠিক আপনার কথা মনে হবে। তখন জানিনা কি করে নিজেকে সামলাবো। হয়তোবা এই বেহায়া সময়ই সব ঠিক করে দিবে। বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে ভুলতে চাই না। কিন্তু পরিস্থিতি কোনকালেই আমার অনুকুল ছিলো না।
জানেন আপনার সাথে কাটানো তেমন কোন স্মৃতি আমার নেই। আজকে না বড্ড আফসোস হচ্ছে কেন সেদিন আপনার সাথে আসলাম না।
আমি না বড্ড দুঃখবিলাসি। দুঃখবিলাস আমার রাজত্ব জানেন প্রতিবার শুধু আপনিই আমার রাজা হয়েছেন। দুঃখের মাঝেও এক অন্যরকম সুখ সুখ অনুভুতি রয়েছে। যা সবাই বোঝতে পারেনা। ”

ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ আসছে না।
প্রতিক্ষা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

” জানেন কালকে যদি আপনি আসতেন তাহলে আমার মেমোরিতে অন্যরকম একটা দিন যোগ হতো। সারাজীবন এই স্মৃতিগুলোই আমার বেচেঁ থাকার অবলম্বন হয়ে থাকতো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুযোগ পেলেই কল্পনায় রং তুলি মিশিয়ে আঁকতাম স্মৃতিগুলে।
ভালো থাকবেন। ”

প্রহর নিজের জেদের কাছে হেরে গেছে। যে করেই হোক প্রতিক্ষার সাথে দেখা করতেই হবে। কিন্তু কালকে যে স্নিগ্ধাদের বাসায় যাওয়ার ডেট।
কি করবে এখন?
গোল্লায় যাক গোটা দুনিয়া।
পিউ এর কথাগুলো কেমন জড়িয়ে আসছিলো।ওর কিচ্ছু ভালো লাগছেনা।
ও কালকে পিউ এর সাথে মিট করছে এটাই ফাইনাল।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে