#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৬
🤍🌸
.
.
.
.
দেখতে দেখতেই কেটে গেলো মাঝখানে আরো দুই সপ্তাহ। সোহেল কে হস্পিটালে এডমিট করা হয়েছে। তার অবস্থা খুব খারাপ। তবে মেহরাম সবসময় তার পাশে থাকে। মেহরামের বাড়ি থেকে সবাই দুই দিন পর পরই আসে সোহেল কে দেখার জন্য। যখন সোহেল কে হস্পিটালে ভর্তি করানো হয় তখন আয়ুশ এসেছিলো তাকে দেখতে। তবে সোহেল যেন তার এই মৃত্যু কে হাসিমুখে আপন করে নিয়েছে। মেহরাম সোহেলের কাছে থাকলে সোহেল বাকি সব কথা ছেড়ে ছুড়ে শুধু তাদের অনাগত বাচ্চার কথাই বলে। তাদের বেবি এমন হবে তেমন হবে কতো কথা। মেহরাম যথেষ্ট স্ট্রং একজন মেয়ে, আর তা তাকে দেখেই বুঝা যায়। নয়তো এতো সব কিছু সহ্য করে এভাবে এগিয়ে যাওয়া চারটে খানিক কথা না। আর রইলো সোহেলের কথা সে তো নিরব দর্শক। যা হচ্ছে যেমন হচ্ছে সব মুখ বুজে দেখছে। তবে সোহেল এতো গুলো দিনে আয়ুশের ব্যাপারে এটা কনফার্ম হয়েছে যে আয়ুশ যথেষ্ট ভালো আর বিশ্বাসী একজন। কেননা আয়ুশ এখনো মেহরামকে বে-ইন্তেহা ভাবে ভালোভাবে। মেহরাম তার ভালোবাসা, জিদ না। আয়ুশ চাইলেই ভুল কিছু করতে পারতো, অন্যায় করতে পারতো। কিন্তু সে তা ভাবেও নি কখনো করবে তো দূর। মেহরাম একসময় একদম সঠিক একজন কে ভালোবেসেছিলো। হয়তো এখনো ভাসে কিন্তু চারিদিকের সব বাধ্য-বাধকতা থাকার ফলে চাপা পরে গেছে।
সোহেল হস্পিটালের বেডে শুয়ে আছে, তখন মেহরাম খাবার নিয়ে এসে তার পাশে বসলো..
মেহরাম;; নিন হা করুন।
সোহেল;; মেহরাম খেতে ইচ্ছে করতে না, মুখে কিছুই ভালো লাগে না।
মেহরাম;; হ্যাঁ ওইতো একটু ব্লাড গিয়েছে তো তাই এমন লাগছে। আর মেডিসিন খেতে হবে তো জলদি এটা খান।
সোহেল;; মেহরাম ভালো লাগছে না পরে খাবো।
মেহরাম;; দেখুন প্লিজ বাচ্চাদের মতো জেদ করবেন না।
সোহেল;; তুমি খেয়েছো?
মেহরাম;; হ্যাঁ আমি বাসা থেকেই খেয়ে এসেছি।
সোহেল;; মা কেমন আছে? কি করে?
মেহরাম;; আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছে। আজ আসতে চেয়েছিলো কিন্তু জানেনই তো উনার শরীর তেমন ভালো না তাই বাড়িতেই রেখে এসেছি।
সোহেল;; ভালো করেছো। অযথা চিন্তা করে।
মেহরাম;; এগুলো অযথা চিন্তা?
সোহেল;; তা নয়তো আর কি!
মেহরাম;; হয়েছে বুঝলাম এবার প্লিজ খান।
মেহরাম সোহেল কে খাইয়ে দিতে থাকে। খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে দেয়। বিকেলের দিকে হঠাৎ তনু আসে। এসে সোহেলের সাথে অনেক কথা বলে। খানিক বাদে ডাক্তার এসে সোহেল কে কিসের যেন একটা ইঞ্জেকশন দেয়। সোহেল রেস্ট নিতে থাকে। তনু & মেহরাম হস্পিটালের করিডরে গিয়ে দাঁড়ায়। দুই বোন এক সাথেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তেমন কথা নেই দুজনের মাঝে।
তনু;; পরিস্থিতি মানুষকে কি থেকে কি করে দেয় তাই না মেহরু!?
মেহরাম;; পরিস্থিতি যেমনই হোক নিজেকে আগে ঠিক থাকতে হবে, ভেংগে পড়লে চলবে না।
তনু;; তুই কি রোবট?
মেহরাম;; তা কেন হতে যাবো?
তনু;; কিভাবে ঠিক আছিস তুই। ভাইয়ের এই অবস্থা তুই, তুই প্রেগন্যান্ট।
মেহরাম;; আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া একটা পাতা পর্যন্ত নড়ে না। হয়তো আল্লাহ আমার ভাগ্যে এগুলোই লিখেছে তাই এমন হচ্ছে। মেনে নিলাম আমি।
তনু এবার হু হু করে কেদে দেয়। মেহরাম তনুর কাছে গিয়ে তার চোখের পানি গুলো মুছে দেয়। তনু শক্ত ভাবে মেহরাম কে জড়িয়ে ধরে। মেহরাম কোন মতে চুপ করায়। আর এক সময় বাসায় পাঠয়ে দেয়। মেহরাম সোহেলের কেবিনে যায়। গিয়ে দেখে সোহেল গভীর ঘুম। মেহরাম তার কেবিনের মাঝেই পায়চারি করতে থাকে। কেবিনে ভালো না লাগলে সামনের থাই গ্লাস টা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তখনই তার মাথা টা কেমন এক চক্কর দিয়ে ওঠে। মেহরাম সামলে নেয়। তার কিছুক্ষণ বাদেই সোহেলের ডাক পরে। মেহরাম জলদি করে যায়।
সোহেল;; কোথায় গিয়েছিলে?
মেহরাম;; কোথাও না।
সোহেল;; কি হয়েছে চোখ মুখ এমন কুচকে রেখেছো কেন?
মেহরাম;; না মানে মাথা টা কেমন একটু চক্কর দিয়ে উঠেছে আর কি।
সোহেল;; কি বেশি খারাপ লাগছে। এখানে এসো বসো। বারবার বলি রাতে হস্পিটালে থাকতে হবে কিন্তু কে শোনে কার কথা।
মেহরাম;; তাহলে আপনাকে দেখবে কে?
সোহেল;; হস্পিটালে কেন আছি আমি। এখানে ডাক্টর নার্স সবাই আছে।
মেহরাম;; রাতে হস্পিটালের ডিউটি প্রায় ৮৫% ডক্টার আর নার্স রা করে না। কখন কি লাগে না লাগে এতো কিছুর চিন্তা মাথায় রাখতে পারবো না তার থেকে আমিই থাকি।
সোহেল;; তোমার সাথে কেউ পারবে না।
মেহরাম;; ____________
সোহেল;; কটা বাজে?
মেহরাম;; ১১ঃ২৩ মিনিট।
সোহেল;; মেহরাম বাইরের ওই জানালা টা খুলে দাও না।
মেহরাম;; দিচ্ছি।
মেহরাম উঠে গিয়ে জানালার পর্দা টা সরিয়ে দেয়। সাথে সাথে এক দমকা হাওয়া রুমের ভেতরে আসে। মেহরাম ক্ষীণ এক নিশ্বাস ছেড়ে আবার সোহেলের পাশে এসে বসে। দুজনেই পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু একদম চুপ।
সোহেল;; মেহরাম!
মেহরাম;; হুম।
সোহেল;; আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মেহরাম সোহেলের বলা কথা তে মাথা ঘুড়িয়ে অন্য পাশে থাকায়।
মেহরাম;; “ভালোবাসা” এই যে এই শব্দ টা আছে না এখন এটার কোন মানেই হয় না আমার কাছে। এগুলো বোকামি, বাচ্চামি আর আবেগ লাগে আমার কাছে।
সোহেল;; লাগার কারণ আছে তাই লাগে।
মেহরাম;; হঠাৎ এই কথা বললেন যে!
সোহেল;; ৩৩ দিন সময় ছিলো আমার কাছে তার থেকে ১৪ দিন পার হয়ে গেছে রইলো আর ১৯ দিন। যদি মনের কথা বলার সুযোগ টুকুও না পাই তাহলে। তাই আগে ভাগেই বলে রাখলাম।
মেহরাম সোহেলের অগোচরেই তার চোখের পানি মুছে নিলো।
।
।
আয়ুশ;; আজ মেহরামের কাছে গিয়েছিলে?
তনু;; হ্যাঁ, সোহেল ভাইয়ের অবস্থা তেমন ভালো নেই।
আয়ুশ;; হুম।
তনু;; মেহরামের জন্য খুব খারাপ লাগে।
আয়ুশ;; ________________
তনু;; দেখতে যাবে!
আয়ুশ;; হ্যাঁ ২-১ দিন পরই যাই।
তনু;; যেটা ভালো মনে করো।
তনু আজ কণার সাথে ঘুমিয়েছে। কণার নাকি ইদানীং একা ঘুমাতে সমস্যা হয় তাই তনু সাথে ঘুমিয়েছে। রুমে আয়ুশ একা। সারা ঘর পায়চারি করছে। একবার এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে এখানে। সব আছে কিন্তু মনের শান্তি নেই। সবকিছু থেকেও কি যেন একটা নেই। নিজের মাঝে এক শূন্যতা কাজ করে। আয়ুশ তার ড্রয়ার টা খুললো, খুলতেই একটা মানিব্যাগ পেলো। এটা গতো ৮ বছর যাবৎ আয়ুশের সাথে আছে। ভার্সিটির লাইফে এটা নিজের লাকি মানিব্যাগ ছিলো। হাতে টাকা না থাকলেও এই ব্যাগে সে সবসময় টাকা খুঁজে পেতো। খুব যত্ন করে এখন রেখে দিয়েছে আয়ুশ। মানিব্যাগ টা তুলে হাতে নিলো। অজান্তেই মুখের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। যত্নে রাখলেও ওপরে কিছু ধুলো বালি জমে আছে। আয়ুশ সেগুলো হাত দিয়েই আর ফু দিয়ে ঝেড়ে ফেললো। মানিব্যাগ টা ভেতরে খুলতেই মেহরামের একটা হাস্যজ্বল ছবি বের হয়ে আসে। ছবি টা আকারে ছোট কিন্তু মেহরামের হাসি টা সেখানে অনেক বড়ো। চুল গুলো উড়ছে আর সে হাসছে। কতো দিন পেরিয়ে গেলো মেহরামকে সে আর এভাবে হাসতে দেখে না। আসলে কি কিছু কিছু জিনিস দ্বিতীয় বার জীবনে কখনোই আসে না। তাই ঝড়ে পরার আগে সেগুলো গুছিয়ে নিতে হয়। আয়ুশ ছবি টার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে ছবিটার ওপর হাল্কাভাবে ছুইয়ে দিলো। চোখ থেকে পানির বিন্দু গড়িয়ে পরার আগেই চোখ গুলো অন্যদিকে ঘুড়িয়ে মুছে ফেললো। ব্যাগ টা মুছে ভালোভাবে আবার আগের জায়গা তেই রেখে দিলো। ঘুম যেন আয়ুশের চোখ থেকে মুখ নামিয়ে নিয়েছে। আয়ুশের নিজেকে এখন পেঁচার মতো লাগে। রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পরলো। চোখ গুলো তে অয়ানি চিকচিক করছে তবুও পলক ফেলছে না, একধ্যানে তাকিয়ে আছে।
।
।
পরেরদিন আয়ুশের তেমন কোন কাজ নেই অফিসে তাই সে হস্পিটালে চলে যায়। তনুকেও বাড়িতে বলে এসেছে। কিন্তু আয়ুশ হস্পিটালে গেতেই যেন অবাক হয়। কারণ মেহরাম সোহেলের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাত দিয়ে কোন রকমে কান্না ধরে রেখেছে। আর ভেতরে ডাক্তার আর নার্সরা এক প্রকার দৌড়াদৌড়ি করছে। আয়ুশ জলদি করে মেহরামের কাছে চলে যায়।
আয়ুশ;; মেহরাম!
মেহরাম;; আয়ুশ, দেখো না উনার কি হয়েছে। মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত যাচ্ছে, শ্বাস নিতে পারছে না।
আয়ুশ;; মেহরাম কেদো না, তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আর কিচ্ছু হবে না।
মেহরাম;; আমার আর ভালো লাগছে না।
আয়ুশ;; বাসায় বলেছো?
মেহরাম;; হ্যাঁ আম্মু চাচ্চু কে বলে দিয়েছি তারা আসছেন। চাচি আমার বাড়িতে মা কে সামলাচ্ছেন।
আয়ুশ;; তুমি আমায় কেন ফোন দাও নি, একটা বার ফোন দিতে।
মেহরাম;; মাথা পুরো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে আমার কি থেকে কি করবো বুঝছি না।
আয়ুশ;; তুমি এখানে বসো আগে।
আয়ুশ মেহরামের হাত ধরে বসিয়ে দেয়। মেয়েটা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। আয়ুশ একবার কেবিনের ভেতরে উকি দিয়ে দ্রুত ফোন বের করে কাকে যেন ফোন দিলো। মেহরাম তার কপালে দুহাত ঠেকিয়ে বসে আছে। আর আয়ুশ হাটছে আর কাকে যেন বারবার ফোন দিচ্ছে। খানিক পরই বাড়ির সবাই ছুটে আসে। মেহরামের আম্মু এসে তার মেয়ের পাশে বসে পরে।
।
।
।
।
🍁চলবে ~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#{বোনাস পার্ট🥀}
🥀. . .
প্রায় ১ ঘন্টা পর ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে পরলেন। ডাক্তার বের হতেই সবাই একদম তড়িঘড়ি করে উনার সামনে গেলেন। কিন্তু মেহরাম কোন কিছু বলছে না সে শুধু ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তার সবাইকে সাইড করে মেহরামের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে….
ডাক্তার;; মিসেস মেহরাম আপনি প্লিজ আমার কেবিনে আসুন।
মেহরাম;; জ্বি।
মেহরাম সবাইকে সেখানেই থাকতে বলে এসে পরে। ডাক্তারের কেবিনে যাওয়ার আগে চোখ মুখ সব ভালোভাবে মুছে তারপর সে গেলো।
মেহরাম;; ম্যা আই কাম ইন ডক্টর!!
ডাক্তার;; জ্বি আসুন।
মেহরাম এসে বসে পরে। ডাক্তার তখন সোহেলের রিপোর্টস গুলোই দেখছিলো। মেহরাম এসে বসলে ডাক্তার তার সামনে রিপোর্ট গুলো রেখে দেয়। মেহরাম ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রিপোর্টস গুলো হাতে তুলে নেয়।
ডাক্তার;; দেখুন মিসেস মেহরাম মিস্টার সোহেলের কন্ডিশন অনেক বেশি খারাপ। উনার শরীরের ভেতরে এক ধরনের ঘা এর সৃষ্টি হয়েছে। আর এটা তার শরীরের প্রায় সকল পার্টস গুলোকেই নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। এমনকি দিয়েছে।
মেহরাম রিপোর্ট গুলো ভালো ভাবে দেখে এবার ডাক্তারের দিকে তাকালো। কথা গুলোতে এমন একটা ভাব ছিলো যেন আর কিছুই করার নেই, সব শেষ।
মেহরাম;; কিছুই কি আর করার নেই?
ডাক্তার;; আমি দুঃখিত।
মেহরাম মাথা নুইয়ে ডাক্তারের কেবিন থেকে এসে পরে। মেহরামের আসার সাথে সাথে আবার সবাই তাকে ঘিড়ে ধরে। মেহরাম সবাইকে কোন রকমে আশ্বাস দেয় যে কিছুই হয় নি সব ঠিক আছে। মেহরাম উঠে গিয়ে সোহেলের কেবিনের পাশে গিয়ে দাড়ালো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সোহেল। হাতে স্যালাইন লাগানো। এভাবেই সময় যেতে থাকে। সবাইকে অনেক বলে কয়ে মেহরাম জোর করেই যার যার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তবে সবাই চলে গেলেও তনু আর আয়ুশ থেকে যায়। মেহরামের আম্মু তার শাশুড়ীর কাছে থাকে সেদিন। মেহরাম এখনো সেই সকাল থেকে না খাওয়া। একটা দানা পানি কিছুই মুখে তোলে নি। মেহরাম মাথা নিচু করে বসে ছিলো। এবার হঠাৎ তনু এসে খাবার মেহরামের মুখের সামনে ধরে। মেহরাম মাথা তুলে তাকায়। দেখে সে যেভাবে তনুর সামনে আগে খাবার নিয়ে বসে থাকতো এখন তনুও ঠিক সেভাবেই তার সামনে খাবার নিয়ে বসে আছে। তনু তাকে মাথা দিয়ে ইশারা করে হা করার জন্য। মূহুর্তেই মেহরামের চোখ গুলো ভিজে গেলো। তনু তার বাম হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের পানি গুলো মুছে দেয়। তারপর মেহরাম কে খাইয়ে দিতে থাকে। মেহরামও খাচ্ছে। দুহাত ভাজ করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে মেহরামকে দেখছে আয়ুশ। বড্ড ইচ্ছে করে তার নিজের দুহাত দিয়ে মেহরামের চোখের পানি গুলো মুছে দিতে কিন্তু পারে না সে। দেখতে দেখতে রাত বেজে গেলো ৯ টা। এদিকে তনুর মাথা ব্যাথার প্রব্লেম আছে এটা মেহরাম জানে। সবারই আজ সারাটা দিন অনেক ধকল গিয়েছে। এখন বেশি রাত জেগে থাকলে আবার সমস্যা তাই মেহরাম বলে ওঠে…
মেহরাম;; ততনু..
তনু;; হু হুম বল।
মেহরাম;; শোন তুই না প্লিজ বাড়ি চলে যা, এখানে আমি আছি তুই বাড়ি যা।
তনু;; আরে না একদম না। তোকে এভাবে এখানে একা রেখে যাবো মাথা খারাপ হয়েছে নাকি। আমি থাকি
মেহরাম;; তনু প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর, আমি আছি। আর এখানে এতো জনের থাকতে হবে না, ডাক্তার নার্স সবাই আছে। তোর পরে সমস্যা হবে তুই বাড়ি যা। আর বাড়িতে কণা তোর শাশুড়ী আছে তুই যা।
তনু;; কিন্তু..
আয়ুশ;; তনু তুমি যাও আমি এখানে থাকি।
তনু;; হ্যাঁ সেটাই আমিও তাই বলতে চাইছিলাম যে তুমি থেকে যাও।
মেহরাম;; না মানে কি দরকার কষ্ট করার, তোমরা চলে যাও।
তনু;; মেহরু প্লিজ কথা শোন আয়ুশ এখানে থাক আমি চলে যাচ্ছি। যদি কোন প্রব্লেম হয় আর লাগে কাউকে তখন। আর তুই এই অবস্থায় একা কি করে সামলাবি। আয়ুশ থাকুক।
মেহরাম;; হুম।
তনু মেহরামের সাথে কথা বলে, আর সোহেল কে আরেক নজর দেখে সেখান থেকে চলে আসে। আয়ুশ আর মেহরামের চোখাচোখি হয়ে গেলে আয়ুশ দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলে। কারো চোখে বিন্দু মাত্র ঘুম নেই। সেভাবেই রাত কেটে যায়। তবে আয়ুশের বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো তা সে জানে না। সকাল বেলা মেহরামের ডাকে তার হুস আসে।
মেহরাম;; আয়ুশ, আয়ুশ!
আয়ুশ;; হাম.. হুমমম বলো।
মেহরাম;; না মানে সকাল হয়ে গিয়েছে তো, আর এখন সবকিছু স্বাভাবিক আছে তাই বলছি যে তুমি বাড়ি যাও।
আয়ুশ;; তোমায় এভাবে রেখে কি করে যাই।
আয়ুশের কথায় মেহরাম তার দিকে তাকায়। আয়ুশ সাথে সাথেই মাথা নামিয়ে ফেলে।
আয়ুশ;; আচ্ছা আমি যাই, কোন প্রব্লেম হলে ফোন দিও। আর নিজের একটু তো খেয়াল রেখো।
আয়ুশ এই বলেই চলে যায় সেখান থেকে। মেহরাম সেখান থেকে এসে সোহেলের কেবিনে চলে যায়। গিয়ে দেখে সোহেল তাকিয়ে আছে। মেহরাম অবাক কেননা সে ভেবেছে সোহেল ঘুমিয়ে আছে।
মেহরাম;; আরে আপনি ঘুমান নি?
সোহেল;; নননা.. আ আ ম আমি
মেহরাম;; না থাক থাক কথা বলতে হবে না। প্লিজ নিজের ওপর প্রেসার দিয়েন না। আমি বুঝে যাবো সবকিছু কথা বলতে হবে না।
সোহেল;; মেহ মে মেহ
মেহরাম;; হ্যাঁ আমি আছি তো বলুন।
মেহরাম সোহেলের পাশে বসে পরে। সোহেল এক নয়নে মেহরাম কে দেখছে। মেহরাম সেখান থেকে খানিক সরে বসলে সোহেল মেহরামের ওরনার কিছু অংশ ধরে রাখে অর্থাৎ যেও না। মেহরামও সেখানেই বসে থাকে। একটু পরে একজন নার্স আসে সোহেলের হাতের সুই টা খুলে দেয়। স্যালাইন শেষ হয়ে গেছে তাই আগের টা খুলে আরেকটা লাগিয়ে দেয়। এখন সোহেলের অবস্থা এতো টাই খারাপ যে সে আর মুখ দিয়ে খেতে পারবে না। তাকে স্যালাইনের মাধ্যমেই সব খাবার খেতে হবে। হাতে-পায়ে তেমন শক্তি পায় না সে এখন। এভাবেই দিন যাচ্ছে তাদের। বাড়ির সবাই একবার হলেও প্রতিদিন এসে সোহেল কে দেখে যায়। সোহেলের মা সোহেলের কাছে গিয়ে একদম ভেংগে পরে। তাকে সবাই সামলে নেয়। দেখতে দেখতেই আরো ১ সপ্তাহ কেটে যায়। সোহেলের শরীরে ভেতরে ঘা গুলো ফুটে ওঠেছে। মাথার চুল গুলো সব ঝড়ে গিয়েছে। তবুও মেহরাম সোহেলের সামনে না কাদার যথেষ্ট চেষ্টা করে। সবসময় হাসে। মেহরাম এটা ওটা কতো কি বলে সোহেল কে, মাঝে মাঝে মেহরামের কথায় সোহেল হাসে। একদম অল্প করে হাসে। হাসতে কষ্ট হলে এক ধ্যানে মেহরামের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেহরাম বুঝে যায় যে সোহেল হেসেছে। একদিন মেহরাম হস্পিটালে থাকতে চাইলে মেহরামকে জোর করে তার চাচ্চু আর আম্মু বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। মেহরামও আর কোন উপায় না পেয়ে বাড়ি এসে পরে। হস্পিটাল থেকে বাইরে বের হলে হঠাৎ তার সামনে একটা গাড়ি থামে। গাড়ির ভেতর থেকে আয়ুশ বের হয়।
আয়ুশ;; কোথায় যাচ্ছো তুমি?
মেহরাম;; আসলে আম্মু আর চাচ্চু আমাকে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।
আয়ুশ;; এসো আমি পৌছে দেয়।
মেহরাম;; আমি রিকশা দিয়ে চলে যাই।
আয়ুশ;; পাগল হয়েছো। এতো রাতে এই অবস্থায় তুমি একা বাড়ি যাবে। আর রিকশা ইম্পসিবল। কথা না বলে গাড়িতে ওঠো।
মেহরাম গাড়িতে উঠে পরে। আয়ুশ খুব আস্তে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। একদম আস্তে যেন মেহরামের কোন অসুবিধে না হয়। মেহরাম একবার আয়ুশের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকায়। তবে এবার মেহরামের চোখ আটকে যায়। কেননা মেহরাম একবার আয়ুশকে একটা কাচের ঘরের ভেতরে কালো গোলাপের একটা সো-পিস দিয়েছিলো। জিনিস টা ছোট কিন্তু দেখতে ভারী সুন্দর। গোলাপ টা কালো কিছুটা ঝুকে রয়েছে। এতো বছর আগে সেটা দিয়েছিলো আর এটা আয়ুশ এখনো গাড়িতে রেখে দিয়েছে। মেহরাম এবার গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রাত ভারী হয়েছে, রাস্তা-ঘাট কেমন যেন নিশ্চুপ। অনেক বাতাস বইছে। তবে মাঝ রাস্তায় গিয়ে ঘটলো আরেক বিপত্তি। গাড়ির টায়ার পাঞ্চার। আয়ুশ আর মেহরামকে বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে যেতে হলো। আয়ুশ গাড়ির ডিকি থেকে সব নামিয়ে নতুন টায়ার লাগাতে থাকে। এরই মধ্যে বাতাস যেন আরো জোরে বয়ে যেতে লাগলো। আকাশে বিদ্যুৎ চমক দিলো। বুঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড বৃষ্টি নামবে। আবহাওয়া বেশি ভালো না দেখে আয়ুশ দ্রুত কাজ করতে লাগলো। এরই মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরতেও ধরেছে। প্রায় ২০ মিনিট পর আয়ুশের টায়ার লাগানো শেষ হলো।
মেহরাম;; কাজ শেষ?
আয়ুশ;; হ্যাঁ, চলো।
আয়ুশ আর মেহরাম গাড়িতে উঠতে ধরলে বাতাসের বেগে একটা কাগজের মতো কিছু আয়ুশের পায়ের সামনে এসে থামে। মেহরামও সেটা লক্ষ্য করে। আয়ুশ কপাল কুচকে নিচু হয়ে সেটা হাতে তুলে নেয়। আয়ুশ দেখে একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটা শাড়ি পরা, বেনুনী করা। তখনই জোরে জোরে হেসে একটা লোক আয়ুশের কাছে আসে। মূলত সে একজন পাগল। লোক টা আয়ুশের কাছে এসে আশে পাশে তাকাচ্ছে আর মাথা চুলকাচ্ছে।
লোকটি;; এই এই তুতুতুমি কককি আমার আমার পরি পরি কে দেখেছো হ্যাঁ। আমার পরি আমার, পরি শুধুই আমার। ওর ওর না একটা একটা অনেক সুন্দর ছবি আছে আমার কাছে জানো। অনেএএএএক সুন্দর। পরি তো সুন্দরই হয় তাই না তাই না। আমার পরি। আমার আমার পপপরি আমার, দেখেছো তুমি আমার পরিকে হ্যাঁ!!?
আয়ুশ;; এটা তোমার পরি? (ছবিটা তার দিকে ধরে)
ছবি টা ধরার সাথে সাথে লোক টা ছবি টা কেড়ে নিয়ে নিলো আয়ুশের হাত থেকে। নিয়েই বুকের ভেতরে লুকিয়ে নিলো।
লোকটি;; হ্যাঁ এই এই এইটাই আমার পরি। ওর নামও পরি ও দেখতেও পরি। পরিকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি অনেক বেশি। কিন্তু আমার পরি যে কোথায় উড়ে চলে গেলো আমাকে ফেলে জানি না। আমার পরি আমার। ওওও পরি পরি…
লোকটি এগুলোই বিলাপ পারছিলো তখনই একজন মাঝ বয়স্ক মহিলা আসে। বুঝা গেলো সে তার মা।
মহিলা;; বাবা মাফ করে দিও, আসলে আমার ছেলেটা পাগল বুঝলা। পরি নামে এই মেয়েটাকে ভালোবাসতো। মেয়েটা একদিন ওর চোখের সামনেই মারা যায়। আমার ছেলেটা মেয়েটার এমন মরণ সহ্য করবার পাই নাই। মেয়েটার একটা মাত্রই ছবি আছিলো। এইটা নিয়াই সারাদিন পইরা থাকে। ওর জন্যে এখনো এই পরি বাইচা আছে। এর এই ছবি টা না থাকলে হয়তো আমার ছেলে ডাও থাকতো না বাবা। তোমাগোর কোন সমস্যা করলে আমি মাফ চাইতাছি।
আয়ুশ;; না না আপনি আমার মায়ের বয়সি। মা দের ছেলের কাছে মাফ চাইতে হয় না। আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে যান।
মহিলা টি তার ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো। ছেলে টি এখনো তার মতো করে বিলাপ পারছে। কেন জানি মেহরামের ভেতর টা এখন দুমড়েমুচড়ে আসছে। খুব বেশি কান্না পাচ্ছে তার। ইতোমধ্যে কেদেও দিয়েছে। আয়ুশ মেহরামের দিকে তাকালে মেহরাম দ্রুত চোখ মুছে ফেলে। আয়ুশ আর মেহরাম গাড়িতে উঠে পরে। এক সময় মেহরামের বাড়ির সামনেও চলে আসে। তবে এতোক্ষনে মুষুলধারে বৃষ্টিও নেমে পরেছে। আয়ুশ মেহরামকে কিছু বলবে বলবে ভাব তবুও বলতে পায় না। আয়ুশ গাড়ির সামনে থাকা আয়নাতে দেখে মেহরাম ফুপিয়ে কাদছে। আয়ুশ সাথে সাথে চোখ সরিয়ে ফেলে। সে পারে না সহ্য করতে যে মেহরাম তার সামনে কাদছে।
মেহরাম;; আয়ুশ আমি যাই।
এই কথা বলেই মেহরাম তীব্র বৃষ্টির মাঝেই নেমে পরে গাড়ি থেকে। নেমে বাড়ির ভেতরে চলে যেতে ধরলে আয়ুশ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে মেহরামকে পেছন থেকে ডাক দেয়।
আয়ুশ;; মেহরাম।
মেহরাম থেমে যায়। আয়ুশ মেহরামের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে দম ছাড়ছে। কিন্তু এবার আর কেউই নিজেকে সামলাতে পারে না। কেদে দেয়। কিন্তু বৃষ্টি পানিতে সব ধুয়ে যায়। মেহরাম পেছনে ঘুড়ে তাকায়। আয়ুশ মেহরামের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। আয়ুশ মেহরামের হাত গুলো নিজের দুহাতের ভাজে এনে মাথা একদম নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে মেহরাম তার ঠোঁট গুলো কামড়ে ধরে রেখেছে। আয়ুশ কিছুটা কেপে ওঠে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সে কাদছে। আয়ুশ মেহরামের হাত গুলো তার হাতে নিয়ে মাথা নিচু করেই ফুপিয়ে বলে ওঠে….
আয়ুশ;; মেহরাম, মেহরাম তফাৎ শুধু এই টুকুই যে
“” তুমি কাদিয়ে বলো ভালোবাসি,
আর আমি কেদে বলি ভালোবাসি””।
আয়ুশ এই কথা বলে ওপরে তাকায় দেখে যে মেহরামের চোখ নাক মুখ সব লাল হয়ে গেছে। আয়ুশ আর এক মূহুর্তের জন্যও সেখানে না দাঁড়িয়ে থেকে চোখ মুছতে মুছতে এসে পরে। গাড়িতে ওঠে এসে পরে। মেহরাম সেদিকে কতোক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সে এই মুষুলধারে বৃষ্টিতে ভিজেই যাচ্ছে। তখনই বাড়ির ভেতর থেকে নিলার জোর চিল্লিয়ে ডাক আসে…
লিনা;; আপায়ায়ায়ায়া ওও মেহরাম আপায়ায়ায়ায়া। আরে আপনে এই বৃষ্টি তে ভিজতাছেন কেন। জলদি ঘরে আহেন। জ্বর আসবো তো মেহরাম আপায়ায়া।
মেহরাম;; আ আ আস.. আসতেছি।
মেহরাম বাড়িতে চলে যায়। ওদিকে আয়ুশও বাড়ি চলে গিয়েছে। হস্পিটালে মেহরামের মা, বাবা আর চাচ্চু আছেন।
।
।
পরেরদিন সকালে উঠেই মেহরাম দ্রুত হস্পিটালে চলে যায়। এর মধ্যে মেহরামের মামা শশুড় মানে কুসুম বেগমের বড়ো ভাই উনি বেশ কয়েকবার এসেছেন। সোহেলকে দেখেছে সোহেলও তার মামা কে দেখেছে। নিজের বড়ো ভাইকে কাছে পেয়ে কুসুম বেগম কিছুটা শান্ত। তবে এবার মেহরাম দ্রুত হস্পিটালে চলে যায়। গিয়েই দেখে ডাক্তার কাজ করছে। মুচকি হেসে নার্স ডাক্তার সবাই এসে পরে। আর মেহরাম সোহেলের পাশে বসে। সে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ তনুর আওয়াজ আসে বাইরে থেকে। মেহরাম বাইরে গিয়ে দেখে তনু এসেছে। তনু মেহরামের দিকে তাকিয়ে হাসে। মেহরামও মুচকি হেসে ওঠে।
।
।
।
।
🍂চলবে~~