#তেমাতেই_বিমোহিত
#পর্বঃ৭(সারপ্রাইজ পর্ব)
#লেখিকা আরোহি জান্নাত(ছদ্মনাম)
“তুমি কোথায় আছো রাফসান? আমি তোমাকে কত খুজেছি জানো?”
চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ইহান।
“আমি এত দিন জেলে ছিলাম মি. ইহান।”
ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠল রাফসান নামের এক যুবক।
রাফসানের কথায় অবাক হয়ে গেল ইহান।
“এসব তুমি কি বলছ? তুমি জেলে ছিলে কিন্তু কেন?”(ইহান)
“কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। এটায় আমার অপরাধ মি. ইহান।আর আমি জেলে ছিলাম না।এখন ও আছি।অনেক কষ্ট করে আপনার নম্বর জোগাড় করেছি। একজন কে ঘুস দিয়ে ফোনের ব্যবস্থা করেছি।আমি তার সাথে একবার কথা বলতে চায় মি. ইহান। শুধু একবার।তিন বছরের জেল হয়েছে আমার।কেবল ১বছর এর একটু বেশি সময় পার হলো এখন ও অনেকটা দিন বাকি।আমাকে একবার তার সাথে কথা বলিয়ে দেবেন মি. ইহান।প্লিজ?”
নিশ্চুপ রইল ইহান।কি বলবে সে।
“আমি যে তোমার আমানতের হেফাজত করতে পারিনি রাফসান।আমি তো তাকে সারাজীবন মতো হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সে কথা তোমাকে কি করে বলব আমি।”
কথা গুলো মনে মনে ভাবল ইহান।
” আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই রাফসান।তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। এখন কিছু বলব না। শুধু একটা কথা জেনে রাখো আল্লাহ কারো কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিলে তাকে আবার কিছু না কিছু দেয়। তোমার ক্ষেত্রে ও একই ঘটনা ঘটেছে।”
নিশ্চুপ রইল রাফসান। ইহান কি বলতে চাইল ঠিক বুঝতে পারল না রাফসান।কিন্তু সে কোন জেলে আছে সেটা জানালো ইহান কে।
ফোন কেটে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইহান।
সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরল ইহান।অন্য দিনের মতে আজ ও লতা বেগম দরজা খুলে দিলেন।ইহান চুপচাপ নিজের ঘরে গেল। সে জানত আরোহি ঘরে থাকবে না।হলো ও তাই। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে গেল ইহান। বাড়িটা বড্ড নিশ্চুপ লাগছে।লতা বেগমকে পানি দিতে বলল সে।লতা বেগম পানি নিয়ে আসলে তাকে জিজ্ঞেস করল,
“বাড়িতে কেউ নেই ফুফু?”
“না ইহান বাবা।সবাই ও বাড়িতে গেছে মানে আরোহি বউমাদের বাড়ি। তুমি ফিরলে তোমাকে ও যেতে বলেছে।”
বললেন লতা বেগম।
“কেন ফুফু কোনো সমস্যা হয়নি তো? “(ইহান)
“আরে না না।কোনো সমস্যা হয়নি। আসলে তোমার খালামনি মানে তোমার শ্বাশুড়ি আজ সকলকে রাতের খাবারের জন্য দাওয়াত দিয়েছে তাই। তুমি ও চলে যেও।আমি এতক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।আমি এবার বাড়িতে ফিরব ইহান বাবা।”( লতা বেগম)
” আচ্ছা ফুফু তুমি যাও। আমি একটু পরে যাবো।”(ইহান)
আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল লতা বেগম। আর লতা বেগম চলে যাওয়ার একটু পর ইহান রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল আরোহিদের বাড়ির উদ্দেশ্য।
ইহান কে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন আতশি বেগম। বোনের ছেলে হিসেবে যখন ইহান আসত তখন ও কোনো যত্নের ত্রুটি করতেন না আতশি বেগম। আর আজ তো ইহান তার জামাই। কোনো রকম যত্নের অভাব রাখছেন না তিনি।আরোহি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তার মায়ের কাজ আর তাচ্ছিল্য হাসছে।
ইহান যাওয়ার পরপরই রাতের খাবারের ব্যাবস্থা করেন আতশি বেগম। কিন্তু বিপত্তি বাধে খাওয়া শেষে বাড়ি ফেরার সময়। আতশি বেগম আর আজমল সাহেব কিছুতেই কাউকে বাড়ি ফিরতে দেবেন না।তাদের অনুরোধ আজ রাতে সবাইকে একসাথে এ বাড়িতে থাকতে হবে। তবে ইহান এর বাবা মা থাকতে চাচ্ছিলেন না।অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আরোহি আয়ান আর ইহান আজ আতশি বেগমদের বাড়ি থাকবেন আর ইহানের বাবা মা বাড়িতে ফিরে যাবেন।
নিজের ঘরে বসে আছে আরোহি।আয়ান ঘুমাচ্ছে কিন্তু আরোহি গভীর চিন্তায় মগ্ন। আরোহির ঘরে একটা সিঙ্গেল সোফা আর সেখানে সারা রাত একটা মানুষ কিভাবে থাকবে সেটাই ভাবছে আরোহি। ইহানের সাথে বেড সেয়ার আরোহি কখনোই করবে না।কিন্তু থাকবে কোথায়? সেটাই ভাবছে আরোহি।
তখনই ঘরে ঢোকে ইহান। আরোহিকে চিন্তা করতে দেখে হালকা কাশে।ইহানের কাশির শব্দে ধ্যান ভাঙে আরোহির। তবে চমকে যায় ইহানের হাতে চাবি দেখে।এই চাবিটা আরোহিদের গেস্ট রুমের চাবি।কিন্তু ইহান এর কাছে কেন ভাবতে লাগে আরোহি।
ইহান আরোহির দিকে কিছুক্ষন দেখে বলে ওঠে,
” আমি রাতে গেস্ট রুমে ঘুমাবো। আসছি।”
আরোহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইহানের দিকে। মনে মনে বলে ওঠে,
“এই লোকটা এত অদ্ভুত কেন।কেন সব সময় আমার সমস্যার কথা বুঝে যান আপনি।কিন্তু আফসোস যখন আমার মনের কথা বোঝা খুব দরকার ছিল তখন আপনি বুঝলেন না ইহান।”
কথাগুলো বলেই শুয়ে পড়ল আরোহি। ওই স্বার্থপর, রাগি জেদি মানুষটার কথা আর ভাবনে না আরোহি।
গেস্ট রুমে এসে শুয়ে পড়ে ইহান।চাবি নিতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে ইহানকে।আতশি বেগমকে অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল ইহান কাল রাফসানকে কি বলবে।কি করে রাফসানকে জানাবে মায়া আর পৃথিবীতে নেয়।আর যখন তার থেকে ও বড় সত্যি টা রাফসান জানবে তখন কি রিয়াকশন হবে রাফসানের। এসব ভাবছে ইহান তখনই মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা যেদিন ইহানের বিয়ের দিন ছিল, যেদিন ইহানের বাসর রাত ছিল।
অতীত,
আরোহির সাথে কথা বলে নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছিল ইহানের। ওই দিকে আরশি বেগম বারবার ফোন দিচ্ছিলো ইহানকে বাড়ি ফেরার জন্য। অবশেষে ইহান সিদ্ধান্ত নিলো বাড়ি ফিরে মায়া বলে মেয়েটার সাথে কথা বলবে । তাকে কখন ও মেনে নিতে পারবে না এটা ও জানিয়ে দেবে।এতে হয়তো মায়ার সাথে অন্যায় করা হবে তবে তার থেকে বেশি অন্যায় হবে মায়াকে ধোয়াসার মধ্যে রাখলে।
১২ টার পর নিজের ঘরে ঢুকল ইহান। মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কি হবে সেটা ভাবতে ও ভয় করছে কিন্তু ঘরে ঢুকেই ইহান অবাক হয়ে গেল।মায়া খাটে বসে কাঁদছে। ইহানকে দেখেই দৌড়ে গেল মায়া। ইহানের পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল।মায়ার এমন কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেল ইহান। কি করবে, কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না।কোনো রকম মায়াকে তুলে দাড় করায় ইহান।কিছু বলার আগেই মায়া বলে ওঠে,
“আমাকে দয়া করুন। আমাকে ছোবেন না আমি আপনার বউ নই।”
মায়ার এমন কথায় ভ্রু কুচকে গেল ইহানের। মায়াকে শান্ত করে বসাল তারপর বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না।আমি আপনাকে স্পর্শ করব না।তার আগে এটা বলুন তো আপনি কেন বললেন আপনি আমার বউ নন।”
মায়া চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না।কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“মাস খানেক আগে আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে। আমার বাবা আর ভাই আমাকে খুঁজে বের করে চার দিন আগে।আমাকে জোর করে নিয়ে আসে বাড়িতে। আজকে আপনাকে বাধ্য করে বিয়ে করতে কিন্তু আমাদের বিয়েটা বৈধ না আমার আর রাফসানের ছাড়াছাড়ি হয় নি।তাহলে কি করে আমি আপনার বউ হই বলুন।আমি এই বিয়েটা করতে চায় নি।কিন্তু আমার ভাই রাফসানকে মেরে ফেলত যদি আমি রাজি না হতাম। আমাকে এমনটাই বলেছে।আপনি দয়া করে আমার সাথে খারাপ কিছু করবেন না।আমাকে রাফসানের কাছে যেতে দিন।”
বলেই আবার কান্না করতে লাগল মায়া।
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে রাফসান বলে ওই ছেলেটা মানে আপনার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেব। আসলে আমি ও একজনকে খুব ভালোবাসি।আর তার ওপর রাগ করেই আপনাকে বিয়ে করেছি।এতক্ষণ খুব অপরাধ বোধে ভুগছিলাম যে আপনাকে বিয়ে করে আপনাকে ঠকালাম না তো কিন্তু এখন আপনার কথা শুনে আমি নিজে ও স্বস্তি পাচ্ছি। আচ্ছা আপনার স্বামীর নম্বর জানেন আপনি? কথা বলবেন তার সাথে?”
মায়ার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো ইহানের কথায়।মায়ার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে রাফসানকে ফোন করল ইহান।মায়া আর ইহান রাফসানকে সবটা বুঝিয়ে বলল।ইহান আসতে বলল রাফসানকে। রাফসান এলে মায়াকে রাফসানের হাতে তুলে দেবে এমনটা ওয়াদা করল ইহান।আর ভাবল মায়া রাফসানের বিষয় টা সমাধান করে আরোহির কাছে ক্ষমা চাইবে ইহান।কিন্তু রাফসান পরের দিন এলো না।সারাদিন মায়া আর ইহান অপেক্ষায় ছিল এই বুঝি রাফসান এলো।কিন্তু রাফসান আসেনি।মায়া আশায় ছিল রাফসান আসবে কিন্তু সে আশা পুরোন হয় নি।দুই দিন কেটে গেল। ইহান সিদ্ধান্ত নিলো মায়াকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। কারণ ধর্মীয় মতে মায়া ইহানের বিয়ে হয়নি।এক স্বামী থাকতে আর একজনকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।আর এভাবে অন্য একটা মেয়ের সাথে এক ঘরে থাকা ও ইহানের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই চাকরির বাহানা দিয়ে বাড়ি থেকে দূরে চলে এলো ইহান।সিদ্ধান্ত নিলো রাফসান যেদিন ফিরবে সেদিনই মায়াকে তার হাতে তুলে দেবে।কারন মায়ার বাবা আর ভাই এর কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না।এর মধ্যে ইহান অনেকবার আরোহির সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু পারে নি।আরোহি বলে নি।অনেক বার আরোহিদের বাড়িতে গিয়েছে ইহান কিন্তু আরোহি ইহানের সামনে আসেনি।
এভাবে কেটে যায় এক মাস।মায়া নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে। তাই ডাক্তারের কাছে যায় সে আর গিয়ে জানতে পারে সে মা হতে চলেছে। মায়া খুব ভালো করে জানে এই সন্তান রাফসানের। কারন ইহান আর মায়ার মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক হয়নি।মায়া ইহানকে জানায় নিজের প্রগনেন্সির বিষয়টা।এমন একটা খবর শুনে ইহান কি করবে বুঝতে পারে না।আর না পারে কিছু করতে কারন তার আগেই ইহানের বাবা মা জেনে যায় মায়া প্রেগনেন্ট।
মায়া যে হসপিটালে টেস্ট করাতে যায় সেখানে ইহানের বাবার বন্ধু চাকরি করেন। আর তিনিই ইহানের বাবকে জানিয়ে দেয়।আর বাকিরা ও ব্যাপার টা জেনে যায়।ইহান বাধ্য হয়ে বলে সে এই সন্তানের বাবা।না হলে মায়ার চরিত্রে দাগ লাগত। তবে সব কিছু ঠিক হলেও ইহান আরোহির কাছে কঠিন অপরাধী হয়ে গেল। আর সেটাও সারাজীবন এর জন্য। সেই ঘটনার পর থেকে ইহান আর আরোহির সামনে যেতো না।ভাগ্য ভেবে মেনে নিয়েছিল সব।তবে আয়ানের জন্মের সময় মায়া মারা গেল।আর মৃত্যুর সময় আরোহির হাতে আয়ানকে তুলে দিল।আরোহিকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল সে যেন কোনো মতে আয়ানকে নিজের কাছ ছাড়া না করে।
অতীতের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল ইহান।কালকে সে মুখোমুখি হবে রাফসান এর।
চলবে,