তৃণকান্তা
পর্ব : ৫
নিশি রাত্রি
এস্ট্রেতে সিগারেটের শেষ অংশটা ফেলে দিয়ে আমিন সাহেব ভাবছেন, তার স্ত্রী রাহেলার কথা। তিনি ভেবেছিলেন মায়ার ধারালো অস্ত্রের মতো কথার জন্য হয়তো রাহেলা বদলে গেছে।নিজের ভুল বুঝতে পেরে সংসারী হয়েছে।কিন্তু না। তার ধারনা ভুল। সে তার বুকে জমিয়ে রেখেছে প্রতিশোধ। দিন দিন প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে বুকে। প্রতিশোধ যেনো তার মৃত্যুর আগে হলেও চাই। যেভাবেই হোক। আর তাইতো আজ আসল রুপটা বেরিয়ে এলো।
রাহেলার যখন বিয়ে ঠিক হয় তখন সে অন্য একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো । ছেলেটা ভোলার একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতো। রাহেলা কিছুতেই আমিন সাহেবকে বিয়ে করবে না । কিন্তু রাহেলার বাবা ছিলেন একজন খ্যাতিমান মানুষ। সমাজে তার বেশ সুনাম রয়েছে। তার কথা কখনো নড়চড় হয়না। একমুখে এক কথার মানুষ তিনি । তিনি বলেছেন আমিন সাহেবের সাথে রাহেলার বিয়ে তা হবেই। মেয়ে কি করলো না করলো তাতে কিছু যায় আসে না। তোড়জোড় করে বিয়ের আয়োজন চলছে। রাহেলার কথার মূল্য দেয়নি তার পরিবার। বিয়ে হয়ে গেলো দুজনের। বিয়ের পর রাহেলা স্বাভাবিক ভাবেই জীবনযাপন করছিলো । কিন্তু সবার সামনে রাহেলা নিজেকে যতোটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছিলো সে মোটেও ততোটা স্বাভাবিক ছিলো না। তার সেই প্রেমিকের সাথে গোপনে গোপনে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলো। আমিনের দুই বোনের মধ্যে বড় মায়া। স্বভাবে চঞ্চল ও বুদ্ধিমতী। কিন্তু খুব সাহসী। কোনো অন্যায় কাজ সে কিছুতেই সহ্য করবে না। উত্তম মধ্যম করতে দ্বিধাবোধ করেন না। সেটাই হলো কাল। আমিন সাহেব সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাসায় ফিরে কোনোরকম খাওয়াদাওয়া করেই ঘুম। আর আমিন রাতে ঘুমানোর পর রাহেলা প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার চুপিচুপি বেরিয়ে গিয়ে ওই ছেলের সাথে বাড়ির পেছনে দেখা করতো। সেটা বাড়ির কেউ বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারে ছোট্ট মায়া। মায়া তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। রাহেলা একবার নয় পরপর চার বার ধরা পরে যায় মায়ার সামনে।
মায়া প্রথমে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
“ভাবি বিয়ের আগে যা করার করেছো এইসব বাদ দাও। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। আর তোমার এই কাহিনি তোমার বাবার কানে যায় তাহলে নিশ্চয়ই আস্ত রাখবে না তোমাকে। ”
সেদিন ভেজা বেড়ালের ন্যায় চুপ করে রইলো রাহেলা। কোনো জবাব দেয়নি । কিন্তু সুযোগ পেয়েও শোধরায়নি রাহেলা। এমন ভাবেই চলতে লাগলো সময়। কিন্তু সমাজ বলেও কিছু একটা আছে। আশেপাশের কেউ যদি একদিন দেখে ফেলে তখন কি হবে?
এভাবে চলতে থাকলেতো পরিবারের মানসম্মানের দিকে আঙ্গুল তুলবে মানুষ। রাহেলার কোনো পরিবর্তন না দেখে একটা সময় মায়া আমিনকে সব জানাতে বাধ্য হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আঁড়ালে আমিন রাহেলাকে সাবধান করে দেয়। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।সেই একইভাবেই সব চলছিলো।তখন অন্য পদক্ষেপ নিতে হলো মায়াকে। ছেলেটা বদলে গেছে। ছেলেটা রাহেলার কাছে আসে না। রাহেলার সাথে সে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দূরে চলে গেছে । আর সেখানেও ছিলো সাহসী ও বুদ্ধিমতী মেয়ে মায়ার কৃতীত্ব।
একদিন বৃহস্পতিবার রাতে।
মায়া রাহেলাকে ফলো করতে করতে সেই ছেলে অবধি পৌঁছে যায়। মায়াদের বাড়িটা ছিলো নদী থেকে অনেকটা কাছে। তাই রাহেলা ওই ছেলের সাথে ওই নির্জন নদী এলাকায় চলে যেতো। সেখানেই দেখা করতো দুজন।
মায়া অপেক্ষা করতে লাগলো তাদের কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত। দুজনের কথা শেষ হওয়ার পর যখন রাহেলা বাড়ি ফিরে যায় তখনি ছেলেটার সামনে হাজির হয় মায়া। মায়াকে দেখে থমকে যায় সে। অনেকটা ভয় ভয় কণ্ঠে বলে,
– কে তুমি? এতোরাতে এখানে কি করছো?
– আপনারা যা করছিলেন আমি তা দেখছিলাম।
– মানে? তুমি রাহেলাকে ফলো করছিলে? আর তুমি কে?
– আমি রাহেলার ননদ।
– ননদ? রাহেলার বিয়ে হলো কবে?কি বলছো তুমি?
– আপনার কি মনেহয় আমি মিথ্যা বলছি?
ভাবির বিয়ে হয়েছে প্রায় দুইমাস।
– তোমার সাহস আছে বলতে হবে।
– দেখুন সাহস বাহসের কিছুই না। আমি চাইনা আমার ফ্যামিলির কোনো বদনাম হোক। তাই এতোটা রিক্স নিতে হলো আমাকে । ভাবিকে এলার্ট করেছিলাম কোনো কাজ হয়নি। ওই যে লোকে বলে না, কুকুরের লেজ কখনোই সোজা হয়না। ভাবিও তেমন স্বভাবেরই একজন। তাই এই ব্যবস্থা নিতে হলো। আপনার ভিতরে যদি ন্যূনতম মনুষ্যত্ববোধ থাকে তাহলে নিশ্চয়ই অন্য লোকের বউয়ের সাথে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে থাকবেন না।
– দেখো আমি প্রতিমাসে একসপ্তাহের জন্য বাড়িতে আসি। রাহেলা আমাকে বলেছে, এটা তার দুর সম্পর্কের খালার বাড়ি।খালা অসুস্থ তাই ওর মা পাঠিয়েছে।
– হোয়াট এ জোক্সস! হাতে চুড়ি, নাকে দুল, এগুলো দেখেও কি আপনার সন্দেহ হয়নি? নাকি আপনার প্রিয়তমা প্রতিদিন এভাবে সেজে গুঁজেই আপনার সাথে দেখা করতে আসে?
– না তেমন কিছু নয়। আমি ততোটাও খেয়াল করিনি।
– যাই হোক বাদ দিন। আপনি যদি এলার্ট না হোন তবে আমি বাসায় জানাবো ব্যাপারটা।তাতে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হলেও আমার কিছু করার নেই।আমার ফ্যামিলির সম্মান আমি শেষ হতে দিবোনা। কিছু গাছ বেড়ে উঠার আগেই গোড়া থেকে উপড়ে তুলে ফেলতে হয়।
– আমি কথা দিচ্ছি আমি আর রাহেলার সাথে যোগাযোগ করবো না। আসি।
– আমি কথায় না কাজে বিশ্বাসী।
– তাহলে ওইটাই করে দেখাবো। আসি।
ছেলেটা তার কথা রেখেছিলো। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো রাহেলার সাথে। সম্পর্কটা শেষ হবার পর মায়া আর রাহেলার মধ্যে এক অন্যরকম এক সম্পর্ক গড়ে উঠলো ।বেশ গভীর সম্পর্ক।ননদীনি আর ভাবির মধ্যে এক নতুন সম্পর্ক। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু কে জানতো এটা যে রাহেলার বাহ্যিক রূপ ছিলো। আর অন্তরে ছিলো বিষ।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আমিন। এই মায়ার রক্তই যে মাইশার শরীরে বইছে। দেখতে হুবহু মায়ার মতোই। মাইশার জন্মের পর মা বলেছিলো,
“এ যেনো আমার মায়া তার মেয়েরূপে ফিরে এসেছে।”
সেই মায়ার মেয়েকে কখনোই আপন করে নিতে পারেনি রাহেলা।প্রথমে শ্বাশুড়ির জন্য পারেনি, তারপর পারেনি মেঘা আর বৃষ্টির জন্য।আর এখন তার জন্য। কারন দিনের বেশিরভাগ সময়ই আমিন বাসায় থাকছেন। তারপরও সব কিছুতে চেঁচামেচি। উল্টাপাল্টা বলতেই ব্যাস শুরু হয়ে যেতো দুজনের চেঁচামেচি। আমিন আগে ভাবতেন, হয়তো মাইশাজ ভালোর জন্যই ওকে শাষন করছে রাহেলা।কিন্তু আজ কি বললো রাহেলা?
কল সেন্টারের ভিতরে বসে মাইশার জন্য অপেক্ষা করছে তূর্য আর তুম্পা। তুম্পা একমনে তাকিয়ে আছে মাইশার দিক। এ কোন মাইশা? এটা কি তার সেই বাচাল মাইশা? তূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলো তূর্যও তাকিয়ে আছে মাইশার দিকে। তুম্পা ভাবছে কতো দুষ্টুমিতে ভরপুর মাইশাটার হঠাৎ কি হয়ে গেলো? যে সারাদিন অন্যকে হাসায় আর তার মুখে হাসি নেই। মনমরা এক অন্য মানুষ।
একদিন বিকেলে সামির সাথে খুব ঝগড়া হয়েছিলো তুম্পার।সামি তুম্পার বয়ফ্রেন্ড। ঝগড়া দাপট এতোটাই বেশি ছিলো সামি সোজা ব্রেকাপ করে দিয়েছে। সেই সুবাদে তুম্পা মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিলো। অবস্থা বেগতিক দেখে তুম্পার ছোট বোন তোহা মাইশাকে সব জানালো। সব শুনে রকেটের বেগে ছুটে যায় মাইশা। অনেক টেনে হিচড়ে বের করে আনে তুম্পাকে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নানান কথায় অনেকটা মন ভালো হতে গেলো তুম্পার। দুজনে হাঁটছে আর রহিম মামার স্পেশাল ঝালমুড়ি খাচ্ছে। সূর্য প্রায় নদীর পানিতে ডুবে যাচ্ছে। আকাশটা কেমন কমলা বর্ণের হয়ে আছে। যাকে সাহিত্যের ভাষায় বলে গোধূলি। গোধূলি সময়টা খুব প্রিয় তুম্পার। নদীতীরে এই সময়টা বেশ উপভোগ করার মতো জায়গা । তাই মাইশা নদীর দিকেই নিয়ে এলো তুম্পাকে। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দুজন।
হঠাৎ কোথা থেকে যেনো ফুলে সাজানো একটা প্রাইভেটকার তাদের সামনে দিয়ে চলে গেলো। ওটা দেখে মাইশা বললো,
– ইশ! মেয়েটা খুব কাঁদছে বল।
তুম্পা আশেপাশে তাকিয়ে,
– কোন মেয়েটা?
– ওই সাজানো গাড়িটা দিয়ে যাকে নিয়ে যাচ্ছে।
– তোকেও নিয়ে যাবে একদিন।
– ওহু।আমাকে নিয়ে যাবেনা। আমার বিয়েতে একটা ব্রেকিং নিউজ হবে।
– ব্রেকিং নিউজ?
– হুম ব্রেকিং নিউজ।
হাত দুটো সামনেরর দিক বাড়িয়ে,
“বরের গাড়িতে চড়ে বরযাত্রি এসেছে কিন্তু বর নেই। ” নিউজপ্যাপারে একদম ফাটিয়ে তুলবে না নিউজটা? গাড়িতে বসে স্মোকিং করার অপরাধে বরকে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে গেছে।
দেখবি আমার বিয়েতে ঠিক এমনই হবে। বিয়ের পর দিন বর হারানোর শোকে কাতর হয়ে থাকবো।
– মাইশা তুই এমন উদ্ভুত কথা কোথা থেকে পাস আমি এটাই বুঝিনা যত্তোসব।
– আরে তুই জানিস না! আমার জন্মটাই যে উদ্ভুত। কণ্ঠে সিরিয়াস ভাব এনে,
শোন, মা তিনবার প্রেগন্যান্সি কীট টেস্ট করেছে প্রথমবার পজেটিভ, দ্বিতীয় বার নেগেটিভ। ওমা তৃতীয় বার আবার পজেটিভ!
ভাব কতোটা অদ্ভুত।
– আন্টি তোকে বলেছে এইসব? ফাজিল। আমি আজকেই আন্টির কাছে বিচার দিবো।
– সত্যি বলছি দাদুমনি বলেছে আমাকে। এই জন্যইতো দেখিস না আমার সব কিছুই কেমন উদ্ভূত। তুই জানিস! ওই বলদটাও আজকাল আমাকে তারছিড়া ডাকছে।
– কোন বলদ? আবার কাকে মুরগী করছিস তুই?
– আরে ওই যে কি যেনো নাম? ও হ্যাঁ। তূর্য।
শব্দ করে হাসলো তুম্পা।
– তোকে যে পাগল বলেনি সেটাই লাক।
তুম্পা হাসতেই তুম্পার দু গাল টেনে ধরে মাইশা।
– আরে কি করছিস তুই?
– এভাবেই হাসবি। এই হাসিটাই শ্যুট করে তোকে।
মাইশার দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে তুম্পা। মাইশা নিজেও জড়িয়ে ধরে।
চোখের সামনে বসে থাকা মাইশা আর সেদিনের মাইশার মধ্যে কতো ব্যবধান তা নিজেও আন্দাজ করতে পারছেনা তুম্পা। স্মৃতিচারণ ছেড়ে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললো তুম্পা।মাইশার দিক তাকিয়ে দেখলো মাইশা সেখানে নেই। হয়তো ইন্টার্ভিউ রুমে তাকে ডেকেছে।
কল সেন্টারের ফ্লোরে একমনে তাকিয়ে আছে তূর্য। মাইশার এমন অবস্থা কি করে হলো? সেটা ভেবেই অস্থির তূর্য। কেমন মনমরা হয়ে গেছে মাইশা। শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হাড় গুলোও বোধহয় গুণতে পারবে মানুষ। চোখের নিচে কালি জমে গেছে। কিছুদিন আগের মাইশা আর এই মাইশার মধ্যে আকাশ পাতাল বিস্তার ফারাক। তূর্য বারবার ভাবছে,
এটা তার মাইশা তো? বারবার চোখের সামনে মাইশার হাসিমাখা মুখটা ভাসছে। তখনি তুম্পা বললো,
– ভাইয়া বেরিয়েছে।
মাইশা ইন্টার্ভিউ রুম থেকে বেরিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। অনেকটা আগ্রহী হয়ে তার হাতে থাকা জয়েনিং লেটারটা দেখছে। সে কিছুত্রি বুঝতে পারছেনা তার মধ্যে এমন কি আছে যে বস তাকে দেখেই জয়েনিং লেটার দিয়ে দিলো? নাকি সে বিখ্যাত ব্যবসায়ী আমিন সাহেবের মেয়ে বলে?
চলবে…