#তুমি_আছো_হৃদয়ে
#পর্ব-১০(শেষ পর্ব)
হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারলাম দুদিন আগেই রোদেলাকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে। সে এখন অনেকটা সুস্থ্য। তাই সেখান থেকে সোজা বাসায় চলে গেলাম আমি। বাসায় এসে যখন কলিংবেল বেলে চাপ দিলাম তখন একটা সুন্দরী মেয়ে দরজাটা খুলে দিলো। বুঝতে পারলাম না মেয়েটা কে। পরক্ষণেই মনে হলো এই মেয়েটাকে কোথায় যেনো দেখেছি আমি। হ্যাঁ রোদেলার জন্মদিনে এসেছিলো মেয়েটা। রোদেলা আমাকে দেখে কিছুটা করুণার চোখে তাকালো। আমি তাঁর চোখের দিকে না তাকিয়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
রাতে যখন রোদেলার বান্ধবী চলে গেলো তখন আমাদের দুজনের প্রথম কথা হলো। প্রথম কথাটা রোদেলায় বলল।
এতোদিন কোথায় ছিলেন? আমাকে এভাবে একা রেখে যাওয়াটা কি আপনার উচিত হয়েছিলো? আমি মরে গেলে মনে হয় আপনি অনেক খুশি হবেন। কারণ আমি থাকাকালে তো আর কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারবেন না।
– এভাবে বলছো কেনো? অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো তাই যেতে হয়েছে। আমি না থাকলেও তোমার সেবা যত্নের কোনো কমতি হয়নি আমি জানি।
– আমাকে যে মানুষটা একটা কিডনি দান করেছে আমি তাঁর কথা ভাবছি প্রতিনিয়ত। মানুষটাকে আমি চিনি না,জানি না আর সে আমাকে জলজ্যান্ত নতুন একটা জীবন উপহার দিলো। এমন মানুষও পৃথিবীতে আছে আমি বিশ্বাসই করতাম না। আর আপনি আমার পাশে থাকারই প্রয়োজন মনে করেননি। দুজন মানুষের মাঝে কতো তফাৎ।
– মানুষটা হয়তো বা আপনাকে অনেক ভালোবাসে। কারণ রিয়াল লাভ ছাড়া মানুষ কারো জন্য এতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে না।
– আমি ডাক্তারকে বলেছিলাম কিন্তু তারা আমাকে জানায়নি। যে মানুষটা এটা করেছে সে নাকি গোপন রাখতে বলেছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না একজন মানুষ কতোটা মহান হলে এতো বড় মহৎ একটা কাজ করেও গোপন রাখতে পারে। তবে আমি তাকে খুঁজে বের করবো। আমার বেঁচে থাকার জন্য যে মানুষটা এতো কিছু করলো একটা বার আমি তাকে খুব কাছ থেকে,দেখতে চাই।
আমি কিছু বলি না,চুপ করে বসে থাকি। সেও কিছু বলে না। একসময় দুজনই ঘুমিয়ে যাই।
সকাল বেলা নুসরাতের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙে আমার। এমন সময়ে তাঁর ফোন দেওয়ার কারণটা আমি খুঁজে পেলাম না। নুসরাতের বিয়ে ঠিক হয়েছে, কালকে তাঁর আংটি বদল। ছেলে ঢাকাতেই থাকে। সে আমাকে আর রোদেলাকে যেতে বলেছে। তাঁর হবু হাসবেন্ড এর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিবে। এই কয়েকটা দিনে এতো কিছু হয়ে গেলো জানতেই পারলাম না। তবে নুসরাতকে শুভকামনা জানানোর জন্য হলেও আমাকে যেতে হবে,মন না চাইলেও যেতে হবে। রোদেলাকেও হয়তো নুসরাত ফোন দিয়েছিলো তাই আমার আর তাকে নতুন করে বলতে হলো না। পরের দিন আমরা দুজন নুসরাতের আংটি বদল অনুষ্ঠানে গেলাম।
আমি কখনো ভাবিনি এতো বড় আয়োজন করা হবে। বুঝতে পারলাম নুসরাতের এমন কারো সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে যার টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। আমি সেখানে যাওয়া মাত্রই রোদেলা আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলো। নুসরাত আমাকে দেখে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো।
কেমন আছো তুমি?
– আছি, তুমি কেমন আছো?
– ভালো,অনেক খুশি। তোমার অভিশাপটা কাজে লাগেনি। আমি তোমার থেকে বেটার কাউকে নিজের জীবনে পেয়েছি।
– অনেক অনেক শুভকামনা রইলো তোমার আর তোমার হাসবেন্ড এর জন্য।
– তুমি তোমার বউ এর কাছ থেকে কোনো সময় অবহেলা ছাড়া কিছু পাওনি,তাকে নিজের করে নিতে পারোনি। অথচ দেখো আমার হাসবেন্ড আমাকে কতোটা ভালোবাসে,তাঁর ছোট্ট একটা নমুনা। সে এসব আমার জন্য করেছে। সো আমি তোমাকে না পাওয়ার জন্য কোনোদিন আফসোস করবো না।
– আমি করি,তবে কাউকে না পাওয়ার জন্য না। নিজেকে নিয়ে অনেক আফসোস হয় আমার। কারণ তোমাদের মতো আমার জীবনটা বেশি দিনের না। আমাকে চলে যেতে হবে নতুন ঠিকানায়। যেখান থেকে মানুষ কখনো ফিরে আসতে পারে না। তবে জানো? আমিও আর সবার মতো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে হাজার বছর বাঁচতে চাই। হোক সেটা কল্পনায় তবুও আমি বাঁচতে চাই।
– কি হয়েছে তোমার? তুমি এমন ভাবে কথা বলছো কেনো?
আমি নিজের অজান্তেই নুসরাতকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই। আমি কেনো জানি নিজের চোখের পানিটাকে ধরে রাখতে পারিনি।
তুমি সেদিন ঠিকই বলেছিলে,আমি তোমার সাথে কখনো মানিয়ে নিতে পারবো না। তুমি কেনো দুনিয়ার কারো সাথেই আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার প্রতি কোন রাগ রেখো না। মানুষ বেঁচে থাকলে তাকে ঘৃণা করা যায় কিন্তু মরে গেলে তাকে ঘৃণা করবে কিভাবে?
– সেদিন আমাদের সম্পর্কটা ওভাবে শেষ করা উচিত হয়নি। আমি তোমার প্রতি অনেক অন্যায় করেছি। তুমি যে রোদেলাকে নিজের একটা কিডনি দিয়ে বাঁচিয়েছো সেটা আমি জানি। কিন্তু আমি তাকে বলিনি। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে আমি তাকে সব বলে দিবো।
আমি তখনো নুসরাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছিলাম। আমাকে পেছন থেকে টান দিয়ে কেউ একজন আমার গালে বিদ্যুৎ গতিতে দুইটা চড় বসিয়ে দিলো। আমার মনে হলো আমি কোনো ঘোরের মধ্যে ছিলাম,সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম।
“ঘরে বিয়ে করা বউ থাকার পরেও তুমি কিভাবে পারলে এতো মানুষের সামনে অন্য একটা মেয়েকে এতো অন্তরঙ্গ ভাবে জড়িয়ে ধরে থাকতে? আমি না আসলে তো মনে হয় জনম জনম এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকতে।”
আমি কিছু বলি না। নুসরাত যখন কিছু বলতে যাবে তখন রোদেলা নুসরাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে নুসরাতকে কথা শোনাতে থাকে। লজ্জায় অপমানে সেখান থেকে আমি চলে আসি।
আমি বাসায় আসার কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম রোদেলা দৌড়ে চলে এসেছে। বুঝতে পারলাম সে সবকিছু জেনে গেছো।
“একজন মানুষ কিভাবে এতোটা ভালোবাসতে পারে? আর আমি তোমাকে সবসময় ঘৃণা করতে চেয়েছি। কেনো আমার মতো স্বার্থপর মেয়েকে এতো ভালোবাসতে গেলো। আমি তোমার ভালোবাসার মূল দিতে পারিনি।”
আমি কিছু বলি না,রোদেলার কান্নারত কণ্ঠটা শুনতে থাকি,তাঁর জলে ভেজা চোখটা জানান দিয়ে যাচ্ছে সে অনুতপ্ত। সে ভুল করেছে।
সবসময় তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতাম আমি আর তুমি আমাকে নিজের কাছে রাখার জন্য নিজের জীবনটাও বাজি লাগিয়েছিলে? তুমি কি মনে করেছো? তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলে আমি তোমাকে যেতো দিবো?
-ওপরওয়ালার ওপর আমাদের কারো হাত নেই।
-কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেনো?
-কয়েকটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছি। এতো যন্ত্রণা নিয়ে ঘুমানো যায় না বাট আমাকে যে ঘুমাতে হবে। তবে ভয় পেয়ো না,আমি আত্মহত্যা করবো না,আত্মহত্যা করার মতো কাপুরুষ আমি নই।
রোদেলার আমার গালে তাঁর নরম দুইটা হাত রাখে আমি বুঝতে পারি,অনুভব করি তাঁর শীতল স্পর্শ।
আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি না? আমি খুব খারাপ মেয়ে। তুমি আমাকে কষ্টগুলো ফিরিয়ে না দিয়ে আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও। শুধু একটাবার সুযোগ দাও। আমি তোমাকে পৃৃথিবীর সব ভালোবাসা দিবো। আমার ভালোবাসা দিয়ে আমি তোমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিবো। আমাকে এভাবে ছেড়ে তুমি যেতে পারো না।
– হয়তো বা সৃষ্টিকর্তা চান না আমরা দুজন পৃৃথিবীর বুকে একে অপরকে ভালোবেসে হাজার বছর বেঁচে থাকি। মৃত্যুর পরেও কিন্তু ভালোবাসা যায়। আমি যদি মরে যাই তাহলে তুমি তোমার অধরা স্বপ্ন গুলো পূরণ করে নিও। তুমি বলেছিলে আমার সাথে বিয়ে হওয়ার কারণে তুমি তোমার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু এখন আর সেই বাঁধা থাকবে না। পরের জনমে আমি তোমাকে আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে চেয়ে নিবো। আমি জানি সেদিন আমাকে আমার পালনকর্তা না বলতে পারবে না। তবে জানো আমার খুব ইচ্ছে ছিলো তোমাকে ভালোবেসে শক্ত জড়িয়ে ধরে আজীবন বেঁচে থাকবো। আমার প্রথম ভালোবাসা নুসরাত হলেও আমি তাকে ভুলে গিয়েছিলাম,তোমাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিলাম,ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু তোমাকেও আমার পাওয়া হলো না। জীবনে দুইজন মানুষকে ভালোবাসলাম অথচ একজন মানুষকেও নিজের করে নিতে পারলাম না। এতোটাই অভাগা আমি।
রোদেলা আমাকে শক্তু করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আমি বুঝতে পারছি। তবে আমার চোখের আলোটাও ঘুমের কারণে নিভে যাচ্ছে।
পরের দিন বিকেলে ঘুম থেকে জাগা পেয়ে কারো কাঁদার শব্দ শুনতে পাই। মনে হলো অনুভূতিরা গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। কিন্তু না,রোদেলা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সেও হয়তো বুঝতে পেরেছে আর কিছু দিন পর আমি এই পৃৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো। আমার মনের অসুখের থেকে এখন শরীরের অসুখটা বেশি।
আমাদেরকে যখন কেউ খুব ভালোবাসতে চায় তখন আমার তাঁর ভালোবাসাটা অনুধাবন করতে পারি না। তাঁর ভালোবাসাটাকে তুচ্ছ মনে হয়,অবহেলা করি। কিন্তু সেই মানুষটা যখন চলে যায় তখন আমরা তাঁর ভালোবাসার গভীরতাটা বুঝতে পারি। কিন্তু তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। হয়তো বা রোদেলাও হয়তো আমার ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছে কিন্তু সে অনেকটা দেরি করে ফেলেছে।
সমাপ্ত।
লেখাঃ আমিনুর রহমান