#তুমি_আছো_হৃদয়ে
#পর্ব-৯
রোদেলা আমাদের দেখে খুব একটা অবাক হলো না। আমার পাশ থেকে শুধু নুসরাতকে দূরে ডেকে নিয়ে গেলো। কি বলল আমি বুঝতে পারলাম না। তবে বুঝলাম সে নুসরাতকে কিছু বলছে। সবাই চলে যাওয়ার পর যখন রোদেলা বলল,
“সরি,আসলে সবার সাথে এতো খুশি ছিলাম যে আপনার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিছু মনে করবেন না।”
আমি কিছু বললাম না,শুধু মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম আপনি আমাকে কখনো মনেই করেননি,ভুলে যাবেন কি করে?
ইদানীং কেনো জানি মনে হচ্ছে আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। মাঝে মাঝে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করি আমি। রক্ত মাংসের শরীরের কোনো এক কোণে ব্যাথাটা হলে হয়তো ডাক্তার দেখিয়ে কিংবা মেডিসিন দিয়ে সারিয়ে ফেলতাম কিন্তু ব্যাথাটা যে মনের। মনের ব্যাথার কোনো ওষুধ এই মন ভাঙার পৃথিবীতে আজও আবিষ্কার হয়নি,হলে হয়তো অনেক মানুষ এই অসহ্য ব্যাথা থেকে মুক্তি পেতো। কি জন্য এমন হয় জানি না। তবে সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে মাথার মধ্যেও ব্যাথা অনুভব করি,শুনেছি ব্রেইন টিউমার হলে মানুষের মাথায় অনেক বেশি পেইন হয়। তাহলে কি আমারও? না আমার ভাবতে ইচ্ছে করছে না এসব। সৃষ্টিকর্তা আমাকে এতোটা পছন্দ করেন না যে এতো আগেই তিনি আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবেন। হয়তো বা এগুলো আমার মনের ভুল। আমার কোনো অসুখ নেই। যা অাছে এগুলো সব মনের অসুখ,শরীরের নয়। আমি পুরোপুরি সুস্থ্য একজন মানুষ।
দেখতে দেখতে বিয়ের অনেকটা দিন পাড় হয়ে গেলো তবুও রোদেলার সাথে আমি ফিজিক্যালি ফ্রী হতে পারিনি। আমি যদি চাই তাহলে হয়তো এই কাজটা করতে পারবো তবে সেখানে কোনো ভালোবাসা থাকবে না। আর ভালোবাসা ব্যতীত এই কাজটা আমার দ্বারা কোনোদিন সম্ভবও না। এই সমাজের মানুষ খুব খারাপ। বিয়ের পর যদি কারো বাচ্চা কাচ্চা না হয় তাহলে ছেলে মেয়ের দোষ খুঁজে বেড়াবে সবসময়। আমার ক্ষেত্রেও এমন হবে ভবিষ্যতে সেটা আস্তে আস্তে করে হলেও আমি বুঝতে পারছি। সেদিন মা ফোন দিয়ে বলল তাড়াতাড়ি একটা নাতির মুখ দেখতে চায় তারা। অথচ তারা জানে না বাচ্চা হওয়ার মতো এতো ঘনিষ্ঠ কোনো সম্পর্ক আমাদের মাঝে এখনো গড়ে উঠেনি।
অফিসে কতো বোরিং টাইম পাড় করি। মাঝে মধ্যে খুব ইচ্ছে করে কাউকে ফোন দিয়ে কথা বলি। নিজের মনের একান্ত গোপন কথা গুলো একান্তে কারো সাথে শেয়ার করি। কিন্তু কেনো জানি বলা হয় না। ফোন দেওয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাই না। যদি কেউ একজন কখনো খুব ভালোবাসা নিয়ে ফোন করে বলতো,
” তুমি কি দুপুরে খেয়েছো? না খেলে কষ্ট করে খেয়ে নাও,না হলে শরীর খারাপ করবে। আমি তোমার জন্য রাতে অপেক্ষা করবো। একটা সারপ্রাইজ অাছে তোমার জন্য।”
কিন্তু এতোটা ভালো কপাল আমার এখনো হয়নি। আমার বিয়ে করা বউ থাকলেও আমার ভালো কিংবা খারাপ লাগাতে তাঁর খুব একটা মনোযোগ নেই। সে শুধু নিজের ভালো থাকা,ভালো লাগাতে মনোযোগী। আমার দিকটা নিয়ে তাঁর ভাববার সময় হয় না।
অফিস শেষ করে রাতে যখন বাসায় গেলাম তখন দেখলাম মেঝেতে কেউ একজন মরার মতো পড়ে আছে। বুঝতে পারলাম রোদেলা,কারণ সে ছাড়া তো আর কেউ নেই। মনের ভিতর কেনো জানি প্রচন্ড ভয় কাজ করতে লাগলো। কেউ কি রোদেলার রুমে ঢুগেছিল কিংবা রোদেলার সাথে খারাপ কিছু করেছে? এসব ভাবতেই মনে হলো আমি কি সব ভাবছি? ছি, আমি ডিপ্রেশনে কি সব উল্টাপাল্টা চিন্তা করছি। আমার রোদেলাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। না হলে বড় ধরণের কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমি তাকে সে রাতেই হাসপাতালে নিয়ে যাই। তাঁর হঠাৎ করে এমন হওয়ার কথা আমি সবার কাছে গোপন করলাম। কারণ রোদেলার অনেক বড় একটা রোগ হয়েছে। আমি যখন ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলাম সেতো আগে কখনো এমন হঠাৎ করে অসুস্থ হয়নি। এমনটা হলে তো সে কিছু জানতো। তখন ডাক্তার বলল,হয়তো সে বুঝতে পারেনি। সাধারণ ভাবে নিয়েছে সব কিছু। বর্তমানে তাঁর দুইটা কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার জন্য অন্তত একটা কিডনি তাঁর দরকার। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তাঁর রক্তের গ্রুপ এ নেগেটিভ। পৃৃথিবীর খুব কম মানুষেরই রক্তের গ্রুপ এ নেগেটিভ। সেখানে রোদেলার অপারেশন এর জন্য অনেক রক্ত দরকার। ডাক্তারকে যখন বললাম আপনি ব্যবস্থা করেন যতো টাকা লাগে আমি দিবো। তখন ডাক্তার আমাকে একটা কথায় বলেল,এই পৃথিবীতে সবকিছু টাকা দিয়ে হয় না।
যখন দেখলাম রোদেলার মৃত্যু নিশ্চিত তখন কেনো জানি আমার মনে হলো আমি তাকে বাঁচাতে পারি। তখন হয়তো বা আমার বাঁচা নিয়ে সাত পাঁচ তৈরি হবে। কিংবা মারা যাবো আমি। তবে আমি চাইলে রোদেলাকে বাঁচাতে পারি। আমার তো দুইটা কিডনিই এখনো ভালো। আমার বেঁচে থাকার জন্য তো একটা কিডনি হলেই হয়। আরেকটা দিয়ে আমি রোদেলাকে নতুন জীবন দিতে পারি। আমি তাকে নিজের চোখে এভাবে মরতে দেখতে পারি না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমি রোদেলাকে আমার একটা কিডনি দিবো। সে আমাকে ভালো না বাসলেও আমি তাকে আমার ভালোবাসায় সারাজীবন বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
কিন্তু যখন ডাক্তারকে কিডনি দেওয়ার কথা বললাম তখন সে রাজি হলো না। কারণ আমার রক্তের গ্রুপও এ নেগেটিভ। অপারেশন এর সময় দুজনের জন্যই রক্ত লাগবে যেটা জোগাড় করা সম্ভব না। আমি ডাক্তারের হাতে পায়ে ধরে অপারেশন করার জন্য অনুরোধ করলাম। একটা জীবনের বিনিময়ে তারা আর একটা জীবন বাঁচাতে চায় না। তবুও তারা আমার কথা রেখেছিলো,এর জন্য আমি তাদের কাছে অনেক অনুরোধ করেছিলাম। ডাক্তাররা রোদেলার অপারেশন করার জন্য রাজি হয়ে যায়। আর আমিও নিজের মৃত্যুর দিকে এক ধাপ এগিয়ে যেতে থাকি।
রোদেলার অপারেশন হয়ে যায়। তাঁর শরীরের সমস্ত রক্ত আমার শরীর থেকেই নিয়েছিলো ডাক্তাররা। একজন মানুষ নিজের শরীর থেকে যে পরিমাণ রক্ত দিতে পারে তাঁর থেকেও অনেক বেশি দিয়েছিলাম আমি,শুধুমাত্র রোদেলার জন্য। কারণ আমি চাইনি মেয়েটা এতো আগেই এই সুন্দর পৃৃথিবীর মায়া ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি জমাক। ডাক্তাররা ভেবেই নিয়েছিলো আমার হয়তো আর বেঁচে থাকা হবে না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যদি কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে চান তাহলে সে মৃত্যুর দোয়ার থেকেও ফিরে এসে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে। এটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।
আমি রোদেলাকে একা রেখে কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও চলে যাই। কারণ আমি চাই নি রোদেলা কখনো জানুক আমি তাকে নতুন জীবন দিয়েছি। যে মানুষটাকে সে এক মুহূর্তের জন্যও নিজের স্বামী হিসেবে কখনো মেনে নিতে পারেনি,একটু ভালোবাসা দিতে পারেনি,সবসময় দূরে দূরে রেখেছে সেই মানুষটাই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে বাঁচিয়েছে এটা যখন সে জানবে তখন হয়তো আমাকে ভালোবাসার জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠবে। যেকোনো কিছুর মূল্যে সে আমার কাছে আসতে চাইবে। কিন্তু আমি তাঁর কাছ থেকে কখনো করুণার ভালোবাসা চাই না। তাই নিজেকে তাঁর কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে সরিয়ে নিচ্ছি। যদি বেঁচে থাকি তাহলে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসবো। আর যদি মরে যাই তাহলে কারো কোনো অভিযোগ থাকবে না আমার বিরুদ্ধে। কেউ কখনো জানতে পারবে না আমার এই মৃত্যু রহস্য।
প্রায় পনেরো দিন পর আমি রোদেলার কাছে ফিরে আসি। সে জানে আমি অফিসিয়াল কাজের জন্য বাহিরে গিয়েছিলাম। আমি এটাই তাকে জানাতে বলেছিলাম তাই সে এটাই জেনেছে। আমি জানি সে আমাকে আগের থেকে আরও দূরে ঢেলে দিবে তবে এটা ভেবে অনেক ভালো লাগছে সে যখন জানবে আমিই তাঁকে নিজের বাম পাশের কিডনিটা দিয়ে আমার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছি। তখন হয়তো সবকিছু ভুলে সে আমাকে নিজ থেকে ভালোবাসতে চাইবে। তবে আমি এটা তাকে নিজ থেকে কোনোদিন বলবো না। সে যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে তাহলে কোনো একদিন এই অপ্রকাশিত সত্যটা সে জানতে পারবে। আর যদি আমার ভালোবাসাটা মিথ্যা হয় তাহলে কখনো জানতে পারবে না আমার এই ত্যাগের কথাটা। কিংবা কখনো জানবার চেষ্টায় করবে না।
চলবে…………
লেখাঃ আমিনুর রহমান