তুমি_আছো_হৃদয়ে পর্ব-০৫

0
2557

#তুমি_আছো_হৃদয়ে
#পর্ব-৫

যখন থেকেই বুঝি তখন থেকেই মানুষের মুখে মুখে কিংবা গল্প উপন্যাসে,নাটক সিনেমায় একটা কথা শুনেছি এসেছি। বাসর রাত অনেক পবিত্র একটা রাত। এই রাত প্রতিটা মানুষের জীবনে একবারই আসে। এই রাতে দুজন মানুষ প্রথম বারের মতো ভালোবাসা বিনিময় করে,একজন আরেকজনকে জীবনের সব না বলা গল্পগুলো বলে। তবে আমার বাসর রাতটা এতো মধুর হয়নি যতোটা এ যাবৎ কাল মানুষের মুখে মুখে শুনে এসেছি। অবশ্য আগে থেকেই জানতাম এমন কিছু হবে আমার সাথে। তাই এটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নই আমি। বিবাহিত জীবন বাহির থেকে সুখের দেখা গেলেও ভিতর থেকে যে সুখী না সেটা আমি খুব করে ভালো করেই জানি।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। বাহিরে বের হতেই দেখলাম মায়ের সাথে রোদেলা গল্প করছে। আমি ভেবেছিলাম আমার মতো হয়তো বাবা মায়ের সাথেও রোদেলা ভালোভাবে কথা বলবে না। কিন্তু যখন নিজে চোখে দেখলাম মার সাথে মেয়েটা খুশি মনে কথা বলছে তখন নিজের ধারণটাকে আজগুবি মনে হলো। হোক না এটা অভিনয় তবুও আমি অনেক খুশি, মেয়েটা আমার মাকে খুশি করার জন্য অভিনয় করুক কিংবা সত্যি সত্যিই মন থেকে কথা বলুক এতে আমার কিছু যায় আসে না। সে আমার মায়ের সাথে কথা বলছে এটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

মেয়েদের জীবনটা কতো অদ্ভূত? সারাজীবন যে বাড়িটাকে আপন মনে করে বেড়ে উঠে, একসময় সেই বাড়িটাকেই ছেড়ে চলে যেতে হয় নতুন ঠিকানায়। নতুন ঠিকানায় নতুন নতুন সব মানুষের সাথে মানিয়ে নিতে হয়। একসময় নিজের বাবার বাড়ি ভুলে গিয়ে নিজের স্বামীর বাড়িকেই নিজের স্থায়ী ঠিকানা মনে করতে থাকে। আমি শুধু রোদেলা মেয়েটার কথা ভাবছি। এখন প্রায় বিকেল। শহর এলাকায় নতুন বউকে দেখার জন্য মানুষ কেমন করে জানি না তবে গ্রাম অঞ্চলে মনে হয় গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো একটু বেশিই করে। সেই সকাল থেকে রোদেলাকে দেখার জন্য কোথায় কোথায় থেকে মানুষ আসছে। এখনো আসছেই। আমি সবচাইতে বেশি অবাক হচ্ছি রোদেলাকে দেখে,সে এসবে বিরক্ত হচ্ছে না,বরং সবার সাথেই খুশি মনে কথা বলছে। আমি নিশ্চিত রোদেলার জায়গায় আমি থাকলে অনেক বেশি বিরক্ত হতাম। এজন্যই হয়তো মানুষ বলে মেয়ে হলে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ রোদেলা।
– ধন্যবাদ কেনো? কি এমন মহান কাজ করলাম যে ধন্যবাদ দিলেন।
– এই যে এতো কিছু খুব ভালোভাবে হ্যান্ডেল করলেন তার জন্য।
– সম্পর্কটা আমাদের মাঝেই থাকুক। শুধু আমরাই জানি আমরা এই বিয়েতে সুখী না। দুই পরিবারের মানুষ গুলো অন্তত জানুক আমরা সুখে আছি। আপনার কথা গুলো রাতে আমি অনেক ভোবেছি,তবে আমি আপনার সাথে থাকবো না। কোনো একদিন চলে যাবো। সেটা হোক ছয় মাস পর,এক বছর পর,পাঁচ বছর কিংবা দশ বছর পর। আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো এটাই সত্য।
– সেই সুযোগটা আমি আপনাকে দিবো না। আপনি আমার বিয়ে করা বউ। আপনি চাইলেই কারো সাথে চলে যেতে পারেন না। আপনার ওপর আমি জোর করে কোনো অধিকার আদায় করবো না তবে আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। আমি বিয়েটা আমার জন্য করিনি।
– তাহলে কার জন্য করেছেন শুনি? বাবা মায়ের জন্য?
– এসব নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। আপনি তো ঢাবিতে পড়েন?
– হ্যাঁ,বলেছিলাম তো,এতো তাড়াতাড়িই ভুলে গেলেন?
– ভুলিনি,শুধু ক্লিয়ার হতে চাইলাম।
– আপনার জন্য তো আমার পড়ালেখাটা হলো না। এই গ্রামে পঁচে মরতে হবে আমাকে। কতো ইচ্ছে ছিলো অনার্সটা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবো,একটা চাকরি করে প্রথম বেতনের টাকায় বাবা মাকে কিছু দিবো। কিন্তু এখন মনে হয় মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখাটা পাপ।
– আপনাকে কে বলল এখানে এই গ্রামে পঁচে মরতে হবে? আমি আপনাকে পড়ার সুযোগ করে দিবো। আপনি আবার ঢাকায় যাবেন। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
– কি শর্ত? আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না। এটা বাদে যে কোনো শর্ত আমি মেনে নিবো।
– আমাকে না বলে আপনি কারো সাথে পালিয়ে যেতে পারবেন না। আপনি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চান সেটা আমাকে বলতে হবে। আমাকে না বলে অন্য কারো সাথে আপনি চলে যেতে পারবেন না।
– আমি পালাবো না। পালানোর আগে আপনাকে জানাবো। কথা দিলাম।
– আমি আমার পোস্টিং ঢাকায় নিয়েছি। শুধু আপনার জন্য। আপনি যেনো আপনার স্বপ্ন পূ্রণের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন,কোনোদিন যেনো বলতে না পারেন আমি আপনার স্বপ্ন গুলো পূরণ করতে দেইনি।
– আমি অনেক কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। তবে আমার কাছ থেকে প্লিজ কখনো স্ত্রীর মতো কোনো কিছু আশা করবেন না।
– এটলিস্ট বন্ধুর মতো ব্যবহার তো আশা করতে পারি।
– হ্যাঁ,তা পারেন।

মনে মনে বললাম,এটা আপনাকে কাছে পাওয়ার প্রথম ধাপ।

আমার এমন সিদ্বান্ত বাবা সহজভাবে মেনে নিলেও মা কিছুটা মন খারাপ করলেন। তাঁর কথামতো আমার ঢাকাতে পোস্টিং নেওয়াটা মোটেই উচিত হয়নি। এখানে বাবা মায়ের সাথে থাকলেই তো পারতাম। কি দরকার ছিলো ইট পাথরে শহরে যাওয়ার। যেখানে এক ছাদের নিচে থাকলেও কেউ কাউকে চিনে না,কেউ কারো বিপদে এগিয়ে আসে না। সবাই শুধু নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। অথচ গ্রামের মানুষগুলো কতো আলাদা। সবাই সবাইকে চিনে,সবাই সবার বিপদে এগিয়ে আসে। মাকে যখন বললাম,
” আমি আমার জন্য ঢাকা যাচ্ছি না মা। রোদেলার জন্য যাচ্ছি। মেয়েটার অনেক স্বপ্ন। আমি যদি এখানে থাকি তাহলে কি আর তোমরা তাকে একা ঢাকাতে থাকতে দিবে? আর তোমরা দিলেও তো মানুষজন অনেক আজেবাজে কথা বলবে। বলবে বিয়ের পর হাসবেন্ড এর সাথে না থেকে ঢাকায় যায় পড়তে। রোদেলার মা বাবাও এমনটা চায় না। তুমি কি চাও তোমার ছেলের জন্য কোনো মেয়ের স্বপ্ন ধ্বংস হোক? জানি চাইবে না। তাই আমি এমন সিদ্বান্ত নিয়েছি। আর আমাদের সাথে তোমরাও যাবে।”

বাবা মা আমাদের সাথে যাবে না। সেটা আগে থেকেই জানতাম আমি। কারণ তারা এই ভিটেমাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তারা এখানেই থাকতে চায়। তাই আমি তাদেরকে জোর করলাম না। তবে আমার চলে যাওয়াতে মা খুব একটা খুশি না। তবে যখন মাকে বললাম আমি প্রতি মাসেই তোমাকে দেখার জন্য চলে আসবো। তখন মায়ের মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হলো।

কিছুক্ষণ পর আমি আর রোদেলা এতো পরিচিত জায়গাটা ছেড়ে ঢাকা চলে যাবো। শুনতে অবাস্তব লাগলেও আমি ঢাকা শহরটা খুব ভালো ভাবে চিনি না। এর আগে আমি ঢাকাতে গেলেও খুব একটা ঘুরে দেখতে পারিনি। তাই শহরটা আমার কাছে অপরিচিতই বলা যায়। তবে রোদেলার কাছে নতুন না। সে ঢাকাতে অনেক দিন ছিলো। ট্রেনে যেতে চাইলেও রোদেলার বাবা আমাদের জন্য একটা প্রাইভেট কারের সাথে একটা ছোটোখাটো ট্রাকেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যেটা সরাসরি বাসার সামনে নামিয়ে দিবে। যেহেত অনেক মালপত্র নিতে হচ্ছে তাই এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অবশ্য ভালোই হয়েছে এটা করাতে।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন দেখলাম নুসরাত আমাদের দিকে আসছে তখন আমার কেনো জানি ভালো লাগলো না। তাঁর এই অসময়ে এখানে আসার কারণটা আমি বুঝলাম না। সে তো আবার কোনো ঝামেলা করতে আসেনি। ধুর কি ভাবছি আমি। তাঁর সাথে আমার তেমন কোনো কিছু নেই যে সে ঝামেলা পাকাবে।

রোদেলার বাবা যখন বলল,
” নুসরাতকে তো চেনই। আমার বোনের মেয়ে। ঢাকা মেডিক্যালে পড়ে। ওরও ঢাকা যেতে হবে। তাই ভাবলাম একা একা যাওয়ার থেকে তোমাদের সাথেই যাক।”

আমি কিছু বললাম না। নুসরাতকে দেখে রোদেলা অনেকটা খুশি হয়েছে। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর কাছের কোনো মানুষকে দেখতে পেলো সে। নুসরাতকে দেখে আমার মনে হলো আমার যাত্রাটা ভালো হবে না। পুরো রাস্তাটা আমাকে অস্বস্তিতে ভুগতে হবে। তবে রোদেলার জন্য নুসরাত এর সঙ্গটা যে ভালো হয়েছে সেটা তাদের দুজনের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে।

চলবে……….

লেখাঃ আমিনুর রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে