তুমি রবে ৪৪

0
1897
তুমি রবে ৪৪ . . – “জোজো আমাকে কথা বলতে দাও।” দাদার আদেশে আশফি আর কোনো কথা না বলে সোফার হাতলের ওপর এসে বসলো। আর তার দৃষ্টি মাহির ওপর। আবরার মাহি আর ঐন্দ্রী দুজনের উদ্দেশেই বলতে শুরু করলেন, – “আমি আমার দাদা আর আমার বাবাকে দেখেছি। ওনারা যেদিন তাঁদের অর্ধাঙ্গীনিকে তাঁদের ঘরে তুলে নিয়ে আসেন সেদিন থেকেই ওনারা মনে করেন একটা সংসারে তাঁদের যেমন দায়িত্ব, কর্তব্য আর অধিকার ঠিক তেমনই তাঁদের স্ত্রীদেরও। তাঁরা যেমন বাহির থেকে কষ্ট করে আয় রোজগার করে এনে ঘরে ফিরতেন তেমন তাঁদের স্ত্রীও তাঁদের সংসারকে তাঁদের সর্বস্ব বিলিয়ে সংসারটাকে আগলে রাখতেন। তাই তাঁদের যা প্রাপ্য তাঁদের স্ত্রীদেরও সমান প্রাপ্য। তাঁদের নামের যতটুকু সম্পদ বা সম্পত্তি থাকে তা বিয়ের পরই সেই স্ত্রীকে তাঁর অর্ধেক পরিমাণ লিখিতভাবে দিয়ে দিয়েছেন। আমিও তাই করেছি, আমার ছেলেরাও তাই করেছে। আর আজ আমার নাতিরাও তাই করবে। আমরা অবশ্য কয়েক বছর যাবৎ সংসার করার পর এই ভাগটুকু তাদের দিয়েছি। কিন্তু তোমাদের বেলাতে আমি তা দ্রুতই দিতে বলেছি ওদের। কারণটা আর ভেঙেচুরে বলছি না। ওরা দুজনই রাজি। তাদের যা আছে মানে তাদের বাবার সন্তান হিসেবে তারা যা পেয়েছে তাদের বাবার থেকে তার অর্ধেক তোমাদের নামে লিখে দিয়েছে ওরা। মাহি তো পড়ে দেখেছো এই পেপাড়ে কী কী তোমার অংশে আছে। ঐন্দ্রী পড়ে দেখতে পারো। এরপর আর তোমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়।” – “আপত্তি আছে দাদা। এর জন্যই আমি এ কাগজে সই করতে পারব না। আপনি যেমন কত বছর এক সঙ্গে থাকার পর এই অংশের ভাগিদার করেছেন আপনার স্ত্রীকে অর্থাৎ দাদীবুকে তেমন আমার ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত। হতেও তো পারে আমি চিরকাল নাও থাকতে পারি তার সঙ্গে। মানে আমাদের সম্পর্ক নাও টিকতে পারে৷ সেক্ষেত্রে কী হবে?” মাহির শেষ কথাগুলোতে আশফির মাথার মধ্যে জ্বলে উঠল যেন। খুব দ্রুতই মাহির স্থান তাকে বোঝাতে হবে। হীরা এবার বললেন মাহিকে, – “যদি এমন কিছু হয়েই থাকে তবে তোমার মন যা বলবে তুমি তাই করবে। আমার নাতি ভুল করেছে৷ অনেক বড় ভুল করেছে৷ একজন মেয়ের কাছে তার সব থেকে বড় মূল্যবান সম্পদ তার সম্মান। আমার নাতি সেখানেই আঘাত করেছে তোমার। আলহাজ ভাই আর তোমার বাবা এখনো অনেক শঙ্কার মাঝে আছেন যে আমাদের নাতি হয়তো তাদের মেয়েকে মেনে নেয়নি বা নেবে না। তার কারণ কী তা আমরা নিজেদের মতো করে বুঝিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আমরা চাই না আমাদের নাতিকে নিয়ে তাদের এই শঙ্কা থাকুক। তারা যাতে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে তাদের মেয়ে নিয়ে তার জন্যই এই সিদ্ধান্ত এত দ্রুত নেওয়া। একই ব্যাপার ঐন্দ্রীর বেলাতেও।” – “দাদীবু! আপনি যখন এ সংসারকে একদম নিজের সন্তানের মতো করে আগলে রাখতে শিখেছেন ঠিক তখনই দাদা এই ভরসাটুকু করেছেন আপনার প্রতি। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় আমি কি এই সংসারকে নিজের বলে গ্রহণ করতে পেরেছি? তাহলে আমার উত্তর হবে না৷ তাই আমি এটুকুই বলতে চাইছি, যেদিন এই সংসার আর এই সংসারের মানুষগুলোকে আপন করতে পারব সেদিন এই অংশের ভাগ নেবো। তাছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় এটা গ্রহণ করা। মাফ করবেন আমাকে।” আবরার, হীরা দুজনেই নিশ্চুপ। তাদের মুখটা দেখে মাহি বুঝতে পারল তারাঁ কিছুটা হলেও অসন্তুষ্ট হয়েছেন মাহির প্রতি। কিন্তু এরপরও মাহি এই অংশ গ্রহণ করতে নারাজ। কারণ হিসেবে সে এই সংসার আপন করাকে প্রধান বৈশিষ্ট্য করলেও সে মূলত আশফিকে যতদিন না গ্রহণ করতে পারছে ততদিন সে আশফির কোনো অংশও গ্রহণ করবে না। মাহি ক্ষমা চেয়ে চলে আসার মুহূর্তে আশফি তার হাত টেনে ধরল। কাগজটা তুলে সে মাহিকে নিজের কাছে এগিয়ে এনে বলল, – “বিয়ের পর একজন স্বামী তার স্ত্রীকে বিশেষ কিছু প্রদান করলে তা অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত সেই স্ত্রীর। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা বা না রাখা তা তো সেই স্বামী স্ত্রী দুজনের ভালোবাসার ব্যাপার। তাতে কমতি না হলেই হলো।” আশফি কাগজটা নিজের হাতে রেখে জোর করে মাহির হাতে কলম গুঁজে দিয়ে শীতল দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল মাহির দিকে৷ মাহি তখনো তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশফির দিকে। পাশ থেকে দিশান বলল মাহিকে, – “এটা তোমার প্রাপ্য মাহি এই বাড়ির বউ হিসেবে।” আশফি তার শীতল চাহনির মাঝেই এত কঠোরতা দেখাল যা মাহি এই প্রথম দেখতে পেলো তার চোখে। আর কোনো কথা না বলে সে সইটা করে চলে গেল ওপরে। আবরার এবার ঐন্দ্রীকে বললেন, – “আশা করছি দাদু তুমি বুঝতে পেরেছো নিশ্চয় ব্যাপারগুলো।” – “জি দাদা বুঝেছি। তবে আমি একটা কথা বলতে চাই। আমার সময় প্রয়োজন। মাফ করবেন আমাকে। আমি নিজেকে যোগ্য ভাবছি না এর। দয়া করে আমাকে জোর করবেন না দাদা।” দিশান কিছু বলতে গেল ঐন্দ্রীকে। তবে ঐন্দ্রী তার বলার পূর্বেই একবার আঁড়চোখে আশফির দিকে চেয়ে দিশানকে বলল, – “আমি আমার যোগ্যতা জানি দিশান।” এরপর আর ঐন্দ্রীও দাঁড়িয়ে থাকেনি সেখানে। তবে হীরা এবং আবরার কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও তাদের দুই নাতিবউয়ের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের মুগ্ধ করেছে। আশফি আর দিশান এক সাথে ওপরে ওঠার সময় দিশান আশফিকে বলল, – “এখনি কি রুমে যাবে?” – “তাই তো যাচ্ছিলাম। কোনো দরকার?” – “আজ না হয় যেতে হবে না রুমে। পাশের রুমে সব রেডি করে বসে আছে শায়খ। খালি আমাদের যাওয়ার অপেক্ষা।” আশফি কয়েক মুহূর্ত দিশানের দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে থেকে এবার দুজনেই এক সাথে হেসে উঠল। আশফির রুমের পাশের রুমটা মূলত তাদের ভাইদের, বন্ধুদের এক সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য আলাদা করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। আশফি রুমে ঢুকেই দেখল শায়খ ড্রিংক রেডি করছে। আশফি তাদের গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করল, – “এগুলোর ব্যবস্থা কী করে করলি? তোরা কি আমার বাসাতে গিয়েছিলি?” শায়খ বলল, – “তোমার বাসায় কি আর এখন এসব আছে?” – “তাই তো। তাহলে?” – “ওসব না জানলেও চলবে। তবে আজকের রাতে বিড়াল মারতে এটা খুব উপকারে আসবে তোমার। আমি আর দিশান তো আপাতত পার্বতি থাকতেও দেবদাস।” দিশান হাসতে হাসতে শায়খের পাশে বসে টিভি অন করে মুভি প্লে করল। অত্যন্ত রোমাঞ্চকর একটা হলিউড মুভি। এরপর শায়খকে বলল, – “আমার পার্বতি না হয় নেই আমার কাছে। তোর পার্বতি কবে হলো বল তো?” আশফি কালো আঙুরের ট্রে নিয়ে বসলো সোফাতে। এরপর ফোনটাও সাইলেন্ট করে নিলো। কারণ আজকের রাত তার বাসররাত হলেও সে আজ ভোর চারটার পর সেই রুমে যাবে। মাহিকে শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আর তাই তারা তিনভাই প্ল্যান করেছে আজকের রাত আমোদে কাটাবে তারা এক সঙ্গে। শায়খ ড্রিংকস ভাইদের সামনে রেখে নিজে একটা হাতে নিয়ে বলল, – “বড় ভাইগুলোরই তো হ্যাঙ্গিং দশা। আমরাটা আর ডিসক্লোজ করি কীভাবে?” আশফি খেতে খেতে বলল, – “আমাদের জন্য ওয়েট করে আর দেরি করিস না। পরে পস্তাবি।” – “আরে বড়দের বুদ্ধি বলে কিছু আছে না কি? তোমাদের মতো বলদদেবি তো আর আমি হবো না। আমি যা করব সব ডিরেক্টলি। কোনো প্রেম চলবে না। সরাসরি বাসরঘর।”
দিশান এবার সোফায় শুয়ে পড়ে বলল, – “দেখা যাবে। সময় মতো কতগুলো গোল দিস।” – “তোমাদের আপত্তি না থাকলে এখনি করে প্রতি বছর বছর এক একটা গোল দিতে পারব। দেখবে না কি?” শায়খের কথার পর তিনভাই এক সঙ্গে হেসে উঠল। এরপর শায়খ বলল, – “তবে বিগ ব্রো তুমি কিন্তু আজ বিরাট বড় রিস্ক নিয়ে নিয়েছিলে। ভাবি যদি সত্যি ফিরে না আসতো তুমি কী করে পারতে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে?” আশফি গ্লাসে এবার এক চুমুক দিয়ে বলল, – “মাঝে মাঝে হাতের বাঁধন হালকা করতে হয় ধরে রাখা জিনিসটার ক্ষমতা বা শক্তি বোঝার জন্য। আদৌ আমার জোর বেশি না কি তার। এতে ভেতরের ঘুমিয়ে থাকা টানটাও জেগে উঠল। দেখলি না?” দিশান বলল, – “তুমি ওই সময় না জানালে কী হতো বলো তো? ও তো মুখ লজ্জার ভয়ে আর ফিরেই আসতো না। সত্যিই খুব বড় ঝুঁকি ছিল আজ তোমার জন্য।” – “ভাগ্যের জোরে ফিরে তো পেয়েছি। এবার ধরে রাখা ছাড়াই বেঁধে রাখব।” শায়খ জিজ্ঞেস করল, – “ধরে রাখা ছাড়া বাঁধে তো রশি দিয়ে। তাহলে কি ভাবির জন্য রশি কিনে আনব?” দিশান হেসে উঠল। আশফি বলল, – “ভাই তুই টেনশন নিস না। রশির ব্যবস্থাও আমি করব।” – “তোমরা দুই ভাই যা টেনশন টেনশন খেলা শুরু করেছো! তাতে আর টেনশনও টেনশন করতে করতে মরবে। আমি এখনো যেটা ভাবি সেটা হলো ভাবি সত্যিই এত রাগী!” – “খুব। কোনো সন্দেহ আছে?” – “তা আর নেই। কিন্তু খেলোয়াড় তোমার চেয়ে কম নয়।” – “খেলাটার শুরুই তো ভাইয়া করেছে। শেষটাও যে ভাইয়াই করল সেটা আর বেচারি বুঝল না।” – “বাট ভাবিকে বোঝানো উচিত। মানে মাত্ যে ভাইয়াই করেছে সেটা ভাবির জানা উচিত নয়? না হলে ভাবি তো নিজেকে উইনার ভাববে।” আশফি এর মাঝে তিন গ্লাস পেটে ঢেলে ফেলেছে। সে এবার সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর বলল, – “ঠিক। উইনার আশফি মাহবুব। নুসরাত মাহি নয়। সেটা জানানোর সময় এসে গেছে।” দিশান ঘাড় উঁচিয়ে খেয়াল করল তার ভাইয়ের পেট বেশিই গরম হয়ে গেছে। শায়খকে ইশারায় বোতল সরিয়ে ফেলতে বলল। শায়খ বোতল সরিয়ে দিশানকে জিজ্ঞেস করল, – “তোর হালকা বউ তো ওয়েট করছে। যাবি না?” – “হালকা বউ আজ থেকে মোটা ঘুম দেবে। তার ঘুম প্রয়োজন। তাই স্পেস দিয়েছি। সে এখন নিশ্চিন্তে ঘুম দিচ্ছে। কিন্তু শায়খ রে! আমার তো এখন মিঠাই প্রয়োজন ভাই।” – “কীভাবে দেবো বলো?” – “তুলে নিয়ে আসি কী বলিস?” শায়খ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, – “যাবে না কি?” – “না থাক। বাসররাত না হলে আজই হয়ে যাবে।” আশফি এদিকে পুরো নিশ্চুপ। সে আজ প্রথম এত ধৈর্য সহকারে রোমন্টিক মুভি দেখছে। এর মাঝে শায়খ একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, – “এত গভীর চাহনিতে কী দেখো ভাই?” আশফি ঝিমানো সুরে উত্তর দিয়েছিল, – “গভীর অংশ।” এরপর সে থেকে থেকে শায়খ আর দিশানের কাছে শুধু টাইম জিজ্ঞেস করছে। প্রায় তিনটার ওপাশে ঘড়ির কাটা। হঠাৎ আশফি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ওদের দুজনকে বলল, – “আমার বিড়াল ঘরে। অথচ আমি রশি নিয়ে এখানে বসে কী করছি?” দিশান হাসতে হাসতে সোফাতেই লুটোপুটি খাচ্ছে। শায়খ হাসির চোটে কথা বলতে গিয়েও আটকে গেল তা। তারপরও প্রচুর কষ্টে সে জিজ্ঞেস করল, – “ভাই! বিড়াল মারবে না বাঁধবে না ধরবে?” – “প্রথমে ধরব তারপর বাঁধব তারপর মারব।” – “তবে আজ রাতেই হওয়া চায় ভাই। নয়তো আগামী রাতগুলোতেও পারবে না কিন্তু।” দিশানের কথাতে আশফি তার দিকে কেমন অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ পর বলল, – “ভালো বলেছিস। আজ রাতেই মারতে হবে।” আশফি চলে যাওয়ার পরই দিশান শায়খকে বলল, – “এই যে এত যন্ত্রণা। এর মাঝেও দেখছিস কত চেষ্টা তার।” – “এত ভালোবাসা ভাবি বেশিদিন অবজ্ঞা করতে পারবে না দেখো। তবে আমি কিন্তু তোমাকে নিয়েও প্রচুর টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম।” দিশান গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে শায়খকে জিজ্ঞেস করল, – “কী কথা হয়েছে মূলত বল তো। ভাইয়ার সঙ্গে ঐন্দ্রী কোনো খারাপ ব্যবহার বা কোনো ফালতু শর্ত দেয়নি তো?” – “ঐন্দ্রী যা করেছে তোমার সঙ্গে। হিসেবে তো তেমনই কিছু করার কথা।” – “আমাকে খুলে বল। আমি খুব টেনশনে আছি ভাই।” – “ভাইয়া আজ যেভাবে বলেছে কথাগুলো ঐন্দ্রীকে। এই কথাগুলো ভাবি শুনলে আমি নিশ্চিত ভাবি নির্ঘাৎ আজ কেঁদে ফেলতো। হয়তো সিনেমার নায়িকাদের মতো ভাইয়াকে জড়িয়েও ধরতো পারতো রাস্তার মধ্যেই। তুমি জানো না ভাইয়াকে কোনোদিনও কারো সামনে এমনভাবে নত হতে দেখিনি। কাঁদতেই বাদ ছিল শুধু। ভাইয়ার দেখা করার ব্যাপারটা ঐন্দ্রী আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল।” . বেলা সাড়ে এগারোটার সময় আশফি শায়খকে ফোন করে বলেছিল, – “একটা মেসেজ সেন্ড করছি। মেসেজটা ঐন্দ্রীকে যত দ্রুত সম্ভব দেখাবি।” এরপরই আশফি শায়খকে ঐন্দ্রীর উদ্দেশে লিখে পাঠায়, – “সব থেকে বড় সিদ্ধান্ত জানার বাকি আছে তোমার। সাড়ে বারোটার মধ্যে শায়খের সঙ্গে চলে এসো। অপেক্ষা করছি।” মেসেজটা শায়খ ঐন্দ্রীকে দেখাতেই ঐন্দ্রী কিছুক্ষণ চুপ থেকে শায়খকে বলেছিল, – “কোথায় যেতে হবে?” – “যাওয়ার পর জানতে পারবেন।” ঐন্দ্রী কিছু শপিং করার কথা বলে শায়খের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। একটু দূর আসতেই রাস্তার এক পাশে আশফিকে গাড়ির মাঝে বসে থাকতে দেখে সে। ঐন্দ্রীকে সঙ্গে করে শায়খ গাড়ি থেকে নামলে আশফিও নেমে আসে। শায়খ তখন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিল। কথা বলার শুরুতেই ঐন্দ্রী তাকে বলে, – “ভাইয়ের জীবন থেকে সরে যাওয়ার মিনতি জানানোর জন্যই ডেকেছো নিশ্চয়?” আশফি গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনের গ্যালারিতে কিছু ছবি ওপেন করল। ফোনটা ঐন্দ্রীর হাতে দিয়ে বলল, – “এই যে প্রথম ছবিটা দেখতে পাচ্ছো না! এটা আমার বারো বছর বয়সের। আর দিশান এখানে নয়। আমার হাতে যে কাচের তাজমহলটা দেখতে পাচ্ছো এটা ছিল তখন আমার বারোটা বছরের মধ্যে সব থেকে প্রিয় একটি জিনিস। যেটাকে আমি সবসময় খুব সাবধানে রাখতাম। আর দিশান শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দেখতো এটাকে। কাছে আসতো না এটার কখনো। কারণ এটা কাচের ছিল। ভাবতো যদি ধরতে গিয়ে কোনোভাবে ভেঙে ফেলে। কিন্তু এই তাজমহলটা ও আমার থেকেও বেশি পছন্দ করতো। শুধু একবার ধরে দেখার ইচ্ছা পূরণ করতো না আমার জন্য। ওই যে কোনোভাবে ভেঙে গেলে আমি খু্ব কষ্ট পাবো তাই। কিন্তু আমি আমার ভাইয়ের এত পছন্দের জিনিসটাকে ছুঁয়ে না দেখাটা মেনে নিতে পারিনি। ওর যেটা এত পছন্দ সেটা ও কোনোভাবেই ধরে দেখে না শুধু আমার কথা ভেবে। তারপর একদিন আমি বাবার কাছে ঠিক এমনই আরও একটা তাজমহল চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা এর থেকেও বড় চেয়েছিলাম। বাবা সেদিন রাতেই এর থেকেও আরও বড় আরও সুন্দর একটা তাজমহল আমাকে দিয়েছিল। দিশান সেদিনও শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছিল আর আনন্দে লাফিয়েছিল এত সুন্দর আরও একটা তাজমহল দেখতে পাবে প্রতিদিন তার জন্য। আমি সেদিন রুমে এসে ওর বিছানার পাশের টেবিলটার ওপর এটাকে সাজিয়ে রেখেছিলাম। আর তার পাশে আমারটা৷ ও সেদিন বলেছিল, – “আমার এখানে রাখলে আমার ভেঙে যেতে পারে ভাইয়া।” আমি বলেছিলাম, – “ভাঙলে আমি জুড়ে দেবো। তুমি এটাকে ধরবে খুব সাবধানে। যাতে কখনো হাত না কাটে।” আমাকে সেদিন ও জড়িয়ে ধরে নেচেছিল। এতটা খুশি হয়েছিল সে! এর প্রায় এক সপ্তাহ পর খেলার মাঝে বল লেগে বড় তাজমহলটা ভেঙে যায় ওর থেকে। ও সেদিন পাগলের মতো সেটাকে জোড়া লাগাতে গিয়ে হাত কেটে নিয়েছিল। আমি খুব রাগ করেছিলাম ওর হাত কাটার জন্য। এরপর আমার প্রিয় সেই ছোট তাজমহলটাও আমি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার যে জিনিস আমার ভাইকে কষ্ট দিতে পারে তা আমার যত প্রিয়ই হোক তার স্থান আমার জীবনে নেই।” ঐন্দ্রী নিশ্চুপ ছিল। আশফি এরপর আরও কিছু ছবি বের করে। ছবিটা ঐন্দ্রীর সামনে মেলতেই ঐন্দ্রীর বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠেছিল। ছবির মানুষটা ব্যালকনিতে ভেজা চুলে দাঁড়িয়ে কানে ফোন নিয়ে অস্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। ছবিটা খুব দূর থেকে নেওয়া হলেও ছবির মানুষটা যে আজ আশফির স্ত্রী, তা বুঝতে সমস্যা হলো না ঐন্দ্রীর। এরপর আরও কিছু ছবি দেখল সে। সেই রাতের ছবি। যেখানে মাহির গায়ে আশফির সাদা শার্টটা। লম্বা চুলগুলো ঝুলে নিচে পড়ে আছে। ঘুমে আচ্ছন্ন সে। আশফির মাথাটা নিজের বুকের মাঝে জাপটে ধরে আছে সে। আশফি এক হাত কোনো রকমে উঁচু করে টুপ করে কয়েকটা সেল্ফি নিয়ে নিয়েছিল তখন। শীতের কাঁপুনি আর জ্বরের কাঁপুনি এক সঙ্গে হয়ে বেহাল অবস্থা ছিল আশফির। নিজের শরীরের উষ্ণতার মাঝে যতটুকু সম্ভব সে আশফিকে সে রাতে আগলে রেখেছিল। আশফি এবার একটু মৃদু হাসলো। কিন্তু তার দৃষ্টি উদ্দেশ্যহীন কোথাও। ঐন্দ্রীকে বলল, – “সেই তাজমহলটার পর আমার জীবনে সেটার মতো আর কোনো জিনিস প্রিয় ছিল না। অথচ কী আশ্চর্য! এই তাজমহলের পর জীবনে আরও একটি অমূল্য আরও প্রিয় কিছু পাবো তা তো আমি আশাও করিনি। এই মেয়েটা, কখন যে জীবনের এই প্রিয় তাজমহলের চাইতেও এত বেশি প্রিয় কিছু হয়ে গিয়েছে তাও টের পাইনি। প্রত্যেকটা দিন যায় আর তার প্রতি আমার আসক্তি বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে আজ এমন এক জায়গায় এই আসক্তি পৌঁছেছে যে আজ ওই তাজমহলের মতো সে আমার ভাইয়ের জীবনের কষ্টের কারণ হলেও তাকে আমি ছুঁড়ে ফেলতে পারছি না আর কোনোদিন পারবও না। আবার ভাইটাকেও কষ্ট পেতে দেওয়া অসম্ভব আমার জন্য।” এটুকু বলার পর সে থামে। কোনো কথা ছাড়াই মাটির দিকে চেয়ে থাকে শুধু। এরপর অস্ফুটস্বরে সে বলেঐন্দ্রীকে, – “আমার কাছে ভালোবাসা অর্থ শুধু মাহি। আর যে ভালোবাসার অর্থই বুঝে ওই একটি নামকে, তার কাছে শুধু তুমি ঐন্দ্রী নয়, পৃথিবীর যে কোনো ঐন্দ্রীই আবছায়া আমার কাছে।” ঐন্দ্রীর দিকে চেয়ে এবার সে বলল, – “তোমার কাছে মাফ পাওয়ার যোগ্য কিনা জানি না। তবে আমাকে যে যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য তুমি আমার ভাইয়ের জীবনে এসেছো, সেখানে তুমি সাকসেস। আমি আজ নুইয়ে গিয়েছি ঐন্দ্রী। আমার ভাইয়ের হাহাকার দেখে আমি আজ অথর্বের মতো হয়ে পড়েছি। হারিয়ে ফেলেছি আমার প্রিয় মানুষকে ধরে রাখার মতো ক্ষমতা। তুমি আজ সত্যিই সাকসেস। আমার ভাইয়ের হাহাকার আমার ভেতরটা আজ দগ্ধ৷ চলে যাব কোথাও। যাকে ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি তাকে ফেলেই চলে যাব। কিন্তু আমি আমার ভাইকে ভালো দেখতে চাই ঐন্দ্রী। তুমি যেটা চেয়েছিলে সেটা তুমি পেয়ে গেছো। এরপরও কি আমার ভাই কষ্টে থাকবে? ঐন্দ্রী তুমি দেখো আমার দিকে তাকিয়ে। তুমি দেখতে পাচ্ছো আমার মাঝে সেই কিছুদিন আগের আশফিকে? আগের আশফির কতটুকু ক্ষমতা ছিল আর আজ সে কতখানি দূর্বল তুমি বুঝতে পারছো ঐন্দ্রী? তুমি সাকসেস।” ঐন্দ্রী সেদিন সত্যিই চেয়ে দেখেছিল আশফির সেই ক্ষীণ চাহনি, তার কম্পিত কণ্ঠ সুর। সব কিছু ঐন্দ্রীকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আশফি আর সেই আগের গাম্ভীর্যপূর্ণ, অনন্য ব্যক্তিসম্পন্ন ও দৃষ্টিভঙ্গির আশফির মাঝের বিশাল ব্যবধান। আশফি আবার বলে তাকে, – “আমার ভাই যে আমার প্রিয় মানুষটাকে আমার কাছে রাখার জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ত্যাগ করেছে। আজ সেই প্রিয় মানুষটাকে আমি যেন পেয়েও পেলাম না। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি কিন্তু ঠকায়নি ঐন্দ্রী। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার প্রতিদান পেয়েছি আমি। আমার প্রিয় মানুষটা আজ আমার কাছে থাকতে চায় না। তুমি যা চেয়েছিলে ঠিক তাই-ই হয়েছে। আজ আমার জীবনে ওই মেয়েটা এমন একটা স্থানে আছে যে আমি তাকে আমার সেই স্থানে আজীবন রাখতে চাইলে আমার ভাইকে কষ্টে থাকতে হবে জেনেও আমি তাকে সেই তাজমহলটার মতো ছুড়ে ফেলতে পারছি না। আর তাই তাকে তার স্থানে রেখে, আমার ভাইকে তার ভালোবাসা ফিরিয়ে আর যার সঙ্গে অন্যায় করেছি তার কাছে প্রায়শ্চিত্ত করে আমি নিজেই সব ত্যাগ করব। তুমি জানো ঐন্দ্রী, তুমি আমাকে আমার প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ না দিলে মাঝখান থেকে আমার ভাইটা তার ভাইয়ের সঙ্গে তার ভালোবাসাও হারাবে। তোমার তো দিশানের ওপর কোনো ক্ষোভ নেই তাই না! তোমার প্রাপ্য আমি ফিরিয়ে দেবো। প্রতিটা মানুষের সামনে তোমার কাছে মাফ চাইবো। আমার জীবনের অর্জিত সম্পদের অংশীদারও তুমি হবে। আশফি মাহবুব যে কষ্ট তোমায় দিয়েছে তার ফলস্বরূপ আর সে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে এসব তোমায় দিয়ে যাবে। তাতে সবাই জানবে এক বিরাট অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত সে করে গেছে।” – “আশফি প্লিজ থামো।” ঐন্দ্রী আর কান্না ধরে রাখতে পারেনি। চেঁচিয়ে উঠেছিল সে। তারপর বলেছিল, – “তুমি চলে যাব অর্থ কী?” আশফি কোনো উত্তর দেয়নি তাকে। তার নীরব চাহনিতে ঐন্দ্রী সব বুঝে নিয়েছিল। এবার আর আশফি ফিরে আসবে না। তা সে বুঝতে পেরেছিল। ঐন্দ্রী বলেছিল, – “আমার সাধ্যি নেই তোমার প্রিয় মানুষকে তোমার কাছে রাখার। তবে দিশানকে ভালো না থাকতে দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। ভেবেছিলাম এমন অনেক কিছুই। আর তা যে আমার কত বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল তা আমি গতকাল বিয়ের রাতেই উপলব্ধি করেছি। আশফি শোনো, ভালো থাকবে দিশান।” এটুকু বলেই ঐন্দ্রী সেদিন চলে এসেছিল। দিশান সব কিছু শুনে চোখদুটো মুছে নিয়ে বলল, – “ভাইয়া চলে গেলে আমি এত বড় আঘাত কী করে সহ্য করতাম শায়খ? মাহি যদি কাল ফিরে না আসতো আজ আমার ভাই কোথায় থাকতো? একজনকে পেয়ে আমি অন্যজনকে হারাতাম। আমার ভাই কেন বুঝতে চায় না আমার জীবনে সব থাকলেও সে ছাড়া সব অসম্পূর্ণ? আমরা কি কেউ না ওর কাছে?” – “ভাইকে ভুল বুঝো না। তুমি যা দেখোনি, যা সহ্য করোনি, যা অনুভব করোনি আর যে সময়টা তুমি পার করোনি সেই সব কিছু ভাইয়া দেখেছে, সহ্য করেছে, তা অনুভব করেছে আর সেই সময়গুলো কাটিয়েছে। এত কিছু পর ভাইয়া এভাবে যে কাউকে ভালোবাসতে পারে তা কি আমরা কেউ ভাবতে পেরেছি? বুঝতেই তো পারছো কতটা জায়গা জুড়ে আছে তার মাঝে ভাবি। হায়রে! তা ভাবি কবে বুঝতে পারবে? তোমার কষ্ট আর ভাবিকে পেয়েও না পাওয়া সবকিছু মিলিয়ে ভাইয়াকে হতাশা ঘিরে ধরেছিল। একটা মানুষ কত শক্ত হতে পারে বলো?” – “আমার তো ছুটে গিয়ে আমার ভাইটাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। আর মাহিকে হাজারবার বলতে ইচ্ছা করছে সে আমার কতবড় সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছে। তার কাছে আমি সারাজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ।” শায়খকে জড়িয়ে ধরে দিশান আবার কেঁদে ফেলল। . . আশফি বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে রুমে এসে ঢুকল। সারা রুমে আজ মোমবাতির হলুদাভা। ব্যালকনিটাও ছাড় দেওয়া হয়নি। আশফির কল্পনার বাহিরে ছিল আজ সে নিজের রুমটাকে এভাবে পাবে। এত সময় সে এটাই বিড়বিড় করে বারবার বলছিল, – “আগে ধরব তারপর বাঁধব তারপর মারব।” আর এবার সে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, – “প্রেম প্রেম পাচ্ছে খুব!” রুমের দরজা লাগিয়ে বিছানায় নজর পড়ল। খুব সাধারণের মাঝেও অসাধারণ। সাদা বেডশিটটাতে খালি লাল গোলাপের পাপড়ি। আর বিছানার চারপাশটাতে লাল রঙের মোমবাতিগুলো কী চমৎকারভাবে জ্বলছে। সারা রুমেও কেমন যেন একটা মিষ্টি ঘ্রাণ। মাথার মধ্যে প্রচন্ড ঝিম ধরে যাচ্ছে আশফির। একটু পর ব্যালকনিতে থেকে সেই শুভ্রকন্যা হেঁটে এসে তার সামনে দাঁড়াল। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে কী যেন দেখছে সে তার পা থেকে মাথা অবধি। ঘ্রাণটা যেন আরও বেশি তীব্র হলো মাহি আসার পর। আশফি মাহির কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে তার ঘাড়ের মাঝে নাক ডুবিয়ে কয়েকবার ঘ্রাণটা অনুভব করল। এরপর তার ভারী কণ্ঠে মৃদু আওয়াজে বলল, – “বড্ড অসুস্থ ঘ্রাণটা।” মাহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, – “অসুস্থ?” আশফি মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ প্রকাশ করল। মাহি এবার আশফির কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, – “অসুস্থ আমার পারফিউম নয়, অসুস্থ আপনি এবং আপনার মস্তিষ্ক।” এরপর মাহি একটু তার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে আশফি তার হাত টেনে ধরল। মাহি থেমে গিয়ে তার দিকে তাকালে আশফি ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে এসে কেমন ভাঙা সুরে বলল, – “তোমার ঘ্রাণ আমাকে অসুস্থ করেছে। তাহলে অপরাধী তোমার ঘ্রাণ।” – “আচ্ছা? তো এখন কী করতে হবে? ডক্টর ডাকব না কি পুলিশ ডাকব?” – “পানিশমেন্ট পেতে হবে তাকে। পুলিশ ডাকো।” মাহি কিছু সময় আশফির ঝিমিয়ে পড়া দৃষ্টি পানে চেয়ে রইল। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, – “নেশাটা কাটিয়ে আসুন।” আশফি অনেকটা তার বাধ্যগত ভাব নিয়ে বলল, – “আচ্ছা। কোথায় যাব?” মাহি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কড়া কণ্ঠে বলল, – “বাথরুম চেনেন না?” আশফি সেই আগের মতো মাথা উপর নিচ করে ইশারায় হ্যাঁ জানিয়ে চলে গেল বাথরুমে। কিন্তু বাথরুমের দরজাটা আর লাগিয়ে নিলো না। প্রায় বিশ মিনিট পার হয়ে গেল সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেকে দেখতে থাকল। মাহির এমনিতেই আজ রাতে ঘুম নেই। তার উপর আশফির নেশারত অবস্থা দেখে মেজাজ আরও খারাপ। এদিকে বাথরুম থেকেও ফেরার নাম নেই তার। কয়েকবার সে ভাবল উঠে গিয়ে দেখে আসবে সে কী করছে ভেতরে। আবার সে ভাবনা থামিয়ে ব্যালকনিতে বসে রইল। গত বিশ মিনিট যাবৎ আশফির বমি বমি ভাব লাগছে কিন্তু কিছুতেই তা উঠে আসছে না। এই অবস্থায় রুমে যাওয়াও ঠিক হবে না। যদি মাহিকে বাঁধতে গিয়ে তার গায়েই বমি করে ফেলে! এক মস্ত বড় মসিবত হলো তার জন্য। মাহি এবার তার পিছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, – “নেশা কাটানোর এ কেমন পদ্ধতি? আয়নাতে নিজেকে কী দেখছেন তখন থেকে?” আশফি আয়নার মাঝে তাকে দেখে জবাব দিলো, – “এমনিতেই নেশা কাটছে না। এর মধ্যে তুমি ঢুকলে কেন?” – “আমি ঢুকলে কী সমস্যা?” – “নেশার বাপ, দাদা সব এসে চেপে ধরবে এবার।” মাহি তার উল্টোপাল্টা কথার কোনো মানেই বুঝল না আর বোঝার চেষ্টাও করল না। আশফি কেমন অসহায় মুখ করে তাকে বলল, – “বমি পাচ্ছে কিন্তু আসছে না।” – “কেন আসছে না?” – “জানি না তো।” – “গলার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিন।” এটা বলেই মাহি মেজাজ দেখিয়ে চলে এলো বাথরুম থেকে। মাহি যেতেই আশফি সেটাই করে বসলো। গলার মধ্যে দু আঙুল ঢোকাতেই পেটের মধ্যে থাকা খাবার উগ্রে বেরিয়ে এলো কিছুটা। সাপোর্ট হিসেবে দেয়ালে হাত রাখতে গিয়ে সোপকেসে হাত পড়ে নিচে সাবান পড়ে গেল। আর এভাবে বমি হতেই আশফির আরও বেশি বমি পেলো। যেন ঠিক ভেতর থেকে ক্লিয়ার করে হলো না বমিটা। মাহি তার বমি করার শব্দ শুনে দ্রুত বাথরুমের মুখে এসে দাঁড়াল। সেখানে দাঁড়িয়েই আশফিকে সে বলল, – “চোখে মুখে পানি দিন। আর মুখের মধ্যে পানি নিয়ে গড়গড় করুন।” আশফি মাহির কথাগুলো শুনে সেটাই করল। তারপর আবার বলল, – “আমার বমি পাচ্ছে আবার।” – “তো করে ফেলুন।” সঙ্গে সঙ্গেই আশফি হড়বড় করে আবার বমি করে দিলো। বমি শেষ হতেই মুখে চোখে পানি দিয়ে এরপর কুলকুচা করে মাহির দিকে ফিরে দাঁড়াতে গেল। কিন্তু তখন ঘটল আর এক বিপদ। নিচে পড়ে থাকা সাবানের ওপর পা পড়ে পিছলে সে নিচে পড়ে গেল। মাথার পেছনটাতে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলো সে, হাতের কনুইতেও ব্যথা পেলো। মাহি দ্রুত তার কাছে ছুটে এলো। চেঁচিয়ে বলে উঠল, – “আশফি ঠিক আছেন আপনি?” মাথার পেছনে হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে রইল আশফি। তাকে টেনে ওঠাতে গেলে আশফি বলল, – “আমি গোসল করব। আমার অস্থির লাগছে খুব।” কথাটা বলেই আশফি দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রইল। বমি করতে এসে সে ঘেমে উঠেছে। আর এর জন্যই এখন তার হঠাৎ অস্থির অস্থির লাগছে। এসব কারণে মাহিও ভাবল তাকে গোসল করিয়ে দেওয়াটাই ভালো হবে। মাহি তাকে গিজারের পানিতে গোসল করানোর জন্য তার কাছে এসে বলল, – “শার্টটা খুলুন তো আগে।” আশফি ঘাড় নাড়িয়ে অনেকটা টেনে টেনে বলল, – “পারব না।” মাহি একটু সরু দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। কিন্তু সে হাত পা টানটান করে ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। যেন তাকে গোসল করিয়ে দেওয়ার দায় মাহির। মাহি এবার নিজে তার শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করলে আশফি তার হাত থাবা দিয়ে ধরে ফেলে বলল, – “এই! আমার শার্ট খুলছো কেন তুমি? কী মতলব তোমার?” – “বাহ্! কী দারুণ কথা! আমার মতলব কী? এসব ফাজলামি বাদ দিয়ে শার্ট, প্যান্ট খুলে টাওয়াল পরে নিন।” আশফি ধমকে তাকে বলল, – “পারব না বললাম না। আমি এভাবেই গোসল করব।” আশফি উঠে দাঁড়িয়ে গিজারের পানি ছেড়ে দিলো। মাহি প্রায় অর্ধেক ভিজে গিয়ে দ্রুত সরে এলো তার কাছ থেকে। দূরে দাঁড়িয়ে সে চেয়ে দেখল আশফি আবার নিচে বসে পড়ে শার্ট প্যান্ট পরে ওভাবেই ভিজে যাচ্ছে অনবরত। মাথার পেছনটাও বারবার চেপে ধরছে। এবার আর মাহি দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তাকে জোর করে টেনে ওঠাতে গিয়ে পড়ল আর এক বিপত্তিতে। আশফি হাতের ইশারায় তাকে অপেক্ষা করতে বলে গায়ের শার্ট খুলে নিচে ছুঁড়ে ফেলল এমনভাবে যেন খুব দুর্গন্ধ তাতে। এরপর প্যান্ট খুলতে গেলে মাহি চেঁচিয়ে তাকে উঠে বলল, – “একদম টাওয়াল ছাড়া প্যান্ট খুলবেন না।” আশফি বিরক্তিকর চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে টাওয়ালটা পরে নিয়ে তারপর প্যান্ট খুলল। এবার মাহি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বাথরুম থেকে বের হতেই আশফি বাথট্যাবের মধ্যে গিয়ে নেমে পড়ে। বাথট্যাবে নামার আওয়াজ পেয়ে মাহি আবার ফিরে এসে আশফির এবারের কান্ড দেখে রাগের চোটে তার দিকে সাবানটা ছুড়ে মারতে গিয়েও থেমে গেল। বাধ্য হয়ে তার কাছে যেতে হলো তাকে। এবার মাহি নিশ্চিত কিছু সাংঘাতিক ঘটনা এই লোকটা আজ ঘটাবেই। আর সেই ভাবনা ভাবনাতে থাকতেই আশফি সেই সাংঘাতিক ঘটনা ঘটিয়ে নিলো। ……………………………. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin আসলে এত বড় পর্ব লেখার পর বানান, ভুল-ত্রুটি খুঁজে এডিট করতে প্রচন্ড আলসে লাগে। তাই কষ্ট করে ভুলগুলো বুঝে নেওয়ার অনুরোধ রইল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে