#তুমি_রবে_নীরবে
#পর্ব_৩
#সাদিয়া_ইসলাম_ইকরা
গানটা শেষ হতেই মনে হল আমার ঘোর কেটেছে।আদিব ভাইয়া আমাকে দেখার আগে আমি তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে আসলাম।এসেই ভাবছি সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে আবিরকে কল দিব।আদিব ভাইয়ার জন্য তো ভালো করে কথাও বলতে পারিনি তখন।
যেদিন প্রথম কলেজে গিয়েছি সেদিন আবিরের সাথে আমার প্রথম দেখা।সব কিছুই প্রথম।ছেলেটা পড়ালেখায় ভীষণ ভালো।দেখতে সুদর্শন তো বটেই।আমি কলেজ যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই অবনী কলেজ যেতো।বাসায় ঝামেলার কারণে আমি কয়েকদিন কলেজে যেতে পারিনি।এর মধ্যে আবিরের সাথে অবনীর পরিচয় হয়।
যাই হোক।অবনীর সাথে একটা ছেলের প্রায় বছর দুয়েক প্রেম চলছে।আমি যেদিন প্রথম কলেজ যাই সেদিন অবনী এক কোনায় বসে কাঁদছিল।পাশে আবিরও ছিল।দুইজনের মধ্যে কথা হচ্ছে।আমি অবনীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।অবনী কাঁদছে তাদের নাকি সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে।ছেলেটা অবনীকে ভুল বুঝে ছেড়ে চলে গেছে।অবনীর সব কথা মোটামুটি আমি জানি।কিন্তু কিছুদিন কথা না হওয়ায় এই কথাটা জানতাম না।আবির অবনীকে খুব করে বুঝানোর চেষ্টা করছে।আবির বলছে
“তোরা দুইজন এতদিন একসাথে ছিলি।মানুষটাকে ছাড়া যে থাকতে পারবি না সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।তুই যদি বলিস অয়নকে(অবনীর সাথে যার সম্পর্ক)ছাড়া থাকতে পারবি আমি কখনো বিশ্বাস করবো না।দিন শেষে ঠিক’ই নীরবে এইভাবে কাঁদবি।যে মানুষটাকে তুই তোর ভরসার কাঁধ ভেবেছিস তাকে এইভাবে হারাতে দিস না।অয়নের নম্বরটা আমাকে দে।বাকিটা আমি দেখছি।
আমি পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুধু আবিরের কথাগুলো শুনছি।
আবির অয়নকে কি বলেছে জানি না কিন্তু পরের দিন থেকে অবনী আর অয়নের মধ্যে সবটা ঠিক হয়ে গেল।তাদের প্রেম আবার আগের মত চলতে লাগলো।
সেদিনই আবিরের প্রতি আমার দূর্বলতাটা তৈরি হয়।কি সুন্দর করেই না বুঝালো সবটা।
এর মধ্যে যে কয়দিন ক্লাস করেছি আমার দিকে আবিরের উঁকিঝুঁকি তো ছিলই।কলেজ থেকে ফেরার পথে প্রতিদিন প্রায় অনেকটা পথ আমার পিছনে পিছনে চলে আসতো।
হঠাৎ একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।একেবারেই ঝুম বৃষ্টি।
এই ঝুম বৃষ্টিতে এক গুচ্ছ কদম নিয়ে আবির আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।মুঠো ভরতি কদম আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে প্রপোজ করে বসলো।যদিও আগে অবনীকে দিয়ে কয়েকবার বলিয়েছে কিন্তু আমি চেয়েছি সরাসরি প্রপোজটা করুক।
এত গুছিয়ে কথা বলতে পারা ছেলেটাও সেদিন কেমন যেন অগুছালো হয়ে গেল।আমার দিকে কদম গুচ্ছ বাড়িয়ে দিয়ে নিচের দিকে মাথা ঝুকিয়ে বললো “তোমার অনুমতি পেলে আমার বাকিটা জীবনের প্রতিটা মিনিট তোমাকে ভালোবাসতে চাই”
খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আরো কিছু বলুক।আরো বেশি করে বলুক।আর আমি শুনি।কিন্তু আর কিছুই না বলে চুপ হয়ে গেল।আমি হাত বাড়িয়ে কদম গুলো নিয়ে কিছু না বলে বাসায় চলে যাচ্ছি।মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলছে উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো কিন্তু।
আমি পিছনে তাকাতে আবির লজ্জায় চোখ জোড়া সরিয়ে নিল।আমি তো লজ্জা পাচ্ছিলামই আবিরও লজ্জায় একেবারে লাল।তারপর আবিরের সাথে আর কোনো কথা হয়নি।
তারপর থেকে তো আর কলেজ যাওয়াও হয়নি।চাচ্চুর বিয়ে নিয়েই আছি।কাল চাচ্চুর গায়ে হলুদ।সবাই টুকটাক কাজ সেরে যে যার মত করে ঘুমিয়ে পড়লো।তখন রাত প্রায় ১টা বাজতে চলেছে।সবাই যখন ঘুমের ঘোরে আমি আবিরকে কল দিলাম আবির কল রিসিভ করতেই নিচু গলায় ফিসফিস করে কথা বলছি তা না হলে তনু সবটা শুনে ফেলবে।আর সবাইকে যা না তাই বুঝাবে।
–হ্যালো!
–তুমি ঘুমাওনি?
–না মাত্র আসলাম ঘুমাতে।
–তুমি আর কল দিবে না মনে করে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।মোবাইলটা বেজে উঠতে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
–ওহ!সরি। তাহলে ঘুমাও তুমি।
–না পরে ঘুমাবো।কি কি করেছ এতক্ষণ?
— বাসায় অনেক ঝামেলা তুমি তো জানোই।
–হ্যাঁ!অবনী বলেছে তোমার চাচ্চুর বিয়ে। আমাকে তো দাওয়াত দিলে না।
–মাথা খারাপ!আম্মু ছেলে ফ্রেন্ড বাসায় এনেছি জানলে কি যে করবে আমি নিজেও জানি না।
–কি?আমি এখনো তোমার ফ্রেন্ড!
–নয়তো কি?ফ্রেন্ডই তো।
–না ফ্রেন্ড না।বলো কি?
–ইশ!জানি না আমি!
আমি আর আবির ঘুম জড়ানো কণ্ঠে কথা বলছি।কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানি না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখছি মোবাইলটা কানের নিচে চাপা পরে আছে।মোবাইলটা রেখে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে নিলাম।
সবাই ব্যস্ত।বিয়ে বলে কথা ব্যস্ততা তো থাকবেই।সবাই মিলে মেহেদী দিচ্ছে।কয়েকজনের তো ইতিমধ্যে দেওয়া শেষ।সেখানে ফেলুদাও আছে।আমাকে ডাকছে মেহেদী দিতে।একগাল হাসি নিয়ে হাত গুলো উপরে করে আমাকে বলছে
–আপু দেখ সবাই মেহেদী দিচ্ছে।আমিও দিয়েছে।
–ভালো করেছিস!
–তুই দিবি না?
–না আমি দিবো না।তুই দিয়েছিস হয়েছে।তা তুই তো কিছুক্ষণ পড়তে বসতে পারতি।বিয়ে বলে কি পড়তে বসা যায় না?অংকে তো আজীবন ফেল মারিস।
–উফ আপু তুই ও পারিস বটে!যেখানে সেখানে আমাকে অপমান করিস শুধু।তোর সাথে কথা বলাটাই ভুল হয়েছে আমার।
এই কথা বলেই রাগে,দুঃখে এক বুক হতাশা নিয়ে গজ গজ করতে করতে চলে গেল।তনু ক্লাস নাইনে উঠেছে এইবার।তনুকে অংকের কথা বলে বলে মাথা খারাপ করে দিই।আমি ওর সাথে এইসব করে বেশ মজা পাই!
যাই হোক,সবাই ঠিক করেছে আজকে শাড়ি পড়বে।ছেলেরা হলুদ রঙের পাঞ্জাবী আর মেয়েরা বেগুনি আর বাসন্তী রঙের শাড়ি।আমি ঠিক করেছি শাড়ি পড়বো না।শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করলেও সামলাতে পারি না।তাই আমার জন্য ড্রেসই ভালো।
সবাই চাচ্চুর বিয়ের জন্য একই রকম শাড়ি নিয়েছে।মা আর চাচীরাও।এইদিকে বাবা আর চাচ্চুরা একই রকম পাঞ্জাবী বানিয়েছে।
বিয়ে বাড়ির সন্ধ্যা মানেই অন্য রকম কিছু।সন্ধ্যা হতেই আমরা যে যার মত তৈরি হচ্ছি।মুখোমুখি দু’টো রুম।একটাতে মেয়েরা তৈরি হচ্ছে।অন্যটাতে ছেলেরা।কেউ শাড়ি পড়ছে কেউ চুল ঠিক করছে কেউ সাজগোজ
করছে।পুরো বাড়ি জুড়ে হৈ-হুল্লোড় ব্যাপার।
আমার ওতো ঝামেলায় পড়তে হয়নি।ড্রেসটা পড়েছি হালকা সেজেছি।চুল খুলে দিয়েছি।আমি সবার আগে তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হলাম।আমি যেই না দরজা খুলেছি সামনা সামনি যে রুমটা আছে সেটার দরজাটাও কে যেনো খুলেছে।কেউ একজন একটা নীল পাঞ্জাবী পড়ে বের হচ্ছে।আমার দিকে ফিরে তাকাতে দেখছি আদিব ভাইয়া।আমি তো অবাক!আমি যতদূর জানি ছেলেদের পাঞ্জাবীর রঙ ঠিক করা হয়েছে হলুদ আর সবাই হলুদ’ই বানিয়েছে তাহলে ভাইয়ার গায়ে এই রঙের পাঞ্জাবী কেন?আমিও নীল পড়েছি ভাইয়াও নীল পড়েছে।
ভাইয়া আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিক থেকে তার চোখই সরছে না।কোনো ছেলে যখন কোনো মেয়ের দিকে এইভাবে তাকায় সেই সময়টা হলো মেয়েদের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর অনুভূতি।তখন কোনো মেয়ে স্থির থাকতে পারে না।আর লজ্জায় ঘামতে থাকে।আমার অবস্থাও ঠিক একই রকম।
ভাইয়া আমাকে নিচু গলায় বলছে
–একটু এইদিকে আসবি?
–কোথায় যাবো।
–চল না।কথা আছে।
–যা বলার এইখানে বলো।
–আরে আয় তো
বলে আমার হাত ধরে নিয়ে গেল।জায়গাটা ঘরের একেবারে কোনায়। সেদিকে তেমন কেউ আসা যাওয়া করে না।আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ভাইয়া বলল
–তোর জন্য!
–কি আছে এতে?
–নিজেই দেখে নে।
–বলো না।
–তুই দেখ।
কাগজে মোড়ানো প্যাকেটটা খুলতেই দেখলাম ২ডজন কাঁচের চুড়ি।তাও আবার ড্রেসের সাথে মিলিয়ে নীল রঙের।
–তুমি কিভাবে জানো আমি নীল ড্রেস পড়বো।
–জেনে নিয়েছি
–কার কাছে।
–ফেলুদা।
আমি আগেই টের পেয়েছি আমার প্রতি আদিব ভাইয়ার দূর্বলতা আছে।কিন্তু আজ পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম।একটু পর দেখলাম তনু আমাদের দিকে আসছে।সে আমাকেই খুঁজচ্ছিল।তার চুল বেঁধে দেওয়ার জন্য।আদিব ভাইয়া তনুকে দেখতে পেয়ে চলে যাচ্ছে।যেতে যেতে বলছে চুড়ি গুলো হাতে দিবি কিন্তু!
চলবে…