#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writer_sumaiya_afrin_oishi
#অন্তিম_পর্ব
নিজের শক্ত পোক্ত ছেলেটা’কে হঠাৎ করে এভাবে কাঁদতে দেখে কেঁপে উঠলেন ফাতেমা খানম।ততক্ষণাৎ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে, ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে ফাহাদ? এভাবে কাঁদছিস ক্যান?”
“মা… মা চাঁদ চলে যাচ্ছে। আমার চাঁদ কে আটকাও মা, ও ঠিক তোমার কথা শুনবে। বলো আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! আমার চাঁদ’কে এনে দেও মা! ওরে যাইতে নিষেধ করো প্লিজ!” ভা’ঙা ভা’ঙা কণ্ঠে বললো ফাহাদ।
প্রিয় জনের চলে যাওয়াতে ছেলেটা আজ নিজের মধ্যে নেই। উ’ম্ম’দের মতো আচরণ করছে। প্রিয় হারানোর কষ্ট যে তীব্র বে’দ’না’দা’য়’ক! এই কষ্ট তিলে তিলে ভিতর থেকে ম*রে গিয়েছিলো ছেলেটা।
প্রথম দ”হ’ন চা’পা রেখে দ্বিতীয় বারের মতো এ্যাই মেয়েটাকে ভরসা করেছে সে। সেই ভরসাযোগ্য রমনীর জন্য নিজের অজন্তে ধীরে,ধীরে হৃদয়ের-কোঠরে ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি জন্ম নিয়েছে। একবার, সে খবর কি রেখেছে মেয়েটা?
হাহ্! সেও দিব্যি চলে যাচ্ছে ভে’ঙে যাওয়া মানুষটাকে একা ফেলে। মেয়েটার কি মোটেও বুক কাঁপছে না? এতো নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্ত কি করে নিলো?
মানছে ফাহাদ, ভুল করেছে সে, চরম ভুল! তারজন্য তো ক্ষমা ও চেয়েছে। কঠিন রমনী কি পারতো না তাকে একবার ক্ষমা করতে? বিচ্ছেদ তো আর সবকিছুর সমাধান নয়! তবে মেয়েটা কেন মুক্তি চাইছে?
আচ্ছা, তবে কি সেও এসেছিলো তাকে সবার মতো কষ্ট দিতে?
সারা রাজ্যের উদ্ভব চিন্তা, সূক্ষ্ণ বেদনা গুলো উইপোকার মতো করে নিগড়ে দিচ্ছে তার মস্তিষ্ক।
তার “চাঁদ পাখি” চলে যাচ্ছে এটা কিছুতেই মানতে পারছে না ছেলেটা।
ফাহাদ মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে, হঠাৎ করে মাথার দুই পাশ হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তার মাথার দুই সাইড য’ন্ত্র’নায় ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে।
সারাক্ষণ গম্ভীর, কাঠিন্য ছেলেটার করুণ চেহারা দেখে আতঙ্কে উঠলেন মা।
ফাতেমা খানম বিচলিত হয়ে ছেলেকে বললো,
“এমন করছিস কেন বাপ? খুউব কষ্ট হচ্ছে কি? একটু শান্ত হ বাপ!”
ফাহাদ নির্বাক। ফাতেমা খানম উঠে দাঁড়ালো, বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে ছুটে গেলেন। তান্মধ্যে দাদি আসলেন ফাহাদে’র নিকটে, নাতির কাঁধে হাত রাখলেন। ফাহাদ চোখ তুলে তাকালো দাদির মুখপানে। এরিমধ্যে দাদি কোমল কণ্ঠে শুধালো,
“কষ্ট হইতাছে দাদুভাই? তয় ক্যান অযথা এই দূরত্ব? হুনো দাদুভাই? সম্পর্কে দুরত্ব বাড়াইতে নাই! সবসময় সব সিদ্ধান্ত মাইনা নেওন যায় না। মাঝে মাঝে নিজের জন্য হইলেও স্বার্থপর হইতে হয়, জোড় কইরা হলেও নিজের ভালো থাকা ছি’না’ইয়া আনতে হয়।
এহনো কিন্তু সময় আছে। এহন এইভাবে ভা’ই’ঙ্গা পড়লে হইবো কও? উইঠা যাও জলদি, হ’ক্ক’ল (সকল) দুরত্ব চুকিয়ে জোড় কইরা হইলেও নিয়া আহো তারে। ব্যাডা হইছোস, মাঝে মাঝে নিজের শক্তি ও প্রয়োগ করোন লাগে।”
দাদির কথায় যেন টনক নড়লো ছেলেটার। সে তড়িৎগতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো। অতঃপর মুহুর্তের মধ্যে বাসা থেকে ছুটি গেলো বাহিরে।
.
চাঁদ ইতোমধ্যে গাড়ির কাছাকাছি চলে গিয়েছে। আচমকা মনে হলো সে শূন্যে ভাসছে। “আল্লাহ গো!” বলে ভয়ে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো মেয়েটা।
কয়েক সেকেন্ড পেরোতেই নিজেকে ধাতস্ত করে নিলো, হঠাৎ পুরুষালী শক্ত হাতের বাঁধনে নিজেকে আবিষ্কার করতেই চোখ মেলো তাকালো চাঁদ।
মুহূর্তে ফাহাদে’র হাসিহাসি মুখটা চোখে পড়লো তার। একসময় এই হাসিতে মুগ্ধ হতো সে, কিন্তু আজ ভীষণ রাগ লাগছে। যাওয়ার বেলায় কেনো এতো পা’গ’লা’মি? যখন থাকতে চেয়েছে তখন তো তুচ্ছ ভেবে বারংবার ছুঁড়ে ফেলেছে।
ফুঁসে উঠলো চাঁদনী! দাঁত দাঁত চেপে বলে উঠলো, “ছাড়ুন আমায়।”
“উঁহু! তোমাকে আর এই জন্মে ছাড়ছি না চাঁদ পাখি।” মুচকি হেসে বললো ফাহাদ।”
চাঁদ কটমট চোখে তাকালো। ফাহাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, পরক্ষণে চাঁদ চারপাশে একবার তাকালো, বাবা-মা সহ সবাই বাহিরে এখন। সবাই তাদের দেখছে আর মিটমিট করে হাসছে। লজ্জায় নাক কা*টা যাচ্ছে তার, অথচ ছেলেটা এখনো বেহায়ার মতো হাসছে।
ফাহাদে’র মতো গম্ভীর পুরুষে’র দ্বারা এমন কাজ হতে পারে, এ যেন অবিশ্বাস্য!
কিন্তু, এই মুহূর্তে বিশ্বাস না করে উপায় আছে?
চাঁদ পুনরায় আবারো রাগী রাগী কণ্ঠে বললো,
“সবার মাঝে বসে এসব কোন ধরণের অসভ্যতা ফাহাদ। আমাকে নিচে নামিয়ে দিন দ্রুত।”
প্রত্যুওরে ফাহাদ কিছু বললো না। হাতের বাঁধন আরো একটু শক্ত করে বাসার দিকে হাঁটা দিলো। চাঁদ টা’ল সামলাতে না পেরে, নিজেকে বাঁচানোর জন্য একহাতে ফাহাদে’র গলা জড়িয়ে ধরলো। ফাহাদে’র ঠোঁটের কোণের হাসিটুকু গাঢ় হলো, লম্বা করে পা ফেললো। কিন্তু, দ’মে নেই চাঁদ।
তার মুখ ননস্টপ চলছে, হাত-পা ছোটাছুটি করে নিজেকে ছাড়াতে চাইছে। কিন্তু বারংবার ব্যর্থ সে। শক্ত পোক্ত পুরুষটির বাঁধন থেকে কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না।
চাঁদের এমন কার্যে খানিকটা বিরক্ত হলো ফাহাদ, পরক্ষণে চাঁদের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে ফাহাদ বলে উঠলো,
“শান্ত হও চাঁদ পাখি! না হয় কিন্তু, এক্ষুনি লিপ কিস করে দিবো। তখন কিন্তু সবার মাঝে আরো বিপাকে পড়বে তুমি। কি করবো নাকি? শুধু একটা!”
কথা শেষ করেই ফাহাদ নিজের ঠোঁট জোড়া এগিয়ে নিলো চাঁদের মুখের দিকে।
চাঁদ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে উঠলো, ছিহ অ’স’ভ্য লোক!”
বলেই, নিজের ঠোঁট হাত দিয়ে ঢেকে নিলো চাঁদ। ফাহাদ এবার খানিকটা শব্দ করেই হাসলো। দ্রুত পা চালিয়ে ভিতরে চলে আসলো ফাহাদ। চাঁদ কিচ্ছুটি না পেরে হঠাৎ করে কেঁদে উঠলো। ফাহাদ এই মুহূর্তে সেদিকে পাওা দিলো না।
.
একটু সময় নিয়ে পিছনে, পিছনে বাবা ও আসলো, তার পিছনে বাকি সবাই।
ছেলের এমন আচরণে আফজাল হোসেন কণ্ঠ কাঠিন্য করে বলে উঠলো,
“দাঁড়া ফাহাদ। এগুলো কেমন অসভ্যতা। আমার মেয়ের থেকে তুই দূরে থাক,ওকে ছাড় তুই।তোর মতো ল’ম্প’টের সাথে আর নয়, আমার মেয়ে তোর থেকে ভালো কিছু ডিজার্ভ করে। অহেতুক ঝামেলা করিস না, আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
ফাহাদ বাবা’র দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চ’ট করে বললো,
“আমার বউ’কে আমি কোথাও যেতে দিবো না আব্বু। আমার বউয়ের সাথে সবটা আমি বুঝে নিবো। তুমিও আমাদের মাঝে অহেতুক ভি’লে’ন’গি’রী করতে এসো না। তুমি গিয়ে তোমার নিজের বউ সামলাও।”
স্বামীর এমন কথায় চাঁদের কান্না থেমে গেলো, সবার সামনে ভ’য়ংক’র লজ্জায় নুয়ে গেলো।
আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না ফাহাদ,সবাইকে উপেক্ষা করে চাঁদ’কে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে সবার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।
এদিকে ছেলের বেফাঁস কথা শুনে ফাতেমা খানম ওখান থেকে চলে গিয়েছে ইতোমধ্যে, আফজাল হোসেন ও পড়ে গেলেন বিপাকে। ছেলের রুমের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলো, “বে’য়া’দ’ব ছেলে!”
পাশেই দাঁড়ানো ছিলো আসিয়া খানম, বাপ-ছেলের কথা শুনে মুখে আঁচল চেপে হাসছেন সে। যা দেখে লজ্জা পেলো আফজাল হোসেন, এই বয়সে এসেও বাঁদর ছেলের জন্য মায়ের সামনে লজ্জায় পড়তে হলো।
উনিও আর না দাঁড়িয়ে, মাথা চুলকাতে চুলকাতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। তবে তার ঠোঁট জুড়ে প্রশান্তির ছাপ।
.
.
রুমে এসে তবেই চাঁদ’কে কোল থেকে নিচে নামালো ফাহাদ। এদিকে রাগে, দুঃখে কথা বলতে বেমালুম ভুলে গেছে চাঁদ। সমস্ত অনুভূতি একাকার হয়ে কাঁপছে সে। ফাহাদ এগিয়ে আসলো, চাঁদ’কে ধরে বিছনায় বসিয়ে দিলো। নিজেও বসলো চাঁদের কাছাকাছি। আদুরে হাতে ছুঁয়ে দিলো কৃষ্ণরাঙা মেয়েটার গাল।
ফাহাদের ছোঁয়াতে সজ্ঞানে ফিরলো চাঁদ। ফাহাদে’র হাতটা এক ঝাঁকায় সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“আপনি ছোঁবেন না আমায়। আপনা’কে সহ্য হয় না আমার ফাহাদ। কেনো এমন করছেন আপনি? আমি থাকবো না এখানে, চলে যাবো।”
মেয়েটার এমন কথা গুলো ধা’রা’লো অ’স্ত্রে’র মতো বিঁধছে ফাহাদে’র বুকে। সে কিচ্ছুটি না বলে, তাকিয়ে রইলো চাঁদের মুখপানে। এরিমধ্যে চাঁদ নিজেই সরে গেলো, উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। ফাহাদ ও উঠে দাঁড়ালো, চাঁদ পুনরায় জোড় করে বসিয়ে দিলো। আজ যেন ফাহাদ নামক শক্ত পুরুষটি ভীষণ নির্লজ্জ, বড্ড বেহায়া হয়ে গিয়েছে।
“বনের পাখি একদিন ঠিকই পোষ মানে কিন্তু
মনের পাখিটা, ভালোবাসার পিঞ্জিরা ভেঙে উড়াল দেয়! বনের পাখিটা একটা সময় পোষ মেনে যায় মানুষের ভালোবাসার টানে।কিন্তু যাকে যত্নে মনের পিঞ্জিরায় ভালোবেসে রাখা হয় সেই পাখিটা উড়ে যেয়ে বন্দী হয় অন্য খাঁচায়, কেনো যাবে কিসের আশায়? আমার খাঁচা শূন্য কইরা, উড়াল দিতে চাও চাঁদ পাখি? আমারে একলা কইরা যেও না পাখি!”
চাঁদের দিকে তাকিয়ে আকুতি কণ্ঠে বললো ফাহাদ। এতেও মন গলেনি মেয়েটার।
ফাহাদ চাঁদের গা ঘেঁসে বসলো, চাঁদের হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে বিনয়ী কণ্ঠে বলে উঠলো,
“স্যরি চাঁদ পাখি!”
নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে চাঁদ বললো,
“কিসের স্যরি হ্যাঁ। আপনি একদম ঢঙ করবেন না আমার সাথে।”
ফাহাদ একহাতে চাঁদকে আলতো জড়িয়ে ধরে, মৃদু কণ্ঠে বললো,
“তুমি বউ না! তোমার সাথেই তো যতপ্রকার রঙ-ঢঙ করবো বউ।”
চাঁদ কটমট করে চোখ রাঙালো। ফাহাদ চাঁদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ালো।
চাঁদের হিজাব, বোরকা জোড় করে একে একে খুলে ফেললো। যদিও চাঁদ খুলবে না বলে জেদ ধরেছিল কিন্তু পুরুষালী শক্তির কাছে পেরে উঠলো না।
নিজের কাজে বাঁধা পেয়ে, কেঁদে উঠলো চাঁদনী। এতক্ষণের দমিয়ে রাখা কান্না গুলো দলা পাকিয়ে বাহিরে আসছে।
ফাহাদ ব্যস্ত হয়ে গেলো চাঁদের কান্না দেখে। চাঁদের চোখের পানিটুকু গড়িয়ে পড়বার আগেই নিজের হাত দিয়ে যত্ন করে মুছে দিলো।
আকষ্মিক কৃষ্ণকলির কপালে গভীর ওষ্ঠ ছুঁয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো,
“কেঁদো না চাঁদ পাখি! প্লিজ আর কেঁদো না, কান্না থামাও। আমি আবারো স্যরি! এবারের মতো প্লিজ সব ভুলে ক্ষমা করে দেও! আর কখনো এমন হবে না। বিচ্ছেদ কোনো সমাধান নয় চাঁদ!”
চাঁদ মুখ ফিরিয়ে নিলো, নাক টেনে টেনে বলে উঠলো, “আপনি ভীষণ খারাপ লোক ফাহাদ, ভীষণ ! আমি সবকিছু উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসে ও আপনার কাছে বারংবার তুচ্ছ হয়েছি।”
“তুমি ঠিক বলছো, তার মানে এই নয় যে আমি ভুল!
তুমি আমার জায়গায় আসো, দেখবা আমিও ঠিক ছিলাম!’
“সবাই ‘ই সঠিক কেবল আমিই ভুল। আমি একাকীই আপনার চাঁদ হতে চেয়েছিলাম।
আপনার অন্ধকারাচ্ছন্ন আমাবস্যা রাত কাটিয়ে দিয়ে আলো ঝলমলে জ্যোৎস্নার রাত হতে চেয়েছিলাম।
এর থেকে বরং, আপনি যদি চাঁদ হতেন তবে আমি দূর থেকে আপনাকে দেখা মুগ্ধ হতাম। চন্দ্র বিলাস করতাম ব্যালকোনিতে বসে। আর না কাছে আসা হতো, আর না যন্ত্রণা পেতাম।” চোখ মুছতে মুছতে মলিন কন্ঠে বললো চাঁদ।
ফাহাদ আহত কণ্ঠে বলে উঠলো, “এভাবে বলো না চাঁদ!”
চাঁদ অশ্রুসজলে খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। অতঃপর অভিযোগ করে পুনরায় বললো,
“এতো কঠিন না হয়ে এই অভাগী মেয়েটার প্রতি একটু সহজ হলেও পারতেন। তাহলে কি এই দিন সামনে আসতো ফাহাদ? আপনি বরং আমার মন আকাশে চাঁদ হতে পারতেন।
আমি দ*স্যু মেয়ের মতে দুঃখ বি’ষাদ না ছুঁয়ে, কয়েক আলোকবর্ষ শুধু জ্যোৎস্নার আলো ছুঁয়ে যেতাম। কিন্তু আপনিও হলেন আমাবস্যার রজনী!”
থামলো চাঁদ, ফাহাদ মাথা নত করে নিলো।
দুজনের মধ্যে নিরবতা। একটু পরপর চাঁদ ফুঁপিয়ে উঠছে।
মিনিট সময় পেরোতেই নড়েচড়ে বসলো ফাহাদ, এতো কাছ থেকে প্রিয় জনের আকুতি কান্না কি সহ্য করা যায়? বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো ছেলেটার। বুকটা খাঁ’খাঁ করছে তপ্ত এক আলিঙ্গনে জন্য।
তান্ম্যধে নিরবতা ভে’ঙে চাঁদ ভা’ঙা ভা’ঙা কণ্ঠে বললো,
“তোমার চাহিদার বাইরে হয়তো এক মাত্র আমি ছিলাম। নয়তো এত কিছু চাওয়ার ভীড়ে আমাকে চাইতে ভুলে যেতে না কখনো।”
ফাহাদ চোখ তুলে তাকালো, চাঁদের চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু সুরে বললো,
“আমাকে ভুল বুঝো না চাঁদ। তুমি জানো না মেয়ে, আমরা সবসময় ভুল মানুষকেই ভালোবাসি। সেই ভুলের রে*শ তো আর অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মুছে ফেলা যায় না। তুমি ছিলে আমার অনাকাঙ্ক্ষিত পাওয়া! তখন পরিস্থিতি অন্য রকম ছিলো চাঁদ।
তবে, সময়ের সাথে সাথে মানুষ পরিবর্তনশীল। এবার দেখো, একবার চোখ রাখো চোখে। এই চোখের দিকে একবার চেয়ে দেখো চাঁদ? কতটা চাই তোমাকে।”
চাঁদ তাকালো না, দরজার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো,
“আর চাওয়ার কি দরকার? চাওয়া -পাওয়ার সমস্ত হিসেব চুকিয়ে নিলাম আজ থেকে।”
বিপরীতে ফাহাদ বললো, ” আমার’তো তোমাকে ভীষণ দরকার, আমার “কৃষ্ণকলি”।”
চাঁদ নিশ্চুপ! ফাহাদ কোমল কণ্ঠে পুনরায় বললো,
“শোনো চাঁদ পাখি? ভালোবাসার ক্ষেএে, এতো কঠিন হতে নেই। সম্পর্কে একটু ছাড় দিতে হয়। তুমি না আমায় ভালোবাসো চাঁদ? সেই ভালোবাসা কি এতো জলদি ফুরিয়ে গেছে? কেনো এতো কঠিন… ”
কথা শেষ হওয়ার আগেই তেতে উঠলো চাঁদ। ফাহাদে’র মুখের উপর আঙুল উঁচু করে বলে উঠলো,
“আমার ভালোবাসা নিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলছেন? আরে, আমার মতো এত ধৈর্য নিয়ে আপনা’কে আর কে ভালোবাসে বলেন তো!বেঁচে থাকতে আপনি হয়তো আরও অনেকের ভালোবাসা পাবেন,কিন্তু আমার মতো কাউকে পাবে না।”
আচমকা দুজনার মধ্যের দুরত্বটুকু চুকিয়ে ফাহাদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো কৃষ্ণকলি মেয়েটাকে। ঘাঁড়ে নাক ডুবিয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আমি আর অন্য কাউকে চাই না কৃষ্ণকলি। আমার শেষ দিন অবধি তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন। কৃষ্ণ কলি শোনো?
আমি তোমার চোখের কাজল না হতে পারি
অশ্রু হবো না, আজ কথা দিলাম।আমি তোমার গানের সুর না হতে পারি তাল ভা’ঙ্গ’বো না, আজ কথা দিলাম।
আমি তোমার খোঁপার ফুল না হতে পারি
কাটা হবো না, কথা দিলাম।আমি তোমার ঠোঁটের লিপিস্টিক না হতে পারি
ফাটা ঠোঁট হবো না, কথা দিলাম।আমি তোমার শাড়ির আচল না হতেপারি কুচি ভা’ঙবো না, কথা দিলাম। আমি তোমার যত্ন না নিতে পারি
কোনো দিন অ’যত্ন করবো না, কথা দিলাম।
আজ তোমায় কথা দিলাম, সারা জীবন তোমায়
মনের সিংহাসনে, রাণী করে-ই রাখবো।”
চাঁদ নিজেকে ছাড়াতে চাইলো, কিন্তু ফাহাদ আলিঙ্গন আরো শক্ত করলো। প্রিয় মানুষটাকে জড়িয়ে ধরার ব্যাপারটা চোষ কাগজের মতো কাজ করে। ব্যক্তিগত একজনকে একবার জড়িয়ে ধরলে প্রায় সমস্ত যন্ত্রণা চুষে যায়। নিজেকে ব্যথাশূন্য লাগে, ভিতরটা তুলোর মতো হালকা হয়ে যায়।
এই-যে ফাহাদের ভিতরটা জুড়ে এতক্ষণ ঝড় বয়ে গিয়েছে, এই একটি মাএ আলিঙ্গন তার অশান্ত বুকটা’কে শীতল করে দিয়েছে।
ফাহাদ চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে তার চাঁদ পাখিকে। তান্মধ্যে অশান্ত চাঁদ নড়ার চেষ্টা করছে, ফাহাদ চোখ খুলে তাকালো চাঁদনীর মুখের দিকে। এই মুখটায় যেন অজস্র মায়া!
চাঁদ কিছু বলবে বলে মুখ খুললো, এরিমধ্যে ফাহাদ তার মুখটা বন্ধ করে ঠোঁটে গাঢ়ো চুমু খেলো। চাঁদ মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেলো।অতঃপর ফাহাদ চাঁদে কানের কাছে মুখ নিয়ে নেশালো কণ্ঠে ফিসফিস করে বলো,
“চাঁদ বউ!বুকের খাঁচায় যত্ন করে রাখবো তোকে। সব ভুলে আমার হয়ে যা।
আজ এই উষ্ণ দুপুরে, মনের মধ্য খানিতে রাখিবো তোকে। তুই কি এই উষ্ণ দুপুরে’র সঙ্গী হবি?”
চাঁদ কেঁপে উঠলো। লজ্জায় মুখ থেকে টুঁ-শব্দটিও বের হচ্ছে না। ফাহাদে’র আদুরে স্পর্শে তার শরীর ছেড়ে দিলো। ফাহাদ মুচকি হেসে আবার জড়িয়ে নিলো মেয়েটাকে। অতঃপর আদরে’র আদরে ভরিয়ে দিলো কৃষ্ণ রাঙা মেয়েটাকে।
.
.
মান অভিমানের মধ্য দিয়ে গত হলো দু’টো দিন। ফাহাদে’র পা’গ’লা’মোতে অবশেষে চাঁদ থাকতে বাধ্য হয়েছে। এই দু’দিন লোকজন সবাইকে উপেক্ষা করে, নিজের সবকিছু ছেড়ে ফাহাদ এক মুহূর্তের জন্যেও চাঁদের পিছু ছাড়েনি। তবুও বউয়ের রাগ কমছেই না।
ফাহাদ ও থেমে নেই, ভুল যখন করেছে তার মাসুল তো দিতেই হবে। তাই আজ ও বাবা-র দোকানে গেলো না, বাবা ও মুখ ফুটে বলেনি।
সময়টা দুপুর। বর্ষার আকাশে মুশলধারা বৃষ্টি হচ্ছে হচ্ছে। চাঁদ জানালার গ্রিল ধরে বৃষ্টি দেখছে। হঠাৎ করে কাঁধে পুরুষালী হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে বুঝতে বাকি রইলো না কে। চাঁদ না তাকিয়েই অন্যদিকে ফিরে আনমনে হাসলো। পুরুষটি প্রিয়তমার রেসপন্স না পেয়ে মায়াভরা কণ্ঠে ডাকলো,
“চাঁদ বউ..?”
“হুম। ” ছোট্ট করে বললো চাঁদ।
“ভিজবে? চলো বৃষ্টি বিলাস করি দু’জনে।”
“নাহ্ ভালো লাগছে না।”
ফাহাদ আর কিচ্ছুটি বললো না। মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে, এরিমধ্যে অবাধ্য পুরুষটি চাঁদের চুলে মুখ ডুবিয়ে, বাগান থেকে আনা গোলাপটি বুক পকেট থেকে বের করে কৃষ্ণকলি মেয়েটার কানের কাছে গুঁজে দিয়ে নেশালো কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এই বৃষ্টি মুখর দিনে, চলো আমরা চুকিয়ে নেই নিজেদের সকল মান-অভিমান। মিটিয়ে নেই দূরত্বটা নিজেদের ভালোবাসাটুকু দিয়ে। ঝুমবৃষ্টিতে মে’তে উঠি প্রথম দিনের প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো। বইতে থাকা অ’বা’ধ্য বাতাসের মতো হয়ে যাই নিজেরাও অ’বা’ধ্য।
কি লাভ বলো, ভেতরে ভেতরে এতো মানঅভিমান পুষে রেখে? কি উপকার হবে বলো নিজেদের মাঝে দূরত্বের দেয়াল তৈরি করে দু’জন দু’জনাকে দূরে রেখে?
একা তো জীবন চলে না। কাউকে তো সেই আবার জড়াতে হবে জীবনে। তার চেয়ে বরং নিজেরা একটু নত হলাম।বাচিঁয়ে নিলাম সম্পর্কটাকে। তুমুল ঝ’গড়া, ভীষণ কথা কা’টা’কা’টি সব তোমার সাথে হোক। দিনশেষে হাজারো ল’ড়া’ইয়ের পরেও তুমি শুধু একান্ত আমার হয়ে থেকো। আমার ঠিকানা বলতে লোকে একনামে তোমায় জানুক, সবশেষে তোমার উপরও শুধু আমার অধিকার চলুক।”
চাঁদ চমকালো! মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পুরুষটির দিকে। লোকটা যেন জাদু জানে। কথায় অজস্র মায়া। মায়াবী কণ্ঠ স্বর নিমেষেই তার কিশোরী মনে দা’গ কেটে যায়। এই লোকের সঙ্গে কি রাগ করে থাকা যায়? কিচ্ছুতেই না! লোকটার মুখোমুখি হলেই অবাধ্য মন নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আচ্ছা পুরুষটির মাঝে এতো মায়া কেনো? ভালোবাসে বলেই কি তার সবকিছু এতো ভাল্লাগে! হয়তো।
পরক্ষণেই চাঁদ দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। এতো দ্রুত হার মানবে না সে। দেখা যাক লোকটা কতটুকু সহ্য করতে পারে তাকে। তার তো সমস্ত রাগ, অভিমান চলে গিয়েছে। তবুও মুখটা গম্ভীর করে বললো,
“অহংকার বিন্দুমাত্র নাই, তবে আত্মমর্যাদা আছে, তাই কাউকে তে’লি’য়ে চলবো না আর। জোর করে কাউকে ধরে রাখার প্রয়োজন নেই, যে থাকার সে থাকবে আর যে চলে যাওয়ার সে চলে যাবেই।”
ফাহাদ চাঁদকে ছেড়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো এবার। চাঁদের গাল ছুঁয়ে মৃদু স্বরে বললো,
“এমন তেঁতো কথা কেনো বলছো বউ? এখনো রেগে থাকবে চাঁদ?”
” রাগ নেই কোনো?” আলতে কণ্ঠে বললো চাঁদ।
ফাহাদ কিঞ্চিৎ হাসলো। চাঁদের কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দেয়ে বলে উঠলো,
“রা’গ বাড়তে দিও না, অ’ভিমান জমিয়ে রেখো না,
য’ন্ত্র’ণা পু’ষে রেখো না, আ’ক্ষে’প বয়ে বেড়াইও না।
কা’ন্না পেলে কেঁ’দে নিও তবে আমার সামনে বসে নয়,দরজা ব’ন্ধ করে অ’ঝরে।
হাসি পেলে হেসে নিও, মন প্রাণ ভরে।
আমার সাথে কখনো কথা বলা বন্ধ করে দিও না, মান-অভিমান চুকিয়ে নিও দ্রুত, মনে রেখো না অতীত। ক্ষনিকের এই জীবনে মৃ’ত্যু ছাড়া সব কিছুই অ’নির্ধারিত।
compromise করে অভিমানটা, কথা বলে নিও
না-ই বা থাকলো অপর মানুষটার ভ্রু’ক্ষেপ,না হলে হঠাৎ করে চলে সে গেলে
মনে থেকে যাবে এক আকাশ আ’ক্ষেপ।
ভালোবাসলে ছাড় দিতে হয়,সম্পর্কের নাম যাইহোক,
দিন শেষে প্রিয় মানুষ, প্রিয় হয়েই থাকুক।”
“ভালোবাসলে ছাড় দিতে হয় চাঁদ।”
হঠাৎ করে চাঁদ জড়িয়ে ধরলো ফাহাদ’কে। ফাহাদ আলতো হেসে আগলে নিলো সাথে সাথে। চাঁদ কাঁদছে, প্রিয় পুরুষটির বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদছে। এই মানুষটার আদুরে কথা, তার স্পর্শে নিজের মি’ছে রাগ অভিমান’টা আর ধরে রাখতো পারলো। তার রাগতো সেই দু’দিন আগেই ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিলো।
আসলে, আমরা যতই ম্যাচিউর হই,বাস্তববাদী হই,শক্ত হই,ইন্টারেস্ট পার্সন হই,ভালো হই…!
কারো না কারো গল্পে ঠিক, ইম’ম্যাচিউর,আবেগী,দুর্বল, বিরক্তিকর,খারাপ!এন্ড ইটস ওকে!
ফাহাদ আলতো করে চাঁদের মাথায় চুমু খেলো। অতঃপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, কোমল কণ্ঠে বললো,
“কেঁদো না চাঁদ।”
চাঁদের কান্নার বেগ বাড়লো, ফাহাদ’কে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্নারত কণ্ঠে বলে,
“তোমার উপর আর কোন অভিমান নেই আমার। এই যে তুমি আমার সাথে তুমি মিষ্টিমুখে কথা কও,
বুকের ভেতর খুব যতনে পুইষা রাখবা বলো,আমার এইসবে মন টানে, ভাল্লাগে।আসলে তোমার সবকিছুই আমার ভাল্লাগে।
ওই যে কথায় আছে না,যারে মনে ধরে তার খা’রাপটাও ভাল্লাগে।আমার বেলায়ও তেমন।
তোমার’র ব’দঅভ্যাস আমার চোক্ষেই পারে না,
তোমার সব কিছুই কেমন যেনো নে’শা নে’শা লাগে।
এইটা কিসের নে’শা কইতে পারো?
তবে জানো -আমি এই নে’শায়ই সারাটা জীবন ডুইবা থাকতে পারবো। তুমি খালি শক্ত কইরা একটু আগলাই রাইখো।
এই জীবনে আমি আর কিছু চাইও না।
এরচেয়ে তোমার কাছে আমার আর বেশি কিছু কি’বা চাওয়ার নেই। ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি প্রিয় পুরুষ!”
ফাহাদ চাঁদের মুখটা এক হাত দিয়ে উঁচু করে, অন্য হাত দিয়ে চোখের জলটুকু মুছে দিলো।
কপালে আলতো করে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললো, “ভালোবাসি কৃষ্ণকলি!”
এই প্রথম মুখে “ভালোবাসি” শব্দটা শুনে আবেগে আপ্লুত চাঁদ। টুপ করে পা উঁচু করে চুমু এঁকে দিলো প্রিয় পুরুষটির কপালে।
তান্মধ্যে ফাহাদ তাকে পাঁজা কোলে করে নিলো। চাঁদ দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরলো ফাহাদে’র। ফাহাদ হাসলো, চাঁদকে কোলে করে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। সুখ নীড়ে সবাই বৃষ্টি পেয়ে যে যার রুমে। ফাহাদ সেই সুযোগে পিছনের দরজা দিয়ে, প্রিয়তমার সাথে বৃষ্টি বিলাসের জন্য বাগানে দিকে হাঁটা দিলো।
হঠাৎ করে দাঁড়ালো ফাহাদ, টিপ-টিপ বৃষ্টি এসে মুহূর্তেই দুজনকে ভিজিয়ে দিলো। বৃষ্টির ছোঁয়া চাঁদকে ভীষণ মায়াবী লাগছে। ফাহাদ ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ” বউ!”
চাঁদ লাজুক হাসলো। ফাহাদ পুনরায় আবারো বললো,
জানো চাঁদ পাখি!
তুমি আমার জীবনে এসেছো বলে হারানো কবিতা ফিরে পেয়েছি।
তুমি এসেছো বলেই গোমরামুখে ফুটে ওঠেছে হাসি। তুমি কাছে থাকলে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ নীলে ফিরে যায়, কবিতারা হয়ে যায় আবেগে উল্লাসী।
তুমি ফিরে তাকালেই এ বুকে হাত চেপে যায়, তোমাকে রেখেছি এ বুকের বাঁ পাশে।
বিষন্ন এই আমার জীবনে, “#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি!
~সমাপ্তি