#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writerঃsumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ১৫
কি অ’দ্ভু’ত? যার জন্য চোখের জল ঘোলাটে হয় সেই লোকটা এসেই তাকে শান্তনা দিচ্ছে। অথচ লোকটা চাইলেও তার হাসির কারণ হতে পারে। হাজারটা ভুলের বারণ হতে পারে। তার অনুভূতি বুঝেও কেনো এতো লুকোচুরি তার মাঝে? মনে মনে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো চাঁদনী।
তার কান্না থেমে গিয়েছে , এখনো অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা পুরুষটির মুখের পানে। এই চোখে মুখে অ’দ্ভু’ত ভ’য়ং’ক’র মায়া যেন ক্ষণে ক্ষণে জ্ব’ল জ্ব’ল করছে! যা বারংবার গায়েল করছে সপ্তদশী মেয়েটাকে। যখনই নিজের মনকে শক্ত করতে ম’রি’য়া হয়ে উঠে চাঁদনী, মনে মনে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয় ভালোবাসার দাবি নিয়ে যাবে না লোকটার ধারেকাছেও। ঠিক তক্ষণই এই মায়াবী মুখটা দেখে তার মনের সমস্ত কঠোরতার দূর হয়ে যায়। উল্টো স্বপ্ন বুনে কিশোরী মেয়েটার বক্ষে, আজীবন এই চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে ইচ্ছে করে। মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত! একবার কাউকে মনে ধরলে সহজে কি তাকে বের করা যায়? মনের আধিপত্য কি এতোটাই সহজ?
আর কত ব্যা’স্ততা আর কত ভু’লে থাকার চেষ্টা করা,
মস্তি’ষ্কে যার বসবাস; হৃদয়ের গলিতে যে মানুষটার চলাফেরা,এতটাই কি সহজ তাকে এ’ড়িয়ে চলা? উঁহু সম্ভবই নয়। চাঁদনী হঠাৎ হাসলো কিঞ্চিৎ। সে-ও বুঝে গিয়েছে এই লোকটাকে ছাড়া তার চলছে না। সপ্তদশী হৃদয়ের প্রথম পুরুষ বলে কথা। মনের অনেকটা জায়গায় জুড়ে আছে। উঁহু শুধু জুড়ে নয় বরং আটঘাট বেঁধে ত’ল্লি-ত’ল্লা চেপে বসে আছে প্রিয় এই পুরুষ। সে খানে এই মানুষটাকে ভুলে থাকাটা তো তার কাছে অসম্ভব ব্যাপার! সে ও হাল ছাড়বে না, লেগেই থাকবে। কোথাও শুনেছে সে, ভালোবাসা দিয়ে পা’ষা’ণ্ড পুরুষেরও মন বদলানো যায়। দরকার পড়লে এ শহরে ভালোবাসার দাবী নিয়ে মিছিল করবে সে। বিনিময়ে এই পুরুষটাকে জীবনের শেষ অবধি পর্যন্ত চাঁদনী চাইবেই।
মনের সাথে এতক্ষণ হাজারটা কল্পনা য’ল্পনা করতে করতে ঠোঁটের হাসিটা আরো একটু গাড়ো হলো চাঁদনী’র। ফাহাদ কিছুক্ষণ সামনে থাকা মেয়ে’টাকে পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যুগল কুঁচকে বুঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটার মনে কি চলছে? মেয়েটা না মাএই কাঁদল, এখন আবার হাসছে। অ’দ্ভুত মেয়ে মানুষ!
নাহ তার মস্তিষ্ক ফাঁকা, উওর মেললো না কবুু। পরক্ষণেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
“নারী তুমি র’হ’স্য’ম’য়ী!”
বলেই উঠে দাঁড়ালো ফাহাদ, আর এসব নিয়ে ঘাঁটলো না। বড়বড় পা ফেলে চাপানো দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে উদ্বিগ্ন হলো তখনই পিছন থেকে চাঁদনী মৃদু কণ্ঠে বললো,
“শুনুন?”
“হুম।” পিছনে তাকিয়ে বললো ফাহাদ।
“আচ্ছা আমি কাঁদলে আপনার কোনো রকম কষ্ট হয়, কিংবা খারাপ লাগে সত্যি বলুন তো?”
“আমার কোন দুঃখে কষ্ট হতে যাবে। তবে আমি চাইনা আমার ঘরে বসে কেউ কাঁদুক।”
ফাহাদে’র সোজাসাপটা উত্তর শুনে মোটেও কষ্ট হলো না আজ চাঁদনী’র। সে বরং খানিকটা হেসে ফাহাদে’র চোখে চোখ রেখে বললো,
“আপনার দু’চোখ বলছে আপনি মিথ্যা বলছেন ফাহাদ। আপনি কি জানেন? আমাদের মন বিনিময় হয়ে গিয়েছে। হাহা! এখন চাইলেও আপনি আমার থেকে দূরে থাকতে পারবেন না। আপনি দেইখা নিয়েন, আপনার হৃদয়ে আমার বিচরণ হতে চলছে খুব শীগ্রই।”
ফাহাদ চমকালো, সত্যিই কি তাদের মন বিনিময় হয়ে গিয়েছে? না সে তো নতুন করে, নতুন গল্প রচিত করতে চায় না। হাঁটুর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ে তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছে। মুহুর্তের মাঝে চাঁদনী বিছানা ছেড়ে ফাহাদে’র কাছে চলে এসেছে। ফাহাদে’র ডান গাল ছুঁয়ে মোহনীয় কণ্ঠে শুধালো,
“আমার ফোকলা দাঁতের হাসির স্তম্ভ দিলাম তোমায়!
তুমি শুধু তোমার হৃদয় থেকে খাঁটি একবিন্দু ভালোবাসা দিও আমায়।”
কণ্ঠ কি যেন ছিলো মেয়েটার, হঠাৎ তুমি ডাকটা মন্দ লাগছে না। ফাহাদ কি করবে? এ কোন গোলকধাঁধায় আঁটকে পড়লো সে? না পারছে গিলতে আর না পারছে ফেলে দিতে! এ কেমন অদ্ভুত অ’শা’ন্তি। হঠাৎ হঠাৎ মানুষকে চমকানোর দারুণ অভিজ্ঞতা আছে এই মেয়ের। তার মতো এক কঠিন মানুষকে ক্ষণে ক্ষণে বিভ্রান্তির মধ্যে আঁটকে দিচ্ছে। ফাহাদ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো চাঁদনী’র দিকে। না আর এভাবে থাকা যাবে না। এই মেয়ের জাদু জানে নিশ্চয়ই! তার এতোদিনে শক্ত খোলস নিমিষেই এই মেয়ের মায়াবী কাজল কালো চোখের কাছে হার মানে। ফাহাদ দৃষ্টি সরিয়ে দ্রুত চলে যেতে নিলো, অমনি চাঁদনী হাত ধরে বললো,
“উওরটা দিয়ে যান দয়াকরে!”
” হাত ছাড়ো! দেখো মেয়ে, বারবার আমার কাছে এসো না। নারীদের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। দিন শেষে সব কিছুতে মরিচীকা ধরেছে। দূরে থেকো আমার থেকে, যত কাছে আসবে ততো নিজেই পু’ড়’বে!হাজার প্রদীপ জ্বেলেও এই হৃদয়ে অ’ন্ধকার।এই জীবন যেন অ’ন্ধের স্বপণ! এ হৃদয়ে রঙিন প্রদীপ জ্বলে না আর। এই ভালোবাসার দায়ভার বয়ে বেড়াতে বেড়াতে মাঝে মাঝে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ি, ভে’ঙ্গে পড়ি। কাউকে ভালোবাসা এখন আ’জা’বে’র মত মনে হয়!”
গম্ভীর কণ্ঠে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো ফাহাদ। কথা শেষ করেই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো বাবার দোকানের উদ্দেশ্যে। ফাহাদে’র এমন আচরণে মানুষটার প্রতি অভিমান জমলো চাঁদনী’র বক্ষ জুড়ে। চাঁদনী জানে এক পাক্ষিক অভিমান, অভিযোগের দাম নেই কারো কাছে। তবুও কিসের যেন একটা অধিকারের জোরে ভীষণ অভিমান করতে ইচ্ছে করছে তার। পরক্ষণে একদিন সব ঠিক হবে এটা ভেবে নিজেই নিজের মনকে শান্তনা দেয়। আদৌও কি একদিন ঠিক হবে সব? নিশ্চয়তা খুঁজে পায় না মেয়েটা। তবুও সে বিশ্বাস রাখে নিজের প্রতি। হ্যাঁ একদিন এই মানুষটা তার চোখে হারাবে। তাকেও ভালোবাসবে, ভালোবাসতে বাধ্য হবে।
পরমুহূর্তেই ফাহাদে’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“আপনি আমার “আকাশ”যাকে মন চাইলে দেখা যায়,কিন্তু ছোঁয়া যায় না!”
___________________________
পৃথিবীর ধরাবাঁধা নিয়ম অনুযায়ী, দিন শেষে রাত হয়। রাতের আঁধার কেটে আবারও পুনরায় নতুন দিনের সূচনা ঘরে। এভাবে এক সপ্তাহ চলে গেলো সবার জীবন থেকে। রাত আটটা বাজে দুই মিনিট। সুখ নীড়ের মানুষগুলো যে যার মতো ব্যস্ত এখন। চাঁদনী রাতের জন্য রান্না করছে, বাকিরা যে যার রুমে। আফজাল হোসেন দোকানে তার সঙ্গে আছে দুই ছেলে। বাবার সাথে অভিমান, অভিযোগ পুষেও এ ক’দিন নিয়মিত বাবার কাজে সাহায্য করেছে ফাহাদ। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। অথচ পিতা-পুএ কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। এদের দুজনার মুখের কথা আদান প্রদান করার মাধ্যম হচ্ছে মাহিম। আফজাল হোসেন মাএ কাপড়ের গোডাউন থেকে কাজ করে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে এসেছে। ফাহাদ আড় চোখে বাবা’র মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বাবা’র পরিশ্রমি, ক্লান্ত মুখটা দেখে তার মায়া হলো। বাবা’র এখন একটা বিশ্রাম খুব দরকার। পরক্ষণেই মাহিমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“মাহিম তোর বাবা’কে বল এখন বাসায় যেতে। এখানে আর থাকতে হবে না তাকে, বাকিটা আমি সামলে নিবো, বলে দে।”
মাহিমও ভাইয়ের কথা মতো তার চুলগুলোতে হাত চালিয়ে বাবা’র উদ্দেশ্য করে বললো,
“মাহিমের বাবা আপনি কি শুনছেন আমাগো দোকানের ফাহাদ কর্মচারী কি বললো? আপনাকে বাসায় যেতে বলা হয়েছে। জলদি যান আপনি।”
আফজাল হোসেন ছেলেদের কান্ড দেখে হেসে বিনাবাক্যে চলে গেলো। তার শরীরটা ক্লান্ত লাগছিলো। ফাহাদ ভাইয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। এরিমধ্যে দোকানে কাস্টমার আসলো, দুই ভাই ব্যাস্ত হয়ে গেলো।
.
.
চাঁদনী রান্না শেষ করে কিছুক্ষণ হলো রুমে এসেছে। সুয়ে সুয়ে ফেসবুক ঘাঁটছে। কয়েকদিন আগেই ফারিহা খুলে দিয়েছে আইডি। তাও মন বসছে না, কেন জানি ভালো লাগছে না তার। হুটহাট বাবা- বোনদের ভীষণ মনে পড়ে, দেখতে ইচ্ছে করে মানুষগুলোকে। অথচ মানুষ গুলো দিব্যি তাকে ছাড়া থাকছে। ভাবতেই মুখটা মলিন হয়ে গেলো। এরিমধ্যে রুমে ফারিহা আসলো তার হাতে নীল, সাদা রঙের দুটো শাড়ী। চাঁদনী নিজেকে সামলে উঠে বসলো। মিষ্টি এক হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“আপা বসেন।”
প্রতি’টি মি’ষ্টি হাসি’র পিছ’নে,একটি তি’ক্ত দুঃ-খ আছে যা কেউ কখনও দে’খতে এবং অনু’ভব করতে পারে না। চাঁদনী’কে দেখেও মনে হচ্ছে তার কোনো কষ্ট নেই। অথচ আড়ালে পাহাড় সমান কষ্ট বয়ে বেড়ায়। ফারিহা বসলো। ভাবী’র দিকে অভিযোগ নিয়ে, মুখ ফুলিয়ে বললো,
“আবারো আপনি আপনি করে ডাকছো কেনো ভাবী? কতবার বলছি আমাদের আপনি করে বলবে না তুমি। এই আপনি আপনি ডাক কেমন পরপর লাগে। আমি তোমাকে নিজের বোন মনে করি আর তুমি আপনি বলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো।”
ফারিহার বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলানো দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে চাঁদনী’র। মেয়েটা বড় হলেও স্বভাবটা এখনো বাচ্চা বাচ্চা। চাঁদনী নিজের হাসি কোনো মতে নিয়ন্ত্রণ করে , কানে হাত দিয়ে বললো,
“স্যরি আপা! আর হবে না। প্লিজ রাগ করো না। এই শাড়ী দিয়ে কি করবে এতো রাতে?”
ফারিহা মুহূর্তেই হাসিহাসি মুখে বলে উঠলো,
“শাড়ী পড়বো। তুমিও পড়বে চলো আমার সাথে আমার রুমে।”
“না। না।এতো রাতে আমার ভালো লাগছে না। তুমি পড় আপা। ”
কে শোনে কার কথা। ফারিহা জোর করে চাঁদনী’কে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। চাঁদনী আর না করতে পারলো না। দু’জন মিলে সুন্দর করে শাড়ী, দু’হাতে কাচের চুড়ী পড়ে হালকা সেজেগুজে ছবি তুলে নিলো। চাঁদনী সাদা শাড়ী পড়েছে। শাড়ীতে সত্যি মেয়েটাকে অপূর্ব সুন্দর লাগে। ফারিহা বুদ্ধি করেই পড়িয়েছে এই রাতের বেলা চাঁদনী’কে শাড়ী। কারণ তার ভাই সাদা রঙের শাড়ী পছন্দ করে ভীষণ। সে শুনেছে পুরুষ মানুষ নাকি শাড়ীতে দুর্বল! এই উছিলায় ভাই-ভাবীর সম্পর্কটা যদি একটু উন্নতি হয়। সেও চায় তার ভাই সব ভুলে যাক। একটু হাসুক, নতুন করে বাঁচুক। এই আশাতেই এই রাতের বেলা শাড়ী পড়া। চাঁদনী’র এতক্ষণের বিষন্নতা কেটে গিয়েছে। হাসি মুখে নিজের রুমে এসেছে। রুমে আসার আগে বারবার বলেছে ফারিহা, চাঁদনী যেন ঘুণাক্ষরেও শাড়ী না খুলে। চাঁদনীও কিছু একটা ভেবে আর পাল্টালো না, সেও অপেক্ষা করতে লাগলো ফাহাদে’র জন্য।
.
রাত দশটায় ফাহাদ নিঃশব্দে রুমে আসলো। চাঁদনী পড়ার টেবিলে বসে কলম মুখে দিয়ে গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবছে। মাঝে মাঝে হাতের কাঁচের চুড়ি গুলো ঝংকার তুলে শব্দ করছে। লম্বা ঘন-কালো কেশ গুলো খোলা যা ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। এ যেন এক চমৎকার দৃশ্য! হঠাৎ নতুন রুপে, শুভ্র রঙের শাড়ীতে মেয়েটাকে দেখে এক মিনিটের জন্য তার চোখ আঁটকে গেলো। পরমুহূর্তেই নিজের কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের গেলো ফ্রেশ হতে। যাবার আগে আড় চোখে আরো একবার তাকালো মেয়েটার দিকে। এতক্ষণে ফাহাদ কে খেয়াল করেনি চাঁদনী। হঠাৎ ওয়াশরুমে’র দরজার শব্দ পেয়ে হকচকিয়ে উঠলো মেয়েটা, ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। তার মানে ফাহাদ এসেছে। মুহুর্তেই স্নিগ্ধ হাসির রেখে দেখা গেলো মেয়েটার মুখে।
.
.
মিনিট দশেক সময় ফাহাদে’র পিছুপিছু গুড়গুড় করছে চাঁদনী। ছেলেটা যেন তাকে দেখছেই না। ফ্রেশ হয়ে এসে সেই থেকে নিজের মতো করে এটা সেটা কাজ করছে। এখন আবার ঘটা করে আয়নায় নিজেকে দেখছে আর চুল আঁচাচ্ছে। কই এসে শাড়ী পরিহিত বউয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। তা না রসকষহীন মানুষটা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে আছে। চাঁদনী বিড়বিড় করছে ফাহাদে’র পিছনে দাঁড়িয়ে। যা ফাহাদ আয়নার মধ্যে দিয়ে আড় চোখে দেখছে। চাঁদনী’র বাচ্চামো মুখটা দেখে তার পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে। এর মধ্যে চাঁদনী অধৈর্য হয়ে ফাহাদে’র হাত থেকে চিরুনী কেঁড়ে নিলো। ফাহাদ কিছু বললো না, চুপচাপ রুম থেকে বারান্দায় চলে গেলো। পকেটে থেকে একটা সিগারেট বের করে লম্বা লম্বা টান দিলো। চাঁদনীও পিছু নিলো, ফাহাদে’র পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে গেয়ে উঠলো,
“কিছু রাগ কিছু ভুল, কিছু অভিমানে জমে থাকা সে প্রিয় মুখ।
এইতো দূরে আছি এইতো কাছাকাছি, প্রিয় মুখটা দেখলে ভরে উঠে বুক।
এভাবেই কাটে দিন ভালোবাসা সীমাহীন, যায় কি দূরে থাকা একা রেখে প্রিয়জন।
তুলে রাগ অভিমান ফিরে দেখি পিছুটান, এভাবেই থেকে যাই তাই তোমার হয়ে আজীবন।”
বলেই চাঁদনী ছোঁ মেরে ফাহাদে’র হাতের জ্ব’ল’ন্ত সিগারেট ফেলে দিলো। ফাহাদ এখনো উল্টো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, সিগারেট নেওয়া ফলে বিরক্ত হলো ভীষণ। তীক্ষ্ণ মেজাজ নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কি হচ্ছে এসব? আমায় এভাবে জ্বালাচ্ছো কেনো?”
“আমার দিকে ঘুরে তাকান ফাহাদ।”
“কেনো? তোমার মাঝে কি এমন আছে?”
“আপনার পছন্দের শাড়ী পড়েছি।”
“তো?”
“ভালো লাগছে না আমায়?”
“দেখো মেয়ে ফাহাদরা কারো রুপে আঁটকায় না! তুমি যাও এখান থেকে বিরক্ত করো না।”
“আপনি এতো কঠিন মানুষ কেনো ফাহাদ? আপনার হৃদয়ে কি একটুও দয়ামায়া নেই..।”
“শুনো মেয়ে? আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু গল্প রয়েছে, প্রত্যকেই এমন কিছু পরিস্থিতির সস্মূখীন হয়েছে যা তাকে কঠোর মানুষ হিসেবে পরিণত করেছে।
তাই কাউকে শুধুমাত্র তোমার পরিচিত গল্প দাঁড়া যাচাই করতে যাবে না। কারণ তার পুরো জীবন সম্পর্ক তুমি অবগত নয়…! ”
“এতো কঠিন কথা বুঝিনি।”
“বুঝতে হবে না। ভিতরে যাও তুমি। আমায় একটু একা থাকতে দেও প্লিজ! ”
“সারাক্ষণ তো একাই থাকছেন। আমি একটু কাছে আসলে কি এমন হয় বলুন তো?”
ফাহাদ ঘুরে তাকালো চাঁদনী’র দিকে, মিনিট খানিক চুপ থেকে মৃদু কণ্ঠে বললো,
“একাকীত্ব’কে কোনোদিন ভালোবাসিনি আমি। বরং একাকীত্বতে আমার ভয় হতো ভীষণ! কিন্তু আমার কাছের মানুষগুলোই আমায় একাকীত্বকে আপন করতে শিখিয়েছে।”
” একবার ভালোবেসে দেখো,কতটা নির্লজ্ব হই
কতটা ফুলে ফুলে সাঁজাই উদ্যান! একবার ভালোবেসে দেখো,একবার কাছে এসো দেখো..
কতটা আকাশ লিখি তোমার নামে, কতটা পাহাড় ডিঙাই, কত সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেই,কতটা অপেক্ষায় থাকি আজীবন! একবার ভালোবেসে দেখো।
একবার কাছে এসে দেখো। ফাহাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো চাঁদনী। কিছু জড়তায় মুখে বলতে পারলো না। ফাহাদ বোধহয় বুঝলো মেয়েটার মনের কথা গুলো। অদ্ভুত ভাবে হাসলো খানিক ফাহাদ। অতঃপর চাঁদনী’র দিকে দু-পা এগিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আমাকে ভালোবাসতে এসো না,
আমার কিচ্ছু নেই তোমাকে দেবার মত। নেই আস্ত একটা হৃদয়, নেই বুকের ভিতর আগলে রাখার মায়া।
নেই এক বুক ভালোবাসা তোমাকে দেবার মত।
তারচেয়ে বরং তুমি দূরে থাকো।আমি সুন্দর মোমের আলোর মত!আমাকে দূর থেকে দেখাই শ্রেয়।
কাছে এসে যদি ছুঁয়ে দিতে চাও
তবে তুমি দ’গ্ধ হয়ে যাবে।যে হৃদয়ে তুমি আসবে ভেবেছোসে হৃদয় ভেঙে গেছে
বুকের ভিতর মানুষের যেখানে মায়া থাকে
সেখানে আমার আজ অন্য কারো শূন্যতা ।
কেউ একজন ছিলো,যে আমার সবকিছু নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে,তোমাকে দেবার মত অবশিষ্ট আমার আর কিছু নেই।
আমাকে ভালোবাসতে এসো না।চোখে জল ছুঁয়ে যাবে,বিরহে মন ভারী হবে।অবশেষে তোমার ভালো থাকাই আর হবে না।”
কণ্ঠে কি যেন ছিলো ফাহাদে’র। চাঁদনী’র কোমল মনটা বিষিয়ে উঠলো। না তাকে ভালোবাসে না এজন্য নয়। ছেলেটার কষ্ট অনুভব করছে যেন কাছ থেকে। সে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“আচ্ছা থাক এসব। ভিতরে চলুন।”
হুট করেই ছেলেটা রেগে গেলো। এই মেয়ে’কে আশকারা দিলে দেখা যাচ্ছে মাথায় উঠে। ফাহাদ মুহূর্তেই দাঁত কটমট করে বললো,
“তোমার কথায় এখন আমায় চলতে হবে?এতটুকু হাঁটুর বয়সী বাচ্চা মেয়ে হয়ে কথায় কথায় আমায় ট্রিক দিচ্ছো তুমি। এগুলো আমার পছন্দ নয়। বাচ্চা মেয়ে বাচ্চার মতো থাকো।”
আশ্চর্য সে কি এমন বলছে যে তাকে ধমক দিতে হবে এভাবে। চাঁদনী’র মেজাজ বিগড়ে গেল, যে ভাবে বাচ্চা বাচ্চা বলছে লোকটা মনে হচ্ছে সে দুই মাসের দুধের শিশু। বউতো বউই হয় তা আবার হাঁটুর বয়সী আছি নাকি। চাঁদনী তেজ নিয়ে কিছু বলতে যাবে অমনি ফাহাদ পুনরায় ধমকে উঠলো। চাঁদনী খানিকটা কেঁপে উঠলো তার চোখের কোণে জল জমলো কিঞ্চিৎ। শুধু শুধু এভাবে কেনো ধমকে উঠে লোকটা। অন্যের উপরে করা ক্রো’ধ তার ঝাড়ছে। কি পেয়েছে টা কি তাকে। চাঁদনী’র খুব করে কয়টা শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। তবুও নিজেকে সামলে নিলো, বাড়াবাড়ি করলে বাসার লোকদের শুনার ভয়ে কিচ্ছুটি আর বললো না। ধমক খেয়ে চুপচাপ নিজের রুমে গেলো।
#চলবে…
#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writerঃsumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ১৬
ঘোর আঁধার মাখা প্রকৃতিকে এক ফালি জোছনা উপহার দিলো চাঁদ ! চাঁদের আলো পেয়ে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে আরো স্নিগ্ধময়, সাথে মিষ্টি বাতাস। চাঁদের ঝলমলে আলো ও প্রকৃতি নিজেস্ব তীব্র ঘ্রাণে চারপাশ মুখরিত!
রুমের জানালাটার কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে চন্দ্র বিলাস করছে চাঁদনী। চাঁদের স্নিগ্ধ জোছনা তার সারা অঙ্গে আঁচড়ে পড়ছে, যার ফলে সারা অঙ্গ জুড়ে আহ্লাদে মাখামাখি। কিন্তু এতো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আজ ফিকে মনে হচ্ছে মনের তা’ন্ড’বে’র কাছে। স্বামীর ধমক খেয়ে সেই যে রুমে এসে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা আর এখান থেকে নড়ছেই না। এক ধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চেনা আকাশ টাও হটাৎ করে অ’চেনা হয়ে যায়,
এইযে, ক্ষণেক্ষণে যে রং বদলায়, কখনও আসমানি, কখনও ধুসর নীল তো কখনও ঘুটঘুটে কালো। সবাই তো নিয়ম ভ’ঙ্গ করে তবে তার স্বামী কেনো তাকে বুঝে না? সব নিয়ম ভ’ঙ্গ করে তাকে কি একটিবার কাছে টানা যায় না? এতোটাই তুচ্ছ সে! আচ্ছা লোকটা কি কখনো তার অনুভূতি বুঝবে না? আর কত বেহায়া হবে, আর কত নিচে নামবে চাঁদনী একটু ভালোবাসা পাবার জন্য। ভিতর থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো মেয়েটা। অতঃপর দূর আকাশের পানে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো চাঁদনী,
“তুমি ঐ দূর আকাশে চাঁদের মতোই! হাত বাড়ালেই পারি না ছুঁতে, যতোই যাই আরো কাছে তুমি যাও দূরে সরে।”
.
ফাতেমা খানম খাবার টেবিলে ছেলের জন্য খাবার সাজাচ্ছে। এতোদিন চাঁদনী যেচে এসে শ্বাশুড়ি’র সাথে খাবার আনা-নেওয়া করলেও আজ আর রুম থেকে বের হলো না। প্রতিদিন সবাই একসাথে রাতের খাবারটা খেলেও আজ সবাই আগেই খেয়েছে। শুধু খায়নি চাঁদনী ও ফাহাদ। যদিও বাবা বলেছিলো তাদের সাথে খেতে কিন্তু সে বাহানা দিয়ে বলেছিলো ক্ষুধা নেই পরে খাবে। মূলত ফাহাদে’র জন্য অপেক্ষায় ছিলো এক সাথে খাবে বলে।
ফাহাদ বাড়ি আসার পর থেকে নিয়মিত খাবারটা মা’ই বেড়ে দেয়, যাতে চাঁদনী তার ছেলের ধারে কাছে আসতে না পারে। তাদের সম্পর্ক যে অন্য স্বামী -স্ত্রী’র মত নয় তা ঢের বুঝেছে সে। এতে মনে মনে ছেলের প্রতি সন্তুষ্ট সে। এটাই তবে তার ছেলে!৷ গর্বে বুক ভরে যায় তার। এখন ভালোর ভালো আ’প’দ’টা বিদায় হলেই হলো, মনে মনে এটাই সে খুব করে চায়।
সব গুছিয়ে ছেলে’কে ডেকেছে বারকয়েক মা, কিন্তু ফাহাদ এখনো বাহিরো যার ফলে মা’য়ের ডাক শুনতে পায়নি। ছেলের এমন হে’য়া’লিপ’না দেখে ভীষণ বিরক্ত হয় ফাতেমা খানম। ধুপধাপ পা ফেলে ছেলের কাছে গিয়ে বিরক্তি কণ্ঠে বললো,
“কতক্ষণ ধরে তোকে খেতে ডাকছি ফাহাদ খাবি না তুই? সেই কখন থেকে খাবার বেড়ে বসে আছি আমি।”
ফাহাদ সবেমাত্র আরো একটা সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সুখটান দিচ্ছিলো। হঠাৎ মায়ের কথা শুনে অস্বস্তিেতে পড়ে চায়। হাতের সিগারেটটা দূরে ছুঁ’ড়ে ফেলে দিলো। দৃষ্টি এখনো আকাশের দিকে। সেদিকে তাকিয়েই মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আসছি মা তুমি যাও।
এবার বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো মা। আগের চেয়ে কণ্ঠে আরো একটু বিরক্তি নিয়ে বললো ,
“কখন আসবি শুনি? সারাদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে কি এমন দেখিস বুঝি না বাপু।”
মায়ের এমন কথায় মলিন হাসলো ফাহাদ, চট করে দৃষ্টি মায়ের দিকে নিক্ষেপ করে মৃদুস্বরে বললো,
“শুনবে মা? ঐ যে বিশাল আকাশটা দেখো না (হাতদিয়ে আকাশটা দেখিয়ে) । আমি ওই আকাশের কাছে নিজের সব কথাগুলোকে জমা রাখি। আমার সমস্ত বিষণ্ণতা তার দিকে তাকিয়ে ভুলে থাকি। প্রচন্ড মনখারাপে তার সাথে অন’র্গল কথা বলি। ক’ষ্টে’র সময়টায় তার দিকে তাকিয়ে মন হালকা করি।
কিছু চাওয়ার হলে উপরের দিকে তাকিয়েই চাই। কিছু না-পেলে ঠিক একই দিকে তাকিয়ে আফসোস জানাই। কখনো অনাকাঙ্খিত সুখ পেলে তার সাথে ভাগাভাগি করে নিতে ভুলি না। আনন্দের সময়ও তাকে মনে রাখি।
আমি আর আমার একখণ্ড আকাশটাই আমার সম্বল। নিজের কাছের বলতে আমি দূরের ওই আকাশটাকেই বুঝি। আমার হাজারো মন্দ লাগায়ও তার মাঝেই এক টুকরো সুখ খুঁজি। আপন বলতে আমি শুধু তাকে বুঝি।”
ছেলের কথায় চমকে উঠলো ফাতেমা খানম। তার কথার মধ্যে কতটা অভিমান যেন মিশে আছে। হঠাৎ কেনো জানি অপরাধ বোধ সৃষ্টি হলো নিজের মধ্যে। আচ্ছা সত্যিই কি তার ছেলের কেউ নেই? ছোট্ট সেই ছেলেটা এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে, নিজের মধ্যে কথা জমিয়ে রাখতে শিখেছে। যত বড় হচ্ছে মা-ছেলের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আগে কতটা না মা পাগল ছিলো তার ছেলেটা। এখন তাদের মধ্যে কতটা দূরত্ব। দূরত্বটা তো সে’ই বাড়িয়েছে, বেকার থাকতে ছেলেটাকে কত মন্দ কথা শুনিয়েছেন তার ইয়াওা নেই। কষ্টের সময় যখন মা’কে সব থেকে বেশী প্রয়োজন ছিলো সেই সময়টাই মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলো সে। এক বাসায়,থেকেও কখনো খোঁজ নেয়নি ছেলেটার। সেই থেকেই তো ছেলেটা তার নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। এখন চাইলেও আর সমস্ত দূরত্ব কাটিয়ে নিতে পারে না। তার ছেলেটা যে ভীষণ অভিমানী। পুরনো স্মৃতি মনে হতেই কঠিন মানবী মানুষটার ও চোখ দু’টো হঠাৎ করে ঝাপসা হয়ে গেলো সবার আড়ালে। দ্রুত চোখের পানিটুকু লুকিয়ে নরম কণ্ঠে বললো,
“আচ্ছা বাবা এখন চল।”
ফাহাদ আর কথা বাড়ালো না ,মায়ের সাথে চলে আসলো ভিতরে। ফাতেমা খানম পরম যত্নে ছেলেকে খাবার বেড়ে দিলো। ফাহাদ আনমনে হাসলো, আজকাল সবার ভালোবাসায় কেমন স্বার্থ লুকানো তাই না? পকটে টাকা থাকলে সবার এক্সটা আদর যত্নের আর অভাব পড়ে না। যখন সে বেকার ছিলো, শূন্য পকেট ছিলো তখন এই মা’টাও তাকে এক থালা খাবার নিয়ে কথা শুনিয়েছেন। দূরত্ব বাড়িয়েছে যোজন যোজন। আজ রাত বারোটা বাজে অথচ মা এখনো জেগে আছে সে খায়নি বলে। আহা টাকা! টাকাই সব!
“ফাহাদ…..?”
পুনরায় মায়ের ডাকে পুরনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসে ফাহাদ। ডাইনিং টেবিলে আজ কাউকে না দেখে আশেপাশে বারকয়েক তাকিয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করলো,
“সবাই খেয়েছে মা?”
“হ্যাঁ খেয়েছে সবাই, তুই খা তাড়াতাড়ি খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
উত্তরটায় মন ভরেনি তার, স্পেশাল কারো কথা যেন জিজ্ঞেস করছে সে। মায়ের উত্তর শুনেও নিজের রুমটার দিকে তাকালো গোপনে। তার চোখ দু’টো কাউকে যেন খুঁজছে। তবে কি চাঁদনী’কে? নিজের অনুভূতি দেখে ফাঁকা ঢোক গিললো ফাহাদ। খাবারের প্লেটে হাতদিয়ে নাড়াচাড়া করছে কিন্তু মুখে দিচ্ছে না, পেটে ক্ষুধা থাকা সত্বেও খেতে ইচ্ছে করছে না। কারো প্রতি অধিকার দেখিয়ে, খুব অভিযোগ নিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, “আমাকে একা রেখে খেয়েছো কেনো?”
আচ্ছা সত্যিই কি খেয়েছে সেই মানুষটা? জানতে ইচ্ছে হয় খুব। ফাহাদ আবারও তাকালো ভিতর থেকে চাপানো দরজার দিকে, নিজের অজান্তে বলেই ফেললো,
“মা চাঁদনী খেয়েছে?”
ফাতেমা খানম গ্লাসে পানি ঢালছিলেন তার হাত থেমে গেলো। দারুণ ভাবে চমকালো, ভড়কালো সে! কোনো ভাবে ছেলেটা কি ওই মেয়ের প্রতি দূর্বল? না না এ হতে পারেনা। পরক্ষণেই উনি ছেলেকে উস্কিয়ে দিবার জন্য বললো,
“তার কথা আর কি বলবো বাবা? ন’বা’ব’জা’দী কি আর কারো খোঁজ রাখে কে খাইলো আর কে না খাইলো। একা একা ভালো ভালো তরকারি দিয়ে কতগুলো গি’লে রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। এখন গিয়ে দেখ, রুমে বসে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। ”
অথচ মা,জানতো চাঁদনী খায়নি। মায়ের এহেন কথায় বিরক্ত হলো ফাহাদ। মেয়েটা খেয়েছে কেনো জানি তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তবুও মায়ের বিপরীতে চট করে বললো,
“খাবার নিয়ে কাউকে খোঁটা দিতে নেই মা। পেটের ক্ষুধা জানে একথালা ভাতের কত মূল্য। তাইতো কতো নিরুপায় মানুষ আছে শত কটু কথা শুনেও একথালা ভাত আর সাথে এক থালা খোঁটা প্রতিনিয়ত খায়, খেতে হয়।
তার ক্ষুধা লেগেছে খেয়েছে এতে দোষের কি আছে মা? তোমার যখন ক্ষুধা লাগবে তুমিও খেয়ে নিবে।”
বলেই নিজের ভাতের প্লেটটা ঠেলে দূরে সরিয়ে হাত ধুতে ধুতে পুনরায় আবার বললো ফাহাদ ,
“কেনো জানি খেতে ইচ্ছে করে না মা। রেখে দেও।”
কথা শেষ করে আর দাঁড়ালো না ফাহাদ বড় বড় পা ফেলে সামনের বারান্দায় চলে গেলো। ছেলের এমন আচরণে মন ক্ষু’ন্ন হলো ফাতিমা খানমের। সে ভেবে ছিলো ফাহাদ রেগে গিয়ে তার সাথে তাল মিলিয়ে মেয়েটাকে বকে দিবে। কারণ সে জানতো মেয়েটাকে সহ্য করতে পারে না ফাহাদ। কিন্তু এখানে হলো উল্টো। উল্টো খাবার রেখে উঠে গেলো ছেলেটা। তার ভীষণ রাগ হচ্ছে, এই ক’দিনে এতো বউ পাগলে হয়ে গেছে তার ছেলে ভাবা যায়! নিশ্চয়ই ওই বা’ন্দি’র বা’চ্চা তার ছেলেকে তাবিজ করে ব’শ করছে। পারলে এক্ষণই চাঁদনী’কে এ বাসা দিয়ে তাড়িয়ে দিতো সে। তাও তো আর সম্ভব নয়। বাপের মতো হয়েছে বড় শ’য়’তা’ন’টা’য়। বাপ-ছেলে এক কোয়ালিটির এক একটা ই’ব’লি’শ!
একা একা গজগজ করতে করতে, আশাহত মনটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো ফাতিমা খানম।
.
.
রাত প্রায় একটা। চাঁদনী খাটে সুয়ে সুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। ঘুমও আসছে না তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তারমধ্যে পেটে ভীষণ ক্ষুধাও সন্ধ্যা থেকে কিছু খায়নি। অথচ কেউ তাকে একটি বার ডাকলো না। লজ্জা, মনের কষ্টে খাওয়ার রুচি হলো না। এরিমধ্যে দরজায় শব্দ হলো নিশ্চয়ই ফাহাদ এসেছে। চাঁদনী নিশ্চুপ হয়ে ঘুমের অভিনয় করে সুয়ে রইলো।
ফাহাদ মাএই রুমে এসেছে চাঁদনী’কে ঘুমাতে দেখে কপালে তীক্ষ্ণ ভাজ পড়লো গুটি কয়টা। তবুও নিঃশব্দে ফ্লোরে নিজের জন্য বিছনা ঠিক করে লাইট নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো। অতঃপর সুয়ে পড়লো। তারও ভালো লাগছে না আজ। বারবার নিজের অজান্তেই চাঁদনীর রাগ, অভিমানী কথা, আবদার, শাসন গুলো মাথায় এসে কিলবিল করছে। এই যে ফাহাদ রুমে এসে যখনই নিচে সোয়ার জন্য বিছনা করতো তখনই চাঁদনী তার কানের মাথা খে’তো। মেয়েটা নিত্য নিয়ম করে বলতো উপরে সোয়ার জন্য। ফাহাদে’র সাথে চি’প’কে থাকতো, বিভিন্ন কথা বলতো। মাঝে মাঝে ফাহাদে’র ভীষণ হাসি পেতো। ফাহাদ বিরক্ত প্রকাশ করলেও তার ভালো লাগতো। ঐ যে মানুষ সঙ্গ প্রিয় স্বভাবের। হঠাৎ আজ মেয়েটা এতো নিরব হয়ে গেলো ভীষন করে ভাবাচ্ছে ফাহাদ কে। নিজের একরোখা স্বভাবের জন্য “কি হয়েছে তোমার?” জিজ্ঞেস করতেও দ্বিধা হচ্ছে। পরক্ষণেই মনে পড়লো কিছুক্ষণ আগের ধমকের কথা। নিশ্চয়ই মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে ভীষণ। চট করে একবার চাঁদনী’র দিকে তাকালো। না দেখা যায় না উল্টো দিকে মুখ করে সুয়েছে। চাঁদনী যে ঘুমায়নি এবার নিশ্চিত হলো ফাহাদ। দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসলো ছেলেটার ভিতর থেকে।
কিছু সময় নিজেকে এতোটাই একা লাগে, চারপাশে এতো মানুষের কলরব, কত রঙিন আয়োজন, কোনো কিছুতেই যেন শান্তি নেই। যেন দুঃখ এসে নিরবে চোখের জল জরায়, বলার মতো অজস্র কথা সত্বেও মুখ ফুটে কিছু বলা যায় না। কিছু পিছুটান, কিছুটা জড়তার জন্য। তেমনি ফাহাদও পারছে না। মস্তিষ্ককে সায় না দিয়ে উল্টো নিজেকে শাসিয়ে সব ভাবনা রেখে জোর করে চোখ বন্ধ করলো ফাহাদ।
এক মিনিট, দু’মিনিট এভাবে কতক্ষণ অতিবাহিত হলো অথচ ঘুম পায়না। মস্তিষ্কে পোকার দল গুলো তীব্র য’ন্ত্র’ণা দিচ্ছে তাকে। ঘুমাতে দিচ্ছে না। উঠে বসলো ফাহাদ, নেশা ধরেছে তার, ভীষণ নেশা। এখন একটা সিগারেট না খেলেই নয়।
হাতে টর্চ লাইটের সাহায্যে দ্রুত সিগারেট নিয়ে বাহিরে গেলো, মিনিট দশেক পড়েই ফিরলো আবার। কতক্ষণ পায়চারি করে হুট করে আলমারি খুলে বহুদিন পর নিজের, একান্তই নিজের ডায়রিটা বের করে নিলো। চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ ডায়েরিটা ঘাটাঘাটি করে কলম হাতে নিয়ে লিখলো,
“অপ্রিয় আমি,
আজকাল তোমাকে আমার প্রচন্ড বি’রক্ত লাগে।প্রিয় থেকে কখন যে অপ্রিয় এর খাতায় নাম লিখেছো আমি টেরও পাইনি।
জীবন যা চেয়েছি পেয়েছি সব তার উল্টোটা এই না পাওয়ার পাল্লাটা এত ভারী হয়ে গেছে যে এখন আর নিজেকেই ভালোলাগেনা।কেমন জানি নি’ষ্প্রাণ পুতুলের মতো বেঁচে আছি।
মাঝে মাঝে ভাবি একটা সময় এই আমিটাই কত না প্রিয় ছিলাম নিজের কাছে অথচ সময়ের স্রোতে আজ নিজের কাছেই সবচেয়ে অপ্রিয়।নিজের জীবনের প্রতি কখন যে এত অনীহা চলে আসছে বুঝতেই পারিনি।
জীবন চলছে জীবনের মতো আমি চলছি আমার মতো।দুটাই স্রোতের বিপরীতে চলছে।না নিজেকে খুশি করতে পারছি না পরিবারকে।নিজেকে খুশি করতে পারিনা জন্য ক’ষ্ট হয়না বরং ক’ষ্ট হয় এজন্য যে আমি আমার প্রিয়জনদেরও খুশি করতে পারিনা।আমি এক অপারক কারো জন্যই কিছুই করতে পারিনা।
কি চাইলাম কি পেলাম এসব আর ভাবতে ইচ্ছে করেনা।নিজেকে পৃথিবীর একটা আ’পদ মনে হয়। এখন শুধু যত তাড়াতাড়ি এই আ’পদ টা পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে ততই যেনো শান্তি।”
আরো কিছু সময় পুরনো স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে দেখতে দেখতে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসলো ছেললটার। অতঃপর ব্যস্ত হাতে ডায়েরিটা যথাযথ স্হানে রেখে সুয়ে পড়লো। চাঁদনী এতক্ষণ আড় চোখে বারকয়েক পরখ করেছে ফাহাদ কে। মানুষটা যে কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পেরেও চুপ হয়েই রইলো। কি করবেটা কি সে? যতবার কাছে গিয়েছে ততবারই সচতা হয়ে ফিরেছে। থাক না যে যেমন থাকতে চায়।
দুজন দুই বিছনায় বসে ছ’ট’ফ’ট করছে অথচ কারো চোখে ঘুম নেই। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না।
এক রুমে থেকেও দুজনের মধ্যে আকাশ সমান দুরত্ব। এভাবে ছ’ট’ফ’ট করতে করতেই একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ফাহাদ, ঘুমালো না চাঁদনী। এরিমধ্য আযানের মধুর প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে চারপাশ থেকে। নির্ঘুম একটি রাত কাটিয়ে দিলো অবলীলায় সে। আযান শুনেই নামাজের জন্য আড়মোড়া ভেঙে বসলো চাঁদনী। বেহায়া মনটা না চাইতেও ওই নিদিষ্ট একজনের পিছু ছাড়ছেই না। সকাল সকাল উঠেই চোখ দু’টো ঠেকলো ঘুমান্ত ফাহাদে’র দিকে, কি সুন্দর স্নিগ্ধ লাগছে ঘুমান্ত ফাহাদ কে। মানুষটা তার অধিকার অথচ মধ্যে বিশাল এক অদৃশ্য দেয়াল। লম্বা শ্বাস টানলো চাঁদনী অতঃপর বিড়বিড় করে বললো,
“বাস্তবে তোমাকে ছোঁয়া অসম্ভব হলেও, স্বপ্নে এবং কল্পনায় তোমাকে ছুঁয়েছি বহুবার। ভীষণ যত্ন করে রেখেছি হৃদয়ের কোটরে। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় তুমি আছো খুব কাছাকাছি। মাঝেমধ্যে ভাবি তোমার আমার দূরত্বটা আকাশের মতো হলেই হতো। তাহলে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে তুমি ছুঁয়ে দিতে পারতে আমায়। কিন্তু, কিন্তু আমাদের মনের দূরত্ব এতোটাই বেশী যে পাশাপাশি থেকেও মনে হচ্ছে আমরা আকাশের থেকেও বেশী দূরত্বে অবস্হান করছি।”
চাঁদনী দ্রুত নামাজ আদায় করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। আজ আর ডাকলো না ফাহাদ কে।
#চলবে……
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ! ]