#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writerঃsumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ১১
চাঁদনী’র কথা শুনে মুহুর্তেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, চোখ বড়বড় করে ফেললো ফাহাদ। কি বলছে মেয়েটা? ডিরেক্ট তাকে ফাজিল বললো? আবর সে কিনা দুষ্ট লোক! ভাবা যায় এগুলো? ফাহাদ মিনিট খানিক সময় চুপচাপ বোকার মতো দাঁড়িয়ে দেখলো চাঁদনী’র কারুকার্য।মেয়েটা এখনো উল্টো পিঠ হয়ে ঘুমাচ্ছে আর কি জানি বিড়বিড় করছে, যা স্পষ্ট ফাহাদে’র কান অবধি আসছে না।এভাবে একমিনিট, দু’মিনিট অতিবাহিত হলো। এবার ফাহাদের ভীষণ রাগ হচ্ছে। এমনিতেই শরীর প্রচুর ক্লান্ত তারমধ্যে এই মেয়েটা তার বেড দখল করে আজগুবি কথা শুনাচ্ছে তাকে। মেয়েটার ভাগ্য ভালো আজ তাদের বাসায় বোনের শ্বশুর বাড়ির লোকজন। না-হয় এতক্ষণে দুর্দান্ত কান্ড বেঁধে যেতো।
ফাহাদ লম্বা শ্বাস ফেলে একটু এগিয়ে গেলো চাঁদনী’র দিকে, ঘাড়ের হাত রেখে ডাকার জন্য হাত বাড়িয়ে আবারও হাতটা গুটিয়ে নিলো, তার ইতস্তত হচ্ছে মেয়েটার শরীর ছুঁতে। তবুও উপায় না পেয়ে ঘাড় ধরে বার কয়েক “এই মেয়ে” বলে ঝাঁকুনি দিয়ে আবার এক ঝটকায় দূরে সরে দাঁড়ালো ফাহাদ। চাঁদনী ঘুমের মধ্যে আকস্মিক এমন ধাক্কা খেয়ে খাট থেকে পড়ে যেতে নিও নিজেকে সামলে নিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। চারপাশে একবার তাকিয়ে অকল্পনীয় লোকটাকে সামনে দেখে দারুণ ভাবে চমকালো। আচ্ছা এটা তার ভ্রম, নাকি সত্যি? চাঁদনী বারকয়েক চোখে পলক দিয়ে চারপাশে তাকিয়ে আবার দেখলো, তার দিকে রাগী লুকে তাকিয়ে আছে লোকটা। চাঁদনী উওেজনায় হৃদ’পি’ণ্ড কেঁপে উঠলো, এ যেনো এক রুপকথার গল্পের মতো দুর্দান্ত স্বপ্ন। দিকবিদিকশুন্য হয়ে বসা থেকে ফাহাদে’র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জোড়ে এক চিৎকার দিয়ে চাঁদনী বলে উঠলো,
“আপ……”
মুখের বাক্য শেষ করতে পারলো না চাঁদনী তার আগেই ফাহাদের লম্বা শক্ত পুরুষালী হাতগুলো দিয়ে মুখ চেপে ধরলো মেয়েটার। বাসায় মেহমান আর এতরাতে নির্বোধ মেয়েটা চেচাচ্ছে । বাহিরের মানুষ শুনলে দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে ব্যাপারটা। ফাহাদ কণ্ঠে ক্রোধ মিশ্রিত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এই মেয়ে চেঁচাচ্ছো কেনো? তুমি আমার রুমে কেনো?”
চাঁদনী যেন শুনলোই না এসব, অকল্পনীয় ঘটনার রেশ এখনো রয়েছে তার মধ্যে। দু’জনার মাঝে একহাতের মতো দুরত্ব। চাঁদনী’র মুখে এখনো ফাহাদে’র হাত চেপে রাখা। পরক্ষণেই চাঁদনী চোখ বড়বড় করে, অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো ফাহাদে’র মায়াবী চোখে’র দিকে। তার এতক্ষণের গভীর ঘুম ছুটে গিয়েছে কই যেন। এটা তার কোনো স্বপ্ন নয়, আর না দৃষ্টি ভ্রম। এটা সত্যি, বাস্তব। তার এতোদিনে অনুভূতি মিশ্রিত শখের পুরুষটি এসেছে। অতঃপর মেয়েটা দীর্ঘ পিপাসিত চক্ষুদ্বয় নিয়ে এই প্রথম দেখছে তার স্বামী নামক অর্ধাঙ্গন’কে। লোকটাকে ছবির থেকেও বাস্তবে একটু বেশীই আকর্ষণী লাগছে চাঁদনী’র কাছে। এই পুরুষটি একদম আগোছলো, এলেমেলো, তবুও এক অদ্ভুত মায়া যেনো লেপ্টে আছে চেহারায়।
একজন মুগ্ধ হয়ে দেখছে, আর একজন তিক্ত হয়ে, ক্রোধিত চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এই চোখ দিয়ে ভস্ম করে ফেলবে মেয়েটাকে। চাঁদনী মনেমনে তবুও হাসলো।অবশেষে লোকটা এসেছে, শুধু আসেনি তাকে বাজে ভাবে চমকেও দিলো। এতটুকুই বা কম কিসে তার জন্য। চাঁদনী’কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তি ইতস্ততবোধ করলো ফাহাদ, জলদি হাত সরিয়ে নিয়ে দূরে সরে গেলো। অন্যদিকে ঘুরে কাঁদে’র ব্যাগ নামিয়ে রাখলো খাটের কর্ণারে। অতঃপর ব্যাগ খুলে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো ,
“এই মেয়ে তুমি এখনো এই বাড়িতেই রয়ে গিয়েছো, তাও আবার আমার রুমেই থাকছো? তোমার সাহস তো কম না! তুমি এক্ষণই আমার রুম থেকে বের হও।”
স্বজ্ঞানে ফিরলো চাঁদনী। মুখে হালকা ব্যথা অনুভব হচ্ছে এখন,শ্যামলা মুখখানা কালচে হয়ে লাল বর্ণ ধারণ করছে। চাঁদনী মুখে একহাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
“রা”ক্ষ”স,ব’দ লোক কোথাকার! এভাবে কেউ মুখ চেপে ধরে। উফ্ কি ব্য’থা।”
চাঁদনী’র কোনো রেসপন্স না পেয়ে একবার ঘুরে তাকালো ফাহাদ, চাঁদনী’কে চুপচাপ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কণ্ঠে আরো একটু ক্রোধ নিয়ে, পুনরায় আবারো বললো,
“কি হলো? কথা কানে চাচ্ছে না তোমার? নাকি বোবা তুমি, কথা বলতে পারো না? সে যাইহোক, আমার রুম থেকে বের হও দ্রুত, আমার চোখের সামনে আর কখনো এসো না।”
চাঁদনী’র মধ্যে ফাহাদে’র তিক্ত কথার কোনো প্রভাব পড়লো না, কারণ সে আগেই ভেবে রেখেছে এমন কিছুই হবে। তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না, সে তার দায়িত্ব, অধিকার আদায়ের করে নিবেই। এইটুতেই কষ্ট পেলে বাকি পথ অ’তি’ক্র’ম করবে কি করে সে। চাঁদনী মনেমনে নিজের মনকে আরও একবার বুঝালো, কারো ব্যবহারে কষ্ট পেলে তার নিকট প্রকাশ করা যাবে না, নিজের দূর্বলতা সম্পর্কে কাউকে আন্দাজ করতেও দেওয়া যাবে না। অতঃপর ফাহাদে’র কথার বিপরীতে মুচকি হেসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“আরে ফাহাদ রিলাক্স এতো হাইপার হবেন না আপনি। আচ্ছা আমাকে আপনি বলুন তো, কক্ষণো কোথাও দেখছেন কোনো বউ তার স্বামী’র রুম রেখে অন্য কোথাও থাকে? জানি দেখেননি। তাই আমিও পারবো না আমার একমাত্র জামাইয়ের রুম ত্যাগ করে অন্য রুমে যেতে।”
ফাহাদ ভ্রু কুঁচকে ফেললো চাঁদনী’র কথায়। না চাইতেও মনে মনে বারকয়েক আওড়ালো, একমাত্র জামাই! হাস্যকর ব্যাপার! ফাহাদ আর তার জীবনে নারী! মনে মনে তাচ্ছিল্য করে হাসলো। এরপর আগে ন্যায় কণ্ঠে গম্ভীরতা বিরাজমান রেখে বলে উঠলো,
“শোনো মেয়ে? আমার সাথে একদম অধিকার দেখাতে এসো না। আবারও বলছি আমার সাথে লা’গ’দে এসো না। পরে ফাহাদে’র উওাপ সহ্য করতে পারবে না! আমি ভীষণ ক্লান্ত, তোমার সাথে অহেতুক কথা বলার মতো সময় নেই। আমি ঘুমাবো চলে যাও এখান থেকে তুমি।”
চাঁদনী নিজেকে সংযোগ করে নিলো, এ লোকটাকে রাগিয়ে দিলো হিতে বিপরীত হবে। আবার তারও ভীষণ রাগ হচ্ছে, বারবার চলে যাও, চলে যাও। তবুও নিজেকে সামলে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
” আশ্চর্য আমি যাবেটা কোথায়? বাসা এক্সাটা বেড রুম নেই, তার উপরে আজ মেহমান।”
“সে আমি কি জানি তুমি কই যাও?তোমার সাথে একরুমে, এক বেডে থাকা,অসম্ভব!”
“অসম্ভব হলে আপনি চলে যান এ রুম থেকে। আমি এতোদিন এই রুমে থেকে আসছি, সুতরাং এই রুমে আমারও অধিকার আছে। তারপর আপনাকে বলছি, আপনি গেস্ট হিসেবে খাটের এক পাশে সুইলে আমি কিছু মনে করবো না।”
বলেই চাঁদনী আড়মোড়া ভেঙে কাঁথা মুড়ি দিয়ে খাটের একপাশে সুয়ে পড়লো, ফাহাদ হতাশ চোখে তাকিয়ে বললো,
“হোয়াট? তোমার সাথে এক বিছনায় ঘুমাবো আমি?”
“না ঘুমালে ফ্লোরে ঘুমান। খবরদার! ভুলেও আমাকে বলবেন না কিন্তু, নিচে ঘুমাতে। শুনুন? আমি কোনো বাংলা সিনেমার সাবানা নয় যে আপনাকে বলবো, “ওগো তুমি রাগ করো না, শুধু আমায় আজকের রাতটা এই ঘরে থাকতে দেও। আমি নিচে ঘুমাচ্ছি তুমি খাটে ঘুমাও!” আমি মোটেও এমন নয়, আপনার যেখানে ইচ্ছে ঘুমান। আমায় একদম বিরক্ত করবেন না। আমার ঘুম দরকার এখন, সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।”
চাঁদনী’র কাঠকাঠ কথা শুনে চরম ভাবে হতাশ হলো ফাহাদ। ইয়া মাবুদ! নিজের রুমে এখন অন্যের দখলে। রাগের, দুঃখে, নিজের লম্বা চুলগুলো মুষ্টি বদ্ধ করে ফেললো ফাহাদ।সারাদিন অফিস করে, আবার লম্বা জার্নিতে অবস্থা বেশ নাজেহাল। শরীর আর চলছে না, দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। তবুও এই মেয়ের সাথে তো আর বেড শেয়ার করা যাবে না। উপায় না পেয়ে একটা চাদর, বালিশ বিছিয়ে ফ্লোরেই সুয়ে পড়লো ফাহাদ।
ফ্লোরে কি আর শান্তি আছে? মশায় যেন তাকে পেয়েছে, চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। তবুও নিজের জেদ কে প্রধান্য দিয়ে আশপাশ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।
চাঁদনী এখনো সজাগ তার চোখে যে আর ঘুম আসবে না। ফাহাদে’র জন্য খারাপও লাগছে, বেচারা কত পথ জার্নি করে এসেছে নিশ্চয়ই অনেক টায়ার্ড। এখন আবার শক্ত ফ্লোরে পড়ে, মশার কাপড় খাচ্ছে।
চাঁদনী’র কোমল মনটা বিষিয়ে উঠলো, ইশ সে নিচে ঘুমালেই পারতো। মুহুর্তেই ঘুরে তাকালো ফাহাদে’র দিকে, রুমে নীল রঙের ডিম লাইটের আলোতে ফাহাদে’র ফর্সা মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফাহাদের মুখটা কি নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো লাগছে। কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে মানুষটাকে! এই মুখ যেন চাঁদনী’র কিশোরী মনটা ভীষণ বাজে ভাবে এলোমেলো করে দেয়। মেয়েটার মায়া হলো ফাহাদে’র জন্য। মিনমিন কণ্ঠে ডাকলো,
“এই শুনছেন?”
কিন্তু কোনো রেসপন্স নেই। বোধহয় গভীর ঘুমে মগ্ন, আর কিছু না ভেবে চাঁদনী উঠে রুমে একটা কয়েল জ্বালিয়ে দিলো। আরো কিছুক্ষণ চুপিচুপি তাকিয়ে থাকলো ঘুমান্ত ফাহাদে’র দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো চাঁদনী। নিজের মনকে কঠিন ভাবে শাসালো। তাকে যে এতো নরম হলে চলবে না। না একদমই চলবে না! তাহলে যে আরো পেয়ে বসবে! নিজ ইচ্ছেই তো সে নিচে সুয়েছে মানুষটা। তার কষ্ট হলে চাঁদনী’র কি? সে তো আর জোড় করে বলেনি নিচে সুতে। যদি বেডে ঘুমাতো তো কি এমন ক্ষতি হতো?
#চলবে,……
#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writerঃsumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ১২
ফজরের আযানের মধুর প্রতিধ্বনি কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ঘুম ছুটে গেলো চাঁদনী’র।
গতকাল রাতে মাথা ভর্তি বিভোর ভাবনার মাঝে, নিজের অজান্তেই শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল মেয়েটা।পরিপূর্ণ ঘুমটা হয়ে উঠেনি এখনো, যার ফলে মাথাটা বেশ ভারি ভারি লাগছে। মন চাচ্ছে আরো একটু ঘুমতে। মন যেন বারংবার ফিসফিস করে বলছে, ঘুমা চাঁদ ঘুমা! এতো শান্তির ঘুম রেখে কেউ উঠে? কিন্তু এখন ঘুমালে চলবে না যে, তাকে উঠে নামাজ পড়তে হবে। পরক্ষণেই মনকে চমকে দিয়ে, পিটপিট করে চোখ মেলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো চাঁদনী। মুহুর্তেই চোখ গিয়ে ঠেকলো ডানপাশে ফ্লোরে ঘুমন্ত ফাহাদে’র দিকে। সেদিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো চাঁদনী। আজ সকালটা এতোদিনের থেকে ভীষণ স্পেশাল তার কাছে, কেননা আজ প্রিয় মানুষটির মায়াবী মুখটা দেখে দিনটার সূচনা হলো।
আরো মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো প্রিয়তম স্বামী’র দিকে। একবার ভাবলো নামাজের জন্য ডাকবে ফাহাদ কে। পরমুহূর্তেই মনের মাঝে ভয় বাসা বাঁধলো, যদি লোকটা সকাল সকাল রেগে যায়,চেঁচামেচি করে। তাদের সম্পর্কটা তো আর অন্য সবার মতো না, প্রথমেই এতো বাড়াবাড়ি ঠিক হবে না। তবে চাঁদনী আশাবাদী খুব শীঘ্রই এমন একটা মিষ্টি ভোরে এক মুঠো প্রেম এসে ধরা দিবে তাদের কাছে। সেও পরম যত্নে প্রিয়তম পুরুষটি’কে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবে আজীবন! ভাবতেই অধর কোণে আবারো মিষ্টি হাসি ফুটলো।আর কিছু না ভেবে সাবধানী পায়ে ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলো।
.
.
চাঁদনী নামাজ পড়ে রুমের জানালটার এক সাইড খুলে দিলো। অতঃপর জানালার কার্ণিশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ ভোরের মিষ্টি বাতাস গায়ে মাখালো। তার খুব ইচ্ছে হয়, এই কুয়াশাচ্ছন্ন মিষ্টি সকালে প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে, হাতে হাত রেখে, পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে, খালি পায়ে, ভোরে বিন্দু বিন্দু শিশির কণাগুলো পায়ে মাখিয়ে, উদ্দেশ্যহীন ভাবে পথ চলতে। কিন্তু, কিন্তু তা তো আর এখন সম্ভব নয়! মানুষটা যে এখন অবধি তাকে সহ্য করতেই পারছে না। তার কাছে এমন আবদার করাটাও যে বিলাসিতা। ভাবতেই বুক চিরে ভারি কয়েকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসলো মেয়েটির। অতঃপর বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মলিন কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এই বাতাসটা যেমন আস্তে করে এসে আলগেছো মনকে শীতল করে দেয়, তেমন করে যদি সব দুঃ’খগুলোকেও উড়িয়ে নিতো! তাহলে, বোধহয় আমিও একটু সুখের মুখ দেখতে পারতাম।”
ইতোমধ্যে চারপাশে ভোরের আলো ফুটেছে। এখন আর তাকে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। দ্রুত রান্না ঘরে যেতে হবে, হাতে মেলা কাজ। বাসায় নতুন মেহমান তার উপরে দাদি অসুস্থ এনিয়ে নিত্যদিনের থেকে রান্নার চাপটা বেশিই। দ্রুত পায়ে দরজা খুলতে গিয়েও আবার ফাহাদে’র দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো চাঁদনী। পরক্ষণেই মাথায় এলো, সে বাহিরে বের হবার পরে যদি কেউ এসে দেখে ফাহাদ নিচে ঘুমাচ্ছে, ব্যাপারটা ভীষণ খারাপ দেখাচ্ছে। সে চায় তাদের শত ঝগড়া, রাগ, অভিমান, সবকিছু চার দেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকুক। কেননা যেকোনো সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপে রাখতে নেই।
চাঁদনী ধীরপায়ে এগিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো ফাহাদে’র মাথার কাছে, মিনিট খানিক সময় চুপ থেকে ফাহাদে’র দিকে খানিকটা ঝুঁকে মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
“এই যে শুনছেন? এই উঠুন?”
বারকয়েক ডাকতেই চোখ মেলে তাকালো ফাহাদ, মুহুর্তেই চাঁদনী’কে নিজের মাথার কাছে ঝুঁকতে দেখে, চোখ বড়বড় করে হুড়মুড় করে উঠে বসে অবাক কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এই মেয়ে কি সমস্যা? আমার ঘুমের সুযোগ নিচ্ছো তুমি?”
ফাহাদের ইঙ্গিত বুঝতে চাঁদনী’র মিনিট খানিক সময় লাগলো। বুঝতে পেরেই শব্দ করে হেসে উঠলো। যা দেখে ফাহাদ বিরক্ত হলো,চোখে রাজ্যের ঘুম তার, এমনিতেই শক্ত ফ্লোরে ঘুম হচ্ছে না ভালো। এর মধ্যে আবার মেয়েটা সকাল সকাল তাকে জাগিয়ে দাঁত কেলাচ্ছে। ফাহাদ তিব্র মেজাজ নিয়ে বললো,
“কি সমস্যা এভাবে হাসছো কেন?
চাঁদনী হাসি থামিয়ে ফাহাদ’কে একটু রাগানোর জন্য মৃদু হেসে বললো,
“এমা হাসবো না কেনো? আপনি জানেন না, স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসাও উওম। তাছাড়া দেখুন আপনি কত সৌভাগ্যবান পুরুষ, যার কিনা সকাল সকাল বউয়ের হাসিমুখটা দেখে ঘুম ভাঙলো! আর কি বললেন আমি আপনার ঘুমের সুযোগ নিচ্ছি? আরে সুযোগ নিবো কেনো আমি? স্বজ্ঞানে থেকেও আপনার সবকিছুতে আমার অধিকার আছে। আপনি চাইলে আপনাকে প্রতিদিন এমন মিষ্টি সকাল উপহার দিবো।”
বলেই চোখ টিপ মারলো চাঁদনী। মুহুর্তেই ফাহাদ র’ক্তি’ম চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত কটমট করে বললো,
“সকাল সকাল তোমার সস্তা ভাষণ শুনতে আমায় ডেকেছো? তোমার সাহস কি করে হয় এতো ভোরে আমার ঘুমটা ভেঙানোর?”
“আরে থামুন! আমার এতো ঠ্যাকা পড়েনি আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ভাষণ শুনাবো। যার জন্য ডেকেছিলাম, আমি রুম থেকে বের হবো এখন আপনি খাটে গিয়ে ঘুমান। আপনি নিচে ঘুমাচ্ছেন বাসার কেউ বা মেহমানরা দেখলে ব্যাপারটা বাজে দেখাবে।”
চাঁদনী’র কথা শুনে ফাহাদ বিপরীতে মুখে কিচ্ছুটি বললো না। তবে চাঁদনী’র এহেন কাজে সন্তুষ্ট হলেন। আড় চোখে একবার তাকিয়ে মনেমনে বিড়বিড় করে বললো,
বাহ্ মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি আছে।”
অতঃপর দ্রুত উঠে চোখ বন্ধ করে খাটে সুয়ে পড়লো। নরম বিছানায় আরাম করে একটা ঘুম হবে। আহ্ এখন একটু শান্তি লাগে! চাঁদনী ফাহাদে’র দিকে এক পলক তাকিয়ে ব্যস্ত হাতে নিচের বিছনা উঠিয়ে সেগুলো গুছিয়ে রাখলো। এরপরে মাথায় ভালো করে ওড়নাটা চেপে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। গতকাল দেরীতে ঘুমানোর ফলে বাবা আর দাদি ছাড়া এখনো কেউ উঠেনি। আফজাল হোসেন মায়ের কাছে বসে আছেন, চাঁদনীও সেখানে গিয়ে হাস্যাজ্জল মুখে তাদের খোঁজ নিলো। আফজাল হোসেন রাত থেকে ভীষণ চিন্তিতো ছিলেন। ছেলেটা
না জানি কি কান্ড বাঁধায় মেয়েটার উপর এটা ভেবে। যদিও কিছুটা ভরসা ছিলো তার, ছেলে আর যাইহোক মেয়েদের অসম্মান করবে না। তবুও রাগের মাথায় কিচ্ছুটি যদি করে বসে, ভরসার ভীতটা অতোটা মজবুত ছিলো না। কিন্তু সকাল বেলা চাঁদনী’র হাসি মুখটা দেখে স্বস্তি’র নিশ্বাস ফেললেন তিনি।
.
.
অন্যদিনের তুলনায় চাঁদনী”র মনটা আজ ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। আজ আর বিষন্নতার ছিটেফোঁটাও নেই তার মাঝে। তবে এতো খুশীর কারণটা কি ফাহাদ? উওরটা বোধহয় হ্যাঁ। কেননা শ্বশুর বাড়িতে মেয়েদের সবথেকে নিরাপদ ও ভরসার স্থান হচ্ছে তার স্বামী। স্বামীর সাথে সম্পর্ক যেমনই হোক, মানুষটা কাছাকাছি থাকলেও যেন মেয়েদের মনোবল মজবুত থাকে, আলাদা একটা প্রশান্তি আসে হৃদয় জুড়ে। তেমনই চাঁদনী’র মাঝেও অদ্ভুত এক শান্তি কাজ করছে। মানুষটা বাড়িতে আছে, তার কাছাকাছি আছে এটাই যেন অনেক কিছু। এখন তো আর লোকজন মন্দ ভাবে টিটকারি মূলক মন্তব্য করতে পারবে না তাকে। তার দিকে আঙুল তাঁক করে বলতে পারবে না, তার জন্য লোকটা বাড়িতে আসেনা বা সে তাকে দেখিনি।”
ভাবতেই বুকের উপরে থাকা এতো দিনের অদৃশ্য ভারি পাথরটা সরে গেলো, শরীর জুড়ে প্রশান্তিময় শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটির শিরা-উপশিরায় এমন কি প্রতিটা রক্ত কণায়।
চাঁদনী এক আকাশ সমান খুশী নিয়ে, প্রথমে রান্না ঘরে গিয়ে দাদির জন্য স্যুপ বানিয়ে নিলো। সেগুলো নিজ হাতে দাদিকে খাইয়ে সকালের ঔষধগুলোও খাইয়ে দিলো। অতঃপর ফাহাদে’র পছন্দ অনুযায়ী খাবার বানাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। দাদির কাছ থেকে আগেই শুনেছে সে, ফাহাদে’র প্রত্যেকটা পছন্দ- অপছন্দের কথা।
এরিমধ্যে তার সাথে যোগ দিলো ফারিহা। চাঁদনী’কে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিলো সে। ভাবীকে তুলনামূলক ভাবে আজ এতো হাসি খুশি দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। পরক্ষণেই দুষ্ট হেসে খোঁ’চা দিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার ভাবি? তোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে কেনো বলোতো?”
চাঁদনী এক ধ্যানে কিচ্ছু একটা ভাবে মুচকি হাসছে আর পিঁয়াজ কা*ট*ছে। হঠাৎ ফারিহার কথা শুনে হকচকিয়ে উঠলো। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“কেমন লাগছে আপু?”
“এই যে এতো খুশী খুশী লাগছে। ”
“এমনিতেই আপু।”
“উঁহু আমারতো মনে হচ্ছে অন্য ব্যাপার স্যাপার। সত্যি করে বলোতো ভাবী? আমার মন বলছে তোমাদের মাঝে সবকিছু হয়ে গিয়েছে।”
বলেই হাসলো ফারিহা, যা শুনে চাঁদনী খানিকটা লজ্জা পেলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“আমাদের মাঝে অন্য আট-দশটা স্বামী স্ত্রী’র মতো সম্পর্ক নয় আপু। আপনি যা ভাবছেন এসব কিচ্ছু না, তবে আপনার ভাই বাড়িতে এসেছে এতটুকুতেই আমি খুশী। জানেন তো, মেয়েরা শ্বশুর বাড়িতে স্বামীকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আজ আমার ভীষণ ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে আমার চারপাশের এতদিনের শূন্যতা কেটে গিয়েছে
ফারিহা হতাশ হলো, চাঁদনী কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে অনুনয় করে বললো,
“এবার দুজনার মধ্যে সবকিছু ঠিক-ঠাক করে নেও প্লিজ!”
“একজনার প্রচেষ্টায় কখনো কোন সম্পর্কে আগানো যায় না আপু। সেখানে আপনার ভাইতো আমায় সহ্য করতেই পারছে না। তবে আমি আমার সাধ্য মতো নিজের দায়িত্ববোধ পালন করে যাবো যতদিন আছি।”
চাঁদনী’র জবাব শুনে আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না ফারিহা। তবে সে মনেমনে খুউব করে চায় দুজনার মাঝে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। তার ভাই অতীত ভুলে নতুন করে বাঁচুক।
.
.
সকাল দশটায় মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে ফাহাদে’র। ফ্রেশ হয়ে রুম হতে বের হতেই প্রথমে চাঁদনী’র মুখোমুখি হলো। চাঁদনী মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,
“শুভ সকাল নিমপাতা!”
ফাহাদ শুনেও না শুনার মতো চাঁদনী’কে পাশকাটিয়ে চলে গেলো বসার ঘরে। মেহমানরা খেয়েছে আগেই, এখন বিদায় নিয়ে নিজ বাড়িতে যাবে। তাই কিছুটা কথাবার্তা বলে তাদের গেইট অবধি এগিয়ে দিলো সবাই। চাঁদনী খেয়াল করলো সেই থেকে ফারিহার ননদ “তনয়া” ফাহাদকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। হেসে হেসে গায়েপড়ে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে। যা দেখে হিংসা হচ্ছে চাঁদনী, এ মেয়েটা এতো কথা কিসের তার স্বামীর সাথে। মেয়েটাকে ইচ্ছে মতো মনেমনে বকে দিলো। সবাই চলে গিয়েছে, একে একে বাসার সবাই বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো। ফাহাদ এখনো খায়নি, সে এসেই টেবিলে বসলো। চাঁদনী তা দেখে দ্রুত টেবিলে খাবার দিচ্ছে তক্ষণ ফাহাদ উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
“এই মেয়ে তুমি খাবার দিচ্ছো কেনো আমায়? যাও এখান থেকে। বলছিনা একদম আমার ধারে কাছে আসার চেষ্টা করবে না। মা কোথায়? ”
“এই আপনি সারাদিন এই মেয়ে, এই মেয়ে বলে ডাকেন কেনো? আমার সুন্দর একটা না আছে। চাঁদনী আমার নাম ঠিক আছে? আপনি চাইলে ভালোবেসে চাঁদপাখি বলেও ডাকতে পারেন। আমি কিচ্ছুটি মনে করবো না। আর আপনি না চাইলেও আমি সারাদিন আপনার পাশেই থাকবো, স্ত্রী হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। তাই আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি।”
হঠাৎ করে পিছন থেকে..
#চলবে….
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ!]