#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writerঃsumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ৬
চাঁদনী শ্বশুর বাড়ি এসেছে আজ তিনটে দিন গত হলো। এরিমধ্যে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সংসারের সমস্ত কাজ তাকেই করতে হয়। কাজ করতে অবশ্য তার তেমন কষ্ট হয় না, কেননা এগুলো সে করে এসেছে। কষ্টতো মানুষের এই জায়গায়, “সারাদিন পরিশ্রম করেও ঘরের মানুষের মন অবধি লাঘব করতে না পারা!” তাছাড়াও তো উঠতে বসতে শ্বাশুড়ি’র কটুকথা আছেই। তবুও মুখ বুঝে সহ্য করে আছে মেয়েটা, কেননা সবার মতো তো আর তার যাওয়ার কোনো একটা নির্ধারিত আশ্রয় নেই।
এখন সময়টা সকাল! আজও প্রতিদিনের ন্যায় সকালের কাজ’বা’জ শেষ করে ক্লান্ত হয়ে নিজের নির্ধারিত ঘরটায় এসেছে চাঁদনী। ধীরপায়ে জানালার কাছ ঘেঁসে, আনমনে বাহিরে দৃষ্টি বুলালো চাঁদনী। আজ সকালটা প্রতিদিনের থেকে একটু বেশিই ঝলমলে মনে হচ্ছে। বাহিরে সোনালী রোদ, তবু মৃদু মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে। সেই সাথে বাড়ির ফুলের গাছগুলো থেকে, ফুলের সুভাস বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশ। যা খুব করে এসে চাঁদনী’র নাকে ঠেকছে। মাঝেমধ্যে জানালা বেঁধ করে এক চিলতে বাতাস আঁচড়ে পড়ছে চাঁদনী’র গায়ে। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য্যও তার কাছে ফিকে, তার মাঝে নেই কোনো চঞ্চলতা, নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। জীবন থেকে যেন সব রঙ হারিয়ে গেছে তার। এ কেমন ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে সে? পৃথিবীতে এতো মানুষ অথচ তার নিজের বলতে একটা মানুষ নেই! যে মানুষটি দিন শেষে মুখ দেখেই তার সমস্ত কষ্টগুলো বুঝে নিবে। দিনশেষে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে রেখে, গাল ছুঁয়ে আশ্বাস দিয়ে বলবে, ” তোর এতো চিন্তা কিসের? আমিতো আছি!”
হঠাৎ নিজের ভাগ্যে’র উপর তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠলো চাঁদনী।
যে মেয়ে তার নিজ মা-বাবার কাছেই অবহেলিত! সে কিনা অন্য কারো কাছ থেকে আকাশ-পাতাল ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এসব ভাবাও যে তার জন্য বিলাসিতা! তিন তিনটি দিন হলো অচেনা,অজানা একটা জায়গায় এসেছে সে। কই? নিজ বাড়ি থেকে একটি বারের মতো তার খোঁজ কেউ নিলো না! আজ বাবা-মা থেকেও কেউ নেই তার। মাঝে মাঝে নিজের জীবনটা, নিজ হাতে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে তার। আ’ত্ম’হ’ত্যা যদি মহা পাপ না হতো কবেই মুক্তি নিতো সে এই অ’ভি’শ’প্ত জীবন থেকে। তাও আর সম্ভব না, এই কাজ যে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ! দুনিয়াতে তো একটু সুখ খুঁজে পেলো না কবুও! পরকালেও কি একটু শান্তি চাইবে না সে! তাইতো এখনো দেহে প্রাণ’টা রয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করেই মনে পড়লো গার্লস স্কুলে পড়া কালীন বাংলা স্যারের একটি কথা। স্যার বলেছিলো,
“জীবনতো একটাই এটা নিজ হাতে শেষ করে কি লাভ? আ”ত্ম’হ’ত্যা কোনো সমস্যা’র সমাধান নয়!
দেখো মানুষের জীবন বড্ড বিচিত্রময়! সুখ-দুঃখ মিলেয়েই আমাদের জীবন। আমরা সৃষ্টির সেরা জীব! তাই এই সমাজের সাথেই আমাদের চলতে হয়। এখানে টিকে থাকতে হলে তোমাদের কঠিন সং’গ্রা’ম করেতে হবে। সে ক্ষেএে কারো উপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। জীবনের একটা সময় এসে দেখবে, কাছের মানুষ গুলো মুহূর্তেই রঙ বদলে অচেনা হয়ে যাবে। কারণ, মানুষ পরিবর্তনশীল! এতে তুমি হতাশ হবে,ভে’ঙে পড়বে, তখন সমাজের মানুষ তোমায় বড়জোড় দু’টো শান্তনা দিবে,আবার নাও দিতে পারে। কেউ কেউ তোমায় সুযোগ বুঝে আ”ঘাত করবে। তাই কারো উপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। পৃথিবীতে সমস্যা যেমন রয়েছে, তার ঠিক সমাধান ও আছে। তার থেকে বরং তুমি তোমার মনোবল শক্ত রেখে, তোমার সমস্যার সমাধান খুঁজে ঘুরে দাঁড়াও। হতাশ না হয়ে রবের প্রতি ভরসা করে ধৈর্য ধারণ করো! চেষ্টা চালিয়ে যাও যতক্ষণ না পর্যন্ত সফল হও। নিজের অধিকার নিজে আদায় করে মাথা উঁচু করে বাঁচো। মনে রাখবে, ” তোমার তুমি ছাড়া আপন আর কেউ নেই! কেউ নেই! তুমি নিজের জন্য বাঁচো। নিজেকে নিজের জন্য রাঙাও বাহারী রঙে!কেননা আস্ত একটা জীবন কেঁদে-কে’টে কাটানোর থেকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া অনেক ভালো। তুমি কেনো এতো দ্রুত পরাজয় স্বীকার করে নিজেকে কষ্ট দিবে কিংবা শেষ করবে? শোনো মেয়েরা নিজেকে নিজে ভালোবাসো! কেননা, তোমার তুমি ভীষণ দামী!”
স্যরারে বলা প্রত্যেকটা কথা যেন এই মুহূর্তে খুব প্রভাব পড়লো কিশোরী মেয়েটার মনে। সত্যিই তো সে কেনো এতো দ্রুত পরাজয় স্বীকার করে নিবে? ভাগ্যের উপরে অভিযোগ করতে করতে একটা সময় থেকে নিজেকেই চরম ঘৃণা করে মেয়েটা। এটা ঠিক না মনে হলো আজ চাঁদনী’র।
উঁহু এতো দ্রুত হারবে না সে। চাঁদনীও বাঁচবে! নিজের অধিকার নিয়েই বাঁচবে সে! তাতে তার যত কষ্ট হোক এই বাড়িতে থেকেই সে তার অধিকার আদায় করে নিবে। হয়তো জিতবে না হয় শিখবে। তবুও ভেঙে পড়বে না সে! আজ থেকে নিজেকে নিজের জন্য রাঙাবে সে! মনে মনে এক চরম প্রতিজ্ঞা করলো চাঁদনী।
এরপরে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদনী লম্বা কয়েকটি শ্বাস ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। হাতে করে নিয়ে গেলো শুভ্র রঙের একটি শাড়ী। গতকাল ফারিহা ও আফজাল হোসেন মিলে সবার অগোচরে চাঁদনী’র সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস এনে দিয়েছেন।
.
.
শাড়ীটা পড়ে চাঁদনী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মিনিট পাঁচেক সময়। না অতোটা মন্দ লাগছে না তাকে যতটা সে ভাবে। অতঃপর চোখে গাড়ো কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে লম্বা চুলগুলো উঁচু করে খোপা বেঁধে নিলো। জাস্ট এইটুতেই যেন ভীষণ মায়াবী লাগছে চাঁদনী কে। নিজেকে পরিপাটি করে ফাহাদে’র রুমটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। রুমটা অন্য অন্য রুমের থেকে বেশ বড়, তবে অনেকটা এলোমেলো। বিভিন্ন জিনিসপএ এদিক সেদিক ছিটিয়ে আছে। যা দেখে চাঁদনী আনমনে বলে উঠলো,
“লোকটা ভীষণ আগোছলোতো!”
তিনদিন ধরে এই রুমে থাকলেও সময়ের অভাবে চাঁদনীর দেখাশোনা হয়নি সবকিছু। আজ হাতে তেমন কাজ নেই। তাই আর দেরী না করে রুমটা গুছাতে লাগলো। সাথে শ্বশুরে কিনে দেওয়া নিজের কাপড় গুলো গুছিয়ে আলমারি’র এক সাইডে রাখলো। আলমারি খুলতেই ফাহাদে’র এলোমেলো কিছু জামা-কাপড় নিচে পড়ে গেলো। চাঁদনী সেগুলো পরম যত্ন করে গুছিয়ে অন্যপাশে রেখে দিলো। হঠাৎ জামাকাপড়ের মধ্যদিয়ে বেরিয়ে আসলো একটি নীল রঙের ডায়েরি। দেখেই মনে হচ্ছে এটা কারো পার্সোনাল ডায়েরি। কারো অনুমতি ছাড়া তার ব্যক্তিগত জিনিস দেখা ঠিক নয়। তাই চাঁদনী আবার রেখে দিলো সে ভাবে। তবুও চাঁদনী’র মনটা ভীষণ উসখুস করছে। এটা কার ডায়েরি? নিশ্চয়ই ফাহাদে’র হবে। তবে কি আছে এতে?জানা’র জন্য মনটা উথাল-পাতাল করছে। সাতপাঁচ ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো, একটি বার সে দেখবেই এটা। মানুষটা তো আর এখানে নেই, দেখে আবার রেখে দিবে তাতে কি এমন হবে? তারপর বসা থেকে উঠে দ্রুত ডায়রিটা যেই না বের করতে যাবে, অমনি বসার ঘর থেকে শ্বশুরে’র কণ্ঠ কর্ণকুহরে ঠেকলো,
“বউ মা? এদিকে একটু এসোতো মা?”
ডাক শুনেই চাঁদনী শাড়ীর আঁচল মাথায় চেপে ব্যস্ত পায়ে রুম থেকে বেরুলো। এই মানুষটার ডাক এক মুহূর্তে’র জন্য উপেক্ষা করার সাধ্য তার নেই। বাবার থেকে বেশি অবদান রাখছে মানুষটা। এই কয়দিনের মধ্যে বাবা’র আসনে অনেকটা জায়গা জুড়ে নিয়েছে লোকটা। চাঁদনী ধীরপায়ে বাবা’র নিকট দাঁড়িয়ে নম্র কণ্ঠে বললো,
“বাবা,ডেকেছেন?”
আফজাল হোসেন মৃদু হেসে বললো,
হ্যাঁ মা। সারাদিন ব্যস্ত থাকি দোকান নিয়ে, তোমার সাথে দু’দ্ব’ন্ড কথা বলার সুযোগ পেলাম না। বসো এখানে। ইশারায় একটা চেয়ার দেখিয়ে বললো।”
চাঁদনী নতজানু হয়ে শান্ত হয়ে বসলো, আফজাল হোসেন পুনরায় আবার বললো,
“তারপর বলো? কেমন আছো তুমি মা? এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো তোমার?”
“না বাবা সমস্যা হচ্ছে না। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আমি।”
আরো কিছু ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে আফজাল হোসেন হঠাৎ বললো ,
“যার জন্য ডেকে ছিলাম, তোমার লেখাপড়ার কি খবর মা? জীবনে আর যাইহোক পড়া লেখাটা করতেই হবে। আমাকে ক্লিয়ার করে বলোতো? আমি এখানেই সব ব্যবস্হা করে দিবো।”
মুহূর্তেই চাঁদনী মাথা নিচু করে ফেললো, কি বলবে সে? সে তো লেখাপড়া বাদ দিয়ে দিয়েছে প্রায় একবছর। তার তো খুব ইচ্ছে ছিলো পড়ালেখা করার। কিন্তু ভাগ্যে আর জুটলো কই? মেধাবী ছাএী হয়েও সে পারেনি পড়ালেখা করতে। বাবার ঘরে বসে সমস্ত কাজ বাজ করে বাড়ির পাশের স্কুলে মাঝে মাঝে যাওয়া হতো। সেখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় দিয়েছে সে। কোনো প্রাইভেট, কোচিং তো দূরের কথা। মনযোগ দিয়ে একটুখানিক পড়ার সময় হতো না। সৎ মা চায়নি চাঁদনী পড়ুক। তবুও নিজ চেষ্টায় মোটামুটি ভালো ফলাফল পেয়েছে এসএসসিতে। তারপরে খুব করে ইচ্ছে ছিলো কলেজে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু মা চায়নি চাঁদনী পড়ুক আরো, এনিয়ে নিত্য সংসারে অশান্তি হতো। বাবার এবিষয়ে ছিলো অনিহা, সংসারে অভাব অনটন। সবমিলিয়ে একটা সময় এসে চাঁদনীই নিজ থেকেই পড়ালেখা করে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা মাটি চা’পা দিয়ে দিয়েছে। শেষ সময় এসে, শুধু তো এইটুকুই চেয়েছে মেয়েটা,” ঝামেলা বিহীন একটু শান্তিতে বাঁচতে!” কিন্তু শান্তি যেন তার জন্য নি’ষি’দ্ধ!
চাঁদনী’কে চুপচাপ থাকতে দেখে আফজাল হোসেন শান্ত কণ্ঠে আবারো বললো,
“কি হলো মা? চুপ করে আছো কেনো?”
“আসলে বাবা আমি পড়ি না এখন। এসএসসির পরে আর পড়াশোনা করা হয়নি।”
তারপরে মলিন কন্ঠে সবটা খুলে বললো চাঁদনী। সবটা শুনে হতাশ হলো আফজাল হোসেন। সময়টা এমন বছরের মাঝামাঝি অবস্থায়, এখন নতুন করে কলেজে ভর্তি করার করার ও সুযোগ নেই। তবুও আফজাল হোসেন আশ্বাস দিয়ে বললো,
“চিন্তা করো না মা। শিক্ষার কোনো বয়স নেই শুধু আগ্রহ থাকতে হবে। দুই এক বছর পিছিয়ে যাওয়াটা কোনো ব্যাপার না। তুমি অবশ্যই তোমার ইচ্ছে মতো পড়াশোনা করবে, যতদূর ইচ্ছে। তোমার এই বাবা সবসময় তোমার সঙ্গে আছে মা। আমি মনে করি তুমি আমার আরেকটা মেয়ে। আগামী ভর্তির সময় হলেই আমি তোমায় ভালো একটা কলেজ ভর্তি করিয়ে দিবো। এখন আর করার কিছু নেই! তবে, লেখাপড়াটা কন্টিনিউ রাখতে হবে এখন থেকে। আমি তোমাকে আগামীকাল কিছু বই এনে দিবোনে। আর শোনো মা, তোমার যখন যেটা লাগবে বা খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবে। সিক্রেট কিছু হলে ফারিহাকে বলবে। খবরদার! লজ্জা পেয়ে নিজেকে কষ্ট দিও না। এখন যাও। রুমে গিয়ে রেস্ট নেও।”
একদমে কথাগুলো বলে থামলো আফজাল হোসেন। সবার কাছে অব’জ্ঞা, অবহেলিত হওয়া মেয়েটা শ্বশুরে’র এহেন কথা শুনে আনন্দে ভিতরটা যেন শীতল হয়ে গেলো। সে আনন্দে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো সামনে বসে থাকা লোকটির দিকে। বাবারো বুঝি এমনই হয়, তবে তার বাবার মধ্যে এতো ব্যতিক্রম কেনো?কেনো এতো তফাত। তবুও মনে প্রাণে চায় বাবা নামক মানুষটা ভালো থাকুক আজীবন। হাজার বছর বেঁচে থাকুক!
.
.
রুমে এসে ধুকপুকানি বুক নিয়ে সাহস করে ডায়েরিটা খুললো চাঁদনী। হ্যাঁ সে যেটা অনুমান করে ছিলো তাই হলো। ডায়রিটা ফাহাদে’রই কেননা ডায়েরিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা -” ফাহাদ’স ডায়রি”।
যা দেখে আগ্রহ বাড়লো কিশোরী মেয়েটার মনে। না চাইতেও যেন লোকটাকে নিয়ে খুব ভাবে সে। সময় নষ্ট না করে কয়েকটি পাতা উল্টোলো চাঁদনী। কিন্তু হতাশ হলো, একি সাদা পৃষ্ঠা, কিছুই লেখা নেই। আরো কয়েকটি পাতা উল্টানোর পড়েই একটি রঙিন ছবি দেখতে পেলো চাঁদনী। ছবিটা দেখে যেন বুকের ভিতরের হার্ট বিট দ্রুত উঠা নামা করছে কিশোরী মেয়েটার……।
#চলবে……..
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ! ]