#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি🦋
#writerঃsumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ৫
ফাহাদ দোলনায় হেলান দিয়ে এখনো ভীষণ মনযোগ দিয়ে আকাশে’র পানে তাকিয়ে আছে। ব্যর্থ মানুষগুলোর যেন খোলা আকাশ’টা ভীষণ প্রিয় হয়। এরিমধ্যে হঠাৎ ছাদে উপস্থিত হলো শুভ্র। ঘুম থেকে জেগে ফাহাদ’কে না পেয়েই মূলত এখানে আসা তার। ছাদের কিনারায় ফাহাদ কে দেখে নিঃশব্দে ফাহাদে’র কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলো শুভ্র। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পিছনে ঘুরে প্রিয় বন্ধু’কে দেখে ফাহাদ হাসলো মৃদু। তারপর নিজে দোলনার এক পাশে চেপে শুভ্র’কে জায়গা করে দিয়ে বললো,
“বস এখানে।”
শুভ্র ফাহাদে’র পাশে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে প্রশ্ন করলো,
“এখানে কখন আসলি?”
“এইতো কিছুক্ষণ হলো।”
দু’জন টুকটাক কথা শেষ করে আবারো খানিক সময় চুপ করেই রইলো দু’জন । রাতের ঘটনার পরে শুভ্র’র মনটা ছটফট করছে বড্ড। যতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনা না শুনতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি নেই তার। ছোটবেলা থেকে দু’জন দু’জনার ভীষণ কাছে’র বন্ধু তারা। একসাথেই শৈশব, কৈশোর বেড়ে ওঠা, গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা। তারপর চাকুরী’র জন্য দীর্ঘ দুই বছর থেকে এক সাথে, একই বেডে থাকা হচ্ছে তাদের। বর্তমানে দু’জনই ভিন্ন দু’টো প্রাইভেট কম্পানিতে কাজ করছে তারা।
দিনশেষে কেমন যেন এক অদ্ভুত মায়া তাদের আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। বিষয়’টা এমন একজনে’র গায়ে ব্যথা পেলে যেন অন্যজন সেই ব্যথায় বেশি আ’ঘা’ত পায়। তারই সেই প্রিয় বন্ধুটাই দিনশেষে বেশী কষ্ট পায় ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো শুভ্র’র। মিনিট খানিক সময় কিছু একটা ভেবে শুভ্র পুনরায় ফাহাদে’র কাঁধে হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
“দোস্ত!”
“হুম। বল?”
“কি হয়েছে তোর?”
“ছেলে মেয়ে কোনোটাই হয়নি এখন অবধি।”
ঠাট্টার সুরে বললো ফাহাদ। সিরিয়াস মুহুর্তে একমাত্র বন্ধু জাতিই পারে “সিরিয়াস মুহুর্তে’কে” র”ফা’দ’ফা বানিয়ে দিতে। মানুষ বাহির থেকে যতই তাকে গম্ভীর অথবা ব’খা’টে, বদমেজাজি বলুক না কেনো একমাত্র শুভ্র’র নিকট ভিন্ন এক ফাহাদ সে। এই মানুষটা’র নিকট মন খুলে, প্রাণ খুলে, যা ইচ্ছে তাই অনায়াসে বলে দিতে পারে। কোনোকিছু ভেবে চিন্তে বলতে হয় না। মুহুর্তেই শুভ্র খানিকটা রেগে গিয়ে ফাহাদে’র পিঠে ধু’প করে এক থা”প্প”ড় দিয়ে বললো,
” মজা করিস না ফাহাদ। আমি কিন্তু সিরিয়াস। যা জিজ্ঞেস করছি দ্রুত সেটা বল।”
ফাহাদ খানিক মুহুর্ত চুপ থেকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে উঠলো,
“বিয়ে করেছি আমি।”
ফাহাদে’র স্বাভাবিক জবাব যেন ভীষণ রকম অস্বাভাবিক ঠেকলো শুভ্র’র নিকট। শুভ্র লাফ দিয়ে উঠে বিস্মিত চোখে চেয়ে, চেঁচিয়ে বললো,
“কিহ্? তুই সত্যি বলছিস?”
“তোর কাছে কখন মিথ্যে বলেছি আমি?”
হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ফাহাদ। হকচকিয়ে উঠলো শুভ্র ছেলেটা। সত্যিই তো ফাহাদ তাকে কখনো মিথ্যে বলে না। তবুও এই বিষয়’টা বড্ড অবিশ্বাস্য ঠেকলো শুভ্র’র নিকট। মুহূর্তেই শুভ্র নিজে’কে সামলিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে আবার বললো,
” কিন্তু, কখন? কিভাবে সম্ভব? আর আমাকে তো একটু বললিও না তুই?
কণ্ঠে তাহার অবিশ্বাস্যে’র ছাপ, আবার কৌতুহল! শোনার জন্য এক আকাশ সমান কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে অপর মানুষটা’র মুখের দিকে। ফাহাদ লম্বা কয়েকটি শ্বাস ছাড়লো। অতঃপর তার সাথে হওয়া ঘটনাগুলো বিস্তারিত বললো। সবটা শুনে শুভ্র মনেমনে ভীষণ খুশী হয়েছে। ফাহাদে’র কাছে গিয়ে আরো একটু পাশ ঘেঁসে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“ফাহাদ নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা উওম পরিকল্পনাকারী! যা তার বান্দা’র জন্য অকল্যণময় তা আমরা যতই যত্ন করে রাখি না কেন, সৃষ্টিকর্তা যেভাবেই হোক না কেন তা আমাদের থেকে উনি কেঁড়ে নিবেই। তার উপর পূর্ণ আস্হা রেখে ধৈর্য ধারণ করলে, উপরওয়ালা যা কেঁড়ে নেয় তার থেকে দ্বিগুন ফিরিয়ে দেয়!”
একটু থামলো শুভ্র। ফাহাদ নিরুও্যর। তারপর আবারও পুনরায় শুভ্র বললো,
“দোস্ত আমি তোর বন্ধু হিসেবে তোর সব সিচুয়েশন আমি বুঝি, তোর এখনকার মনের অবস্থা আমি ফিল করতে পারি। যতটুকু শুনলাম, এখানে মেয়েটার কোন দোষ নেই। সবাই পরিস্থিতির স্বীকার। তবে আমি বলবো, বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেনো, তুই মানিস আর না মানিস, বর্তমানে সে তোর অধিকার! তোর স্ত্রী। সেই হিসেবে তার ভালোমন্দ যাবতীয় কিছু দেখাশোনার দায়িত্ব কিন্তু তোর।”
শুভ্র’র কথা শুনে ফাহাদ রেগে গিয়ে বললো,
“কিসের দেখাশোনা? কিসের দায়িত্বের কথা বলছিস শুভ্র? যেখানে আমি এই বিয়েটাই মানছি না।”
“কেনো মানবি না ফাহাদ? সবাই সব মেয়েতো আর তোর ইশা মনি’র মতো!”
“শুভ্র……!”
চিৎকার দিয়ে বললো ফাহাদ। শুভ্র জানে ফাহাদ কে রাগীয়ে দিলে হীতে বিপরীত হবে। দেখা যাবে একরোখা জে’দী ছেলেটা এই বাসা থেকেও চলে যাবে। সে তার এতোদিনের বন্ধুত্ব’কে হারাতে চায় না। তারথেকে পরে ঠান্ডা মাথায় এগুলো নিয়ে বুঝাবে সে। শুভ্র গোপনে হতাশার তপ্ত শ্বাস ছেড়ে কানে হাত দিয়ে বললো,
“আচ্ছা বাবা স্যরি! রেগে যাচ্ছিস কেনো? চল নিচে যাই, নাস্তা করবো।”
“রাখ তোর সরি! সবাই তোরা তোদের নিজেদে’র মতো করে সস্তা স্বান্তনা’র বাণী ছুঁড়ে দিচ্ছিস। আরে ভাই মনের উপরে কি আর কারো আধিপত্য চলে? আমার বুকে কি ঝ’ড় বইছে সেটা একমাত্র আমি জানি। তোরা কেউ বুঝিবি না! কেউ না!”
“আচ্ছা দোস্ত মাফ কর! ভাবিস নাতো এতো কিছু। আরে আমি সবসময় তোর পাশে আছি। চল এবার নিচে যাই। আমার অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
কথা বলেই শুভ্র ফাহাদে’র হাত ধরে টেনে একপ্রকার নিচে নিয়ে গেলো।
_______________________
প্রায় ঘন্টা খানিক যাবৎ ধরে, বিষাদে গাড়ো হওয়া মনটা নিয়ে একা একা রান্না ঘরের সমস্ত কাজ শেষ করলো চাঁদনী। এরমধ্যে বাড়ির কাউকে আর রান্না ঘরে’র আশেপাশে দেখা যায়নি। দাদী কিছুক্ষণ তার সাথে বসে, সে-ও নিজের রুমে চলে গিয়েছে। বাবার বাড়ি থেকে কাজ করার পূর্ণ অভিজ্ঞতা আছে চাঁদনী’র। তবুও আজ অন্য মনস্ক হয়ে কাজ করার ফলে বেখেয়ালি’তে রুটির জন্য আলু ভাজি খানিকটা পুড়িয়ে ফেলছে। এজন্যও ভীষণ ভয় হচ্ছে তার। না জানি এনিয়েও শ্বাশুড়ি তাকে মন্দ কথা শুনায়। মানুষের তিক্ত কথা শুনতে যে তার বড্ড খারাপ লাগে, কথা নামক তী’রে’র আঘাত ভীষণ রকমের ভয় করে মেয়েটা। তবুও এগুলোই যেন সৃষ্টিকর্তা তাকে বেশী শুনায়।
এই বাসায় নতুন সে, যার ফলে কোন জিনিস কোথায় রাখা তাও অজানা তার। না হয় পুনরায় আবার ভাজি করে ফেলতো সে, এখন তারও উপায় নেই। ধুকপুকানি মন নিয়ে ভয়ে ভয়ে একে একে সব নাস্তা ডাইনিং টেবিলে রাখলো চাঁদনী। অনেকক্ষণ সময় কাজ করার ফলে পেটে ভীষণ ক্ষুধাও লেগেছে। তবুও সবার সাথে খাবে বলে খেলো না কিচ্ছুটি মেয়েটা। কাজ শেষে হাতটা ধুয়ে রান্না ঘর থেকে মাএ বেড়ালো চাঁদনী। এরিমধ্যে দেখলো মিম রেডি হয়ে এসে চেয়ারে বসে আম্মু, আম্মু বলে ডাকছে। চাঁদনী’র কিছুটা জড়তা কাজ করছে মিমের সাথে কথা বলতে। সম্পর্কে চাঁদনী বড় হলেও বয়সে ফারিহা ও মিমের ছোট্ট হবে সে। এদের নাম ধরে ডাকতেও বিবেকে বাঁধে খুব। তবে কি ডাকবে এদের? আপু! নিজে নিজে মনে মনে প্রশ্ন ও উওর সাজিয়ে সাহস করে, নম্র কণ্ঠে চাঁদনী বললো,
“কিছু লাগবে ছোট আপা? আমাকে বলুন আমি দিচ্ছি।”
মিম মুহুর্তেই নাক মুখ কুঁচকে ক’র্ক’শ কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এই মেয়ে আমার থেকে দূরে থাকো তুমি। তোমাকে কিছু দিতে বলছি আমি? যতসব! ”
“ভদ্র ভাবে কথা বলুন আপা! কিসের এতো অহংকার আপনার? সাদা চামড়ার! হাহা! দেহের সৌন্দর্যে’র থেকে কথার সৌন্দর্য অধিক জরুরি। আর আপনার সেটাই নাই মনে হচ্ছে। একটা কথা মনে রাখা উচিত, ছোট-বড় সে যেই হোক না কেনো, সম্মান দিলে সম্মান পাওয়া যায়। আজ আপনি কাউকে অপমান করলেন, তার সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেলে সেও একটা সময় পাল্টা জবাব দিবে। তা সহ্য করার ক্ষমতা কতটুকু আছে আপনার?”
” তুমি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছো? আমাকে জ্ঞান দিবার কে তুমি? যাও আমার চোখের সামনে থেকে। আম্মু…? কই তুমি? এই মেয়ে এখানে কেনো?”
চাঁদনী বিনাবাক্যে এখান থেকে চলে গেলো। কেননা এসব অহংকারী মানুষের সাথে তর্ক করতে নেই, এরা নিজেকেই বড় কিছু একটা ভাবে। তার থেকে এদের এড়িয়ে চলা ভালো বলে মনে হচ্ছে চাঁদনী’র। এরিমধ্যে ফাতেমা খানম ডাইনিং রুমে আসলো, মেয়ে’কে নাস্তা বেড়ে নিজেও ডিম রুটি খাওয়া শুরু করলো।
হঠাৎ ঠাসস করে নিজের নাস্তা’র প্লেট ধাক্কা মেরে ফেলো দিলো মিম। নাক ছিটকিয়ে বলে উঠলো,
“ওয়াক! এমন পোড়া ভাজে নাস্তা কে বানিয়েছে আম্মু? এগুলো কি খাওয়া যায়? কলেজে এখন না খেয়ে যেতে হবে আমার? এ বাড়ি আর শান্তিতে থাকা-খাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছে। কোথাও আর শান্তি নেই সবাই ইচ্ছে মতো কাজ করছে।”
বলেই না খেয়ে গটগট পায়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো মিম। নিজের মেয়েটা না খেয়ে যাচ্ছে এটা মায়ের খুব লেগেছে গায়ে। উনি উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
“না খেয়ে যাসনে মিম। ডিম ভাজি করে দেই আমি খেয়ে যা মা।”
মিম শুনলো না, ইতোমধ্যে কয়েকবার কেউ অবিরত কল দিয়ে যাচ্ছে তাকে। হাতে একদম সময় নেই। চাঁদনী’র উপরে ভীষণ ক্ষু’ব্ধ হলো ফাতেমা খানম।
“হারামজাদী ইচ্ছে করে এমন পুড়িয়ে ফেলছে সবকিছু। ওর জন্য আমার মেয়েটা সকাল সকাল খেতে পারলো না। আহারে, সারাদিন না জানি না খেয়ে থাকে মেয়েটা। শুধু বসে বসে গিলতে আসছে এই বাসায়, কোনো কাজ শিখে আসে নাই। ছোটলোকের বাচ্চা!”
আরো কিছু গালি দিতে গিয়েও স্বামী’কে বাসায় আসতে দেখা চুপ হয়ে গেলেন ফাতেমা খানম। তারপর নিজের খাবার ফেলে দিয়ে রুমে চলে গেলো। এতক্ষণে একে একে নাস্তার টেবিলে উপস্থিত হলেন সবাই। শুধু আসেনি চাঁদনী, আফজাল হোসেন চেয়ারে বসে ডাকলো চাঁদনী’কে। শ্বশুরের ডাক শুনে চোখ দু’টো মুছে ধীর পায়ে আসলো। আফজাল হোসেন মুচকি হেসে বললো,
“বসো মা। একসাথে নাস্তা করি।”
সবাই বসে পড়েছে খাবার সার্ভ করার জন্য কেউ নেই। একটু আগে শ্বাশুড়ি’র কথা কান এড়ায়নি তার। এসব শুনে খাবারে’র ইচ্ছেটা একদম ম’রে গিয়েছে তার। গিলতে পারবে না এই খাবার সে। চাঁদনী বাহানা দিয়ে সবাই’কে খাবার বেড়ে দিলো। সবাই খেয়ে যে যার কাজে গেলো, নিজের আর খাওয়া হলো না। সবকিছু গুছিয়ে বিষন্ন মন নিয়ে রুমে আসলো মেয়ে’টা। কিয়াৎক্ষণ পরে দাদী রুমে নাস্তা নিয়ে এসে চাঁদনী’র সামনে রাখলো। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“খাবারে’র উপরে রাগ করতে নাই মাইয়া। খাইয়া লও। পারে’র জন্য ক্যান নিজের শরীলডারে কষ্ট দিবা কও?”
বলেই পরম যত্নে একটুকরো রুটি ছিঁড়ে চাঁদনী’র মুখের সামনে ধরলো। চাঁদনী এই বৃদ্ধা মানুষটিকে না করতে পারলো না। কিচ্ছুটি না বলে চুপটি করে দুই চোখের জল নিয়ে মুখে নিলো খাবারটুকু। পেটের ক্ষুধার কাছে বোধ হয় দুনিয়ার সমস্ত কটু কথা হার মেনে যায়। তাইতো মানুষ পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে একথালা ভাত আর এক থালা খোঁটা হজম করে নেয়!
চলবে……
[কার্টসী ছাড়া কপি করা নিষেধ! ]