তুমি রঙিন প্রজাপতি পর্ব-০৪

0
887

#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি🦋

#writerঃsumaiya_afrin_oishi

#পর্বঃ৪

পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চারপাশ। রজনী’র নিকাষ কালো আঁধার কেটে, ধরণীর বুকে ফুটে উঠেছে ভোরের মিষ্টি সোনালী আলো। প্রকৃতির নিয়মে শুরু হলো নতুন আরো একটি মিষ্টি ভোরের সূচনা। কিন্তু, সবার জন্য এই ভোরের অমায়িক সময়টা মিষ্টি মধুর হয় না। যেমনটি চাঁদনী’র! তার জন্য এই মিষ্টি ভোরগুলো হয়তো নিষিদ্ধ করে দিয়েছে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা! এগুলো কিশোরী মেয়েটি’র কাছে নিতান্তই বি*ষা*ক্ত ঠেকায়! গতকাল রাতে হাজার চিন্তা ভাবনা করে মেয়েটা রাতে’র শেষ প্রহরে ক্লান্ত দেহটা নিজের অজান্তে শান্তির নিদ্রায় গিয়ে ডুব দিয়েছে। দেহ, মন ক্লান্ত থাকায় এই শান্তিটুকু থেকে তারা যেন বঞ্চিত হতে চাইছেই না। কতই বা সহ্য করতে পারে এইটুকু মেয়েটি। সমস্ত চিন্তা ভাবনা ফিকে নিশ্চিন্তে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে সে। হঠাৎ রান্না ঘর থেকে হাঁড়ী পাতিলে’র ঝংকার আওয়াজে ঘুম ছুটে গিয়েছে তার। হঠাৎ কানে বাজতে লাগলো শ্বাশুড়ি’র ক’র্ক’শ কণ্ঠ স্বর, সেই সাথে আরো একটি অপরিচিত কণ্ঠ কর্ণকুহরে ঠেকলো। কিন্তু কে সে? জানা নেই তার।
রান্না ঘরে’র থেকে ফাহাদে’র রুমটা পাশে থাকার কারণে ওপাশে’র টুংটাং শব্দও স্পষ্ট শোনা যায়। আর সেখানে দুই মহিলার বাজখাঁই কন্ঠ যেন ঘর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মুহুর্তেই চাঁদনী’র ঘুম ছুটে গিয়েছে, হুড়মুড় করে উঠে বসে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো দেয়ালে থাকা ঘড়িটা’র দিকে। সময় ৭ঃ ১২ মিনিট। আতঙ্কিত হয়ে উঠলো মেয়ে’টা। এতো বেলা হয়ে গিয়েছে অথচ সে ঘুমাচ্ছে? বাবা’র বাসায় থাকতেও খুব ভোরে উঠে ঘরের সমস্ত কাজ করতে হতো তাকে। বিনিময়ে মিলতো তিন বেলা তিন প্লেট ভাত আর, তিন প্লেট খাবারের খোঁটা। আর এটা তো শ্বশুর বাড়ি! সে এখানে’র নতুন বউ! কি করে এতো বেলা অবধি ঘুমালো সে? নিজের উপরই ভীষণ রাগ উঠলো তার। লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে, দ্রুত ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলো চাঁদনী। শাড়ী’র আঁচলটা মাথায় চেপে, ধুকপুকানি বুক নিয়ে রুমের বাহিরে পা বাড়ালো চাঁদনী।

“আমার হয়েছে যত জ্বা লা। মরলেও শান্তি পেতাম একটু। বা’ন্দী’র মতো একা একা গা’ধা খাটুনি খেটে সবাইকে খাওয়াতে হবে। সবাই জমিদার! সবাই বেলা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে তারা! বাসায় যে আসে সেই নবাব! সব নবাব’জা’দী’র দেখা আমার ঘরে মিলে।”

হাতে থাকা খুন্তি’টা স্বঃশব্দে রেখে ক”র্ক”শ কণ্ঠে ফাতেমা খানম বকছে আর কাজ করছে। আর তার পাশে টুলে আরাম করে বসে অপরিচিত মহিলা’টা তা “ল দিচ্ছে আর পান চিবচ্ছে। রান্না ঘরে’র কিনারায় এসে হঠাৎ শ্বাশুড়ি’র এমন কথায় আপনা আপনি পা জোড়া যেনো থেমে গেলো চাঁদনী’র।
তবে তাকে-ও কি খাবারের খোঁটা দিচ্ছে সে? মাএ কালই তো এ বাসায় এসেছে সে। তার পরদিনই শ্বাশুড়ি’র এমন কথা শুনে কিশোরী মেয়ে’টার হৃদয়টা বড্ড ব্যথা পেলো। পরক্ষণেই নিজের মনটাকে বুঝ দিলো এটা ভেবে, “আমারই ভুল! নতুন বউ হয়ে এতো বেলা অব্দি ঘুমানো ঠিক হয়নি।”
অতঃপর ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে রান্না ঘরে’র ভিতরে প্রবেশ করে মৃদু কণ্ঠে চাঁদনী বললো উঠলো,

“আম্মা আমি সাহায্য করি আপনাকে? ”

ফাতেমা খানম ভ্রু কুঁচকে পিছনে তাকিয়ে চাঁদনী’কে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। হয়তো বা দু’য়েকটা তিক্ত কথা বলতে যাবে কিন্তু তার বলার আগেই অপরিচিত প্রতিবেশী মহিলা বলে উঠলো,

“নতুন বউ হইয়া এতো বেলা অবধি ঘুমাও কেমনে বউ? বাপ-মায় কোনো কিছু শিক্ষা দিয়া পাঠায় নাই? আমার পোলার বউডা মাশাআল্লাহ! দেখতেও যেমন কাজ-কা’মও তেমন। হেয়তো ফজরের আযানে’র লগে লগে উইঠা সব কাম সাইরা ফেলে…।”

” আপনি কে জানি না আমি। বাবা-মা’কে টানছেন কেনো? আসলে রাতে দেরী করে ঘুমিয়েছি তো তাই একটু দেরী হয়ে গিয়েছে। আম্মা আমারে একবার ডাকলেই হতো।”

মহিলা’র কথা শেষ হবার আগেই নম্র কণ্ঠে বলে উঠলো চাঁদনী। মহিলা বিস্মি চোখে তাকালো চাঁদনী’র মুখের দিকে। নতুন বউ বড়দের মুখে মুখে কথা বলে? উনি ছিঃ! ছিঃ! করে উঠলো।
কতটা অভদ্র এই মেয়ে ভাবা যায়! নিশ্চয়ই এর পারিবারিক সঠিক শিক্ষা’র অভাব রয়েছে। ভীষণ অভাব! এটা যেন গোড় অন্যায় হয়ে গিয়েছে চাঁদনী’র। তার ভাষ্যমতে, বউয়েরা থাকবে মুখে কুলুপ এঁটে। এদের হাজার গা’ল, মন্দ কথা বললেও এরা মুখ বুঝে সহ্য করবে। কারণ এরা বউ! হাজার অপমান সহ্য করার ক্ষমতা এদের থাকতেই হবে। নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই এর মা কিছু শিখাইনি এই মেয়ে’কে। এটা তো ভীষণ রকমের দৃষ্টিকটু লেগেছে মহিলার কাছে। অপমানে গা শিউরে উঠলো তার,
উনি চোখ মুখ কুঁচকে বলেই ফেললো,

“এই মাইয়া আমার মুখে মুখে কতা কও? গায়ের রং ও কালা কতাডাও কালা! মায় তো কিছু শিখায় নাই তোমারে। অসভ্য মাইয়ে মানুষ! ফাহাদে’র মা? এ কেমন মাইয়া তোমার পোলার বউ’র? হায়! হায়! পোলাডার কপাল পু’ড়’লো বুঝি!

পরক্ষণেই ফাতেমা খানম মুচকি হাসলো।যেন মহিলার অপমান তার বেশ পছন্দ হয়েছে। উনি তাচ্ছিল্য করে উঠলো,

“কারে কি যে বলেন ভাবী! এর মা থাকলে না শিখাইবে কিছু। মা তো এক বে শ্যা! মেয়ে রেখেই অন্য বেডার সঙ্গে পালাইছে। বাপে জোড় করে আমার ছেলেটার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। মধ্যে খান দিয়ে আমার ছেলেটার কপাল পু’ড়’লো।”

এমন কথা শুনে মহিলা যেন পেয়ে বসেছে। যাকে ঘরের মানুষই মূল্যয়াণ করে না তাকে গোটা দুনিয়াটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সুযোগ পায়। কেননা তার বুঝেই যায় তার বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। সেখানে বউয়ের আপন শ্বাশুড়ি’র মুখে এমন কথা শুনে মহিলা’কে আর পায় কে। উনি ইচ্ছে মতো অপমান অ’প’দ’স্ত করেই যাচ্ছে চাঁদনী’কে আর নিজের বউয়ের গুনগান গাইছে। মায়ের কথা শুনে মুহূর্তেই চাঁদনী যেন ভিতর থেকে থমকে গিয়েছে, নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে সমস্ত প্রতিবাদ বাক্য। শব্দে’র ঝুলিটা যেন শূন্যে’র কোঠায়। কেননা এই জায়গাটাই তার একমাত্র দুর্বলতা। চাঁদনী অবাক নয়নে নিজ শ্বাশুড়ি’কে দেখছেন। শ্বাশুড়িরা নাকি হয় মায়ের মতো মমতাময়ী! এ কেমন শ্বাশুড়ি জুটলো তার কপালে? লজ্জায় ঘৃণায় উঁচু মাথা নিচু করে ফেললো মেয়ে’টা। নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে অশ্রুকণা গুলো গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। এতটা মন্দ ভাগ্য কারো হয় বুঝি?

এদের উচ্চ স্বরে’র কথা বার্তা শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো দাদী। উনি নামাজ পড়ে এতক্ষণ দোয়া দুরুদ পড়ছিলো। এসে এসব শুনতে পেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ মহিলার উদ্দেশ্য কাঠকাঠ গলায় বলে উঠলো,

“হ বউ তুমি আর তোমার পোলার বউ তো ফেরেশতা! এজন্যই তো একমাত্র পোলা-পোলার
বউর লগে এক বেলা খাইবার পারো না। একলা একলা রাইন্ধা খাওন লাগে। নিজের গুনগান আর কত গাইবা কও তো? আমরা তো জানিই কারা কেমন? আমাগো ঘরে’র মাইয়া-বউ কেমন হেইডা আমরা বুঝবো। তুমি তোমার চিন্তা করো। আমার ঘরে আইসা আমার নাতবউয়রে মন্দ কথা কইবার অধিকার কেডা দেছে তোমারে?”

মহিলার মুখটা চুপসে গেলো মুহুর্তেই। বরাবরের মতোই এই বুড়ি’র তীক্ষ্ণ কথা ভয় পায় সে। উনি কথা না বাড়িয়ে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। আসিয়া বেগম নিজের পুরবধূ’কে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“বউ? খবরদার আর অশান্তি বাড়াইয়ো না! তোমারও কিন্তু মাইয়া আছে। যেমন কর্ম করবা ফল তেমন পাইবা! নিজের ঘরের কতা নিজের মধ্যে রাখতে হয়। কেননা নিজের কতা অন্যেরে কইয়া মানষের কাছে ছোট কিন্তু তুমিই হও। নিজের বংশের কতা বোধহয় ভুইলা গেছো তুমি? অতীত ভুইলা যাইতে নাই! তোমার বোইন ও কিন্তু দুইডা বড়বড় পোলা- মাইয়া রাইখা পলাইয়া গে……”

শেষ করতে পারলো না মুখের বাক্য আসিয়া বেগম। নিজের গায়ে আঘাত পেয়ে ফুঁসে উঠলো ফাতেমা খানম। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” আমার চিন্তা আপনার করা লাগবে না বুঝছেন। বসে বসে খায় আর তেজ কত এর!
এই অ”ল”ক্ষ্মী মেয়েটা পেয়ে খুব জোড় বাড়ছে আপনার তাই না! আগে একটা আপত ছিলো এখন আরো একটা সঙ্গে জুটছে। যতসব! ”

থামলো ফাতেমা খানম, রাগে ফুঁসছে তার শরীর। আরো কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলেন স্বামীর ভয়ে। আফজাল হোসেন বাহিরে গিয়েছে দরকারী কাজে, যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। ক্ষীণ কন্ঠে’র কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেলো না আসিয়া বেগম। শুনলে বোধহয় উনিও কড়া কয়টা কথা শুনিয়ে দিতেন। চাঁদনী আগের অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, ফাতেমা খানম চাঁদনী’কে ধমক দিয়ে বলে উঠলো,

“ওখানে সঙ সেজে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি রান্না সেরে ফেলো। আমার ঘরে থাকতে হলে কাজ করে খেতে হবে। এতো জমিদারগিরি চলবে না এখানে।”

কথা শেষ করে ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমে গিয়ে সুয়ে পড়লো ফাতেমা খানম। আসিয়া বেগম হতাশার তপ্ত শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলো চাঁদনী’র নিকট। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম কণ্ঠে বললো,

“নিজের চোখের পানির মেলা মূল্য বোইন। যারতার জন্য এগুলো নষ্ট কইরো না। মুখ বুইঝা থাকলে চলবো কও? একবার তোমারে যারা মন্দ কতা কইবে, তুমি হেগো সুযোগ দিবা দেখবা এরা আবার আইসা তোমারে অপমান করার সুযোগ খুঁজবে। এই দুনিয়ায় মানুষগুলো এমনই! এদের তুমি ভদ্রতা দেখাইবা হেরা তোমারে দুর্বল মনে করবো। মনে রাখবা, সবাই সম্মান পাওনের যোগ্য না!”যোগ্য পাএ রাইখা যদি জল তুমি অপাএে ঢালো তয় ক্ষতি কিন্তু তোমারই হইবো বোইন!”
.
.
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছে ফাহাদে’র। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে কোনো মতে ফ্রেশ হয়ে ছাদের দোলনায় এসে বসেছে ফাহাদ। মাথারা কেমন ভার হয়ে ঝিমঝিম করছে তার। তবুও একনাগাড়ে একটার পর একটা সিগারেট টানছে সে। যেন নিজের সমস্ত কষ্ট গুলো উড়িয়ে দিচ্ছে নিকোটিনের ধোঁয়ায়। শেষ সিগারেটেটায় লম্বা কয়েক টান দিয়ে ছুঁড়ে মারলো কিছুটা দূরে। যার ফলে হাতে টান অনুভব হলো,পরক্ষণেই হাতের ক্ষ’তে’র দিকে একবার তাকালো সে, রক্ত জমাট বেঁধে শুঁকিয়ে গিয়েছে। হাসলো ক্ষীণ ফাহাদ। হৃদয়ে’র আঘাতের থেকে এই আঘাত অতী তু’চ্ছ। তারপর তাকালো বিশাল ঐ আকাশটা দিকে, এক মিনিট! দুই মিনিট! এভাবে কয়েক মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেলো এখনো তাকিয়ে আছে ছেলেটা। অতঃপর লম্বা কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হঠাৎ মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলো,

“বিচিত্র এই শহরে! অনেক মানুষ জীবিত থেকেই ম’রে যায়, দেহ খাঁচাটা জীবিত মানুষের মতো দেখা গেলেও ভিতরে আ’ত্মা’টা জীবিতো থাকে না! আর সেটা ওই মানুষটা ছাড়া কেউ জানেও না!”

#চলবে..

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ! ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে