তুমি রঙিন প্রজাপতি পর্ব-০৩

0
937

#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি🦋

#writerঃsumaiya_afrin_oishi

#পর্বঃ৩

পরন্ত বিকেল! সূর্যের প্রবল তেজ কিছুটা কমে গিয়েছে। প্রকৃতি জুড়ে মৃদু মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে। সেই বাতাসে’র সাথে পাল্লা দিয়ে চাঁদনী’র বুকে ধুকপুকানি বেড়েই চলছে। উওেজ’না’য় শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার।
এরপর তার সাথে কি হতে চলছে? অজানা তার। হঠাৎ করে এক কাল্পনিক ভাবে কোথাথেকে কোথায় যাচ্ছে সে! বাবা ফিরোজে মিয়া’র মেয়ে থেকে অন্য নতুন একটা পরিচয় হয়েছে তার। নতুন পরিচয় পেয়ে নতুন পরিবেশে যাচ্ছে সে। এদের সাথেই আবার নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে।
আচ্ছা তার শ্বশুর বাড়ি’র লোকগুলো কেমন হবে? তাকে মেনে নিবে তো তারা? যদি বাসায় ডু’ক’তে না দেয় তাকে। কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে সে? এমন হাজারো প্রশ্ন এসে চাঁদনী’র ছোট্ট মস্তিষ্কে জড়ো হয়ে কিলবিল কিলবিল করছে। চাঁদনী বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলে নড়েচড়ে বসলো। না মাথা’টা ভীষণ যন্ত্রণা করেছে।
পাশের সিটে বসা থাকা আফজাল হয়তো বুঝতে পারলো মেয়ে’টার মনের অবস্থা। উনি চাঁদনী’কে আশ্বাস দিয়ে বললো,

“ভয় পেয়ো না মা! তোমার এই বাবা সবসময় আছে তোমার পাশে।”

চাঁদনী তপ্ত একটা স্বস্তি’র শ্বাস ছাড়লো। আফজাল হোসেন পুনরায় বললো,

“মা কিছু খাবে তুমি?”

“না।”

নিচু কণ্ঠে ছোট্ট করে জবাব দিলো চাঁদনী। আফজাল হোসেন শুনলো না। গাড়ি থামিয়ে মিনিট কয়েক সময়ে মধ্যে দোকান থেকে দুই’টা কোন আইসক্রিম এনে চাঁদনী’র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

“যে গরম পড়ছে! খেয়ে নেও ভালো লাগবে তোমার।”

যদিও এখন আইসক্রিম খেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না চাঁদনী”র,তবুও মুচকি হেসে নিয়ে নিলো। বিনিময়ে আফজাল হোসেন ও মৃদু হাসলো।
.
.
চাঁদনী গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। নিজ গ্রামটা ছেড়ে নীলপদ্ম (ছদ্মনাম) গ্রামে এসেছে চাঁদনী।এই গ্রামে’র নাম অনেক শুনেছে সে লোকমুখে, কিন্তু কখনো নিজ চোখে দেখা হয়নি। লোকমুখে শুনেছে এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা রয়েছে। গ্রাম হলেও শহুরে শহুরে একটা ভাব রয়েছে এখানে। এটা তাদের গ্রামের মতো অজপাড়া-গাঁ নয়। তখন খুব শখ জাগতো নিজ চোখে গ্রামটা’র বিশেষ বিশেষ জায়গা গুলো দেখার। কিন্তু পরিস্থিতি’র চাপে কখনো কারো কাছে আবদার করেনি চাঁদনী। অথচ আজ সে হয়ে গেলো নীলপদ্ম গ্রামে’র পএুবধু। পরমুহূর্তেই চাঁদনী চলন্ত গাড়ি থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চারপাশটা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার সাথে যোগ দিলো আফজাল হোসেন। সে ও এটাসেটা আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখাচ্ছে আর জায়গা গুলো সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।
.
প্রায় ঘন্টা খানিক পথ অতিক্রম করে প্রথমবারে’র মতো শ্বশুরে’র হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি’র ভিতরে পা রাখলো চাঁদনী। সাথেসাথে আফজাল হোসেন মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,

“আমার ছোট্ট বাড়িতে তোমায় স্বাগতম ‘বউ মা! উপরওয়ালা’র কাছে প্রার্থনা, এই বাড়িটা’ই যেন হয় তোমার শেষ ঠিকানা।”

চাঁদনী চমকালো! একবার আশেপাশে দৃষ্টি বুলালো। মেইন রোডে’র পাশেই টিন সেট আকাশী-নীল রং মিশ্রনে বিল্ডিং একটা ঘর। যার চারপাশটা টিনের বেড়া দিয়ে আটকানো। বাড়ির চারপাশে খালি জায়গায় ছোটছোট বিভিন্ন ফল-ফুলের গাছ রয়েছে। ঘরের সামনে’র দুই পাশে কতগুলো গোলাপ ও কাঠগোলাপ গাছ। যাতে লাল টকটকে গোলাপ , ও সাদা কাঠগোলপ ফুটে চারপাশে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। যা চাঁদনী’র কিশোরী নজর কেঁড়েছে খুব! কেননা দু’টো ফুলই তার ভীষণ পছন্দের। রাজকীয় বিলাসবহুল ঘর না থাকলেও বাড়িটা ভীষণ গোছানো সুন্দর, পরিপাটি। বাড়ি দেখে মনে হচ্ছে বাড়ির মানুষ গুলো খুবই আধুনিক।
এরিমধ্যে আফজাল হোসেন বার কয়েক কলিং বেল টিপ। মিনিট খানিকে’র মধ্যে ছোট মেয়ে মিম দরজা খুলে চোখ বড়বড় করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো বাবা ও সামনে থাকা অপরিচিত মুখটি’র পানে। না চাইতেও উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসছে তার। নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে,
” বাবা’র পাশে নববধূ রুপে মেয়েটা কে? ছিঃ! ছিঃ! বাবা বিয়ে…. না! না! একি ভাবছি আমি? আমার বাবা এমন না!”

এরিমধ্যে আফজাল হোসেন ডাকলো,

“মিম?”

বাবা’র ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

“মা….! ও আম্মুরে? ফারিপু? মাহিম? কই তোরা? জলদি এসো। দেখে যাও আব্বু এ কাকে নিয়ে আসছে?”

“আরে মেয়ে! এমন চেঁচাচ্ছিস কেনো বাচ্চাদের মতো? ও চাঁদনী! আমাদের ফাহাদে’র বউ। তোর বড় ভাবি।”

মেয়ে’কে কিঞ্চিৎ ধমক দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো আফজাল হোসেন। বাবা’র কথা শুনে আরো একদফা চমকালো মিম। তার মুখটা অটোমেটিক হা হয়ে গেলো। কিহ? তার ভাই বিয়ে করছে, আর তারা জানে না! যে ভাই বিয়ের নাম শুনলেও রেগেমেগে বাসা মাথায় তুলে সেই ভাই বিয়ে করছে? এটা তো বড্ড অবিশ্বাস্য! কিন্তু তার বাবা’তো আর মিথ্যা বলা কিংবা মজা করা’র মতো লোক নয়। কিন্তু ভাইয়া কোথায়? সে পরে দেখা যাবে।
একরাশ কৌতূহল নিয়ে চাঁদনী’র পাশে এসে দাঁড়ালো মিম। চাঁদনী এতক্ষণ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার ভীষণ নার্ভাস ফিল হচ্ছে। চাঁদনী টের পাচ্ছে তার হার্টবিট অস্বাভাবিক ভাবে উঠানামা করছে, হাত-পা মৃদু কাঁপছে। তবে কি সে ভয় পাচ্ছে? ভয় পাবার মতো মেয়েতো সে নয়। ফোঁস করে একটা শ্বাস টানলো চাঁদনী, নিজে যথেষ্ট সামলানোর প্রচেষ্টা করে মাথাটা উঁচু করে তাকালো মিমে’র পানে।
মিম উশখুশ করছে সামনে থাকা মেয়ে’টাকে দেখার জন্য কিন্তু, মেয়েটার মুখটা ঘোমটার জন্য স্পষ্ট দেখা যায় না। সাতপাঁচ না ভেবে ঘোমটা টা সরিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো মিম। এরিমধ্যে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলো ফাহাদে’র মা “ফাতেমা খানম”, বড় বোন- “ফারিহা”, ছোট ভাই “মাহিম”। অপরিচিত একটি মুখ দেখে উপস্থিত সবাই অবাক হলেও অবাক হয়নি শুধু মাহিম। কারণ বাবা তাকে আগেই সবকিছু ফোনে জানিয়েছে। সে অলরেডি চুপিচুপি ভাইয়ের রুম ফুল দিয়ে বাসর ঘর সাজিয়ে ফেলছে, ভাই-ভাবী’কে সারপ্রাইজ দিবে বলে। মাহিম এগিয়ে গিয়ে মৃদু হেসে বাবা’র উদ্দেশ্য বললো,

“আব্বু এই তাহলে আমাদের ভাবী?”

আফজাল হোসেন কিছু বলার আগেই ফাতেমা খানম চেঁচিয়ে বললো,

“মাহিম তোর ভাবি মানে? কিরে ফাহাদে’র আব্বু? কে এই মেয়ে?”

“আরে মা আমার ভাই কয়টা? উনি আমাদের ফাহাদ ভাইয়ের বউ। মাশাআল্লাহ! ভাবী’তো অনেক কিউট।”

“কিউট না ছাই! এমন খ্যা’ত কালো একটা মেয়ে আমার অতো সুন্দর ভাইয়ের বউ ভাবতেই শরীর ঘিনঘিন করছে আমার। আমার ভাইয়ের সাথে এই মেয়ে কি মানায় বাবা?”

মুখ বাঁকিয়ে বিরক্তি কণ্ঠে কথাটা বললো মিম।আফজাল হোসেন মুহূর্তেই ক্রোধিত কণ্ঠে মেয়ে’কে ধমকে উঠলো,

“মিমমমমম! মুখ সামলে কথা বল। সম্মান দিলে সম্মান পাওয়া যায়। ভুলে যাসনা, মেয়েটা যেমনই হোক না কেনো সম্পর্কে ও তোর বড় ভাবী। সে হিসেবে তোর থেকে সম্মান তার প্রাপ্য। ফের এমন কথা জানি না শুনি খবরদার!”

বাবা’র ধমক খেয়ে চুপ হয়ে ভিতরে চলে গেলো মিম। বরাবরের মতো বাবা’কে ভয় পায় সে, তাই মুখের উপরে কিছু বলতে পারলো না। তবে মনে মনে চাঁদনী’কে কয়েকটা গালি দিয়ে দিলো। মিনিট খানিক সময় সবার মাঝে নিরবতা বিরাজমান।
চাঁদনী নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই চোখ দু’টো অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে গেলো তার। মিমে’র কথাগুলো যেন কাঁ*টা*র মতো বিঁধলো তার বুকে। শ্বশুর বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই মানুষ তার কালো চামড়া’কে নিয়ে কথা শুনাচ্ছে, তাকে তু’চ্ছ’তা’চ্ছি’ল্য করছে। এই চাপা রং নিয়ে তো মানুষ কম কথা শুনাইনি তাকে। উপরওয়ালা যা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছে, তার সৃষ্টি’তো কখনো অসুন্দর নয়! তবুও মানুষ গায়ের রঙকে কেনো এতো প্রধান্য দেয়?
আচ্ছা সে কি এতোটাই কুৎসিত দেখতে? যে তাকে দেখলে শরীর ঘিনঘিন করছে তার! সৃষ্টিকর্তা এ কোথায় এসে দাঁড় করিয়েছে তাকে? ভাবতেই চোখে’র জমানো অশ্রু গুলো গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। এরিমধ্যে আফজাল হোসেন চাঁদনী’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

“কিছু মনে করো না মা! আসলে আমিই ব্যর্থ বাবা! মেয়ে’টা মানুষ করতে পারলাম না।”

চাঁদনী কিছু বলতে গিয়েও বললো না। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো ফারিহা। সবটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো তার। বুঝতে পেরে মুহুর্তেই ছুটে এসে চাঁদনী’কে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,

“বাবা তুমি সত্যি বলছো? এই মেয়ে আমাদের ভাবি। আমাদের ভাইয়া বিয়ে করেছে? আমি যে কি খুশী হয়েছি বুঝতে পারবো না তোমাকে।”

বলেই চাঁদনী’র কাপালে চুমু খেলো ফারিয়া। চাঁদনী লজ্জা পেলো যেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে যেন বাচ্চা মেয়ে হয়ে গেলো ফারিহা। তার ভাই বিয়ে করেছে এতেই সে ভীষণ ভীষণ খুশী। কিন্তু বেঁ’কে বসলো ফাতেমা খানম, এতক্ষণ বুকে হাত গুঁজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিলো এদের কথোপকথন। তার আর সহ্য হলো না এসব। তার বড় ছেলে বিয়ে করছে অথচ মা হয়ে সে জানে না। উনি বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,

“এসব কি হচ্ছে ফাহাদে’র আব্বু? কোথাকার কোন মেয়ে আমার ছেলের বউ। বললেই হলো নাকি?
মিম তো ঠিকই বলছে, এমন কালো মেয়ে’কে আমার ছেলের সাথে যায় না। লোকে কি বলবে? অবশেষে আমার হিরে’র টুকরো ছেলে’কে নিয়ে হাসাহাসি করবে লোকজন। এ মেয়ে’কে আমি ছেলের বউ হিসেবে মানি না আমি। আর না কখনো মানবো।”

শ্বাশুড়ি’র কটুবাক্য শুনে বুকটা মো’চ’ড় দিয়ে উঠলো চাঁদনী’র। না চাইতেও মাথা তুলে একবার তাকালো সামনে থাকা মহিলার মুখের দিকে। আফজাল হোসেন সবার অগোচরে নিজের স্ত্রী’র দিকে র’ক্তি’ম চোখে একবার তাকালো। স্বামীর চোখে ক্রো’ধ দেখে আর কিছু বলার সাহস পেলো না ফাতেমা খানম। মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো হিং’স্র আফজাল হোসেনকে। তার স্বামী যেমনটা ভালোর ভালো, আবার খারাপের খারাপ। সেটা তার অজানা নয়। ভিতরে ভিতরে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বিনাবাক্যে জায়গা ত্যাগ করলো ফাতেমা খানম। ফারিহা চাঁদনী’র হাত ধরে আদুরে সুরে বললো,

“মা একটু এমনই ভাবী। তুমি প্লিজ কষ্ট নিও না মনে। আসলে হঠাৎ করে তো সবকিছু। তোমায় একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে। দেখবে একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এবার আমার সাথে চলো ভিতরে।”

কথা শেষ করে চাঁদনী’র হাত ধরে ভিতরে প্রবেশ করলো ফারিহা। আফজাল হোসেন মেয়ে’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

“ফারিহা বউমা কে ফাহাদে’র রুমে নিয়ে যা। ফ্রেশ করিয়ে খাবার দে মেয়েটাকে।”

“আচ্ছা আব্বু।”

বলে ফারিহা চাঁদনী’কে নিয়ে চলে গেলো। আফজাল হোসেন তপ্ত কয়েকটি শ্বাস ছাড়লো। ভিতরে ভিতরে ছেলের জন্য আবার এই অসহায় মেয়ে’টার জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে তার। আর কিছু না ভেবে বড় বড় পা ফেলে সোজা নিজের মায়ের রুমে চলে গেলো আফজাল। ভিতরে প্রবেশ করে মায়ের পাশে বসে ডাকলো,

“আম্মা!”

বৃদ্ধা মা শুনলো না ছেলের ডাক। বয়সের কারণে শ্রাবণ শক্তি কিছুটা কমে গিয়েছে তার। তাইতো বাসায় এতো হৈচৈ রুমে বসে কিচ্ছুটি টের পায়নি সে। সে একমনে সুয়ে সুয়ে জিকির করছে। আফজাল হোসেন মায়ের কপালে হাত দিয়ে আবারো মৃদু আওয়াজ করে ডাকলো। ছেলেকে দেখে মুচকি হেসে উঠে বসতে বসতে আসিয়া বেগম বললো,

“বাপ জান আইছো তুই।”

“হ্যাঁ আম্মা। আমি একা আসি নাই। ঘরে নতুন মেহমান আসছে।”

“নতুন মেহমানডা আবার কেডায় আব্বা? ”

“আপনার নাতবৌ এসেছে আম্মা।”

“কি? এইডা তুই হাছা কইবার আছো?”

“জ্বি আম্মা।”

তারপর একে একে সব ঘটনা মায়ের নিকট খুলে বললো আফজাল হোসেন। সব শুনে ছেলের কাজে বড্ড খুশী হয়েছে মা। বৃদ্ধা বয়সে এসেও মনে মনে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো আসিয়া বেগম। সত্যিই তার ছেলেটা মানুষ করতে পেরেছে সে। ভাবতেই মুখে অমায়িক হাসি ফুটলো তার!গর্বে যেন বুকটা ফুলে-ফে’টে উঠলো। আহা এখানেইতো তার শান্তি!
.
.
এখন সময় সন্ধ্যা সাতটা বাজে দুই মিনিট। ফাহাদে’র রুমে ফুল দিয়ে সজ্জিত খাটের উপরে চাঁদনী’কে নিয়ে গোল হয়ে বসে আছে ফারিহা ও মাহিম। দুই ‘ভাই-বোন এটা-সেটা নিয়ে আলাপ করছে ভাবীর সাথে আর চাঁদনী আনমনা হয়ে শুনছে। যদিও হাজার চেয়েও এদের সাথে স্বাভাবিক হয়ে মনযোগ দিয়ে কথপোকথন শুনতে পারছে না সে। না চাইতেও বিভিন্ন ভয়-জড়তা ঝেঁকে ধরছে তাকে। ফাতেমা খানম ও মিম’কে আর দেখা চায়নি। কিছুক্ষণ আগে আফজাল হোসেন একবার এসে খোঁজ নিয়ে গেছে চাঁদনী’র। এরপরে সে চলে গিয়েছে নিজের দোকানে। নীলপদ্ম বাজারে কাপড়ে’র নিজের একটা দোকান রয়েছে তার। এটা দিয়েই সংসার সামলাতে হয় তাকে।
মিনিট দশেক পড়েই লাঠি ঠকঠক করে রুমের ভিতরে প্রবেশ করলো আসিয়া বেগম। চাঁদনী মুখে কৃত্রিম মুচকি হাসি ঝু’লি’য়ে সালাম দিলো তাকে। দাদী জবাব দিয়ে চাঁদনী’র গা ঘেঁষে বসলো। এর আগে একবার এসে নাতবউয়ের সাথে আলাপ করে গিয়েছে। মেয়েটা ভীষণ মনে ধরেছে তার। আসিয়া বেগম মাহিম’কে হাতে থাকা লাঠি দিয়ে গুঁ’তো দিয়ে বললো,

“কিরে মাহু তুই মহিলা গো মধ্যে বইসা কি করোছ? বেডি গো মতোন চিপকে না থেকে, যা এনতে। তোর না কয়দিন পর মেট্রিক পরিক্ষা। যা যা পড়তে বয় ”

নতুন ভাবী’র সামনে দাদী’র বে”ফাঁ”স আচরণে লজ্জা পেলো মাহিম। কিছু না বলে মুখ কালো করে ঝাঁকড়া চুলগুলোতে হাত চালাতে চালাতে চলে গেলো রুম থেকে। এরমধ্যে বিকট শব্দে ফারিহার মুঠোফোনটা কেঁপে উঠলো। তার হাসবেন্ড আয়ান কল দিয়েছে। হাসবেন্ড আয়ান একজন প্রবাসী। তারও পারিবারিক ভাবেই ভালোবাসা’র মানুষটি’র সাথে ফোনে’র মাধ্যমে নতুন বিয়ে হয়েছে মাস ছ’য়েক হয়েছে। ফারিহা মুচকি হেসে ভাবী’কে বলে পা বাড়ালো নিজের রুমে।
রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান। বদ্ধ রুমে এখন চাঁদনী ও আসিয়া বেগম। দাদী সরু চোখে একবার তাকালো চাঁদনী’র মুখের দিকে। মেয়ে’টার মুখটা মলিন, চোখ দু’টো ফুলে গিয়েছে, তবুও যেন চেহারায় অদ্ভুত একটা মায়া উপচে উপচে পড়ছে। মিনিট খানিক সময় অতিবাহিত করে দাদী চাঁদনী’র হাত দুটো নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে নরম সুরে বললো,

“কষ্ট অইতাছে তোমার বইন! মন ভার কইরো না। ভাগ্যে যার যা আছে তা হইবোই।আমার বড় নাতনীডা কিন্তু মেলা ভালো। হেরে একবার এক মাইয়া ভীষণ ভালোপাইয়া আবার ধোঁ’কা দেছে। এজন্য হে কাউরে বিশ্বাস করবার চায় না। তয় সব মানুষ তো এক না। তুমি ওরে ছাইড়া যাইও না বইন। থাইকা যাও! ওরে বুঝাইয়া দেও, সবাই ছাইড়া যায় না! দেখবা একদিন তুমি মেলা সুখ পাইবা। একটু ধৈর্য ধরো বইন! আল্লাহর উপরে ভরসা করো। কথায় আছে না, “ধৈর্যের ফল মিডা হয়!” ফাহাদ একটু রাগী হইলেও মনডা নরম! একটা রা’ক্ষ’সী আইয়া জীবনে, হের জীবনডা বেদনা কইরা দিছে। কি নাতনীডা আমার কি হইয়া গেছে।”

বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো দাদী।ফাহাদ তার প্রথম বয়সে’র নাতনী ছিলো, এজন্য তারজন্য আলাদা একটা ভালোবাসা রয়েছে দাদীর। তাইতো হাতজোড় করে নাতবউয়ের কাছে নিজের নাতনী’র জীবনটা পুনরায় গুছিয়ে দিবার দাবী নিয়ে এসেছে। এহেন কথায় চাঁদনী কি বলবে বুঝতে পারলো না। তার কিশোরী মনে চলছে তীব্র আ’ন্দ’ল’ন। তার সদ্য বিবাহিত স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসতো ভাবতেই বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। আসিয়া বেগম নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় আবার বললো,

তয় একটা কথা বোইন, নিজের মনডা শক্ত রাখবা সব সময়। নিজের দুর্বলতা কখনো প্রকাশ করবা না অন্যে’র নিকট। বিয়াডা যেমনেই হইছে, তয় তুমি এহন থাইকা এই বাড়ির বউ। নিজের কখনো দুর্বল ভাববা না! নিজের অধিকার নিজেই আদায় কইরা নিতে হইবো তোমার। ” এহনকার যুগে সবাই তোমায় তাল দিলেও মিঠা কেউ দিবে না!”

একটু থামলো লম্বা শ্বাস টেনে আবার বললো, আরো একটা কথা মনে রাখবি, কখনো অন্যে’র কথায় কোনো সিদ্ধান্ত নিবি না।” সংসারে অশান্তি করবার জন্য, সংসারডা ভা’ঙা’র জন্য মেলা মানুষ পাইবা তুমি। তয় হেরা কিন্তু ভাঙতে আইবো শুধু, তোমার দায়িত্ব কেউ নিবে না।এজন্য মানষের কথায় কান দেওন যাইবো না।”

চাঁদনী নিরব হয়ে মনযোগ দিয়ে শুনছিলো দাদী’র কথা। আরো কিছু সময় কথা বলে দাদী ও চলে গেলো নিজের রুমে। চাঁদনী এখন সম্পুর্ন একা রুমে। সবাই যার যার মতো থাকছে কেউ আর তার খোঁজ নিচ্ছে না। নিজের দীর্ঘদিন থাকা ঘরটা ছেড়ে নতুন পরিবেশে একা একা ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার, আবার ভয় ও করছে।
সারাদিনটায় তার উপর দিয়ে কম ঝ’ড় গেলো না। শরীরটা আর চলছে না আরকিছু না ভেবে একটু সুয়ে পড়লো।
.
.
ফাতেমা খানম ফুঁসতে ফুঁসতে সশব্দে সদর দরজা লাগিয়ে দিলো। বসার ঘরে চেয়ারটায় ধপাস করে বসে ন্যাকা কান্না করে উচ্চস্বরে বলছেন,

“আল্লাহ গো! এই দিন দেখার আগে কেন আমার ম’র’ন হলো না? অ’প’য়া একটা মাইয়া জু’টি’য়ে দিয়েছে আমার ছেলেটার গলায়। যার মা’র কোনো নাম পরিচয় নাই! মাইয়াডা রাইখা অন্য বেডা’র লগে ভাগছে! এর মাইয়া আর কেমন হবে! ছিঃ! এই মাইয়ার জন্য আমার ছেলেটা বাড়ি থেকে চইলা গেলো। কতদিন পর বাড়ি আসলো ছেলেটা। কপাল পু’ড়ি থাকতে দিলো না! দিলো না! উড়ে এসে ক’ল’ঙ্কি’নী কই থেকে জুটছে আমার ঘরে। আসতে না আসতেই আমার সোনার সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে গেলো!”

বসার ঘর থেকে শ্বাশুড়ি’র উচ্চস্বরে তিক্ত কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে বসলো চাঁদনী। মনে হচ্ছে তার বুকে হাজারটা সুচ দিয়ে কেউ খোঁচাচ্ছে। সবার একটা দুর্বলতার জায়গা থাকে, চাঁদনী’র দুর্বলতা তার মা। যতবার লোকজন তার মা’কে নিয়ে কটুকথা বলে ঠিক ততবারই তার কিশোরী মনটা অসহ্য য’ন্ত্র’ণা’য় কেঁপে উঠে। চোখের অশ্রুগুলো আপনা আপনি গাল বেয়ে পড়ছে তার।
মাএই পাশের বাড়ির থেকে সবটা শুনে এসেছে সে। বাবু’র রিজেক্ট করা পাএী’র সাথে তার ছেলের বিয়ে হয়েছে। তার সাথে মেয়ে’র মা নাকি ছিঃ! ছিঃ! ভাবতেই শরীর গুলিয়ে আসছে তার। ইতোমধ্যে জা-য়েরা তাদের নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। এই মেয়ে’কে কিছুতেই থাকতে দিবে না সে। কিন্তু পরক্ষণে স্বামী’র ভয়ে চুপ হয়ে গেলো। কৌশলে কাজ করতে হবে তাকে।
.
.
চাঁদনী আনমনে বসে এসব ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। লোকের কাছে নিজেকে শক্ত দেখালেও রাতের আঁধারে একাকী তারও বুকে ভীষণ কষ্ট হয়। বুকের কষ্ট গুলো এই আঁধারে অশ্রু হয়ে ভিজিয়ে দেয় তাকে। যা দেখার মতো তার একটি আপন মানুষ নেই। সবাই’ই তার কিশোরী মনটায় ব্যথা দেয়। হঠাৎ ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো চাঁদনী। চারপাশে একবার শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখের অশ্রু কণাগুলো মুছে ভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,

” সুখ তোরা ভীষণ দামী তাই না? তোদের ধরে রাখার মতো দামী ভাগ্য আমার নেই’রে! আমি কত বোকো তাই না?যার কপালেই “সুখ” নামক শব্দটি নেই সে কিনা হন্যে হয়ে একটু সুখ খুঁজে। হাহা! আমি তো ভুলেই গেছিলাম রে, কপালে “সুখ” লেখা থাকলে নিজের ঘরেই সুখে থাকে। নিজের ঘরে যারা সুখ খুঁজে না পায়, তারা ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও সুখ খুঁজে ম’র’লে’ও কপালে শুধু দুঃখই মিলে! যার নিজ ঘরেই সুখ নেই, তার পুরো পৃথিবীতেও সুখ থাকে না।”

.
.
ঢাকায় নিজের রুমে এসে রুমে’র সমস্ত জিনিস ভে’ঙে ত’ছ’ন’ছ করছে ফাহাদ। কাঁচের টুকরো হাতে গেঁথে গলগল করে হাত দিয়ে র’ক্ত পড়ছে। সেই দিকে বিন্দুমাএ হুঁশ নেই তার। রাগে দুঃখে শরীর কাঁপছে তার, চোখ দু’টো র’ক্তি’ম বর্ণ ধারণ করছে। চোখের সামনে যা পাচ্ছে ছুড়ে মারছে ফ্লোরে। বাবা কেনো এমনটা করলো তার সাথে ? কেনো? কেনো? সে মেয়েদের ঘৃণা করে চরম ঘৃণা করে। আর সেখানে কিনা বাবা তাকে ব্লাকমেইল করে একটা মেয়ে’র সাথে জুড়ে দিয়েছে। মানতেই পারছে না সে। এতক্ষণে জমানো রাগ গুলো যেন রুমে এসে তড়তড় করে মাথা চাপা দিয়েছে। মাএই ঢাকায় এসেছে সে, আর এসেই একটার পর একটা জিনিস ভাঙছে। হঠাৎ চোখে পড়লো টেবিলে থাকা মোবাইলটা’র উপরে, এই শা’লা’ই যতো সমস্যার মূল। মোবাইল না থাকলে তো আর বাবা তাকে খুঁজে পেতো না। মুহূর্তেই গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো মোবাইল ফোনটা। মুহূর্তেই ঝনঝন শব্দ করে মুঠোফোনটা ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। ভাঙার মতো আর কিছু পেলো না হাতের কাছে। নিজের র’ক্তা’ক্ত হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরে মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়লো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা’র পর একটা ফুঁকছে। এরিমধ্যে ফাহাদে’র বন্ধু “শুভ্র” অফিস থেকে রুমে এসে ফাহাদ এবং রুমের এই অবস্থা দেখে আ’ত’ঙ্কি’ত হয়ে উঠলো। শুভ্র হিসাব মিলাতে পারছে না, ফাহাদতো ছুটিতে বাড়ি ছিলো। এখানে কখন আসলো, আর এতো রেগেই বা কেনো আছে? তবে আন্দাজ করতে পারলো বড় সড় কোনো কিছু হয়েছো তো নিশ্চয়ই। দ্রুত হাতের ব্যাগটা রেখে ফাহাদে’র পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো শুভ্র,

“কি হয়েছে ফাহাদ? তোর এই অবস্থা কেনো? কখন আসলি? এই বল কি হয়েছে তোর?”

কিন্তু ফাহাদ নিশ্চুপ, নিরুও্যর। বারংবার জিজ্ঞেস করেও শুভ্র জানতে পারলো না কিছু। এখন আর হাজার বলেও কিছু বলবে না ফাহাদ, তাই আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ফাহাদকে জোর করে তুলে খাটের উপরে বসালো শুভ্র। ফাহাদ হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

“আমাকে একটু পানি দে শুভ্র। প্রচুর মাথা ব্যথা করছে।”

শুভ্র বিনাবাক্যে দ্রুত পানি এনে, চুপিসারে পানির ভিতরে ঘুমের টেবলেট গুঁড়ো করে দিয়ে ফাহাদ কে খাইয়ে দিলো। নিজের অজান্তেই মিনিট দশেক পড়েই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো ফাহাদ……।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে