তুমি নামক সপ্তর্ষি মন্ডলের প্রেমে পর্ব – ২৯(অন্তিম পর্ব )

0
2004

#তুমি নামক সপ্তর্ষি মন্ডলের প্রেমে💖
#মিফতা তিমু
#পর্ব-২৯(অন্তিম পর্ব )

‘ এসব কি কথা আফরিন? তুমি বাড়ি ছেরে যেতে চাও মানে? ‘ অবাক হয়ে বললো তাহসান।

আমার কথা শুনে সকলেই হতভম্ব হয়ে গেছে।ডাক্তার সাহেব আমার দিকে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন যেন আমার কথাগুলো উনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।আমার ঠোঁটের কোণে এক ক্রুর হাসি যার অর্থ শুধু আমিই জানি।

‘ যা বলার তাতো বলেই দিয়েছি তাহসান ভাইয়া, আর কিছু বলার মত আছে বলে আমার মনে হয়না।তাছাড়া কথাগুলো আমি বাংলাতেই বলেছি বলে আমি জানি। ‘ ক্রুর হেসে বললাম আমি।

‘ হুট করে কি এমন হলো যে তুই চলে যেতে চাইছিস আফরিন? ‘ বিস্ময় সুরে বললো মা।

আমি মায়ের দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা আপাতত আমার নেই তাই আমি মৌনতা বজায় রাখলাম।আমায় চুপ থাকতে দেখে এবার নিহা বললো,
নিহা: ভাবী কি হয়েছে তোমার? তুমি চলে যেতে চাইছো কেন? ভাইয়া কি কিছু বলেছে তোমায়?তুমি আমায় বলো…আমরা সবাই মিলে ভাইয়াকে পানিশমেন্ট দিবো তবুও তুমি যেওনা প্লিজ ভাবি….
আমি এবার নিহার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলাম। ওর কথা শুনে অবচেতন মনে কিছু একটা ভেবে বললাম,
আফরিন: আমাকে একটা হেল্প করবে নিহা?

আমার কথা শুনে নিহা খুশি হলো। ও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সায় দিল।আমি বললাম,
আফরিন: তাহলে একটা কাজ করো।তুমি সবাইকে নিয়ে বাইরে যাও কিছুক্ষণের জন্য।আমার ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে কথা আছে শেষবারের জন্য।কে জানে এরপর আর কোনোদিন সুযোগ হয় বা না হয়।

আমার কথায় নিহার মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। ও অসহায় মুখে সবাইকে নিয়ে বাইরে গেলো।ডাক্তার সাহেব এখনও শক্ত পাথরের ন্যায় আমার বেডের পাশের টুলে বসে আছেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিলাম।আমার যদি দেখে উনি আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে আমি উনার দিকে বাঁকা হাসি দিয়ে তাকালাম।

‘ হঠাৎ করে ওদের মধ্যে কি এমন ঝামেলা হলো যে আফরিন বাড়ি চলে যেতে চাইছে? আফরিন তো এরকম হুটহাট বেরিয়ে যাওয়ার মেয়ে না।আমি যতটুকু জানি ও ঘরকুনো তাহলে এসবের কারণ কি? ‘ আফরিনের কেবিনের বাইরে থাকা চেয়ারে বসে চিন্তিত মুখে বললেন রহিমা বেগম।

উনার মুখে স্পষ্ট চিন্তার রেশ।উনার কথায় বাকিরাও চিন্তিত হয়ে পড়ল কিন্তু আনসারী ক্রুদ্ধ গলায় বললো,
আনসারি: ভাগ্যিস আমার মেয়েটা আপনাদের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছে নাহলে আপনার ছেলে আমার মেয়ের প্রাণ নিয়ে তবেই ক্ষ্যান্ত হতো।যখন থেকে আপনাদের ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে তখন থেকে আমার মেয়ের জীবনটা নরক হয়ে গেছে।

‘ আজব তো।আপনি এক কথা কয়বার বলবেন? আপনার কি বিরক্ত লাগে না এক কথা বারবার বলতে? ‘ অবশেষে আনসারীর কথায় বিরক্ত হয়ে বললো নিহা।এতক্ষণ নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে অনেক কথা শুনেছে কিন্তু আর পারলো না শুনতে কারণ সবকিছুর একটা লিমিট আছে তাই ওকে এই স্টেপ টা নিতে হলো।

‘ আমার মেয়ের কথা ভেবে আমাকে এসব কথা বারবার বলতেই হবে। সে তুমি শুনতে না পারলে আমার কিছু করার নেই। ‘ ক্রুদ্ধ গলায় এবারও বললো আনসারী।

আনসারীর এই কথা নিয়ে বাকিরা কিছু বলবে তার আগেই আফরিনের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো তাহরীম।মুখ তার বিবর্ণ।চোখগুলো ফুলে গেছে,মনে হয় অনেক কেঁদেছে।অবস্থা বেগতিক দেখে তাহরীমের বাবা ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে তাহরীম কে জড়িয়ে ধরে বললো,
বাবা: কি হয়েছে তাহরীম? তোর এই অবস্থা কেন?

তাহরীম নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না।বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে দিল। কাপা কাপা গলায় বললো,
তাহরীম: বাবা মিসেস আফরিন আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবেন…

তাহরীমের কথা শুনে রহিমা বেগম নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। আঁচলে মুখ চেপে নিঃশব্দে কেদে দিলেন। নিহা রিমাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলো।ওদের এহেন অবস্থা ফিরোজা দেখতে পারছেন না তাই উপায়ন্তর না পেয়ে স্বামী আনসারীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ধীর কণ্ঠে আস্তে করে বললেন,
ফিরোজা: আফরিনের বাবা আফরিন কে না নিয়ে গেলে হয়না?দেখুন না সবাই কিভাবে কান্নাকাটি করছে…

ফিরোজার এহেন কথায় আনসারীর পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল।আনসারীর ইচ্ছা করছে ফিরোজা কে গলা টিপে মেরে ফেলতে কিন্তু নিজের ইচ্ছাকে দমন করে দাতে দাত চেপে বললো,
আনসারি: তুমি যদি সুস্থ থাকতে চাও তাহলে নিজের মুখ বন্ধ রাখো।এসব ব্যাপারে পাকনামি করলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।
আনসারীর হুমকি শুনে ঘাবড়ে গেলেন ফিরোজা বেগম।ভয়ে চুপসে গিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন।খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বাবার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল তাহরীম আর বললো,
তাহরীম: যে যেতে চায় তাকে যেতে দেওয়াই ভালো। যার থাকবার সে এমনিতেই থেকে যাবে।মিসেস আফরিনের থাকার হলে উনি থেকে যেতেন,উনি যখন চাইছেন না তখন আর এই ব্যাপারে উনাকে জোরাজুরি না করাই বেটার।

তাহরীমের গম্ভীর গলায় বলা কথাগুলো শুনে কেউ আর কিছু বললোনা। তাহরীম আর কিছু না বলে এগিয়ে গেলো ডিসচার্জ পেপার আনতে।আনসারী ফিরোজা বেগম কে বললেন আফরিন কে রেডি করিয়ে আনতে।ফিরোজা বেগম স্বামির হুকুম তামিল করতে মাথা নত করে চলে গেলেন।

সময় হয়ে এসেছে আমার বাবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার। আমি একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডাক্তার সাহেবের সামনে এসে দাড়ালাম।একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলাম।ডাক্তার সাহেবও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।অতঃপর কিছু না বলেই বাবার দিকে এগিয়ে গেলাম।বাবা আর ফিরোজা বেগম কে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।হসপিটাল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার শুধু পিছনে ফিরে ডাক্তার সাহেব কে দেখলাম।ক্রমশ উনার মুখখানা অস্পষ্ট হয়ে এলো।

‘ বাড়ির পথে ফেরার সময় হঠাৎ এক দুর্ঘটনার স্বীকার এক পঁচিশ বছরের তরুণী।গাড়িতে তখন চারজন যাত্রী। অ্যাক্সিডেন্ট এর পূর্বাভাস পেয়ে তরুণীর মা বাবা বেচেঁ গেলেও বাঁচতে পারেনি জান্নাতুল আফরিন কাজী নামক এক বিবাহিত তরুণী আর মর্তুজ আলী নামক ড্রাইভার।তাদের মৃত্যুর করুন দৃশ্য দেখে সকলেই হতবাক। ‘

টিভিতে নিউজটা চোখে পড়তেই সকলে ভাষা হারিয়ে ফেললো। তাহরীমের মা অনবরত কেঁদেই চলেছেন,উনাকে সামাল দিচ্ছে রিমা আর নিহা।তাহসান, তাহরীমের বাবা আর আকাশও স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।তাদের মুখে ভাষা নেই প্রতিক্রিয়া করার মত।

সকলে খবরটা দেখে হতবিহ্বল হলেও একমাত্র তাহরীম শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে।ওর চোখে মুখে চিন্তার রেশ মাত্র নেই।ওর এমন প্রতিক্রিয়া সকলের কাছেই আশ্চর্যজনক হলেও কেউ তা বিশেষ পাত্তা দিলোনা কারণ নিজের স্ত্রীয়ের মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয় তবে সকলের অগোচরে তাহরীমের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক রহস্যময় হাসি যার অর্থ একমাত্র সেই জানে।

অলস ভঙ্গিতে সন্ধ্যে নামার আগে বারান্দায় হাতে এক কাপ কফি নিয়ে বসে আছে তাহরীম।ইদানিং তার আফরিনের মত ব্ল্যাক কফি খাওয়ার ভূতে ধরেছে।যখন তখন ব্ল্যাক কফি খেতে ইচ্ছা করে।অবশ্য আফরিন সেটা শুধু স্ট্রেস কমানোর জন্য করে।তবে এতদিন আফরিনের সঙ্গে থেকে ওর অভ্যাস ধরে গেছে কফি খাওয়ার।

তাহরীমের দৃষ্টি স্থির সামনে থাকা টি টেবিলের উপর রাখা ফোনের দিকে।দৃষ্টি যেদিকেই যাক না কেন সেই ঘুরে ফিরে ফোনের দিকেই যাচ্ছে।বিশেষ একজনের ফোনের অপেক্ষায় আছে সে। সেদিন এর পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। বাড়ির পরিস্থিতি বেজায় খারাপ। তাহরীমের মা ছেলের বউ হারানোর দুঃখে অনেকটা ভেঙে গেছে। খাওয়া দাওয়া একেবারে ছেরে দিয়েছে বললেই চলে।

নিহা আর রিমার অবস্থাও তেমন ভালো না।কিন্তু ওরা কোনমতে নিজেকে সামলে রেখেছে শুধুমাত্র তাহরীমের মায়ের জন্য।সবাই এখন মনমরা হয়ে থাকে।প্রথম কিছুদিন তাহসান আর তাহরীমের বাবা অফিস না গেলেও এখন জীবিকার তাগিদেই বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে তাদের।

পুরনো কথা ভাবতে ভাবতেই অতীত ছেরে বেরিয়ে এলো তাহরীম।চোখের সামনে টি টেবিলের উপর থাকা ফোনটা বেজে উঠলো।এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। ফোনে কলার আইডি দেখে তাহরীমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ‘ ডাক্তার সাহেব…’

অস্ফুটে উচ্চারণ করলো তাহরীম ‘ ভালোবাসি প্রিয়দর্শিনী….’

সমাপ্ত……..

আসলে আপনারা একেক জন একেক ভাবে চিন্তা করেছেন শেষ পর্ব নিয়ে আর আমার ভালোও লেগেছে তাদের চিন্তা ভাবনা।কিন্তু ওই যে আমি আরাফাতের মত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে চিন্তা করি।আমি পার্থিব জীবনে সহজ সরল হলেও গল্পের ক্ষেত্রে ঘুরিয়ে চিন্তা করি যার কারণে আপনাদের ভাবনা যেখানে শেষ হয় আমার ভাবনা সেখান থেকেই শুরু হয়।সবসময় আমরা যেটা চাই সেটা সম্ভব হয়না তাই উপন্যাসটা আমি এক নাগাড়ে লিখতে চাইলেও পরীক্ষার কারনে সম্ভব হলোনা সেটা এজ এ রিডার আপনাদেরও বুঝতে হবে কারণ আপনাদের অনেকেরও পরীক্ষা আছে। আর পরীক্ষা শেষ হলেই দ্বিতীয় খন্ড আর সাথে কিছু নতুন তবে ভালো চরিত্র নিয়ে ফিরবো😊😊😊 )

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে