#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
সুচনা পর্ব
–ঝলসে দেওয়ার মত উত্তাপ নিয়ে কেন প্রকট হলে!
যখন তোমার শীতলতা ভরা চাহনিতে খুনই করেছিলে!
কেন তবে এত লুকোচুরি, এত আড়াল।
যখন অনুভুতির আদলে বাধার ছিল রংমশাল।
দুরত্ব উত্তাপ বাড়ায়।যন্ত্রণা বাড়ায়।ভিষন পোড়ায়।
তুমি নামক যন্ত্রণার অনলে দগ্ধ প্রতিকাল।
তবুও কেন তুমি এত আড়াল।
কথাগুলো কর্নকুহুরে পৌছুতেই থমকে গেল পা।থমকে গেলাম আমি। আমার পিছনে অবস্থানরত মানুষটি তারা ভরা মহাকাশে তার গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই কথাগুলো মায়া জড়ানো কন্ঠে উগড়ে দিল।মানে বুঝতে না পারলেও স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম তার পিছনে।
রাতের তারা ভরা উজ্জ্বল আকাশের নক্ষত্রগুলো দেখার লোভ সামলাতে না পেরে তিশা আপুকে রেখে একাই ছুটে এলাম ছাদে।মনের সুখে এই বিশাল নক্ষত্রগুলোকে পর্যবেক্ষন করবো বলে।ছাদের দরজার ঠেলে ভেতরে ঢোকার আগেই তা আচমকা খুলে গেল আর ব্যাল্যান্স ধরে রাখতে পারিনি বলে আমি গিয়ে পড়লাম ঠিক কারো বক্ষ পিঞ্জিরায়।সযত্নে আগলে নিলে সে।ভয় তটস্থ হওয়ায় ইতোমধ্যে চক্ষুযুগল বন্ধ আমার।তবে যখন নিজের অবস্থান আর নিজেকে কোনো বলিষ্ঠ হাতের বাধনে আবিষ্কার করলাম ঠিক তখনই টনক নড়লো আমার।সামনে অবস্থানরত মানুষটি কে হতে পারে ধারনা না থাকায় পিটপিটিয়ে চোখ খুললাম আমি।ঠিক তখনই আমার সামনে এক ভিষন পরিচিত মুখ ভেসে উঠলো।তার শান্ত শীতল একঘেয়ে দৃষ্টি আমাতে নিবদ্ধ।তার দুহাতের বাধনে আমি।পড়ে যাওয়া থেকে বাচার জন্য তার মেরুন রঙের শার্টটার হাতের দিকটা খামচে ধরে আছি।তার একহাত আমার পিঠে ও অন্যহাতে আমার কোমর আকড়ে ধরে আছে।পরিস্থিতি আর অবস্থান বুঝতে পেরে বিদ্যুত বেগে সরে এলাম তার কাছ থেকে। মাথা নিচু করে দু হাত কচলাচ্ছি।অস্বস্তি আর অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে আমায়। হাত- পা কাপছে।সাথে হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি কয়েকগুন বেড়ে গেছে। সে যেন তান্ডব করছে।মনে হচ্ছে এখুনি দম বন্ধ হয়ে মারা পড়বো।
মনে মনে আল্লাহ ডাকছি।
–ইয়া আল্লাহ! এ কোন মসিবতে পড়লাম আমি।যার থেকে পালিয়ে বেড়াই আর আজ তার কাছেই এভাবে….
না, না এত বড় শাস্তি তুমি আমায় দিতে পারোনা।এই তো কান ধরছি আর জীবনেও নামাজ ছেড়ে দিব না।প্রমিস।যেভাবেই হোক আমাকে এই দুরবস্থা থেকে বাচাও আল্লাহ।প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
নিজের দুরবস্থা দেখে নিজের ই নিজের উপর করুনা হলো আমার।পরক্ষনেই শুষ্ক ঠোটজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে অতন্ত্য সুক্ষ্ম স্বরে বললাম।
— আ্ আ’ম সরি ভাইয়া।ভ্ ভুল করে…
আর বলতে পারলাম না।তার আগেই বুঝতে পারলাম আমার আরো খানিকটা কাছে চলে এসেছে উনি।আমি সঙ্গে সঙ্গে দুকদম পিছিয়ে গেলাম।উনি এগোচ্ছেন আমি পেছনে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে ছাদের রেলিং ঘেষে দাড়ালাম।উনি আমার দু পাশে হাত রেখে বেশ খানিকটা ঝুকে গেলেন। আমি ভয়ে মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে দুহাত পিছনে দিয়ে রেলিং চেপে ধরলাম।চোখমুখ খিচে বন্ধ করে আছি।
উনার গাড় নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।এই নিস্তব্ধ রাতে শুধু তার নিশ্বাসের শব্দই যেন কানে বাজে আমার।আমার গলায় ঘাড়ে আচড়ে পড়ছে সে ঘন শ্বাস প্রশ্বাস। রুদ্ধ হয়ে আসছে কন্ঠনালি।
কিন্তু উনার কোন ভাবান্তর নেই। গভীর চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে।তারপর ভেজানো গলায় বললেন,
–এত দহন কেন এ বুকে।ওই শীতলতা ভরা স্পর্শ কি এ দহনকে শীতলতা দিতে পারে না।ওই মায়াবি অক্ষিগোলক কি আমার অস্থিরতা বুঝতে পারে না।কেন সে বোঝে না।কেন প্রেমের বর্ষনে সিক্ত করে না এই হৃদয়ে জ্বলতে যন্ত্রণার অনল থেকে।
বিস্ময়ে থমকে না গিয়ে পারলাম না আমি।এত্ত বিশাল বিশাল কথার মানে কি? এর পরিসর কি? আর কি তার বিস্তৃতি!আমাকে এসব বলার মানে কি!হঠাৎ উনার এসব অদ্ভুত কথার মানে বুঝতে পারলাম না আমি।
ড্যাবড্যাব করে ঘাড় উচু করে তাকিয়ে আছি তার মুখে। আমি তার থেকে বেশ ছোট।সে বিশাল লম্বা।আর হবো নাই বা কেন? মাত্র অনার্সে সদ্য এডমিশন নিয়েছি।আর তিনি তো লেখাপড়া শেষ করার পর্যায়ে।মাসটার্স লাস্ট টার্ম।হয়তো কিছুদিন পরেই পরীক্ষা শেষ হবে তার।
এতক্ষণের তার ভেজা কন্ঠস্বর আমার বুকের ভিতর অদৃশ্য রক্তক্ষরন করছিলো যেন।আমার ভেতর কেমন এক যন্ত্রণা অনুভব করলাম।এই মানুষটার থেকে সবসময় দুরত্ব রেখেছি।ভয় পাই উনাকে। ভিষন!ভয়ে একবারে হার্ট অ্যাটাক করবো টাইপের ভয়।তবুও তার এমন জলভরা চোখ দেখে কিছু তো হচ্ছে আমার ভেতর বুঝতে পারছি না।হঠাৎ আমার গালে ঠান্ডা পানির অস্তিত্ব টের পেলাম।হ্যাঁ উনার চোখের জলে টুপ করেই আমার পড়লো।আমি কেপে উঠলাম।অসহায় চোখে তাকালাম তার মুখপানে।কিন্তু বেশিক্ষণ তা স্থির রাকতে পারলাম না।চোখ নামিয়ে নিতে হলো। তিনি আবারও বললেন,
— কাছে থেকেও দুরে থাকার যন্ত্রণা বুঝিছ কথা।ইচ্ছে করে দুরে সরে থাকার যন্ত্রণা। বুঝবি! একদিন ঠিক বুঝবি! যখন তোর একান্ত প্রিয় মানুষটিকে চাইলে কাছে পাবি না।চাইলেও তার থেকে দুরে সরে থাকতে পারবি না। অথচ থাকতে হবে তোকে। অবাধ্য কিছু অনুভুতি রোজ পোড়াবে রোজ পোড়াবে তোকে।তুই পুড়বি। যন্ত্রনার অনলে।মানসিক নয়।আত্মিক।ভালোবাসার দহনে ভিষন করে পুড়বি।বুঝবি ঠিক কতটা জ্বলন হয়!কতটা অসহনীয় হয়!যে অনলের দগ্ধতা।প্রকাশিত নয় তবে অপ্রকাশিত রয়।
এতটুকু বলেই দুরত্ব বাড়ালেন উনি।ততক্ষণে চোখের কোনে জল চিকচিক করছে আমার।নিজেকে সামলাতে না পেরে একসময় ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম।উনি আমার দিকে মুখ তুলে চাইলেন। উত্তেজিত হয়ে ছুটে এলেন।দুগাল তার হাতের তালুর মাঝে নিয়ে সন্তপর্ণে চোখ মুছিয়ে দিলেন।বললেন,
— কাদিস না প্লিজ।ও চোখের জল যে এ বুকে জলতে থাকা অগ্নিকে আগ্নেযগিরিতে রুপান্তর করে উত্তাপ বাড়িয়ে দেয় বহুগুন।উত্তলে উঠে ওরা।আরও বেশি করে জ্বালাতে!আরও বেশি পোড়াতে!আরও হাজার গুন বেশি ক্ষত বিক্ষত করতে।
আর পারছিলাম না নিতে তার এসব কথা। তাই এক ঝাড়া দিয়ে ছুটে এলাম আমি।তিনি শুধু শান্ত চোখে চেয়ে ছিলেন কিন্তু কিছু বললেন না।
ঠিক তখনই পেছন থেকে মেঘমন্দ্র কন্ঠে বলে ওঠলো উপরোক্ত বাক্যগুলো।
তাহলে আসুন এবার তার পরিচয়ে ফেরা যাক।আমি হৃদিতা ইসলাম কথা। আর ইনি হলেন আমার জেঠিমনির একমাত্র আদরের সুপুত্র ফয়সাল আহমেদ স্রোত।আর তিশা আপুর একমাত্র ভাই।আর আমার একমাত্র জেঠুর একমাত্র ছেলে।কেমন গম্ভীর একটা ছেলে।এই পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কাউকে ভয় না পেলেও এই মানুষটাকে জমের মত ভয় পাই আমি।কারন জানা নেই তবে পাই বেশ ভয় পাই।কেন জানি উনি সামনে এলেই শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। মনে হয় এই বুঝি আমার প্রানপাখিটা উড়াল দিবে।তাই সব সময়ের মতই তার কাছ থেকেই দুরে দুরে থেকেছি আমি।তবে মা বলতো ছোটবেলায় সারাক্ষণ উনার সাথেই থাকতাম।দুজন বেশ ঝগড়া করতাম।আমার পছন্দের সবকিছুই উনার চাই।এ নিয়ে খুব কাঁদতাম আমি।তবে সবটাই শোনা কথা।আমার তেমন কিছুই মনে নেই।আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন কাজের জন্য জেঠুমনি ঢাকায় চলে যায়।আর আমরা অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছিলাম।তাই কৈশোর কালটা আমার তার সাথে কাটানো হয়নি।যার ফলে ছোটবেলার স্মৃতি আর সম্পর্ক দুটোই ফিকে হয়ে গেছে।
.
বাবা-মায়ের সাথে অন্য একটা শহরে থাকি আমরা।জেঠু তার কাজের সুত্র আর পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকে। আর আমরা চট্টগ্রাম। আমার প্রানের শহর।ভিষন ভালোবাসি এই শহরকে আমি।
এবারের গরমের ছুটিতে সবাই মিলে বেড়াতে এসেছে আমদের বাড়িতে। আমাদের নইরে বাবা দাদুর বাড়িতে। ফুপ্পিরাও এসেছে।আমার বাবারা দুই ভাই দুই বোন।বেশ ছোট পরিবার।জেঠুমনি বাবার বড়।আর তারপর দুবোন।আমার বাবা সবার ছোট।আর আমার পরিবারে আমি আর আমার ছোট ভাই।পিচ্চিটা ভিষন ঝগড়াটে সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকাই যেন ওর কাজ।আর এখন তো খিটখিটে বদমেজাজি পাজি লোকটার সাথে হাত মিলিয়েছে। এবার এ দুটো মিলে আমার জীবন নামক রেলগাড়িটাকে যেন ঝাঝড়া করে দিচ্ছে।ওই নাটের গুরু পাজি লোকটাকে কিছু বলতে পারি না আর আমার হারামি মার্কা বদ নাম্বার ওয়ান ভাইটাকে সহ্য করতে পারি না।উফফ,জীবনটা বেদনার।এ আসার পর থেকেই জীবনটার বেদনায় ভরে গেছে আমার।কোনদিন যেন কোন উত্তাল সমুদ্রে এর ভরাডুবি হয়।ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার ভিতর থেকে। আমি অসহায়!
অবলা নারী!
কিই বা করতে পারি!
তবে যতটুকু সম্ভব তাকে এড়িয়ে চলি।এড়িয়ে চললি বলে ভুল হবে নিজেকে লুকিয়ে রাখি।তার কাছ থেকে লুকিয়ে বাঁচি। তার অনুপস্থিতিতে নিজের মত করে বাঁচি।
আজ প্রায় সাতদিন হয়ে গেছে ওনারা এখানে এসেছে সবার সাথে চঞ্চল যুবতী হলেও এই মানুষটার সামনে ভিজে বিড়াল।সব দোষ এর চোখ নামক যন্ত্রের।এত তীব্র আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কেন দেবে সে।হুহ! ভাবলেই রাগ হয় ভিষন রাগ।সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়ার মত রাগ।
.
এই মুহুর্তে তার মুখ নিসৃত কথাগুলো নাড়িয়ে দিয়েছিল আমায়।থমকে ছিলাম আমি।হৃদপিন্ডে দুরুম দুরুম শব্দের তাল তুলেছে।পরমুহূর্তেই আবারো ভারি ঘোড়েল কন্ঠে সুধালেন,
— তুমি নামক যন্ত্রণা এতটা তীব্র কেন? যার তীব্রতার কাছে আমি বাজেভাবে হেরে গেছি।আজ পর্যন্ত কখনো কেউ আমাকে কোন কিছুতে বাধ্য করতে পারেনি।তবে তুমি পেরেছো! নিজেকে হারিয়েছে! যতবার খুঁজেছি তোমাকেই পেয়েছি! কেন এমন করলে বলতে পারো?
তার কথায় ভিষন চমকে যাচ্ছি আমি।এসব কি তিনি আমাকেই বলছে।তবে উনি তো আমার সাথে এইভাবে কথা বলে না।যাও দু- তিনবার মোটে কথা হয়েছে।তখন তো তুই করেই বলতো।এখন আবার এভাবে কেন বলছে!আমার মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।তার এমন কথার আগাগোড়া বুঝতে না পারলেও যেন কষ্টটা সহ্য করতে পারছিলাম না।তার চোখের জল দেখে যেন ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো।তাই কিছু না ভেবেই ছুটে এলাম। একছুটে চলে এলাম।হয়তো তিনি ওভাবেই দাড়িয়ে। ওই বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন।ওই বিশাল আকাশকে তার যন্ত্রণা উজার করে দিতে চাইছেন।তার বিশালতায় মিলিয়ে দিতে চাইছেন।
একছুটে নিজের রুমে চলে এলাম।ডান বাম কোথায় তাকায়নি।আর এত রাতে কেই বা জেগে থাকবে।সবাই ঘুমিয়ে গেছে।তিশা আপু আমার বেশ বড়।স্রোত ভাইয়ার ও বড় উনি।উনার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।এইতো সামনের মাসে জিজুর কাজ সেরে এব্রোড থেকে ফিরলেই বিয়ে।তাই উনার সাথে রাতের বিশালতার সাথে দুজনের মনের মাঝে জমা কথা উজার করতে চাইছিলাম।তাই সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আড়ালে চলে আসি।এমনিতেও রাতের তারা ভরা আকাশ আমার অসম্ভব প্রিয়।তারওপর প্রিয় মানুষটির সঙ্গ।আমার কাজিনদের মধ্যে কেন জানি তিশা আপুর সাথেই আমার ভাব বেশি।তবে এর কারন অজানা।
রুমে এসে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম।হাপাচ্ছি আমি। সাথে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি। তবে নিরবে,নিভুতে।কাঁদতে কাঁদতেই ভাবনার সাগরে ডুব দিলাম।মনে পড়ে গেল সেই প্রথম দিনের কথা যখন প্রথম বার স্রোত ভাইয়ার সাথে আমার দেখা হয়। কি অদ্ভুত সে ঘটনা!কি অদ্ভুত সে অনুভুতি!
চলবে,,