#তুমি আসবে বলে
#পর্ব_৫
#ইভা রহমান
আকাশ কাপিয়ে এখনো অবিরত বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। কখন গিয়ে এই বৃষ্টি থামবে তা জানা নেই। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে উজান আর হিয়া। রিকশা দাদু একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার ভেজা পলিথিনের ব্যাগ থেকে টাকা গুলো বের করে দেখছে সেগুলো অক্ষত আছে কি না। পরিবেশের এ-ই শীতল আমেজে গা শিরশির করছে হিয়ার। তার উপর তারা দু’জনই ভিজে গিয়েছে অনেকটা। হিয়া এক কোণে দাঁড়িয়ে গায়ে লেগে থাকা পানি গুলো ঝারছে। সাথে ভেজা চুল গুলোও হাত দিয়ে চিপে ঝেড়ে নিতে থাকলো হিয়া। যার ফলপ্রসূ সেগুলো থেকে পানি ছিটকে এসে উজানের মুখে পড়তেই উজান হিয়ার দিকে চোখ তুলে তাকালো। বৃষ্টির ছাট এর সাথে হিয়ার ভেজা চুলের পানি এসে জড়ো হতে থাকে উজানের মুখে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে উজান। হিয়ার এ-ই কাক ভেজা শরীর এক অন্য রকম স্নিগ্ধ শীতল মার্ধুযতে ভরিয়ে দিচ্ছে হিয়াকে। মেঘ গুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গুরুম গুরম ডাকছে। তাদের ঝলকানিতে কিছু আলো এসে জড়ো হচ্ছে হিয়ার মুখে। বজ্রপাতের অগ্নিমূর্ত আলোর এই ঝলকানি হিয়ার উপর পড়ে যেনো জানান দিচ্ছে এ-ই প্রেয়সী শুধু তোমার জন্যোই লিখে রাখা উজান। শুধু তোমার জন্য। উজানের চোখে চোখ পড়তে চোখ নামিয়ে নিলো হিয়া৷ চুল গুলো হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। উজান পেছনের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একটা পা ভাঁজ করে তুলে দিলো সেই দেওয়ালে। তার পাশে এক পা দূরে দাঁড়িয়ে হিয়া। একটা হিমেল বাতাস এসে ছুঁইয়ে দিলো দুজনকে। পাশে বেড়ে ওঠা গন্ধরাজ ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়লো আর মনোমুগ্ধকর গন্ধে উজান আর হিয়াকে জানিয়ে দিলো যে আজ বৃষ্টি শুধু তোমাদেরকে ভিজিয়ে দিতেই এই বসুন্ধরার পতিত হচ্ছে। শুধু তোমাদেরকে ভিজিয়ে দেবার জন্যই! সব নিরবতা কাটিয়ে উজান নিজে থেকে কথা শুরু করলো।
-আমি সাথে না আসলে কি হতো বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই?
-কি আর হতো। তখন শুধু আমি আর এই দাদু একা একা দাঁড়িয়ে থাকতাম এভাবে। আর কি?
-তাই। আপনি কি জানেন আপনার সাহস স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই।
-সমস্যা কি তাতে। সাহস থাকা তো গুনের কথা তাই নয় কি।
-মাঝে মাঝে অতিরিক্ত সাহস দেখাতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যায় আপনি বোধহয় সেটা জানেন না____আচ্ছা বাদ দিন ওসব কথা। এই কদিনে এটা বেশ বুঝতে পেরেছি আপনার সাথে কথায় আমি পারবো না।
হিয়া মুচকি হাসলো,হেঁসে দিয়েই বললো,
– মেয়ে মানেই একটু বেশি কথা। আপনি হয়তো এর আগে খুব একটা মেয়েদের সাথে মেলামেশা করেননি তাই জানেন না।
-তা ঠিক। তা আপনার সম্পর্কে তো খুব একটা জানার সুযোগ হলো না। সেদিন বললেন ফুফুর কাছে মানুষ আপনি?
-জ্বী।খুব ছোটতে বাবা মাকে হারিয়ে ফুফুর কাছে বড় হওয়া। আমাদের ছোট্ট পরিবার আমি ফুফা ফুফু আর তাদের এক মেয়ে বুলি আর আমার দাদি।
-অনার্স থার্ড ইয়ার?
-জ্বী। আপনার পড়াশুনা?
-জ্বী হিসাববিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছি তিন বছর হলো। পারিবারিক এতো বড় বিজনেসের জন্য আর চাকরির দিকে মনোনিবেশ করতে মন চায় নি।
-ওহ! ঠিকই আছে এতো বড় পারিবারিক ব্যবসা থাকতে আর চাকরির জন্য এপ্লাই করবার কি প্রয়োজন৷ আমাদের মতো কিছু শিক্ষিত বেকারদের কেও তো একটু সুযোগ দেওয়া উচিৎ তাই না বলুন?
-শিক্ষি–ত বে–কার। আপনি একটা চাকরি করছেন তবুও বলছেন আপনি বেকার?
– এই চাকরিটা নিশ্চয়ই আমার সারাজীবন থাকবে না?
-অবশ্যই পারে, আপনি চাইলেই থাকতে পারে! কেনো পারবে না?
হিয়া বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,এই কথাটার মানে?
-না কিছু না। আসুন বৃষ্টি টা ধরে গেছে অনেকটা, এবার ফেরা উচিৎ।
হিয়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে উজান রিক্সায় গিয়ে উঠে পড়লো। রিক্সা দাদু এসে প্যাডেল তুলতেই হিয়াও পেছন পেছন এসে উজানের পাশে বসে গেলো। মাএারিক্ত বৃষ্টি না থাকলেও এখনো ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। উজান পলিথিনের ব্যাগ টা আবার হুটে গুঁজে দিলো। কোথা হতে এক অদৃশ্য আলো এসে পড়তে থাকলো দু’জনের শরীরে। উজান হিয়ার মুখের দিকে অনেকক্ষণ যাবৎ তাকিয়ে আছে। হিয়া নিজেও বুঝতে পারছে উজান তার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়ার মনে এ মুহুর্তে ঘোর পাক খাচ্ছে উজানের বলা শেষ কথা টা। কোনো কিছুতেই হিয়া এর রহস্য ভেদ করতে পারছে না। তার উপর উজানের এই অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকা বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। না এবার আর চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। এ-ই লজ্জা নাহলে শেষ করে দেবে হিয়াকে। হিয়া উজানের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ভূ কুঁচকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি সমস্যা? উজান মুচকি হাসলো কিছু না বলে তার চোখ নামিয়ে নিলো। এখনো উজানের ঠোঁটে এক ভালোলাগার হাসি ঝুলছে।
-আপনি কি সব মেয়েদের দিকেই এভাবে তাকিয়ে থাকেন?
-না আপনি প্রথম!
স্বাভাবিক উওর উজানের৷ কিন্তু এই স্বাভাবিক উওর টাই বড় অস্বাভাবিক লাগলো হিয়ার কাছে।একটা বড়সড় রকমের ভীষম খেলো হিয়া। কি বলছে কি এই লোকটা। হিয়া গোয়েন্দা ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
-বাড়িতে আপনি যেভাবে থাকেন আপনাকে দেখে কিন্তু এটা বোঝার উপায় নেই আপনি মেয়েদের সাথে এভাবে ফ্লাট করতে পারেন।
-আমি আপনার সাথে ফ্লাট করছি?
-তা কি করছেন,চড়ুইভাতি খেলছেন?
উজান হাসলো শুধু।প্রতিউওরে কিছু বলতে যাবে তার আগে রিক্সা এসে থামলো বাড়ির কাছে। উজান কিছু বলতে পারলো না না পারলো হিয়া নিজে। দুজনে বাড়িতে ঢুকলো। এদিকে বাড়িতে এসে দেখা মিললো উজানের সেই চিরচেনা গম্ভীর রুপ। হিয়া তো অবাক এটা কি সেই মানুষ যে একটু আগে তাকে লজ্জার সাগরের একদম গভীরে ডুবে নিয়ে যাচ্ছিলো। রাগে মাথার চুল খামছে ধরে হিয়া৷ না এ-ই লোকটাকে চেনা বড় মুশকিল!
!
কিছুদিন বাদে;
খাবার টেবিলে ঠিক সময় এসে যে যার মতো বসে গিয়েছে। উজান নিবিড়ের সাথে টুকিটাকি কথা বলছে। দাদিমণি কথা বলছে এ বাড়িতে থাকা আরেকজন ভদ্রমহিলার সাথে উনিও এ বাড়ির পুরাতন কাজের মানুষ কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নাই।উপরন্তু উনি শিক্ষিত আবার সৌন্দর্য মন্ডিতোও। পাশের চেয়ারে স্পর্শকে নিয়ে বসে আছে হিয়া। বুঝাই যাচ্ছে আজও স্পর্শ ঠিক মতো হিয়াকে খেতে দিবে না কিন্তু কি করার এ-ই মুহুর্তে হিয়া ছাড়া যেনো তার আর কারো কোল পছন্দ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ বাদে মোহিনী আসলো। পড়নে একটা শর্ট স্কাট উপরের কটি টাও চোখে লাগার মতো। বুকের অনেকটাই বেড়িয়ে আছে তার। হিয়া মেয়ে হয়েও মোহিনীর দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে এরকম। দাদিমণি কিছু বললেন না কারণ মোহিনীর এই সব পোশাকে উনি অভ্যস্ত। যদিও এই ব্যাপারে উজানের ছিলো কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু মোহিনী কি আর তা শোনার মেয়ে।
খাবার খাওয়ার মাঝপথে নিজের টুকু শেষ করেই মোহিনী বলে উঠলো তার হয়ে গেছে সে এখন একটু বাহিরে ফ্রেন্ডদের নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আগে হয়তো ফিরে আসবে। মেহুর কথায় খাবার থামিয়ে দিলো উজান। মুখ তুলে কঠিন চোখে মেহুর উপর প্রশ্ন তুললো।
-তুমি এই পোশাকে বাহিরে বের হবে মেহু?
-এই পোশাকে মানে! আমি তো এর আগেও এই পোশাক পড়ে বেড়িয়েছিলাম উজান। তাতে কি?
-তাতে কি মানে। আমি এর আগেও অনেকবার নিষেধ করেছিলাম তুমি ঢাকা গিয়ে যা ইচ্ছে করো কিন্তু এসব এখানে চলবে না। তুমি তারপরো কেনো? এসব আমার একদম ভালো লাগে না মেহু।
-এখন তো তোমার আমার কোনো কিছুই ভালো লাগবে না উজান!
বলেই ভাতের প্লেট টা সামনে চটকে দিয়ে মেহু তার রুমের দিকে পা বাড়ালো। দাদিমণি ঠান্ডা গলায় উজানকে বোঝাতে চেষ্টা করলো কিন্তু উজান শুনলো না। মেহুর জন্য এর আগেও তাকে কথা শুনতে হয়েছিলো কিন্তু এবার যেনো একটু বেশি লাগামহীন হ’য়ে যাচ্ছে সে। হিয়া এবার ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো,
-দিলেন তো মেয়েটার খাওয়া টা নষ্ট করে। আমি এর আগেও দেখেছি আপনি মেহুর উপর সবসময় এরকম করেন। এভাবে না রাগ করে শান্ত ভাবে তাকে বোঝালেই সে ঠিক বুঝবে।
-আপনি কতোটা জানেন মেহু সম্পর্কে?।
-দেখুন জানা টা বড় কথা না। এতদিনে এতটুকু তো আমি চিনেছি মেহু ঠিক কি রকম। মেহুর পোশাক নিয়ে সমস্যা তো আপনার। ঠিক আছে আমি বলছি মেহু এ পোশাকে আর কখনো বাহিরে যাবে না।
উজান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো তা কখনোই সম্ভব নয় মিস মুনতাসীর ৷ হিয়া হাসলো সে জানে মেহুকে ঠিক কি করে রাজি করানো যায়। সে দাদিমণির কানে কানে গিয়ে বললো দাদিমণি যাতে মেহুকে গিয়ে বলে এই জামা টা সে হিয়ার জন্য কিনেছিলো তাকে ভীষণ মানাবে নাকি। মেহু তো এসব পড়ে না,কি বুঝবে তার মর্ম। দাদিমণিও হিয়ার কথা অনুযায়ী তাই করলো। আরো রস ঢেলে মেহুকে কথা গুলো বলতেই সাথে সাথে কথাগুলো গিয়ে লাগলো মেহুর কলিজাতে,এই পোশাকে নাকি তার চাইতে হিয়াকে বেশি সুন্দর লাগবে। অসম্ভব। সে দাদিমণিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললো সে এই পোশাক পড়বে আর তাকে হিয়ার থেকে ঠিক কতো টা সুন্দর লাগে তাই সে দেখাবে…….হিয়ার উদ্দেশ্য সফল। মেহু হিয়ার থেকে নিজেকে বেস্ট প্রভ করতে দাদিমণির দেওয়া জামা পড়ে বেড়িয়ে পড়লো বাহিরে। এদিকে উজান হতবাক। সাথে নিবিড় সাহেবও অবাক। দাদিমণি হেঁসে দিয়ে উজানকে ঘুতো দিয়ে বললো এতোদিনে বাড়িতে একটা যোগ্য মানুষ ঢুকেছে,হিয়া যেমন কথার জালে মেহুকে ফাসালো ওমনি তোকেও দেখিয়ে দিলো তুই কতো অক্ষম হু। দাদিমণির কথায় উজান হাসলো। হিয়ার কাছে নিজের অপারগতা স্বীকার করে নিলো অকপটে। হিয়া মুচকি হেসে বিজয়ী ভঙ্গিতে স্পর্শকে খাওয়াতে উপরে উঠে আসলো। হিয়ার এই এক ফালি হাসি উজানের ভেতরের স্বত্বা টাকে জাগিয়ে তুললো। চুপিসারে উজানকে এসে বললো এরপরো তোমার কোনো সন্দেহ আছে উজান…!!
!
!
দেখতে দেখতে সময় গুলো ফুরিয়ে তিনটে মাসের কাছাকাছি হয়ে আসলো। এই তিন মাসে স্পর্শ আর হিয়া দুজন যে দু’জনকে এতো টা আপন করে কাছে টেনে নিবে এটা উজান বা দাদিমণি সবার জন্য ছিলো অবিশ্বাসযোগ্য। স্পর্শ যেনো হিয়ার মাঝে তার মায়ের কোল খুঁজে পেতে থাকলো। এদিকে হিয়াও এক অজানা টানে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত সেই মাতৃত্বকে বিলিয়ে দিতে থাকলো স্পর্শের মাঝে। দু চারদিন নিজের ঠিক করে দেওয়া রুমে থাকলেও পরে স্পর্শকে ছাড়তে কিছুতেই মন চাইলো না হিয়ার। সে ঠিক করলো সে দাদিমণির রুমে সে স্পর্শ আর দাদিমণি থাকবে। দাদিমণি দ্বিমত পোষণ করলেন না বরং কথাটা শুনে উনি আরো খুশি হলেন। স্পর্শকে ঘুম থেকে তুলে,খাওয়া থেকে শুরু করে আবার রাতে ঠিক মতো খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া সবটা হিয়া একা হাতে করতো। দাদিমনি চাইলেও কিচ্ছু করতে দিতো না। এর বেশি এ বাড়িতে তেমন আর কাজ ছিলো না হিয়ার। স্পর্শ ঘুমালে বা নিবিড়ের সাথে বাহির হাঁটতে বের হলে হিয়া কিছু সময় ওর বই গুলো নাড়াচাড়া করতো কখনো বা সেলাইয়ের কাজে দাদিমণিকে সাহায্য করতো।
এদিকে উজানো এই কটা মাসে হিয়ার ব্যবহার থেকে শুরু করে হিয়ার মুখের এক ফালি হাসিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করলো। সব মেয়ে তো তাকে,ঠিক না তাদের এই বিশাল শাহরিয়ার কুঞ্জে আসার জন্য একটু বেশি হেংলামোপোনা করতো। যেচে এসে গায়ে ঝুলতো কিন্তু হিয়া,হিয়া যেনো একটু বেশি অবাধ্য তার। উজান বাড়ির সবার সামনে একটা গাম্ভীর্যের বিস্তার ঘটালেও হিয়ার সামনে এমন সব কাজকর্ম করতো যে হিয়ার বুঝতে বাকি থাকতো না এই লোকটা তার নিজেকে হিয়ার মাঝে ধীরে ধীরে বিলিয়ে দিচ্ছে।
_______________________________
হিয়ারই সমবয়সী হিয়ার ফুফাতো বোন বুলবুলি। সবাই ছোট্ট করে বুলি বলেই ডাকে।অতি সুন্দর উপাধি দিতে গেলে যা দরকার হয় তার পুরোটাই তার মাঝে বিদ্যমান। এই সৌন্দর্য যেকোনো ছেলেকে কাবু করতে যথেষ্ট। তার এই সৌন্দর্য পেতে মরিয়া হয়ে থাকে অনেক পুরুষই। সেই তালিকা থেকে বাদ যায় না বিহান নিজেও। হিয়ার থেকে যখন কিচ্ছু পেতে পারলো না তখন চাকচিক্যের আড়ালে মুড়ে নিলো সে বুলিকে। বুলির অপরিপক্ক মস্তিষ্কে একটা নেশা তৈরি করে দিলো হিয়ারই অগোচরে। সেই বিহানের সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়েই একদিন বুলি মুখোমুখি হলো অর্পার। অর্পা কিছু বললো না তবে সে বেশ বুঝতে পারলো হিয়ার বিয়ে ভাঙা নিয়েই কিছু কথা বলছিলো বুলি। যার রহস্য জানতে এবার হিয়ার পাশাপাশি গোয়ান্দার খাতাতে নাম লিখতে প্রস্তুত হলো অর্পা নিজেই।
______________________________
দুপুরে স্পর্শকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানায় একটা বড় কাথা নিয়ে বসেছে দাদিমণি আর হিয়া। দু’জনে দুদিক থেকে ধরে কাঁথায় সেলাই বুনছে আর হাজারো কথার ফুলঝুরি ফুটাচ্ছে। হঠাৎই গল্পের মাঝে দাদিমণি হিয়াকে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলো যেটা ছিলো হিয়ার কাছে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত একটা বিষয়!
– আমার নাতি টাকে বিয়ে করবি হিয়া?
দাদিমণির এই কথা শুনে সেলাই থামিয়ে দিলো হিয়া। হিয়া স্তব্ধ সাথে কম্পিত। এটা কি বলে দিলো দাদিমণি! নিজেকে সামলে নিয়ে হিয়া স্বাভাবিক ভাবে তার মুখে এক ফালি হাসি টেনে বললো,
-ধ্যাত পাগল তুমি দাদিমণি__তোমার নাতির মতো একটা কঠিন মানুষকে বিয়ে করবো আমি। সারাজীবন না শাসন এর উপর দিয়ে থাকতে হবে। এটা করা যাবে না। ওটা ঠিক না। এটা সময় মতো কেনো হয়নি। আরো কতো কঠিন কঠিন জিনিস
-ধুর পাগলি। আমার উজান মোটেই কঠিন না। সে শুধু সঠিক টাকে সঠিক আর ভূল টাকে ভূল ব’লেই বিচার করে চলতে চেষ্টা করে। এছাড়া ওর মন টা একদম নরম।
-কচু নরম। ফাজিল একটা লোক। তুমি তো জানো না উনি আসলে ঠিক কি রকম। আসলে আমি না নিজেও বুঝতে পারি না উনি আসলেই ঠিক কি রকম। এরকম না ওরকম।
-কি বলছিস বল তো একা একা। ছাড় ওসব আমি উজানের চোখে তোর জন্য ভালোলাগা দেখেছি। তুই রাজি থাকলে আমি তোর ফুফুকে বলে না হয়
-বাদ দেও তো দাদিমণি এসব কথা। এটা কখনো সম্ভব না। ওসব ছাড়ো তুমি যে বললা প্রতি বছর বৈশাখে নাকি বাড়িতে সব আত্মীয় স্বজন এক হয়। তো আর এক মাস বাদে তো বৈশাখ এবার আসবে না সবাই?
-আসবে মানে। বৈশাখে আমাদের বাড়িতে কতো মজা হয় তুই শুধু তাই দেখবি। যতোই রেশারেশি চলুক এই দিনে ঐতিহ্য অনুযায়ী হাল খাতার আয়োজন হয়।আর নিয়ম অনুযায়ী উজান সব হিসাব করে যার যার ব্যবসায়িক পাওনা মিটিয়ে দেয়। তাই না চাইতেও সবাই এসে জড়ো হয় এই শাহরিয়ার কুঞ্জে।
-রেশারেশি কেনো বলছো দাদিমণি? বাড়িতে কি সবার সাথে সবার মনোমালিন্য আছে?
-শুধু কি মনোমালিন্য রে মা আরো যে কতো কি চলে। বাদ দে ওসব মনে করলেও কষ্ট হয় আমার।
-কেনো দাদি তুমি যে বললে ঔ ওনার সব কাজিন’রা নাকি একসাথে এ বাড়িতে থাকতো। বিহান নিলয় স্নেহা আর কি কি নাম বললে ওদের সাথে কি ওনার সম্পর্ক ভালো না। না মানে কখনো সেভাবে…
হিয়া আর কিছু বলতে যাবে সেই মুহুর্তে মোহিনী রুমে এসেই হিয়াকে জেড়া করতে শুরু করলো।ভয়ে আঁতকে উঠলো হিয়া।
-তুমি তো এ বাড়িতে নার্স হিসাবে জয়েন করেছো তাই না। তাহলে এ বাড়িতে কে কোথায় থাকে,কার সাথে কার কি সম্পর্ক এতে এতো নজরদারি কিসের তোমার?
মোহিনীর কথায় দাদিমণি রাগ করে তার দিকে ঝারি দিয়ে উঠলো। এ কেমন আচরণ করছে মেহু হিয়ার সাথে। মেহু দাদিমণিকে পাওা দিলো না বরং উল্টে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো
-তোমার মনে হয় না দাদিমণি ইদানীং তুমি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করো এই মেয়ে টাকে নিয়ে। আর তোমাকে বলছি,আমার কিন্তু নজর তোমার উপর সবসময়ই থাকে। সেদিন ও দেখলাম নিবিড়ের সাথে বাড়ির সবার ব্যাপারে কথা বলছিলে।
-আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন।
-তাই,সময়ই বলবে সেটা।
আরো অনেক কথা শুনিয়ে মেহু রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।দাদিমণি বললো মেহুর কথায় মন খারাপ না করতে ওহ কেনো জানি প্রথম দিন থেকেই তোকে সহ্য করতে পারে না। হিয়া কিছু বললো না শুধু একটাই ভয় বাসা বাঁধলো তার মেহু যদি কখনো সত্যি সত্যি তার উদ্দেশ্য জানতে পারে। হিয়ার কাছে এই তিন মাসে সবকিছু অনেকটা পরিষ্কার এখন শুধু সে একবার মুখোমুখি হতে চায় বিহানের!
!
!
রাতের দিকে স্পর্শকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের বই টা খুলে স্পর্শের গা ঘেঁষে শুইয়ে ছিলো হিয়া। সে তো বই পড়ছে কম পাতা উল্টোছে বেশি। হালকা করে কাশি দিয়ে উজান রুমে ঢুকলো। হিয়া সোজা হয়ে বসে গায়ের ওড়না টা ঠিক করলো। উজান বিছানায় বসে স্পর্শের মাথায় হাত বুলে দিলো। আজ বড্ড হিংসে হচ্ছে তার। আগে স্পর্শ উজান বলতেই পাগল ছিলো উজানই ছিলো তার মা তার বাবা কিন্তু হিয়া আসার পর স্পর্শের কাছে তার গুরুত্ব কিছুটা হলেও কমে গিয়েছে। উপরন্তু আগে তো সময় সুযোগ পেলেই স্পর্শকে নিয়ে ঘুমোতো সে এখন তো হিয়া তার সেই অধিকার টাও কেঁড়ে নিয়েছে।
-খুব তো বাচ্চা টার জন্য চিন্তা করেন। তা সারাদিনে তার কাছে আসার এখন নিয়ে সময় হলো আপনার?
উজান মুচকি হেসে উওর দিলো,
– কি করবো বলুন। মাঝেমধ্যে কাজের এতো চাপ এসে যায়। আর তাছাড়া পরশও তো এখন সারাক্ষণ ইয়া ইয়া (হিয়া হিয়া স্পর্শের আধো আধো স্বরে উচ্চারিত হয় ইয়া ইয়া) করে আমার আর প্রয়োজন টা কোথায় তার।
-এতে বুঝি আপনার খুব হিংসে হয়?
– হিংসে হওয়া টা কি স্বাভাবিক নয়_____ঘুমোননি কেনো এখনো। বই পড়ছিলেন?
-হুম
উজান হিয়ার হাত থেকে বই টা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে থাকলো। ইংলিশ লিটারেচার এর বই ছিলো একটি।
-ওহ আপনি তো আবার ইংলিশ এর স্টুডেন্ট। আমি অবশ্য ইংলিশ কম পাড়ি। আপনার কথা স্মরণে থাকবে। এরপর ফরেন থেকে কোনো প্রডাক্টের জন্য ইমেইল আসলে আপনাকে দিয়ে পড়াবো। মাঝেমধ্যে কিছু ওয়ার্ডের মিনিং জানা থাকে না। আপনি হেল্প করবেন…….কি করবেন তো, স্যালারিও দেবো সমস্যা নেই,কতো দিতে হবে বলুন?
হিয়া হাসলো, হেঁসে উওর দিলো
-আপনি তো এ্যাকাউন্টিং এর স্টুডেন্ট। হিসাব নিকাশ ভালোই পারেন। আপনি একটু হিসাব করে দিয়ে দিয়েন।
-বেশ! তাহলে তাই হবে?
– তবে যখন আমি থাকবো না তখন কি করবেন।
-কেনো থাকবেন না বলছেন?
-আরে,স্পর্শ কি সবসময় ছোট থাকবে,একদিন বড় হবে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। আমিও তখন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।
-স্পর্শের প্রয়োজন ফুড়াবে না আপনার, কোনটা?
-মানে!
-আপনি চাইলেই সারাজীবন এ বাড়িতে স্পর্শের মা বাবা যাই বলি সেটা হ’য়ে থাকতে পারেন। আমাদের কারো কোনো আপওি হবে না।
-বালাইষাট। আপনাদের বাড়িতে অহেতুক থাকতে কেনো যাবো আমি। আমার কি কখনো বিয়ে হবে না সংসার হবে না।
-হবে কেনো হবে না?
-তাহলে কিভাবে হবে? আমার যে হাসবেন্ড হবে সে যদি স্পর্শকে গ্রহন করতে না চান তখন?
– এমন কাউকে বিয়ে করে নিলেই তো হচ্ছে যে আপনার পাশাপাশি স্পর্শকেও গ্রহন করবে!
উজানের কথার মানে বুঝতে দেড়ি হলো না হিয়ার। কিন্তু এটা যে কখনোই সম্ভব নয়। হিয়া প্রসঙ্গ বদলাতে চাইলো।
– ছাড়ুন ওসব কথা। অনেক রাত হচ্ছে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
-যাবো বলছেন?
– হ্যা যান।
-আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?
-না অবাক হচ্ছি। আপনি অন্য সবার সাথে কতো মেপে ঝুঁকে কথা বলেন আর আমার কাছে আসলেই কিরকম ভাঙ্গা রেডিও হয়ে যান। টিয়া পাখির মতো কথা বলতেই থাকেন। তখন আপনার সেই গাম্ভীর্য কোথায় হারিয়ে যায় শুনি?
-বিশ্বাস করুন আমি নিজেও জানি না সেগুলো কোথায় হারিয়ে যায়। আপনাকে দেখলেই মনে হয় সারাক্ষণ কথা বলি।
-তাই, কথাটা মেহুকে গিয়ে বলতে পারবেন আপনি?
-আপনি সুযোগ দিলে মেহু কেনো বাড়ির সবাইকে বলতে পারবো।
উজানের কথায় হিয়া লজ্জা পেলো ভীষণ।স্পর্শের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো “যান তো আপনি,একটু বেশি কথা বলে ফেলেন আজকাল” উজান মুচকি হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে এসে নিজেকে একবার দেখে নিলো। রুম থেকে বেড়িয়ে পড়তে যাবে ওমনি কি মনে করে আবার এসে হিয়ার পাশে বসলো। হিয়া বিরক্তি নিয়ে বললো আবার কি চাই, স্পর্শ উঠে যাবে তো।
-কাল একবার ভোরের দিকে আমার সাথে বের হতে পারবেন!
হিয়া বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো কেনো? ভোরে হঠাৎ!
-আমাকে বিশ্বাস করেন তো আপনি। কোনো ক্ষতি হবে করবো না আপনার।
– আমি সে কথা বলেছি একবারো। কিন্তু এতো ভোরে মেহু জানতে পারলে,
– মেহু কখনোই ভোরে ওঠে না। আপনি উঠেন, নামাজ পড়তে আমি জানি৷ প্লিজ না করবেন না।
-হ্যা কিন্তু। ওতো সকালে কোথায় যাবো আমরা?
– আপনি সেদিন ছাঁদে কি জানি বললেন আপনার পছন্দের ফুল জারুল সোনালু তাই তো। কাল আমি আপনাকে এর চাইতেও সুন্দর কিছু দেখাবো। তৈরি থাকবেন। আসছি আমি___শুভ রাএি।
বলেই উজান চলে যেতে হিয়া খানিকটা ভাবনার জগৎ এ হারিয়ে গেলো। কোথায় নিয়ে যেতে পারে উজান তাকে এই কাক ভোরে। ভেবেও কিছু কূল কিনারা বিহিত করতে না পেরে হিয়া ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিতে উঠে দাঁড়ালো। আর পায়ের কাছে বালিশ টা তুলতে গিয়েই আবিষ্কার করলো একটা নীল রেপিং পেপারে মোড়া প্যাকেট!
চলবে……