তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-১৯+২০

0
667

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ১৯

ফজরের নামাজ আদার করে পাভেল, শরীফ, পারফি ও শাফিন এক সাথে বাসায় প্রবেশ করলো। সবার মন খুব ফুরফুরে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চারজনে এক সাথে হাসি আনন্দ গল্প করতে করতে আসছে। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর সবাই এক সাথে প্রাণ খুলে হাসছে গল্প করছে।
তখন মসজিদে যাওয়ার আগে পারফি শাফিনকেও ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। পাভেল চৌধুরী আর শরীফ শিকদার সে কি খুশি ছেলেদের এভাবে সকাল সকাল নামাজে যাওয়ার জন্য।

বেলকনি থেকে ইয়ানা চারজনের হাসিখুশি মুখশ্রী মুগ্ধ হয়ে দেখলো। তারা সবাই কতোটা প্রাণবন্ত, কতটা মিশুক দেখতেও ভালো লাগে।

ইয়ানা বেলকনির রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে স্নিগ্ধ সকালের আবহাওয়াটা অনুভব করতে লাগলো তখন হঠাৎ পিছ থেকে পারফি বলে উঠলো এই ঠান্ডার ভিতরে বেলকনিতে কি করছো?

কারো কন্ঠস্বর শুনে ইয়ানা পিছু ঘুরে তাকালো। পিছে তাকাতে চোখে পড়লো পারফি দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে। ইয়ানা এবার আস্তে করে বললো এমনি দাঁড়িয়ে আছি, ভালো লাগছে সকালের এই আবহাওয়াটা।

পারফি মুচকি হাসি দিয়ে বললো ঠান্ডা লেগে যাবে। এবার ভিতরে এসে ঘুমিয়ে পড়ো।

ইয়ানা বাধ্য মেয়ের মতো সম্মতি দিয়ে রুমে চলে আসলো।

পারফিও ইয়ানার সাথে আসলো তারপর সোফায় চলে গেলো এখন একটু ঘুমের প্রয়োজন। রাতে ভালো ঘুম হয় নি তাই মাথা ধরেছে।

পারফিকে আবার সোফায় শুতে দেখে ইয়ানা ভাবলো বেডে শুতে বলবে কিনা। অবশেষে নিজের ভিতর জড়তা কাটিয়ে থেমে থেমে ইয়ানা পারফির উদ্দেশ্যে বললো আপনি চাইলে এখন বেডে শুতে পারেন, সোফায় শুতে কষ্ট হবে আপনার।

পারফি তাকালো ইয়ানার দিকে তারপর ধীর গলায় বললো সমস্যা নেই আমি এখানে শুতে পারবো।

ইয়ানা কি বলবে বুঝতে পারলো না। বুঝতে পারছে যে পারফি ওর জন্যই বেডে আসতে চাচ্ছে না কিন্তু ওর জন্য লোকটা এতো কষ্ট করবে ভাবতে খারাপ লাগছে ইয়ানার। তাই ফের পারফিকে বললো আপনি বেডে আসতে পারেন আমি এখন ঘুমাবো না। বেড তো ফাঁকা আছে তাই ঘুমাতে পারেন।

পারফি ভ্রু কুঁচকে বললো ঘুমাবে না কেনো?

আ..আসলে এখন ঘুম পাচ্ছে না, আপনি ঘুমান না। আমার ঘুম পেলে সোফায় ম্যানেজ করে নিতে পারবো।

পারফি বুঝলো ইয়ানা ওর জন্যই এমন করছে তাই বসা থেকে উঠে ইয়ানার সামনে এসে দাঁড়ালো।

পারফিকে হঠাৎ নিজের সামনে আসতে দেখে কিছুটা ভড়কে গেলো ইয়ানা।

ইয়ানাকে অবাক করে দিয়ে পারফি ইয়ানার গাল টেনে দিয়ে বললো বাচ্চা মেয়ে আমার জন্য এতো চিন্তা করতে হবে না বুঝলে এখন চুপচাপ শুয়ে পড়ো।

পারফির এভাবে গাল টেনে দেওয়াতে বেকুব বনে গেলো ইয়ানা। ঠোঁট উল্টে ভাবলো আমি কি বাচ্চা যে এভাবে গাল টেনে দিলো? আবার বাচ্চা বলেও সম্মোধন করলো।

ইয়ানাকে এমন ঠোঁট উল্টাতে দেখে শুকনো ঢোক গিললো পারফি। এই মেয়েকে এমন ঠোঁট উল্টালে যে কি মারাত্মক লাগে আর তাতে যে কারো বুজে ঝড় বয়ে যায় সেটা কি এই মেয়ে জানে? এটা ভারী অন্যায়। অন্যের বুকে ঝড় উঠিয়ে দিয়ে নিজে রিলাক্সে দিন পার করছে।

নিজেকে সামলে পারফি ডাক দিলো বিড়াল ছানা….

বিড়াল ছানা ডাকটা শুনে চমকে তাকালো ইয়ানা পারফির দিকে। বিড়াল ছানা বললে আগে রাগ লাগতো কিন্তু সব সময় এই নামটা পারফির মুখে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই ছোট করে বললো জ্বি?

পারফি কিছু বলতে যেয়েও বললো না, কথা ঘুরিয়ে কোমল স্বরে বললো যাও ঘুমাও এখন জেগে থেকে একা একা কি করবে? এতো সকালে কেউ উঠবে না যে যার রুমে আছে।

ইয়ানা সম্মতি দিয়ে বললো তাহলে আমি সোফায় যাই? সত্যি আমার সমস্যা হবে না।

ইয়ানার কথায় হালকা হাসলো পারফি, এখন বেডে না গেলে যে এই মেয়ে মন খারাপ করবে তা ভালো করেই জানে তাই পারফি সম্মতি দিয়ে বেডে শুয়ে পড়লো।

পারফি ওর কথায় সম্মতি দিতে ইয়ানা খুশি হয়ে গেলো। তারপর আস্তে ধীরে সোফায় যেয়ে ছোট শরীরটা এলিয়ে দিলো সোফায়। তেমন একটা সমস্যা হলো না এভাবে শুতে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।

দরজায় কারো করাঘাতে ঘুম ভাঙলো ইয়ানার। আস্তে ধীরে উঠে দরজা খুলতে প্রীতিকে দেখতে পেলো।

প্রীতি ইয়ানাকে একপাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো ঘুম কেমন হলো ভাবিজী?

প্রীতির মুখে ভাবি ডাক শুনে থতমত খেয়ে গেলো ইয়ানা। কুনোই দিয়ে পাশ থেকে ইয়ানাকে খোঁচা মেরে বললো আমাকে ভাবি বলছিস কোন দুঃখে?

প্রীতি হেসে বললো তুই আমার ভাইর বউ তাহলে তোকে ভাবি ডাকবো নয়তো কি খালাম্মা ডাকবো?

ইয়ানা প্রীতির কান টেনে দিয়ে বললো ফাজিল মেয়ে উল্টা পাল্টা বকবকানির স্বভাব তোর জীবনেও যাবে না।

প্রীতি ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরে বললো তোর সাথে বকবক করবো নাতো কার সাথে করবো? সবাই নিচে ওয়েট করছে ফ্রেশ হয়ে নিচে চল।

পারফি পিছ থেকে বলে উঠলো যেভাবে চিপকে ধরে আছিস এভাবে থাকলে সারাদিন ও নিচে যেতে পারবে না আবার বলছিস তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতে।

পারফির কথায় প্রীতি ইয়ানাকে ছেড়ে কোমরে হাত দিয়ে বললো আমার জানুকে আমি ধরেছি দরকার হলে সারাদিন ধরে রাখবো কোনো সমস্যা?

সমস্যা মানে ওফ কোর্স সমস্যা। আমার বউকে তুই ক্যান ধরে রাখবি?

ওহ-হহহো এক দিনেই বউকে নিয়ে এতো জেলাস?

দুই ভাই বোনের কথায় ইয়ানা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। লজ্জায় গালে লাল আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। এই দুই ভাই বোনের মুখে যে কোনো কথা আঁটকায় না ভালো করেই জানে। এখন যে মুখ দিয়ে আরো কি কি বেফাঁস কথা বের করে তার ঠিক নেই তাই ইয়ানা ফাঁক বুঝে ওখান থেকে কেটে পড়লো। এখন এখানে থাকা মানেই লজ্জায় পড়া এর থেকে কেটে পড়া ভালো তাই চুপচাপ ওখান থেকে কেটে পড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

ইয়ানাকে এভাবে যেতে দেখে পারফি আর প্রীতি এক সাথে হেসে ফেললো।
——————
ডাইনিং টেবিলে সবাই বসে সকালের নাস্তা করছিলো তখন পাভেল চৌধুরী পারফি উদ্দেশ্যে বললো আমি চাচ্ছিলাম নেক্সট উইকে তোমাদের বিয়ের জন্য রিসিপশন করতে। যেহেতু বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হয়েছে তাই কেউ তোমাদের বিয়ের ব্যপারে জানে না তাই চাচ্ছিলাম রিসিপশন করে সবাইকে বিষয়টা জানিয়ে দেই এতে তোমার মতামত কি?

পারফি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো তোমার যেটা ভালো মনে হয় করো আমার সমস্যা নেই।

পিয়াসা বেগম বললো যাক ভালো তাহলে আর শোন বাবা আজ একটু ইয়ানাকে নিয়ে ওদের বাড়ি ঘুরে আয় তাহলে ওর একটু ভালো লাগবে।

ইয়ানা চমকে তাকালো পিয়াসা বেগমের দিকে। ওর সত্যি বাবার কাছে খুব যেতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু কাউকে বললো না আর পিয়াসা বেগম কিনা না বলতেও মনের অবস্থাটা বুঝে ফেললো ভাবতেই চমকে গেলো ইয়ানা। মনে মনে খুব খুশি হলো পিয়াসা বেগমের উপরে।

পারফি তাকালো ইয়ানার দিকে। বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে মেয়েটা যে খুশি হয়েছে তা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছ। মনে মনে বললো তোমার এই মুখে সবসময় এই খুশিটাই দেখতে চাই স্নিগ্ধ ফুল।

খাওয়া শেষ হলে পারফি ইয়ানার উদ্দেশ্যে বললো রেডি হয়ে নেও এ বলে উপরে চলে গেলো।

পাভেল চৌধুরী ইয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো সাবধানে যেও মামনী। যদি থাকতে ইচ্ছে হয় তাহলে আজ থেকে যেও সেখানে।

পাভেল চৌধুরীর কথায় অশ্রুসিক্ত নয়নে ইয়ানা তাকালো তার দিকে। এই বাসার লোক গুলো কতো ভালো কতোটা বোঝে ওকে ভাবতেই মনের ভিতর একরাশ ভালোলাগায় ভরে গেলো।

পাভেল চৌধুরী ইয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো কাজে। পাভেল চৌধুরী যেতে ইয়ানা কিছু একটা মনে করে পিয়াসা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো আন্টি একটা কথা বলি?

পিয়াসা বেগম টেবিলের সব কিছু গুছাতে গুছাতে বললো আমি কারো আন্টি না যদি কেউ মা বলতে পারে তাহলে কিছু বলতে পারে শুনতে পারছি।

ইয়ানা মুচকি হেসে বসা থেকে উঠে পিয়াসা বেগমকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো আন্টি না মানে মা প্রীতিকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই?

পিয়াসা বেগম হেসে একপাশ থেকে ইয়ানার গালে হাত রেখে বললো এবার ঠিক আছে। আর কখনো যদি আন্টি ডাকিস তাহলে মার খাবি আমার হাতে।

আচ্ছা আর ডাকবো না এবার বলো প্রীতিকে নিয়ে যাবো?

ও গেলে নিয়ে যাবি তা আবার আমাকে জিজ্ঞেস করা লাগে? তারপর প্রীতি দিকে তাকিয়ে বললো যাবি তুই?

প্রীতি লাফ দিয়ে উঠে বললো যাবো মানে অবশ্যই যাবো। আমি না গেলে হয় নাকি?

প্রীতির কথায় ইয়ানা আর পিয়াসা বেগম হেসে ফেললো তারপর ওরা রেডি হতে রুমে চলে গেলো।

সবাই রেডি হয়ে পিয়াসা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সোজা চলে গেলো ইয়ানাদের বাসার সামনে। বাসার সামনে গাড়ি থামাতে ইয়ানা আর প্রীতি নেমে দাঁড়ালো। পারফি গাড়ি থেকে না নেমে ইয়ানার উদ্দেশ্যে বললো আমার একটু জরুরি কাজ আছে তাই এখন বাসায় যেতে পারবো না। সমস্যা নেই রাতে আসবো তোমরা ভিতরে যাও আর সাবধানে থেকো।

ইয়ানা আর প্রীতি সম্মতি দিয়ে বাসার ভিতরে চলে গেলো। ইয়ানারা যেতে পারফি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফোন লাগালো শাফিনকে। শাফিনকে কিছু গার্ড নিয়ে অফিসের সামনে দাঁড়াতে বলে বললো আমি আসছি।

পারফির কথা মতো কিছু গার্ড নিয়ে শাফিন অফিসের সামনে দাঁড়ালো তখন আসলো পারফি।

পারফি নেমে আসতে শাফিন বললো কোনো সমস্যা? এখানে গার্ড নিয়ে আসতে বললি কেনো?

একটা জায়গায় যেতে হবে তাই এদের নিয়ে আসতে বলেছি চল এবার।

এখন আবার কোথায় যাবি?

গাড়িতে ওঠ তারপর বলছি এখন চল সময় কম আজকের ভিতরেই আবার সেখান থেকে ফিরতে হবে।

শাফিন আর কথা না বাড়িয়ে পারফির সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে লাগলো আর পিছু পিছু গার্ডের গাড়ি যাচ্ছে।

#চলবে?
#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ২০

পারফি, শাফিন আর কিছু গার্ড দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের মাঝে সেই বাড়িটার সামনে যে বাড়িতে পারফি আর ইয়ানাকে আঁটকে রাখা হয়েছিলো।
এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য হলো কোনো ক্লু খুঁজে বের করা। কারা এমন করেছিলো তাদের ধরার জন্য হলেও অন্তত একটা ক্লু তো লাতবেই। জানে এখন এখানে কেউ থাকবে না, সব ক্লু সরিয়ে ফেলবে তবুও আশায় আছে কোনো না কোনো ক্লু খুঁজে পাওয়ার।

সবাই এক সাথে ওই পুরোনো বাড়িটার কাছে গেলো। দরজার সামনে ঝুলে আছে বিশাল এক জং পড়া তালা। দেখে মনে হচ্ছে কয়েক যুগ থেকে এখানে কেউ থাকে না কিন্তু ধারণাটা পুরোটাই ভুল। এখানে সবসময় কেউ যাওয়া আসা করে, যাতে বাহিরের কেউ বুঝতে না পারে তাই এরকম পুরোনো করে রেখেছে জায়গাটা। কেউ যে প্রখর বুদ্ধিমত্তার সাথে এগুলো করছে তা খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শাফিন বললো তুই কি সিওর এটা সেই জায়গা? বাড়িটা দেখে তো মনে হচ্ছে কয়েক যুগ থেকে এটা তালাবদ্ধ।

পারফি শাফিনের দিকে তাকিয়ে বললো জানতাম তুই মাথা মোটা কিন্তু এখন দেখছি তার থেকেও অধম তুই। এটা ওদের গোপন আস্তানা, এখন এখানে কি তোর জন্য সোনা দিয়ে বাধাই করে চকচকে করে রাখবে? গাধা একটা…..

শাফিন ঠোঁট উল্টে বললো এভাবে বলতে পারলি তুই আমাকে? ভালো করে বুঝিয়ে বললেইতো হয়। আমার এই ছোটখাটো সহজসরল মাথাটা এতো পেছগোছ বুঝে না তা জানিস না?

হয়েছে তোর পকপক থামা এবার তালা ভাঙার ব্যবস্থা কর।

শাফিন গার্ডের নির্দেশ দিলো তালা ভাঙতে। তারা তালা ভেঙে দিতে ভিতরে প্রবেশ করলো পারফি আর শাফিন। গার্ডের বলে দিলে বাহিরে পাহাড়া দিতে।

শাফিন আর পারফি ভিতর প্রবেশ করতে দেখলো ধুলোবালিতে পুরো ঘর ভরে আছে এটা যে ইচ্ছাকৃত ভাবেই করেছে তা জানা আছে পারফির কারণ সেদিন এই ঘর পুরো ক্লিন ছিলো।

এদিকে শাফিন মনে মনে ভাবছে পারফি ওকে ভুল জায়গায় নিয়ে এসেছে কারণ এই বাসার যে ছিরি দেখে মনে হচ্ছে কয়েক বছর থেকে কেউ পাও দেয় নি কিন্তু মুখে কিছু বললো না। এখন কিছু বলা মানে পারফির থেকে এতোগুলা কথা শোনা তাই চুপচাপ পারফির পিছু পিছু যেতে লাগলো।

পারফি চারেদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে প্রথমে চলে গেলো সেই রুমে যে রুমে ওদের বেঁধে রাখা হয়েছিলো। সেখানে যেতে দেখতে পেলো সেদিনের সেই চেয়ার দুটো ভেঙেচুরে নিচে পড়ে আছে বুঝলো যে ওদের খুঁজে না পেয়ে কেউ এই চেয়ার দুটোর উপরে নিজের জিদ ঢেলেছে। তারপর কিছুটা দূরে পড়ে আছে কিছু রশি যেগুলো দিয়ে ওদরে বাঁধা হয়েছিলো। এগুলো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না।

পারফির সাথে সাথে শাফিন ও সব কিছু পর্যবেক্ষণ করলো। সব কিছু দেখে এবার শাফিনের মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায় এই এসেছে। এতক্ষণ নিজের বোকা বোকা ভাবনার জন্য নিজের মাথায় নিজের চাপর মারলো।

ওই রুমে কোনো কিছু খুঁজে না পেয়ে পাশের রুমে চলে গেলো এভাবে এক এক করে সবকয়টা রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো কিন্তু কোনো ক্লু চোখে পড়লো না। সব প্রমাণ যে নিখুঁত ভাবে মুছে দিয়ে গেছে তা বুঝতে পারলো।

শাফিন বললো শালা খুব ধূর্তবাজ কিভাবে সব প্রমাণ একবারে লুট করে দিয়েছে।

তাইতো দেখছি চল এখানে বেশি সময় থাকা ঠিক হবে না ওরা আগে থেকেই জানতো এখানে কেউ আসবে তাই আগে থেকে সব ক্লু সরিয়ে ফেলেছে।

পারফির কথায় শাফিন সম্মতি দিয়ে আশাহত হয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলো। গার্ডদের নির্দেশ দিলো তালাটা আবার লাগিয়ে দিতে আগের মতো। কথানুযায়ী গার্ডরা তাই করতে লাগলো।

পারফি আর শাফিন যেই চলে আসতে যাবে অমনি কিছুর উপরে পারফির চোখ আটকালো। বাসার সামনে শুঁকনো পাতার ফাঁকে একটা সিম পড়ে থাকতে দেখলো। পারফি নুয়ে সিমটা হাতে নিলো তারপর ভালো করে ওই জায়গাটা দেখতে চোখে পড়লো ফোন ভাঙার ছোট ছোট টুকরো যেগুলো গভীর ভাবে না দেখলে চোখে পড়ার মতো না।

পারফি সিমটা এপিট ওপিট করে দেখতে দেখতে বললো মনে হচ্ছে কেউ রাগ দেখিয়ে ফোনটা আছাড় মেরে ভেঙেছে যার দরুন সিমটা ফোন থেকে খুলে পড়ে গেছে। ফোনের টুকরোগুলো সরিয়ে ফেললেও হয়তো এই ছোট সিমটা চোখে পড়ে নি। মনে হচ্ছে এই সিম থেকে কিছু হলেও জানতে পারবো।

শাফিন বললো আমার ও তাই মনে হচ্ছে। তাহলে চল এখন যাওয়া যাক আশা করি এই সিম থেকেই আসল কালপ্রিট এর কাছে পৌঁছাতে পারবো।

পারফি সম্মতি দিয়ে সবাইকে নিয়ে বের হলো ওই জায়গা থেকে। এখন বিকেল হয়ে গেছে এবার ঢাকা ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যাবে তাই ওখানে আর সময় নষ্ট না করে ঢাকা উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
——————————————-
এদিকে বিকেলে ছাঁদে বসে ইয়ানা, ইমা আর প্রীতি গল্প করছিলো। ইয়ানা সবার সাথে গল্প করলেও ওর মন বসছে না গল্পে। আসার পড় থেকে ইতি বেগমের সাথে দেখা হয় নি। কেনো যেনো একটা বার মায়ের মুখটা দেখার জন্য হাসফাস করতে লাগলো। ইচ্ছে করলো ছুটে যেতে তার কাছে কিন্তু সেদিনের কথা গুলো মনে করতে আর যেতে পারলো না তার কাছে। তাকে আর বিরক্ত করতে চাইলো না।

ইয়ানার গল্পের দিকে মন না দিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে থাকতে দেখে ইমা বললো কি হয়েছে তোর এতো কি ভাবছিস?

ইয়ানা নিজেকে সামলে বললো না কিছু না।

প্রীতি ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো আমাদের বোকা পেয়েছিস? তুই কিছু না বললি আর বিশ্বাস করে নিলাম। তোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোর মনে কিছু একটা চলছে, কি হয়েছে সত্যি করে বল।

ইয়ানা কি করবে বুঝতে পারলো না। বলবে কি বলবে না দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলো অবশেষে ওদের জোরাজোরিতে ইয়ানা থেমে থেমে বললো আসলে মাকে এক নজর খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মাতো আমার উপরে বিরক্ত তাই এই বিরক্ত মুখশ্রী নিয়ে তার কাছে যেতে পারলাম না বলতে বলতে চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো ইয়ানার।

ইয়ানার কথায় প্রীতি আর ইমার মন ও খারাপ হয়ে গেলো। ইমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো জানিনা মা এতোদিন কেনো তোর সাথে এমন করতো। কিন্তু তুই যাওয়ার পর থেকে একটাবার এর জন্য রুম থেকে বের হয় নি। বাবা ও রাগ করে মায়ের সাথে কথা বলে নি এখনো। আমি গিয়েছিলাম কয়েকবার কথা বলতে কিন্তু লাভ হয় নি। কোনো কথা বলে নি, কিছু খায় ও নি। কালকে থেকে না খাওয়া।

ইমার কথায় ইয়ানার বুকের ভিতর কামড় মেরে উঠলো। মা যতোই ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করুক না কেনো মাতো মা এই। মায়ের অবস্থা এমন শুনে ইয়ানার মন কেঁদে ইঠলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো আপু আ..আমি কি যাবো একবার মায়ের কাছে?

ইমা ফের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো কথা বলবে কিনা জানিনা, তবে যেয়ে দেখতে পারিস একবার।

ইয়ানা সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বললো তোমরা তাহলে গল্প করো আমি দেখে আসি মাকে এ বলে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছুটে চলে গেলো।

ইয়ানার যাওয়ার পানে প্রীতি তাকিয়ে ভাবলো এতো কিছুর পর ও মেয়েটা মায়ের জন্য কতটা পাগল হয়ে আছে। আন্টি যে কেনো ওর সাথে এমন করে ভাবতেই খারাপ লাগে।

ইয়ানা এক ছুটে ইতি বেগমের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। এবার ভিতরে যাবে কি যাবে না তাই ভাতে লাগলো। অবশেষে হালকা করে নিঃশব্দে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো। পুরো রুম অন্ধকার হয়ে আছে। অন্ধকারের মাঝে চোখে পড়লো ইতি বেগম চুপচাপ শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। ইয়ানা ধীর পায়ে বেডের কাছে এগিয়ে গেলো।

আস্তে করে ডাক দিলো….. মা।

মা ডাকটা শুনে বুকের ভিতর কামড় মেরে উঠলো ইতি বেগমের। বন্ধ করা চোখ খুলে সামনে তাকাতে অন্ধকার রুমে ইয়ানাকে দেখতে পেলো। ইয়ানাকে দেখে অপরাধবোধ টা আরো বেরে গেলো কয়েক গুন। দুটো দিন থেকে অপরাধবোধ তাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। না পারছে কাউকে কিছু বলতে আর না পারছে এই অপরাধে বোঝা বয়ে বেরাতে।

ইতি বেগমকে কোনো কথা না বলতে দেখে ইয়ানা আস্তে করে পাশে বসলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছে মা ভালো নেই তাই কোমল গলায় বললো কাল থেকে কিছু খাও নি নাকি?চলো খাবে এখন।

ইতি বেগম ছলছল চোখে তাকালো ইয়ানার দিকে। এই মেয়েটাকে এতোটা বছর কতোটা অবহেলা করে আসছে আর সেই মেয়েটা এখনো তার কথা ভেবে চলেছে ভাবতেই কষ্টে বুকটা ভারী হয়ে আসছে।

ইতি বেগমকে এবার ও কথা বলতে না দেখে ইয়ানা আস্তে করে ইতি বেগমের হাত ধরে বললো চলো এভাবে না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে।

ইতি বেগম এবার নিজেকে একটু সামলে ভাঙা গলায় বললো পড়ে খেয়ে নিবো আমি এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।

ইতি বেগমের এমন ভাঙা গলা শুনে ইয়ানা চমকে গেলো। তারমানে সত্যি মা ঠিক নেই, ইয়ানা তারাতাড়ি রুমের লাইট জ্বালিয়ে ইতি বেগমের দিকে তাকাতে থমকে গেলো। চোখনামুখ ফুলে আছে, চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে৷ মাকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ইয়ানা দ্রুত ইতি বেগমের কাছে যেয়ে তার দু গালে হাত রেখে বিচলিত হয়ে বললো এ কি হাল করেছো নিজের? কি হয়েছে মা তোমার? আমাকে বলো। বাবা রাগ করেছে দেখে কি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? আমি এখনি বাবাকে বলছি তোমার সাথে কথা বলতে প্লিজ আর কষ্ট পেও না। তোমার…

আর কিছু বলার আগে ইতি বেগম ইয়ানাকে ঝাপটে ধরে ডুকরে কান্না করে উঠলো।

মায়ের এমন কান্না দেখে ইয়ানা ও কান্না করে দিলো। মায়ের এতো কষ্টে ও নিজেও কষ্ট পাচ্ছে।কিভাবে মাকে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারলো না।

তখন ইতি বেগম কান্না করতে করতে বলে উঠলো আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। এতো বছর তোর সাথে অনেক বেশি অন্যায় করে ফেলেছি আমি। জানি আমার অন্যায়ের ক্ষমা হয় না। আমি তোকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিয়ে এসেছি যার অনুশোচনায় আজ আমি দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।

ইয়ানাও ইতি বেগমকে ঝাপটে ধরে কান্না করতে লাগলো। এক পর্যায়ে নিজেকে একটু সামলে ইতি বেগমের চোখে পানি মুছে দিতে দিতে বললো পুরোনো সব কথা ভুলে যাও মা। আমি ওসব কিছু মনে রাখি নি, এখন মা হয়ে মেয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে প্লিজ ছোট করবে না। আমরা মা মেয়ে মিলে আবার নতুন করে একটা জীবন শুরু করবো। পুরোনো সব অতীত পিছে ফেলে দিবো বুঝলে?

ইতি বেগম ইয়ানাকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে ফুপিয়ে কান্না করতে লাগলো।

ইয়ানা কিছুক্ষণ ওভাবে চুপ থেকে ইতি বেগমের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ইতি বেগমের হাত ধরে টেনে নিতে নিতে বললো অনেক হয়েছে কান্না এবার চলো কিছু খেয়ে নিবে এ বলে ইতি বেগমকে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে খাবার বেরে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো।

আজ ইয়ানা খুব খুব খুশি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। অনেক অপেক্ষার পর আজ মাকে আপন করে পেয়েছে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু আছে?

ইতি বেগম ইয়ানার দিকে ছলছল করে তাকিয়ে রইলো শুধু।

এদিকে ড্রয়িংরুমে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে ইয়ানা আর ইতি বেগমকে দেখছে প্রীতি, ইমা ও ইসহাক আহমেদ। ব্যপারটা যেনো কারো হজম হচ্ছে না। এটা কি সত্যি নাকি স্বপ্ন দেখছে তাও বুঝতে পারছে।

ইমা এটা সত্যি নাকি স্বপ্ন দেখছে তা বোঝার জন্য প্রীতিকে বললো প্রীতি আমাকে একটু চিমটি কাটতো, আমি কি চোখে ঠিক দেখছি নাকি স্বপ্ন দেখছি?

প্রীতি বেখেয়ালি ভাবে ইমার হাতে চিমটি কেটে বললো আমার ওতো একি অবস্থা আপু। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুলছে না।

এদিকে ইসহাক আহমেদ থম মেরে বসে রইলেন। সত্যি নিজের চোখকে কেনো যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। বিষয়টা হজম করতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার কাছে।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে