#তুমি_আমার_প্রিয়তমা
#লেখিকা_Amaya_Nafshiyat
#অন্তিম_পর্ব
এরপর কেটে গেছে প্রায় ৩ টা বছর,
সময় যে কারও জন্য কখনো থেমে থাকে না তা আবারও প্রমাণিত হলো।
১০ মাস বয়সী বাচ্চা মেয়ে সুরভী দোকানের এটা ধরবে ওটা ধরবে বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।বেচারা সৌরভ একটা চিপসের প্যাকেট ও দুটো চকো চকো ওই ছোট ছোট হাতটিতে ধরিয়ে দিলো।সুরভী তাও আরও মজা কিনতে চায় দোকান থেকে।এতটুকুতে তার মন ভরছে না।যদিও পিচ্চিটা এগুলো তেমন একটা খায় না।শুধু কিনে দেয়ার জন্যই এত বাহানা।ছোট বাচ্চারা মূলত এমনই হয়ে থাকে।সুপরিচিত পাড়ার দোকানদার বাপ বেটির কান্ডকারখানা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
সুরভী বাবা বাব্বা বলে নিজের ভাষায় কতকিছু বলার চেষ্টা করছে সৌরভকে।সৌরভ দোকানদারকে মেয়ের জন্য কেনা চকোলেট চিপসগুলো ব্যাগে ভরে দিতে বললো।সুরভীর হাতে যেগুলো রয়েছে সেগুলো যদি পিচ্চিটা নিজে থেকে না দেয় তাহলে তা কেউ জীবনেও নিতে পারবে না।তাই সৌরভও ঘাটালো না তার জেদি মেয়েকে।তাও তার আম্মুটা খুশি থাকুক।
সৌরভ:-আমার আম্মুজান,এবার খুশি তো তুমি?
সুরভী বাপের দিকে তাকিয়ে প্রাণখোলা এক হাসি দিলো তার ইঁদুরে দাঁত চারটা বের করে।মেয়ের হাসি দেখে সৌরভও হাসলো।মেয়েটাকে হাসলে পুরোই প্রিয়তার মতো লাগে।দোকানদার সবকিছু প্যাকেট করে দিতে দিতে বললো;
দোকানী:-ভাতিজী তো দেখা যায় আমাদের সারা দোকান তুলে নেয়ার ধান্দা লাগিয়েছে।হে!কী গো ভাতিজী,এই বয়সে চিপস চকোলেটের জন্য পাগল হলে চলবে বলো?দাঁতে পোকা ধরবে না?
সুরভী আবারও তার চমৎকার দাঁত ক’টি দেখিয়ে দিলো দোকানীকে।চিপসের প্যাকেট বুকের সাথে চেপে ধরে ছন্দে ছন্দে বাব্বা বাব্বা বলতে লাগলো।সৌরভ মেয়ের গালে চুমু খেলো একটা।চিপসের প্যাকেটসমেত বাপের গলা জড়িয়ে ধরলো পিচ্চিটা।দোকানি সৌরভকে হাসিমুখে বললো;
দোকানী:-ভাইজানের তো এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ডিউটি তাই না?আমাদের মামণিকে নিয়ে এখন নিয়মিত দোকানে আসতে হবে,বুঝলেন ভাই!নয়তো আপনার লগে ঘোষা করবো আম্মাজান।
সৌরভ:-হ্যা ভাই,এই ডিউটি আমি অনেক আগে থেকেই করে আসছি।এককালে মেয়ের মাকে কোলে নিয়ে দোকানে আসতাম চকোলেট চিপস কিনে দেয়ার জন্য।এখন মেয়েকে নিয়ে আসি।মা যেমন মেয়েও তেমন হয়েছে।
দোকানী:-আল্লাহ আপনার এত সুন্দর পরিবারে রহমত দান করুন।
সৌরভ আমিন বলে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে আদুরে কন্ঠে বললো;
সৌরভ:-আম্মু চলো আমরা এখন বাসায় যাই।তোমার আম্মু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
সৌরভ দোকানীর টাকা মিটিয়ে বিদায় দিয়ে পলিথিন হাতে মেয়েকে কোলে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো।সারা রাস্তা মেয়ের সাথে কথা বলে বাসায় এলো সৌরভ।বাসায় ঢুকতেই মিসেস মিনা নাতনিকে নিজের কোলে নিয়ে নিলেন।সুরভী তার মজা আর কাউকে না দিলেও দাদীকে সে সব দিয়ে দেয়।দাদী যেমন নাতনীর জন্য পাগল নাতনীও তেমন দাদী বলতে অজ্ঞান।সুরভী মুখ দিয়ে বু বু শব্দ করে চকো চকো গুলো দাদীকে দিয়ে দিলো।
মিসেস মিনা:-ওরে আমার সোনা বোনটা রে।দাদীর জন্য কত ভালোবাসা আমার বোনটার!এখন আসো দাদু তোমাকে গোসল করিয়ে দিই আমি।
মিসেস মিনা সুরভীকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন গোসল করাতে।সুরভীকে গোসল করাতে পারে না প্রিয়তা।তার ভয় লাগে বাচ্চা কাচ্চা গোসল করাতে।মনে হয় এই হাত পিছলে পড়ে যাবে।তাই এই দায়িত্ব সুরভী হওয়ার পর থেকে মিসেস মিনাই পালন করে আসছেন।
সৌরভ নিজের রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেল,সুরভীর কাপড় চোপড় সব ভাজ করে পরিপাটি ভাবে র্যাকে তুলে রাখছে প্রিয়তা।সৌরভ পলিথিন ব্যাগটা বিছানার ওপর রেখে গিয়ে পিছন থেকে প্রিয়তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিলো।প্রিয়তা সৌরভের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো;
প্রিয়তা:-চলে এসেছো?মেয়েকে কার কাছে রেখে এলে?
সৌরভ:-আম্মু গোসল করাতে নিয়ে গেছে।মেয়েটা বড্ড চঞ্চল হয়ে গেছে এই বয়সেই।হুবহু তোমার ফটোকপি।ছোটবেলায় তুমিও এমন ছিলে।
প্রিয়তা দাঁত বের করে হেসে জবাব দিলো;
প্রিয়তা:-দেখতে হবে না কার মেয়ে!আই উইশ আমার একটা ছেলে হোক ঠিক তোমার স্বভাবের, তোমার মতো।তাহলে আমি সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবো।
সৌরভ দুষ্টু হেসে বললো;
সৌরভ:-ছেলেকে আনতে হলে তো আমাদের কিছু প্ল্যানিং ট্যানিং করতে হবে।কী বলো সুরভীর আম্মু?
প্রিয়তা:-তুমি দিন দিন বড্ড বেয়ারা লোক হয়ে যাচ্ছো!মুখে কিছুই কী আটকায় না তোমার?
সৌরভ প্রিয়তার ঘাড়ে বেশ কয়েকটা চুমু খেয়ে প্রতুত্তরে বললো;
সৌরভ:-এত সুন্দরী বউ কাছে থাকলে মনটা ও মুখটা সত্যি সত্যিই অনেক বেয়ারা হয়ে যায় গো।কী করবো বলো,আমার বউটা যে মারাত্মক আকর্ষণীয় ও সুন্দরী।যার প্রেমে আমি হাজার রকমে হাজার ভাবে প্রতিনিয়ত পড়ি।এই ভালোবাসার কোনো শেষ নেই গো প্রিয়তমা।
প্রিয়তা:-হয়েছে গো আমার কবিস্বামী!প্রেমের কবিতা না আউড়িয়ে এবার আপনি যান গিয়ে গোসল করে আসুন।একসাথে দুপুরের খাবার খাবো।
সৌরভ:-আমার আনরোমান্টিক বউ একটা।যাচ্ছি গোসল করতে।
সৌরভ মুখ গোমড়া করে বিছানার ওপর রাখা কাপড় চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করতে।প্রিয়তা আগেই গোসল করে নিয়েছে।সে এখন ঘরদোর গোছগাছ করতে ব্যস্ত।সৌরভ ও প্রিয়তার সম্পর্ক আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে বেবি হওয়ার পর।
✨
আজ থেকে প্রায় ২০ মাস পূর্বে,অর্থাৎ ১ বছর ৮ মাস আগে প্রিয়তা কন্সিভ করে।যেদিন সৌরভ ও প্রিয়তা জানতে পারে যে তাদের এই ছোট্ট সংসার আলো করে একটা কিউট বেবি আসবে পূর্ণতা দিতে সেদিন ওদের খুশি দেখে কে!সৌরভ এই প্রথম অতি আবেগে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিলো।বাসার সবাই খুব খুশি নতুন অতিথির আগমন উপলক্ষে।এলাকার পরিচিত সবাইকে মি.শফিক ও মি.সালাম মিষ্টি খাইয়েছেন সেই খুশিতে।মুসকান তার এরিয়ায় মিষ্টি বিতরণ করেছে মামা হওয়ার আনন্দে।
◑এ ক’বছরে সবার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে।মুসকানেরও বিয়ে হয়ে গেছে।তার বউ মিহুও মুসকানের মতো প্রিয়তাকে অনেক পছন্দ করে।ডলি এবং তানিয়ারও বিয়ে হয়ে গেছে।আর আকিল এখনও পড়াশোনা করছে।প্রিয়তাও বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা কন্টিনিউ করছে।সে চাকরি বাকরি করবে না ঠিকই কিন্তু স্টাডি কমপ্লিট করবে।◑
এটা একদম আকস্মিক ছিলো তাদের জন্য।সৌরভ বা প্রিয়তা কেউই বেবি নেয়ার প্ল্যানিং করে নি।অজান্তেই কন্সিভ করেছিলো সে।কিন্তু তারপরও তাদের সবার মনেই খুশির বন্যা বইছিলো।
সৌরভ অফিস করে বাসায় এসে সারাটা সময় প্রিয়তার পিছনে ছায়ার মতো কাটিয়ে দিতো।দুতলার রুম থেকে নিচতলায় একটা রুমে শিফট করে সৌরভ একমাত্র প্রিয়তা ও তার অনাগত সন্তানের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য।সৌরভ অফিস থাকাকালীন সময়ে মিসেস মিনা ও মিসেস শিলা তারপর তিন জায়েরা তার পরিপূর্ণ খেয়াল রাখতো।[সারা আর আবির আরও দুয়েক বছর পর বেবি নেয়ার প্ল্যানিং করেছে।তাই ওদের বেবি নেই]।
আগে এমনিতেও রাজকন্যার মতো সবার আদুরে ছিলো সে,বেবি পেটে আসার পর এমন হয়েছে যে তাকে তখন প্রতিবেলা মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেয়া হতো।একা একা কোথাও যেতে দেয়া হতো না কাজকর্ম তো বহুত দূরের কথা।এমন আদুরে বউমা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না,আর এমন শ্বাশুড়ি ও জা তো কল্পনাতেও না।প্রিয়তার ভাগ্য বরাবরই সুপ্রসন্ন।
প্রিয়তার যখন ৭ মাস তখন সৌরভের প্রমোশন হয়।কাজেকর্মে অধিক দক্ষ থাকায় প্রমোশন পেতে দেরী হয় নি।এখন সে সবচেয়ে বড় পদে জব করে।আগে যেমন ছুটি পেত কম,এখন তেমন নয়।এখন ইচ্ছা করলেই ছুটি পেয়ে যায়।বাসায় বসে ল্যাপটপের মাধ্যমে কাজ করলেও চলে।আগের তুলনায় কাজের চাপ অনেকটাই কমে গেছে।
প্রিয়তার শরীরে প্রচুর পানি এসেছে।নড়তে চড়তে কষ্ট হয় তার।আগের তুলনায় প্রচুর গুলুমুলু হয়ে গেছে সে।সৌরভের তো টেককেয়ারের কোনো সীমা নেই।প্রতিমাসে নিয়মিত চেকআপ করানো,ঔষধ খাওয়ানো সব দিকে খেয়াল রাখে সে।প্রিয়তার মুড এই ভালো তো এই খারাপ।সবদিকে নজর রাখতো সৌরভ।প্রিয়তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করতো সর্বস্ব দিয়ে।একজন আদর্শ স্বামী ও বাবা হিসেবে যা যা করার দরকার সব করেছে সে।পেটে কান পেতে বাচ্চার সাথে কথা বলতো।সৌরভ বলতো তার একটা মেয়ে হবে,আর প্রিয়তা বলতো তার একটা ছেলে হবে।এই নিয়ে দুজন মধুর ঝগড়া করতো প্রতিদিন।
প্রিয়তার যখন ৯ মাস ১৮ দিন তখন তার ভীষণ পেইন শুরু হয়।সঠিক সময়ের ৩ দিন আগে ব্যথা ওঠেছে।এমন এক সময় যে বাসায় মহিলা ছাড়া ছেলেমানুষ কেউ নেই।ওইদিন সবারই কাজ ছিলো।সৌরভ তো কল্পনাও করে নি যে ওইদিনই প্রিয়তার পেইন ওঠবে।সৌরভকে যখন জানানো হয় তখন সে দিশেহারা অবস্থায় অফিস থেকে বের হয়।
মিসেস মিনা,মিসেস শিলা ও এশা মিলে নিজেরাই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেয়।এশা নার্স ছিলো,কিন্তু ২ বছর জব করে আর করতে পারে নি আবিদের জন্যে।আবিদ চায় না সে হসপিটালে গিয়ে নার্সগিরী করুক।তাই বাধ্য হয়ে জবটা ছেড়ে দেয় এশা।আর আজ সেই বিদ্যা কাজে লেগে গেল।
সৌরভ ঝড়ের গতিতে বাসায় এসেছে ততক্ষণে প্রিয়তার ডেলিভারিও হয়ে গেছে।এবং তাদের একটা পুতুলের মতো মেয়ে হয়েছে।প্রিয়তাও আল্লাহর রহমতে ভালো আছে।সৌরভের যেন ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসতে চাইলো।সর্বপ্রথম সোফায় বসে পানি খেয়ে নিজেকে স্থির করলো সৌরভ।কিছু মুহূর্ত রিল্যাক্স থেকে অতঃপর দ্রুত রুমে প্রবেশ করে।প্রিয়তা তখন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শুয়ে আছে।প্রিয়তার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে একদম।সৌরভ খুশিতে আরেক দফা কান্না করলো প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে।সেটা ছিলো সুখের কান্না।
প্রিয়তার পরিবারের সবাই চলে এসেছে খবর শোনামাত্রই।মুহূর্তেই বাসাটা মেহমানে ভরে গেছে।বাচ্চার জন্য সবাই কাপড় চোপড়,খেলনা,বালিশ,কাঁথা,কম্বল,মশারী,তোষক,বেবি লোশন,শ্যাম্পু,পাউডার,তেল,টাওয়েল ন্যাপি,স্বর্ণের চেইন,স্বর্ণের নুপুর,রুপার চেইন,রুপার নুপুর,মানে কোনো কিছু বাদ রাখে নি কেউ কিনে আনতে।
সাতদিনের দিন বিরাট বড় করে আকিকা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হলো।বাপ মায়ের নামের সাথে মিল রেখে মেয়ের নামকরণ করা হলো,সুরভী তালুকদার প্রিতি।
মেয়ে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠতে লাগলো।ছোট থেকেই বাপের পাগল সুরভী।সাথে অধিক পছন্দের লিস্টে দাদীও আছেন।বাকিদের সাথেও তার অনেক ভালো বন্ডিং।কিন্তু এই দুজনের মধ্যে তার জান প্রাণ সব।প্রিয়তাকে দুধ খাওয়ার সময় আর ঘুমানোর সময় প্রয়োজন পড়ে তার।নয়তো সারাদিন দাদীর কাছে নয়তো সৌরভ বাসায় থাকলে বাপের কাছে থাকবে।পিচ্চিটা সবার আদরের।এমনকি জিহান এবং সিমি ওরা দুজনও ছোট হওয়া সত্ত্বেও তাকে আগলে রাখে।এতকিছুর মধ্যে সৌরভ আর প্রিয়তার ভালোবাসা যেন মেয়ে হওয়ার পর আরও হাজার গুণ মজবুত হয়েছে।তাদের ভালোবাসার গভীরতার কথা আর না-ই বা বললাম।
✨
অতীতের সব ঘটনা রোমন্থন করছিলো প্রিয়তা বিছানার ওপর বসে।এমনসময় মিসেস মিনা টাওয়েল দিয়ে প্যাচিয়ে উদোম অবস্থায় সুরভীকে নিয়ে এলেন।
মিসেস মিনা:-প্রিয়ু,তোর মেয়েকে কাপড় চোপড় পড়িয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়া তো মা।এখন তো ওর ঘুমের সময়।সকালে কী সেরেলাক খেয়েছিলো সে?
প্রিয়তা বসা থেকে ওঠে সুরভীকে কোলে নিয়ে জবাব দিলো;
প্রিয়তা:-হ্যা মা সকালে খেয়েছে।
মিসেস মিনা:-আচ্ছা আমি যাই,তোর বাবা বাসায় এসেছে।দেখি তার কী লাগে!
প্রিয়তা:-আচ্ছা মা।
মিসেস মিনা চলে গেলেন।প্রিয়তা সুরভীকে বিছানার ওপর শুইয়ে রেখে তেল লোশন কাপড় ও ন্যাপি নিয়ে এলো।সুরভী বিছানায় শুয়ে হাত পা নাচাচ্ছে।প্রিয়তা মেয়ের সাথে আদুরে কন্ঠে কথা বলে তেল লোশন মাখাচ্ছে।
প্রিয়তা:-আমার আম্মুটা এত নাচানাচি কেন করে রে?হুম?কী হয়েছে আমার মা টার?আমার মা টা এত দুষ্টুমি কেন করে?
প্রিয়তার কথা শুনে খিলখিল করে হাসছে সুরভী।প্রিয়তাও হাসছে মেয়ের হাসি দেখে।কাপড় ও ন্যাপি পড়িয়ে তাকে কোলে নিয়ে ব্রেস্ট ফিডিং করাতে লাগে প্রিয়তা।
কিছুক্ষণ পর সৌরভ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো গোসল সেড়ে।দেখলো প্রিয়তা মেয়েকে খাওয়াচ্ছে।সৌরভ টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছে প্রিয়তার পাশে এসে বসলো।কিছুটা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো;
সৌরভ:-ঘুমিয়ে গেছে তাই না?
প্রিয়তা:-হুম,এইমাত্র চোখ বন্ধ করলো।
সৌরভ:-বেডের মধ্যখানে শুইয়ে রেখে নিচে আসো।আমিও নিচে যাচ্ছি।
প্রিয়তা:-আচ্ছা যাও তুমি।আমি আসছি।
সৌরভ সায় জানিয়ে প্রিয়তার গালে ও বাচ্চার কপালে চুমু খেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।প্রিয়তা বাচ্চাকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মশারী টাঙিয়ে নিচে চলে আসে।
অতঃপর দুজনে একসাথে বসে খাবার খায়।
বিকেলে সৌরভ প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।পিচ্চিটা তার দাদা দাদীর কাছে।সারা এবার কন্সিভ করেছে,সে ৪ মাসের প্রেগন্যান্ট।সেও এখন প্রিয়তার মতো কন্ডিশনে আছে।
✨
রাতের খাবার খেয়ে প্রিয়তা আজ আগেই রুমে চলে এসেছে।সৌরভ মেয়েকে কোলে নিয়ে ভাইদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে ড্রয়িং রুমে।
প্রিয়তা আজ সৌরভের জন্য সাজতে লাগলো।আজকে সে নেভি ব্লু কালার ও গোল্ডেন পাড়ের একটা সুতির শাড়ি পড়েছে।দুহাত ভর্তি চুড়ি।চুল হাত খোঁপা বেঁধে তাতে কাঠগোলাপের গাজরা লাগালো।চোখে গাঢ় করে কাজল টানলো।ঠোঁটে চেরি কালারের হালকা করে লিপস্টিক দিয়েছে।কানে টানাদুল।আঙ্গুলে সৌরভের দেয়া আংটি।গলায় সেই স্বর্ণের চিকন চেইন।পায়ে রুপার নুপুর।সবকিছু মিলিয়ে তাকে দেখতে পুরো মায়াবতী পরীর মতো লাগছে।আজকে নির্ঘাত সৌরভ হার্ট অ্যাটাক করবে প্রিয়তাকে দেখে।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে।সৌরভ সুরভীকে কোলে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো।ঘুমে ঢুলছে সুরভী।বাপের বুকে মাথা রেখে নিভু নিভু চোখে আশপাশে তাকাচ্ছে।সৌরভ রুমে ঢুকে প্রিয়তাকে দেখেই পুরোপুরি থমকে গেল।তার প্রাণপ্রিয়া প্রেয়সী ও প্রিয়তমাকে দেখতে এত সুন্দর লাগছে যে তা বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সৌরভ।
সৌরভ প্রিয়তার কাছে গিয়ে একহাত দিয়ে তার থুতনিতে ধরে মুখটা উঁচু করলো।কাজলরাঙা চোখ জোড়া মেলে সৌরভের দিকে তাকালো প্রিয়তা।মুখে তার একরাশ লাজ এসে ভির করেছে।সৌরভ প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বললো;
সৌরভ:-ইশশ,চাহনিটা একদম বুকে এসে লাগলো।তোমার প্রেমে মেরে ফেলার ধান্দা লাগিয়েছো বুঝি বউ?আজ এত আকর্ষণীয় লাগছে কেন তোমাকে?
প্রিয়তা লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকলো।সৌরভ হেসে দিয়ে প্রিয়তার দুই চোখের পাতায় চুমু খেলো।সুরভী মায়ের কোলে যাওয়ার জন্য হাত বাড়ালো।প্রিয়তা মেয়েকে কোলে নিয়ে বললো;
প্রিয়তা:-একটু অপেক্ষা করো প্লিজ।ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আসি!
সৌরভ:-আচ্ছা।আমি বারান্দায় অপেক্ষা করছি।তুমি এসো।
প্রিয়তা:-আচ্ছা।
সৌরভ বারান্দায় চলে গেল।প্রিয়তা মেয়েকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।বেশ কিছুক্ষণ পর মেয়ে ঘুমিয়ে যেতেই ওকে তার জায়গায় শুইয়ে রেখে গায়ে কাঁথা দিয়ে বারান্দায় চলে এলো।দেখলো সৌরভ বারান্দার রেলিঙে হাত রেখে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে।প্রিয়তা কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সৌরভ তাকে নিজের কাছে আগলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো।প্রিয়তা সৌরভের বুকে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকালো।আজকে আকাশে বিরাট একটা থালার মতো চাঁদ উঠেছে।সৌরভ আর প্রিয়তার প্রেমের পূর্ণতার জানান দিতেই যেন আজকে এই চাঁদের আগমন।আশপাশটা চাঁদের আলোয় ভরে গেছে।সৌরভ নেশালো কন্ঠে বললো;
সৌরভ:-আজকে আমার সোনা বউটাকে দেখেই বোধহয় এত সুন্দর চাঁদ উঠেছে!আকাশ যেমন তার চাঁদের আলোয় আলোকিত,আমিও তেমনি আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর রূপের আলোয় আলোকিত।আহ কত মিল আমাদের মধ্যে তাই না?
প্রিয়তা:-যাহ,খালি ফাও কথা বলো!
সৌরভ:-উহুম,মোটেও না।জানো আমি প্রচুর সুখী একটা মানুষ।আমি এতটা কখনো আশা করি নি।আমার জীবন রাঙিয়ে দিতে তোমার আগমন।আমার জীবন পরিপূর্ণ করতে আমার মেয়ে সুরভীর আগমন।আর কী চাই বলো?আমি তো এতেই অনেক সুখী।জীবনকে উপভোগ করতে আর কী লাগে?
প্রিয়তা:-আমার তো কোনোকালেই বিয়ের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না।কিন্তু জানি না তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মনটার কী যে হলো!তোমাকে না পেলে ডেস্পারেট হয়ে যাবো এমন একটা কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেত সবসময়।তোমাকে পেয়ে আমার জীবনটা এত সুন্দর হয়েছে যে আমি বলে বোঝাতে পারবো না।তোমার প্রতি আমার ফিলিংসটা অনেক বেশি।আমার মতো ভাগ্যবতী কজন আছে বলো?আমার স্বামীর মতো স্বামী দুনিয়ায় এক পিসই আছে।আমার পুরো দুনিয়া তুমি।অনেক ভালোবাসি গো তোমায়।অনেক বেশি ভালোবাসি।
প্রচন্ড রকমের আবেগময় কন্ঠে কথাগুলো বললো প্রিয়তা।সৌরভের কণ্ঠনালীতে দুটো চুমু খেয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।সৌরভও প্রিয়তার মাথায় চুমু খেয়ে বললো;
সৌরভ:-আমি আমার আবেগ ও ভালোলাগাটুকু সুন্দর করে সাজিয়ে বলতে পারি না কিন্তু জানো তো,আমার বুকের ভেতর যতটুকু ফিলিংস লুকিয়ে আছে তার সবগুলোই তোমার জন্য।অন্যান্যদের মতো ছন্দ মিলিয়ে হয়তো বলতে পারবো না,তবে আমি তোমায় ঠিক কতোটা ভালোবাসি তার কোনো পরিমাপ করা যাবে না।আমার সবকিছুই তুমি।হৃদয় উজার করে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি বউ।
এই মুহুর্তে দুজন দুজনকে অনুভব করতে ব্যস্ত।দুজন দুজনার চোখের দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সৌরভ প্রিয়তার কপালের সামনে আসা চুলগুলো সযত্নে কানের পিছে গুঁজে দিলো।ঘোরলাগা কন্ঠে বললো;
সৌরভ:-আনাড়ি কন্ঠে আজ একটা গান শোনাই তোমাকে বউ?গানটা অনেক আগের,বাট আমি আমার অনুভূতিটা এই গানের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তুলতে চাই।শুনবে?
প্রিয়তা জবাব দিলো;
প্রিয়তা:-হুম শোনাও।
তোমার চোখে আকাশ আমার
চাঁদ উজার পূর্নিমা,
ভেতর থেকে বলছে হৃদয়
তুমি আমার প্রিয়তমা!
পথের শুরু থেকে শেষে
যাবো তোমায় ভালোবেসে,
বুকে আছে তোমার জন্য
অনেক কথা জমা!
ভালোবাসি তোমায় কতো
দেখাে হৃদয় খুলে,
রাঙিয়ে দেবো তোমার পাজর
মনের রঙিন ফুলে।
তোমায় দেখার শেষ হবে না
দু চোখ বুজার আগে,
আকাশ হয়ে জড়িয়ে রবো
গভীর অনুরাগে।
সৌরভের খোলাকন্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছে প্রিয়তা।সৌরভ প্রিয়তার ঠোঁটে চুমু খেয়ে আদুরে কন্ঠে বললো;
সৌরভ:-আমার প্রিয়তমাকে আমি অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।এই ভালোবাসার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।মৃত্যুর আগ অবধি এই ভালোবাসার বন্ধন অটুট থাকবে।এভাবেই আমার কলিজাকে আমার বক্ষপিঞ্জরে আটকে রাখবো।এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়বো না।
প্রিয়তার চোখ থেকে দুফোঁটা খুশির অশ্রু ঝরে পড়ে।আবেশে দু চোখ বন্ধ করে সৌরভের বুকের সাথে লেপ্টে যায় সে।একদম যতটা টাইট করে জড়িয়ে ধরা যায় ততোটাই জড়িয়ে ধরেছে সে।সৌরভ প্রিয়তাকে বুকের সাথে আগলে রেখে মাথায় চুমু খেলো।ফিসফিসিয়ে বললো;
সৌরভ:-আমার প্রিয়তমা স্ত্রী।আই লাভ ইউ!❤️
প্রিয়তা:-আই লাভ ইউ মোর দ্যান ইন মাই লাইফ সৌরজগত!আই লাভ ইউ সো মাচ!এন্ড আই স্টিল লাভ উইথ ইউ মাই ডিয়ার হাবি!স্টিল লাভ উইথ ইউ!❤️
রাতের এই নিস্তব্ধতায় দুজন মানুষ নিজেদেরকে অনুভব করতে ব্যস্ত।ওরা নিজেদের মধ্যে প্রেম বিনিময় করছে এই চন্দ্রপূর্ণিমার রাত্রিতে।এভাবেই ওদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক ও ভালোবাসা চির অটল থাকুক।এই দোয়াই করি!
__________________সমাপ্তি___________________
[নোট:-অবশেষে সমাপ্ত হলো গল্পটি।অন্তিম পর্ব পড়ে কার কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।এই গল্পটা আমি এই পর্যন্তই লিখবো ভেবে রেখেছিলাম আগে থেকে।এর থেকে বেশি লম্বা করলে আবার একটুও ভালো লাগবে না পড়তে।সৌরভ ও প্রিয়তার প্রেমকাহিনী একদম সাদামাটা টাইপের।কোনো প্যাচগোছ নেই এরমধ্যে।সব গল্পে প্যাচ থাকাটা আমার ভালো লাগে না।বিয়ের পরের হালাল প্রেমটা আশা করছি সবারই ভালো লেগেছে।গঠনমূলক মন্তব্যের আশায় রইলাম।দেখা হবে পরবর্তী কোনো গল্পে।একটু গুছিয়ে নিয়ে আবারও ফিরে আসবো দ্রুত আপনাদের মাঝে।আল্লাহ হাফেজ।]