#তুমি_আমার_প্রিয়তমা
#লেখিকা_Amaya_Nafshiyat
#সুচনা_পর্ব
সিলেট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়ে স্পর্শ করলো ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের চাকা। মাটি স্পর্শ করেই ছুটতে শুরু করলো বিমানটি সামনের দিকে।
এতক্ষণ সিটবেল্ট বাধা অবস্থায় সিটে বসে বিমানের গোল জানালাটির দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্যটা দেখছিলো সৌরভ।প্লেন থামতেই হুঁশ ফিরলো তার।প্লেনের ভেতর সব যাত্রীদের কোলাহল ছাপিয়ে স্পিকারে শোনা গেল একজন স্টুয়ার্ডেসের গলা।সবাইকে শৃঙ্খলা বজায় রেখে লাইন ধরে নামতে অনুরোধ করছে।
স্টুয়ার্ডেসের কথা শুনে সৌরভ সিটবেল্ট খুললো। চাপা উত্তেজনায় ধুরুধুরু কাঁপছে তার বুক।আজ দীর্ঘ ৬ টা বছর পর কানাডা থেকে দেশে ফিরলো সৌরভ।কতটা দিন সে তার মা-বাবা,ভাই-বোনকে দেখে নি সামনাসামনি।মায়ের হাতের সুস্বাদু রান্না ভীষণ মিস করে সে।
আজ তার এতদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। অবশেষে সে তার সেই চিরচেনা মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছে।আর কয়েক মুহূর্ত পর সে তার পরিচিত মুখগুলো দেখতে পাবে,সেই খুশিতে মনে মনে টগবগ করে ফুটছে সৌরভ।সৌরভের পাশে বসা মেয়েটির নাম জেসিয়া!সিটবেল্ট খুলতে খুলতে সৌরভকে লক্ষ করে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বললো ;
জেসিয়া:-খুব Excited মনে হচ্ছে তোমায় দেখে?
মেয়েটির দিকে একবার তাকালো সৌরভ প্রশ্নটা শুনে।মেয়েটির কথা শুনতেও এখন সৌরভের বিরক্ত লাগছে।লাগারই কথা!সেই সুদূর কানাডা থেকে এখন পর্যন্ত মেয়েটি শুধু বাচালের মতো ঘ্যানর ঘ্যানর করতেই আছে।শুনতে শুনতে কান একদম ঝালাপালা হয়ে গেছে সৌরভের।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে শরীরের জড়তা কাটিয়ে ভদ্রতার খাতিরে দায়সারা একটা জবাব দিলো সৌরভ।স্বপ্নীল হয়ে আছে তার চোখদ্বয়।
সৌরভঃ-Yes,i’m excited for this moment,যখন আমি আমার আব্বু, আম্মু, ভাইবোন সবাইকে দেখতে পাবো!
কথাটা শুনে জেসিয়া সৌরভের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।এটা যে সৌরভকে Impress করার চেষ্টামাত্র তা সৌরভ অনেক আগেই বুঝে গেছে।
মেয়েটাকে সুন্দরী বলা চলে,কিন্তু ন্যাচারাল বিউটি যেটাকে বলে সেটা নয়,ময়দা সুন্দরী!সৌরভের মতে,মেয়েটা মুখে এত পরিমাণ আটা-ময়দা লাগিয়েছে যে ওর আসল ফেস টা কীরকম সেটা বুঝার কোনো কুদরতই নেই।এমনকি চোখেও নীলরঙা লেন্স লাগিয়েছে।চুল তো নয় যেন পাটের সোনালি আঁশ।একটা জিন্স আর সাদা গেঞ্জি পরনে ওর।এই মোটা শরীরে এমন ড্রেসআপে মেয়েটাকে বিদঘুটে দেখাচ্ছে।কিন্তু জেসিয়া নামক মেয়েটা নিজেকে বিশ্বসুন্দরী ভাবে।চেহারায় কেমন একটা দাম্ভিক ভাব বিদ্যমান।
যাইহোক,মেয়েটা প্লেনে ওঠার পর থেকে সৌরভের পিছনে পড়ে আছে।সৌরভকে Impress করার জন্য নানা চেষ্টা চালাচ্ছে সে।অবশ্য তাকে দোষ দিয়েও লাভ নেই।সৌরভ সত্যিই খুব সুদর্শন একটা ছেলে।এতটাই সুদর্শন যে,যেকোনো মেয়েই তাকে দেখে ফিদা হতে বাধ্য।তার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের।সাধারণত বেশিরভাগ মেয়েদের ক্ষেত্রে চোখ হরিণী চোখের মতো টানা টানা হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে সৌরভের আঁখিদ্বয় টানা টানা হরিণী চক্ষুর মতো৷চোখের পাপড়ি ঘন ও কুচকুচে কালো আর লম্বা লম্বা,দেখলে মনে হয় মাশকারা লাগিয়েছে।এই চোখদ্বয়ের জন্য আরও বেশি এট্রাকটিভ লাগে তাকে দেখতে।সেই সাথে আছে জোড় ভ্রু যোগল।
ঘন চাপদাড়িতে তাকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়।মাথায় ঘন কালো ঝাঁকড়া চুল, উহুম কোঁকড়ানো নয়,একদম স্ট্রেইট স্পাইক করা।তার ঠোঁট জোড়া এত গোলাপি ও নয় আবার এত লাল ও নয় অন্যান্য সাধারণ ছেলেদের মতো দেখতে৷সৌরভ মোটেই জিম করে না তবে রেগুলার ব্যায়াম করে আর এজন্যই ওর বডি একদম ফিটফাট টাইপের।শুকনোও নয় আবার মোটাও নয়।৮০ কেজি ওজন ও ৬ ফুট উচ্চতা তার।ওর মুখের গড়ন ভীষণ মায়াবি।সে যখন কারো দিকে তাকায় তখন যে কেউ দেখলেই বলবে,কী ইনোসেন্ট একটা ছেলে আর কী ইনোসেন্ট তার ভাবভঙ্গি!
বেচারি জেসিয়াও ক্রাশ খেয়েছে তার ইনোসেন্ট লুক এ।
সৌরভ সিটের উপরের তাক থেকে নিজের ব্যাকপ্যাকটা পেড়ে নিলো।তার দেখাদেখি জেসিয়াও নিজের ব্যাকপ্যাক হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো৷লাইন ধরে বেরিয়ে এলো প্লেনের দরজার কাছে।তারপর গ্যাংওয়ে বেয়ে তরতর করে টারমাকে নেমে এলো বাকি যাত্রীদের সাথে।
সৌরভের কাছে নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গ মনে হচ্ছে।কতদিন পর সিলেটের মাটিতে পা রাখলো সে। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে স্কলারশিপ পেয়ে কানাডার টরেন্টো তে স্টাডি করতে গিয়েছিল সে আজ থেকে ৬ বছর আগে।আর আজ সে ফিরে এসেছে নেটওয়ার্ক ইন্জিনিয়ার হয়ে।মাঝখানে আর দেশে আসা হয় নি।তার কারণ সে ঐ দেশের লিগ্যালিটি পায় নি।আর দুয়েক বছর থাকলে হয়তো অনুমোদন পেয়ে যেত কিন্তু সে তো লিগ্যাল হতে চায় না।তার কারণ সে নিজ দেশে থাকতে চায়।বিয়েশাদি করে সিলেটেই স্যাটেল হতে চায়।অন্য কোনো খানে থাকার কোনো ইচ্ছাই নেই তার।
এই মাসে তার চাচাতো ভাই আবিরের বিয়ে।আবির তারই সমবয়সী।আবিরের পর সে নিজে বিয়ে করবে।আর এজন্য সে তার আম্মুকে আগে থেকেই বলে রেখেছে যে তার জন্য কনে দেখতে।তেমন ভালো মেয়ে পেলে ২ মাসের মধ্যেই বিয়ে কনফার্ম। সৌরভ প্রেম ভালোবাসায় মোটেই আগ্রহী নয়।এখনের যুগের এসব ন্যাকা মেয়েদের তার মোটেই সহ্য হয় না।আর তেমন কাউকে তার ভালোই লাগে নি।এজন্য বিষয়টা সে তার মায়ের ওপরই ছেড়ে দিয়েছে৷যা হয় হোকগে,যে কপালে আছে সে এমনিতেই আসবে!এমনই মনোভাব সৌরভের।
একটা বাস এসে ওদেরকে তুলে নিয়ে এয়ারপোর্টের বড় ভবনটিতে নামিয়ে দিলো।প্রায় আধাঘন্টা পর সব নিয়মকানুন শেষে ইমিগ্রেশন থেকে সমস্ত লাগেজ ব্যাগেজ চেক করার পর সেগুলো বিরাট লাগেজ রাখার ট্রলিতে রেখে ট্রলি ঠেলে ইমিগ্রেশন সেন্টার থেকে বেরিয়ে এলো ওরা।জেসিয়া একটা ট্রলি ঠেলে সৌরভের পাশে হাঁটতে হাঁটতে তাকে জিজ্ঞেস করলো;
জেসিয়া:-আমার কথা কী মনে থাকবে তোমার?
সৌরভ:- Obviously, আমি এত সহজে কাউকে ভুলি না।~নির্বিকারভাবে
জেসিয়া:-না ভুললেই ভালো,!
আচমকা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো;
জেসিয়া:-ওইততো আবার পাপা মাম্মাকে দেখা যাচ্ছে।Okay সৌরভ,ভালো থাকো,সিলেটেই যখন আছো তখন অবশ্যই দেখা হবে।তোমার সাথে অনেক সুন্দর সময় কাটলো৷Bye,and take care yourself.
হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো সে সৌরভের দিকে।ভদ্রতার খাতিরে সৌরভ জেসিয়ার হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললো;
সৌরভ:-Same to you, and bye!
জেসিয়া আবারও Bye জানিয়ে চলে গেলো ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ওর গন্তব্যের দিকে।এয়ারপোর্টে প্রচুর মানুষের ভীর।কেউ এসেছে প্রিয়জনকে বিদায় দিতে আর কেউবা এসেছে প্রিয় মানুষটাকে রিসিভ করার জন্য।সৌরভকেও রিসিভ করার জন্য অনেকে এসেছে সেটা ভাবতেই তার খুব ভালো লাগছে।হাতঘড়ির দিকে তাকালো সৌরভ।দুপুর ২ টা বাজে৷মনে মনে বললো;
সৌরভ:-হুম এজন্যই এত খিদে পেয়েছে।
ট্রলি ঠেলে সামনে এগোতে লাগলো সে ভীর এড়িয়ে।হঠাৎ কে যেন সৌরভ বলে জোরে ডেকে উঠলো৷সামনে তাকাতেই দেখতে পেল তার সমবয়সী চাচাতো ভাই আবিরকে।খুশিতে সাদা ঝকঝকে দাঁত সবকয়টি বেরিয়ে পড়লো সৌরভের।ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে আবিরের দিকে এগোলো সে।আবিরের কাছে গিয়ে ট্রলি একপাশে রেখে ছুটে এসে আবিরকে জড়িয়ে ধরলো সে শক্ত করে।আবিরও তাকে জড়িয়ে ধরলো হাসিমুখে। আবির খুশি গলায় বলে উঠলো;
আবির:-কেমন আছিস ব্রো?কতবছর পর তোকে সামনাসামনি দেখলাম!
সৌরভ আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে হাসিমুখে জবাব দিলো;
সৌরভ:-তোর বিয়ে খাব শুনে পুরোপুরি চিল মুডে আছি আমি।তুই কেমন আছিস?
দাঁত বের করে হেসে জবাব দিলো;
আবির:-আমিও খুব ভালো আছি।
আবিরের পিছন থেকে আবিরের ছোট ভাই আকিল ভ্রু নাচিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো;
আকিল:-কীরে ভাইয়া!আমাকে ভুলে গেলি নাকি?
সৌরভ আবিরকে সরিয়ে আকিলকে জড়িয়ে ধরলো।খুশিগলায় বললো;
সৌরভ:-কেমন আছিস রামছাগল?তোকে খুব মিস করেছি আমি এতদিন জানিস!আহা,আমার আদরের রামছাগলটা।
আকিল মুখ বাকিয়ে বললো;
আকিল:-দুর্গন্ধ ভাইয়া,আমি কিন্তু মোটেই রামছাগল নই।
সৌরভ:-তাহলে আমিও দুর্গন্ধ নই।
আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে দুই ভাই হেসে ফেললো।তারপর নজর দিলো অন্যদিকে৷বাসার সব ছেলেরা এসেছে সৌরভকে রিসিভ করতে।মেয়ে কাউকে আনা হয়নি।সৌরভের বাবা মি.শফিক, ছোটচাচা মি.সালাম,সৌরভের আপন বড়ভাই হৃদয়, চাচাতো মেঝোভাই আবিদ,আবির আর আকিল।মোট ৬ জনই এসেছেন।সৌরভ একে একে সবাইকে হাগ করলো।আবির আর আকিল ট্রলি থেকে লাগেজ গুলো সব নামিয়ে একে একে গাড়ির পেছনে তুলে রাখছে৷মি.শফিক স্নেহভরা কণ্ঠে সৌরভকে জিজ্ঞেস করলেন;
মি.শফিক:-তোর আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো বাবা?
সৌরভ:-না আব্বু,কোনো অসুবিধে হয়নি।
মি.সালাম:-সৌরভের জন্য ভাবী -“সৌরভের আম্মু”- কত পদের তরকারি যে রান্না করেছেন তা হিসাবের বাইরে।তোর খিদে পায় নি বাবা?
সৌরভ:-পায়নি মানে?পেটের ভেতর মনে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে।তুমি এই কথা বলে তো খিদেটাকে আরও চাগিয়ে দিয়েছো।~হেসে হেসে~
হৃদয়:-তাহলে উঠে পড় গাড়িতে।জলদি বাসায় যাওয়া দরকার।আম্মু তোর জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন।
আবিদ:-হ্যা,হ্যা।আমারও জোরসে খিদে লেগেছে।আজকে তোকে নিয়ে আমরা একসাথে ফুর্তি করে খাবার খাবো।
সৌরভ খুশিমনে মাথা ঝাঁকিয়ে কালো বড় টয়োটা হাইয়েস গাড়িটাতে উঠে পড়লো।বাকি সবাই একে একে গাড়িতে ওঠে পড়লে আবির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ড্রাইভ করতে লাগলো।গাড়ির ভেতর প্রচুর খোশগল্প চললো বাসায় যাওয়ার আগপর্যন্ত।
প্রায় ২০ মিনিটের মাথায় হাউজিং এস্টেট এরিয়ায় ঢুকে পড়লো গাড়িটি।কয়েকটা লেন পেরিয়ে অবশেষে লেন ৫ এ বিশাল বড় এক ডুপ্লেক্স বাসার সামনে থামলো গাড়ি।গাড়ির হর্ন বাজাতেই সিকিউরিটি গার্ড এসে গেট খুলে দিলো।গাড়ি নিয়ে গেটের ভেতর ঢুকে পড়লো আবির।গাড়িবারান্দার সামনে এসে গাড়ি থামালো।
গাড়ির শব্দ শুনেই সৌরভের ছোটবোন ডলি ও আবিরের ছোটবোন তানিয়া দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে এলো।গাড়ি থামতেই সবাই গাড়ি থেকে নেমে এলো।আকিল আর আবির মিলে সব লাগেজ গাড়ি থেকে সিরিয়ালি নামাচ্ছে।সৌরভ গাড়ি থেকে নামতেই ডলি আর তানিয়া দৌড়ে এসে সৌরভকে জড়িয়ে ধরলো।সৌরভও পরম যত্নে জড়িয়ে ধরলো দুই আদরের ছোট বোনকে।স্নেহময় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল;
সৌরভ:-কেমন আছে আমার ছোট্ট সোনা বোনেরা হুম?
ডলি:-আমরা ভালো আছি।তুই কেমন আছিস ভাইয়া?
সৌরভ:-আমিও খুব ভালো আছি।
তানিয়া:-জানো,আমরা তোমায় খুব মিস করতাম ভাইয়া!
দুই বোনের মাথায় চুমু খেয়ে আদুরে কন্ঠে বললো;
সৌরভ:-আর মিস করতে হবে না।ভাইয়া এসে গেছি তো।এখন থেকে তোদের সাথেই থাকবো। আর দুরে কোথাও যাবো না প্রমিজ।
আবিদ:-আচ্ছা ঠিক আছে।ভেতরে চলো এখন সবাই।~তাড়া দিয়ে~
ডলি আর তানিয়া সৌরভ দুই হাতে ধরে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।বাসার পরিবেশ পুরোপুরি রূপে পাল্টে গেছে।এই ৬ বছরে প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। সারা এলাকাটাই চেঞ্জ হয়ে গেছে।সৌরভের চিনতে কষ্ট হচ্ছিলো যে এটাই তার সেই চিরপরিচিত এলাকা।
যাইহোক,ভেতরে ঢুকে বিশাল বড় ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলো সবাই।মিসেস মিনা ড্রয়িং রুমেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।সাথে বাকিরাও ছিলো।সৌরভকে দেখে মিসেস মিনা কেঁদে ফেললেন।আজ কতবছর পর ওনি তার ছেলেকে কাছে পেয়েছেন। সৌরভকে জড়িয়ে ধরে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন।কেউ কিছু বলছে না।সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।মা তো মা-ই হয়।সন্তান দুরে থাকলে কোনো মা কী ভালো থাকতে পারে?অবশ্যই না। সৌরভ ও তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।কতদিন পর সে তার মাকে দেখতে পেল৷মিসেস মিনা কান্নারত কন্ঠে সৌরভের মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন;
মিসেস মিনা:-কেমন আছিস বাবা?আমার ছেলেটাকে কতদিন আমি সামনে থেকে দেখি নি। এতদিন কী খেয়েছে না খেয়েছে আমার বাচ্চাটা, মা হয়ে আমি কিছুই দেখি নি।কেমন শুকিয়ে গেছে আমার সোনা বাচ্চাটা,ইশশ!~আফসোস করে আবার কেঁদে দিয়ে~
এমনভাবে বললেন তিনি কথাগুলো যেন সৌরভ মাত্র ১-২ বছরের শিশু।মি.শফিক এবং মি.সালাম মিটিমিটি হাসছেন।বাকিরাও দাঁত কেলিয়ে হাসছে।লজ্জায় সৌরভ লাল হয়ে গেল।মিসেস মিনাকে স্বান্তনা দিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে বললো;
সৌরভ:-আম্মু,এভাবে কেঁদো না প্লিজ!তুমি তো জানো যে তুমি কান্না করলে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি তো এসে গেছি আম্মু দেখাে!তোমার ছেলে তোমার কাছেই ফিরে এসেছে।আর কোথাও আমি যাচ্ছি না আমার আম্মুকে ছেড়ে আই সোয়্যার।এবার একটু হাসো আম্মু প্লিজ।
মিসেস মিনা:-তোকে আমি আর কোথাও যেতে দিবোই না।আমার বাচ্চাদের আমি আমার থেকে দূরে কোথাও যেতে দিবো না।কখনোই না।আমার বাচ্চারা আমার কাছেই থাকবে।
এবার মি.শফিক বলে উঠলেন;
মি.শফিক:-আচ্ছা মিনা।তুমি তোমার বাচ্চাদের রুমে তালা দিয়ে রেখে দিয়ো আর নাহয় ছোটবেলায় যেমন সাথে সাথে রাখতে সেভাবে রেখো।কেউ তোমার বাচ্চাদের নিতে আসবে না। ~রসিকতা করে~
মিসেস মিনা কড়া চোখে তাকালেন মি.শফিকের দিকে।মি.শফিক কুঁকড়ে গেলেন বউয়ের চোখ রাঙানিতে।উপস্থিত দর্শক সবাই হো হো করে হেসে ফেললো।সহজ হয়ে গেল পরিবেশ।সৌরভ পেটে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো;
সৌরভ:-আম্মু আমার ভীষণ খিদে লেগেছে।খিদের জ্বালায় মনে হচ্ছে আস্ত একটা গরু সাবাড় করে ফেলতে পারবো।এতোটা খিদে পেয়েছে।
মিসেস মিনা:-পাবে না!কত দূর জার্নি করে এসেছে ছেলেটা।কই কানাডার টরেন্টো আর কই আর কই বাংলাদেশের সিলেট।আয় বাবা ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং রুমে আয়।সব রেডি করাই আছে।শুধু হাত ধুবি আর খেতে বসবি।আয় বাবা।
সৌরভ ডলি আর হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে মশকরা করে বললো;
সৌরভ:-কী?হিংসে হয়?হিংসে করেও লাভ নেই। আমি এই ৬ বছরের সব আদর সুদে আসলে উসুল করে নিবো।বুঝলে?তোমরা দেখবে আর জ্বলবে লুচির মতো ফুলবে।
ডলি:-আমরা তোর মতো এত হিংসুটে নই বুঝলি?আমাদের আম্মু আমাদেরকে সবসময় ভালোবাসে।তাই না গো আম্মু?
মায়ের দিকে তাকিয়ে বললে মিসেস মিনা হাসলেন শুধু কিছু বললেন না।বাকিরাও হাসছে তাদের খোঁচাখুঁচি দেখে।এতদিন পর বাসার মধ্যে খুশি আনন্দ কানায় কানায় পূর্ণ হলো।
সৌরভ তার চাচী মিসেস শিলা, বড়ভাবী অর্থাৎ হৃদয়ের বউ ইশা আর মেঝোভাবী অর্থাৎ আবিদের বউ এশার সাথে কুশল বিনিময় করলো।হৃদয়ের মেয়ে সিমি আর আবিদের ছেলে জিহানকে কোলে নিয়ে আদর করে ডাইনিং রুমের পাশে ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এলো।খিদের জ্বালায় আর নিজের রুমে যাওয়ার ইচ্ছে হয় নি তার।
ডাইনিং রুমে এসে চেয়ার টেনে সবাই বসে পড়লো।হরেক রকমের খাবারের বহর দেখে সবার জিভেই পানি চলে এলো।খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সবাই।গ্রোগাসে গিলতে লাগলো সুস্বাদু সব খাবার।আকিল তার আম্মু মিসেস শিলাকে জিজ্ঞেস করল;
আকিল:-আম্মু,ঝিঁঝি পোকা কই গো?কতক্ষণ থেকে দেখছি না তাকে।এতক্ষণে তো তার সারা বাড়ি মাথায় তোলার কথা!
মিসেস শিলা:-আর বলিস না ওর কথা!জ্বর বাঁধিয়ে রুমে শুয়ে আছে।আর পারি না ওকে নিয়ে।দিনে দিনে মারাত্মক দুষ্টা হয়ে ওঠছে সে।মোটেই কথা শুনে না।~বিরক্তি প্রকাশ করে~
সৌরভ তাদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না।কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো;
সৌরভ:-এই ঝিঁঝি পোকাটা আবার কে?কার কথা বলছো তোমরা?
সৌরভের আম্মু মিসেস মিনা সৌরভের পাতে ভাত তরকারি বেড়ে দিয়ে বললেন;
মিসেস মিনা:-তোর সামাদ আঙ্কেলের মেয়ে প্রিয়তার কথা বলছে আরকি।
সৌরভ:-ওহহো,,বুঝেছি।তা ওকে প্রিয়ু না ডেকে ঝিঁঝি পোকা ডাকিস কেন আকিল?
আকিল:-আর বলিস না ভাইয়া,সারাদিন ওর মুখে খই ফুটে।পুরোই ঝিঁঝি পোকার স্বভাব।সারাদিন ঘ্যানর ঘ্যানর করে।তাই এই নামে ডাকি।
ওর কথা শুনে হেসে ফেললো সৌরভ।তানিয়া হুঁশিয়ার করে বললো;
তানিয়া:-খবরদার।ওর সামনে এরকম করে বলিস না ছোট ভাইয়া।তোর মুখের নকশা পাল্টে ফেলবে।ও সামনে নেই বলেই আজ তুই বেঁচে গেলি।নইলে তোর কপালে দুঃখ লেখা ছিলো।
সৌরভ:-তোদের কথা শুনে তো মনে হচ্ছে ও খুব ডেঞ্জারাস।প্রিয়ু যখন ছোট ছিলো তখন তো ওকে কতবার কোলে নিয়ে দোকানে গিয়ে চকোলেট কিনে দিয়েছি।আমার এখনও মনে আছে।আমাকে খুব পছন্দ করতো সে।এখন কতবড় হয়েছে প্রিয়ু?হুম?
ভাত খেতে খেতে জবাব দিলো ডলি;
ডলি:-ও এখন আর সেই ছোট্ট খুকিটি রয় নি ভাইয়া।অনেক বড় হয়ে গেছে।বয়সে আমাদের থেকে ছোট হলেও গায়েগতরে,লম্বায় চওড়ায় আমার আর তানিয়ার থেকেও বড়।ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে এবার।১৭ বছর বয়স।
সৌরভ:-বাহ,তাহলে তো অনেক বড় হয়ে গেছে।এখানে এসেছে নাকি?
মিসেস শিলা:-হ্যা।আবিরের বিয়ের জন্য তাকে আগেই নিয়ে এসেছি।সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতে সে একাই যথেষ্ট।ভীষণ চঞ্চল টাইপের আমার ভাইঝিটা।কালকে বিকেলে বৃষ্টি হয়েছিলো।সে চুপিচুপি ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে কাউকে না বলে।তারপর আর কী বলবো!দেখোগে,জ্বর ওঠে তানিয়ার রুমে শুয়ে আছে।সামাদ আমাকে বারবার করে বলেছিলো তার মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখতে।আমি তো মানুষ,শয়তানও তাকে মনে হয় ওয়াসওয়াসা দিতে পারবে না,সেই বরং শয়তানকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিতে পারবে।এতই দুরন্ত স্বভাবের মেয়েটা।
মি.সালাম:-খাইয়েছো কিছু মেয়েটাকে?জ্বর কমেছে ওর?
মিসেস শিলা:-নাহ,এইতো এখন খাবার নিয়ে যাবো।আচ্ছা আমি বরং এখন যাই।
মিসেস মিনা:-হ্যা,তুই যা।এখনে আমি আছি।প্রিয়ুকে খাবার খাইয়ে ঔষধটা খাইয়ে দিয়ে আসিস মনে করে।
মিসেস শিলা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একটা ট্রেতে করে খাবার এবং পানি নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠে তানিয়ার রুমে চলে গেলেন।সৌরভের খুব কৌতুহল হলো মেয়েটিকে দেখার।তবে কিছুক্ষণ পর অটোমেটিক্যালি তার মন থেকে মুছে গেল প্রিয়তার কথা।অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে মেতে উঠলো সবাই।
চলবে..