#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী
হঠাৎ শেফালী বেগমের চিৎকারে জোবায়দা চমকে উঠে। ও দৌড়ে বাবার ঘরে গিয়ে দেখে ওর মা শেফালী বেগম ওর বাবার কানের কাছে জোরে জোরে কলেমা পড়ছে আর চিৎকার করে বলছে,
—-তোর বাবা আর নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
জোবায়দা একথা শুনে ওর বাবার বুকে চাপ দিতে থাকলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দৌড়ে নিজের রুম থেকে প্রেসার আর পালসের মেশিনটা নিয়ে এসে মাপতে গিয়ে দেখে মেশিন আর কথা বলছে না। ও বিপর্যস্ত হয়ে ওর বাবার পাশে বসে পড়লো। আর মনে মনে বললো,”বাবা তুমিও আমায় ছেড়ে চলে গেলে। কেন চলে গেলে? বলনা আমি এখন কাকে নিয়ে থাকবো। কার স্বপ্ন পূরণ করবো। এখানে সবাই নিজের স্বার্থের কথা ভেবে চলে। আমারও আজ থেকে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা ফুরিয়ে গেল।”
আলতাফ সাহেবের মৃত্যুর কথা শুনে খবর পেয়ে রাতের বেলা ও বাড়ি থেকে হিমেল আর ওর বাবা মা জোবায়দাদের বাড়িতে আসে। হিমেলের ধারনা জোবায়দা কিছুই জানে না। কেননা হিমেল ওর বাবাকে জোবায়দাকে না জানিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বলেছিলো। আর হিমেলের বাবা জমির মোল্লা প্যাঁচ কষে হিমেলের অজান্তে জোবায়দার পরিবর্তে আদিবাকে আংটি পরিয়ে দেয়। সেই কারনে হিমেল স্বাচ্ছন্দে এ বাড়িতে আসে। ওর ধারনা জোবায়দা কিছুই জানে না। আদিবাও হিমেল আর জোবায়দার কাহিনী জানতো না। তবে ওর এই বিষয়ে কোনো প্যারা নেই। ওর বিশ্বাস বিয়ে একবার হয়ে গেলে ও ছলে বলে কৌশলে হিমেলকে ওর আয়ত্বে আনতে পারবে। এখানে আসার পর থেকেই হিমেলের চোখ শুধু জোবায়দাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মেয়েটাকে ও কতোদিন দেখেনা। আচ্ছা ওর কি দেখতে ইচ্ছে হয় না। একটা সময়ছিলো দুজন দুজনকে না দেখে থাকতে পারতো না। তখন প্রেম কি জিনিস জোবায়দা ভালো করে বুঝতোও না। অথচ এখন ভালোবাসার মানে বুঝেও কিভাবে দূরে দূরে থাকতে পারে হিমেল বুঝে পায় না। বুকের গহীন থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
এদিকে জোবায়দা নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদছে। কারণ ও হিমেলের সামনে আর পড়তে চায় না। আজও হিমেলের গলারস্বর ওর হৃদয়কে আলোড়িত করে। কিন্ত সেই আলোড়িত অনুভবটা বড্ড প্রেমহীন। কষ্টের কন্টকে জর্জরিতো।চোখের কোল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। সে জল শোক আর অনুতাপে মাখামাখি।
জোবায়দার খোঁজে ওর রুমে এসে হিমেলের মা একসময় ওকে সান্তনা দিয়ে যায়। মেয়েটাকে দেখলে উনিও আবেগপ্রবন হয়ে উঠেন। এই মেয়েটাকে ছেলের বউ করার জন্য উনি কতোবছর ধরে স্বপ্নটাকে লালন করেছিলেন। অথচ উনি কি ভাবলেন আর বাস্তবে কি হলো।
এই সুযোগে আদিবা কয়েকবার হিমেলের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হিমেল ওর সাথে তেমন কথা বলেনি। শুধু একবার ওকে ডেকে বলেছে,ও যেন জোবায়দার দিকে খেয়াল রাখে। এতে আদিবার অনেক অভিমান হয়। মনে মনে বলে,” বিয়েটা আগে হোক তখন বউ ফেলে জেঠুসের খবর রাখার মজাটা চিরদিনের মতো ঘুঁচে যাবে।”
আলতাফ সাহেবের শরীরে ঘা হওয়াতে খুব দ্রুতই দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। আত্মীয় স্বজন তেমন কেউ আসতে পারেনি। জোবায়দার একমাত্র ফুফু সাভারে থাকাতে উনি দ্রুত চলে আসতে পেরেছেন। জোবায়দার দুই মামা রংপুরে থাকে। উনাদের পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি। লাশের গোসল শেষ করে কাফন পড়ানো শেষ হলে ফজরের আযান শুরু হয়। জানাযা পড়াতে মসজিদে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। লাশ নিয়ে ওমর আর জাফরের সাথে হিমেলও রওয়ানা দেয়। জানাযা পড়ানো শেষ হলে দাফন করানোর জন্য কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। হিমেলের বাবা মাও বিদায় নিয়ে চলে যায়। জোবায়দাদের বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। উনি গুলশানে থাকেন। উনিও আদিবার মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায়।আর যাওয়ার সময় বলে যায় দুপুরের খাবারটা উনি পাঠিয়ে দিবেন।
এদিকে আদিবার বিয়ের বিষয়টা খুব কাছের আত্মীয়স্বজনরা জানে। আদিবার ফুফুর তো কথাবার্তার ছিড়ি নেই। তারউপর মনে মনে উনি আদিবাকে নিজের ছেলের বউ হিসাবে দেখে রেখেছেন। ছেলে উনার এইচএসসি পাশ। তাতে কি? বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে। ওদের আছে স্বর্ণের দোকান। আদিবার ফুফুর কথা হচ্ছে জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে টাকার দরকার। সেটা যখন আয়ত্বে থাকে তখন লেখাপড়ার পিছনে এতো সময় ব্যয় না করে ব্যবসার পিছনে ব্যয় করলে আখেরে লাভ বেশী হবে। উনি ভাবছেন বিয়েটা ভেস্তে দেওয়ার এই একটা সুযোগ। সে সুযোগটাই এখন উনি কাজে লাগাবেন।তাই শোকের বাড়িতে যেখানে তার ভাইয়ের জন্য মন খারাপ করা উচিত বরং সেটা না করে উনি
আদিবার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে শেফালী বেগমকে বললেন,
—দেখো ভাবি, আমার মনে হচ্ছে তোমার মেয়ের সাথে ঐ ছেলের বিয়েটা শুভ নয়।
উনার কথার বিরুদ্ধে গিয়ে স্বর্ণা বলে,
—ফুফু এখানে শুভ অশুভের ব্যাপার কেন আসছে বুঝলাম না। উনার হায়াত শেষ উনি আল্লাহপাকের কাছে চলে গিয়েছেন। তাছাড়াও বাবা অসুস্থ ছিলেন। উনি কষ্ট পাচ্ছিলেন।
স্বর্ণা মনে মনে ভাবছে কোথায় ননদগুলোর তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়ার জন্য ও আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করছে আর উনি এসেছেন বাগড়া দিতে। বড় জনের তো বিয়ে নিয়ে কোনো হেলদোল নেই আর ছোটো টা যা রাজি হয়েছে আর এখন কানভাঙ্গানি দিতে একজন এসেছেন।
স্বর্ণাকে এভাবে কথা বলতে দেখে আদিবার ফুফুখুব বিরক্ত অনুভব করে। প্রসঙ্গ ঘোরাতে উনি স্বর্ণাকে বলেন,
—-,তোমার বাবা মা কেউ আসেননি?
—-না,মানে আমার এভাবে বিয়ে করাটা উনারা মেনে নিতে পারেননি। আর কেমন করে মানবে। লালবাগে আমার বাবার চারটা আড়ত আছে। সদরঘাটে দুইটা বড় দোকান আছে। সেই তুলনায় আপনার ভাতিজা কিংবা আমার শ্বশুরের তেমন কিছুই নেই।
—-তাহলে বিয়েটা করেছো কেন?
—-আপনাদের ছেলে আমাকে ভালোবাসে আর আমিও ওকে ভালোবাসি। আর আমি সেসব মেয়েদের মতো নই যারা বয়ফ্রেন্ডের সাথে লটরপটর করবে আবার বিয়ের কথা উঠলে পিছিয়ে যাবে।
এদিকে ওমর দাফনের কাজ শেষ করে ঘরে এসে এসব কথাবার্তা শুনে স্বর্ণা আর ওর ফুফুর উপর রেগে গিয়ে বললো,
—-কখন কোন কথা বলতে হয় সেটা মনে হয় আজকালকার মানুষ ভুলে গেছে।
এরপর শেফালী বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপু,আদিবা আর জাফর কোথায়?
—-ওদের রুমে বসে আছে।
—-আম্মু তুমি আমার রুমে আসো। তোমার সাথে কথা আছে।
আসলে হিমেল কিছুদিনের জন্য এই বিয়েটা পিছিয়ে দিতে চায়। ও জানে, জোবায়দা ওর বাবার উপর খুব দুর্বল। বিয়ে পেছানোর কথা জানাতেই ওমর শেফালী বেগমকে নিজের রুমে ডেকে নেয়। ওমরের মুখে একথা শুনে শেফালী বেগমের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠে। না,জানি শেষপর্যন্ত বিয়েটা ভেঙ্গে যায়।এরপর শেফালী বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—তোমার চাকরির চেষ্টা কতদূর। বিয়ে করেছো এখন তো গায়ে বাতাস লাগিয়ে চললে হবে না। দায়িত্ব শুধু কাঁধে নিলে হবে না। সঠিকভাবে পালনও করে হবে।
—-বস বলেছে, সামনের মাসেই উনি আমার চাকরির ব্যবস্থা করবেন।
—-দেখো বাবা, ঐ সব নেতানেত্রীর হাতে পায়ে ধরে চাকরির চেষ্টা না করে নিজের যোগ্যতা দিয়েঅর্জন করা উচিত।
ছেলের উপর বিরক্ত হয়ে উনি একথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ওমরের উপর উনি একটু বিরক্ত। প্রাইভেটে পড়াশোনা করলো। কতোগুলো টাকা ওর পিছনে খরচ হলো। আজও নিজেকে প্রতিষ্টিত করতে পারলো না।
এদিকে আদিবার বিয়েটা তিনমাস পিছিয়ে গেল। এতে জোবায়দা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আর মনে মনে ভাবলো,ওদের বিয়ের দিন ও থাকবে না। সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে ও দূরে কোথাও চলে যাবে। জোবায়দার আজ সেই কবির কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল।
“বসন্ত নয় আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিলো অবহেলা।
ভেবেছিলাম অনেকগুলো বর্ষা শেষে
শরতের উষ্ণতা মিশে এলো বুঝি বসন্ত
দরজা খুলে দেখি আমাকে ভালেবেসে এসেছে অবহেলা।”
চলবে