তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০৫

0
391

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

আটচল্লিশ ঘন্টা ডিউটি সেরে ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন দেহে ঘরে ফিরে আসলো। ডোর বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো আদিবা। আদিবাকে এসময় ঘরে দেখে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জোবায়দা ওকে বললো,
—-কিরে, তুই এসময় বাড়িতে?
—-হুম,আম্মু এখন কলেজ যেতে নিষেধ করেছে।
—-এভাবে ফাঁকি দিলে আর পড়াশোনা হবে না। তার থেকে বরং বিয়ে করে হাড়ি ঠেলার ব্যবস্থা কর। শুধু শুধু আমার টাকার শ্রাদ্ধ করবি না।
একথা বলে জোবায়দা ডাইনিং টেবিলের উপর ব্যাগটা রেখে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে বললো,
—-যে গরম পড়েছে, এতো পানি খাচ্ছি তারপরও মনে হচ্ছে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সকাল দশটার মধ্যে সুর্যের তেজ এতো বেশী শরীরের কাপড় ঘামে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। পানি সব ঘাম হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এমনসময় শেফালী বেগম রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে জোবায়দার পাশে বসে বললো,
—-তোকে তো একটা কথা বলা হয়নি। আদিবার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। ওমরটা যে কান্ড ঘটালো এইটা আবার কখন কি করে বসে তার কোনো ঠিক আছে? ভালো প্রস্তাব পেলাম। তাই হুট করেই ওর বিয়েটা ঠিক করে ফেললাম।
জোবায়দা ভীষণ অবাক হয়ে শেফালী বেগমকে বললো,
—এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলে আমাকে একবার বলার প্রয়োজন মনে করলে না? আর ছেলে সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ খবর নিয়েছো তো?
শেফালী বেগম কিছু বলার আগেই ওমরের বউ স্বর্ণা এসে বললো,
—-ছেলে তো আপনাদের পরিচিত। আপনার ভাইতে বললো, “ছেলে নাকি খুব ভালো।” আদিবার কপাল বটে! এমন ছেলে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার।

জোবায়দা একটু নড়ে চড়ে বসলো। মায়ের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—মা,ও কার কথা বলছে?
শেফালী বেগম আমতা আমতা করে বললো,
—-হিমেল,
—মানে কি? হিমেল ভাই আদিবাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে?
স্বর্ণা জোবায়দাকে একটু খোঁচা মেরে বললো,
—-সবাই তো আর আইবুড়ো হয়ে বসে থাকতে চায় না। হিমেল ভাই নিশ্চয় রাজী হয়েছে। তা,না হলে উনার বাবা মা এসে আদিবাকে আংটি পড়িয়ে যাবে কেন? আর আমাদের আদিবাও তো রাজী।
জোবায়দা স্বর্ণার খোঁচাটা ভালোই বুঝতে পারলো। স্বর্ণা যে ওকেই আইবুড়ো বলেছে এটা জোবায়দা ভালোই বুঝতে পেরেছে। ও আদিবার দিকে একপলক তাকানো মাত্রই সামনে থেকে ও সরে গেল। জোবায়দা মনে মনে ভাবলো,
হিমেল ভাই এভাবে ওর উপর প্রতিশোধ নিলো। যাক ভালোই হয়েছে। মানুষ যাকে ভালোবাসে তার জন্য যুগযুগান্তর অপেক্ষা করতে পারে। অথচ হিমেলভাই ওর জন্য কটা বছর অপেক্ষা করতে পারলো না। না, ও আর তার কথা ভাববে না। যে তার হয়নি আসলে সে কোনোদিন তার ছিলো না। ভুল মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে এই ঢের ভালো হয়েছে। আসলে সে হিমেলের মোহ ছিলো। যে করেই হোক তাকে ভুলে যেতে হবে। ওর বাবার স্বপ্ন পূরণে ও নিজেকে বিলিয়ে দিবে। ওকে অনেক বড় ডাক্তার হতে হবে। জোবায়দা মন থেকে এক হৃদয় কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ও টলতে টলতে নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে সবাইকে বললো,”কেউ যেন ওকে ডিস্টার্ব না করে। এদুদিন ওর ঘুম হয়নি। ও এখন ঘুমোবে। তারপর উপুড় হয়ে বিছানায় নিজেকে সঁপে দিলো। বুকের ভিতরে চাপা কান্নার ঢেউ উথলে উঠছে। না, ও কাঁদেনি। তবুও ফোঁটা ফোঁটা নোনা জল দু,চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। জোবায়দা ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠছে।

ওদিকে শেফালী বেগম মেয়ের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছেন,ভিতরে ভিতরে মেয়েটা ভেঙ্গে চুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হচ্ছে। উনি কি পারতেন না জোবায়দার সাথে হিমেলের বিয়েটা দিতে? কিন্তু হিমেলের বাবাই তো জোবায়দার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখালো না। আবার হিমেলের মতো ভালো পাত্র উনার হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু এখন আত্মদহনের অনলে উনি পুড়ছেন। বিছানায় শুয়ে আলতাফ সাহেব শেফালী বেগমের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। শেফালী বেগমও উনার দিকে তাকিয়ে ভাবছেন,ঐ মানুষটার আয়ু মনে হয় ফুরিয়ে আসছে। শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠে দুটো বেডশোর হয়েছে। দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করার পর চলাচলের ক্ষমতাটা প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। আদিবাটারও পড়াশোনায় মন নেই। ওমরটাতো বোনটার পাশে না থেকে বরং সাত সকালে বিয়ে করে সংসারের খরচা বাড়িয়ে দিলো। আর আদিবার ও চলা ফেরা খুব একটা সুবিধার নয়। সারাদিন সাজগোজ,আর বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোড় করে বেড়ানোই যেন ওর প্রধান কাজ। জোবায়দার পায়ের নীচের মাটিটা শক্ত। সেই কারনে সে শক্ত মাটির উপর দাঁড়াতে শিখেছে। আর আদিবার তো নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। ওর তো অবলম্বন দরকার। সেই কারনে বিয়ে দিয়ে শেফালী বেগম দায় মুক্তি হতে চাইছেন।
জাফর এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। উনি এবার জাফরের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিবেন। জাফরও যেন জোবায়দার মতো নিজেকে তৈরী করে নিতে পারে। উনিই বা আর কতোদিন বাঁচবেন? জোবায়দার ডাকে উনার ভাবনায় ছেদ পড়লো।
—-আম্মু খেতে দাও। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
—-তুই ডাকতে নিষেধ করেছিস বলে ডাকিনি। ক্ষুধা তো লাগারই কথা। বেলা তিনটা বাজে।
—+তুমি খেয়েছো?
—-তোকে ছাড়া আমি কিভাবে খাই?
—-চলো, খেয়ে নেই।
জোবায়দা বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। খেতে বসে জোবায়দা ওর মাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-আদিবার বিয়ের কেনাকাটা তো করতে হবে।
—-হুম,তবে ওরা বলেছে, এক সপ্তাহ পর ওরা এসে আক্দ করাবে। তারপর সুযোগ মতো বৌ তুলে নিবে।
—-ঝামেলাটা একবারই মিটিয়ে ফেললে হতো না? আমাদের মতো টানাটানির সংসারে দুবার খরচ করার কোনো মানে হয় না।
—-মানে, আমি হিমেলের বাবাকে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লোকটা এমন ধড়িবাজ যে আমাকে কথা বলার সুযোগই দিলো না।
—-ঐ ধড়িবাজ লোকটা এখন তোমার বেয়াই হবে। সামলাতে পারবে তো? যাক বিয়ের পাকা কথা যখন দেওয়া হয়েছে শপিং আয়োজন সবই করতে হবে। আজ আর বেরোবো না। কাল আমার অফ ডে আছে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কাজে নেমে পড়বো।

জোবায়দা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-তোমার মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো? নিজের দিকে খেয়াল রেখো।বাবার সেবা যত্ন তো তোমাকেই করতে হয়।

—-এই যে সবার কথা এতো ভাবিস, নিজের কথা কবে ভাববি?
—-আমি তো সবসময় নিজের কথাই ভেবে চলেছি।
তোমরা কি আমার পর? আমার আত্মার অংশ। তোমাদের কথা ভাবা আর নিজের কথা ভাবা একই কথা।
আসরের আযান শোনা যায়। দিন ছোটো হয়ে আসছে। এখন ডিসেম্বর মাস। চারটার আগেই আসরের আযান পড়ে যায়। আযান শুনে জোবায়দা ওর মাকে বললো,
—-মা আমি নামাজ পড়ে নেই।
রুমে গিয়ে জোবায়দা আসরের নামাজটা আদায় করে আবারও নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিলো। এমন সময় জাফর ঘরে ঢুকে জোবায়দার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপু তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস?
আধো ঘুম আধো জাগরনে জোবায়দা বললো,
—-কিছু বলবি?
—-আমার কিছু টাকার দরকার। খাতা কলম কিনতে হবে।
ঘুম ঘুম চোখে জোবায়দা ওকে বললো,
—-ব্যাগ থেকে বের করে নিয়ে যা।
—-পাঁচশ টাকা নিয়ে গেলাম।
—-যা পারিস নিয়ে যা। আমাকে এখন একটু ঘুমাতে দে।
জাফর মনে মনে বেশ খুশী হলো। আপু যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন টাকা নেওয়ার এই একটা সুবিধা। ব্যাগ থেকে মনের মতো টাকা নেওয়া যায়। জেগে থাকলে তো একশত টাকার বেশী টাকা দিতে চায় না। কাল স্কুলে মন ভরে টিফিন খাওয়া যাবে।

মাগরিবের আযান শুরু হওয়াতে আদিবা এসে জোবায়দাকে ডেকে দিলো। ঘুম থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে ওজু করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিলো। ওর মাথাটা বেশ ভার হয়ে আছে। রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে চা বানাতে গিয়ে দেখে স্বর্ণা ওর নখে ডিজাইন করে নেইল পলিশ লাগাতে লাগাতে শেফালী বেগমকে বলছে,
—-মা, আমার মাথাটা ধরেছে। একটু চা হবে?
এই দৃশ্য দেখে জোবায়দার মাথার চাঁদিটা গরম হয়ে গেল। স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-পড়ালেখাটাতো ভালো করে শিখলে না তাই বলে কি আদব লেহাজও শেখোনি। নাকি তোমাদের বাড়িতে সেসবের চর্চা নেই।
—-আপু, আপনি আমাকে দেখলে এরকম তেঁতে উঠেন কেন? নাকি আপনার থেকে বয়সে ছোটো হয়ে দিব্যি স্বামীর সংসার করছি দেখে আপনার সহ্য হচ্ছে না। শুধু ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হলেই হয় না, স্বামীর সংসার পেতে গেলেও মেয়েদের যোগ্যতা থাকতে হয়।

একথা বলে দুপদাপ করে স্বর্ণা নিজের ঘরে চলে গিয়ে সপাটে দরজা লাগিয়ে দিলো। জোবায়দাও অবাক বিস্ময়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-মা ও কি কথার কি উত্তর দিয়ে গেল। একমাত্র তোমার প্রশ্রয় পেয়ে ওর এতো সাহস বেড়েছে। অলস মস্তিস্ক শয়তানীর কারখানা। এ কথাটা মা তুমি ভুলে যেও না।
শেফালী বেগম খুব শীতল গলায় জোবায়দাকে বললেন,
—-তুই ঘরে গিয়ে বস। আমি আদিবাকে দিয়ে চা,টা পাঠিয়ে দিচ্ছে।
জোবায়দা ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো আহত হয়ে নিজের রুমে চলে আসলো। লাইট অফ করে লাগোয়া বারান্দায় বসে ভাবলো,
“এই পৃথিবীটা ভীষণ কঠিন জায়গা। এখানে বেঁচে থাকতে গেলে প্রতিনিয়ত দেনা পাওনার হিসেব কষে চলতে হয়। হৃদয়ের কথা শোনা বা বোঝার মতো মানুষের দেখা মেলা ভার।”
—আপু, তোমার চা।
চা,টা নিতে গিয়ে চাঁদের আলোয় আদিবার আংটির উপর জোবায়দার দৃষ্টি পড়লো। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে চুমুক দিলো। একটু ঠান্ডা পড়েছে। গরম চায়ে চুমুক দেবার পর বেশ ওম ওম লাগছে। মনে হলো আদিবা দাঁড়িয়ে আছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে বললো,
—-কিরে,কিছু বলবি?
—-তুমি তো আমার আংটিটা দেখলে না?
জোবায়দা মনে মনে বললো,”এই যে আর একজন এসেছেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগিয়ে দিতে।”
—-পরে দেখবো। তুই এখন যা।
আদিবা চলে যাবার পর কেন যেন জোবায়দার চোখদুটো নোনা জলে ভরে গেল। জোবায়দার বুকের গহীনে থাকা কিছু অবিশ্বাস আর কিছু চাপা দীর্ঘশ্বাসের স্বাক্ষী হলো ঐ আকাশের চাঁদ। পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছটায় টুপটাপ ঝড়ে পড়া শিশিরের শব্দ জোবায়দা শুনতে পারছে। ওর মনে হলো অন্য গ্রহে বাস করা হয়তো কোনো অভিমানী প্রেয়সীর কান্না মাটির পৃথিবীতে ঝরছে।
জোবায়দা অনুভব করছে, ওর বুকে আজ নেই কোনো প্রণয়ের ঢেউ। সেখানে রয়েছে শুধু তপ্ত মরুভুমি।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে