#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী
নিজ ঘরে পরবাসী হয়ে থাকতে কার ভালো লাগে? ঘরের শান্তি বড় শান্তি। জোবায়দাও ঘরের এই শান্তির কাছে হার মেনে ওমরের বায়না মেনে নিলো। ও আরো একটা কোচিং এর ব্যাচ চালু করলো। জোবায়দার এই সিদ্ধান্তে মা শেফালী বেগম ভীষণ খুশী হলেন। সংসারের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসাতে উনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আসলে স্বামী আলতাফ সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হওয়াতে পানির মত টাকা খরচ হয়ে যাওয়াতে উনি কপর্দক শুন্য হয়ে পড়েন। যদিও ঘরের কর্তা ব্যক্তিটি পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে সংসারের হালটা আর ধরতে পারলেন না।
এদিকে এতোবড় সংসার চালাতে গিয়ে শেফালী বেগম জীবন সমুদ্রের অথৈ জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলেন। তখন তার এই বিশ বছরের কন্যাটি এসে তার হাত ধরে পাশে দাঁড়ায়। মনে মনে তার এই সন্তানটির মঙ্গল কামনায় আল্লাহপাকের কাছে তিনি সর্বদা প্রার্থনা করেন।
এর মাঝে পদ্মা মেঘনা যমুনা দিয়ে বহু পানি প্রবাহিত হয়ে গেছে। জোবায়দার জীবন নদী দিয়েও অনেক স্রােত বয়ে চলেছে। একদিকে ডাক্তারী পড়া অন্যদিকে ছুটির দিনগুলোতে কোচিং এর ব্যাচ পড়িয়ে সংসারের চাকাটা সচল রাখার জন্য জোবায়দা রাতদিন এক করে খেটে চলেছে। আর এদিকে ওমর প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পাংখা মেলে উড়ছে। জোবায়দা আর ওমর পিঠাপিঠি ভাইবোন হওয়াতে ওমরকে জোবায়দা বেশ ভালো করেই চিনে। হাজার তৈল মর্দন করলেও কুত্তার লেজ কখনও সোজা হয়না এই কথাটি ওমরের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য।
জোবায়দার সামনে ফাইনাল প্রফ শুরু হবে। কিছুদিন ছুটি থাকায় বাড়িতে এসে জোরশে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কোচিং ও সমানতালে চালাচ্ছে। এরমাঝে ওমর একদিন হুট করে কাউকে কিছু না বলে ওর সহপাঠি স্বর্ণাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। ওমরের এই সিদ্ধান্তে জোবায়দা ভীষণ রেগে গিয়ে বলে,
—কোন সাহসে তুই এই কাজটা করলি? বউকে কি খাওয়াবি সেটা একবার ভেবে দেখেছিস?
—আর একবছর পরে আমি পাশ করে বের হয়ে যাবো। তখন চাকরি পেলে আর কোনো সমস্যা হবে না।
—-তোমার রেজাল্টের যা অবস্থা আদৌ কপালে চাকরি জুটবে তো?
—-তুমি নিজে ছাত্রী ভালো বলে আমার বউয়ের সামনে আমাকে অপমান করতে পারো না।
—-তোমার মান অপমান বোধ আছে?
কিন্তু ওমর জোবায়দার কথার গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো ওর মা শেফালী বেগমকে থ্রেট দিয়ে বলে,
—-আম্মু তুমি যদি ছেলে হাতছাড়া করতে না চাও তাহলে স্বর্ণাকে বরণ করে ঘরে তুলে নাও। নয়ত আমি ওর হাত ধরে চিরতরে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। ভেবে দেখো আমি কিন্তু তোমার উপকার করেছি। কষ্ট করে তোমার আর বউ খুঁজতে হলো না।
মায়ের সাথে এভাবে নির্লজ্জের মতো কথপোকথনে ওমরের সাথে জোবায়দার আর কথা বলতে রুচি হলো না। নিজের রুমে গিয়ে সপাটে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। একটু পরে আদিবা এসে বললো,
—-আপু,দরজাটা খোলো। আম্মু বলেছে ভাইয়ার বাসর এ ঘরে হবে।
—-কেন ওমর আর জাফরের রুমে বাসর সাজানোর ব্যবস্থা কর। আমি এখন এরুম ছাড়তে পারবো না।
—-ঐ রুমের খাটটা ভাঙ্গা। তাই এই রুমে খাটটা আম্মু সাজাতে বলেছে।
অগত্যা জোবায়দা ওর বইপুস্তক নিয়ে ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। এদিকে আলতাফ সাহেবের শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগলো। ওমরের এভাবে বিয়ে করে আনাটা উনিও হয়তো মেনে নিতে পারেননি। স্ট্রোকের পর উনার গলা দিয়ে তেমন সাউন্ড বের হয় না। নিরবে পরিবারের এসব কাহিনী দেখে গেলেন।রাতে উনার প্রেসার অনেক হাই হয়ে গেল। জোবায়দা ওর বাবার প্রেসার মেপে দেখে সিস্টোলিক ১৮০ আর ডায়াস্টোলিক ১১০। ও আর অপেক্ষা না করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আলতাফ সাহেবকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে ওর এক পরিচিত ডাক্তারের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে । তবে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়াতে ওর বাবা এবার বড় ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়। জোবায়দা অবশ্য এতেই খুশী। মানুষটা বেঁচে তো আছে! একটা মেয়ের মাথার উপর বাবার ছায়া থাকাটা জরুরী। এটা জোবায়দা ভালোই বুঝতে পারে। এক সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে জোবায়দা বাবাকে নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে। এর দু,দিন পর জোবায়দার ফাইনাল প্রফ শুরু হয়। সব ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে অবশেষে জোবায়দার প্রফ শেষ হয়। ভালোভাবে ডাক্তারী পাশ করে জোবায়দা ইন্টানী ডাক্তার হিসাবে ময়মনসিংহ মেডিকেলে জয়েন করে। মেয়ের সাফল্যে শেফালী বেগম খুশী হলেও মনে মনে ওমরের উপর বিরক্ত হন। উনি আশা করেছিলেন,উনার আদরের ওমর একদিন এই সংসারের হাল ধরবে। অথচ ওমরের সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। বরং বিয়ে করে নিয়ে এসে এই সংসারে আর একজন খাওয়ার লোক বাড়িয়ে ফেললো। এই কয়দিনে উনি যতটুকু বুঝেছেন, ছেলের বউটা তার মোটেই সুবিধার হয়নি। সারাদিন রুমে দরজা বন্ধ করে মোবাইলে কি যেন টিকটক করে। যদিও এসব বিষয়ে শেফালী বেগমের খুব একটা জ্ঞান নেই। মেয়েটার একদম চোখের চামড়া নেই। শেফালী বেগম সারাদিন সংসারের পিছনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাঁটছেন অথচ বৌটা এসে একটুও কাজে হাত লাগায় না। পরের মেয়ের কথা বলে কি হবে। নিজের মেয়ে আদিবাটাও কম যায় না। সারাদিন নিজের রুপচর্চা নিয়ে থাকে। কলেজে উঠে যেন সাপের পাঁচপা দেখাচ্ছে। অথচ এসএসসি তে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে টেনেটুনে জিপিএ 4, পেয়েছে।
এরমাঝে হিমেল বিসিএস দিয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডারে জয়েন করে। বাসায় ওর মা বাবাকে জোবায়দাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠানোর ব্যাপারে রাজী করায়। প্রথমে অবশ্য হিমেলের বাবা প্রস্তাব পাঠানোর ব্যাপারে রাজী হতে চায় না। কিন্তু হিমেল উনাকে বলে যদি প্রস্তাব না পাঠায় তাহলে ও বিদেশে চলে যাবে। দেশে আর ব্যাক করবে না। ছেলেকে হাতে রাখার জন্য জমির মোল্লা রাজী হয়।যদিও হিমেল জোবায়দাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে কিছু জানায় না। কিন্তু এখানে হিমেলের বাবা জমির মোল্লা একটা কূট চাল দেয়। কেননা হিমেল নতুন করে কনে দেখতে যেতে চায় না। একবারই বিয়ের আসরে বর সেজে গিয়ে জোবায়দাকে অবাক করে দিবে। নিজের আকাঙ্খিতো প্রেয়সীকে দুচোখ ভরে দেখার অপেক্ষায় হিমেল দিন গুনতে থাকে। মনের গোপন কোনায় জমিয়ে রাখা ভালোবাসার ফুটন্ত শতদলগুলো জোবায়দার হাতে তুলে দিয়ে প্রণয়ের চাদরে ওকে জড়িয়ে নেওয়ার স্বপ্নে হিমেল সেই কবে থেকে বিভোর হয়ে আছে। ও ভাবছে শীঘ্রই ওর অপেক্ষার অবসান হবে।
কিন্তু নিয়তির নিঠুর খেলায় জোবায়দা আর হিমেল দুই ভুবনের বাসিন্দা রয়ে গেল। জোবায়দার আটচল্লিশ ঘন্টা ডিউটি পড়েছে। এরমাঝে জমির মোল্লার কূটচাল অনুযায়ী উনারা জোবায়দাদের বাড়িতে এসে আদিবাকে আংটি পড়িয়ে দিলো। কারণ বেশী বুদ্ধীমতি মেয়েদের জমির মোল্লা পছন্দ করেন না। এদের বশে আনা মুশকিল। জোবায়দার তুলনায় আদিবার বুদ্ধির ধার বেশ কম। দেখতেও আদিবা জোবায়দার থেকে একটু বেশী সুন্দরী। জমির মোল্লার ধারনা বিয়ে হয়ে গেলে হিমেল আর বেশিদিন আদিবার থেকে দূরে থাকতে পারবে না। হাজারও হোক পুরুষ মানুষ বলে কথা। নিজের বউকে আর কতদিন দূরে সরিয়ে রাখবে।যদিও হিমেলের মা জোবায়দাকে বেশী পছন্দ করেন। কিন্তু হিমেলের বাবা রাজী না দেখে উনিও আর জোর করেননি। এই পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করার উনার খুব ইচ্ছে ছিলো। জোবায়দার পরিবর্তে আদিবাকে বউ করে আনতে জমির মোল্লা রাজী হয়েছে এতেই উনি খুব খুশী। আর ওদিকে জোবায়দার মা শেফালী বেগমও মনে মনে খুশী। কারণ এই মুহুর্তে উনিও জোবায়দাকে বিয়ে দিতে চান না। জোবায়দা ছাড়া উনার সংসারের হাল ধরার কেউ নেই। আলতাফ সাহেবের ওষুধের পিছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ওমরের ফাইনাল পরীক্ষা কেবল শেষ হয়েছে। কবে চাকরি পাবে কে জানে। উনার ভয় হয় জোবায়দা বিয়ের পর যদি আর খরচ চালাতে না পারে তাহলে উনি কিভাবে এই সংসার সামলাবেন? তবে ওমরের চাকরি হলে উনি জোবায়দার বিয়ের ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু করবেন। তাইবলে হিমেলের মতো ভালো পাত্রকে তো আর হাতছাড়া করা যায় না। আর উনিও দুটো মেয়ের মধ্যে একটা মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হওয়াতে কন্যাদায় হতে কিছুটা মুক্ত হলেন। সবার স্বার্থবাদী চিন্তায় দুটো হৃদয় যে ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল এবিষয়টা একবারের জন্য কেউ ভাবলো না। মানুষের জীবন আসলেই বড় অদ্ভূত।
চলবে