#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৩৯)
এক রাতের শর্ট নোটিশে বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। শীতের কনকনে হাওয়া নাকি অন্য রকম এক শিহরণ নবনীকে সারা শরীর কাঁপিয়ে দিলো!
নবনীর সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না নবনী। আনন্দ, আবেগ,উত্তেজনায়,ভয়ে নবনীর দম বন্ধ হবার যোগাড়।
ক্ষণে ক্ষণে নবনীর পুরো চেহারা রঙ বেরঙ হয়ে যাচ্ছে।
চুল খুলে নবনী বসলো চুলে তেল দেওয়ার জন্য।সেই মুহুর্তে ফাল্গুনী এলো হাতে করে দুইটা মেহেদীর টিউব নিয়ে। চৈতালী এলো একটু পরে।দুই বোন মিলে ঝাপটে ধরলো নবনীকে।মেহেদী পরতেই হবে নবনীর আজকে।
নবনী লজ্জায় লজ্জাবতী পাতার মতো কুঁকড়ে গেলো। তার বুকের ভেতর কেমন দুরুদুরু করছে।
দুই বোন দুই হাত টেনে ধরে নবনীর হাতে মেহেদী পরাতে লাগলো। খোলা চুল বারবার উড়ে এসে নবনীর নাকে মুখে লাগছে।
নবনী বিরক্ত হচ্ছে, নবনীর বিরক্তি দেখে দুই বোন হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
চৈতালী বললো, “আপা,তোকে একেবারে সিনেমার নায়িকাদের মতো লাগছে।এতো সুন্দর কেনো আপা তুই?”
নবনী মুখ বাঁকিয়ে বললো, “পাকা কথা বাদ দিয়ে আমার চুল বেঁধে দে তুই আগে।আমার অস্বস্তি হচ্ছে খোলা চুলে।”
ফাল্গুনী বললো,”না আপা,আজকে তোমার চুল বেঁধে দেওয়া হবে না।তোমাকে মন ভরে দেখতে দাও। এই মুহুর্ত কি আর ফিরে আসবে আমাদের জীবনে?
তুমি চলে গেলে আমরা আবারও একা হয়ে যাবো আপা।”
মুহূর্তেই হাসিমুখে অন্ধকার নেমে এলো নবনীর। এই ব্যাপারটা নবনী কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।মনে হলেই কেমন মাথা এলোমেলো লাগে নবনীর।একবার সব ছেড়ে গিয়েছে, এখন বুঝি আবারও চলে যেতে হবে?
বাবা মা ভাই বোন,এদের সবাইকে ছেড়ে আবারও যেতে হবে অন্যের ঘরে!
বুকের ভেতর একটা ঝড় বয়ে গেলো। এতো উত্থানপতন কেনো এক জীবনে?
মেয়েদের জীবন এতো অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক কেনো?
জন্ম থেকে যাদের কাছে বেড়ে ওঠা,যারা ছিলো সবচেয়ে আপন,যেই ঘর ছিলো একান্ত আপন সেই ঘর একদিন ভীষণ অচেনা হয়ে যাবে।আজ থেকে ২০ বছর পর এই ঘরকে আর নিজের ঘর বলতে পারবে না।এই ঘরের মানুষেরা একদিন ভীষণ অচেনা হয়ে যাবে।আজ যেই ভাইবোন মিলে একসাথে গলাগলি করছে,একটা সময় আসবে যখন ভাইবোনের সাথে বছরের পর বছর কেটে যাবে আর দেখা হবে না।
একই শহরে থেকেও সময়ের অভাবে কেউ কারো সাথে দু দন্ড মন খুলে কথা বলতে পারবে না।নিজের সন্তানের মতো করে যেই ভাইবোনকে বড় করে তুলেছে তাদের সাথে আর দেখা হবে না।
এই ছোট্ট ভাই বোনেরা এক দিন বড় হবে।জীবনের তাগিদে একজন একদিকে চলে যাবে।এই যে ভাইবোন সবার মিলনমেলা বসে এই মিলনমেলা কি আর বসবে?
এই চাঁদেরহাট একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আহারে জীবন!
বৈচিত্র্যময় জীবন!
সাব্বির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নবনীর দুটো ক্যান্ডিড ছবি তুললো। তারপর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিলো মেঘের কাছে।
এই প্রথম বার মেঘ নবনীর ছবি পেলো।আকাশরং জামা পড়ে এলোমেলো চুলে যেনো রূপকথার রানী বসে আছে।
সাব্বিরকে টেক্সট দিয়ে বললো, “এর জন্য তুমি স্পেশাল একটা ট্রিট পাবে আমার তরফ থেকে। ”
সাব্বির রিপ্লে দিলো, “ট্রিট চাই না ভাইয়া, আমার আপা কাঁদছে। অনুরোধ করছি,এই কান্না যেনো আমার আপার শেষ কান্না হয়।আপনার কাছে যাওয়ার পর আমার আপার মুখ থেকে যেনো হাসি না ফুরায়।”
মেঘের ভীষণ ভালো লাগলো বোনের প্রতি ভাইয়ের এই ভালোবাসা দেখে।পৃথিবীর সব ভাইয়েরাই বুঝি এমন হয়।বড় হোক বা ছোট, বোনেদের জন্য বুকের গভীরে একটা আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা পুষে রাখে পরম যতনে।
যেমন করে মেঘ পুষে রেখেছে মেঘলার জন্য।
সাব্বির রুমের ভিতরে গিয়ে নবনীর চুল বেঁধে দিলো একটা হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে। অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে অবাধ্য চুলগুলো বড্ড জ্বালাতন করছে বোনকে।
সামান্য একটা কাজ,অথচ নবনী নিজেকে সামলাতে পারলো না আর।হুহু করে কেঁদে উঠলো।
কান্না একটা ছোঁয়াচে রোগের মতো। বিশেষ করে আপন জনের কান্না।আপন মানুষের কান্না দেখলে সবারই দুই চোখ ভিজে যায় নিজের অজান্তে। বুকের ভেতর দুঃখের নদীতে জোয়ার উঠে।
নবনীর কান্নাও সেভাবে ছড়িয়ে গেলো ভাইবোনদের মাঝে।একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আড়াল থেকে সেই কান্নার সাক্ষী হয়ে রইলেন হাশেম আলী আর রাবেয়া বেগম।
দুজনের চোখ ভেজা,বুকে হারানোর যন্ত্রণা তবুও সন্তানের সামনে গেলেন না।ভাইবোনের ব্যাপার, ওরা নিজেরাই সামলে নিক।
হাশেম আলী ফিসফিস করে বললেন,”আমার ঘরের চন্দ্রটা বুঝি অন্য ঘরে চইলা যাইবো নবনীর মা?আমার ঘর আন্ধার কইরা দিয়া আরেক ঘরে আলো দিবো।”
রাবেয়া বেগম আঁচলে চোখ মুছে বললেন,”আপনেও পোলাপাইনদের মতো কথা কন!মাইয়াগো কি ক্ষমতা আছে বাপের বাড়ি আজীবন পইড়া থাকনের।এইটাই তো এই দুনিয়ার নিয়ম। নিজ হাতে বড় কইরা মাইয়ারে তুইল্লা দেওন লাগে অন্যের হাতে।এই নিয়ম চলে আসছে,চলবেই।”
হাশেম আলী ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন।নিজেকে সামলে নিয়ে বোনদের কাছে,প্রতিবেশীদের কাছে ফোন দিলেন।একে একে একজন দুজন করে প্রায় ২০-২৫ জন হয়ে গেলো।
শফিক আহমেদ কল দিলেন হাশেম আলীকে। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বললেন,”আপনার কাছে একটা অনুরোধ করতে চাই।আমাকে কথা দিন আপনি আমার কথা রাখবেন।ধরে নিন আপনার ভাই আপনার কাছে কিছু চাইছে।”
হাশেম আলী হতভম্ব হলেন শুনে।তারপর ভীতু গলায় বললো, “জ্বী,বলেন ভাইসাব”
শফিক আহমেদ বললেন,”আপনি তো আপনার প্রাণটাই আমার ছেলের হাতে তুলে দিবেন।তাই আমি চাচ্ছি,বিয়েতে মেহমানদারি করতে যা যা করা লাগে সবটাই আমরা করবো।আপনারা এসব নিয়ে একটুও মাথা ঘামাবেন না।আপনার মেয়েটা ছাড়া আর অন্য কিছু চাওয়ার নেই আমাদের। দয়া করে আমাকে ভুল ভাববেন না।আমি সমাজের প্রচলিত নিয়ম মানতে চাই না,যেই নিয়ম মেয়ের বাবার মাথায় বারি দিয়ে সর্বস্বান্ত করে দেয়।একটা মানুষ তার কলিজার টুকরা আমার হাতে তুলে দিবে আর আমি কি-না পাষন্ডের মতো মেয়ের পাশাপাশি খাওয়া দাওয়া, এটা-সেটা চাইবো!
এই শিক্ষা আমি পাই নি।”
হাশেম আলী বিমূঢ় হয়ে গেলেন শফিক আহমেদের বিনয় দেখে।সব মানুষ খারাপ হয় না হাশেম আলী আবারও টের পেলেন।পৃথিবীতে আজও ভালো মানুষ আছে।আর আছে বলেই পৃথিবী টিকে আছে।
নবনীর ফুফু,ফুফা,মামা,খালু,প্রতিবেশী কয়েকজন ১১টার দিকেই চলে এলো।
নবনীদের বাসা দেখে নবনীর তিন ফুফু অবাক হলো। হাশেম আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, “এতো বড় বাসায় থাকস তোরা?কতো দেস ভাড়া?”
অন্যজন জিজ্ঞেস করলো, “নবনী কি অনেক বড় চাকরি করে? আমরা তো ভাবতেই পারি নাই এরকম বড় বাসা তোগো।তোর তো কপাল খুলে গেছে রে হাশেম।”
হাশেম আলী আনন্দিত হলেন মেয়ের সাফল্যে।
নবনীকে সাজাতে পার্লার থেকে দুজন মেয়ে এলো সকাল বেলা শিমলার সাথে।শিমলা দাঁড়িয়ে থেকে ডিরেকশন দিতে লাগলো। ভারী সাজ যাতে না হয়,সিম্পল একটা লুক যাতে দেওয়া হয়। ন্যাচারাল লাগে যেনো।
একটা সাদা রঙের জামদানী শাড়ি পরে নবনী বিয়ের জন্য সাজলো,সাথে জামদানী একটা ওড়না গোলাপি রঙের। ডায়মন্ডের এক সেট সিম্পল গহনা পরানো হলো নবনীকে।
সাদা শাড়ি,গোলাপি ওড়নায় নবনীকে পরীর রানীর মতো লাগলো। নবনী নিজেই মুগ্ধ হয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো।
নবনীদের বাসায় বিয়ে হলো।খাবার এলো ৫ তারা হোটেল থেকে। মেঘকে দেখে নবনীর আত্মীয় স্বজন সবাই চমকে গেলো। নবনীর বড় ফুফু ফিসফিস করে রাবেয়া বেগমকে বললেন,”তোর ডিভোর্সি মেয়ের জন্য এই রাজকুমার কেমনে জোটাইলি?
সিনেমার নায়কদের মতো দেখা যায় এরে।”
মাসুমা বেগম এসেই নবনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোকে শিমলার বাসায় প্রথম দেখেই আমার এতো ভালো লেগেছে।আল্লাহর কাছে মনে মনে তোকে চেয়েছি ছেলের বউ করতে।আল্লাহ ফিরিয়ে দেয় নি আমাকে।আজ থেকে কাগজে কলমে তুই আমার ঘরের মেয়ে হয়ে গেলি।মৃত্যু পর্যন্ত এই ভাতে,এই কাপড়ে যেনো জীবন কাটাতে পারিস এই দোয়া করি মা তোকে।”
নবনীর আত্মীয় স্বজন সবাই অবাক মেঘের পরিবার দেখে।একটা ডিভোর্সি মেয়ের ভাগ্য এতটা ভালো হবে কেউ কখনো ভেবেছে?
এতো বড় ঘরের মেয়ে হবে কেউ কি জানতো এটা?
কবুল বলতে গিয়ে নবনীর গলা শুকিয়ে গেলো। দুচোখ জুড়ে শ্রাবণের ধারা বইতে লাগলো। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি ভাইবোন ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে।তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নবনীর মনে হলো প্রচন্ড যন্ত্রনায় সবার মুখ নীল হয়ে গেছে। যেনো কেউ ওদের কলিজা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে তিনজনে মিলে।
উদভ্রান্তের মতো লাগলো নবনীর নিজেকে।হায়,আজ থেকে বুঝি পরের অধীন হয়ে যাচ্ছে সে!
বাবাকে ভীষণ মনে পড়লো নবনীর।কান্নাভেজা গলায় একবার ব্যাকুল হয়ে বাবা বলে ডাকলো নবনী।
হাশেম আলী যেনো অপেক্ষায় ছিলেন মেয়ের একটা ডাকের।ছুটে এলেন মেয়ের কাছে।জড়িয়ে নিলেন বুকের ভেতর। এই যেনো তার ছোট্ট নবনী।রাতে ভয় পেলে যেভাবে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে সে কান্না করতো, বহু বছর পর আজ আবারও তেমন করে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না করছে।হাশেম আলীর দম বন্ধ হয়ে আসছে যেনো। এই বুঝি চিরতরে মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
কিভাবে দিবেন তিনি নিজের প্রানপাখিকে বিদায় দিতে?
এ যে বড় নিষ্ঠুর নিয়ম এই পৃথিবীর। সব বাবা মাকেই যেনেই নিয়ম পালন করতে হয়।
কেউ কোনো তাড়া দিলো না নবনীকে হালকা হবার সুযোগ দিলো।অনেকক্ষণ পর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে নবনী কবুল বললো।
মেঘ তামিমকে বিশেষ ভাবে দাওয়াত করেছে আজ।ঘটনা কি জানার জন্য তামিম লাজ লজ্জা ভুলে বরপক্ষের সাথে এলো।সাদা একটা পাঞ্জাবি পরা মেঘের পাশে সাদা জামদানী শাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা নবনীকে দেখে তামিমের মন ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলো। টের পেলো বুকের ভেতর ভীষণ জ্বালাপোড়া হচ্ছে।এই মেয়েটা আজ থেকে তামিমের ভীষণ পর হয়ে গেলো। এনগেজমেন্টের পরেও যা একটু চান্স ছিলো আজ থেকে সব পথ বন্ধ তামিমের। পরাজিত সৈনিকের মতো তামিম পালিয়ে গেলো এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে। হেরে গেছে সে।একূল ওকূল কোনোটাই আর রইলো না তার।
নবনী ও হারিয়ে গেলো, নিতুকে ও নিজ দোষে হারালো। প্রথমবারের মতো তামিম বুঝতে পারলো সে ভীষণ একা আজ থেকে।
খাওয়া দাওয়ার পর মেহমানরা সবাই বিদায় নিলো। সন্ধ্যার দিকে নবনীদের পক্ষের সবাই ও চলে গেলো।যেহেতু ঈদ চলে এসেছে সামনে, তাই কেউ বেড়াতে পারলো না একদিন।মেঘ ও বরযাত্রীর সাথে চলে গিয়েছে।
পুরো বাসা নিরব নিস্তব্ধ হয়ে যাবার পর নবনী নিজের রুমে গিয়ে বসলো।
কেমন শূন্যতা অনুভব হলো নবনীর হঠাৎ করেই। ভালো লাগা এবং খারাপ লাগা নিয়ে একটা অন্যরকম অনুভূতি জন্ম নিলো।
রাতে মেঘের কল এলো। নবনীর ভীষণ লজ্জা লাগলো আজ আবারও মেঘের কল রিসিভ করতে।আজ থেকে এই মানুষটা নবনীর স্বামী। নবনীর একান্ত আপন লোক।
নবনী কল রিসিভ না করায় মেঘ মেসেজ দিয়ে বললো, “আজ থেকে তো আমার সাথে বের হতে কোনো ভয় নেই নবনীতা। আমি অপেক্ষা করছি,নেমে এসো।আজ আমরা পুরো শহর ঘুরবো। তাছাড়া তোমাকে একটা চুমু খাওয়া বাকি আছে।
এতো দিন প্রেমিক ছিলাম বলে কখনো এই আবদার করি নি।আজ তো বৈধতা পেয়ে গেছি।তাড়াতাড়ি আসো।”
আপনমনে হেসে বিড়বিড় করে নবনী বললো, “এই লোকটা ভীষন রকমের খারাপ!”
চলবে……
রাজিয়া রহমান