#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৩৬)
সিলেট ভ্রমণ নবনীর জীবনের অন্যতম আনন্দময় ভ্রমণ ছিলো। জাফলং ভিউ পয়েন্টে গিয়ে নবনীর মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেলো। মে থেকে জুলাই মাস হচ্ছে জাফলং ভ্রমণের অন্যতম সময়। কিন্তু নবনীরা যখন গিয়েছে তখন অক্টোবর মাস।তাই টিভিতে যেমন জলে টইটম্বুর নদী দেখে মন পুলকিত হতো নবনীর এখন এরকম হলো না।মেঘ নবনীর মন খারাপ বুঝতে পেরে বললো, “আগামী বছর আমরা আবার আসবো নবনীতা।তখন আমাদের একটা নতুন পরিচয় থাকবে।আমরা দুজন স্বামী স্ত্রী হয়েই আসবো।”
চারদিকে শুধু পাথর আর পাথর।পাথরের উপর দিয়ে হাটতে গিয়ে অসাবধানতার জন্য নবনী পায়ে চোট পেলো।
তবুও ভ্রমণটা আনন্দময় লেগেছে সবাই মিলে একসাথে থাকায়।নবনীর মনে পড়ে গেলো সিড়ি বেয়ে ভিউ পয়েন্টে নামার সময় সব কিছুই ঠিক ছিলো।অস্থায়ী দোকানগুলো থেকে সবাই ইন্ডিয়ান,বাংলাদেশি অনেক কিছু কিনেছে প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় সবকিছুই।
সিড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় মেঘলা গোঁ ধরলো তাকে শৈবাল কোলে করে নিয়ে আসতে হবে উপরে।সে হেটে উঠতে পারবে না।
শফিক আহমেদ এবং আসমা বেগম শৈবালকে বললেন,”নে নে,মেঘলাকে কোলে তুলে নে।”
আসমা বেগম বললেন, “আহারে,আমার পুতুলের কোমল পা জোড়া ব্যথা করছে বুঝি।খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে কি তামাশা দেখস না-কি শৈবাল ওকে কোলে নে।”
মাসুমা বেগম বিরক্ত হলেন।রেগে গিয়ে বললেন,”এখানে এতো আহ্লাদীপনা দেখাতে হবে না।পাগল নাকি?এতো মানুষ এখানে,আর শৈবাল কি-না মেঘলাকে কোলে নিয়ে হাটবে?এই মেয়ের ওজন কি কম না-কি? নিম্নে ৭০ কেজি হবে।”
মেঘলা নাকি সুরে বললো,”৭০ নাঁ তোঁ মাঁ,৬৬ কেঁজিঁ।”
শৈবাল কিছুটা লজ্জা পেলো কিন্তু আসমা বেগমের চোখ রাঙ্গানি দেখে বাধ্য হয়ে মেঘলাকে কোলে তুলে নিলো।
ফাল্গুনী,চৈতী, সাব্বির,শিমলাসহ বাকী সবাই শিষ বাজাতে লাগলো এটা দেখে।
মাসুমা বেগম রাগ হয়ে বললেন,”নিজের মেয়ের দুঃখ তো বুঝলে,এবার তোমার ছেলেকে বলো নবনীকে কোলে নিতে।এমনিই বেচারি পাথরের সাথে লেগে চোট পেয়েছে পায়ে।ওর তো আরো বেশি অসুবিধা হচ্ছে হাটতে।”
মেঘ আগেই বলে উঠলো, “বান্দা হাজির মা।নবনী,লাফ দিয়ে কোলে উঠে পড়ো তো। অনেক দিনের শখ তোমাকে কোলে নিয়ে হাটার।এক সুযোগে ইচ্ছে পূর্ণ করে নিই।”
নবনী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো, “না না,তা লাগবে না।আমি হাটতে পারছি।”
মেঘ চোখ মে/রে বললো, “এরকম সুযোগ হাতছাড়া করতে নেই।”
শফিক আহমেদ বললেন,”অসুবিধা কিসের?নে মেঘ,ওকে কোলে নে।”
নবনী প্রায় কেঁদে ফেলবে এরকম করে বললো,”না স্যার,আমি হাটতে পারছি।প্লিজ এরকম করতে বলবেন না।”
শফিক আহমেদ বললেন,”লজ্জা পেও না মা।আমাকে স্যার বলবে না খবরদার। বাবা বলার প্রাকটিস করো।আর এই হাঁদারামকে যতো খুশি খাঁটিয়ে নাও।আমরা কেউ-ই কিছু মনে করবো না। ”
নবনীর ভয়ার্ত মুখ দেখে সবাই হেসে ফেললো। মাসুমা বেগম গৌরবের ভঙ্গিতে বললেন,”ভদ্র মেয়ে বলে তোমার মেয়ের মতো বেহায়াপনা করতে চায় নি।ছি ছি,আমার তো মাঝেমাঝে সন্দেহ হয়,এই ছেলেমেয়ে দুটো আমার পেট থেকে হয়েছে কি-না! নাকি হাসপাতালে বাচ্চা অদলবদল হয়ে গেছে। ”
শৈবাল মেঘলাকে কিছুদূর নিয়ে ধপ করে ফেলে দিলো নিচে।তারপর হয়রান হয়ে নিজেও বসে পড়লো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “তুই মানুষ না-কি আস্ত জলহস্তী মেঘলা? দেখে তো মনে হয় ফুঁ দিলে উড়ে যাবি।ওখান থেকে কি পাথর কয়েকটা গায়ে বেঁধে নিয়েছিস না-কি?আমার তো আরেকটু হলেই দম বন্ধ হয়ে যেতো। ”
মেঘলা ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,”বাবা,এই বিয়ে ক্যান্সেল। শৈবাল আমাকে কোল থেকে ফেলে দিয়েছে। ”
শফিক আহমেদ মাথা নেড়ে বললেন,”ভেরি ব্যাড শৈবাল। ”
মাসুমা বেগম যথেষ্ট বিরক্ত হলেন স্বামীর এরকম ব্যবহারে। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলেন। এরকম করার জন্য শফিক আহমেদকে একটা উচিত শিক্ষা দিবেন ভেবেও ঠিক করলেন।
উপরে আসতেই দেখলেন শীলপাটা বিক্রি হচ্ছে।একটা শীলপাটা কিনে মাসুমা বেগম শফিক আহমেদকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,”গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবে তুমি এটা।শৈবাল যদি তোমার মেয়েকে এতটা পথ কোলে তুলে নিয়ে আসতে পারে তবে তুমিও পারবে এইটুকু পথ বয়ে নিতে।আমাকে তো আর কোলে নিতে হচ্ছে না,আপাতত এটা কোলে নাও।”
মুখ চুন করে শফিক আহমেদ স্ত্রীর কথা মেনে নিলেন।হাশেম আলী আর রাবেয়া বেগম এদের কর্মকাণ্ড দেখে হেসেই মরে যাচ্ছে।
চৈতালী ভাইকে ডেকে ফিসফিস করে বললো, “আপার কপাল ভীষণ ভালো তাই না ভাইয়া। দেখ না,কি মজার একটা পরিবারের বউ হতে যাচ্ছে আপা।”
ফাল্গুনী বললো, “দুঃখের পর সুখ আসে এটা তো চিরন্তন সত্যি।আপা একটা সময় ভীষণ কষ্ট পেয়েছে,এজন্য দেখ আল্লাহ আপার কপালে এখন কতো সুখ লিখে রেখেছে।”
সাব্বিরের দুই চোখ জলে ভরে গেলো বড় বোনের কথা ভাবতেই।আপা না থাকলে তারা সবাই সেই কবেই ভেসে যেতো। আপা-ই তো শক্ত হাতে তাদের হাল ধরেছে।
সাব্বির ভাবছে সে কি কখনো আপার মতো করে পারবে সবার হাল ধরতে।শেষ বয়সে বাবা মা’কে আদর যত্ন করে রাখতে পারবে তো?আপার এতো কষ্টের মূল্য সে যথাযথভাবে দিতে পারবে তো?
সিলেট ফেরার পথে সবাই মিলে তামাবিল বর্ডার দেখে এলো। হাশেম আলী আর রাবেয়া বেগম যা দেখছেন তাতেই মুগ্ধ হচ্ছেন।
বাড়ির চৌহদ্দির ভিতরে বাস করা রাবেয়া বেগম আর গ্রামে একটা ছোট চায়ের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা হাশেম আলীর কাছে এ যেনো এক অন্য দুনিয়া।
আল্লাহর দুনিয়ায় দেখার মতো এতো কিছু আছে অথচ তারা জানতো-ই না এসব।রাবেয়া বেগম যাই দেখছেন তাতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে হাশেম আলীকে ফিসফিস করে বলছেন,”দ্যাখেন দ্যাখেন,কি সুন্দর তাই না?আল্লাহ দুনিয়া এতো সুন্দর কইরা বানাইছে?
আমার কেমন আচানক লাগতাছে সবকিছু দেইখা।”
হাশেম আলীর দুই চোখ আনন্দে ভিজে যাচ্ছে বারবার। জীবনে এতো আনন্দ তিনি কখনো পান নি।স্রষ্টার এতো সুন্দর সৃষ্টি দেখে হাশেম আলী বারবার ভাবছেন,”ওই আল্লাহ না জানি কত্তো সুন্দর।”
অফিসের লোকদের সাথে একজোট হয়ে আলাদা ঘুরলেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তামিম নবনীকে দেখছিলো।কি আশ্চর্য, এখনো বুকের ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার।নবনী তার নয় এটা তামিমের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।ওই তো দেখা যাচ্ছে নবনীকে। গাঢ় সবুজ রঙের থ্রিপিস পরনে নবনী।গায়ে সাদা একটা পাতলা চাদর।কানে সবুজ পাথরের ছোট একজোড়া দুল পরা। তামিম মুগ্ধ হয়ে দেখছে।এ যেনো সবুজ বনে ফুটে থাকা একটা সাদা গোলাপ।
গ্রীক দেবীদের মতো অপূর্ব সুন্দর নবনী।মেরিল দেওয়া ঠোঁটজোড়া ভেজা-ভেজা।এক সময় এই অধরযুগলের উপর তামিমের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো। কেনো তখন একবার ভালো করে দেখে নি তামিম।আজ বহুদিন পর একটা অন্যায় ইচ্ছে মাথাচাড়া দিচ্ছে।ওই ঠোঁট জোড়ায় একটা গাঢ় চুম্বনের স্বাধ জাগছে।
আর পারছে না তামিম।নিজেকে ভীষণ পাগল পাগল লাগছে তার আজ।
তামিমের আড় চোখের নজর মেঘের চোখ এড়ালো না।তামিমের সামনে থেকে আড়াল করার জন্যই যেনো মেঘ বারবার নবনীর পাশ ঘেঁষে দাড়াচ্ছে।
নবনী এতে করে ভীষণ বিব্রত হচ্ছে। লজ্জায় পড়ে যাচ্ছে মেঘ বারবার তার আশেপাশে থাকায়।
————–
জাফলং ট্যুর নবনীর জীবনের অন্যতম মধুর একটা স্মৃতি।জাফলং ছাড়া ও আরো অনেক জায়গায় ঘুরেছে সবাই মিলে। নিজের বাবা মা হবু স্বামী সবাইকে নিয়ে এক আনন্দময় সময় কাটিয়ে নবনীরা বাসায় ফিরেছে গতকাল। এখনো মনের মধ্যে ট্যুরের সেই রেশ রয়ে গেছে।এক অনিন্দ্য ভালোলাগায় নবনীর মন ভরে আছে। হালকা শীত শীত লাগছে,মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে এরকম এক আরামদায়ক ওয়েদারে নবনী মায়ের হাতে সেলাই করা কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছে। স্বপ্নে মেঘের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখনো জাফলং এ।আজকের সকালটা কেমন অলস অলস লাগছে নবনীর। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না।জানালার পর্দা ভেদ করে সকালের কাঁচা সোনা রোদ এসে উঁকি দিয়েছে রুমে।আরামদায়ক আলস্যে নবনী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
রোদের উঁকিতে বাহিরে কুয়াশা মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে।রাস্তা থেকে ভেসে আসছে গাড়ির হর্ণ,হকারের ডাক,সবজিওয়ালার হাঁক।
হঠাৎ করেই নবনীর মনে হলো সে ভীষণ সুখী। কেনো এরকম মনে হলো নবনী জানে না।প্রিয় মানুষকে আপন করে পাচ্ছে বলেই কি এরকম মনে হচ্ছে?
নবনী বের হলো বাহিরে যাবার জন্য।রাবেয়া বেগমের বানানো কাঁথা সেল করার জন্য নবনী একটা পেইজ খুলেছিলো,পেইজে ইদানীং বেশ ভালো রেসপন্স পাচ্ছে নবনী।হাতের কাজের জিনিসপত্র এখনো মানুষ সাদরে গ্রহণ করে,এর গ্রহণযোগ্যতা এখনো আছে দেখে নবনীর ভীষণ ভালো লাগলো।
কাঁথার কয়েকটা অর্ডার পেন্ডিং। ৭ জন গ্রাহক অগ্রীম টাকা ও পাঠিয়ে দিয়েছে। নবনী বের হলো তাই গ্রাহকদের কাস্টমাইজেশন অনুযায়ী কাপড়, সুতা কিনতে।নবনীর ভীষণ ইচ্ছে সুই-সুত এবং রং তুলির একটা উদ্যোগ নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে যাবার।নিজের আলাদা একটা পরিচয় গড়ার।
কেনাকাটা করে নবনী যখন ফিরছিলো লিফটম্যানের থেকে জানতে পারলো লুবনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। শুনে নবনী খুশি হলো।
বাসায় ফিরে মা বাবাকে বললো। কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
শুধু রাবেয়া বেগম এটুকু বললেন,”মেয়েটার ভবিষ্যৎ ভালো হোক।ওর মায়ের মতো শাশুড়ী যেনো না জোটে।”
হাশেম আলী বিরক্ত হয়ে বললেন,”এসব কেমন কথা কও।বাদ দেও তো রাবেয়া।এইসব ভুইলা যাও।”
নবনী একটু ভেবে বললো, “বাবা,ওই বাসা থেকে আমাকে যে সব গহনা দেওয়া হয়েছে,যে টাকা বাবা আমাকে দিয়েছেন, আমি টাকা,গহনা সব ফিরিয়ে দিতে চাই ওদের।”
হাশেম আলীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো মেয়ের কথা শুনে। আনন্দিত হয়ে বললেন,”এই কথাটা আমার মাথায় অনেক দিন ধরে ঘুরতেছিলো রে মা।কিন্তু বলি নাই কিছু তবুও।ভাবলাম তুই ভালো বুঝবি এসব ব্যাপারে। ফিরিয়ে দে মা।”
রাবেয়া বেগম বললেন,”কেনো দিবে?
এগুলো ওর শ্বশুর ওর দিছে,এসব কি ওই পোলার দেওয়া না-কি? ওরা কি পারবে আমার মেয়ের জীবনের সেই সময়গুলান ফিরত দিতে?আমার মেয়ের জীবন যে ওরা নষ্ট করছে,এরকম হাজারটা গহনা দিয়ে কি তা ফিরতে দিতে পারবে?”
হাশেম আলী নরম স্বরে বললেন, “আমার মাইয়ার জীবনের দাম দেওনের ক্ষমতা কি ওগো আছে?আমার মাইয়া কি ফেলনা না-কি যে ওগো এসব তুইচ্ছ্য জিনিসের মায়া করমু আমরা? ”
রাবেয়া বেগম বললেন, “ওই কুটনী মহিলার মুখের উপর ছুইড়া মারবি সব গিয়া।”
নবনী হেসে ফেললো মায়ের কথায়।
দরজা খুলে নবনীকে দেখেই তাহেরা বেগম যেনো শক খেলেন।নড়াচড়ার ক্ষমতা ও হারিয়ে ফেললেন তিনি।তামিম দুপুরের খাবার খাচ্ছে বসে।দরজা খোলার শব্দে পিছনে ফিরে তাকিয়ে নবনীকে দেখে চমকে গেলো তামিম ও।মুহুর্তের জন্য মনে হলো নবনী বুঝি ফিরে এসেছে আবার।
নবনী তাহেরা বেগমকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে বললো, “সেদিন যাওয়ার সময় আমাকে যেসব গহনা বাবা দিয়েছিলো তার সব এখানে আছে।আপনি একটু চেক করে দেখুন সব ঠিক আছে কি-না। আর এই যে টাকাগুলো, এগুলো ও বাবা আমাকে দিয়েছিলো আপনাদের অজান্তে। সব ফিরিয়ে দিতে এলাম।লুবনার বিয়ে শুনেছি। আপনাদের তো রীতি আছে এসব মেয়ের বাড়ি থেকে এসব দিতে হয়।না হলে মেয়ের বাবা মা’কে ফকির ভাবে সবাই।
দোয়া করি,লুবনাকে যেনো শ্বশুর বাড়িতে কোনো গঞ্জনা সইতে না হয়।সবার আদরে বড় হয়েছে, অল্প আঘাতেই নয়তো ভেঙে পড়বে।”
আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে নবনী চলে গেলো। তামিমের কাছে কেমন স্বপ্নের মতো লাগলো।
গহনাদি পেয়ে তাহেরা বেগমের কিছুটা সাহস বেড়ে গেলো। নবনীর বলে যাওয়া কথাগুলো গায়ে লাগালেন না।এসব বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে।মহা ধুমধামে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন এই ভেবে তাহেরা বেগম ভীষণ খুশি হলেন।
পরদিন অফিসে যাবার পর নবনীর ভীষণ লজ্জা লাগতে লাগলো। সবাই এতোদিন তাকে যেভাবে দেখতো আজকে সবাই অন্যরকম করে দেখছে।
আড়ষ্ট হয়ে নবনী নিজের ডেস্কে এলো। এইটুকু আসতেই নবনীর হার্টবিট বেড়ে গেলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো।
নবনীর মনে পড়লো,বিয়ের পর কিভাবে সে অফিস করবে?
তখন তো লজ্জায় সে মরেই যাবে।
দুপুরে ক্যান্টিনে যাবার পর নবনী শুনতে পেলো কয়েকজন আড়ালে কানাঘুষা করছে,”কেমন করে মেঘ স্যারকে পটিয়ে নিলো দেখলি?”
অন্য একজন বললো, “ডিভোর্সি মেয়েদের এতো দাম বাবা!অথচ আমরা ভার্জিন হয়েও দেখ,কপালে কোনো ছেলেই জুটে না।”
একজন বললো, “একবার তামিম স্যার,এবার তো রাঘব বোয়াল উঠেছে বঁড়শিতে।একেবারে একটা কোম্পানির মালকিন হবে! ”
নবনীর কান্না এলো এসব শুনে।নিজের মনকে নিজে প্রশ্ন করলো,”আমি কি আসলেই এরকম কিছুর লোভে পড়ে মেঘকে ভালোবেসেছি?
তবে কি আমি নিজের স্বার্থের জন্য বিয়ে করতে যাচ্ছি?সবার এই মনোভাব আমার সম্পর্কে?
আল্লাহ তুমি তো জানো আমার মনে এরকম কোনো লোভ ছিলো না। ”
টেবিলে মাথা রেখে নবনী ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। তারপর সিদ্ধান্ত নিলো,সবার মুখ বন্ধ করতে হবে নিজের যোগ্যতা দিয়ে।আমিও সবাইকে দেখিয়ে দিবো আমি কোনো কিছুর লোভে পড়ে এরকম করি নি।
নিতু ঠিক করলো তামিমকে সে আরেকটা সুযোগ দিবে।নিজের বেহায়া মন বারবার ছুটে যাচ্ছে তামিমের কাছে।বারবার তামিমকে ভেবে যাচ্ছে।ফোন নিয়ে তামিমকে কল দিলো প্রেগন্যান্সির খবর জানাতে।
একবার, দুইবার, তিনবার….
কল বাজতেই লাগলো। তামিম সকালে ফাইল দিতে এসে নবনীকে দেখলো মেঘের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।এরপর থেকেই তামিমের মাথায় আগুন জ্বলছে যেনো।অসহ্য লাগছে সবকিছু তামিমের।টেবিলে থাকা সব ফাইল ছুঁড়ে ফেলে দিলো নিচে।
চারবারের সময় তামিম কল রিসিভ করে বললো, “কেনো কল দিয়েছিস তুই?আমার জীবন থেকে তো চলে গেলি,আমি এখন একটু শান্তিতে আছি।আমার শান্তি সহ্য হয় না তোর?”
প্রবল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নিতু দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে বললো,”আমি প্রেগন্যান্ট তামিম। ”
তামিম একটা নোংরা গালি দিয়ে বললো, “যার সাথে শুয়ে পেট বানাইছস,তারেই বল।আমার কাছে আর কোনো দিন কল দিবি না।আমাকে শান্তিতে থাকতে দে।আমি আমার মতো করে বাঁচতে চাই।এই জীবনে আমার কাউরে লাগবে না।”
ফোন রেখে নিতু চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “মুক্ত করে দিলাম তোরে।সুখে থাকিস ভালো থাকিস বাসা বেঁধে নতুন নীড়ে।”
চলবে………
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৩৭)
হঠাৎ করেই যেনো শীতের প্রকোপ বেড়ে গেলো। যদিও গ্রামের তুলনায় শহরে শীত কম তারপরেও নবনীর মনে হলো বেশ ভালোই শীত পড়ছে।
আশেপাশের সব গাছের পাতা ঝরে পড়ে গেছে।এক বুক শূন্যতা নিয়েই শীত এসে হানা দিয়েছে প্রকৃতিতে।অথচ এই শীতেই আবার আমাদের দিয়ে যায় নানারকম ফসল।
শুক্রবারের এক কুয়াশাজড়ানো সাতসকাল।নবনী গায়ে একটা বেগুনি রঙের কার্ডিগান আর গলায় মাফলার পেঁচিয়ে বসে আছে চেয়ারে।বাহিরে এখনো কুয়াশা।নবনীর ইচ্ছে হলো এই কুয়াশাজড়ানো সকাল বেলায় প্রিয় মানুষের সাথে ব্যস্ত শহরের এই নিস্তব্ধ পথে,অলিতে-গলিতে একটু হেঁটে বেড়াতে।নবনীর অনেক কিছুই ইচ্ছে করে। কিশোরী মেয়েদের মতো ফুসকা খেতে গিয়ে ভালোবাসার মানুষের সাথে একটু ঢং করতেও মন চায় আজকাল।ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে চা খেতে ইচ্ছে করে। শাড়ি পরে ঘুরতে ইচ্ছে করে।
কি যন্ত্রণা!
এই বয়সে এসব মানায় না নবনী জানে।কিন্তু নবনীর মন তা বুঝতে চায় না।প্রেমের প্রতিটি মুহুর্ত বেহায়ার মতো উপভোগ করতে ইচ্ছে করে নবনীর।
মেঘ যখন রাতে বাসার নিচে এসে কল দিয়ে বলে, “কি সুন্দর চাঁদনী রাত দেখলে,এই রাতে যদি জোছনা বিলাস না করি একেবারে ৩০২ ধারার অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। একটা সাদা রঙের শাড়ী পরে জলদি বের হয়ে আসো।আজ আমি চাঁদের জোছনা দেখবো আর চাঁদকে আমার চাঁদের জোছনা দেখাবো।”
নবনীর তখন হার্টবিট বেড়ে যায়,থরথর করে সারা শরীর কাঁপতে থাকে। বুক ধড়ফড় করে।মনে হয় এর চাইতে মধুর কথা,মধুর অনুভূতি বুঝি আর নেই।
কিন্তু নবনী যায় না।এখন পর্যন্ত মেঘের সাথে আলাদাভাবে কোথাও ঘুরতে যায় নি নবনী। মেঘের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে। এসব ব্যাপার নবনী এখনো হজম করতে পারে না। এখনো বড্ড ভীতু রয়ে গেছে সে।
নবনী নিজেকে সামলে রাখে,নিজের মনের নিষিদ্ধ ইচ্ছের লাগাম টানে।
মেঘকে কখনো ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেয় না তার এসব ইচ্ছের কথা।একে তো নাচুনে বুড়ী, তার উপরে নবনী ঢোলের বারি দিয়ে মেঘকে উসকে দিতে চায় না মোটেও।
রাবেয়া বেগম নবনীর জন্য লেবু দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে এলেন।
এলোমেলো লম্বা চুলে,গলায় মাফলার পেঁচানো,চোখের নিচে কালি পড়ে যাওয়া মেয়েটাকে দেখে তার মনে হচ্ছে কোনো অচিনপুরের রাজকন্যা বুঝি ভুল করে তার ঘরে চলে এসেছে। গরীব ঘরে রূপ নিয়ে জন্ম নেওয়া কন্যারা বাবা মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ হয়।অথচ আল্লাহ তার তিন মেয়েকেই অত্যন্ত রূপ দিয়ে পাঠিয়েছে।
নবনী চা খেতে খেতে বললো, “বাবা কই মা?”
“নামাজ পইড়া তো এখনো আসলো না। কে জানে,হাটতেছে হয়তো একটু।”
ভাইবোন সবাই নিজেদের রুম থেকে বের হয়ে এলো। রাবেয়া বেগম সবার জন্য চা বিস্কিট নিয়ে এলেন।শুক্রবার দিনটা সবার জন্য মিলনমেলার মতো হয়।নবনীকে যেহেতু শুক্রবার ছাড়া ফ্রি পাওয়া যায় না তাই বাকি তিন ভাইবোন অপেক্ষায় থাকে শুক্রবারের। বিশেষ করে সাব্বির বেশি অপেক্ষায় থাকে। বড় বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ের।
ফাল্গুনী বললো, “মা,আজকে আমরা সবাই মিলে বাহিরে খেতে যাবো দুপুরে।রেডি থেকো সময় মতো। ”
নবনী ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকালো।চৈতালী বললো, “তুমি এভাবে তাকাচ্ছো কেনো?তুমি তো ইজি কাজে বিজি থাকো,ভাইয়া আমাদের নিয়ে যাবে বলছে।মা বাবা আমরা সবাই।তোমার কথা ভাইয়া বলে নি যদিও,তবুও তোমাকে আমরা নিবো।বাসায় বসে বসে তুমি আমাদের খাবারের কথা ভেবে নয়তো কষ্ট পাবে।”
নবনী জিজ্ঞেস করলো, “সাব্বির নিবে?”
ফাল্গুনী বললো, “দূর,সাব্বির ভাইয়া না।ভাইয়া একটা ঢেড়স।আমাদের কোথাও নিতে চায় না।কিছু বললেই বলে, বড় আপাকে আগে জিজ্ঞেস করে অনুমতি নে।আপা বকবে।”
নবনী চোখ রাঙিয়ে বললো, “তোদের মতো না-কি? ও তো আমাকে ভালোবাসে,তোরা দুজন তো বাসিস না।”
দুই বোন হেসে বললো, “আমরা ভাইয়াকে ভালোবাসি,ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে।তো সেই হিসেবে আমরা ও তোমাকে ভালোবাসি।”
রাবেয়া বেগম রান্নাঘর থেকে শুনছেন মেয়েদের কথাবার্তা।আপন মনে হাসছেন তিনি এসব শুনে।হাশেম আলী এলেন দুইটা কাগজের ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে। ভিতরে গরম গরম ভাঁপা পিঠা,চিতুই পিঠা,ভর্তা।
ভাইবোন সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো পিঠার উপর। হাশেম আলী ব্যস্ত হয়ে বললেন,”আরে তোরা থাম,এখনই খাচ্ছিস যে সবাই।মেঘ বাবাজি আসতেছে।ও আসলে সবাই মিলে খাবো আমরা। ”
মুহুর্তেই সবাই পিঠা রেখে দিলো নবনী ছাড়া। চৈতালী বললো, “আপা কি ছোঁচা রে,এখনই খেয়ে নিচ্ছে।তর সইছে না আপার।”
নবনী কিছুটা লজ্জা পেলো যেনো। তবুও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে খেতে লাগলো। মেঘ এসে হাজির ১০ মিনিটের মাথায়। হাতে নিয়ে মিষ্টির প্যাকেট, ফলমূল।
রাবেয়া বেগম টেবিলে পিঠা সাজিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে পরোটা,ডিম ভাজা,নুডলস নিয়ে এলেন।
নবনী অবাক হয়ে তাকিয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা সবাই জানতে উনি আসবে যে সকালে?এজন্য এসব করে রেখেছ,অথচ আমাকে কেউ বলার প্রয়োজন ও মনে করে নি। ”
মেঘ পিঠায় ভর্তা মাখাতে মাখাতে বললো, “তোমাকে কেনো বলবে?তুমি যেনো সংসদের স্পিকার যে কোনো কাজে তোমার সংসদে বিল উপস্থাপন করতে হবে?
আর এমন ভাব করছো যেনো তোমাকে দেখতে আসছি আমি!
আমি এসেছি আমার রসগোল্লার মতো মিষ্টি দুটো বোনের কাছে।ওদের দেখি না কতোদিন। তাই ওদের সাথে সময় কাটাতে এসেছি। এখানে তোমাকে বলতে হবে কেনো?”
নবনীর রাগ হলো মেঘের এরকম নির্লিপ্ত কথা শুনে।ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, “বেশ তো।”
নবনীর ফুলানো নাকের দিকে তাকিয়ে সবাই হেসে ফেললো। নবনী কপট অভিমান করে চলে গেলো নিজের রুমে।
একটু সময় পরে নবনী শুনতে পেলো বাহিরে তুমুল হইচই হচ্ছে,মেঘ,সাব্বির,ফাল্গুনী,চৈতালী সবাই মিলে চিৎকার করছে একটু পর পর।নবনী নিজের কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না আর।দরজা খুলে বের হয়ে এলো। দেখে সবাই মাথা এক করে বসে আছে। এগিয়ে গিয়ে দেখে লুডু খেলছে সবাই মিলে।
নবনীর হঠাৎ করেই ভীষণ ভালো লাগলো। এরকম একজন মানুষ সব মেয়েই কামনা করে জীবন সঙ্গী হিসেবে যে মেয়েটার সাথেসাথে মেয়েটার পরিবারের মানুষদের ও আপন করে নিবে।
নবনীর মনে পড়ে যায় তামিম কখনো ফাল্গুনী চৈতালীর সাথে খুব একটা কথা বলতো না।সাব্বিরের সাথে ও না।একটা আলাদা গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে থাকতো ওদের দেখলে।ওরা সবাই তামিমকে দুলাভাই ডাকতো সামনাসামনি। আর পেছনে বলতো আপার বর।
অথচ মেঘকে ওরা শুরু থেকেই ভাইয়া বলে। সম্পর্কের এই ছোট ছোট যত্ন,মানুষকে ভীষণ আনন্দিত করে তোলে।সম্মান বেড়ে যায় বিপরীতে থাকা মানুষটার প্রতি।
রাবেয়া বেগম চেয়ারে বসে স্মৃতিচারণ করছেন।সেই কবে গ্রাম থেকে এসেছেন। গ্রামে থাকা মানুষ শহরে এসে যতই আরামে থাকুক,গ্রামের জন্য মন পোড়েই তার।আহা,এরকম সময়ে তো ছেলেমেয়েদের চুলার পাশে বসিয়ে রাতের বেলা পিঠা বানিয়ে খেতেন সবাই মিলে।সকালে গাছের তাজা রস আনতো হাশেম আলী। ছেলেমেয়েরা কাঁচা রস খাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি করতো।
কি মধুর সেসব দিন ছিলো!
আর কবে যাওয়া হবে গ্রামে?
কে জানে?
————–
লুবনার বিয়ে উপলক্ষ্যে ভীষণ তোড়জোড় চলছে।তাহেরা বেগম ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সবাইকে কার্ড পাঠাচ্ছেন।বারবার অনুরোধ করছেন সবাইকে বিয়েতে আসার জন্য। মনের মধ্যে একটা সুপ্ত অহংকার জন্মেছে তাহেরা বেগমের। যেনো সবাইকে দেখাতে চায় মেয়েকে কেমন ভালো জায়গায় বিয়ে দিচ্ছে।দেখুক সবাই,কয় জন পারে এতো বড় ঘরে মেয়ে বিয়ে দিতে!
কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন করা হলো। বিয়েতে পাত্রপক্ষ লুবনাকে বারোভরি ওজনের গহনা দিলো।যারমধ্যে গলার হারের ওজন পাঁচ ভরি।
তাহেরা বেগমের বুক ভরে গেলো গর্বে।আত্মীয় স্বজন সবাইকে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন,”দুবাইয়ের সোনা এগুলো। একেবারে ২২ ক্যারেটের খাঁটি সোনা বুঝলেন।মেয়ের আমার রাজকপাল।নয়তো এরকম বড় ঘরে আমাদের আত্মীয় স্বজন কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে পেরেছে না-কি?
অহংকার করে বলছি না,তবুও দেখেন না।”
একজন বললো, “জামাইয়ের বয়স একটু বেশি মনে হচ্ছে। মাথায় চুল ও মনে হয় তেমন নেই।”
তাহেরা বেগম ছ্যাৎ করে উঠে বললেন,”না না,বয়স ঠিকই আছে।তাছাড়া চুল ও আছে আমি নিজে দেখেছি। ”
বিয়ে হয়ে গেলো কোনো ঝামেলা ছাড়াই।তাহেরা বেগম স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। এতো দিনে নিশ্চিন্ত হয়েছেন ভেবে স্বস্তি পেলেন। অথচ তিনি যদি জানতেন এর ভেতরে কতো অজানা রহস্য রয়ে গেছে তবে নাকের জল আর চোখের জল এক করে ফেলতেন।
————–
ফয়সাল চেম্বারে বসে রোগী দেখছে। হঠাৎ করেই কল এলো হাসপাতালে একজন পেশেন্ট এসেছে। ইমার্জেন্সি যেতে হবে।এসিস্ট্যান্টকে বাকিদের ফি ফেরত দিয়ে দিতে বলে ফয়সাল উঠে চলে গেলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
নিতু শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে।স্যালাইন দেওয়া হাতে।ফয়সাল একটা ইনজেকশন পুশ করতে করতে বললো, “প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষ যখন বাচ্চাদের মতো কাজ করে তখন তাকে আসলে কিভাবে বুঝানো যায় আমার জানা নেই।আপনি আমার আপন কেউ হলে অন্তত পক্ষে দুটো থাপ্পড় উপহার পেতেন।”
নিতু বাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো, ” জীবনে বেঁচে থাকার জন্য, স্বপ্ন দেখার জন্য যখন সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যায় ডাক্তার মানুষ তখন কি নিয়ে বাঁচে?
বাঁচতে হলেও ত একটা অবলম্বন চাই।”
ফয়সালের হাসি পেলো শুনে।তবে সে কিভাবে বেঁচে আছে? কেউ কি জানে সেটা?
ফয়সাল হেসে বললো, “নিজের বেঁচে থাকার জন্য নিজেকেই দুয়ার খুঁজে নিতে হয়।আচ্ছা এটা বলুন,কয়টা খেয়েছেন?”
নিতু হেসে ফেললো এই প্রশ্ন শুনে।তারপর বললো, “মরতে তো চাই নি।নিজের কষ্টটা সাময়িক সময়ের জন্য অসহ্য হয়ে গেছিলো। তার থেকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি পেতে চেয়েছি।মাত্র ৩ টি ট্যাবলেট খেয়েছি। ”
ফয়সাল হেসে বললো, “আপনার আব্বা আম্মা তো বললেন দুই পাতা খেয়ে নিয়েছেন। ”
নিতু বললো, “না না,দুই পাতা থেকে বিশটা ঔষধ বের করেছি ঠিকই। বাকি ১৭ টা ফেলে দিয়েছি।সাহস হয় নি।”
ফয়সাল চেয়ার টেনে বসলো বেডের পাশে। তারপর বললো, “এই সময়ে মানুষ চায় হাজার বছর বাঁচতে। নিজের যতই কষ্ট থাকুক,নতুন যেই অতিথি আসছে তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে,তার মুখ থেকে মা ডাক শুনতে মানুষ হাজার বছর বাঁচার ইচ্ছে পোষণ করে। আপনার বেঁচে থাকার স্বপ্ন তো আপনার মাঝেই আছে।”
নিতুর কপালে ঘাম জমতে শুরু করলো, বিড়বিড় করে বললো, “ও স্বপ্ন নয় ডাক্তার, ও দুঃস্বপ্ন আমার। ওকে আমি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা দেখাতে চাই না।আমি এতো শক্ত মনের মানুষ হয়েও ভেঙে পড়েছি,ও কিভাবে টিকে থাকবে।আমি চাই ও এসব যন্ত্রণা ভোগ না করুক।
ও যখন জানবে ওর বাবা ওকে নিজের সন্তান বলে স্বীকার করে না তখন ও কিভাবে সহ্য করবে।আমি চাই না।আমি কিছুতে চাই না এরকম কিছু হোক ডাক্তার। আমি সব ভেঙে ফেলবো। খুন করে ফেলবো সবাইকে।”
নিতু হঠাৎ করেই ভীষণ উগ্র হয়ে গেলো। টান দিয়ে স্যালাইনের তার খুলে ফেললো। চিৎকার করে বলতে লাগলো, “ও আমায় ভালোবাসে নি ডাক্তার। ও আমাকে ঠকিয়েছে।আমার ভালোবাসার সাথে প্রতারণা করেছে।আমার বাচ্চাকে ঠকিয়েছে।আমি তাকে ঘৃণা করি ডাক্তার। তবুও কেনো ওকে ভুলতে পারি না।আমি মরে যেতে চাই।মরে যেতে চাই।আমাকে ভালোবাসার কেউ নেই আর।আমার কথা শোনার কেউ নেই ডাক্তার। ”
ফয়সাল শক্ত হাতে নিতুর দুই হাত চেপে ধরে রাখলো। জোর করে নিতুকে শুইয়ে দিলো। তারপর নিতুর সাথে আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলো।ভরসা দিয়ে বললো, “আপনি আগে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকুন প্লিজ। আপনার সব অভিযোগ আমি শুনবো। আমি আছি আপনার সব কথা শোনার জন্য। ”
হাঁপাতে হাঁপাতে নিতু ঘুমিয়ে গেলো ফয়সালের হাতের আঙুল ধরেই।
ফয়সালের মনে হলো এই মেয়েটার মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। কাউকে প্রচন্ডভাবে ভালোবেসে মেয়েটা ঠকে গেছে। সেই শোক সামলাতে না পেরে এরকম পাগলামি করছে।
বুক পকেট থেকে একটা স্ট্যাম্প সাইজের সাদাকালো ছবি বের করলো ফয়সাল। নির্নিমেষ ছবির সেই যুবতীর দিকে তাকিয়ে বললো, “এতো অদ্ভুত কেনো ভালোবাসা! কাউকে বানিয়ে দেয় এরকম পাগল, আর কাউকে করে দেয় আমার মতো অনুভূতিহীন।”
চলবে……
রাজিয়া রহমান