#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৩৪)
এনিভার্সারির পার্টি শুরু হলো হোটেলেই।ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে পুরো হলরুম ।সবাই নিজের ইচ্ছেমত নিজেকে সাজিয়েছে। এতো রংবেরং এর সাজের মধ্যে নবনীর মনে হচ্ছে নবনীকে বেখাপ্পা লাগছে।সাদা রঙ এর একটা হালকা কাজের থ্রিপিস পরা,লম্বা চুলে খোঁপা করে নবনী এসেছে।মেঘ আড়চোখে বারবার দেখছে নবনীকে।
শফিক আহমেদ একটা মেরুন কালার শেরোয়ানি পরেছেন।মাসুমা বেগমের পরনে মেরুন কালার জামদানী। ছোট নীড়ের পরনেও জামদানী মোটিফের পাঞ্জাবী।
তাদের সামনে রাখা বিভিন্ন ফ্লেভারের ৫ পাউন্ডের ৮ টা কেক।রেড ভেলভেট কেকটা দুজন মিলে কাটবেন।
তাদের কেক কাটার মাধ্যমে পার্টি শুরু হলো।
মেঘ দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজেও শামিল হয়েছে।
কয়েকজন ওয়েটার ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আত্মীয় স্বজন সবাই নিজেদের গিফট দিয়েছে। নবনী নিজেও ছোট একটা গিফট এনেছে।
রাবেয়া বেগমের হাতে বানানো একটা নকশিকাঁথা আর নিজের হাতে করা মেঘের থিমের একটা হ্যান্ড পেইন্ট কাপল ড্রেস।
এরকম পার্টিতে নবনী এই প্রথম এসেছে।কি গিফট দিবে এটা নিয়ে নবনীর ভীষণ কনফিউশন ছিলো।
টাকাপয়সা, সোনাদানা এদের কাছে কোনো ব্যাপার না নবনী জানে।তাই ভেবে নিজের পছন্দ মতো এই গিফট নিয়েছে।গিফট দেয়ার পর নবনী ভীষণ লজ্জিত হলো।উপহারের মোড়কে যদি নিজের নামটা না লিখতো তবে কিছুটা স্বস্তি পেতো,কেউ জানতো না এই সস্তা উপহার কে দিয়েছে।ভয় হলো নবনীর যদি কেউ হাসাহাসি করে।
নিম্নবিত্ত পরিবারে বিলং করা নবনীর উচ্চবিত্তদের এসব পার্টি সম্পর্কে অজ্ঞতার জন্যই নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হচ্ছে বারবার।
মাসুমা বেগম সবার উদ্দেশ্যে বললেন,”আমি আমার ছেলের কাছে একটা উইশ জানাবো।মা হিসেবে বলতে পারেন আমার দাবি এটা ছেলের উপর।এটাই হবে আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার।”
সবাই চিৎকার করে উঠলো এক্সাইটমেন্টে।মেঘ ঘাবড়ে গেলো।এই মুহুর্তটার জন্যই মেঘ অপেক্ষা করে ছিলো। কি রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা চেপে রেখেছিলো বুকের ভেতর তা কেবল মেঘ জানে।
মাসুমা বেগম যথেষ্ট শান্তস্বরে বললেন,”ছেলে মেয়ে বড় হলে প্রত্যেক বাবা মায়ের চিন্তা থাকে তার জন্য উপযুক্ত সঙ্গী নির্বাচন করার।আজকাল প্রায় সব ছেলে মেয়ে নিজের জীবন সঙ্গী নিজেই চুজ করে।বাবা মায়ের সেখানে কথা বলার ও জো থাকে না।খাইয়ে,পরিয়ে নিজের জীবনের সর্বোচ্চ দিয়ে,নিজের সব শখ ত্যাগ করে যেই সন্তান কে বাবা মা বড় করে,তাদের জীবন সঙ্গী নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বাবা মা’কে কোনো প্রায়োরিটি দেওয়া হয় না।মনে করা হয় বাবা মা কিছুই বুঝে না এসব ব্যাপারে।অথচ সন্তান ভুলে যায় বাবা মায়ের চাইতে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী সন্তানের জীবনে আর কেউ নেই।
মেঘ আমার একমাত্র ছেলে।ছেলে হিসেবে সে কখনো আমার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখে নি।একটা মেয়েকে সে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে।তার সেই ভালোবাসাটাই আজ আমি ছিনিয়ে নিতে চাইছি।আমি মেঘের জন্য একজন পাত্রী পছন্দ করেছি।আমার ইচ্ছে মেঘ আমার পছন্দের মেয়েটাকে বিয়ে করুক।নিজের ভালোবাসা জলাঞ্জলি দিয়ে।মেঘ কি আমার এই ইচ্ছেটাকে মূল্য দিবে?নাকি তার কাছে তার দুই দিনের ভালোবাসাই বেশি প্রাধান্য পাবে?”
মেঘের হাসিমুখে মুহুর্তেই রাজ্যের অন্ধকার নেমে এলো।নবনী নিজেও হতভম্ব হয়ে গেলো। ভাগ্য আবার ও তাকে নিয়ে প্রহসন করছে বুঝতে পেরে লজ্জায়,অপমানে মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। নবনীর মনে হলো উপস্থিত প্রতিটি মানুষ তার দিকে তাকিয়ে যেনো হাসছে।কাকে দোষ দিবে নবনী?
মেঘকে?
না,তার তো কোনো দোষ নেই।দোষ আসলে নবনীর। আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখেছে সে,তার তো এরকম হবার কথা।
তামিম নবনীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,”মেঘ স্যারের বউ হবার খুব শখ ছিলো তাই না?দেখলে তো এবার?স্যারের মা কিভাবে বুঝিয়ে দিলো তুমি কখনোই ওনার বউ হবার যোগ্যতা রাখো না।গতকাল ওনারা তোমাদের বাসা থেকে আসার সময় আমি সবকিছুই ওনাদের জানিয়ে দিয়েছি।বেশি বেড়েছো না?পাখা গজিয়েছে তোমার?
পাখা কেটে দিলাম।এবার উড়ে দেখো আকাশে।”
মেঘ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,”বাবা মায়ের চাইতে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী পৃথিবীতে আর কেউ নেই।সন্তানের হাসি মুখের জন্য এজন্যই বাবা মা সব ত্যাগ করে থাকেন।কিন্তু সেই ত্যাগের নমুনা যদি হয় এই যে সন্তানের মুখের হাসি কেড়ে নিয়ে তাকে সুখী করা,তবে সেই সুখ আমার চাই না।একজন মা যখন জানে সন্তান কোথায় নিজের মানসিক শান্তি খুঁজে পায়,অথচ জেনেও সে সন্তানের সেই শান্তির উৎস কেড়ে নিতে চায় তবে সেখানে বাবা মায়ের সন্তানের জন্য ভালো চাওয়াটা আসলে কোথায় তা আমার জানা নেই।”
মাসুমা বেগম জলভরা নয়নে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,”মায়ের পছন্দ আজকে তোর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মেঘ?”
মেঘ জবাব দিলো,”না মা,বরং ছেলের ভালোবাসা আজ তোমার কাছে মূল্যহীন। ”
মাসুমা বেগম হার স্বীকার করে নেয়ার ভঙ্গিতে বললেন,”বেশ,তবে তোমার পছন্দই জিতে যাক।আমি মেয়ের বাবা মায়ের কাছে সবার সামনে ক্ষমা চাইবো। ”
মাসুমা বেগম শিমলাকে বললেন,”ওনাদের ডেকে নিয়ে আসো।”
থমথমে মুখে সবাই তাকিয়ে রইলো। শুধু হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তামিম।পুরো ব্যাপারটায় তামিম সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাচ্ছে।তামিম জানে মেঘ যতোই নবনীকে ভালোবাসুক,এতো মানুষের সামনে কিছুতেই নিজের মা’কে লজ্জা পেতে দিবে না।
তামিম অপেক্ষা করছে সেই মুহুর্তের যেই মুহুর্তে নবনীর সব স্বপ্ন ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাবে।
শিমলার পিছন পিছন হাশেম আলী,রাবেয়া বেগম,সাব্বির,ফাল্গুনী, চৈতালী এসে দাঁড়ালো। তামিমের হাসিমুখে অন্ধকার নেমে এলো।চমকে গেলো নবনী। সবচেয়ে বেশি অবাক হলো মেঘ নিজে।
মাসুমা বেগম হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে রাবেয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে বললেন,”মাফ করবেন আপা,আপনার বড় মেয়েকে পুত্রবধূ করার ভীষণ শখ ছিলো।কিন্তু আমার ছেলে…..”
মাসুমা বেগম কথা শেষ করতে পারলেন না।তার আগেই মেঘ বললো,”আমি রাজি মা।তোমার পছন্দের মেয়েকেই আমি বিয়ে করবো।”
মাসুমা বেগম ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,”অসম্ভব। তা হবে না এখন আর।”
মেঘ মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো,”না মা,আমি তোমার অসম্মান হতে দিবো না।”
শফিক আহমেদ বিড়বিড় করে বললেন,”আমি কিছুই বুঝতেছি না।মেঘ তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?নবনীর কি হবে তাহলে? ”
শফিক আহমেদের কথা শুনে শিমলা এবং মাসুমা বেগম দুজনেই অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো। দ্বিধান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলো সবাই।
শিমলা হাসি থামিয়ে বললো,”সরি মামা।পুরোটাই আমার আর মামীর প্ল্যান ছিলো। গতকাল মামী এসে আমাকে যখন জানালেন তিনি নবনীকে মেঘের বউ করতে চান,তখন আমি মামীকে বলে দিই যে মেঘ নবনীকে ভালোবাসে।মেঘকে একটু সারপ্রাইজ দিতেই আমরা দুজন এই নাটক করেছি।
মামী গতকাল আমার বাসা থেকে বের হয়ে আবার নবনীদের বাসায় যান।নবনী অফিসে যাওয়ার পর।তারপর আংকেল আন্টিকে সব বলেন বুঝিয়ে।যদিও এই ব্যাপারে ফাল্গুনী, চৈতালী,সাব্বির ভীষণ সহযোগীতা করেছে।অবশেষে আংকেল আন্টিও রাজি হন।তবে সবাই নবনী আর মেঘের থেকে ব্যাপারটা গোপন রাখে।ওদের দুজনকে সারপ্রাইজ দিতেই সবাই মিলে এরকম করেছি আমরা।”
লজ্জায় নবনী চোখ বন্ধ করে ফেললো।মেঘলা এসে নবনীকে জড়িয়ে ধরে বললো,”মা দেখো,ভাবীর দুই গাল লজ্জায় পাকা টমেটোর মতো হয়ে গেছে।”
মাসুমা বেগম সেখানেই মেঘ আর নবনীর এনগেজমেন্ট ঘোষণা করলেন।পার্স থেকে একটা ডায়মন্ডের রিং বের করে মেঘের হাতে দিলেন।রাবেয়া বেগম একটা সোনার রিং দিলেন নবনীকে মেঘকে পরিয়ে দেয়ার জন্য।
দুজন দুজনকে রিং পরিয়ে দেয়ার পর শফিক আহমেদ স্টেজে উঠলেন।তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন,”বেশ তো,আমার মতামত না নিয়েই ছেলের এনগেজমেন্ট করিয়ে ফেললে তুমি।তাই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আমিও তোমার মতামত ছাড়াই মেঘলার এনগেজমেন্ট ঘোষণা করলাম।আজকে,এই মুহুর্তে মেঘ নবনীর এনগেজমেন্টের সাথে সাথে মেঘলা আর শৈবালের ও এনগেজমেন্ট হবে।”
আসার সময় মেঘ গাড়িতে বসে বাবাকে মেঘলা আর শৈবালের সম্পর্কের কথা খুলে বলেছেন।শৈবালকে শফিক আহমেদ ভালো করে চিনেন।মেধাবী একটা ছেলে,লেখাপড়ায় যেমন ভালো ছোট থেকে তেমনি চারিত্রিক দিক দিয়েও ছেলেটা যথেষ্ট ভালো।শফিক আহমেদ অমত জানানোর মতো কিছু পেলেন না।তাছাড়া শৈবাল মাসুমা বেগমের যে কতো প্রিয় তা শফিক আহমেদ জানেন।
মাসুমা বেগম অবাক হয়ে তাকালেন স্বামীর দিকে।আসমা বেগম এগিয়ে এসে বোনের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,”দেখলি,তলে তলে কবে হতচ্ছাড়া অবুঝ মেয়েটাকে পটিয়ে ফেলেছে।অথচ এদিকে আমরা ওর জন্য পাত্রী খুঁজে খুঁজে হয়রান।আমার অবুঝ মেয়েটা ছেলেটার ফাঁদে পা দিলো কিভাবে আমার মাথায় আসে না।আমি শিওর ওর বাবা যেমন আমাকে চিনিপড়া খাইয়ে বিয়েতে রাজি করিয়েছে এই ছেলেও মেঘলাকে তেমন পানিপড়া খাইয়ে প্রেমে ফেলেছে।বশীকরণ যাদু করেছে ও।ওদের পুরো জাতটাই তো এমন।”
মাসুমা বেগম অবাক হয়ে বললেন,”শৈবালের মতো একটা এডুকেটেড ছেলে কিভাবে আমার এই গণ্ডমূর্খ মেয়ের প্রেমে পড়লো আমি তো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।শৈবাল বাবা,তুই শিওর তো?আবার ভেবে দেখবি তুই?মেঘলাকে তো তুই চিনিস,এই মেয়ে এখনো ১৩ এর ঘরের নামতা পারে না।আমি তো ভেবে ভেবে হয়রান এই অশিক্ষিত মেয়েকে কে বিয়ে করবে।বাবা,আবার ভেবে দেখ তুই।তোর বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ কিন্তু অন্ধকার।তোর মনে নেই,ও গুনতে গেলে বলতো,”একুশ,বাকুশ,তেকুশ?সাতত্রিশ,আটত্রিশ,নয়ত্রিশ?
এ তো এখনো তেমন রয়ে গেছে।জিজ্ঞেস কর রবীন্দ্রনাথ কতো সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে এ পারবে না।অথবা জিজ্ঞেস কর ভাওয়েল কয়টি,তাও পারবে না।”
আসমা বেগম রেগে বললেন,”ও কি বলবে?ওর বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কারো আছে এরকম পুতুলের মতো মেয়ে?ওদের গোষ্ঠীতে ওর বাবা ছিলো সৌভাগ্যবান আমার মতো সুন্দরী বউ পেয়েছে বলে।আর এখন ও সেই সৌভাগ্যবানের খাতায় নাম লিখাতে যাচ্ছে আমার মেঘলা মা’কে পেতে যাচ্ছে বলে।এমন আসমানের পরী ও পাইবো সারা দুনিয়া খুঁজলেও?ও মেঘলাকে একটা প্রশ্ন করেই দেখুক না,ওর মাড়ির দাঁত সবগুলো আমি খুলে হাতে নিবো।ও কোথাকার বিদ্যাসাগর হয়েছে দেখে নিবো আমি।আর তুই,একটা কথা বললে তোর দাঁত ও আর আস্ত রাখবো না।”
দুই বোনের কথা কাটাকাটির মধ্য দিয়ে মেঘলা আর শৈবালের এনিগেজমেন্ট হয়ে গেলো।
হতাশায় ছেয়ে গেলো তামিমের মন।নবনীকে ফিরে পাবার আশার বিন্দু ও নিভে গেলো তামিমের। চোরের মতো লুকিয়ে তামিম রুমে চলে গেলো।
সবাই খাবার দাবার সেরে আড্ডা দিচ্ছিলো।নবনী লজ্জিত মুখে বাবা মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রাবেয়া বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,”আমার আল্লাহ কখনো অন্যায় অবিচার করেন না মা।আজ দেখ,তোকে রাজরানি করেছেন আল্লাহ। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন বুঝলি তো এবার।”
ফাল্গুনী, চৈতালী,সাব্বির বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো,”আমরা কিন্তু আগে থেকেই সব জানতাম আপা।ভাইয়া প্রথম দিন এসেই আমাদের কাছে সব কিছু বলেছেন।এজন্যই তো ভাইয়াকে আমাদের এতো পছন্দ।”
হাশেম আলী হাসতে হাসতে বললেন,”আমি তো কোনোদিন ভাবি ও নাই,আমার মেয়েটাকে পাবার জন্যে কেউ এতো কষ্ট করবে।এই ছেলে কিনা নিজেকে এতিম পরিচয় দিয়ে এতো কষ্ট করে গেছে।আমার মাইয়ার কপাল আসলেই ভালো।”
একে একে অফিসের সবাই এসে নবনী আর মেঘকে কংগ্রেশনাল জানালো।এক রাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে শুরু হওয়া দিনের শেষ হলো একটা মধুর অনুভূতি নিয়ে।আবেগে বারবার মেঘের চোখ ভিজে যাচ্ছিলো।
পুরো ব্যাপারটা এখনো কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে তার।জীবন এতো সুন্দর কেনো?
জানা নেই মেঘের।
চলবে……
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৩৫)
শুক্রবার সকাল বেলা।তাহেরা বেগম ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছেন।দীর্ঘদিন ধরে রান্নাবান্না থেকে দূরে থাকায় তার মনে হচ্ছে কোনো কিছুই যেনো ঠিকমতো হচ্ছে না।
লুবনার আজকে এনগেজমেন্ট হবে।তাহেরা বেগমের ইচ্ছে যতো শীঘ্রই সম্ভব বিয়ের তারিখ ধার্য করার।সম্ভব হলে কুরবানির ঈদের আগেই।
এরকম পাত্র হাতছাড়া হয়ে গেলে দ্বিতীয় বার আর সুযোগ পাবেন না।ভাগ্য বারবার তাকে সুযোগ দিবেন না।
রান্নাবান্নায় দিশা,লুবনা কেউ-ই একটু সাহায্য করতে আসছে না।তাহেরা বেগম কোনটা রেখে কোনটা করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।মেইন ডিশ,ডেজার্ট কোনোটাই হচ্ছে না ঠিকঠাক। হাতে হাতে কেউ একজন এগিয়ে দিলে কাজটা যেমন সহজ হয়,সেই সাহায্য করবার মতো মানুষ নেই তার।
নিজের ভাগ্যকে দুটো গালাগাল দিয়ে তাহেরা বেগম কাজে লেগে গেলেন আবার।
মশলা নেই,মশলা ব্লেন্ড করতে হবে।তাহেরা বেগম উঁচু গলায় লুবনা,দিশা দুজনকে ডাকলেন।দিশা আর লুবনা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে,ফোন টিপছে।তাহেরা বেগমের ডাক শুনে দিশা অস্ফুটে একটা গালি দিয়ে কানে হেডসোন গুঁজে নিলো।
লুবনাও পাত্তা দিলো না তেমন। আজকে তার এনগেজমেন্ট,এই সময় রান্নাঘরের আশেপাশে ও লুবনা যেতে রাজি না।
তাহেরা বেগমের প্রচন্ড রাগ হলো।দুজনেই সামনের রুমে বসে আছে,স্পষ্ট তার ডাক শুনছে ইথচ এগিয়ে আসছে না।
আদা রসুন কুচি করতে গিয়ে তাহেরা বেগম পোড়া গন্ধ পেলেন।গরুর মাংস পুড়ে গেছে কিছুটা।রাগে তাহেরা বেগমের গা জ্বলে গেলো।প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে কিচেন থেকে বের হলেন।তারপর ক্ষোভ মেটাতে লুবনার চুল চেওএ ধরে দুইটা থাপ্পড় মেরে বললেন,”বুড়ি ধুমসি মেয়ে,বসে আছিস এখানে।আমি রান্নাঘরে ডাকতে ডাকতে মরে যাচ্ছি সেদিকে কোনো খেয়াল নেই কারো।শ্বশুর বাড়ির ভাত এতো মিঠা না।এমনে এমনে গলা দিয়ে নামে না ওই ভাত।”
প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো লুবনার।ঝি’কে মেরে বউকে শেখানোর প্রবাদটা অজানা থাকায় মায়ের কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না সে।উল্টো আজকের দিনে মা তাকে মা/রায় তেড়ে জবাব দিলো,”শ্বশুর বাড়ির ভাত যে কতো তিতা তা আমি আরো তিন বছর আগে থেকেই জানি।নবনী,নিতুর সাথে তুমি যেভাবে ব্যবহার করেছ তা দেখেই আমার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।তোমার মতো শাশুড়ী হলে কোনো মেয়েই সংসার করতে পারবে না।”
তাহেরা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন মেয়ের কথা শুনে। নিজের পেটের মেয়ে কি-না তার বিরুদ্ধে কথা বলছে!মেয়ে ও বুঝলো না তিনি কথাগুলো মেয়েকে নয় দিশাকে বলেছেন?
এই ছিলো মেয়ের মনে?
তবে কি মেয়েও তাকে খারাপ মা হিসেবে জানে?
এক বুক হাহাকার নিয়ে তাহেরা বেগম নিরবে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।সেই সাথে আড়াল করলেন তার দুই চোখ ভরা অশ্রু।
দিশা শুধু শুধু কানে হেডফোন দিয়ে গান শোনার ভং ধরে বসে ছিলো। মা মেয়ের এই নাটক দেখে দিশার পৈশাচিক মন একটা অন্যরকম সুখ পেলো।মোবাইলের দিকে তাকিয়ে মজার কিছু দেখছে এরকম ভান করে হাহাহা করে হাসতে লাগলো দিশা।
তাহেরা বেগম মোটামুটি ২০ জন মেহমানের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।পাত্রপক্ষ বলেছে ১২-১৩ জন আসবে এনগেজমেন্ট করতে।
মেহমান আসার পর দেখা গেলো মেহমান এসেছে ২৬ জন।
তাহেরা বেগমের মাথায় হাত পড়ে গেলো।এদিকে সামিম তামিম কেউই নেই বাসায়।দিশা সং সেজে বাপের বাড়ির লোকদের কোলে নিয়ে বসে আছে আর হাহা হিহি করছে।
তাহেরা বেগমের প্রেশার হাই হয়ে গেলো চিন্তায়।কিভাবে সামলাবেন তিনি এখন?
এই প্রথম তাহেরা বেগম নিতুর অভাব বোধ করলেন।মেয়েটা মুখরা,ঝগড়াটে,বেয়াদব,অভদ্র যাই হয়ে থাকুক না কেনো,এরকম পরিস্থিতি নিশ্চয় সামলে নিতে পারতো।
পাত্রপক্ষ দেখতে আসার দিনেও তো সে-ই সব সামলেছে।আজকে তো সে ও নেই।
অথৈ জলে পড়ে হাহুতাশ করতে লাগলেন তাহেরা বেগম। খেতে বসে দিশার চাচী আমেনা ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,”আজকের খাবারের চেহারা দেখেই তো কেমন লাগছে।গতবারের রান্না সবই ভালো ছিলো পোলাও ছাড়া। এবার তো দেখছি সবই কেমন কেমন যেনো।”
তাহেরা বেগমের মুখ শুকিয়ে গেলো শুনে।আমতাআমতা করে বললেন,”আসলে আপা,একা হাতে সব সামলাতে হয় তো তাই আরকি।খান না আপনারা, খেতে ভালোই হয়েছে। ”
পাত্রের বোন রোস্টে কামড় দিয়ে বললো, “কি রে দিশা,এনগেজমেন্টের খাবার না-কি হয় বিয়ের খাবারের চাইতেও ভালো। সবাই বলে বিয়েসাদীর ক্ষেত্রে এনগেজমেন্টের খাবারই হচ্ছে মেইন।এখন তোর শ্বশুর বাড়িতে এনগেজমেন্টের আইটেম যদি এতো কম হয়,তো বিয়েতে কি করবে কে জানে!
আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে এসব কি যায় না-কি? ”
তাহেরা বেগমের মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো শুনে।কলিজা শুকিয়ে গেলো ভয়ে।পাত্রপক্ষের মুখ থেকে এজাতীয় কথা শোনা যে ভালো লক্ষণ নয় তা তাহেরা বেগমের চাইতে ভালো কে জানে!
নবনীকে ও তো তিনি এরকম করেই বলতেন!
খাবারের শেষের দিকে কেউ কেউ খাসির মাংস পায় নি,কেউ রোস্ট পায় নি,গরুর মাংস হয় নি সবার।
মেহমানরা সবাই মুখ বাঁকাতে লাগলো। কেউ কেউ কটাক্ষ করে বললেন,”এই কোথায় আত্মীয়তা করছেন?আজকেই এই অবস্থা, বিয়ের পর না জানি কেমন করবে এরা।”
লজ্জায়,অপমানে তাহেরা বেগম টিকতে পারলেন না এক দন্ড আর মেহমানদের সামনে। রান্নাঘরে সিংকের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিলেন।তারপর সিংকে মুখ ধুয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে বের হয়ে এলেন সবার সামনে। বুক ভরা ব্যথা চাপা দিয়ে তাহেরা বেগম মেহমানের সাথে কথা বলতে এলেন।
পাত্রের নাম মুবিন। হাতে একটা ডায়মন্ডের রিং নিয়ে লুবনার হাতে পরিয়ে দিলো মুবিন। লুবনা একটা সোনার রিং পাত্রকে পরিয়ে দিলো।
তাহেরা বেগমকে শুনিয়ে পাত্রের বোন মালিহা বললো, “কি রে দিশা,তোর শ্বশুর বাড়ির কালচার এরকম না-কি?
আমাদের সব ভাইবোনের এনগেজমেন্টের রিং ডায়মন্ডের ছিলো তোর মনে নেই।আর দেখ,এরা মুবিনকে এটা কি দিলো?
এটা দিয়ে লোক হাসানোর তো দরকার ছিলো না। সমাজে আমাদের তো একটা সম্মান আছে না-কি?
এতো আত্মীয় এসেছে,সবাই বাসায় গিয়ে আমাদের নিয়ে সমালোচনা করবে।তুই আগে থেকে বলে রাখলি না কেনো?”
তাহেরা বেগমের অন্তরে তীরের মতো বিঁধলো কথাগুলো। কিন্তু আজ তিনি নিরুপায়। সামিম ও টাকা পয়সা দিচ্ছে না,তামিম ও বাসার খোঁজ খবর নেয় না।হামিদুর রহমান ও তেমন কোনো টাকা পয়সা রেখে যান নি।এরকম টানাটানিতে তাহেরা বেগম আগে পড়েন নি।অভাব যখন আসে সব দিক দিয়েই আসে।
অন্য সময় হলে তিনিও পাত্রের জন্য ডায়মন্ডের রিং নিতেন।কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই।
নিরবে সব অপমান সহ্য করা ছাড়া আর কিছু করার নেই তাহেরা বেগমের।
যিনি সৃষ্টি জগতের মালিক তার ইশারা বুঝা কি এতো সহজ! তুচ্ছ মানুষ আমরা,কিভাবে বুঝবো তার ইশারা?
বিয়ের তারিখ ঠিক হলো পাঁচদিন পরে।কুরবানির ঈদের ৭ দিন আগে বিয়ে।তাহেরা বেগম ভীষণ খুশি হলেন শুনে।একটা তো ভালো খবর পেলেন অন্তত। মেহমান চলে যাবার পর দিশা নিনের রুমে ঢুকে গেলো। লুবনা তাহেরা বেগমের উপর রেগে আছে সকালে তাকে মা/রার জন্য।সেও নিজের রুমে গিয়ে দরজা দিলো।পুরো বাসায় তাহেরা বেগম একেবারে একা হয়ে গেলেন।নিজেকে তার মনে হলো শূন্যপুরীতে একা বেঁচে থাকা এক মানবী।পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে আছে,এখানে সেখানে খাবার পড়ে আছে,তরকারির ঝোল পড়ে আছে।
এসব এখন একা তার পরিষ্কার করতে হবে। সারাদিন কাজ করার পর শরীর একটু বিশ্রাম চায়।এই মুহুর্তে এসব পরিষ্কার করতে মোটেও ইচ্ছে করছে না তাহেরা বেগমের।
নিজের ভাগ্যকে গালি দিলেন নিজেই আজ।এঁটো প্লেট বাটি, টেবিল,হাড়ি পাতিল সব পরিষ্কার করে তাহেরা বেগম যখন বিছানায় পিঠ লাগালেন তখন চারদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে।
ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই তাহেরা বেগমের চোখ লেগে এলো। সেই চোখ লেগে আসাটা ও বেশীক্ষণ রইলো না যখন মনে পড়লো ঈদে তো লুবনার শ্বশুর বাড়িতে গরু দিতে হবে,সবার জন্য পোশাক দিতে হবে,সেমাই,চিনি এসব কিছু দিতে হবে।
মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো তাহেরা বেগমের। বড় পরিবারে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা তাহেরা বেগমের মনেই ছিলো না সমাজের বানানো এসব নিয়ম নীতি।
চাইলেও যেই নিয়ম তিনি এখন ভাঙ্গতে পারবে না।তাহেরা বেগমের বুকের ভেতর কেমন একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব হলো।
কি করবেন তিনি?
————–
প্রেগন্যান্সি কীট হাতে নিয়ে নিতু বসে আছে থ’ হয়ে।জীবনের সব স্বপ্ন যখন ভেঙে গেছে সেই মুহুর্তে একটা নতুন স্বপ্ন ধরা দিলো।প্রেগন্যান্সি কীটে পজিটিভ এসেছে। মাথার চুল চেপে ধরে নিতু বসে পড়লো। পুরো পৃথিবী তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে নিতুর এই মুহূর্তে।
কিছুদিন আগে ও এই পজিটিভ রেজাল্ট নিতুকে যেই সুখের সাগরে ভাসাতো,আজকে সেই রেজাল্ট নিতুকে গভীর জলে নিমজ্জিত করেছে।
ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো নিতু।
আর কতো পরীক্ষা দিবে সে?
সৃষ্টিকর্তা আর কতো পরীক্ষা নিবে তার থেকে!
জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় তো পাশ করতে পারে নি।আজীবন একসাথে থাকার জন্যই তো বেছে নিতে পারে নি সঠিক মানুষ।
যখন সেই মানুষটাই নেই জীবনে, তখন তার দেওয়া ভালোবাসার চিহ্নকে নিয়ে কিভাবে থাকবে নিতু?
ফ্লোরে গড়িয়ে কাঁদতে লাগলো নিতু।নিতুর কান্না শুনে বাবা মা দুজনেই ছুটে এলেন।অন্ধকার রুমে মেয়ে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে। মেয়ের সেই কান্নায় এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে বাবা মায়ের কলিজা।রেবেকা বেগম মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন,”কি হইছে তোর,এমন করস কেনো মা তুই?এমন করিস না মা।তোর কান্না দেখলে যে আমার আর তোর বাবার বুক ফেটে যায় যন্ত্রণায়। আমরা দুজন মানুষ তোদের দুই বোনের দিকে তাকিয়েই তো বেঁচে আছি।আমাদের মেরে ফেলিস না এভাবে তোরা।”
নিতু মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা’গো,কেনো আমার সাথে এরকম হলো?কেনো আমি এতো যন্ত্রণা পাচ্ছি।আমি তো বিশ্বাস করেছি তাকে,তবে কেনো দিনশেষে আমিই ঠকে গেলাম,আমিই কষ্ট পাচ্ছি।যে আমাকে ঠকালো মা’গো সে তো সুখে আছে।আমি কিভাবে বাঁচবো গো মা?”
চলবে……