#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৩০)
বাহিরে হিমহিম ঠাণ্ডা, কুয়াশার হালকা আস্তরণ। পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে তামিম আরাম করে ঘুমিয়েছিলো।
তামিম ঘুম থেকে উঠে নিজেকে তাহেরা বেগমের রুমে দেখে অবাক হলো।যতোদূর মনে পড়ে তার,সে বাহিরে ছিলো।বাসায় আসলো কখন তাহলে?
মাথার ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তামিমের,সারা শরীর ভীষণ হালকা অনুভব হচ্ছে।বহু পরিশ্রমের পর শান্তির ঘুম হলে শরীর যেমন ঝরঝরে হয়ে যায় তেমন লাগছে।
আড়মোড়া ভেঙে তামিম বের হলো মায়ের রুম থেকে।বাহিরে এসে দেখে ফ্লোরে নিতু বসে আছে পাথরের মূর্তির মতো।ফোলা ফোলা দুই চোখ,এলোমেলো চুল,পরনে এলোমেলো শাড়ি।ক্লান্ত,বিধ্বস্ত নিতুকে দেখাচ্ছে জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের ন্যায়।
সারারাত নিতু এখানে বসে ছিলো। সামিম তামিমের সাথে শুয়েছিলো।সকালে উঠে এসে সোফায় বসেছে। সামিম বুঝে উঠতে পারছে না কাকে দোষ দিবে?
এতোদিন নিতুকে সে খারাপ ভাবতো,কিন্তু এখন সামিম বুঝতে পারছে সবচেয়ে বেশি নিতু ঠকেছে।অন্ধ ভালোবাসার পুরষ্কার এমনভাবে পেয়েছে বেচারা যে তার কাছে দিন রাত সব এক হয়ে গেছে।
তামিম এসে জিজ্ঞেস করলো,”তুই বাসায় এলি কখন?তোর ভাবী এভাবে বসে আছে কেনো?”
সামিম মুচকি হেসে বললো,”আমি পরশু এসেছি ভাইয়া।”
তামিম বুঝতে পারলো দুই দিন সে বাসায় আসে নি।কিছুটা লজ্জা পেলো তামিম।সেদিন নবনীর হাতের থাপ্পড় খেয়ে তামিমের মাথায় রক্ত উঠে গেছে।নিজের রাগ,ক্ষোভ সামলাতে না পেরে ঘৃণ্য জায়গায় যেতেও বিবেকে বাঁধে নি।
আড়চোখে নিতুর দিকে তাকালো তামিম।তারপর সামিমকে বললো,”ও এভাবে বসে আছে কেনো?”
সামিম হেসে বললো,”যার স্বামী প্রাক্তন স্ত্রীর হাতে মার খেয়ে পরনারীর কাছে যায়,মদে চুর হয়ে বাসায় আসে,মাতাল হয়ে নিজের প্রাক্তন স্ত্রীর নাম ধরে ডাকে বর্তমান স্ত্রীর সামনে।সে আর কিভাবে থাকবে ভাইয়া?তার ভালোবাসা যখন প্রশ্নবিদ্ধ তখন তার অবস্থা কেমন হবে?”
তামিম চোখ রাঙিয়ে সামিমকে ইশারা করলো নিতুর সামনে এসব না বলার জন্য।সামিম হাসলো ইশারা বুজবতে পেরে।তারপর বললো,”এখন কেনো ভয় পাও ভাইয়া?কাল যখন নিজেই সব বলে দিয়েছো,নবনী,নবনী করে হেসেছো,কেঁদেছ তখন তো ভাবো নি ওনার কি হবে!
এই মেয়েটাকে যখন ঠকিয়ে বিয়ে করেছ,তখন কেনো ভাবো নি যেদিন এই মেয়েটা সব সত্যি জানতে পারবে তখন কেমন করে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে এর সমস্ত ভালোবাসা,বিশ্বাস?
এর জীবন নরক করে দেয়ার আগে কেনো ভাবো নি ভাইয়া?ভাবী সব জেনে গেছে ভাইয়া,কি লুকাতে চাও আর?আর কতোদিন লুকিয়ে রাখতে?”
তামিম চমকে গেলো সামিমের কথা শুনে।নিতু বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো,তারপর রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। বাহিরে থেকে তামিম দরজা ধাক্কাতে লাগলো বারবার। চিৎকার করে বলতে লাগলো, “নিতু আমার কথা শোনো,আমাকে ব্যাপারটা এক্সপ্লেইন করতে দাও অন্তত। প্লিজ নিতু,একবার দরজা খোলো।আমি জানি আমি ভুল করেছি,আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
তামিমের চিৎকার শুনে তাহেরা বেগম উঠে এলো।তাহেরা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,”মেয়ে মানুষের এতো তেজ কিসের আবার?বিয়ে তো আমরা জোর করে করাই নি।নিজেই তো পাগল হয়ে গেছে আমার ছেলেকে বিয়ে করার জন্য।এখন এতো নাটক দেখায় কেনো?”
সামিম হেসে বললো,”তোমার ছেলেকে ভালোবেসে মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে মা,তাই সে কোনো খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করে নি।দোষ তোমার ছেলের।সে সত্যি গোপন করে মেয়েটাকে ঠকিয়েছে।”
তাহেরা বেগম ধমকে বললেন, “তুই চুপ কর।ভাইয়ের বিরুদ্ধে কথা বলিস বসে বসে,বেয়াদব ছেলে।”
সামিম বললো,”এই বেয়াদবিটা যদি আগে করতে পারতাম তবে হয়তো এই মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট হতো না মা।আফসোস, আমি আগে জানতাম না মেয়েটা যে এসব ব্যাপারে কিছুই জানে না।”
নিতু বের হলো ৪৫ মিনিট পরে।পরনের শাড়ি চেঞ্জ করে সুতি একটা থ্রিপিস পরে,লাগেজ গুছিয়ে নিতু বের হয়ে এলো।কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা হাটতে লাগলো। তামিম ছুটে গিয়ে হাত চেপে ধরলো।ব্যস্ত হয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করলো নিতুকে।নিতু হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত কাজ করলো।
একদলা থুথু তামিমের মুখের উপর মে/রে বললো,”তোর এই নর্দমার চেহারা আমাকে আর দেখাবি না।যদি কখনো আমার সামনে আসিস,তবে সেদিন তুই আমার হাতে খু/ন হয়ে যাবি।”
সবাইকে হতবাক করে দিয়ে নিতু বের হয়ে গেলো বাসা থেকে।তাহেরা বেগমের এক মিনিট লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। বুঝার পর তাহেরা বেগম ছুটে গেলেন নিতুকে ধরতে।তার আগেই নিতু লিফটে উঠে গেলো। তাহেরা বেগম আক্রোশে বাসায় এসে একটা ফুলদানী ভেঙে ফেলল।
সামিমের গলা চেপে ধরে বললো,”শান্তি পাইছস তুই?এইটা ও আমার দেখার বাকি ছিলো?
জানো/য়ার তোর এসব উষ্কানির জন্য ওই ফকিন্নির ঘরের মাইয়া আমার ছেলেরে এভাবে অপমান করে গেছে।আমি ও এর শেষ দেখে ছাড়মু।ওই মাইয়ারে আমি মজা দেখামু।”
সামিম তাহেরা বেগমের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,”তোমার আরো অনেক কিছু দেখার বাকি আছে মা।তোমার পিরিতির দিশাকে যেদিন আমি দুই লা/থি দিয়ে বের করে দিবো সেদিন তুমি আসল মজা পাবা।”
তাহেরা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন।
সামিম উঠে চলে গেলো রুমে।তারপর বেরিয়ে এলো নিজের ওয়ালেট,ব্যাগ নিয়ে।কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে চলে গেলো বাসা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। তামিম হতভম্ব হয়ে রইলো পুরো ব্যাপারটায়।
কিছুক্ষণ পর তামিমের হুঁশ এলো নিতু তাকে অপমান করে বাসা থেকে চলে গিয়েছে।তামিম ভীষণ আশ্চর্য হলো এই ভেবে যে এতে তার একটুও খারাপ লাগছে না।বরং নিজেকে স্বাধীন মনে হচ্ছে ভীষণ। নিতু নেই মানে তামিমের একটা পিছুটান নেই।নবনীকে আর একবার ফিরে পাবার চান্স রয়েছে।
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো নবনীর কথা ভাবতেই।মনে মনে তামিম বললো,”জীবন থেকে সবাই হারিয়ে যাক নবনী,তবুও তোমাকে আমার চাই।তোমার জন্য উন্মাদনায় মেতে আজ আমি নিতুকে হারিয়েছি তাতে আমার মোটেও আফসোস নেই তবুও আমি তোমাকে চাই।তার জন্য যা করা লাগে আমি করতে রাজি। ”
তাহেরা বেগম ছেলের পাশে বসে বললেন,”মন খারাপ করবি না বাবা তুই।এরকম কতো মেয়ে তোর পায়ের কাছে এসে গড়াগড়ি খাবে দেখিস।আমি তোকে আরো ভালো জায়গায় বিয়ে করাবো।”
তামিম রেগে গিয়ে বললো,”আর কতো?আর কতো তোমার হাতের পুতুল বানিয়ে রাখবে আমাকে? আমার নিজেকে মানুষ বলে মনে হয় না।মেরুদন্ডহীন পুরুষ আমি।যার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমার পাল্লায় পড়ে আমার নবনীকে ছেড়ে দিয়েছি।এখন বুঝতে পারছি নবনীকে ছাড়া আমার কিছুতেই চলবে না।সোজাসাপটা একটা কথা শুনে রাখো মা,বিয়ে করে আমি আবার নবনীকে আনবো।তোমার থেকে আমার জীবন নিয়ে আর একটা উপদেশ ও আমি শুনতে চাই না।আমার জীবনটা তুমি নষ্ট করে দিয়েছ নিজের লোভ মিটাতে গিয়ে।”
তাহেরা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তামিম নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।তাহেরা বেগম সাপের ন্যায় ফুঁসতে লাগলেন।ওই ছোটলোকের মেয়ে নবনীর উপর এখনো ছেলের মন পড়ে আছে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পান নি।
—————–
সাত সকালে নিতুকে দেখে রেবেকা ভীষণ অবাক হলেন।বরকত সাহেব মেয়েকে দেখে এগিয়ে এসে বুকে টেনে নিলেন।তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছিস তুই?”
নিতু কান্নার জন্য কথা বলতে পারলো না।রেবেকা বেগম ও গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।কাঁদতে কাঁদতে নিতু বেহুঁশ হয়ে গেলো। বরকত সাহেবের মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেলো। রেবেকা মেয়ের মাথায় তেল পানি দিলেন,মুখে পানির ছিটা দিলেন।
কিছুক্ষণ পর নিতু উঠে বসলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,”আমি একেবারে চলে এসেছি বাবা।তামিমকে যতো শীঘ্র সম্ভব আমি ডিভোর্স দিতে চাই।”
বরকত সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”আচ্ছা ঠিক আছে মা।জীবন তোর,সিদ্ধান্ত ও তোর।তুই আগে সুস্থির হয়ে নে।তারপর কি হয়েছে সব খুলে বল।”
নিতু এক গ্লাস পানি খেয়ে বললো,”তামিম আমাকে ঠকিয়েছে বাবা।তামিম আগে একটা বিয়ে করেছে।নবনী নামের একটা মেয়েকে।তারপর আমার সাথে সম্পর্ক হবার পর তামিম,তামিমের মা আমার চাকরির লোভে পড়ে ওই নিরীহ মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।
তামিম আমাকে মন থেকে ভালোবাসে নি বাবা।আমাকে হয়তো ওর ভালো লাগতো। সেটাকে ও ভালোবাসা ভেবে নিয়েছে।কিন্তু এখন যতো দিন যাচ্ছে ও বুঝতে পারছে ও আসলে আমাকে কখনো ভালোবাসতে পারে নি।এভাবে সংসার হয় না তো বাবা।আমি তো ওকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসি।সেখানে ওর সবটা জুড়ে আমি নেই।আমি এসব নিতে পারছি না বাবা।আমার যতোবারই মনে হচ্ছে আমার জন্য একটা মেয়ের সংসার ভেঙে গেছে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।
আর যতোবারই মনে হচ্ছে আমার সত্যিকার ভালোবাসার দাম তামিম দিতে পারে নি আমার ততবারই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।আমি সত্যিই ভালোবাসি ওকে,কেনো এভাবে ঠকালো আমাকে?”
বরকত সাহেব মেয়ের কষ্ট অনুভব করতে পারলেন।বেঁকে বসলেন রেবেকা বেগম। মুখ অন্ধকার করে বললো,”বিয়ে ছেলেখেলা নয় নিতু।সমাজে আমাদের একটা সম্মান আছে।সবাই যখন জানবে তোর ডিভোর্স হয়ে গেছে,আমরা মুখ দেখাতে পারবো না।তাছাড়া, তামিম আগে যদি বিয়ে করেও থাকে তাকে এতো হাইলাইট করার কি আছে?এরকম তো অহরহ হচ্ছে। সব মেয়ে কি তাই বলে স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে আসে না কি?
একটা ভুল করে ফেলেছে তাকে ক্ষমা করে দিলেই তো হয়।সব কিছুকে এতো বড় করে দেখতে নেই।”
বরকত সাহেব অবাক হয়ে বললেন,”কি বলছ তুমি এসব?এই তোমার শিক্ষা রেবেকা?আমার মেয়েকে ওরা ঠকিয়েছে।একে তো সত্যি গোপন করে বিয়ে করেছে,তারপর আমার মেয়ে ওর স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সেই ছেলে অন্য একটা মেয়েকে চাচ্ছে।
যেখানে আমার মেয়ের এতো বড় অপমান হয়েছে সেখানে আমার মেয়ে আবারও ফিরে যাবে?”
রেবেকা ঠান্ডা গলায় বললো,”হ্যাঁ যাবে।না গিয়ে কি করবে? ডিভোর্সি মেয়েকে তুমি ঘরে রেখে কি করবে?
লোকে হাসাহাসি করবে।রিতুর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা শুনলে মেয়েকে অপদস্থ করবে,রিতু শুনলেও রাগ হবে।তাছাড়া এই সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদের কতো দোষ তুমি জানো?বিয়ে দিতে পারবে মেয়েকে?”
নিতু মায়ের কথা শুনে ভীষণ চমকালো।এই কাকে দেখছে সে?এই কি তার আপন জন্মদাত্রী মা?
শিক্ষিত একজন মানুষ হয়েও তিনি এরকম মানসিকতা ধারণ করেন?
মেয়ের এই নাজুক অবস্থায় মেয়েকে সাপোর্ট না দিয়ে উল্টো মেয়েকে কথা শোনাচ্ছেন?
শিক্ষিত হলেই যে কেউ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না তার আবারও প্রমাণ পেলো নিতু।
মানুষ হতে গেলে মানবিকতা দরকার হয়।সবাই কি এক রকম হয়?আমাদের সমাজে এরকম কতো বাবা মা আছেন,যারা মনে করেন মাটি কামড়ে পড়ে থেকে সংসার করে যাওয়াটাই হচ্ছে জীবনের মূল উদ্দেশ্য। সেখানে স্বামী স্ত্রী দুজনের মধ্যে মনের মিল থাকুক আর না থাকুক।লোক দেখানো সম্পর্ক থাকলেই হলো।ভেতরে ভেতরে দুটো মানুষ যে দুই মেরুর অধিবাসী হয়ে যায়,তাদের কাছে সম্পর্ক শব্দটা হয়ে যায় সম্পূর্ণ ঠুনকো তা কে জানে?
চলবে……………
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৩১)
সকাল সকাল এক অদ্ভুত কান্ড ঘটে গেলো। মেঘ প্রতিদিনকার মতো ফাল্গুনী আর চৈতালীকে পড়াতে এলো। মাসুমা বেগম ও সেই মুহুর্তে উপস্থিত একজন ফর্সা,স্বাস্থবতী মহিলাকে সাথে নিয়ে।
নবনী ভীষণ চমকে গেলো মাসুমা বেগমকে দেখে।
মাসুমা বেগম নবনীকে জড়িয়ে ধরে বললো,”মা গো,আমি আজ এসেছি তোমাকে আমার আপন করে নিতে।তোমার বাবা মা কোথায়? ”
মাসুমা বেগমের দুই হাতে ফলমূল, পাশের মহিলার হাতে কয়েকটা মিষ্টির প্যাকেট।
নবনীর বাবা মা দুজনই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।নবনী আমতাআমতা করে বললো,”ওনারা আমার বাবা মা।”
মাসুমা বেগম এগিয়ে গিয়ে রাবেয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরলেন।তারপর বললেন,”আপা,আপনার মেয়েটাকে নিজেদের বাড়ির বউ করে নেয়ার জন্য এসেছি আমি।আপনার মেয়েটা এতো লক্ষ্মী আপা,আমার ভীষণ মনে ধরেছে ওকে।”
নবনী চমকালো।মাসুমা বেগম কি তবে জেনে গেছেন সব?
রাবেয়া মাসুমা বেগমকে বসালেন নিজেদের রুমে নিয়ে।তারপর নবনীকে ইশারা করলেন ওনাদের জন্য নাশতার ব্যবস্থা করতে।
মাসুমা বেগম বিছানার এক পাশে বসে বললেন,”উনি আমার বড় আপা।আপার দুইটা ছেলে। প্রথম জন বিয়ে করে বউ নিয়ে সিলেট থাকে।ও ডাক্তার,সিলেট সরকারি হাসপালে চাকরি করে।আর ছোট জন সোনালি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। ছোট থেকে আমার হাতের উপর দিয়ে মানুষ হয়েছে দুজনে আমার ছেলের সাথে।”
রাবেয়া বেগম হাশেম আলীর দিকে তাকালেন।হাশেম আলী গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,”আপা,আপনার সাথে নবনীর পরিচয় হলো কিভাবে তাই তো জানা হলো না।”
মাসুমা বেগম উৎসাহ নিয়ে বললেন,”আমার শিমলা মা’র বাসায় আপনার মেয়েটাকে আমি প্রথম দেখেছি।নবনী তো আমাদের অফিসেই চাকরি করে।এতো নম্র,ভদ্র,সুন্দর মেয়ে আজকাল তো দেখাই যায় না।মেয়েটাকে দেখেই আমার কেমন ভীষণ আপন আপন মনে হচ্ছিলো।সত্যি বলতে কি,আমি কিন্তু প্রথমে আমার ছেলের বউ করতে চেয়েছি মেয়েটাকে।কিন্তু আমার ছেলে অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসে।ছেলের পাগলের মতো ভালোবাসা দেখে আমার নিজেরই বুক ফেটে কান্না আসে।
এদিকে আপনার মেয়েটাকেও এতো মনে ধরেছে যে কিছুতেই তাকে অন্য কারো বউ হবে এটা মানতে পারছি না।তাই ছুটে এলাম আমার শৈবালের বউ করার জন্য।”
নবনী নাশতা নিয়ে আসতেই মাসুমা বেগমের বোন আসমা বেগম উঠে গিয়ে নবনীর পাশে দাঁড়ালেন।নবনীর মুখটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,”আমার বোনের চয়েসের উপর আমার বিশ্বাস ছিলো।আমার বোন খাঁটি সোনা বাছাই করেছে আমার ছেলের বউ করার জন্য।”
নবনী আৎকে উঠলো শুনে।তারপর সবাইকে নাশতা দিয়ে বের হয়ে এলো।ফাল্গুনীদের রুমে গিয়ে দুই বোনকে বললো,”ডাইনিং টেবিলে তোদের জন্য সেমাই রেখে এসেছি,খেয়ে আয় যা দুজন দ্রুত।”
দুই বোন উঠে যেতেই নবনী মেঘের পাশের চেয়ারে বসে বললো,”সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
মেঘ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বললো,”সে তো আমার অনেক আগেই হয়েছে,যেদিন তোমাকে কাদাপানিতে মাখামাখি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি সেদিনই আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।সবাই প্রেমিকার চোখে নিজের সর্বনাশ দেখে, আমি মনে হয় একমাত্র প্রেমিক যে কিনা প্রেমিকার গায়ের কাদাপানিতে নিজের সর্বনাশ দেখলাম।”
নবনী ভ্রু কুঁচকে বললো,”বেশি কথা বলেন আপনি।আপনার মা এসে হাজির বাসায়।আপনার খালাতো ভাইয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।”
মেঘ চমকে বললো,”মা কিভাবে তোমার বাসা চিনলো?”
নবনী উদাসীন হয়ে বললো,”আপনার মা তো,আপনার মতোই কোনোভাবে বাসা চিনে নিয়েছেন।এখন আপনি দ্রুত বিদায় নেন।”
মেঘ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,”তাই তো,আমাকে তো পালাতে হবে।তুমি কোনো চিন্তা করো না।আমি সব ম্যানেজ করে নিবো।দরকার হলে শৈবাল ভাইকে হাত করে নিবো।আসছি আমি।”
বলে বের হতে গিয়ে ও দাঁড়িয়ে গেলো।তারপর হঠাৎ করেই নবনীর হাত চেপে ধরে টান দিয়ে নিজের বুকের কাছে এনে বললো,”তোমার স্থান শুধু আমার বুকে নবনী।এখান থেকে তোমাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।তুমি শুধু এটুকু দেখো,চাচা চাচী যেনো এখনই তোমার ডিভোর্সের ব্যাপারটা প্রকাশ না করে।”
নবনী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।মেঘ বের হতে গিয়ে আসমা বেগমের সামনে পড়ে গেলো।মাসুমা বেগম নবনীর বাবা মায়ের সাথে কথা বলছিলেন।আসমা বেগম বের হয়ে এলেন নবনীদের বাসাটা দেখার জন্য।
মেঘকে দেখে আসমা বেগম কেমন থতমত খেলেন।তারপর বিস্মিত হয়ে বললেন,”মেঘ,তুই এখানে?”
মেঘ না চেনার ভান করে বললো,”আমাকে বলছেন?আমি তো মেঘ না চাচী।আমার নাম রাফিন।ফাল্গুনীদের টিউটর আমি।”
আসমা বেগম বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে বললেন,”অসম্ভব মেঘ,আমার সাথে চালাকি করবি না।আমি জানি তুই আমাদের মেঘ।আমি তোর মা’কে ডেকে আনছি।”
মেঘ হেসে বললো,”আপনার ভুল হচ্ছে চাচী।আমাকে দ্রুত যেতে হবে।আমার অফিসে আজ একটু তাড়াতাড়ি যাবার দরকার। অফিস থেকে ১ সপ্তাহের জন্য আমাকে রাজশাহী যেতে হবে।”
এক মুহুর্ত দেরি না করে মেঘ বের হয়ে গেলো।আসমা বেগমের ডাকাডাকি শুনে মাসুম বেগম, হাশেম আলী,রাবেয়া বেগম ও বের হয়ে এলেন।
নবনী দরদর করে ঘামতে লাগলো এই হালকা শীতেও।
খোলা বারান্দা দিয়ে উত্তরের বাতাস সগৌরবে ভেতরে প্রবেশ করছে।শীতের বুড়ি কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে প্রকৃতিতে নিজের সবটা উজাড় করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে।মাসুমা বেগম এসে জিজ্ঞেস করলেন,”কি হয়েছে আপা?”
আসমা বেগম হতভম্ব হয়ে বললেন,”মেঘ এসেছে এখানে,বিশ্বাস কর মাসুমা।আমি নিজের চোখে মেঘকে দেখেছি।অথচ ও বলছে ও নাকি মেঘ না।কি যেনো নাম বলে গেলো নিজের,রাফিন না শাফিন মনে নেই।”
মাসুমা বেগম অবাক হয়ে বললো,”কি বলছো আপা,মেঘ এখানে আসবে কেনো?ওরা বাবা ছেলে মিলে তো জগিং করতে বের হয় প্রতিদিন সকালে।একসাথে বের হয় আবার একসাথে ফিরে আসে।”
আসমা বেগম দৃঢ় গলায় বললো, “আমার দুই চোখ যথেষ্ট ভালো আছে,আমি অন্তত মেঘকে চিনতে ভুল করবো না।”
হাশেম আলী বললেন,”আপনের ভুল হইতেছে আপা।আপনে যার কথা কইতাছেন সে তো আমার দুই মাইয়ার মাস্টার।ওদের পড়ায়।এতিম ছেলে।একটা মেসে থাকে।”
আসমা বেগম তবুও বিশ্বাস করতে পারলেন না।নিজের চোখে দেখেছেন তিনি।ভুল দেখেন নি তা তিনি ১০০% নিশ্চিত। মাসুমা বেগমকে বললেন,”তুই শফিককে কল দিয়ে বল মেঘের কাছে ফোন দিতে।”
মাসুমা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,”দিচ্ছি।অযথা তুমি সন্দেহ করছো।”
শফিক আহমেদকে কল দেয়ার সাথে সাথে তিনি কল রিসিভ করলেন।মাসুমা বেগম বললেন,”তুমি কোথায়?মেঘ কোথায়?”
শফিক আহমেদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন,”আমি আর মেঘ এই তো একসাথে।একটা বেঞ্চে বসে আছি।যা দৌড় দৌড়েছি আজকে বাপ ব্যাটা মিলে,উফ!এভাবে ওয়ার্ক আউট করলে অন্তত আরো কয়েক বছর বেশি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে।আমি তো তুমি মরে যাবার পর নতুন আরেকটা বিয়ে করার প্ল্যানিং ও করে রেখেছি।আমার নাতিপুতি এলেই ওদের সাথে ডিসকাস করবো ব্যাপারটা নিয়ে।ওরা রাজি হলে তুমি জীবিত থাকাকালীন নতুন দাদী এনে দিবো ওদের।ওদের আবদার তো আমি ফেলে দিতে পারি না।কি বলো তুমি?”
মাসুমা বেগম নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বললেন,”মেঘের কাছে ফোনটা দাও।”
শফিক আহমেদ মেঘের কাছে ফোন দিতেই মেঘ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,”হ্যাঁ মা বলো।”
মাসুমা বেগম বললেন,”কি দরকার এতো এক্সারসাইজ করার।এমনিতেই তো রোগাপটকা শরীর তোর।তোর বাপকে বল বেশি করে দৌড়ে জলহস্তীর সাইজ থেকে মানুষের সাইজে আসতে।তুই বাবা এতো কষ্ট করিস না।”
মেঘ হেসে বললো,”মা,ফিট থাকতে হলে একটু কসরত করা লাগবে।তোমার ছেলে এতো মেয়ের ক্রাশ তো এমনি এমনি হয় নি।”
মাসুমা বেগম ফোন রেখে বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুমি অযথাই সন্দেহ করছো। এক রকম দেখতে ৭ জন মানুষ পৃথিবীতে আছে।মেঘ আর ওর বাবা একই সাথে আছে।কাকে না কাকে দেখে কি ভাবছ কে জানে!”
আসমা বেগম দ্বিধায় পড়ে গেলেন।
মেঘ বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,”ধন্যবাদ বাবা।আজ বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।তুমি কিভাবে এলে এখানে?”
শফিক আহমেদ বললেন,”তোর মা গাড়িতে বসে আমাকে কল দিয়ে বললো,”শৈবালের জন্য নবনীকে দেখতে যাচ্ছে।শুনেই তো আমার মনের ভেতর বিপদ সংকেত বেজে উঠলো।আমিও উবার নিয়ে চলে এলাম এখানে।তোর মায়ের বুদ্ধির দৌড় কতোটুকু তা তো আমার জানা আছে।তাই বুঝলাম কোনোভাবে যদি তোকে দেখে ফেলে সন্দেহ করে তবে নির্ঘাত আমাকে কল দিবে।”
মেঘ চিন্তিত হয়ে বললো,”বাবা,আমার খুব চিন্তা হয় একটা ব্যাপারে। মা যেদিন শুনবে নবনী ডিভোর্সি সেদিন কেমন রিয়েক্ট করবে।উনি এসব ব্যাপারে কেমন খুঁতখুঁতে তা তো তুমি জানোই।আমি কিন্তু কোনোভাবেই নবনীতাকে হারাতে পারবো না বাবা।মাকে তুমি যেভাবে পারো ম্যানেজ করে নাও।মা ম্যানেজ হয়ে গেলেই আমি নবনীকে বিয়ের কথা বলবো।তুমি না পারলে আমি নবনীকে নিয়ে এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো দরকার হলে।তবুও কেউ ওকে খোঁচা দিয়ে কথা বলবে এসব সহ্য করতে পারবো না।”
শফিক আহমেদ হেসে বললেন,”তোর বাবা আছে না তোর পাশে,বাবার উপর ছেড়ে দে এসব ছোটখাটো ব্যাপার।সব কিছুই বাবা সেটিং করে রেখেছি।তুই রিল্যাক্স মুডে থাক।চুটিয়ে প্রেম কর বউমা’র সাথে।”
মেঘ হেসে ফেললো বাবাকে জড়িয়ে ধরে।তারপর দুজনেই উবার থেকে নেওয়া গাড়িতে উঠে বাসার পথ ধরলো।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে মাসুমা বেগম আর আসমা বেগম বের হয়ে এলেন। লিফটে দাঁড়িয়ে দুজনে নবনীর ব্যাপারে কথা বলছেন।আসমা বেগম বললেন,”মেয়েটাকে আমার ও ভালো লেগেছে ভীষণ। ওরা পজিটিভ সাইন দিলে আমরা আগামী শুক্রবার শৈবাল,সৈকতকে নিয়ে এসে পাকা কথা বলে যাবো।”
মাসুমা বেগম বললেন,”আমি তোমাকে বলেছি না,নবনীকে দেখলে তুমি অমত করতে পারবে না।”
লিফটে দাঁড়িয়ে তামিম সবটা শুনলো।তারপর লিফট থেকে বের হয়ে বললো,”এক্সকিউজ মি,আপনারা কি থার্ড ফ্লোরে থাকা নবনীর কথা বলছেন?”
মাসুম বেগম বললেন,”হ্যাঁ, আপনি কে?”
তামিম হেসে বললো,”আমি ওর এক্স হাজব্যান্ড।আপনারা অযথাই সময় নষ্ট করছেন।মেয়েটা এতোটাও ভালো না।আপনাদের দেখে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ বলেই মনে হচ্ছে।তাই কথাটা বললাম।আপনাদের ছেলের ও নিশ্চয় আগে একটা বিয়ে হয়েছে। তা না হলে তো কেউ ডিভোর্সি মেয়েকে অবিবাহিত ছেলের বউ করতে চায় না।”
মাসুম বেগম,আসমা বেগম দুজনেই ভীষণ চমকে গেলেন তামিমের কথা শুনে।তামিম মুচকি হেসে বললো,”আমি জানি আপনারা হয়তো বিশ্বাস করছেন না আমাকে।ব্যাপার না।বিল্ডিং এর লিফটম্যান,দারোয়ান,কেয়ারটেকার সবাই জানে এই ব্যাপারটা। ওনাদের জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন আপনি।”
দেরি না করে তামিম মুচকি হাসতে হাসতে অফিসের জন্য চলে গেলো।
মাসুমা বেগমের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেলো শুনে।আসমা বেগম বললেন,”এসব কি মাসুমা।আমার ছেলেটা অবিবাহিত। আর তুই কি না একটা ডিভোর্সি মেয়ের জন্য আমার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলি?”
মাসুমা বেগম কি বলবেন খুঁজে পেলেন না।আসমা বেগমকে বাসায় পৌঁছে দিতে ড্রাইভার কে বলে দিয়ে মাসুমা বেগম শিমলার বাসায় চলে গেলেন।শিমলা তার জীবনে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।মাঝেমাঝে মাসুমা বেগমের মনে হয় তিনি বুঝি মেঘলার চাইতেও শিমলাকে বেশি ভালোবাসেন।
শিমলার বাসায় গিয়ে মাসুমা বেগম ধপ করে বসে পড়লো সোফায়।তারপর বিড়বিড় করে বললো, “এতো বড় প্রতারণা! ওরা একটা বার বললো ও না ওদের মেয়ের আগে একটা বিয়ে হয়েছে। ”
শিমলা চা নিয়ে এসে বললো,”কার কথা বলছো মামী?”
মাসুমা বেগম বললেন,”নবনীর কথা।”
শিমলা হেসে ফেললো। শফিক আহমেদ আগেই শিমলাকে বলে রেখেছেন এই ব্যাপারে। শফিক আহমেদ জানতেন এরকম কিছু শুনলে মাসুমা বেগম শিমলার কাছে ছুটে আসবেন পরামর্শ করার জন্য।
শিমলা মুচকি হেসে বললো,”সে কি মামী!তুমি জানো না?আমি তো ভেবেছি তুমি জেনেছ।আমি বলতে ভুলে গেছি আসলে।”
তারপর শিমলা মাসুমা বেগমকে নবনীর সম্পর্কে সবকিছু খুলে বললেন।শুনতে শুনতে মাসুমা বেগমের দুই চোখ বারবার অশ্রুতে টইটুম্বুর হয়ে গেলো। বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো।
আসমা বেগমকে কল দিয়ে বললেন,”শোন আপা,নবনীকে তোর ছেলের বউ করার দরকার নেই।ওর ছবি তুই ফোন থেকে ডিলিট করে দে।নবনীকে আমি আমার মেঘের বউ বানাবো। ”
আসমা বেগমকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে মাসুমা বেগম ফোন কেটে দিলেন।
চলবে……
রাজিয়া রহমান