#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (২৬)
অফিসে গিয়ে তামিম জানতে পারলো তাকে উপরের ফ্লোরে শিফট করে দেওয়া হয়েছে। শুনে তামিম কিছুটা আশাহত হলো। এতো দিন তো নবনীকে দেখতে পেতো,আজ থেকে তা আর সম্ভব হবে না।
তামিমের প্রচন্ড রাগ হলো।
ইচ্ছে করলো ছুটে গিয়ে মেঘের গলা টি/পে ধরতে।তামিম বুঝতে পারছে মেঘ কেনো এই কাজ করেছে।তামিম যাতে নবনীকে যখন তখন দেখতে না পারে তার জন্য মেঘ এই ব্যবস্থা নিয়েছে।
প্রচন্ড আক্রোশে তামিম চেয়ারে লা/থি মারলো।
তারপর সোজা মেঘের কেবিনের দিকে গেলো। গিয়ে দেখে মেঘ এখনো আসে নি অফিসে।নবনী পিসি’তে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে।
তামিম নবনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
নবনীর খোঁপায় বেলীফুলের মালা জড়ানো, হাতে সাদা রেশমি চুড়ি,চোখে কাজল।কালো সুতির একটা নরমাল ড্রেসে নবনীকে মনে হচ্ছে অপ্সরা। তামিমের বুকে জ্বলুনি শুরু হলো।
খাঁ খাঁ মরুভূমির মতো তামিমের বুকের ভেতর ধুলোর ঝড় উঠলো যেনো।তপ্ত রোদে মরুভূমির বালু যেমন উত্তপ্ত হয়ে থাকে,তেমনি তামিমের বুকের ভেতর উত্তপ্ত হয়ে আছে।
বুকের ভেতর যেনো এক পৃথিবী শূন্যতা।এই নবনী তার ছিলো, অথচ আজ আর কেউ না।একসময় এই নবনীর উপর তামিমের ১৬ আনা অধিকার ছিলো অথচ আজ এর দিকে এক দন্ড প্রান ভরে তাকাতে ও বারন।
এই নবনীর জন্য কি-না একটা প্রতিষ্ঠানের মালিক উন্মাদ হয়ে ঘুরছে!
তামিম মানতে পারছে না এটা।
কেনো এতোদিন একে তামিম চিনতে পারলো না,কেনো এতো দেরি হলো তার?
কেনো অন্য কেউ এখন নবনীকে ভালোবাসে?
তামিম কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছে না।নবনী তামিমের না হোক,তাতে তামিমের সমস্যা নেই কিন্তু তামিম এটা মানতে পারছে না যে নবনী অন্য কারো হবে।অন্য কারো সঙ্গে ঘর বাঁধবে এটা ভাবলেই তামিমের মাথায় আগুন ধরে যায়।
নবনী মাথা তুলে তামিমের দিকে তাকালো। তারপর বললো, “কিছু বলবেন?স্যার তো এখনো আসেন নি,কোনো প্রবলেম থাকলে আমাকে বলুন,আমি স্যারকে জানিয়ে দিবো।”
তামিমের রাগ ক্ষোভে রূপ নিলো।স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি লোপ পেলো।স্থান কাল পাত্র ভুলে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো, “খুব ভালো আছো এখন?বড় স্যারকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছ,স্যারকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছ, ভীষণ সুখে আছো এখন তাই না?এসব কাহিনি করার জন্যই আমাকে ছেড়ে যাবার জন্য এতো উতলা হয়ে গেছো?”
নবনী চোখ মুখ শক্ত করে বললো, “ডোন্ট ক্রস ইওর লিমিট। ”
তামিম টেবিলে থাপ্পড় মেরে বললো, “লিমিট ক্রস করলে কি করবি তুই আমাকে?তোরে আমি ভয় পাই না-কি?
শোন,এতো আকাশে উড়িস না।স্যার কে আমি বলে দিয়েছি তুই যে ডিভোর্সি, আমি যে তোরে দুই লাথি দিয়ে আমার জীবন থেকে বের করে দিয়েছি স্যার জেনে গেছে।তাই এতো ভাব মারিস না আমার সাথে। ”
নবনীর সহ্য হলো না। এতো দিন নিরবে সহ্য করে যাওয়া সব আক্রোশ এবার বিদ্রোহ জানালো,কষে একটা চড় দিলো তামিমের গালে।পুরো অফিসের নিস্তব্ধতা যেনো খানখান করে ভেঙে পড়লো।
হিসহিসিয়ে নবনী বললো, “এটা আমার কর্মক্ষেত্র,এখানে আমি যেমন কাজ করতে এসেছি, আপনি ও কাজ করতে এসেছেন।আমার ব্যক্তিগত লাইফ নিয়ে কথা বলার রাইট আমি আপনাকে দিই নি।তাই নেক্সট টাইম সতর্কতা অবলম্বন করে কথা বলবেন।”
চড় খেয়ে তামিমের মাথা ঘুরে গেলো যেনো।
এই সেই নবনী!
নরম,কোমল,ভীতু!
সাত চড়ে যার রা ছিলো না,এই সেই নবনী!
শত আঘাতে ও যে উহ শব্দটা উচ্চারণ করতো না,এই কি সেই নবনী?
এতো তেজ এর কোথা থেকে এলো?
এই অগ্নিমূর্তি তো তামিম আগে দেখে নি।
তামিম আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ৬ বছরের চাকরি জীবনে এই প্রথম এরকম হলো তামিমের সাথে।
ধীর পায়ে তামিম অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।
মেঘ অফিসে এসে দেখে নবনী চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। ইন্টারকমে মেঘ নবনীকে কেবিনে যেতে বললো।
নবনী কেবিনে গিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। মেঘ ভীষণ মনোযোগ দিয়ে নবনীকে দেখতে লাগলো। তারপর বললো, “কি হয়েছে?”
নবনী মাথা নিচু করে রাখলো।মেঘের কোমল স্বর কঠোর হয়ে গেলো। আবারও জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে নবনী, সত্যি করে বলো।”
নবনী মাথা নিচু করে বললো, “তামিম সাহেব আমার সাথে অভদ্রতা করেছেন,এজন্য আমি ওনাকে একটা থাপ্পড় মেরেছি। ”
মেঘ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,”ওকে আমি…. ”
নবনী আর কিছু বলতে দিলো না,মেঘকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “উনি আমার সাথে মিসবিহেভ করেছেন,তার জন্য আমি প্রতিবাদ করেছি।আমি আশা করছি আপনি এটা নিয়ে একটা কথাও বলবেন না,এটা কে পার্সোনালি নিবেন না।এই টপিক এখানেই সমাপ্ত।আপনি যদি এটা কেন্দ্র করে কোনো একশান নেন,তবে আমি কষ্ট পাবো ”
মেঘ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো।তারপর বললো, “তুমি কষ্ট পাবে এমন কাজ আমার জান থাকতে কখনো করবোনা আমি।”
নবনী বের হয়ে গেলো মেঘের কেবিন থেকে।মেঘ চেয়ারে বসে আপনমনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “কোথায় ভেবেছি আজকে ফার্স্ট দেখাতে একটু ভালো করে দুজনে কথা বলবো,তা না উল্টো তৃতীয় ব্যক্তির জন্য এরকম একটা সুন্দর সময় নষ্ট হয়ে গেলো।শুধু তুমি কষ্ট পাবে বলেছ বলে এই মেঘ থেমে গেছে,নয়তো কুত্তার মতো মার খেতো ওই তামিম আমার হাতে।”
লাঞ্চের সময় নিতু জানতে পারলো তামিমকে নবনী থাপ্পড় দিয়েছে। কথাটা শুনে নিতু চমকালো ভীষণভাবে।মনের ভেতর যেই সন্দেহ দানা বেঁধেছে, এই কথা শুনে তা যেনো আজ চারাগাছে রূপ নিয়েছে।অশান্ত মনকে শান্ত করতে অফিস থেকে ফিরে নিতু সোজা বাবার বাসায় গেলো।
নিতুর বাবা রিটায়ার্ড বরকত হোসেন একটা চেয়ারে বসে মেয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন।তার ছোট্ট মেয়ে নিতু,পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটাকে আজ কেমন বিবর্ণ লাগছে।ফ্যাকাসে মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে সারা শরীরে বুঝি এক ফোঁটা রক্তবিন্দু ও নেই।
নিতু বাবার পায়ের কাছে বসে রইলো খানিকটা সময়। নিতুর মা রেবেকা টেবিলে খাবার দিতে দিতে বললেন,”তোর কি কোনো সমস্যা চলছে নিতু?তোকে এরকম লাগছে কেনো?”
নিতু মলিন হেসে জবাব দিলো, “কতোদিন তোমাদের দেখি না মা,তাই চলে আসলাম।তোমাদের জন্য মন কেমন করছে।”
রেবেকা বেগম গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,”তা হলে তো আর ভাবনার কিছু নেই।তবে নিতু শোন,একটা কথা মাথায় রাখিস,বিয়ের আগের জীবন আর বিয়ের পরের জীবন দুটো আলাদা। বিয়ের আগে যেসব স্বভাব ছিলো সেসবে পরিবর্তন আনার চেষ্টা কর।সবসময় প্রতিবাদী মনোভাব থাকা ভালো নয়।তুই আমার মেয়ে তো,আমি তো জানি তোকে।অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিবাদ করিস নিজের বাবার মতো। রিতুর মতো ধৈর্যশালিনী হতে চেষ্টা কর। সংসার জীবনে নানা আঘাত আসে মানুষের। সবকিছুতে উগ্রভাব দেখাস না।”
নিতু মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো।বরকত সাহেব রেগে বললেন,”তোমার মতো শিক্ষিত মানুষ যদি এভাবে অন্যায়কে সাপোর্ট করে যায় তাহলে এই সমাজ তো রসাতলে যাবে।না না,আমার মেয়েকে আমি যেই আদর্শ দিয়ে গড়ে তুলেছি,তা থেকে আমার মেয়ে এক চুল ও নড়বে না।নিতু মা আমার,আমি জানি না তোর কি হয়েছে। তবে যাই হোক,মনে রাখিস তোর বাবা তোর সাথে আছে।তোর উপর বাবার সম্পূর্ণ ভরসা আছে।তুই কখনো ভুল করবি না।নিজের মনকে শান্ত কর মা।তোকে ভীষণ অস্থির লাগছে।”
রেবেকা বেগম টেবিলের উপর শব্দ করে প্লেট বাটি রাখতে লাগলেন।নিতু বুঝতে পারলো মা রেগে গেছেন।বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিতু বাসায় চলে এলো।
আজ বহুদিন পর সামিম বাসায় এসেছে। আগামীকাল লুবনাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে,তাহেরা বেগম কল করে কাঁদাকাটি শুরু করায় আসতে বাধ্য হলো ।এবার অবশ্য চেনাজানা থেকে সম্বন্ধ এসেছে।দিশার চাচাতো ভাইয়ের জন্য সম্বন্ধ এসেছে।শুনেই তো তাহেরা বেগম আনন্দে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছেন যেনো।
এতো বড় ঘরের বউ হবে তার মেয়ে!কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
সামিম নানাভাবে মা’কে বুঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তাহেরা বেগম এসব শুনতে ও চাচ্ছেন না।তিনি শুধু এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন যে শহরে ছেলের বাবার দুটো ৬ তলা বাড়ি আছে,ছেলেরা দুই ভাই মাত্র।
ছেলের আগে দুটো বিয়ে হয়েছে এই ব্যাপারটা ও যেনো দুটো ৬ তলা বাড়ির সামনে তুচ্ছ হয়ে গেলো। সামিম দিশার চাচাতো ভাই রাকিবের সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়েছে। এই ছেলেটা একেবারে বাজে চরিত্রের। বহু নারীতে আসক্ত,নেশায় আসক্ত।৩ বার রিহ্যাবে ও ছিলো। কিন্তু ওকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা যায় নি।
সামিম যতোবার মা’কে এসব বলতে যায় তাহেরা বেগম ততবারই এড়িয়ে গিয়ে বলেন,”ঘরে একটা বউ গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।এই বয়সে সব ছেলেদের এরকম একটু আধটু দোষ থাকে।আর বড়লোকের ছেলেমেয়েরা একটু এরকমই হয়।এতে অসুবিধা নেই।”
সামিম অধৈর্য হয়ে গেলো মায়ের এসব শুনে।চিৎকার করে বললো, “তোমার এই লোভের জন্য আমাদের সব ভাইবোনের জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মা।আমরা কেউই সুখী না।বড় ভাইয়ের আগে আমাকে বিয়ে করিয়েছ শুধুমাত্র নিজের লোভের বশে।দিশার বাবা ধনী বলে। অথচ কখনো দিশার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন তা জানতে চাও নি।স্বামী স্ত্রী হয়েও আমরা দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। দিশা আজ এই পার্টি,কাল ওই পার্টি করে দিন কাটায়।তুমি সোনামুখ করে তা মেনে নাও,কেনো?
শুধু দিশার বাবার টাকা আছে,বড় ঘরের মেয়ে দিশা এই জন্য। আমি এটাই ভেবে পাচ্ছি না,দিশার বাবার টাকাপয়সা থাকলে তোমার আমার কি লাভ হবে?
আমাদেরকে কি ওখানে থেকে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে দিবে?
না-কি ওসব আমাদের কোনো কাজে আসবে?
এই সহজ কথাটা তোমার মাথায় ঢোকে না মা।তোমার এই কাজের জন্য আমার বাবা আমার উপর অভিমান করে ছিলেন।বাবার কাছে আমি ক্ষমা চাইতে পারি নি। ”
তাহেরা বেগম রেগে গিয়ে বললেন,”খবরদার, আমার সামনে চিৎকার করে কথা বলবি না।আমার মেয়ের ভালো আমি তোর চাইতে ভালো বুঝি।গায়ে পড়ে উপদেশ দেয়ার চেষ্টা করবি না।মেয়েকে বড় ঘুবিয়ে দিবো তা তোর সহ্য হচ্ছে না?”
সামিম পরাজিত সৈনিকের মতো সোফায় হেলান দিয়ে বসে পড়লো।পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ছেলেটা ও চায় তার বোনের একটা ভালো জায়গায় বিয়ে হোক,বোন সুকজে থাকুক।
নিতু ফিরে দেখে সামিম বসে আছে। কেউ না বলে দিলেও নিতু বুঝতে পারলো, এ তামিমের ছোট ভাই সামিম।দুই ভাইয়ের চেহারায় অনেকটা মিল রয়েছে। নিতু এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো সামিমকে।সামিম হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি কে?”
নিতু হেসে বললো, “আমি নিতু।”
সামিম কিছুটা বিরক্ত হলো নিতুর নাম শুনে।এই সেই মেয়ে যার জন্য তামিম নবনীকে ছেড়ে দিয়েছে!
এই মেয়েটাই নবনীর সংসার ভেঙ্গে দিয়েছে মনে হতেই সামিমের ভ্রু কুঁচকে গেলো।
নিতু হেসে বললো, “আপনি মনে হয় আমাকে এখানে এক্সপেক্ট করেন নি,অথবা আমাকে দেখে বিরক্ত হচ্ছেন।খাবার খেয়েছেন কি?চা কফি কিছু খাবেন?
কিছু খেতে হলে আমাকে ডাকবেন।আমি করে দিবো।”
সামিম কোনো কথা বললো না।নিতু নিজের রুমে চলে গেলো। তাহেরা বেগম নিতুর রুমে গিয়ে আদেশের সুরে বললো, “কাল অফিসে যাবে না,১১ টার দিকে বাসায় গেস্ট আসবে লুবনাকে দেখতে।ওদের জন্য সব রকম খাবারের ব্যবস্থা করবে সকালে উঠেই।ভাত,পোলাও, চিকেন,বিফ,মাটন,ফিস,স্নেক্স সব কিছু চাই আমার। ”
নিতু হাই তুলতে তুলতে বললো, “আমি রোবট নই,আপনার মেয়েকে দেখতে আসবে তার ব্যবস্থা আপনি করবেন।বড় ভাইয়ের বউ হিসেবে আমি থাকতে পারি উপস্থিত, কিন্তু তাকে অন্যভাবে নেওয়ার সাহস করবেন না।আমি বাসার কাজের মহিলা নই।বড়জোর আপনাকে একটু হেল্প করতে পারি গেস্টদের খাবার সার্ভ করতে।আপনার বাড়ির ছোট বউ যদি সারাদিন অন্য ছেলেদের সাথে সময় কাটিয়ে, সংসারে মনোযোগ না দিয়ে, গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরতে পারে তাহলে আমি ও তা পারি।আমি তবু তা করি না কেননা আমি এই শিক্ষা পাই নি আমার পরিবার থেকে।তাই বলে আবার আমার ভদ্রতাকে আমার দুর্বলতা ভাববেন না।আমার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন না।”
তাহেরা বেগম চাপা ক্রোধ নিয়ে নিতুর রুমে থেকে বের হয়ে গেলো। বসার রমে বসে সামিম সবটা শুনতে পেলো। এবং শুনেই এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে সামিমের মন ভরে গেলো। সামিমের একটুও খারাপ লাগলো না তার মায়ের সাথে বড় ভাইয়ের বউ এরকম ব্যবহার করায়।বরং আনন্দিত হলো এই ভেবে যে এতো দিনে একজন উপযুক্ত জবাব দিয়েছে।
তবে আফসোস হলো নবনীর জন্য,নবনী যদি এভাবে সাহস করে রুখে দাঁড়াত তবে হয়তো এভাবে সংসারে ভাঙ্গন দেখা দিতো না,এতো তাড়াতাড়ি বাবাকে হারাতো না সামিম।
বাবার সাথে যে এখনো অনেক কথা বলা বাকি ছিলো সামিমের।আর কি এই জনমে বাবাকে তা বলা হবে?
আজীবনের জন্য এতিম উপাধি দিয়ে বাবা হারিয়ে গেলো এক বুক অভিমান নিয়ে।সামিম তো পারলো না বাবার সেই অভিমান ভাঙ্গাতে,সেই চেষ্টা করবার আগেই যে বাবা ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো।
তাহেরা বেগম নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।সামিম সোফাতেই শুয়ে পড়লো। লুবনা নিজের রুমে রূপচর্চা করছে।দিশা মেসেঞ্জারে ব্যস্ত। এতোদিন পর স্বামী বাসায় এসেছে অথচ তাতে দিশার কোনো মাথাব্যথা নেই।
ফ্লোরে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো নিতু। বারবার নিতুর মনে হতে লাগলো এই নবনী -ই সেই মেয়ে যার সাথে তামিমের বাবা তামিমের বিয়ে দিতে চেয়েছিলো।
বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে নিতু,ঘড়ির কাঁটা ১ টার ঘরে পৌঁছে গেছে অথচ তামিম এখনো বাসায় আসে নি।নিতুর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বাহিরে তাকে যতোই শক্ত মনে হয়, ভেতর থেকে যে সে ততই ভঙ্গুর তা কি কেউ জানে!
ভালোবাসার কি অপরিসীম শক্তি!একজন কঠোর হৃদয়ের মানুষের মনকেও ভেঙে চুরমার করে দেয় অনায়াসে।
নবনী মেঘের সাথে কথা বলতে গিয়ে বারবার লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হয়ে যাচ্ছে। কিছুই বলতে পারছে না নবনী। অবশ্য মেঘ নবনীকে কথা বলার সুযোগ ও দিচ্ছে না।নিজেই সব বলে যাচ্ছে। যেনো কতো বছর ধরে মেঘ কারো সাথে কথা বলতে পারে নি,তাই জমানো সব কথা প্রকাশ করছে নবনীর কাছে।
অথচ ব্যাপারটা হলো,মেঘ নবনীকে ফ্রি হবার টাইম দিচ্ছে।শুরুতেই যদি নবনীকে বারবার কথা বলো না কেনো এসব বলে তবে নবনী বিব্রত হবে বারবার। এর চাইতে ভালো নবনী আগে ফ্রি হয়ে নিক,তারপর নিজ থেকেই কথা বলবে। এরকম হু হা করবে না।
অবশ্য এই হু হা শুনতেও মেঘের ভীষণ ভালো লাগছে।
ভালোবাসার মানুষের সবকিছুই কি সবার এতো ভালো লাগে!
এতো মধুর মনে হয়! ভালোবাসা ব্যাপারটা এতো বেশি মধুর কেনো!
চলবে…….
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (২৭)
তাহেরা বেগমের রাতে ঘুম ভালো হয় নি।বারবার ঘুম ভেঙে গেছে।ঘুমে ধরেছে ভোররাতের দিকে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে তার সকাল ১০:২৫ বেজে গেলো।
এতো দেরিতে ঘুম ভাঙ্গায় তাহেরা বেগম আঁতকে উঠলেন।
এতো বড় পরিবার থেকে আজ সম্বন্ধ আসছে,তাদের সামনে সেই অনুপাতে তো খাবার দিতে হবে।অথচ তিনি তো এখনো বিছানায়।নিজের উপর নিজের রাগ হলো খুব।তাড়াতাড়ি করে উঠে বের হয়ে দেখেন খাবারের ঘ্রাণ আসছে রান্নাঘর থেকে।
পা টিপে টিপে তাহেরা বেগম রান্নাঘরের দিকে গেলেন।গিয়ে দেখেন নিতু চুলায় পিঠা বানাচ্ছে ।টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অনেকগুলো খাবারের ডিশ দেখা যাচ্ছে। হৃষ্টচিত্তে তাহেরা বেগম এসে দেখতে লাগলেন কি কি করা হয়েছে।
দেখে তিনি ভীষণ চমৎকৃত হলেন।ইতোমধ্যে বিফ রেজালা,চিকেন রোস্ট, কোরমা,মাটন,ইলিশ ভাজা,ডিমের কোরমা,চিংড়ি দিয়ে করলা ভাজি,দুই রকম ভর্তা,ফ্রাইড রাইস,চিলি চিকেন,চাইনিজ ভেজিটেবল, চিংড়ির মালাইকারি,দুধ পুলি,দুধ চিতই,পায়েস বানিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
এতো আইটেম দেখে তাহেরা বেগমের চমক লেগে গেলো। তিনি নিজেও এতো আয়োজন করতেন না নিশ্চিত। মনে মনে ভীষণ ভালো লাগলো তার।
তবুও কিচেনে ঢুকে বললেন,”এসব আদিখ্যেতা দেখাতে কে বলছে তোমাকে?আমার মেয়ে যখন, আমার তো ঠেকা পড়েছে।আমার কাজ আমি নিজেই করতাম।তোমার এতো দয়া দেখিয়ে কাজ করতে হবে না আমার মেয়ের জন্য। কে জানে কোন খাবারে কি মিশিয়ে রেখেছ!”
নিতুর সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। সারা মুখ লাল হয়ে গেছে সেই রাত থেকে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে করতে। তাহেরা বেগমের কথা শোনার পর নিতু বললো, “এই যে এখানে পাটিসাপটা পিঠা বানানোর ডো করা আছে,ক্ষীর করা আছে।ক্ষীর দিয়ে বাকি পিঠা আপনি বানিয়ে নিন।আমি এখনো পোলাও করি নি,তাও করে নিন আপনি। বাকি আপনার যা ভালো লাগে তা করুন”
তাহেরা বেগমকে সেখানে রেখেই নিতু রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলো। রুমে এসে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো নিতু।সারা শরীর ভীষণভাবে কাঁপছে। তামিম রাতে বাসায় ফিরে নি।নিতু সারারাত তাই জেগে ছিলো তামিমের অপেক্ষায়। জেগে থাকতে থাকতে নিতুর মনে হলো অযথা বসে থেকে কি লাভ,এর চাইতে কাজ করা শুরু করি,তাহলে সময় কেটে যাবে।সকালেও আমাকেই করতে হবে এসব।আগেই করে রাখি বরং।
এই ভেবেই নিতু রাত থেকে রান্না করা শুরু করে দিলো।
শরীরের সকল ক্লান্তি, যন্ত্রণা চাপিয়ে একটা চিন্তায় মাথায় উঁকি দিতে লাগলো, “তামিম বাসায় ফেরে নি রাতে।”
নিতু নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। সারারাত নিজেকে অনেকভাবে কন্ট্রোল করে রেখেছে। তামিমকে কল দেয় নি তাই।কিন্তু এখন যেনো আর পারছে না।বেহায়া মনটা উদগ্রীব হয়ে উঠেছে তামিমকে কল দিতে।
বাহিরে রোদ উঠেছে, কেমন তেজহীন।
নিতুর মনে হলো তার সাথে সাথে আজ সূর্যের ও বুঝি মন খারাপ। শীত আসি আসি করছে,শেষ রাতের দিকে কিছুটা ঠান্ডা পড়ে। সেই ঠান্ডায় নিতু তামিমকে ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরে। আজ ভীষণ মনে পড়ছে এসব।
নিতু জানালা খুলে দিয়ে তামিমকে কল দিলো।
রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন তুলছে না কেউ।নিতু আবারও কল দিলো। ফোনটা এবার সুইচ অফ।
বুক ছিরে একটা হতাশার নিশ্বাস বের হয়ে এলো। ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষের সাথে ঘর বাঁধার পরেও যদি সেই ঘরে সুখ না থাকে তবে সেখানে মিথ্যে সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর মানে কি?
আত্মসম্মানী নিতু অথচ আজ মনে প্রাণে চায় একবার তামিম তাকে আগের মতো ভালোবাসুক,নিতু নিজের জান ও দিতে পারে তামিমের জন্য।
কিন্তু তা কিছুতেই হচ্ছে না আর।গত এক সপ্তাহ ধরে তামিমের মন ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।নিতুর সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে তামিম।
নিতু সব সয়ে যাচ্ছে।ভালোবাসা কি এরকমই?
ভীষণ প্রতিবাদী মনোভাবাপন্ন একটা মেয়েকে কি ভীষণ বেহায়া,নির্লজ্জ করে দিচ্ছে!
নিতুর তাতে মোটেও আফসোস নেই।তবুও চায় তামিমের মন ঠিক হয়ে যাক।
বিয়ের আগে তামিম যেমন ছিলো তেমন হয়ে যাক তামিম এখন আবার। এজন্যই বুঝি মানুষ বলে,”যাকে ভালোবাসো তাকে বিয়ে করো না।ভালোবাসার মানুষের দেওয়া অবহেলা সহ্য করা যায় না।অন্যের দেওয়া আঘাতের ক্ষত সহজেই মুছে যায় কিন্তু প্রিয় মানুষের দেওয়া আঘাতের ক্ষত মুছে গেলেও স্মৃতিতে তা তাজা হয়ে থাকে আজীবন। ”
মেহমান আসলো সাড়ে এগারোটার দিকে।দিশা গিয়ে বসার রুমে আড্ডায় মেতে গেছে।তাহেরা বেগম মেহমান রেখে আসতে পারছেন না।নিতু একা একা সব গরম করা,ওনাদের সামনে সার্ভ করা কুলাতে পারছে না।
শেষে বাধ্য হয়ে দিশাকে কঠিন গলায় বললো, “দিশা,এদিকে উঠে আসো।ওনাদের নাশতার ব্যবস্থা করতে হবে তো।বসে বসে কি কথা বললেই ওনাদের সমাদর করা হবে?মা মুরুব্বি মানুষ আছেন,উনি কথা বলুক।এদিকের কাজে সাহায্য করো তুমি।”
দিশার মাথায় রক্ত উঠে গেলো নিতুর কথা শুনে।দিশা কিছু বলার আগে সামিম বললো, “বে-আক্কেলের মতো কথা বলতে বসে গেছো মেহমানের নাশতার ব্যবস্থা না করে! তোমরা রিলেটিভ, তোমার উচিত ছিলো এই ব্যাপার সচেতন থাকা।ভাবী একা সব করছে তুমি বসে রয়েছ কেনো এখানে?যাও ভাবীর কাছে।”
দিশা নিজের বাবার বাড়ির মানুষের সামনে সিনক্রিয়েট করতে পারলো না। এখন সে কিছু করলে সব বাবা মায়ের কানে উঠবে।দিশার বাবা ভাইয়েরা এসব পছন্দ করেন না।জানতে পারলে ভীষণ অপমানিত হবে দিশা।নিজের রাগ সামলে উঠে গেলো নিতুকে সাহায্য করতে।
নাশতার পর লুবনাকে নেওয়া হলো পাত্রের সামনে। নিতু ভালো করে পাত্রের দিকে তাকালো। কেমন বিশ্রীভাবে লোকটা লুবনাকে দেখছে।নিতুর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। লোকটার দিকে তাকালেই কেমন চরিত্রহীন মনে হয়। চোখ দিয়ে লুবনার মাথা থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত পরখ করে ফেলেছে সে।এরপর নিতুর দিকে তাকালো। নিতু চমকে ভেতরের দিকে চলে গেলো। মনের ভেতর সতর্ক সংকেত বেজে উঠেছে নিতুর।এখানে লুবনাকে কিছুতেই বিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
আর একবার ও নিতু ওদের সামনে গেলো না।মেহমান বিদায় নিলো তিনটের দিকে।যাবার সময় বলে গেলো, পাত্রী তাদের পছন্দ হয়েছে। আগামী শুক্রবার তারা এনগেজমেন্ট করতে চায়।
সবাই যাওয়ার পর নিতু লুবনার দিকে তাকালো। লুবনাকে ভীষণ আনন্দিত লাগছে।ছেলে লুবনার হাতে ৫ হাজার টাকা দিয়েছে। লুবনা দিশাকে ফিসফিস করে বললো, “তোমার ভাই ভীষণ রোমান্টিক ভাবী,আমার হাতে টাকা দেয়ার সময় কেমন করে আমার হাতটা ধরেছিলো,আমার ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে কেমন! ”
বলেই লজ্জা পেলো লুবনা।নিতু শুনে হতাশ হলো। লুবনাকে নিতু জিজ্ঞেস করলো, “তুমি রাজি বিয়েতে?”
লুবনা বিরক্ত হয়ে বললো, “রাজি না হবার কি আছে।এরকম ধনী ছেলে কি সবসময় এসে বসে থাকবে আমার জন্য? ”
নিতু আর কিছু না বলে সামিমের কাছে গেলো। কোনো ভণিতা ছাড়া বললো, “এই বিয়েটা কি বন্ধ করা যায় না?”
সামিম হেসে বললো, “লাভ হবে না।মা’কে আমি হাজার বার বুঝিয়েছি।মা কিছুতেই শুনবে না।আমি লুবনাকেও বলেছি,সেও স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে।দিশা এদের সবার ব্রেইন ওয়াশ করে দিয়েছে। কোনো কথা এদের মাথায় ঢুকছে না। ”
নিতু ভীষণ কষ্ট পেলো এসব শুনে।কিন্তু লুবনার রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে শুনে তাহেরা বেগম আর তার মেয়ের কতো প্ল্যানিং শুরু হয়ে গেছে এখনই।
নিতু নিজের রুমে চলে গেলো। তামিমের ফোন এখনো বন্ধ।নিতুর হঠাৎ করেই এই পৃথিবী কেমন অসহ্য লাগতে লাগলো। এতো বড় পৃথিবীতে তার একান্ত আপন বলে কেউ নেই!
————–
সকালে কলিং বেলের শব্দে নবনীর ঘুম ভাঙলো। দরজা খুলে দেখে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে একটা সাদা টি-শার্ট, একটা নীল জিন্স।অথচ কি ভীষণ ফ্রেশ লাগছে তাকে!মেঘের মুখখানা এতো আদুরে মনে হচ্ছে কেনো আজ হঠাৎ করে!
নবনীর ইচ্ছে হলো মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখতে।কিন্তু তা সম্ভব হলো না।
হাশেম আলী রুম থেকে বের হয়ে বললেন,”মাস্টার আসছে নবনী?ভিতরে আইতে দে,কাইল আসলো না।আমি তো চিন্তায় পইরা গেছি।একলা একটা মানুষ, কোন অসুখ টসুখ হইছে কি-না কে জানে।স্যার,আপনের মেসের ঠিকানা একটু দিয়া যাইয়েন।আপনের কোনো অসুবিধা হইলে যাতে দেখতে যাইতে পারি।”
নবনী ঠোঁট কামড়ে হাসলো মেঘের দিকে তাকিয়ে,এবার জব্দ হবে মেঘ। অথচ মেঘ যেনো আগে থেকেই জানতো এরকম কিছু হবে।একটা কাগজ বের করে হাশেম আলীকে দিয়ে বললো, “এই নেন চাচা,এটাই আমার ঠিকানা। ”
নবনী হতভম্ব হয়ে গেলো দেখে।মেঘ নবনীর দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে বললো, “একটু পানি দিবেন প্লিজ।”
তারপর ফাল্গুনীদের রুমে গিয়ে বললো, “আমার স্টুডেন্টরা কই,পড়তে বসে যাও সবাই।”
ফাল্গুনী আর চৈতালীর সাথে মেঘের ভীষণ ভাব হয়ে গেছে। দুজনে গাল ফুলিয়ে রইলো। চৈতালী বললো,”ভাইয়া,তুমি গতকাল আসো নি কেনো?আমরা তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।জানো গতকাল আপা আমাদের পড়িয়েছে। তোমার নামে অনেক বাজে কথা বলেছে আপা।”
ফাল্গুনী গলার স্বর নিচু করে বললো, “ভাইয়া,আমি বলি বাকিটা। আপা বলেছে,তুমি নাকি আমাদের ঘোড়ার আন্ডা পড়াও।পড়াতে পারো না মোটেও।অযথা সময় নষ্ট করো।আমরা দুজন তাই গতকাল থেকে আপার সাথে কথা বলি না।”
মেঘ তাকিয়ে দেখে নবনী এসে দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। ফাল্গুনীর চুলের ঝুটি ধরে বললো, “এই তাহলে আসল ঘটনা তাই না,এজন্য আমার সাথে কথা বলা হয় নি। তোদের স্যারের সামনে বলছি এবার,তোদের স্যার একটা গণ্ডমূর্খ, কিছুই পারে না। ”
মেঘ মুচকি হাসলো নবনীর কথা শুনে। তারপর নিজের ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বললো, “তোমরা বলো তো,খালি কলসি বাজে বেশি,এর ইংরেজি কি হবে?”
দু’জনে সমস্বরে চিৎকার করে এর ইংরেজি বললো।নবনী টেবিলের উপর ধপ করে গ্লাসটা রেখে দিয়ে চলে গেলো। দুই বোন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো। তাদের প্রিয় স্যারকে নিয়ে বাজে কথা বলার উচিত জবাব পেয়েছে।
মেঘ পকেট থেকে তিনটা ডেইরি মিল্ক চকলেট বের করে দুজনকে দিয়ে বললো, “এটা তোমাদের আপার জন্য।আমি চলে গেলে দিবে তোমরা। এবার পড়তে বসো।”
নবনী রুমে বসে একটা বই পড়ছে।মেঘের টেক্সট এলো তখন।নবনী পড়ে দেখে মেঘ লিখেছে, “ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। ”
নবনী রিপ্লে দিলো,”পানি রেখে এসেছি,খেয়ে নিলেই হয়।”
মেঘ আবার মেসেজ দিলো,”এ তৃষ্ণা যে কাউকে দেখার তৃষ্ণা, আকণ্ঠ জলপান করলেও কি এই তৃষ্ণা মিটবে?”
নবনীর কেমন লজ্জা লাগলো এটা পড়ে, সারা শরীর যেনো অবশ হয়ে গেলো,নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করতে লাগলো। লজ্জায় নবনী আর বের হতে পারলো না। এই মানুষটা এতো ঠোঁটকাটা কেনো?
হুট করে কি কথা থেকে কি কথায় চলে যায়!
সে কি বুঝে না এসব শুনলে নবনীর কেমন ঘোর ঘোর লাগে,নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়!
মেঘ যাওয়ার সময় জোর গলায় বললো, “চাচী,ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে আমার,নবনী ম্যাডামের কাছে একটু লেবুর শরবত চাইলাম,দিলেন না তো উনি।বেশি ব্যস্ত মনে হয় উনি।আচ্ছা থাকুক,আমি বাহিরে কোথাও ভ্যান থেকে খেয়ে নিবো। ”
রাবেয়া বেগম রান্না চড়িয়েছেন,মেঘের কথা শুনে তিনি ভীষণ লজ্জা পেলেন।ছুটে এসে বললেন,” না না বাবা,দাঁড়াও।শরবতটা খেয়ে যাও বাবা।”
ফাল্গুনী আর চৈতালী এসে বললো, “স্যার তো সেই কখন,সকালে এসেই শরবত চেয়েছে, আপা দিলোই না মা।”
রাবেয়া বেগম মেয়ের ব্যবহারে ভীষণ লজ্জিত হলেন।নবনীর রুমে গিয়ে দেখেন নবনী আপনমনে হাসছে।মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,”মাস্টারে তোর কাছে সেই কখন এক গ্লাস শরবত চাইছে,তুই দিলি না ক্যান?এক্ষন তুই শরবত বানাইয়া দিবি নবনী।আমার হাতের মাইর খাবি নইলে।মাস্টার মানুষের সাথে এরকম বেয়াদবি আমি সইয্য করমু না।ওনারা সম্মানী মানু।সম্মান দিতে শিখ।”
নবনী হতভম্ব হয়ে বললো, “উনি কখন শরবত চাইলো আবার? মিথ্যা কথা মা।”
রাবেয়া বেগম রেগে বললেন,”হ, উনি এতো বড় মানুষ এক গ্লাস শরবতের জন্য মিথ্যা কথা কইবো?উনি মনে হয় জীবনে শরবত চোখে দেখে নাই,এই দুনিয়ায় তুই একমাত্র শরবতওয়ালি হইছস,তোর হাতের শরবত খাওয়ার জন্য এখন উনি মিথ্যা কথা কইতাছে।আমার দুই মাইয়া ও তো মিথ্যুক, ওরা ও কইছে তোর কাছে ওগো স্যার শরবত চাইছে তুই দেস নাই।একটা এতিম পোলা,এতিমের প্রতি তোর দেখি কোনো মায়াদয়া নাই।এতো বড় চাকরি আল্লাহ দেখবো না,অন্তরের মায়াদয়াই আল্লাহ দেখবো। ”
নবনী মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”মা,তুমি এরকম রিয়েক্ট করছ কেনো,সামান্য একটা ব্যাপার এটা।”
রাবেয়া বেগম রেগে বললেন, “তুই কি শরবত বানাইতে যাবি না-কি আমি রান্নাঘরের হাতা আইনা তোরে মারমু?”
নবনী কথা না বাড়িয়ে ছুটে গেলো রান্নাঘরের দিকে। তারপর শরবত বানিয়ে মেঘের সামনে নিয়ে গেলো। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করছে,নবনীর মনে হলো সবাই যেনো সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
মেঘ নিচু স্বরে বললো, “এতোক্ষণে তৃষ্ণা মিটেছে আমার বিবিজানকে দেখে ”
তারপর জোরে বললো,”চিনির কৌটায় মনে হয় লবণ রেখেছেন চাচী,উনি তো চিনির বদলে লবণ দিয়ে রেখেছেন। উহু,এতো লবণাক্ত শরবত! তবুও খেয়ে নিচ্ছি,আমার কপালে তো বাসার বানানো খাবার জোটে না।বাহিরের খাবার সুস্বাদু হলেও বাসার খাবার স্বাস্থ্যকর। তা যতোই লবণাক্ত হোক।”
তারপর বিদায় নিয়ে মেঘ চলে গেলো। রাবেয়া বেগম মেয়ের দিকে এমনভাবে তাকালেন,নবনীর মনে হলো সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলে বুঝি ভস্ম হয়ে যাবে।নিজের রুমে গিয়ে নবনী দরজা লাগিয়ে দিলো তাড়াতাড়ি।
মনে মনে মেঘের গুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেললো।ঠিক করলো আজ অফিসে গিয়ে মেঘের সাথে একচোট ঝগড়া করে নিবে।
চলবে….
রাজিয়া রহমান