#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (২৪)
গত এক সপ্তাহ ধরে মেঘ নিয়মিত নবনীদের বাসায় আসা যাওয়া করে।ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।প্রথম দিন সকালে বাসার কলিং বেল বাজতেই নবনী গিয়ে দরজা খুলে দিলো। মেঘকে দেখতেই নবনীর হার্টবিট এতোটা বেড়ে গেলো যে নবনীর মনে হলো বুকের পিঞ্জিরা থেকে হার্ট বুঝি এখনই টুপ করে বের হয়ে যাবে।
গায়ে একটা নরমাল টি-শার্ট,একটা গ্রে কালার প্যান্ট পরা মেঘকে দেখে কিছুতেই বুঝার উপায় নেই এই ছেলে কোনো অফিসের বস।
নবনী ভাবলো চোখে ভুল দেখছে সে।তাই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে যেতেই মেঘ এক পা ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। নবনী দরজা বন্ধ করতে যেতেই মেঘ মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। নবনী ভীষণ চমকে গেলো।
মেঘ মুচকি হেসে সালাম দিয়ে বললো, “আমি ফাল্গুনী আর চৈতালীর টিউটর।”
নবনী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। হাশেম আলী রুম থেকে বের হয়ে মেঘকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “এই স্যারে আইজ থাইকা ফাল্গুনী আর চৈতালীরে পড়াইবো রে মা।”
নবনী চোখ মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো, “কে ঠিক করেছে বাবা?”
হাশেম আলী হেসে বললো, “আর কইস না মা,তোরে তো কাইল কইতে পারি নাই।কাইল আমি ওগো ইস্কুলে গেছি না,তখন ওগো স্কুলের স্যারেরা ওনারে ঠিক কইরা দিছে।”
নবনী জিজ্ঞেস করলো, “কেনো ঠিক করে দিছে ওনাকে?”
হাশেম আলী বললো,”ও এক সময় ওই ইস্কুলে পড়ছে।পোলাডার অবস্থা আমাগো মতোই আছিলো।ফ্রি-তে ইস্কুলের স্যারেরা পড়াইছে।এখন নিজে চাকরি করে। বাপ মা নাই।নিজেই ইস্কুলে আইসা স্যারগো কইছে সে ও কাউরে সাহায্য করবার চায়।স্যারেরা আমাগো ফাল্গুনী চৈতালীর লাইগা ঠিক করছে ওরে।গতকাল আমারে যাইতে কইছে ইস্কুলে। আমি গেছি আর স্যারেরা কইলো এই স্যারে আমার দুই মাইয়ারে ফ্রি পড়াইবো।দেখলাম এরকম আরো কয়েক জন আছে স্কুলে,পোলা মাইয়াগো ফ্রিতে পড়ানোর লাইগা।মানুষের মন কতো বিশাল তা কাইল ইস্কুলে না গেলে বুঝতাম না রে মা।কতো পোলারে দেখলাম কাইল ফ্রিতে পড়ানোর লাইগা আইসা বইসা রইছে। ভালো মানুষ এখনো আছে এই দুনিয়ায়। ”
নবনী ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেঘের দিকে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো,কেউ বুঝলো না।
নবনী নিজের রুমে গিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। মাথা তার এলোমেলো লাগছে।নীড়ের জন্মদিনের পর থেকে নবনী মেঘের দিকে ভুল করে ও তাকায় না।সিম কার্ড চেঞ্জ করে ফেলেছে। লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে বসে থাকে।মেঘের দিকে তাকালেই নবনীর ভীষণ কষ্ট হয়,বুকের ভেতর কেঁপে উঠে,দ্বিধায় পড়ে যায়।আজকাল নবনী নিজের মনকে বুঝতে পারে না। নীড়ের জন্মদিন ছিলো ৪ মাস আগে,এই ৪ মাস ধরে নবনী নিজের সাথে নিজে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এখন আর তামিমকে দেখলে মোটেও জ্বালাপোড়া অনুভব হয় না।বরং নিতুর সাথে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। এখন জীবনে একটাই সমস্যা, মেঘ।
মেঘের কাছ থেকে নবনী তাই লুকিয়ে বেড়াতে চায়।বারবার মনে হয়, সরাসরি তাকালেই বুঝি মেঘ বুঝে যাবে নবনীর বুকের ভেতর জমে থাকা একটা কষ্টের পাহাড় মেঘের কাছাকাছি থাকলে গলে যেতে চায়।বুকের ভেতর বসন্তের বাতাস বইতে চায়।প্রাণপণ চেষ্টা করে নবনী সেই বাতাস কে থামিয়ে দেয়।ধরা দিতে চায় না কিছুতেই নবনী।
হাশেম আলী নবনীর রুমের সামনে এসে দরজা নক করলেন।নবনী উঠে বসে বাবাকে ভেতরে আসতে বললো।
হাশেম আলী মেয়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “ছেলেটার জন্য একটু নাশতার ব্যবস্থা করতি যদি।”
নবনী বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”কি দরকার ছিলো বাবা টিউটর রাখার?আমি অথবা সাব্বির কি ওদের পড়াতে পারতাম না?না-কি আমরা পড়াই না?”
হাশেম আলী বললেন,”কি বলস মা,ইস্কুলের এতো বড় বড় মানুষের সামনে আমি কি কমু যে না আমি রাজি না।সব বাপ মায়েরা দেখলাম হাসিমুখে রাজি হই গেছে। আমি সেখানে কেমনে না করি?আমি মুর্খ মানুষ কি এতো বড় মানুষের লগে কথা কইতে পারি?”
নবনী আর কথা না বাড়িয়ে কিচেন রুমে চলে গেলো। হাশেম আলী বুঝতে পারলেন মেয়ে কোনো কারণে রেগে আছে। মেয়ের পিছনে পিছনে গিয়ে হাশেম আলী বললেন,”রাগ করছস মা?রাগ করিস না।শুন মা,আমার আসলে খুব খারাপ লাগছে যখন শুনছি পোলাডার বাপ মা নাই,বাপ মা মরা পোলাডার লাইগা আমার এতো মায়া লাগছে।মেসে থাকে,আত্মীয় স্বজন নাই।যাওনের জায়গা নাই।শুইনা আমার কলিজা কাঁইপা উঠছে।
এতিম পোলাডার মুখের দিকে তাকাইয়া আমার যে কেমন লাগছে। আমি ও তো এতিম ছিলাম রে মা।মা মরছে আমারে ছোট রাইখা।”
নবনী বাবার সাথে তর্ক করলো না। বাবার মন খারাপ হয়ে যাবে নবনী কথা বাড়ালে।
নবনী মেঘের জন্য এক মগ কফি আর এক প্লেট পাস্তা নিয়ে ফাল্গুনীদের রুমে গেলো।
হাশেম আলী সেখানেই বিছানার এক পাশে বসে ছিলো। মেঘ নবনীর হাতের রান্না বুঝতে পেরে গোগ্রাসে খেয়ে নিলো। হাশেম আলী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেঘের দিকে। নবনীর পিছুপিছু এসে বললেন,”দেখলি মা,পোলাডা মনে হয় গতরাতে ও কিছু খায় নাই।ভীষণ ক্ষিধা ছিলো পেটে মনে হয়। শুন মা,এখন থাইকা প্রত্যেক দিন পোলাডারে নাশতা দিস,মাঝেমাঝে ভালো কিছু রান্না হইলে তোর মায়েরে কমু পোলাডারে ভাত খাওয়াইতে।”
নবনী বিরক্ত হয়ে বললো,”তোমার যেমনে ভালো লাগে করো বাবা।”
হাশেম আলী মেয়ের রাগ বুঝতে পেরে বললেন,”রাগ কইরা আছস এখনো? আমাগো নবীজি ও তো এতিম ছিলো। নবীজি কইছে এতিমরে মায়া করতে।”
নবনীর ইচ্ছে করলো চিৎকার করে বলে দিতে সব কিছু,কিন্তু বলতে পারলো না বাবার ইমোশন দেখে।
নবনী নিজের রুমে গিয়ে বসে রইলো। রাবেয়া বেগম রান্নার জন্য তরকারি কাটছেন।হাশেম আলী রাবেয়ার পাশে বসে বললো,”মেয়েটা এরকম রাগ কইরা আছে ক্যান কও তো?”
রাবেয়া বেগম কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছেন মেয়ের মন খারাপ। কিছু নিয়ে মেয়ে চিন্তায় আছে তিনি বুঝতে পারছেন, আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করছেন না নিজে।মেয়ে বড় হয়েছে এখন,ভালো মন্দ বুঝে।নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করে মেয়েকে বিব্রত করতে তার লজ্জা লাগছে।আবার মেয়ে কোনো সমস্যায় আছে কি-না তাও বুঝতে পারছেন না।
হাশেম আলী স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো, “কি হইলো তোমার? ”
রাবেয়া বেগম বললেন,”মেয়েটার মনে হয় মন খারাপ কোনো কারণে। আপনে আর ওর লগে কথা বাড়াইয়েন না।মেয়েটার মন ভালো হইলে দেখবেন সব ঠিক হইয়া যাইবো।”
হাশেম আলী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,”কি কও তুমি, আগে কও নাই ক্যান?আমি এখন কি করমু?
মেয়ের মনে কষ্ট দিলাম বুঝি আমি?”
রাবেয়া বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,”আরে না,আপনি কষ্ট দিলেন কখন। ওর মন আগে থেকেই খারাপ। আপনি ওরে কিছু জিজ্ঞেস কইরেন না।নিজের মন ভালো হইলে নিজেই কইবো কোনো অসুবিধা হইলে।”
এক সপ্তাহ পরে শুক্রবার। মেঘ আজ জুমার নামাজ পড়ে পড়াতে এসেছে।বাসায় আসতেই রাবেয়া বেগম বললেন, ” বাবা আজকে আমাগো লগে কয়েকটা ডাইল ভাত যদি খাইতেন খুশি হইতাম।”
মেঘ বিগলিত হয়ে বললো,”কি বলেন চাচী,আমার জন্য এতো কষ্ট করবেন না।আমি মেসেই খেয়ে নিবো।”
রাবেয়া বেগম বিনীত হয়ে বললেন, “আপনার চাচা আপনার লাইগা নিজ হাতে বাজার কইরা আনছে।আমারে কইছে আইজ বাবাজিরে লইয়া একসাথে খানা খামু,তুমি সব রান্দো ভালো কইরা।”
মেঘ হেসে বললো, “চাচা যেহেতু বলেছে তাহলে তো নিশ্চয় খাবো চাচী।তাছাড়া আজকে মেসে দেখলাম ব্রয়লার মুরগী রান্না হয়েছে।মেসের খাবারের কথা আর কি বলবো চাচী,এক বাটি ঝোলের মধ্যে দুই পিস আলু আর এক পিস মাংস হাবুডুবু খায়।বেঁচে থাকার জন্য খেতে হয় শুধু। বাবা মা না থাকলে কপালে এরকম কষ্টই হয়।”
রাবেয়া বেগমের চোখে পানি চলে এলো মেঘের কথা শুনে। আঁচলে চোখ মুছে নবনীর রুমে এসে বললেন,”আহারে ছেলেটার কতো কষ্ট রে মা।দুনিয়ায় আল্লাহ মানুষের এতো কষ্ট দিলো ক্যান!
বাপ ও নাই মা ও নাই,কে রাখে তার খাওনের খবর!
কি খায় না খায়,কে জানে!”
নবনীর ইচ্ছে করলো চিৎকার করে বলতে,”তুমি জানো না মা ওনাদের খাবার জন্য কতো মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে,ওনাদের খাবার আসে ৫ তারা হোটেল থেকে।আমাদের এসব খাবার ওনাদের সইবে না।”
বললো না কিছু,সিদ্ধান্ত নিলো আজকে একটা বিহিত করবে সে।আজকে সরাসরি মেঘকে জিজ্ঞেস করবে এসব নাটক কেনো করছে সে!নিজের সাথে নিজে এভাবে আর যুদ্ধ করতে পারছে না।যেকোন একটা সিদ্ধান্ত এবার নেওয়া উচিত।
রাবেয়া বেগম রান্না করতে গেলে নবনী বললো, “মা তরকারিতে ঝাল কম দিও।”
রাবেয়া বেগম অবাক হলেন মেয়ের কথা শুনে।তাদের বাসায় সবাই ঝাল খেয়ে অভ্যস্ত। বরং ঝাল কম দিলেই কেউ খেতে চায় না।
মেয়েকে সে কথা জিজ্ঞেস করতেই নবনী বললো,”আজ ঝাল কম দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে মা।পেটে গন্ডগোল।”
খেতে বসে মেঘ চমৎকৃত হলো।ছোট মাছের চচ্চড়ি,ধনেপাতা দিয়ে পাতলা ডাল,চমৎকার একটা ঘ্রাণ আসছে ডাল থেকে।চিকন চিকন করে তেলের উপর করা আলুভাজা,ইলিশ মাছ ভাজা,বেগুন ভাজা।
ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে মেঘ খাবার খেলো।যদিও প্রথমে ভয় পেয়েছিলো খাবারে ঝাল নিয়ে।মেঘ ঝাল খেতে পারে না।
কিন্তু খেতে বসে দেখলো সব খাবারে তার মন মতো ঝাল হয়েছে। নবনী ছাড়া বাকি সবাই একইসাথে বসে খাবার খেলো।নবনী পেটে সমস্যা বলে খেতে এলো না।
খেয়ে মেঘ বিদায় হবার আগে নবনী বের হলো ঔষধ আনতে যাবে বলে। মেঘ বাহিরে এসে দাঁড়াতেই নবনী এগিয়ে গেলো মেঘের দিকে। মেঘের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার এসব নাটকের মানে কি?”
মেঘ নিজের দিকে তাকিয়ে বললো,”নাটক কোথায় দেখলে?আমি তো নাটক করি না।”
নবনী বিরক্ত হলো প্রচন্ড। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো, “আপনি এরকম বেহায়াপনা কেনো করছেন?নিজের স্ট্যাটাস,নিজের অফিস সব ফেলে রেখে এরকম এতিম সেজে আমার বাসায় আসার মানে কী?”
মেঘ বললো,”আমার একটাই অপরাধ নবনী, আমি তোমাকে ভালোবাসি,ঠিক ততটাই ভালোবাসি যতোটা ভালোবাসলে আমার মতো একটা ছেলে নিজের সব ছেড়ে তোমাকে একটু সময় বেশি দেখার আশায় তোমার বাসা পর্যন্ত চলে আসতে পারে।”
নবনী ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেঘের দিকে। মেঘ মুচকি হেসে আবার বললো,”আমি মাঝেমাঝে আফসোস করি,কেনো আমি বখাটে হতে পারলাম না।তাহলে অন্তত সাহস করে তোমার হাতটা আমার বুকে চেপে ধরে বলতাম,দেখো তোমার নামে বারবার আন্দোলিত হয় আমার এই হৃৎপিন্ড।আমার ব্যাড লাক নবনীতা, আমি এসব পারি না।আমি তাই তোমাকে দেখার জন্য মিথ্যা বাহানা দিতে পারি।
তুমি আমার ভয়ে সিম কার্ড চেঞ্জ করে ফেলেছ,তুমি লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে থাকো,অফিস টাইমে রোবটের মতো নিচের দিকে তাকিয়ে থাকো।সিসি ক্যামেরায় আমি দেখি,আমার নবনীতা আমার থেকে ১০-১২ ফিট দূরে বসে আছে মাথা নুইয়ে,শুধু আমি যাতে তাকে না দেখি এর জন্য।ক্যামেরায় দেখে আমার মন ভরে না নবনীতা,আমার আজন্ম পিপাসা তোমাকে দেখার।তাই তো শুধু কিছু সময় বেশি দেখার জন্য এতো প্ল্যানিং আমার। আমাকে তুমি মিথ্যাবাদী বলতে পারো,অপরাধী বলতে পারো,আমি হাসিমুখে মেনে নিবো।ইস্পাত কঠিন মানবীকে ভালোবাসার মতো অপরাধ যখন করে ফেলেছি তার শাস্তি পাবো না তা কি হয় না-কি। ”
নবনী অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল গোপন করে বললো,”আমার সাথে আসুন,আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
মেঘ মিষ্টি হেসে বললো, “তা আগে বললেই পারতে যে আমার সাথে আলাদা করে কথা বলবে।এভাবে রাগ করে বলার কি আছে নবনীতা। আগে জানলে তো আমি একটু সেজেগুজে আসতাম।”
নবনী চোখ গোল করে তাকাতেই মেঘ হেসে বললো, “আসো আমার সাথে। ”
একটা রিকশা ডেকে নিয়ে মেঘ নবনীকে রিকশায় উঠতে বললো। তারপর নবনী বসার পর নিজে উঠে বসলো। নবনী অস্বস্তিতে নুইয়ে গেলো। মেঘের ভীষণ ভালো লাগছে। এই প্রথম দুজন এতো কাছাকাছি বসেছে।
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামলো। নবনী বললো, “আমি রেস্টুরেন্টে বসবো না।আমি একটা খোলামেলা জায়গায় বসতে চাই।”
মেঘ যথা আজ্ঞা বলে রিকশায় উঠে বনানী লেকে যেতে বললো।
১০ মিনিট পর লেকের পাশে এসে রিকশা থেকে নামলো দুজনে।মেঘ কিছুটা সামনে এসে বললো, “সাঁতার জানো?”
নবনী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।মেঘ বললো,”নৌকায় উঠবে?”
নবনী মাথা নাড়িয়ে না বললো।কিছুটা হেটে দুজন বসলো রাস্তার পাশে।তারপর মেঘ নরম স্বরে বললো, “কি বলবে? ”
নবনী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “একটা গল্প বলবো। নবনীর গল্প।”
মেঘ মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা আজকে না হয় আমি গল্প বলি,তুমি শোনো,ভুল হলে আমাকে সংশোধন করে দিও।”
নবনী উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকালো। মেঘ কি গল্প বলবে কে জানে!
মেঘ গম্ভীরমুখে বললো, “এক গ্রামে ছিলো এক দম্পতি। তাদের চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছোট সুখের সংসার।তাদের সংসার শুধু সংসার নয়,সুখের রাজ্য যেনো।বড় রাজকন্যার নাম নবনী জাহান।ছোট ফুটফুটে সেই রাজকন্যা বাবা মায়ের সংসারে বাকি তিন ভাই বোন নিয়ে হেসেখেলে দিন কাটাচ্ছিলো।অনার্সে ওঠার পর তার বিয়ে হয়ে যায় এক অচেনা রাজ্যের রাজকুমারের সাথে।হুট করেই বিয়ে হয়ে যায়। কেননা নবনীকে তার শ্বশুর কলেজ থেকে ফিরার সময় পথে দেখে এতো বেশি পছন্দ করে ফেলেন যে তিনি আর দেরি করতে রাজি হন নি।আসলে ভদ্রলোকের জহরির চোখ,খাঁটি হিরে চিনতে তিনি ভুল করেন নি।ফুলবাগানে ফুটে থাকা উৎকৃষ্ট গোলাপটিকে তাই অতি যত্নে,ভালোবাসায় নিজের রাজ্যের শোভাবর্ধন করতে রাজকন্যার বাবার কাছে এক প্রকার ভিক্ষা করে নিয়ে যায়।
কিন্তু ভদ্রলোক জানতেন না তার বাসায় তিনি আর তার ছোট পুত্র ছাড়া বাকি সবাই যে রাক্ষসরূপী মানুষ। রাজকন্যা নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে ও শ্বশুর ছাড়া আর কারো আপন হতে পারে নি।
এদিকে রাজকন্যার স্বামী,সে নিজের বাগানের গোলাপের দিকে না তাকিয়ে অন্য বাগানের গোলাপ থেকে মধু আহরণ করতে উঠে পড়ে লেগে গেলো। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো যে তার স্বভাব তা সে ছাড়া আর কেউ জানতো না।এজন্যই নিজে বাগানের ফুলটি তার কাছে বিবর্ণ লাগতে লাগলো।
তারপর একটা সময় আসে যখন রাজকন্যা জেনে যায় সে আসলে নিজের সব দিয়েও রাজকুমারকে আপন করতে পারে নি। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাজকন্যা তখনই সিদ্ধান্ত নিলো সব অবহেলা সহ্য করে নিলেও এই অবহেলা সে সইবে না।তারপর তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
রাজকন্যা তারপর থেকে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য এক অদম্য মনোবল নিয়ে শহরে আসে পুরো পরিবার নিয়ে।সেই শহরে আসে যেখানে সে তার একটা সুখের স্বপ্ন দাফন করে শূন্য হাতে ফিরে গিয়েছিলো,যেখানে সে শূন্য হয়েছে সেখানেই সে আবার পূর্ণ হতে আসে।
রাজকন্যা পূর্ণতা পেতে লাগলো,আত্মবিশ্বাসী রাজকন্যার ভালোবাসায় পড়ে শূন্য হতে লাগলো সেই শহরের এক কাঙাল প্রেমিক। ভালোবাসা ছাড়া যার চাওয়ার কিছু নেই।কাঙালের মতো নিজের আত্মসম্মান ত্যাগ করে রাজকন্যার পদে পদে ঘুরতে লাগলো। কে জানে,হয়তো একদিন রাজকন্যার মনে দয়া হবে।পৃথিবীতে কতো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, এরকম করে এটা ঘটে যায় যদি এই আশায় বাঁচে সে কাঙাল। ”
নবনী হতবিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে কে বলেছে এসব?কিভাবে জানলেন?আমি তো এসব শিমলা আপাকে ও বলি নি কখনো। ”
মেঘ মুচকি হাসলো।
চলব………
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (২৫)
নবনী নিজের কৌতূহল কিছুতেই নিবৃত করতে পারছে না।মেঘকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কিভাবে মেঘ এসব জেনেছে।
মেঘ নবনীর এরকম উৎসাহ দেখে চুপ করে রইলো।নবনীর কথা শুনতে মেঘের কাছে ভীষণ ভালো লাগছে।বারবার জিজ্ঞেস করে বিরক্ত হয়ে নবনী উঠতে যাচ্ছিলো সেই মুহুর্তে সাহস করে মেঘ নবনীর হাতটা টেনে ধরে বসিয়ে দিল।
নবনীর মনে হলো ২২০ ভোল্টের শক লেগেছে তার।মেঘ চোখ বন্ধ করে লম্বা করে শ্বাস নিলো। নবনীর হাত ছাড়লো না,নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রাখলো। যেনো ছেড়ে দিলেই নবনী হারিয়ে যাবে তার কাছ থেকে।তারপর বললো, “নবনীতা,আমি তোমাকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই তোমার পিছন পিছন এসে তোমার বাসা দেখে গেছি।তারপর থেকে আমার একটা রুটিন হয়ে গেলো তোমার বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকার।তোমার বাসার উল্টো দিকের রাস্তার সব ভিক্ষুকেরাও আমাকে চিনে নবনীতা। তোমার জন্য এতো পাগল হলাম আর এটুকু জানবো না?
আমি প্রথমে তোমাদের বিল্ডিংয়ের দারোয়ানের থেকে শুনেছি। আমার বিশ্বাস হয় নি।ওভাবে পাত্তা দিই নি। তারপর আবারও ওই দারোয়ান আমাকে সব বলে। সেদিন আমি সিদ্ধান্ত নিই তোমাকে আর কষ্ট পেতে দিবো না।
কিন্তু একদিন তামিম সাহেব নিজেই আমাকে সব বললেন। আমাকে সবসময় এখানে দেখে ওনার মনে হয় সন্দেহ হয়।একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করতেই আমি বলে দিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি,তাই এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি।আমার ভালো লাগে দাঁড়িয়ে থাকতে।শুনে আমাকে নিয়ে চায়ের দোকানে বসলেন।চা খেতে খেতে সব বললেন,দারোয়ান আমাকে তামিম সাহেবের নাম বলে নি।তামিম সাহেবের থেকে জানলাম আমি উনি ছিলেন তোমার প্রাক্তন স্বামী। তবে সেদিন এটাও বুঝলাম তখন ওনার মনের এক কোণে এখনো তোমার জন্য দুর্বলতা রয়ে গেছে।
আমার তখন মনে হয়েছে যতো দ্রুত সম্ভব তোমাকে আমার করে নিতে হবে।আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার মনের সব কষ্ট দূর করে দিবো।আমি যে তোমার বাসায় এভাবে আসি এটা কিন্তু আমার প্ল্যান ছিলো না। আমার বাবার প্ল্যান জানো।
বাবাকে আমি বাসায় গিয়ে সব জানালাম।বাবা শুনে আমাকে বুদ্ধি দিলেন তোমার সাথে বেশি বেশি কথা বলার চেষ্টা করতে,তোমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতে।এতে করে না-কি তুমি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাবে সহজেই।
বাবা তো জানে না তোমার মন লোহায় গড়া।আমি সারাদিন তোমার বাসায় শুয়ে থাকলেও তুমি আমার দিকে করুণা করে হলেও তাকাবে না।তবুও আমি বাবার বুদ্ধি কাজে লাগালাম।কেননা, বাবা আমার সব ব্যাপারে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে। ”
নবনীর মনে হলো সে যেনো এখনো শকের উপর আছে!
নবনী হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার বাবা চিনেন আমাকে? ”
মেঘ বললো,”সে তো আমি বাবাকে বলেই দিয়েছি তুমি অফিসে জয়েন হবার পর।আর তার ১ সপ্তাহ পর বাবাকে দেখিয়ে দিয়েছি তোমাকে।”
নবনী আর বলার মতো কথা খুঁজে পেলো না। মেঘ নবনীর হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললো, “নবনীতা, আমি বেশি কিছু চাই না।তোমার এই হাতটা আজীবন এভাবে ধরে রাখার সুযোগটুকু তুমি আমাকে দাও শুধু।আমি কথা দিচ্ছি,মরন পর্যন্ত তোমার হাত আমি ধরে রাখবো। একটা সুযোগ দাও নবনীতা। অতীত আঁকড়ে ধরে রেখে কি লাভ বলো?
নিজে কি সুখ পেয়েছ এতে করে?
পাও নি তো,বরং কষ্ট বেড়েছে আরো।এর চাইতে ভালো জীবনকে আরেকটা সুযোগ তুমি দাও।আমি আমার ভালোবাসার চাদরে তোমাকে মুড়িয়ে রাখবো নবনীতা।”
নবনী নিজেকে আর মানাতে পারলো না। এতো দিন ধরে নিজের কাছ থেকে নিজে অনেক লুকিয়ে বেড়িয়েছে,মনকে নানাভাবে শাসিয়ে এসেছে।আজ যেনো নিজের মন ও নবনীর সাথে বিদ্রোহ শুরু করে দিলো।নবনী মেঘের দিকে তাকালো জলভরা নয়নে।
টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মেঘ অপলক তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে। তারপর বললো, “ভালোবাসি নবনীতা ”
নবনী মাথা নিচু করে ফেললো। এর জবাবে কি বলবে সে?
মেঘ উঠে বললো,”চলো,কোথাও বসি,তোমার দুপুরের খাবার খাওয়া হয় নি।”
নবনী মাথা নিচু করে বললো, “না বাসায় গিয়ে খাবো।”
মেঘ জোর করলো না আর।রিকশায় করে নবনীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলো।
আসার সময় বললো,”তোমার সাথে যে আমার সারাক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করে নবনীতা। ”
নবনী হেসে নিজের ফোন থেকে মেঘের ফোনে একটা কল দিলো। তারপর আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে পালিয়ে এলো। লজ্জায়, উত্তেজনায় নবনীর বুক ধুকপুক করতে লাগলো।
কেমন একটা অচেনা অনুভূতি!
বাসায় ফিরে নবনী মা’কে বললো খাবার দিতে।হাত মুখ ধুয়ে নবনী খেতে বসলো। খাবার খেতে বসে নবনী ভালো মতো খেতে পারলো না। গলায় বারবার খাবার আটকে যাচ্ছে। নবনীর মনে হলো পুরো দুনিয়া যেনো কাঁপছে। কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে ওর।
নবনী খাবার না শেষ করেই উঠে গেলো। রাবেয়া বেগম মেয়ের অস্থিরতা দেখে জিজ্ঞেস করলেন,”কি হইছে নবনী?”
নবনী চমকে গেলো মা’য়ের প্রশ্ন শুনে।আমতাআমতা করতে লাগলো।
রাবেয়া বেগম অবাক হলেন।এতো বিচলিত লাগছে কেনো নবনীকে!
নবনী চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো আবার। তারপর বললো, “মা আমাকে একটু লেবুর শরবত বানিয়ে দাও।আমার কেমন যেনো লাগছে।”
রাবেয়া বেগম মেয়ের জন্য শরবত বানাতে গেলেন।নবনী বারবার নিজের ফোনের দিকে তাকাচ্ছে।
মেঘের কল এলো রাত ১০ টার পর।নবনী তখন ফাল্গুনীর পড়া দেখছে।কল আসতেই নবনী চমকে উঠলো। তারপর তাড়াহুড়ো করে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। কল রিসিভ করবে কি করবে না এই ভাবতে ভাবতে নবনীর গলা শুকিয়ে গেলো। হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো।
টিন এজে প্রথম প্রেমে পড়লে মানুষের যেমন অবস্থা হয়,নবনীর তাই হয়েছে। নবনীর বুকের ভেতর কেমন একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করছে।মেঘ আবারও কল দিলো। কাঁপতে কাঁপতে নবনী কল রিসিভ করে হ্যালো বললো।হ্যালো বলতে গিয়ে নবনী টের পেলো কেমন আটকে যাচ্ছে তার কথা।
মেঘ হেসে ফেললো নবনীর এরকম জড়তা দেখে।
————–
সকালে মেঘের ঘুম ভাঙলো দেরিতে। ঘড়িতে সকাল সাড়ে দশটা।গতরাতে নবনীর সাথে কথা বলতে বলতে কখন যেনো রাত ২ টা বেজে গেছে টের পায় নি দুজনে।
মিষ্টি মধুর একটা অনুভূতি নিয়ে মেঘের দিন শুরু হলো। নিজেকে কেমন হালকা লাগছে আজ মেঘের।
নাশতা না করে মেঘ ছুটলো অফিসের জন্য। মাসুমা বেগম সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু দেখছেন।মেঘকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে দেখে মাসুমা বেগম মেঘকে থামালেন।তারপর উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এতো কিসের তাড়া তোর?টয়লেটে চাপ দিয়েছে না-কি প্রবল বেগে?ওয়াশরুম তো তোর রুমেই আছে,বাহিরে ছুটছিস কেনো তাহলে এরকম ফাইভ জি স্পিডে?”
মেঘ থেমে গিয়ে বললো, “অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে মা।যেতে হবে।তাছাড়া ওর সাথে দেখা করা লাগবে খুব দ্রুত।”
মাসুমা বেগম সরু চোখে বললেন,”বাপের স্বভাব তো পুরোপুরি পাইছস,অফিস শেখাতে আসছে আমাকে।বস এখানে,আমার জুয়েলারি পছন্দ করে দে আগে।আগামী মঙ্গলবার কি পরবো তার একটা ব্যাপার আছে না?”
মেঘ অবাক হয়ে বললো, “মঙ্গলবার কি?”
মাসুমা বেগম হতভম্ব হলেন ছেলের প্রশ্ন শুনে।তারপর বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠে স্বামীকে কল দিলেন।শফিক আহমেদ ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছিলেন।স্ত্রীর কল পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিসিভ করলেন কল।
শফিক আহমেদকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মাসুমা বেগম কেঁদে উঠে বললেন,”আমি তো চলে যাচ্ছি। এই দুনিয়ায় আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই আমার।তুমি কোথায়,শেষবারের মতো তোমার একটা ছবি পাঠাও তো।যাবার সময় তোমার মুখটা দেখে আমি মরতে চাই।কার জন্য নিজের জীবনের সব শখ আহ্লাদ ত্যাগ করলাম।আমার ছেলে কি-না আমাকে জিজ্ঞেস করে মঙ্গলবারে কি?এই ছেলের জন্য কি-না আমি পিএইচডি করার জন্য দেশের বাহিরে যাই নি,এর একা থাকতে হবে বলে। সেই ছেলে আজ মায়ের কথা ভুলে গেছে।কোন লম্বা হাতওয়ালা শাকচুন্নির সাথে কথা বলে আমাকে তাগাদা দেখাচ্ছে তার সাথে দেখা করতে যাবে আমার সাথে কথা বলার সময় না-কি তার নেই।”
শফিক আহমেদ নিজেও ভেবে পেলেন না,তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আশ্চর্য, ঘটনা কি বলবে তো তুমি আগে।আর মঙ্গলবার কি সেটা তো আমি নিজেও জানি না।”
মাসুমা বেগম এবার বিলাপ করলেন আরো জোরে। ফোন কেটে দিয়ে পরনের শাড়ি দিয়ে নিজের নাক মুছলেন।শফিক আহমেদ বুঝতে পারলেন একটা ঝামেলা হয়েছে, ড্রাইভার কে গাড়ি ঘুরাতে বললেন আবার।
শফিক আহমেদ বাসায় এসে দেখলেন মেঘ সোফায় স্থানু হয়ে বসে আছে। মাসুমা বেগম লাগেজ গোছাতে গোছাতে শিমলাকে কল দিয়ে বললেন,”শিমলা রে মা,মামীকে ক্ষমা করে দিস তুই।মামী তো চলে যাচ্ছি। আজকেই এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো। এই স্বামী, সন্তান,সংসার কেউই আমার না।এজন্যই তো বলি,আমার স্বামী এভাবে বদলে যাচ্ছে কেনো,সে যে এখনো তার প্রাক্তন প্রেমিকার কবে জ্বর হলো কবে সর্দি হলো সেই খবর রাখতেই ব্যস্ত। বউয়ের কথা মনে থাকবে কেনো তার এখন!তোর মামার প্রাক্তন প্রেমিকার কথা মনে আছে তো তোর,ওই যে চাইনিজদের মতো ছোট ছোট চোখ, ধলা চামড়ার সেই বিলাতী ছেমরি। যে তোর মামার সাথে বিদেশে থাকতে সিগারেট ভাগাভাগি করে খেতো।”
তারপর কল কেটে দিলেন।
মেঘ বিরক্ত হয়ে বললো, “মা,আমাকে যেতে হবে।তোমার হবু বউয়ের সাথে গতরাতে মাত্র কথা হলো,আজ যদি তার সাথে দেখা না করি তবে কেমন দেখায় বলো?তুমি তোমার কান্নাকাটি এখন স্টপ করে রাখো,আমি সন্ধ্যায় আসলে তারপর না হয় শুরু করে দিও।”
মাসুমা বেগমের কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো।সোফার হাতলে মাথা ঠেকিয়ে বললো,”এই ছেলে তো আমার না গো,কাল একটা মেয়ের সাথে কথা হতে না হতে আজকেই এই ছেলে মা’কে ভুলে গেলো?
ও আল্লাহ, ওই মেয়ে এই বাড়ির বউ হয়ে এলে তো এই ছেলে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে।এই বাড়িতে একটা গাছ কে ও মূল্য দেওয়া হয়,শুধু আমাকে ছাড়া।আমি আজকেই ল’ইয়ারের কাছে যাবো,এক রাতে একটা মেয়ের সাথে কথা বলে যে ছেলে এরকম একটা দিনের কথা ভুলে যেতে পারে তার সাথে আমার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিবো।ওই মেয়েকে আমি কিছুতেই ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবো না।
আমার ফোন কই,শিমলাকে আবারও কল দিতে হবে।”
এদিক ওদিক তাকিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললেন,”গাধার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো,আমার ফোন এনে দে।শিমলাকে কল দিতে হবে আমার।আমার এই দুরবস্থা শিমলা ছাড়া কেউ বুঝবে না।”
মেঘ টেবিলের উপর থেকে ফোন এনে দিয়ে বাবাকে বললো,”তোমার স্ত্রীকে তুমি সামলাও বাবা,আমি যাই তাড়াতাড়ি। ”
শফিক আহমেদ ছেলেকে যেতে বলে নিজে স্ত্রীর পাশে এসে বসলেন।শান্ত স্বরে বললেন, “কি হয়েছে তোমার? ”
মাসুমা বেগম নাক ঝেড়ে শিমলাকে কল দিয়ে বললেন,”আমি আর বেশিদিন নেই এই সংসারে।তোর ছেলের জন্য একটা খেলনা বাইক কিনেছি,ওটা তার হাতে পৌঁছে দিলেই আমার দায়িত্ব শেষ ।জল তো অনেক দূর গড়িয়েছে রে শিমলা।সব এখন আমার কাছে একেবারে মিনারেল ওয়াটারের মতো পরিস্কার।
আমার গাধা ছেলেটা একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে সব ভুলে গেছে।আর তোর মামা,সে তো তার পুরনো প্রেমিকার কথা ভাবতে ভাবতে সব ভুলে গেছে।”
শিমলা বললো, “ঘটনা কী মামী?”
মাসুমা বেগম চোখ মুছে বললেন,”প্রথম থেকে বলছি শোন,সকালে আমি বসে জুয়েলারি দেখছি।মেঘ অফিসের জন্য বের হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে। আমি ওকে বললাম কি,এদিকে আয় তো বাবা।আমাকে একটু জুয়েলারি পছন্দ করে দে।মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানে পরবো।তুই তো জানিস,মঙ্গলবার কি?”
শিমলা নিজেও জানে না মঙ্গলবার আসলে কী?রিস্ক নিয়ে বললো,”হ্যাঁ মামী,জানি তো আমি। ”
মাসুমা বেগম শুকনো চোখ আবারও মুছলো,তারপর বললেন, “দেখলি মা,তোর মনে আছে মঙ্গলবার আমাদের বিবাহবার্ষিকী, অথচ আমার নিজের পেটের পোলা,স্বামী কেউ মনে রাখে নি।”
শিমলা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।মাসুমা বেগম আবার বলতে লাগলেন,”আমার ছেলে কি-না আমাকে জিজ্ঞেস করে, মঙ্গলবার কি মা।তুই বল কেমন লাগে তখন?এরপর আমি মনের দুঃখে তোর মামাকে কল দিলাম ঘটনা জানাতে।তোর মামা কি বললো,শুনবি?
তোর মামা আমাকে জিজ্ঞেস করে, মঙ্গলবার কি?
তুই বল,এখন আমার কি করা উচিৎ।আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি,আজকেই আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাবো।তোর ভাই যেই নাগিনীর প্রেমে পড়েছে সেই নাগিনীকে নিয়ে সুখে থাকতে বলিস।তোর ভাই বিন বাজাবে আর নাগিনী তালে তালে নাচবে।আমার ভাগ্য খারাপ, আমি সেই নাচ দেখতে পারবো না শুধু।
আর তোর মামাকে কিছু বলার নেই।লোকটা তার প্রাক্তন প্রেমিকার শোকে দিন দিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।আমার রান্না তার মুখে রোচে না।আজকাল আমার রান্নার খুঁত ধরে, কবে ওই মহিলা নাকি তোর মামাকে পাঙ্গাশ মাছ ফ্রাই করে খাইয়েছে,সেই স্বাদ তোর মামার মুখে লেগে আছে আজও।তোর মামার নজর এখনো পাঙ্গাশ মাছে আটকে আছে।আমার রান্না খেলে নাকি তার পেট খারাপ হয়ে যায়। আমি তোর বাসায় আসছি মা।নীড় সোনার খেলনাটা ওকে দিয়ে ওর থেকে বিদায় নিয়ে সোজা চলে যাবো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। আপাতত ওরাই আমার আপনজন।
তোর মামা বিদেশ চলে গেলে তোরা কেউ আপত্তি করিস না।বেচারা এক জীবন বাপ্পারাজের গান শুনে এসেছে,শেষ বয়সে যদি ওই বিদেশিনীর দেখা পায় তবে মন্দ কি।তবে শুন,আমার একটা শাড়ি,গহনা যেনো ওই মহিলাকে না দিতে পারে। এই বাড়িটা আমার নামে।আমি এই বাড়ি কোনো সংগঠনকে দিয়ে যাবো।স শাড়ি,গহনার কথা স্ট্যাম্প পেপারে লিখে যাবো।তোর মামার সই নিবি তুই।সবকিছু তোকে দিয়ে গেলাম।আমার ছেলে যেনো তার পিরিতের পেত্নীর জন্য একটা সুতাও না নিতে পারে সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকবি।”
শিমলা একটা দম নিয়ে বললো,”মামী,সত্যি কথা আমি বলি।মামা,মেঘ মিলে প্ল্যান করেছিলো তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার।এজন্যই তো ওনারা তোমাকে বলে নি মঙ্গলবার কি? ”
মাসুমা বেগম চোখ ছোট করে স্বামীর দিকে তাকালেন।শফিক আহমেদ মনে মনে ইয়া নাফসি পড়তে লাগলো।
মাসুমা বেগম ফোন রেখে দিয়ে স্বামীর পাশে এসে বসলেন।তারপর মধুর সুরে বললেন,”তুমি আগে বলো নি কেনো তুমি যে জানতে আমাদের বিবাহবার্ষিকীর কথা?আমার ছেলেও যে জানতো,আগে বলো নি কেনো?আমি তো ভেবেছি আমার ছেলে একটা শাকচুন্নির প্রেমে পড়ে সব ভুলে গেছে। ”
শফিক আহমেদ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।তারপর কপট অভিমান দেখিয়ে বললেন,”ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দিবো তোমাকে,তোমার জন্য তো এখন তা আর হলো না।”
মাসুমা বেগম আহত মনে বললেন,”আহারে,আমি তো ভেবেছি তোমরা সবাই ভুলে গেছো।আচ্ছা,যা হবার হলো।এবার আসো,আমরা প্ল্যানিং করি অনুষ্ঠানের।আচ্ছা শুনো, তোমার অফিসের সবাইকে কিন্তু ইনভাইট করবে।”
শফিক আহমেদ ছেলেকে টেক্সট করে সারসংক্ষেপে জানিয়ে দিলেন সব।তারপর স্ত্রীর দিকে তাকালেন।একটু আগে হওয়া রণমুর্তি এখন কেমন শান্ত হয়ে তার পাশে বসে আছে। যেনো কিছুই হয় নি।শফিক আহমেদ স্ত্রীর এক হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে বললেন, “আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তুমি এমনই থেকো,বিশ্বাস করো,এই আধা পাগলী, মেজাজী,খামখেয়ালি মহিলাটিকে আমি প্রচন্ডরকম ভালোবাসি। ”
মাসুমা বেগম লজ্জা পেয়ে স্বামীর বাহুতে মুখ লুকালেন।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান