#তুমিই আমার পূর্নতা — [১]
#মুনিয়া_মিরাতুল_নিহা
বিয়ের প্রথম বিবাহ বার্ষিকিতে যে নিজের স্বামীর কাছ থেকে সতীন ঘরে আনার মতন সারপ্রাইজ পাবো ভাবিনি কখনো! আজকে আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ন হলো এবং এরই সঙ্গে আজকে আমাদের ছোট্ট সংসারে দু’জন থেকে তিনজন হবার আনন্দটুকু প্রকাশ করার কথা ছিলো আমার সাগরের কাছে। কিন্তু সেই আনন্দ যে কেবল আমার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে সেটা কখনো কল্পনাতেও আসেনি! যেদিন আমি অনুভব করি আমার ভেতর অন্য ছোট্ট একটা প্রানের অস্তিত্ব আছে সেদিনই ঠিক করি আর সপ্তাহ খানেক পর তো আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী সেই শুভ দিনেই সাগরকে আমাদের অনাগতো সন্তানের কথা বলবো। স্মৃতি হয়ে থাকবে সেই মুহুর্তটা আমাদের জীবনে। সাগরের জন্য সারপ্রাইজ রেখেছিলাম, কিন্তু কে জানতো ভাগ্যে রয়েছে সাগরই আমাকে আমার থেকে দ্বিগুন বড়ো সারপ্রাইজ একেবারে পরিপূর্ণ করে দিবে! যার কারনে আমাদের পথ চলা হয়তো এখানেই সমাপ্তি ঘটবে! আসলেই কি সমাপ্তি ঘটবে আমাদের পথ চলার? নাকি আমাকে আরো অন্য কোনো ঝ’ড়ের জন্য নিজেকে তৈরী করতে হবে?
-‘ এইভাবে স’ঙ সেজেছো কেনো এই ভর সন্ধ্যা বেলা? তুমি জানো না তোমাকে সাজলে কেমন দেখায়? কোথাও যাবে বুঝি? আচ্ছা সে যেখানে যাবার যেতে পারো তবে একটা কথা শুনে রাখো এ হচ্ছে কলি, ওকে আর আমাকে বর আর বধূর বেশে দেখে নিশ্চয়ই তোমার বুঝতে বাকি নেই যে ও আমার সদ্য বিয়ে করা বিবাহিতা স্ত্রী। ‘
সাগর কি সুন্দর করে বলে দিলো কলি ওর স্ত্রী! একবারো ভাবলো না দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিও বোধহয় তার স্ত্রীর পরিচয়েই তার সামনে আছে। সে কথা যদি ভাবতো হয়তো কলি আজকে সাগরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো না। অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলো দু নয়ন কিন্তু কথায় আছে না? “চোখ ভরে জল এলে, চোখেই তা ফেলো মুছে” ঠিক সেইরকম আমিও চোখের জল সামনে না আসতে দিয়ে ওদের সামনে থেকে সরে আসলাম। সাগরের গলার আওয়াজ শুনে আমার শশুড়, শাশুড়ী, দেবর, জা, ননদ সবাই নিচে নেমে এসেছে। সবার সামনে আমার দাঁড়িয়ে থাকতেও কেমন কুন্ঠা বোধ হচ্ছে! কিন্তু আপাততো পরিস্থিতিতে চুপ করে রইলাম। আমার শাশুড়ি মা তার নতুন বউমার কাছে গেলেন। আমার শশুড় মশাই বেশিরভাগ সময়ই নির্বাক থাকেন আমার শাশুড়ির সামনে।
-‘ খোকা, এই মেয়েটাকে তুই বিয়ে করেছিস? ‘
-‘ হ্যাঁ মা। একবার তো বললাম না-কি? ওকে দেখো একবার ভালো করে? কলি দেখতে কেমন সুন্দর? ওই প্রিয়ার থেকে আরো ভালো দেখতে। এবার দেখবে কলির সঙ্গে আমি ঠিক কতোটা সুখে থাকি বুঝেছো? তুমি ও তোমার প্রতিবেশীদের মুখের উপর জবাব দিতে পারবে তোমার পুত্রবধূ কোনো কালি মূর্তি নয়, তাদের ছেলের বউয়ের থেকে হাজার গুন সুন্দরী। ‘
কথাগুলো বেশ উৎফুল্ল মনে সাগর তার মা’কে বলছিলেন আর আমার শাশুড়ি মা-ও খুব মনোযোগ সহকারে ছেলের কথাগুলো শুনছেন, যেনো অতীব কাঙ্ক্ষিত কথাগুলো তিনি শুনতে পেয়েছে। হয়তো সেটাই চাইতেন তিনি।
সাগরের দিত্বীয় বিয়ে করার কারন আমার সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা কিংবা আমার কোনো শারীরিক অসুখ এরকম কোনো কিছুই নয়! আমি দিব্যি সবদিক দিয়ে সুস্থ আছি। শুধু সমস্যা একটাই আমার গায়ের রং কালো! আমি তার দিত্বীয় স্ত্রী কলির মতন দেখতে সুন্দর নই। হ্যাঁ বিয়ের শুরুতেই আমি বুঝেছি সাগর এই বিয়েটাতে মত নেই, বিয়েতে বেশ মো’টা অংকের টাকা দিয়েছিলেন আমার বাবা মা আমার শাশুড়ি মাকে। অথচ সেই টাকাগুলো দিয়েছিলেন আমার বাবা, মা যাতে তাদের মেয়েটি সুখে থাকতে পারে। শশুড়বাড়ীতে এসে যে খুব একটা সুখে আছি এই কথাটা বেশ জোর দিয়ে যে বলবো তার উপায় নেই কারন বিয়ের পরদিন পাড়া প্রতিবেশীর নতুন বউ দেখতে এসে মুখ টি’পে হাঁসতে দেখেছি যে আমি। বলাবলি করছিলো রাজীবের মতন একটা সুর্দশন যুবকের জন্য আমার মতন একটা শ্যামলা রঙের মেয়েকে কি করে বউমা করে আনলেন? তখন আমি সবটা শুনেও যেনো কিছুই শুনিনি ।
বিয়ের এক সপ্তাহ সাগর আমার কাছে ছিলো তারপর ব্যাবসার কাজের জন্য ছয় মাস পর ফিরে আসে। অন্য জায়গায় যে ব্যাবসায় ছিলো? সেখানে লস হতে থাকে তাই বাধ্য হয়ে সাগর সেখানেই থেকে ব্যাবসা সামলাচ্ছিলো। মাসে দু একবার দেখা করে যেতো পরিবারের সঙ্গে। সাগর কখনোই আমার সঙ্গে কোনো রকম খারাপ ব্যাবহার করেনি বিয়ের এক সপ্তাহ পর্যন্ত। দরকার হলে কথা বলতো কিংবা চুপচাপ থাকতো। তবুও সাগর কখনো আমার সঙ্গে কোনো রুপ খারাপ ব্যাবহার অব্দি করেনি। যেই না অফিস থেক ফিরে আসলো প্রায় সাত মাস পর অমনি সাগর ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে লাগলো। আগে তো দরকার হলে কথা বলতো আমার সঙ্গে, আর মাঝে মধ্যে একটু আধটু গল্প করতো। কিন্তু ফিরে আসার পর থেকে দরকার হলে কিরকম করে কথা বলতো আমার সঙ্গে। তখন থেকে শুরু হয় সাগরের বদলে যাওয়া। অযথাই আমার উপর রে’গে থাকতো সবসময়। আমি কিছুতেই কিছু বুঝতাম না সাগর কেনো রেগে আছে আমার উপর! ওতো কখনো আমার গায়ের রং নিয়ে কোনো কথা বলেনি তাহলে এরকম কেনো করছে? এখন বুঝতে পারছি ততদিনে সাগর কলিতে মজেছিলো তাই আমাকে ভালো লাগেনি। তার পরেও ফিরে এসে বেশিদিন থাকেনি আবারো চলে গেছিলো ব্যবসায়ের কাজে অন্য জায়গায়। আর তখন থেকেই সাগরের পরিবর্তন ব্যাপক!
-‘ কলি তুমি ভেতরে যাও তো। ‘
-‘ শোনো প্রিয়তা, তুমি ওই নিচের রুমটায় থাকবে এখন থেকে বুঝেছো?’
আমি মা’থা দুলিয়ে হ্যাঁ নামক সম্মোধন করে সেই রুমে চলে আসলাম। সাগর নিশ্চয়ই এখন কলিকে নিয়ে তার নতুন জীবনে পা রাখবে আর আমি অন্ধকার জীবনের অতলে ডুব দিলাম!
—————————-
সকাল হতেই সবার পেটে পড়ে আমার বানানো চা। সেই মোতাবেকই রান্না ঘরে এসেছি চা বানাতে তারপর নাস্তা বানাবো। পাঁচটা বাজে সকালের আলো ফুটতে করেছে, রাত্রে ঘুম হয়নি সকালবেলা রান্না ঘরে চলে এসেছি তাড়াতাড়ি করে। কাজের মাঝে থাকলে যদি একটু ভালো লাগে। চা বানানো শেষ। কাপে ঢালার সময়ই দেখতে পেলাম আমার স্বামীর সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী কলি দাঁড়িয়ে আছে।
-‘ শুনেন চায়ের কাপগুলো আমি দিয়ে আসছি সবাইকে।’
আমার থেকে অনুমতি না নিয়ে কাপগুলো নিয়ে উপরে চলে গেলো কলি। বেশ বুঝতে পারছি হয়তো এখন সবাইকে গিয়ে বলবে চা সে বানিয়েছে। সবার কাছে ভালো বউমা সাজবে।
আমি সেদিকে মন না দিয়ে নাস্তা তৈরী করতে লাগলাম। আপাততো এসবই তো হবে এই সংসারে আমাকে সহ্য করে নিতে হবে।
-‘ নাস্তা আমি পরিবেশন করে দিচ্ছি আপনি যান আপনার রুমে।’
-‘ এগুলো তো আমিই করি আজকে তুমি?’
-‘ এখন থেকে আমার আমার একটু কম করবেন। ভূলে যাবেন না এখন আমিও আছি।’
সত্যিই তো বললো কলি, এখন তো সে-ও আছে। আমি প্রতুত্তর না করে নিজের রুমে চলে গেলাম। কথা বললেই কথা বাড়বে। আমার রুম থেক ডাইনিং টেবিলটা দিব্যিই স্পষ্ট বোঝা যায়। আমার ছোটো জা সেরকম কোনো কাজই করতো না সব কাজই বলতে গেলে আমিই করতাম। সবাই রান্না খেয়ে নতুন বউয়ের প্রসংশা করছে। ভাবছে রান্নাগুলো বোধহয় কলি বানিয়েছে! অথচ এই এতো বছরে আমার রান্নার সুখ্যাতি তারা করেইনি বলতে গেলে। আমি শুধু ভাবছি মেয়েটা প্রচণ্ড চালাক কি সুন্দর করে আমার বানানো চা, নাস্তা নিজের বলে চালিয়ে দিলো। সে দিক ওরকম মন মানসিকতা আমার নেই তাই চুপ করে রইলাম।
রুমে বসে বসে আনমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। খোলা আকাশের দিকে চেয়ে। দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই পিছন দিকে ফিরে তাকাতে সাগরের দেখা পেলাম। সে তো এখন অফিসে যাবে। সাগর প্রতিদিন অফিসে যাবার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যেতো। প্রায় এক বছর হয়ে গেছে আমাদের বিয়ের কখনো মুখ ফুটে বলেনি ভালোবাসি আমাকে কিন্তু আমি বুঝতাম হয়তো বলতে পারে না কিন্তু ভালো তো বাসে। কিন্তু ধারনা টা ভূল ভালোবাসলে এরকম হতো না। আজকেও এসেছে কিন্তু আজকের দিনটিতো পুরোই অন্য রকম। তাহলে আজকে কেনো এসেছে?’
-‘ আপনি আমার রুমে কেনো হঠাৎ করে?’
-‘ ভুলে গেছো আমি এখন অফিসে যাবো? অফিসে যাবার আগে কখনো তোমার সঙ্গে দেখা না করে যাই আমি?’
-‘ আজকে তো অন্যরকম! কলিকে তো নিয়ে এসেছেন তাই না? তাহলে ওর সঙ্গেই তো দেখা করে যাবেন।
-‘ ভুল বুঝছো! আমি অপারগ আমাকে এটা করতেই হতো। শুধু এটুকু জেনে রাখো সময় এলে সবটা বুঝবে প্রিয়তা। আপাততো আমি কিছুই না বলতে পারবো আর না করতে পারবো।’
সাগর চলে গেলো। কিন্তু শেষোক্ত বলা কথাটি বুঝতে পারলাম না আমি! ওদিকে রান্নাঘরে চিৎকারের আওয়াজ আসছে! ভালো করে শুনে বুঝতে পারলাম ওটা কলির আওয়াজ!
#চলবে?