#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_সতেরো
“আমি ফালাক ভাইয়াকে ভালোবাসি বাবা। সত্যিই খুব বেশি ভালোবাসি সেজন্যই তো তাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি। তাকে ছেড়ে যেতে চাইনি আমি। সবসময় তাঁর কাছে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। জানো তখন প্রচন্ড অভিমান হয়েছিল আমার। পাঁচবছর যোগাযোগ করিনি। ভেবেছি সে যোগাযোগ করলেই তাকে বলে দেবো আমিও তাকে তাঁর চাঁদও তাকে ততটাই ভালোবাসে যতটা সে তাঁর চাঁদকে ভালোবাসে। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে আমি কি জেনেছি জানো? ফালাক ভাইয়া একজন খু’নি। মেহমেদ ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর শত্রুতা আছে। দুটো দলের মধ্যে যে ঝামেলা চলছে তার সমাধান একটা দলের ধ্বংস। আমি জানি ফালাক ভাইয়া অভিনয় করতে ভালোবাসে। তাঁর থেকেও বেশি আমি ভালোবাসি তাঁর অভিনয় দেখতে। মনে মনে কত সান্ত্বনা দিয়েছি নিজেকে, যে সেদিন যেটা হয়েছে সেটা ফালাক ভাইয়ার অভিনয়। নিজেকে সামলেও নিয়েছি। কিন্তু সে প্রচন্ড রাগি। তাঁর রাগ, জেদ অনেক। সে বড় হতে চায়, ঠিক আছে কিন্তু অহংকারিও হয়ে গেছে সেই বিকেলের পর থেকে। আমি তো তাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চাইনি। সে আমার চরিত্র তুলে আমার আদর্শ তুলে কথা বলেছিল বলেই তো তাকে ওভাবে বলেছি। আমাকে সবাই ভালোবাসে। কিন্তু তোমাদের মত করে তো শুধু ফালাক ভাইয়া ভালোবাসতো।সে যদি আমাকে কষ্ট দেয়,আমি কি সহ্য করতে পারি? এরপর যখন জেনেছি ওরা আমার ওপর নজর রাখে, আমার প্রতিটা শক্তি ও দূর্বলতার খোঁজ রাখে তখন কিভাবে সবাইকে জানাতাম আমার মনের কথা? ফালাক ভাইয়া নিজের গ্যাং বাদ দিয়েছে অভিনয়ের জন্য। তাঁর কাছে অভিনয় জিনিসটা এতটা মূল্যবান জানার পরও তাকে আমি অভিনয় ছাড়তে বলেছি। আমার কি খারাপ লাগেনি? সবাই ভাবছে আমি নিজের জন্য সব করছি, করেছি। কিন্তু তোমরা তো জানো আমি নিজের জন্য কিছু করিনি। আমার নিজের আছে’টা কি? যে নিজের জন্য করবো। নিজের বলতে তো শুধু ওই মানুষগুলো। কুসুম নতুন মানুষ, আমার প্রিয়জনের তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে আমি ওদের কাছে থাকলে ওরও তো ক্ষতি হতে পারে। দাদাই ওকে কত ভালোবাসে, ওর কিছু হলে কি দাদাই বাঁচবে? দাদাইয়ের কিছু হলে কি আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো? যে মানুষগুলো আমাকে এতটা আপন ভেবেছে, ভালোবেসেছে তাদের কষ্ট দিতে পারি না আমি।
ভালোবাসা, সেটা তো নিঃস্বার্থ হয়, কারনবিহীন হয়। অথচ দেখ সেই ভালোবাসার মামলাতেও আমি কত শত শর্ত জুড়ে দিলাম যেন ফালাক ভাইয়া আমার ওপর আবার রাগ করে। আর সে রাগ করলেই আমি অযুহাত দেখিয়ে চলে আসবো মিশনে। কিন্তু সে অভিনয়টাই ছেড়ে দিয়েছে।সবাই বলে ফালাক ভাইয়া আমার সব কথা শোনে, আমার সব শর্ত মানে। কিন্তু কেউ একবার ভাবে না আমি তাঁর জন্য কি করি? আমি যে তাঁর জন্য আজ অবধি কোনো ছেলেকে গুরুত্ব দেইনি, বন্ধু বানাইনি,কারোর সঙ্গে হেসে কথা বলিনি। এগুলো কেউ বোঝেনা।সবাই ভাবে আমি অস্বাভাবিক, প্রতিক্রিয়াহীন এটা তো সত্য নয়। তুমি তো জানো মামনি। আমারও মন চায় ছোটবেলার মত সবার আদরে থাকতে। মামনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তোমরা কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? আমাকে সাথে নিলে না।
তোমাদের থেকেই তো ত্যাগ করা শিখেছি। শিখেছি কি ভাবে অন্যের সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিতে হয়। তবুও সব সময় সব অপবাদ আমার গায়ে কেন লাগে? আমার কাজগুলো কি বড্ড খারাপ? আমি চাইনি ফালাক ভাইয়া পুনরায় নিজের হিং’স্র রূপে ফিরে আসুক। এটা কি খারাপ? তবুও কুসুম, দাদাই ভাবছে ফালাক ভাইয়ার জীবন আমি নষ্ট করছি। তাকে বদলে দিয়ে তাঁর ওপর বাজে প্রভাব ফেলছি। কষ্ট দিচ্ছি। কিন্তু কেউ বুঝতে চাচ্ছে না, আঠারো বছর বয়সে আমি ঠিক কতটা স্ট্রাগেল করেছি। কিভাবে থেকেছি, কিভাবে চলেছি। সবাই ভাবছে ফালাক ভাইয়াকে আমি মাফ করে দিচ্ছি না, সুযোগ দিচ্ছি না। কিন্তু একটাবারও ভাবে না, তেরো বছর বয়সে, ওই অল্প একটু বয়সে আমি কি কি ফেস করেছি।তখন কতটুকুই বা বুঝতাম? শুধু জানতাম ফালাক ভাইয়া আমার বন্ধু আর আমি তাকে ভালোবাসি। এই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপান্তর হচ্ছে সেটা আমাকে কেউ বলেছে? বলেনি। দাদাইয়ের প্রেমের কথা শুনে বুঝেছি। তাহলে আমার দোষটা কোথায়? কেন সব খানে শুধু রোজের দোষ হয়? রোজ খারাপ হয়? রোজকে অপবাদ দেওয়া হয় জীবন নষ্টের। আমার কি সুন্দর জীবন আছে? আমি পেয়েছি সেটা? আমার কি কেউ সত্যিই ছিল? অভিমান আমি কেন করবো না? যখন ফালাক ভাইয়াকে আমার প্রয়োজন ছিল, একটা কাছের মানুষ, যে আমার ব্যক্তিগত মানুষ হবে তাঁর প্রয়োজন ছিল তখন ফালাক ভাইয়া কোথায় ছিল? সে তাঁর জেদ নিয়ে পড়ে থাকেনি?পাঁচটি বছর নষ্ট করেনি? কিন্তু না, এটা কারোর চোখে পড়বে না। সে মাফ চাইলো আর সবাই গলে পড়লো। সবার মনে হতে শুরু করল ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেলেই মিলন সম্ভব। কিন্তু মনের ভেতর রাগ, অভিমান, কষ্ট জমা থাকলে মিলন হলেও সেটা তেমনই থাকে।এটা কেন বোঝে না? সেদিন দাদাই কুসুমকে বলল, আমি নাকি পাঁচবছর পর ফিরে আসতে চেয়ে অনেক সময় নিয়েছি। যদি মিশনে গিয়ে আর ফিরে না আসি তখন? ফালাক ভাইয়াকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে কেন রাখবো? সে জানুক আমি ফিরবো। যদি নাও ফিরি তাহলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক তো হবে, রাগ মিটে গেলে সে নিজের মনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আর বাকি সবাই তো আছে ওকে সামলে রাখার জন্য। দেড়বছর হয়ে গেল। জার্নালিজমে আমি আরও একটি কারনে পড়ছি, সেটা তো জানো তোমরা। কুসুমকে সুস্থ করতে হবে, দাদাইয়ের কাছে পরিপূর্ন কুসুমকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সবাই ভাবে দাদাইয়ের ওপর আমার ঝোঁক আছে। কেন ভাবে? কারন আমি দাদাইকে অনেক ভালোবাসি। কেন বাসি সেটা কেন কেউ জানতে চায়না? বুঝতে চায়না? কলকাতায় যখন ফালাক ভাইয়া আমাকে নানা কথা শোনাচ্ছিল তখন কে আমাকে আগলে রেখেছিল? কে আমার পাশে ছিল? মানছি দাদাই আর আমার কথাগুলো ফালাক ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল কিন্তু ফালাক ভাইয়া কি শুনেছিল? সেদিন চাইলেই তো দাদাই সবটা বলতে পারতো। বলেনি আমার কথা ভেবে, আমার ভালো চেয়ে। ফালাক ভাইয়ার বিপক্ষে গিয়ে আমার হয়ে যে মানুষটা লড়েছিল তাকে ভাই হিসেবে ভালোবাসা সম্মান করা কি ভুল? সে ভেবেছিল ফালাকের কাছে আমি নিরাপদ নই, যেখানে সে ফালাককে এতগুলো বছর ধরে চেনে। সে যদি আমার জন্য সবার সঙ্গে লড়াই করতে পারে তাঁর হয়ে কিছু কথা বলা কি অন্যায়?
কুসুমের পরিস্থিতি, কষ্ট বুঝি আমি। চোখের সামনে যদি সহসা কোনো দূর্ঘটনা ঘটে তা থেকে বের হওয়া কঠিন। আমি তো তোমাদের সাহসী মেয়ে তাই সবটা ওভার কাম করতে পেরেছি। কিন্তু কুসুম তো ভীতু, নরম মনের আহ্লাদি মেয়ে। ও পারেনি। ওর পরিস্থিতি ঠিক করা কি আমার কর্তব্য নয়? ও তো আমারই নতুন পরিবারের নতুন সদস্য।
আমি তবুও ফিরবো না বাবা, মামনি। ফিরে গিয়ে ওদের সামনে দাড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই।তাই আমি এখানে থাকবো। যে কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা করবো। যে দায়িত্ব বাবা আমার ওপর অর্পণ করেছে তা পালন করে যাবো শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। কিন্তু ফালাক ভাইয়ার স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে তাকে যে কষ্ট দিচ্ছি তাঁর বদদোয়া আমার লাগবে না? স্বার্থপরের মত কাজ করছি? তাঁর কি এই কথা জানার অধিকার নেই যে আমি তাকে ভালোবাসি। যদি জানিয়ে দেই, উনি তো দুনিয়া ওলোট পালোট করে দেবে। তখন যদি টেরোটিস্টরা ওনার ক্ষতি করে? কি করবো আমি? তোমরাই বলো! ওনাকে কি বলে দেবো অভিনয় করার কথা? লিস্ট থেকে রাগ বাদে সব শর্ত কে’টে ফেলার কথা? এটাই ভালো হবে। ”
আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে ফারহানের নাম্বারে কল করল রোজ। দু বার বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। হয়তো আননোন নাম্বার বলে কল রিসিভ হচ্ছে না।
বারংবার কল আসায় প্রচন্ড বিরক্ত ফারহান। মুগ্ধতা ভেবে সে ফোনটা বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছে। সকাল বিকাল ছ্যাছড়া হিরোইনটার প্যারা আর ভালো লাগছে না।হিপোক্রেট একটা।কিন্তু একটানা কয়েকবার ফোন বাজতেই ফারহান ফোন রিসিভ করেই দিল এক ঝারি,
-কি সমস্যা?স্লাট হতে চাইলে অন্যকোনো খোদ্দের খোজ, তোর মত বে’শ্যা আমার বিছানার আশেপাশে থাকারও যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা। বালডা বিরক্ত করেই চলেছে। আর ফোন দিবি না।
এমন বাক্য শুনে রোজের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। হাত কেঁপে উঠল মুহূর্তেই। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-ফালাক ভাইয়া!
ওপর পাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। রোজ বলল,
-কেমন আছো? আমি রোজ। কন্ঠ চিনতে পারছো না? কথা বলছো না কেন?
ওপাশ থেকে কিছু পড়ার শব্দ পেল রোজ। আতঙ্কিত কন্ঠে রোজ আবার বলে,
-বিরক্ত হচ্ছো? ফোন রেখে দেবো?
ফারহানের গলা ধরে আসলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু বলার মত শক্তিও যেন পাচ্ছে না সে। রোজ ফোন করেছে এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না। ফারহানের ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার আভাসে রোজ টলে উঠলো। পা দুলছে। ফালাক কাঁদছে এটা ভাবলেও রোজের দুনিয়া আঁধারে ঘনিয়ে আসে। সেখানে আজ ফালাকের কান্নার স্বর শুনছে। রোজ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলে,
-শুনেছি পুরুষ মানুষরা নাকি কাঁদে না। তাদের কাঁদতে নেই। তারা কঠিন, আর কঠোরতায় তাদের বেশি মানায়।
-ফিরে আয় চাঁদ। আমি তোকে একটুও কষ্ট দেবো না। তোর সব কথা শুনছি, ভবিষ্যতেও শুনবো।
রোজেরও কান্না পেয়ে গেল ফারহানের কান্নাভেজা কোমল কন্ঠে। মানুষটার রাগ মিটে গেছে? আজ সে রোজকে একদম ধমক দেয়নি। বরং মিষ্টি করে কথা বলছে। তাঁর কন্ঠ জানান দিচ্ছে তাঁর তীব্র যন্ত্রণা। রোজ নাক টেনে বলে,
-ফিরবো তো। কিন্তু এখনও তোমার কষ্ট পাওয়া হয়নি। শোনো, অভিনয় জগতে তুমি ফিরে যাও। শুধু রাগটা বাদ দিলেই হবে।
-ভালোবাসি চাঁদ। তোকে কখনও বলা হয়নি। আঠারো বছর হলো তোকে ভালোবাসি আর আজ বলছি। তুই প্লিজ আমার কাছে আয়। ছোটবেলার মত আমার গলা জড়িয়ে ধরে অভিমান দেখা, তোর পা ধরে আমি স্যরি বলবো। তবুও ফিরে আয়।
রোজ এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে। ফারহানও কাঁদছে। দুজনের কথার সমাপ্তি ঘটে ক্রন্দনের প্রারাম্ভ ঘটেছে। কিন্তু রোজ তো এখন ফিরতে পারবে না। এটা সে কি করেরে বোঝাবে ফারহানকে? ফারহান আবার বলল,
-আসবি না?
-এই মুহূর্তে আসাটা কি জরুরি? যদি তোমার ভাগ্যে আমি থাকি। যদি তোমার হওয়া’টা আমার ভাগ্যে থাকে আমি নিশ্চই তোমার হবো ফালাক ভাইয়া। পৃথিবির দ্বিতীয় কোনো পুরুষ তোমার চাঁদকে পাবে না। তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে, এই দূরত্বের পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার সুমিষ্ট ফলের প্রতীক্ষা করতে পারবে না? চাঁদকে পেতে হলে একুটু করা সামান্য বিষয়।
-আমার ম’রার পর আসবি? লাশ দেখতে আসবি? তবুও আসিস। আমার কবরে যেন তোর হাতের মাটি পড়ে।
-সৃষ্টিকর্তার কাছে বাবা আর মামনির জন্য দোয়া করার পর আমি নিজের জন্য সবসময় একটা জিনিস চাই। সেটা কি জানো? সেটা হচ্ছে আমার ফালাক ভাইয়ার সুখ, সমৃদ্ধি। আর তাঁর আগে আমার মৃ’ত্যু। বোঝার পর থেকে এই একটা চাওয়াই চেয়ে এসেছি। আর আমি মনে করি বিধাতা আমাকে নিরাশ করবেন না। যদি করে তাহলে জেনে রেখো তুমি, ফালাক বিহীন চাঁদ এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রাণবায়ু গ্রহণ করবে না।
-ঠাটিয়ে মা’রবো এক চর। খুব কথা শিখেছিস তাইনা? সামনে পেলে তোকে মে’রেই ফেলতাম এমন কথা বলার দুঃসাহস পেলি কোথ থেকে?
-অপেক্ষা করো।পরীক্ষা দাও,যেদিন উত্তীর্ণ হবে, দেখবে তোমার চাঁদ তোমার সামনে দাড়িয়ে। আমাকে এবার দূরে ঠেলে দেবে না তো?
-একবার এসে দেখ।
-এভাবে বলবে না তুমি। তাহলে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারবো না। তোমার ওপর যত অভিমান আছে সব পুষে রাখছি। সামনে এলে তোমার ওপর ঝারবো।
-ভালোবাসিস আমায়?একবার বল চাঁদ! আঠারো বছর ধরে তোকে দেখছি, আমাকে বাদ দিয়ে তুই সবাইকে সম্মুখে ভালোবাসার কথা বলেছিস। প্রাণ থাকতে এক বার তোর মুখ থেকে শুনতে চাই। একবার বলবি?
-সবার সামনেই বলবো।
-এখন একবার বল না চাঁদ। প্লিজ চাঁদ।
-আমি তোমাকে ভা
-ভা? পুরোটুকু বল। আমি শুনতে চাই।
-লজ্জা লাগছে।
-তোকে মিস করছি চাঁদ। এবার আসলে তোকে আমি ছাড়বো না। কোথাও একা যেতে দেবো না, একমুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেবো না তোকে।
-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না এমন নিষেধাজ্ঞা তোমার ওপর থেকে তুলে নিলাম। অভিনয় করার, ও অসাধারণ থাকার নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিলাম ফালাক ভাইয়া। জলদি রোম্যান্টিক একটা মুভি করে ফেলো। আমি ফিরে আসার আগে হলে তোমার মুভি দেখতে চাই।
-আমার হতে চাস না কেন?
-চাই তো।
-তাহলে নিষেধাজ্ঞা কেন তুলছিস? তোর মনে হয় তুই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে আমি অন্য নারীকে নিয়ে সামান্য একটা চিন্তাও মাথায় আনবো? আমি শুধু তোকে আর তোকেই ভালোবাসি চাঁদ। যেদিন প্রথম তোকে কোলে নিয়েছিলাম। বারো বছরের বাচ্চা ছিলাম আমি আর তুই দুধের শিশু। বোন পাওয়ার জেদ করেছিলাম বলে মা তোকে আমার কোলে দিয়েছিলো। কিন্তু তোকে প্রথম দেখার পর থেকে বোনের স্বপ্ন বাদ দিয়ে দিয়েছি। বন্ধুর স্বপ্ন দেখেছি আর তা মাত্র চারবছরে বদলে গেল। বুঝতে পারছিস কি বলতে চাচ্ছি? কৈশরে আমি এক দুধের শিশুকে বউরূপে দেখতাম। এটা কতটা জঘণ্য ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল। তুই যতবার আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতিস আমার বুকের ভেতরটা ততবার চিরে যেত। তবুও সব হাসিমুখে সহ্য করেছিলাম কারন তুই আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতিস না। জীবনের আঠারোটা বছর তোর জন্য আমি কারোর রূপে, গুণে মুগ্ধ হইনি। এমনকি আকর্ষনবোধও করিনি। আর এই আঠারো বছর পর তোর মনে হচ্ছে আমি কোনো হিরোইনের চক্করে পড়লেও পড়তে পারি? তোর মনে হয় কারোর রূপে আমি আটকাবো? বিছানায় তো অনেকে আসতে পারে চাঁদ কিন্তু মনে? তোকে ছাড়া মন নামক আমার বিষাক্ত দেহাংশে আর কারোর ঠাই নেই। কারোর না।
-আমি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার আদৌ যোগ্য তো ফালাক ভাইয়া?
-যোগ্যতার হিসেব আমি করতে চাইনা। আমি শুধু জানি আমি তোকে চাই, আর তুই শুধু আমার হবি। ব্যাস।
-কয়েকটা মাস লেগে যেতে পারে। একটু ধৈর্য ধরো। আমি ফিরে আসবো।
-আমার থেকেও তোর মিশন বড় চাঁদ?
-তুমি জানো?
-মেহমেদ বলেছে। তুই ফিরে আয় চাঁদ। কি দরকার এই ঝুঁকি নেওয়ার? আমার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে পারবি না? ওসবে কি পাবি? যন্ত্রণা ছাড়া।
-বাবা আমার ওপর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। যা পালন করা আমার কর্তব্য।
-ইশতিয়াক ইরফান ভালো না চাঁদ। তোকে ও বাঁচতে দেবে না। কোথায় আছিস তুই? আমাকে বল। আমি নিজে তোকে নিয়ে আসবো। তারপর দেখবি আমরা একসাথে থাকবো, আমাদের ছোট একটা সংসার হবে। তুই আমি আমাদের বাচ্চা…
-ডি.আই.জি স্যারের খেলাটা শেষ করে তবেই ফিরবো। উনি আমার বাবাকে মে’রেছেন, আমার মামনিকে মে’রেছেন। ওদেরকে আমি এত সহজে ছেড়ে দিতে পারবো না। কিছুতেই না। তোমার সঙ্গেও যোগাযোগ করবো না। কারন তুমি আমাকে আমার দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে যেতে বলছো। এটা তুমি বলতে পারো না, ফালাক ভাইয়া। বাবা-মামনির শেষ ইচ্ছে ছিল এটা।
-আমি আমার সব ইচ্ছে বাদ দিচ্ছি, আমার পুরো জীবন তোর হাতে তুলে দিচ্ছি। তুই তার বদলে এটুকু করতে পারবি না?
-না। (কিছুটা থেমে) তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে এমন অনুরোধ করবে না। আমার কসম ভাইয়া, তুমি অপেক্ষা করবে। আমাকে খুজতে আসবে না। পৃথিবির সামনে ততদিন কিছু বলবে না যতদিন না ইরফান মা’রা যায়। রাখছি।
ফোন রেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো রোজ। মেজাজ আবারও খারাপ হচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই ঠোঁটের অদৃশ্য হাসি চওড়া হলো। কেন হাসলো রোজ? আর নিজের ভালোবাসার কথা স্বীকারই বা করলো কেন? সে তো এগুলো বলতে ফোন দেয়নি। তবুও ফারহানের কান্না দেখে গলে গিয়ে সব বলে দিলো? ভালোবাসা তো এমনই হয়! কিন্তু ফারহান? পাঁচবছর ধরে রোজের কান্না দেখার পর গলেনি। ভালোবাসার নতুন কোনো অধ্যায় ছিল নাকি ওটা? নাকি ভয়ের ছাঁপ? লুকানোর চেষ্টা অত্যন্ত গোপনীয় কিছু! রেলিঙ-য়ের পাশেই লম্বা রডটা বেরিয়ে আছে। রডের পাশে কিছু লম্বা লোহা। রোজ রেগে সেটা চেপে ধরতেই তালুর মধ্যে ঢুকে গেল লোহা। রোজ চোখ বুজে হাত টেনে নেয়। লালরঙা এই তরল পদার্থ অতিমূল্যবান জানা সত্ত্বেও তা দেহ থেকে বের করার মাঝে এক নিঃস্বার্থ সুখ খুজে পায় রোজ। মনে পড়ে প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা, ঘাতকদের প্রতিটা আঘাত, অতিতের কষ্ট, বাবার ভালো মানুষ হওয়ার ভুল, তাঁর ঠকে যাওয়ার কথা, অতি আপনজনদের ভালোবেসে, বিশ্বাস করে মৃ’ত্যুকে বরণ করে নেওয়ার কথা। রোজ সে ভুল করবে না। রোজ মনে করে ভালো খারাপও একটি মুদ্রার দুটো পিঠ। কেউ সম্পূর্ণ ভালো হতে পারে না, আবার খারাপও হতে পারে না।রোজও তার ব্যতিক্রম নয়। রোজ ভালো হলে যতটা ভালো, খারাপ হলে তার থেকে শত গুন বেশি খারাপ। এটা সবাইকে বোঝানোর সময় দ্রুতই আসবে। রোজ শুধু সে সময়টুকুর অপেক্ষা করছে।
চলবে?