#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_পনেরো
আরশানদের বিয়ের তারিখ পুনরায় ঠিক করা হয়েছে। আজ ওদের পুনর্মিলনের একবছর পূর্ণ হলো। আর বিয়ের তারিখটাও আজ। গতবছর ঠিক এই তারিখেই আরশানের সঙ্গে অয়ন্তির ক্যাফেতে দেখা হয়েছিল। আর বিশ্রি একটা ঘটনাও ঘটেছিল ভেবেই লাজুক হাসে অয়ন্তি। অনার্সের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট বের হওয়ার আগে অয়ন্তি বিয়ে করতে চায়নি কিন্তু না চাইতেও বিয়েটা করতে হচ্ছে শুধু অরুনির জন্য। কিছু একটা ঘাপলা আছে মেয়েটার মাঝে। রোজের কথাটা যাচাই করেও দেখেছে অয়ন্তি। কিন্তু মেয়েটা এতটা চালু যে ধরা যায়নি। আশরাফ সাহেবও বিষয়টা লক্ষ করে বিয়ের তারিখ ঠিক করলেন।
যথারীতি বিয়ের সকল অনুষ্ঠান পালন করা হলো। আজ রাতে অয়ন্তিরা এবাড়িতেই থাকবে। অয়ন্তিদের বাড়ির নিয়ম এটা। বিয়ের পর প্রথম দিন নাকি মেয়েরা বাবার বাড়িতেই থাকে। আরশান হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে নিয়ম দেখে। কিন্তু সে হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না। রাতে খাবার টেবিলে বসতেই হাসি সারারাতের জন্য উবে গেল। বাড়ির নিয়ম অনুসারে জামাইয়ের পাতে যতটুকু খাবার দেওয়া হবে সব খেতে হবে। এটা কোন দেশের রীতি? আরশান উঠে যাবে তার আগেই অয়ন্তির বাকি ভাইবোন এসে চেপে ধরে আরশানকে বসিয়ে দিল। প্রায় দশ পনেরো পদের রান্না। এত খাবার খেলে তো পটলের তরকারি খেতে হবে না, বরং নিজেই পটল তুলবে। অয়ন্তি ঠোঁট টিপে হাসছে। আসলে এসব কোনো রীতি নয়। নতুন দুলাভাইকে পেয়ে ওর ভাইবোনেরা তাকে জব্দ করার চেষ্টা করছে। আর আজ এ বাড়িতে থাকবে কারন অয়ন্তির শরীর ভালো লাগছে না।
বাসরঘরটা দারুনভাবে সাজানো হয়েছে। হরেকরকম ফুল,মোমবাতি! অয়ন্তি খাটের মাঝ বরাবর বসে আছে। আরশান পেট নিয়ে হাটতেও পারছে না। যা যা গেলানো হয়েছে তা থোকা থোকা জমে আছে পেটের মধ্যে। কোনোরকম দেহটাকে টেনে এনেছে সে। দরজা লাগিয়ে বিছানার কাছে আসতেই অয়ন্তি সালাম দিল। আরশান উত্তর দিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলে,
-তোমার পরিবার আমার সঙ্গে দুর্নীতি করেছে কুসুম। মানুষ খায় এনার্জি পাওয়ার জন্য, আর অতিরিক্ত খায় তা খোয়ানোর জন্য। দেখো, খেতে খেতে ক্লান্ত আমি। নড়তেও পারছি না, আমার বাসররাত চাঁন্দে গেল।
-ফালাক ভাইয়াকে দেখলাম না কেন?
-তোমার স্বামী আমি, তুমি আমার কথা ভাববে। তা না আমার ভাইয়ের কথা ভাবছো। কাহিনি কি?
-রোজ আবারও উপহার পাঠিয়েছিল। তারপর থেকেই উনি নিঁখোজ তাই জিজ্ঞেস করছি। কিছু করে টরে বসে যদি?
-ও পাগল। কিন্তু ওতটাও না। নিজের ক্ষতি করবে না। রোজ কষ্ট পাবে তাহলে।
-এদের মিল কি হবে না? একবছর হয়ে গেল। রোজের পাত্তা নেই।
-আজকের রাতটা শুধু আমাদের হোক?
-কিন্তু,,, আচ্ছা।
-ওযু আছে তোমার? সালাত আদায় করতে হবে।
-হ্যাঁ।
-আসো।
সালাত আদায় করে আরশান বিছানায় বসে অয়ন্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-লাইটটা বন্ধ করে আসো।
-কেন?
-জ্বালিয়ে রাখতে চাইলে রাখো। তাতে আমারই লাভ। তুমি লজ্জা পাবে যখন তখন সেই চেহারা দেখতে আমার ভালো লাগবে।
অয়ন্তি লজ্জা পেল। গাল লাল হয়ে উঠলো। কান গরম হয়ে গেছে। আরশান খোঁচা মেরে বলে,
-এখনও তো কিছু করলাম না, তাতেই এই রিয়াক্শন? করার পর তো তোমার প্রতিক্রিয়া খুজেই পাওয়া যাবে না।
-অসভ্য।
-মানে টা এখনও বুঝিয়ে দেইনি। আজ সময় সুযোগ দুটোই আছে।
বলেই নিজে উঠে গিয়ে লাইট বন্ধ করে দিল আরশান। এরপর লাইটের সুইচের পাশে দাড়িয়ে থাকা অয়ন্তিকে পাঁজকোলা করে তুলে নিল। অয়ন্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-আজ পালাবে কোথায়? সম্পর্কটাও বৈধ আর স্পর্শও। বৈধতার কারনে তোমার সম্মতিও আছে নিশ্চই।
_______________
ক্লাস শেষ অবিশ্রান্ত শরীর টেনে ফিরছিল রোজ। কাধে কলেজ ব্যাগ, হাতে বাজারের ব্যাগ। ঘামে জামা শরীরে সঙ্গে লেপ্টে আছে। এমন অবস্থায় কিছু ছেলেকে পেছনে আসতে দেখে বিচলিত হলো রোজ। নিজের জন্য নয়, ছেলেগুলোর জন্য। এমনিতেই ওর মেজাজ আজ প্রচন্ড খারাপ তার ওপর এরা। রাগ উঠে গেলে কি হবে তা রোজ নিজেও জানে না। কানে ব্লুটুথে অতিরিক্ত ডি.আই.জি সাহেবের সঙ্গে কথা বলছে ও। আনসারী সাহেবের কেসটা নিয়েই মূলত কথা বলছে। বাবা’মায়ের হত্যাকারীকে এত সহজে ছেড়ে দেবে? বাবার স্বপ্ন ছিল রোজ জার্নালিস্ট হবে, সে চেষ্টা তো করছে রোজ। আর নিজের স্বপ্ন? বাবা-মায়ের হত্যাকারীকে খুজে শেষ করা। তাই বাবার পেশার প্রতিও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে সে। ছোট থেকে ওর মস্তিষ্ক বেশ প্রখর বলে এক সাথে দুটো দিকই মিলিয়ে চলতে পারছে। ডাক্তারি পড়লে এটা হত না। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর রোজকে যখন বলা হয় জার্নালিজমের চিন্তাও বাদ দিতে তখন রোজ সেটা পারেনি। যদিও কারোর মুখের ওপর না বলেনি। কিন্তু মনে মনে সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। আমীর আঙ্কেল, ফারদিন আঙ্কেল কখনও রোজকে জার্নালিজমে পড়তে দিতেন না। আরশানও লাইব্রেরিতে এসেছিলো রোজকে আটকাতে। ফালাকও নিশ্চই এখন সবটা জানার পর রোজকে বাঁধা দিত। এত মানুষের মন দুখিয়ে, রোজ তাদের সামনেই জার্নালিজমে পড়তে পারবে না বলে আজ একা অন্য শহরে চলে এসেছে। তাছাড়া ফালাকের ওপরও তো প্রচন্ড রাগ ও অভিমান জমা আছে।
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। শর্টকাট রাস্তায় ঢুকে পড়ায় এদিকটায় মানুষজনও কম। ছেলেগুলোর হাটার গতি বৃদ্ধি পেল। রোজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হাটছে। পনেরো দিন হলো সে বাবার পেশায় সরাসরি যুক্ত হওয়ার জন্য ক্যারাটে আর প্রতিরক্ষার কিছু কৌশল শিখেছে। সেগুলো এত তাড়াতাড়ি কাজে লাগবে? রোজের কি উচিত সেগুলো পরীক্ষা করা?কেমন শিখেছে সে? সেটা জানতে এখনও মাস তিনেক বাকি। এ্যান্টি টেরোরিজম ডিপার্টমেন্টে রোজকে তিনমাস প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপর রোজের কাজ সম্পর্কে অবগত হবেন তারা। রোজের জন্যই শুধু ভিন্ন নিয়ম, কারন সে মেয়ে এবং আনসারী সাহেবের ক্ষমতার কারনে রোজকে অতিরিক্ত সুযোগ দেওয়া হবে। ছেলেগুলো কাছাকাছি চলে আসতেই রোজ হাসলো।ফালাক থাকলে কি করতো? এগুলোকে পিস পিস করে কে’টে ফেলতো। ভাগ্গিস সে নেই। রোজ হাতের ব্যাগগুলো রাস্তার ওপর রেখে পেছনে ফিরে তাকালো।
-অনেকক্ষণ ধরে দেখছি, শুধু ফলো করছেন। আর কিছু করার ইচ্ছে নেই নাকি? আপনারা আমাকে কিছু না করলে আমিও তো করতে পারছি না।
ছেলেগুলো রোজের কথার ভিন্ন মানে ধরে নিয়ে এগিয়ে আসলো। রোজ স্মিত হেসে ওরনা আড়াআড়ি বেঁধে নিল। জামার হাতা গুটিয়ে কনুইয়ের ওপর তুলতে না তুলতেই একজন অশ্লীল বাক্য ছুড়ে রোজের হাত ধরে টান দিতেই রোজ মৃদু হাসে। এরপর ‘স্যরি’ বলেই সে ছেলেটার পুরুষাঙ্গ বরাবর লাথি দিল। প্রথমেই এমন কাজ করতে চায়নি রোজ। হাতা গোটানোর সময় দেয়নি ওরা তাই রেগে গিয়ে প্রথমেই মেইন এ্যাটাক করে বসেছে। তার জন্য রোজ প্রচন্ড দুঃখিত বোধ করেছে। দুঃখিত বললেও ছেলেগুলো সে কথা পাত্তা না দিয়ে তেড়ে আসলো। রোজ ব্যাপক মুডে আসলো এবার। দুপক্ষই সমান চটে আছে। এবার গড়ে পেটানো সম্ভব। পাশ থেকে শুকনো ডাল তুলে নিয়ে রোজ ইচ্ছে মত পেটালো সবাইকে। বখাটে এরা, একটু আকটু বখাটেগিরিই করে বোধ হয়। তাই মা’রপিট তেমন জানে না। তা ওদের আনাড়ি হাতাহাতিতেই বোঝা গেল। ওদের মে’রে রোজ দাঁড়িয়েই থাকলো। অনুশোচনা হচ্ছে খুব। কলেজের রাগও এদের ওপর মিটিয়েছে। এতটা রাগ ঠিক ছিল না। এদের কি গাড়িতে তুলে দেবে? হাতে তো তেমন টাকাও নেই যে চিকিৎসার জন্য দেবে। রোজ এগিয়ে আসতেই ছেলেগুলো গড়িয়ে, দৌড়ে চলে গেল। রোজ হা করে চেয়ে আছে। মা’রটা বেশি হয়ে গেছে। ওরা ভয়ও পেয়েছে। রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগগুলো তুলে হাটা শুরু করল। বাড়ি পৌঁছাতে আর মিনিট দশেক লাগতে পারে।
______________
গোসল সেরে অয়ন্তি কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। ভেজা চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। আরশানের ঘুম ভাঙেনি এখনও। বরাবরই দেরিতে ওঠে সে। কিন্তু বিয়ের পর কিছু নিয়ম আপনাআপনি বদলে যায়। এই নিয়মটাও বদলাতে হবে। যথাসময়ে ঘুম এবং সজাগ হতে হবে। অয়ন্তি আরশানের ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছু সময় চেয়ে থেকে ফালাকের মুভির কথা ভাবলো।চুলের পানিতে নায়কের ঘুম ভাঙানোর সীন। ওটা করলে কি অদ্ভুত দেখাবে? শাড়ির আঁচল গুজে নাকে সুড়সুড়ি দিলে কেমন হয়? না থাক! মানুষটা অতিমাত্রায় বউ সোহাগী! দিনের বেলায় ধরলে যদি না ছাড়ে? তাই এসব চিন্তাকে মাথা থেকে নামিয়ে অয়ন্তি ডাক দিল।আরশান ঘুমে বিভোর। সাড়া-শব্দ নেই। অয়ন্তি আবার ডাকে। না উঠছে না। সকাল আট’টা বাজে। এখনও ওঠে না কেন? অয়ন্তি দুষ্টু হেসে খানিকটা চেঁচিয়ে বলে, ‘আররে রোজ! তুমি? কখন এলে?’ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো আরশান। বাসরঘরে বইন আসলে মানইজ্জত শেষ।ঘোরের মধ্যেই নাম শুনে যার এমন অবস্থা সামনে থাকলে সে কি করতো? অয়ন্তি হাসতে হাসতে টেবিলের ওপর উঠে বসেসে পড়ে। আরশান চোখ পিটপিট করে খুললো। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটিকে আজ বড্ড উৎফুল্ল ও প্রসন্ন দেখাচ্ছে। প্রাণোচ্ছল, প্রাণবন্ত লাগছে। আরশান উঠে বাথরুমে যেতে যেতে বলে,
-কাজটা ঠিক করলে না কুসুম। এর শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।
-হু! যান আগে গোসল সেরে আসুন।
-বাহ, দারুন জ্ঞান আছে তোমার। একবছরে এতকিছু শিখে ফেলবে ভাবিনি।
-ভাবতে হবে না।
-ভাবলাম না, পরে যেন বলো না। ভেবে কাজ করতে পারেন না? (ব্যাঙ্গসুরে)
-আবার শুরু করলেন? সরুন, যান।
-যাচ্ছি।
খাবার টেবিলে ফারহানকেও দেখলো ওরা। ফারহান চুপচাপ খেয়ে চলেছে। পাশের ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে আরশান ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো কে ফোন দিচ্ছে।প্রডিউসার আলম! আরশান বসতে বসতে বলে,
-ফোন রিসিভ কর।
-দরকার নেই।
-একেবারে বাদ দিচ্ছিস অভিনয়?
-হুম। চাঁদকে কষ্ট দেওয়ার তুলনায় স্বপ্ন বাদ দেওয়া নিতান্তই তুচ্ছ।
-সাবাশ বেবি!!
-সাবাশ বেবি, কেন?
-তোর মত সাইকোকে সিধে করে ফেলছে।
-কি করবো বলো? আগে জেদ করে, রাগ করে, সন্দেহ করে, ওকে ভুল বুঝে, ঘৃণা করে পাঁচবছর কাটিয়ে এসে যখন জানলাম আমার পুরোটাই ভুল ছিল। তখন বুঝতে পারলাম আমি মানুষটা ঠিক নই। তোমার কাছে ও ছিল ভেবে শান্তিতে ছিলাম। আর এখন? সবকিছু শূণ্য শূণ্য লাগছে। কোনো কাজে মন বসছে না। অভিনয় তো হচ্ছেই না।
-সব ঠিক হয়ে যাবে।
-চাঁদের অভিমান আমার রাগের চেয়েও ভয়ঙ্কর দাদাই। তুমি তো জানো এটা। এত সহজে সব ঠিক হবেনা। ও যদি আমাকে মে’রেও ফেলতো এত কষ্ট হত না।
-ফালতু কথা বলবি না। চুপচাপ খা। তবে হ্যাঁ, রোজের এভাবে চলে যাওয়া উচিত হয়নি। তুই পাঁচবছর নষ্ট করেছিস এবার ও পাঁচবছর নষ্ট করার চেষ্টা করছে। সময়ের মূল্য দিতে জানিস না তোরা।
খেতে খেতে ফারহান ডুব দিল অতিতে। রোজের তখন সাড়ে তিনের একটু বেশি বয়স। ফারহান আর ও হাটতে বেড়িয়েছিল। রাস্তায় ফারহানের ক্লাসের একটা মেয়ের সঙ্গে ফারহানের দেখা হলে সে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। বাচ্চা রোজ তখন একাকি বোধ করে বাড়ি ছুটে এসে কান্না জুড়ে দিল। ফারহান পিঁছু পিঁছু আসে। কিন্তু ততক্ষণে নালিশ ঠুকে দেওয়া সারা। ফারিয়া লাঠি হাতে দাঁড়ালেন, রেণু আন্টি গম্ভিরমুখে চেয়ে আছেন। বাড়িতে ঢুকতেই ফারিয়া সপাৎ করে বারি কষলেন ছেলের হাতে। ফারহান হতভম্বচোখে সামনের সোফার বসা গাল ফোলানো মেয়েটার দিকে তাকায়। সেও বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে কেঁদে। ফারিয়া চেঁচিয়ে বললেন,
-এমন কেন করেছ ফালাক? তুমি জানো না তুমি ছাড়া রোজের কোনো বন্ধু নেই। তোমার জন্য রোজের বন্ধু হয়না। আর তুমি রোজকে রাস্তায় দাড় করিয়ে নিজের বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করো? যাও মাফ চাও ওর কাছে। (ফিসফিসিয়ে) কাঁদতে কাঁদতে দম আটকে যাচ্ছে ওর। ওকে চেতালি কেন? যা, রাগ ভাঙা।
-যাচ্ছি।
ফারহান রোজের কাছে যেতেই রোজ গাল ফুলিয়ে দু হাত সামনে বেঁধে বসে। ফারহান ওর পায়ের কাছে হাটু গেড়ে বসে বলল,
-স্যরি! আর এমন হবে না।
রোজ মুখ ঘুরিয়ে নিল।
-স্যরি বলছি তো। স্যরি, স্যরি, স্যরি, স্যরি স্যরি। অনেক গুলো স্যরি।
-পা ধরে।
-কি? তোর চেয়ে আমি কত বড় জানিস? আমাকে পা ধরতে বলছিস।
-পা ধরে। (একগুঁয়ে কন্ঠস্বর)
ফারহান নিরুপায় হয়ে রোজের পা ধরে ‘স্যরি’ বললেও সেই স্যরিতে মাফ করা হলো না।
-আবার কি?
-তুমি পঁচা। খুব পঁচা! তোমার সাথে কথা নেই।
রোজ উঠে দৌড়ে চলে গেল নিজের ঘরে। ফারহানও চলল সেদিকে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
-আরে বাবা তোর পা ধরেই তো স্যরি বললাম। আবার কি হলো?
ঘরে ঢুকেই ফারহান দেখলো রোজ বিছানার ওপর বসে কেঁদেই চলেছে। বালিশের চাদরে নাকের সর্দি মুছতে মুছতে সে ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহান ভ্রুকুটি করে চেয়ে আছে। রোজ বাবার ফোনের গেইম চালিয়ে খেলতে শুরু করে। ফারহান পাশে বসে টিস্যু এগিয়ে দেয়। রোজ নিল না।
-রাগ হয়েছে? রোজের তো রাগ হয়না। সে তো কখনও রাগ করেনা।
রোজ বা হাতের উল্টোপিঠে সর্দি লাগাতেই ফারহান হাত চেপে ধরে টিস্যু দিয়ে তা মুছে দিল। রোজ ব্যাথায় জোরে কেঁদে ওঠে। ফারহান রাগি কন্ঠে বলে,
-একদম কাঁদবি না। নাকের পানি চোখের পানি এক করার মত কি হয়েছে? স্যরি বললাম তো। মাফ করলে কর নাহলে করার দরকার নেই। কিন্তু এত কাঁদা যাবে না।
রোজ চুপ করে বসে রইলো। ফারহান উঠে রোজের পাশে বসে রোজকে কোলে নিতেই রোজ বলল,
-যাবো না। কোলে উঠবো না। তোমার বন্ধুকে ওঠাও। আমি তুরান ভাইয়ার কোলে উঠবো।
-তুরান কে?
-রাস্তার ওপারে বাড়ি।
-তোর বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ। তোকে বলেছি না? তোর বন্ধু আমি। আর কাউকে লাগবে না। তোর যা চাই সব আমি দেবো।
-না তোমার বন্ধুদের দাও। আমার লাগবে না।
-তাহলে চলে যাবো আমি? যাবো চলে?
রোজ আবারও কাঁদলো। পেটে মধ্যে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে।খিদে লেগেছে। ফারহান চকলেট কিনে এনেছিল। পকেট থেকে চকলেটগুলো বের করে সে রোজকে দিল। রোজ সেগুলো ছিনিয়ে নিয়ে খেতে শুরু করে। ফারহান রোজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-তোর চুলগুলো তো বেশ লম্বা হয়ে গেছে চাঁদ। গরম লাগে না? টাক হতে হবে।
-না।
-কেন?
-তুমি টাক হওনি, আমিও হবো না। তোমার বন্ধুও তো টাক না। আমি টাক হলে সবাই হাসবে।বলবে, টাক টাক চারানা চাবি দিলে ঘোরে না, টাকের কি অবস্থা আলুর দাম সস্তা। টাকবেল, কতবেল, কমলা বেল।
ফারহান হাসল,
-কমলা বেল কি জিনিস?
-ওই যে আঠা থাকে। শরবত খায়। কমলা কমলা।
-কিন্তু চুল না কাটলে তো ঘামাচি হবে। গরমে ঘেমে ঠান্ডা লেগে যাবে।
-লাগুক। তোমার কি? আমি তো তোমার বন্ধু না। তাই আমাকে ফেলে তুমি চলে গেছিলে। তোমার সঙ্গে কথা বলবো না।
-এত অভিমান?
-অভিমান? সেটা কি?
-কিছু না। আচ্ছা বল, কি দিলে কথা বলবি?
রোজ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
-তুমি আমাকে ছাড়া কাউকে চকলেট দেবেনা। আমার বন্ধু থাকবে। আর কারোর না, আমারও তো বন্ধু নেই। কেউ আমার সাথে খেলে না। তাহলে তোমার সঙ্গে ওরা খেলবে কেন? ওত বড় বড় বন্ধু কেন তোমার? আমার তো তুমি ছাড়া বড় বন্ধু নেই।
-আচ্ছা আর কাউকে চকলেট দেবো না। কোনো বড় বন্ধু বানাবো না। ঠিক আছে?
-কাল আমি টাক হলে তুমিও টাক হবা তো?
ফারহান নিজের ঝাঁকড়া চুলগুলোর দিকে তাকাল।কত কষ্টে বড় করেছিল। সাইজ করে সেপে এনেছিল। কে’টে ফেলতে হবে বলে? এত সাধের চুলগুলো। না কাটলে তো রোজের অভিমানও কমবে না। কাঁদতে কাঁদতে কাঁদুনি রোগ বাঁধিয়ে ফেলবে। পরে বাড়ির সবাই ওকেই বকাবকি করবে।রোজ আবার বলে,
-হবা না?
-হতে হবে? আমার চুলগুলো দেখ কত সুন্দর।
-ঠিক আছে। টাক হতে হবে না। তুমি কেন টাক হবা? আমার কথা তো শুনবা না। আমিও শুনবো না। তোমার চকলেট খাবো না। থু, থু, ওয়াক। সব বমি করে ফেলে দেবো।
-উফ। ঠিক আছে কে’টে ফেলবো। টাক হয়ে ঘুরবো।
রোজ শুনলো না। টানা দশদিন কথাও বললো না। শেষে এগারো দিনের মাথায় যখন ফারহান চুল কে’টে টাক হয়ে আসলো রোজ সেদিন কথা বলেছিল। সারাবাড়ি দৌড়ে সবাইকে ডেকে ডেকে ফারহানের টাক হওয়ার কথা বলে শান্ত হয়েছিল। সামান্য একটা কারনে ওমন বাচ্চাবয়সে রোজ যদি এত অভিমান করতে পারে তা হলে এই মারাত্মক ঘটনায় রোজের এক আকাশসম অভিমান তো অনিবার্য ছিল। রোজের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ভীষম লাগায় ফারহানের নাকে ভাত উঠে গেল। অয়ন্তি পানি এনে ফারহানকে দিতে দিতে বলে,
– কি করছ ভাইয়া? সাবধানে খাবে তো।কি ভাবছো এত?
-কিছু না।
আরশান খোঁচা মে’রে বলে,
-কি আবার? নিশ্চই বেবিকে গোসল করানোর ওই সীনটার কথা ভাবছিল। আরে বাচ্চার গোসলে কি আসে যায়, বড় হওয়ার পর করালে নাহয় কাজে…
ফারহান চোয়াল শক্ত করে আরশানের কথা থামিয়ে বলে,
-তুমি থামবে দাদাই? বউ পেয়ে অনেক উড়ছো। আমার কথা তো ভাবছোই না। সিঙ্গেল পুড়ে কয়লা হচ্ছি আর তুমি ওর কথা মনে করিয়ে দহন বাড়াচ্ছো?
-তোর দহন বাড়াতে আমার দারুন লাগে। বিয়ের পর তো তোকে ডেডিকেট করে একটা লাইনই সারাদিন বলতে ইচ্ছে করে।
-কি?
-”দেখ কেমন লাগে!!” সেদিন হাইপার হয়ে কান্ডখানা না ঘটালে তোর পাশের সীট ভরাই থাকতো।
-ধ্যাত খাবোই না।
অয়ন্তি বাধ সাধলো।
-না খেয়ে উঠতে নেই ভাইয়া। খেয়ে নাও, এমনিতেই তো পছন্দমত খেতে পারছো না।ডায়েটিংও বন্ধ!মনমেজাজ খারাপ। এত কম খেলে শরীর খারাপ করবে।
আরশান হা-হুতাশ করে বলে,
-কুসুমের কথা শোন। আমাকে তো বলেনা। তোকে তাও বলছে। আশ্চর্যবস্তুগুলো শুধু তোর আর বেবির কপালে থাকে। আমার কপাল তো,
-বকবক না করে খান। (ধমক দিয়ে বলে)
-তুমি আমাকে ধমকাচ্ছো কুসুম? আমাকে? (রেগে)
-হ্যাঁ। তো? (দ্বিগুণ রেগে)
-না কিছু না। খাচ্ছি।
চলবে?