তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১০

0
1503

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_দশ

“সাইরাহ্ আনসারী রোজা” সাফোয়ান আনসারী এবং মিফতাহুল মেহরিন রেণু’র একমাত্র কন্যা। সাফোয়ান আনসারী ছিলেন এ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের ডি. আই. জি। একটি গোপনীয় মিশন চলাকালীন পাঁচবছর আগে বো’মব্লাস্টে তিনি মা’রা যান। টেরোরিস্টদের কিছু গোপন তথ্য আনসারী সাহেবের কাছে ছিল বলে ওদের বাড়িতেও হা’মলা করা হয়েছিল। রোজ তখন কলকাতা অর্থাৎ আরশানের কাছে গিয়েছিল ঘুরতে। আরসালান, রজনী ভাবি, অভী, অয়ন, ফালাকসহ প্রায় সবাই এক সঙ্গেই গিয়েছিল। রোজের বাবা কাজের জন্য যেতে পারেননি আর রেণু আনসারী সাহেবের জন্য।সেই জঙ্গী ও টেরোরিস্ট বাড়িতে এসে ভাঙচুর করে, রেণু বাঁধা দিলে রেণুকেও মে’রে ফেলে। তাদের মৃত্যুর খবর দুদিন পর পৌঁছায় রোজের কাছে। রোজের বয়স তখন তেরো বছর। প্রচন্ড দুষ্টু ও চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে সে। সবাইকে জ্বালাতন করা ওর পেশা! দিনটি ছিল বৈখাশের প্রথম দিন। প্রচন্ড গরমে সে ছাদের কোনায় পা ঝুলিয়ে বসে সামনের আম গাছের থেকে আম ছিড়ে লবন দিয়ে খেতে খেতে গান গাইছিল। ফারহান শ্যুটিংয়ের কাজে দার্জিলিং গিয়েছিল। আজ কালের মধ্যেই ফিরবে। তাই তাঁর জন্যও কিছু আম গুছিয়ে রাখলো রোজ। এলে দুজনে মিলে মাখিয়ে খাবে। আরসালানের বড় ছেলে অভী রোজের পাশে বসেই গল্প করছে আর খাচ্ছে। ঠিক তখনই আরশান আসে ছাদে। রোজ খেতে খেতে পেছনে ফিরে বলে,
-দাদাই তোমার বাড়িতে সব ঘরে এসি নেই কেন? শুধু তোমার আর আঙ্কেলের ঘরে এসি। আমার গরম লাগে তো। এই অভী তোমার গরম লাগে না?

পাঁচ বছরের অভী খিলখিল করে হেসে উঠে বলে,
-লাগে তো। চাচ্চু আমার আর ফুপির ঘরে এসি দেবে। গরমে কালো হয়ে যাচ্ছি আমরা।

আরশানের গলা ধরে আসছে। রোজকে সে কিভাবে জানাবে ওর বাবা-মায়ের কথা?আমীর সাহেব অবধি সাহস পাচ্ছেন না এমন সংবাদ নিয়ে রোজের সামনে আসার। সেখানে আরশান এসেছে। না এসে উপায় নেই, রোজকে তো জানাতে হবে খবরটা।মেয়ে হিসেবে এটা জানার অধিকার আছে ওর। আমীর সাহেব নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছেন। সপ্তাহখানেক আগে আনসারী সাহেব তাকে ফোন করে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন,

-মেয়েটাকে তোদের সঙ্গে পাঠাচ্ছি আমীর। ওকে দেখে রাখিস। আমার পেশায় কখন কি হয় জানি না। আমার কিছু হলে রেণু আর রোজকে তুই নিজের কাছে রাখবি। রোজকে নিরাপদে রাখবি।পরিচয় গোপন রাখবি। কেউ যেন না জানে ও সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে, আনসারী রক্ত ওর শরীরে।

-কি হয়েছে? এভাবে কথা বলছিস কেন? ফারদিনকে নাকি ফোন দিস না অনেকদিন হলো। কোথায় তুই?

-মিশনে আছি। বাড়িতেও তেমন যোগাযোগ রাখতে পারছি না। সকালে রেণুর ফোন পেয়ে রোজকে দেখতে এসেছিলাম। ওদের মাত্র গাড়িতে তুলে দিলাম। এবার আবার ফিরতে হবে। ওদের খেয়াল রাখিস। ফারদিন আর তুই ছাড়া আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না।

-চিন্তা করিস না, আমি আছি তো। আমি কথা দিচ্ছি আমি ওদের খেয়াল রাখবো।রোজকে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছি, রেণু ভাবিকেও যেতে বললাম কিন্তু তোর জন্য যাবে না ভাবি। তুই রোজকে নিয়ে টেনশন করিস না। রোজের সকল দায়িত্ব আমার।

-রাখছি। জিপ চলে এসেছে।

-সাবধানে থাকবি। সময় পেলেই ফোন করবি। অপেক্ষা করবো আমরা।

একসপ্তাহ আগে যারা ছিল তারা আজ নেই। ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে আমীর সাহেবের। বাল্যকালের বন্ধু তারা। একসঙ্গে এক স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি থেকে এই বয়স অবধি একসঙ্গে ছিলেন। কিন্তু এখন এসবের থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোজ। আরশান রোজকে কাছে ডাকল,
-বেবি শোন।

রোজ আম কামড়ে টকে চোখমুখ খিঁচে ফেলেছে। ডাক শুনে সে একচোখ মেলে বলে,
-টাইম নেই। এখন ফালাক ভাইয়ার জন্য আম গোছাতে হবে। ফালাক ভাইয়া কবে আসবে?

-আমার কাছে আয়। তোকে একটা কথা বলতে হবে। জরুরি কথা। ওখান থেকে উঠে এখানে আয়।

রোজকে ডাকার অর্থ হচ্ছে, রোজ যেমন দুষ্টু তেমনই জেদি, রাগি, অভিমানি। যদি খবরটা শুনে লাফ দিয়ে বসে? রোজ উঠে অভীর জামার ওপর আমগুলো দিয়ে আরশানের কাছে আসলো। আরশান রোজের চুলগুলো ঠিক করে বলল,
-অনেক খেয়েছিস। আর খেলে পেট ব্যাথা করবে।
-ওকে। এবার বলো তোমার জরুরি কথা কি? কি বলবে যার জন্য আমাকে, রোজকে তুলে আনলে।

আরশান দম ফেলে বলল,
-তোর বাবা-মা নেই বেবি।

রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এটা নতুন কি? বাবা-মা তো এখানে আসেনি। তারা তো বাড়িতে। তাই এখানে তারা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। আরশান বোকা বোকা কথা বলছে দেখে রোজ হেসে উঠলো,
-তো কি হয়েছে? তোমরা তো আছো। আর আমরাও তো দেশে ফিরবো কিছুদিন পরেই। এখন নেই তখন থাকবে।

আরশানের চোখে পানি চলে এসেছে। মেয়েটা এখনও ওর কথার অর্থ বোঝেনি। বুঝলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? আরশান কেঁদে উঠলো। বলল,
-তোর বাবা-মা মা’রা গেছে বেবি। আঙ্কেল বো’মব্লাস্টে আর আন্টিকে টেরোটিস্টরা খু’ন করেছে।

রোজের হাত আম ছিল। সে সেগুলো নেড়ে চেড়ে দেখে আরশানের হাতে দিতে যাচ্ছিলো। এমন বাক্য শুনে ওর হাত থেকে আমগুলো পড়ে যায়। সর্বাঙ্গ টলে ওঠে। কান কি ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছে নাকি ভুল কিছু শুনলে? হ্যাঁ ভুলই শুনেছে। এমন হতে পারে নাকি? ওর বাবা কত সাহসী বুদ্ধিমান,ব্লাস্টে কিভাবে তাঁর ক্ষতি হবে? আর মা তো বাড়িতে।রোজ আরশানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-এমন বাজে কথা বলবে না দাদাই। আনসারীর মেয়ে আমি। এত সহজে ভয় পাবো না। আর তুমি কি ফালাক ভাইয়ার মত অভিনেতা হতে চাও? কাঁদছো কেন এমন করে? মেজাজ খারাপ করবে না একদম।

আরশান রোজকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে রোজের মাথা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস কর আমাকে।

রোজের চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে। তাহলে এটাই সেই কথা যা আসার আগে রোজকে আনসারী সাহেব বুঝিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন কঠিন পরিস্থিতে নিজেকে কিভাবে সামলাতে হয়। রোজকে বলেছিলেন সে যেন কখনও ভে’ঙে না পড়ে। সর্বদা মনে রাখে সে আনসারীর মেয়ে।আত্মসম্মান নষ্ট, মাথা নত করা, ছোট হওয়া, এগুলো আনসারীর মেয়ের জন্য শোভানীয় নয়। আনসারীর মেয়ে হবে, বাবার মত সাহসী, বুদ্ধিমতি, মায়ের মত কোমল, মমতাময়ী। রোজ আরশানের বুক থেকে মাথা তুলে দুহাতে চোখের পানি মুছে বলে,

-বাবাদের কবর কি দেওয়া হয়ে গেছে?

-হুম। তুই বাজে কিছু করার কথা ভাববি না বেবি। তুই একা নোস্ আমরা সবাই আছি তো। আমরা তোকে অনেক ভালোবাসি। আমি তোকে অনেক ভালোবাসি বেবি। অনেক!

– আমিও তোমাকে ভালোবাসি। আমি কষ্ট পাবো না। কারন তুমি, তোমরা আছো তো। তোমরা আমাকে কষ্ট পেতে দেবে না আমি জানি।

রোজের বুকের ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। ফালাক কোথায়? ওর যে ওর বন্ধু ফালাককে প্রয়োজন। ফালাককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চায় রোজ। কোথায় ফালাক? রোজের কাছে কেন আসছে না সে?

ফালাক শ্যুটিং শেষে সোজা ছাদে চলে এসেছিল। আর এসেই আরশান ও রোজের কথা শুনে সে স্তব্ধচোখে তাকাল। রোজ আরশান একে অপরকে ভালোবাসে? রোজ সেটা নিজ মুখে বলছে? ফালাক এসে রোজকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেল। আরশান ওর এমন কাজে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো। কি হলো ছেলেটার? আরশানও পিঁছু পিঁছু যেতেই দেখলো ফালাক দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। জানালার কাছে এসে সে তাকাল ওদের দিকে। ফালাক রোজের গালে চ’র বসিয়ে বলল,

-কি বললি তুই?কি বললি? তুই দাদাইকে ভালোবাসিস।দাদাইকে? আর আমি? আমাকে? তোকে আমি ভালো ভেবেছিলাম রোজ! কিন্তু তোরও তো সব মেয়েদের মত টাকা চাই তাইনা? আগে সবসময় আমাকে চিনতিস যেই দাদাই আসলো ওমনি পছন্দ পাল্টে গেল? এমন করতে পারলি তুই? কেন করলি এমন? কেন ঠকালি?

বলেই রোজের গলা টিপে ধরল ফালাক। আরশান এটা দেখে দরজা ধাক্কাতে থাকে। সবাই চলে আসে চিৎকার শুনে। রোজ হা করে তাকিয়ে আছে। আরশান জানে এই ধরনের ভালোবাসার মানে। আরশান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে কিন্তু ফালাক ছোট, ও তা পারছে না। রোজও কি ফালাককে ভালোবাসে? নাকি ফালাকের দিক থেকেই শুধু এই অনুভূতি জন্মেছে? ফালাক বলতে থাকে,

-মাত্র তিনদিন ছিলাম না এখানে।তারমধ্যেই ভালোবাসা হয়ে গেল? আর কি হয়েছে? কি দিয়েছে তোকে? বল কি পেয়েছিস? যে আমাকে ভুলতে সময় লাগলো না।

রোজ এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। প্রথমে বাবা-মা আর এখন ফালাক। ফালাক ওকে বাজেভাবে অপমান করছে। রোজ বোঝে এসব কথার ধরন। ফালাক তো রোজের নিরাপত্তার জন্য ওকে সব বুঝিয়ে বলেছিলো। বলেছিল খারাপ ভালোর তফাৎ। তাই ফালাক ওকে সে সব ইঙ্গিত দিচ্ছে তাও বুঝতে পারছে রোজ। আনসারী কখনও নিজের আত্মসম্মান নষ্ট করতে দিতে পারেনা।সবকিছুর উর্ধ্বে তাদের আত্মসম্মান। বাবা তো এসবই বলেছিলেন। রোজের চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। এই ফালাককে রোজ চেনে না। রোজের সম্মান নিয়ে যে কথা বলে, রোজকে যে অবিশ্বাস করে তাকে রোজ মাফ করবে না। কিছুতেই না। রোজ গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে বলল,

-কি বলছো এসব? কেন বলছো?

আরশান দরজা ভেঙে ফেললো। রোজকে একহাতে আগলে ধরে বলল,
-কি করছিস ফালাক? বেবিকে মারছিস কেন? এসব কি কথা? ঠান্ডা হ। আমার সঙ্গে চল আমি সবটা বলে দিচ্ছি। তুই ভুল ভাবছিস।

-ভুল? তোমাদের প্রেমের কথা ভুল দাদাই? তুমি তো সব জানতে।তুমি জানতে এই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। তবুও এমন করলে? কেন করলে? দাদাই কেন? আর তুই তোর কি দরকার ছিল? বয়সের আগে পেঁকে গিয়ে এই হাল করেছিস তাইনা? এখনই ছেলে লাগবে? থাকা লাগবে? আমাকে বলিসনি কেন? আমি থাকতাম।

আরশান সপাটে থাপ্পড় বসালো ফালাকের গালে।রোজ হিচকি তুলে কাঁদছে। আরশান রাগে থরথর করে কাঁপছে। চেঁচিয়ে বলে,

-এসব কি ফালাক? কি বলছিস, তার মানে জানিস? ও আমাদের বেবি, আমাদের প্রিন্সেস! তুই ওকে এভাবে, আর তুই ওকে ভালোবাসিস, ও কি বলেছে ও তোকে ভালোবাসে? রোজ, তুই ফালাককে ভালোবাসিস?

রোজের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ফর্সা গাল লাল হয়ে রয়েছে। রোজ জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
-না! উনি শুধু আমার বন্ধু। আমি কাউকে ভালোবাসিনি ভালোবাসিনা। আর হ্যাঁ এটা সত্য আমি দাদাইকে ভালোবাসি। তবে সেটা ভাই হিসেবে।

ফালাক তাচ্ছিল্য হাসি হেসে বলল,
-সবার সামনে পাল্টি খেয়ে আমাকে খারাপ বানাতে চাইলি চাঁদ? ওকে! তোর এই চাওয়াটাও পূর্ণ করবে ফালাক। খারাপ হবে সে, প্রচন্ড খারাপ। যে খারাপের কল্পনাও কেউ করতে পারবে না।

আমীর সাহেব ফালাকের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-ঠান্ডা হ, ফালাক।কি বাচ্চামি শুরু করেছিস? এধরনের কথা বলার সময় না এখন। রোজকে এভাবে বলিস না। ও সবে খবরটা পেল।

-তুমিও আমাকেই দোষারোপ করলে আঙ্কেল? তোমার ছেলে যেটা করেছে সেটা ঠিক?

-আরশান! ফালাক কি সত্য বলছে? তুই ভালোবাসিস রোজকে? এটা বলেছিস?

আরশানের জবাব,
-বলেছি। আর সেটা সজ্ঞানে বলেছি। ওর মত ছেলের হাতে বেবিকে তুলে দিতে পারবে তোমরা? যে এভাবে বেবিকে মা’রলো, বাজে কথা বললো। প্রয়োজনে বেবির দায়িত্ব আমি নেবো। কিন্তু এই বেয়াদবটাকে এখুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলো।

রোজ আমীর সাহেবের হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
-যেতে বলো ওনাকে। আমি ওনাকে ঘৃণা করি আঙ্কেল। আমার সহ্য হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে। যেতে বলো ওনাকে।

আমীর সাহেব কিছু বলবেন তার আগেই ফালাক বলে,
-আমিও চাঁদ! না চাঁদ না, আমার চাঁদ এমন হতেই পারে না। তুই রোজা, সাইরাহ্ আনসারী রোজা। আমার রোজ এমন ছিল না, আমার চাঁদ এমন ছিল না। সে প্রতারণা জানতো না। তোর মত প্রতারককে আমি ঘৃণা করি। তোর চেহারা আমি দেখতে চাইনা, কখনও না। আমাকে তুই কখনও ফালাক ভাইয়া বলে ডাকবি না। ফালাক নেই, ফালাক বলে কেউ থাকবে না। আমি চলে যাচ্ছি আঙ্কেল, তোমার ছেলের বাড়ি থেকে। তাঁর জীবন থেকে ভালো থাকিস রোজা! খুব ভালো থাকিস।

ফালাক চলে যেতেই আমীর সাহেব আরশানের দিকে তাকালো।এরপর আরশানকে প্রশ্ন করে সবটা জেনে বললেন,
-কেন করলে এমন? কেন বললে তুমি রোজকে ভালোবাসো? তুমি চেনো না ফালাককে? ওর রাগ জেদ জানো না? রোজ ওকে

রোজ কঠিন গলায় বলে,
-ভালোবাসিনা। বন্ধু ছিল। বন্ধুত্ব শেষ। আর ভালোবাসা কি? কাকে বলে? এসব কথা কেন আসলো? দাদাইকে তো আমি ভাইয়ের নজরের ভালোবাসার কথা বলেছি সেটাও দাদাই প্রথমে বললো সেজন্য। আমার মেজাজ ভালো নেই আঙ্কেল। ওই লোক আর এসব কথা বলা বন্ধ করো প্লিজ।

রোজ মুখে এটা বললেও আমীর সাহেব রোজের মনের কথা জানেন। কিন্তু পরিস্থির কথা ভেবে আরশানকে কিছু বললেন না। রজনী রোজকে নিয়ে চলে যেতেই আমীর সাহেব বললেন,
-ঠিক করোনি এটা। ফালাক ভুল করেছে, অন্যায় করেছে। তুমিও সমান ভুল করেছো আরশান।

-বেবি ওকে ভালোবাসে না। আর এমন ছেলে বেবিকে পাওয়ার যোগ্য নয়। আমি বেবিকে ভালোবাসি এটা শুধু ওকে শোনানোর জন্য বলেছি। ওকে বোঝানোর জন্য বলেছি।যেন ওর রাগ হয়, ওর এমন স্বভাব নিয়ে চলে যায় বেবির জীবন থেকে। তুমি ভাবতে পারছো বেবিকে মা’রতে চেয়েছে ও। ওর কাছে বেবি সেফ না। আর তুমি তো বেবির সেফটির দায়িত্ব নিয়েছো। তোমার উচিত ওর ভালো থাকার, নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা করা। ওকে ওমন হিং’স্র, ছেলের কাছে রাখা নয়।

আরশানও রেগে বেরিয়ে গেল। আমীর সাহেব খাটের ওপর বসে পড়লেন। কি থেকে কি হয়ে গেল?ফারদিন ফোন করেছে। আমীর ফারদিনের সঙ্গে কথা বলে সব জানাতেই ফারদিন রেগে গেল। ফালাক রোজের গায়ে হাত তুলেছে? আমীর সাহেব সবটা বলে ওনাকে ঠান্ডা থাকতে বললেন। বাচ্চাদের মধ্যে সমস্যা হয়েছে, ওরা মিটিয়ে নেবে। কিন্তু মিটলো না কিছু। রোজ নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেললো। দেশে ফিরে সে চলে গেল নানাবাড়িতে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আরশানও থেকে গেল ওই দেশেই। আমীর সাহেব সন্তানদের এমন বিচ্ছিন্ন বিচ্ছেদে দুঃখে কষ্টে জর্জরিত। সমস্যা মিটে যেত, কিন্তু আরশান রেগে বানোয়াট কথাগুলো বলে ব্যাপারটা মিটতে দিল না। সব ঝামেলার মূল এই ছেলে। রোজকে আনার জন্য গ্রামে যায় আমীর সাহেব। কিন্তু রোজ স্পষ্ট বলেছে সে ফিরবে না। কারোর সঙ্গে আপাতত সে যোগাযোগ রাখতে চায়না।

এরপর চারবছর পর রোজ শহরে আসে। নানার মৃ’ত্যুর পর গ্রামে থাকার অবস্থা ছিল না ওর। ট্রান্সফার নিয়ে এখানকার কলেজে ভর্তি হবার পর আরশানের সঙ্গে দেখা হয়। আরশান রোজকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে রোজ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আমীর সাহেব নিজে ডেকে পাঠালে রোজ যায়। কিন্তু থাকার প্রস্তাবে রাজি হয়না। এখানে থাকলে পুরোনো ক্ষতে যন্ত্রনা হবে। তাই রোজ আমীর সাহেবের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে একটা ফ্লাট কেনে। আর রেডিওকে কাজ করে সেই টাকা পরিশোধ করার চেষ্টা করছিল। কারন ওর বাবা বলেছিল আনসারী বংশ কখনও কারোর করুনা, দয়ায় বাঁচেনি।রোজ বাবার সম্মান নষ্ট করতে চায়না। কারোর দয়ায় বাঁচতে চায়না। বৃত্তির টাকায় পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। আর রেডিওর মাধ্যমে দিন। আরশানদের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারলেও রোজ এখনও ভাবে ফালাককে নিয়ে। টিভিতে ফালাকের মুভিগুলো দেখে আর ভাবে মানুষটা কতটা বদলে গেল। আরশানের দোষ ছিলনা সেদিন। ফালাকের ব্যবহারে রেগে গিয়ে সে ওসব বলেছিল। রোজও রাগের মাথাতেই সেসব বলেছে, ফালাকও তাই। কিন্তু রোজের কষ্ট লেগেছে ফালাক ওকে অবিশ্বাস করেছে বলে। ভালোবাসলে বিশ্বাস থাকাটা জরুরি ছিল। যাক, অতিত ভাবতে থাকা মেয়ে নয় রোজ। সে অতিত ভাববে না। বাবার ইচ্ছে ছিল রোজ জার্নালিস্ট হবে, বাবার মত সাহসী! দেশের কাজ করবে। নরকের কীটগুলোকে টেনে বের করবে। আজ রোজের ধ্যানজ্ঞান শুধু সেটাই। বাবা-মা ও তাদের স্বপ্নগুলো। রোজ হার মানবে না, কারোর সামনে মাথা নত করে বাবার আদর্শ নষ্ট করবে না। সে বাঁচবে বাবা-মায়ের আদর্শে, সে হাটবে তাদের দেখানো পথে। ভালোবাসা! বাবা-মা ছাড়া কেউ তাকে আদৌ কি ভালোবেসেছে? আমীর আঙ্কেল, ফারদিন আঙ্কেল ও ফারিয়া আন্টি হয়তো বেসেছে। তাদের ভালোবাসাকে সম্মান করে রোজ। এজন্যই তো তাদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ রেখেছে। ফালাকের সঙ্গে যোগাযোগ না’ই বা থাকলো!

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে