#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_আট
সোমবারের সকালে মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। অয়ন্তি তা দেখে মিটিমিটি হাসে।রোজের অনুষ্ঠান যেদিন থাকে সেদিনই কি বৃষ্টি হয়? আজ নীল রঙয়ের এটা থ্রিপিচ পড়েছে অয়ন্তি। কারন রোজ একদিন বলেছিল বেদনার রঙ নীল আর তাই রোজের পছন্দের রঙও নীল। কিন্তু এটা কেন বলেছিল রোজ? ওর কি কোনো কষ্ট আছে নাকি শো করতে করতেই বলেছে। ভাসা মেঘ বাতাসের সঙ্গে দিক পরিবর্তন করে চলে যেতে যেতে স্বচ্ছ করে দিল নীল আকাশটা। রোদের স্নিগ্ধ কোমল আলো এসে পড়ল অয়ন্তির চেহারার ওপর।অয়ন্তি চোখ বুজে রইল। রোদে ভিজতে তাঁর ভালো লাগে, বিশেষ করে এমন নরম কোমল রোদে।কানে ভেসে আসছে পাখির কূজন। হাতের ঘড়িটা ঠিক করে চুলগুলো বেঁধে নিল অয়ন্তি। সেদিন টেবিলে বসে কথাগুলো বলার পর থেকে আরশান আর কোনো কথা বলেনি, অয়ন্তিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছিল। একবার খোজও নেয়নি, ম্যাসেজ দেয়নি, কল করেনি। অয়ন্তি মনে মনে ভাবলো ঝামেলা মিটেছে। পরে আবারও ভাবলো যে ছেলে ওর বন্ধুকে মে’রে হাসপাতালে ভর্তি করল শুধু অয়ন্তি তাকে পছন্দ করে বলে। সে এত সহজে ওকে ছেড়ে দেবে?
আরশান আজ বাড়িতেই এসেছে। অরুনি আরশানের জন্য নাশতা বানিয়ে এনেছে। আশরাফ মীর্জা হেসে হেসে কথা বলছেন যা অয়ন্তির ভালো লাগলো না। এই মানুষটার সঙ্গে এত কথা কিসের? মেয়ের থেকেও উনি বেশি হলো? অয়ন্তি সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল,
-খেতে দাও।
আরশান তাকাল না অয়ন্তির দিকে। অয়ন্তি অপমানিত হলো আরশানের এমন কাজে। তাই রেগে সোজা খাবার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।কিছুক্ষণ পর আশরাফ সাহেব ও আরশানও এসে বসলো চেয়ার টেনে। অয়ন্তি খেতে খেতে আড়চোখে আরশানের দিকে তাকাল। সে কালো রঙয়ের শার্ট পড়েছে। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করেছে, হাতে কালো ঘড়ি, দাড়িগুলো সমান করে কেটে রেখেছে। মডেলিং করতে যাচ্ছে নাকি বিয়ে করতে? এত সাঁজ কেন? অয়ন্তি যে আরশানকে দেখছে তা বুঝে আরশান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চেহারায় কি আসে যায়? যদি মনই মানুষকে আকৃষ্ট করতে না পারে। আরশান না খেয়েই উঠে দাঁড়ালো। অয়ন্তির খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে সে হাত মুছছিল, আরশানকে এভাবে উঠে দাড়াতে দেখে সে থতমত খেয়ে তাকালো। আরশান তর্জনি দিয়ে ঘাড় ডলে বলে,
– শো এগারোটায় শুরু হবে। সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। এখন না গেলে দেরি হয়ে যাবে।আমরা আসছি আঙ্কেল। চিন্তা করবেন না, অয়ন্তিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবো।
আশরাফ সাহেব হেসে বললেন,
-আচ্ছা। আর তোমার বাবাকে বলবে আমি শীগ্রহই দেখা করতে যাবো তাঁর সঙ্গে।
– জি।
গাড়িতে বসেও আরশান অয়ন্তির সঙ্গে কথা বলেনি। সেদিনের কথাগুলোয় কি সে কষ্ট পেয়েছে? কষ্ট যদি পেয়েও থাকে তাহলে অয়ন্তি কি করবে? ও তো ভুল বলেনি। ওর অরুপির বিয়েটাও নড়বড়ে হয়ে গেছে এই বয়সের ব্যবধানের কারনে। ওরও তো তেমনই হবে। সে তো নিজের দিক থেকে ঠিক। বাকিটা রোজের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করবে। রোজ ভালো বুঝবে, সবার সব সমস্যা কি সুন্দর করে মেটায় সে, অয়ন্তির সমস্যাও নিশ্চই মিটিয়ে দেবে।
রেডিও সেন্টারটা পাঁচতলা ভবনের! আরশান গাড়ি পার্ক করে এই প্রথম মুখ খুলল,
-চলো।
-আপনি কি রেগে আছেন?
-না। তবে সেদিনের কথাগুলো ভাবছি। তুমি আমাকে না চাইলে, আমাদের আলাদা থাকাই উচিত। এক হওয়া সম্ভব না।
-আমি ওভাবে বলিনি। ডিফারেন্স’টা আসলেই অনেক বেশি। আপনিও ভাবুন একবার!
-রোজ এখনও আসেনি। রাস্তায় আছে বোধ হয়। এসে যাবে, তুমি গিয়ে আমার কেবিনে বসো। চারতলার দুই নাম্বার কেবিন, নেমপ্লেটে নাম আছে। লিফট ইউজ কর। আমি আসছি একটু।
-কোথায় যাচ্ছেন?
-রোজ আসলে ওকে তোমার কথা বলতে হবে। নাহলে ও শো শুরু করে ফেলবে, আর শো শেষ হতেই ফিরে যাবে।
-ওহ। ওকে।
রোজ এলো সাড়ে দশটায়। আরশান গেটের কাছে বসে আছে।সে চায়না অয়ন্তিকে রোজ কনভেন্স করুক। ওর কষ্ট রোজ সহ্য করতে পারবে না, যদি অয়ন্তিকে রোজ অনুরোধ করে আরশানের জীবনে থাকতে? এটা রোজ ও আরশান দুজনের জন্যই অপমানজনক হবে। অয়ন্তি তো সরাসরিই নাকোচ করে দেবে, তখন রোজ ছোট হবে। যা আরশান একেবারেই চায়না। আরশান চায় না ওর বেবি কারোর সামনে মাথা নত করতে শিখুক।রোজ স্কুটার থেকে নেমে হেলমেট খুলতেই আরশান এগিয়ে আসে।
-কোনো কথা না দাদাই, দেরি হয়ে গেছে। শো শুরু করে আবার শেষ করতে হবে।
-কুসুম এসেছে।
রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আরশান অনুনয়ের সুরে বলে,
-আমার সাপোর্টে কথা বলবি না প্লিজ! অনেক ভেবেছি আর বুঝেছি ও আমাকে চায় না। কথা হয়েছিল ওর সম্মতিতে সব হবে। ও যখন রাজি না। আমি মেনে নিতে পারবো এটা।
-স্যরি? কি বললে?
-আমি সত্যিই মেনে নিতে পারবো বেবি। তুই প্লিজ এই ভুল সম্পর্ক জোড়াতালি দিতে যাস্ না।
-সেটা রোজের কাজ নয়। আর রোজের দাদাই কুসুমকে পাবে না এটাও রোজ চায়না।
-প্লিজ বেবি!
-আমি তোমার নিজের বোন নই, তাই এভাবে বলতে পারছো। কিন্তু তোমাকে আমি নিজের ভাই মনে করি। আমাদের ভাই-বোনের সম্পর্ককে দুনিয়ার মানুষ যা মনে করে করুক, তাতে আমার কিছু আসে-যায় না দাদাই। সে যখন ভুল বুঝে চলে গিয়েছে,তখন আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। আর এই যন্ত্রণা কতটা অসহনীয় আমি জানি সেটা, তাই সেই কষ্ট আমি তোমাকে পেতে দেবো না। তোমার কুসুমকে আমি জোর করবো না তোমার জীবনে থাকার জন্য, কিন্তু কিছু তথ্য অবশ্যই দেবো। যেটা ওর জানা উচিত।
-তুই কিছু বলবি না বেবি।
-রোজ শুধু নিজের কথা শোনে দাদাই। তোমার বা অন্য কেউ আমাকে আমার মতের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে পারবে না। কারন রোজ সাইরাহ্’র নতুন পরিচয়, নতুন সত্ত্বা। সে কখনও পুরোনো সাইরাহ্ এ রোজায় পরিনত হবে না।
রোজ স্কুটারের চাবি নিয়ে চলে আসলো।পথিমধ্যে কিছু সংখ্যক আর’জে রোজের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে রোজ তা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। সবাই জানে এটা রোজের স্বভাব। তাই কিছু বললো না। পাঁচ তলার চার নম্বর রুমটায় রোজের কেবিন। রোজ সেখানে গিয়ে ঠান্ডা পানি পান করে চেয়ার টেনে বসলো। মেজাজটা গরম হয়ে আছে। রোজের ভাই কষ্ট পাচ্ছে! তাও সেই মেয়েটার জন্য যে ওর ভাইকে ঠকিয়েছে? মানুষ এতো বোকা কিভাবে হয়? রোজ বোকামি করেছিল সেটা দেখেও তো আরশান শিক্ষা নিতে পারতো। তা না করে একই ভুল করতে গিয়েছে। প্রেম ভালোবাসা জিনিসটাই বিষাক্ত। ঠিক তখনই দরজায় খটখট শব্দ হলো। রোজ চেয়ার ঘুরিয়ে বিপরীত পার্শ্বে মুখ করে বসলো। এরপর আর’জে রোজের চরিত্র অবলম্বন করে কঠোর গলায় বলল,
-কাম ইন।
আরশান অয়ন্তিকে নিয়ে প্রবেশ করে। অয়ন্তি আমোদে কেঁপে কেঁপে উঠছে। উত্তেজনায় অস্থিরচিত্তে চেয়ারের ওপর পাশ দেখার জন্য উঁকিঝুকি দিচ্ছে। আরশান ধরে আসা গলায় বলল,
-বেবি!
রোজ চেয়ার ঘুরিয়ে তিক্তকন্ঠে বলল,
-নো! নট বেবি আর’জে খাঁন! আমি রোজ, ফর নাও। হোয়াট হ্যাপেন্ড? আমার শো’টাইমে বিরক্ত করছেন কেন?
অয়ন্তি হা করে চেয়ে আছে। শনিবার তো ভারি মিষ্টি করে কথা বলেছিল মেয়েটা। এখন এমন রুক্ষ ব্যবহার কেন? আর রোজা এখানে কি করছে? রোজ কোথায়? রোজা নিজেকে রোজ বলছে কেন? আরশান হতাশ কন্ঠে বলল,
-কুসুম কথা বলবে আপনার সঙ্গে।
-ওকে! উনি কি আজকের গেস্ট? নমুনার প্রকারভেদ তো শিডিউলে রেখেছিলাম। দ্যেন উনি?
-পার্সোনাল মিটিং আর’জে রোজ।
-এ্যাজ?
-ইউর ব্রাদার্স ফ্রেন্ড!
রোজ শীতল চোখে তাকালো। এরপর কন্ঠ নরম করে বললো,
-বসো।দাদাই তুমি কি কিছু বলবে?বললে থাকো নাহলে বের হও।গ্যাদারিং পছন্দ না আমার। আর অয়ন্তি নাকি কুসুম? অয়ন্তি! কুসুম ডাকটা দাদাইয়ের জন্য থাক। কি নেবে তুমি? চা-কফি-কোল্ডড্রিংস? আই থিংক তোমার পানি প্রয়োজন। যাওয়ার সময় পানি পাঠিয়ে দিও দাদাই। নাও গো প্লিজ।
আরশান করুন চোখে চাইলো। রোজ রেগে আছে। কিছু বলে দেবে না তো? মেয়েটা রেগে গেলে তো রণচণ্ডী রূপ ধারণ করে। আরশান বেরিয়ে যেতে যেতে রোজকে টেক্সট করলো। রোজ ফোনের নোটিফিকেশন দেখেই ফোনটা বন্ধ করে দিল। সর্বনাশ! ম্যাসেজ তো দেখলোই না। নিরুপায় হয়ে আরশান বেরিয়ে যেতেই রোজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অয়ন্তির দিকে তাকায়।
-বসবে না? কাজ না থাকলে যেতে পারো। আমার শো শুরু করার সময় হয়ে যাচ্ছে।
অয়ন্তি বসলো। একটা ছেলে এসে পানি দিয়ে যায়। রোজ পানির গ্লাসটা অয়ন্তির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-পান করো। বুঝতে পারছি আমাকে এভাবে দেখে ভয় পেয়েছ। ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আর’জে হিসেবে আমি এমনই। তো বলো কি করতে পারি তোমার জন্য।
-আ,,আ,,আসলে,
-পানি পান করো আগে। গলা ভিজিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলো। তোমার গলা কাঁপছে।
রোজের এমন ক্রোধমিশ্রিত কন্ঠে অয়ন্তি ভয় পেয়ে যায়। রোজ বিরক্তচোখে তাকায়। এরপর উঠে গিয়ে অয়ন্তির পিঠে হাত রেখে নিজেই গ্লাসটা অয়ন্তির মুখের সামনে ধরল। অয়ন্তি পানি পান করেও শান্ত হতে পারল না। রোজ নিজের ওরনা দিয়ে অয়ন্তির কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলে,
-এত ভীতু কেন? একটু রেগে কথা বলেছি বলে এমন ব্যবহার করছো যেন তোমাকে শূলে চড়ানো হবে শুনেছো। বি ইজি! আমি বাঘ ভাল্লুক নই আপু।
অয়ন্তি ঠান্ডা হয়ে বসে বলল,
-আমি আসলে আরশান মানে তোমার দাদাই। আসলে, তোমার বন্ধু।
-আমার শো শোনো তুমি?
-হুম।
-কি মনে হয়? আমি কেমন? ভালো বুদ্ধি আদৌ দিতে জানি? যা বলি তা কাজে দেয়?
-দেয় তো।
-তাহলে আজ যা বলবো, আশা করি মন দিয়ে শুনবে। দাদাইকে তুমি ভালোবাসো না, এটা তোমার কেন মনে হয়?
-মানে?
-মানে, তুমি ওকে ভালোবাসো না এটা বুঝলে কি করে? সিনটম গুলো কি? ওকে দেখলে রাগ হয়? ওর চেহারা খারাপ লাগে? ওর কথাবার্তা খারাপ?কন্ঠ ব্যবহার?
-একটু শান্ত হয়ে কথা বলবে?
রোজ এবার নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। কফির কাঁচের কাপটা মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে বলল,
-পারছি না। তোমরা এমন কেন? ভালোবাসা পেলে তার মর্ম বোঝো না?
অয়ন্তি ভয়ে কেঁদে উঠলো। রোজ এমন করছে কেন? রোজ জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে। রাগা যাবে না, অয়ন্তি কাঁদছে। আরশানের ভীতুর ডিম কাঁদছে, একে কাঁদতে দেখলে ওটাও কাঁদবে। রোজ পানি পান করে বলল,
-কেঁদো না। আর রাগ করছি না আমি। শান্তভাবে কথা বলছি। কেঁদো না অয়ন্তি আপু। তোমাকে কান্নায় ঠিক মানায় না। হুস! চোখ মোছো, চোখ মুছে আমার কথাটা শোনো। তোমার এগুলো জানা প্রয়োজন। তোমার ছোট জীবনে যা যা ঘটেছে ঘটছে সবকিছু সম্পর্কে তোমার অবগত থাকা উচিত।
-ক,কি ব,বলতে চাইছো?
-সত্যটা। যেটা তুমি জানো না।
“”তুমি তখন ক্লাস টেনে পড় অয়ন্তি আপু! বয়স মাত্র ষোলো! আর দাদাই’য়ের বয়স তখন আটাশ, তোমাদের মাঝে তখন কিছু সুন্দর মুহুর্ত এসেছিল, তোমরা একে অন্যকে চেনার জানার চেষ্টা করেছিলে। তবে তোমার মনে তখনও দাদাইকে নিয়ে কোনো প্রেমের ভাবনা উঁকি দেয়নি। দাদাইকে তোমার ভালো লাগতো, দাদাইয়ের চালচলন তোমাকে মুগ্ধ করেছিল। ব্যাস এটুকুই, দাদাই চেয়েছিল তুমি নিজ থেকে যখন দাদাইকে চাইবে দাদাই তখন নিজের মনের কথা বলবে। কিন্তু এরপর তুমি চলে আসো দেশে, তোমার পরীক্ষার সময় আসে, অনা আপু ব্যস্ত হয় পড়ে নিজের সাংবাদিকতা নিয়ে। তোমার পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে, হয়তো চার থেকে পাঁচটা পরীক্ষা দিয়েছিলে! তুমি যেবার লাস্ট পরীক্ষা দিচ্ছো মানে তোমার পাঁচ নম্বর পরীক্ষা সেদিন পুরো দেশে রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় কোনো বিষয় নিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা চলছিল। অনা আপু সেটা স্যুট করছিল বেশ ভালো করে। তুমি পরীক্ষা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বের হয়েছিলে তখনই তুমি দেখতে পাও রাস্তায় জমে থাকা শতসহস্র মানুষের ভীড়। ভীড়ের মধ্যে তোমার অনাপিও ছিল। পুলিশ, র্যাব, কিছু মুখোশধারি ছাত্রনেতা, ভালো মন্দ মেশানো একটা দারুন ভীড়। গুলিবর্ষণ হওয়া দেখে তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলে, জনতা গিয়েছিল ক্ষেপে। ইট, পাটকেল, লাঠি, টায়ার পোড়ানো, কাঁদানে গ্যাস মা’রামা’রিতে যখন চারপাশ গরম তখন তোমার অনাপির এক্সিডেন্ট হয়, একটা মালবাহী ট্রাক পিসে দিয়ে যায় তাঁর শরীর। সবটা তোমার চোখের সামনেই হচ্ছিল, তুমি দেখছিলে কিন্তু স্বচক্ষে এমন দৃশ্য দেখার পর তুমি পাথরের ন্যায় হয়ে গিয়েছিলে। শরীরের সব ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তুমি চিৎকার দিয়ে সামনে এগোতেই একটা ইট এসে তোমার কপাল বরাবর লাগে। রক্ত গ’লগ’ল করে বেরিয়ে আসলেও তুমি থামো নি। ছুটে গিয়েছিলে অনা আপুর কাছে। ঠিক তখন একটা প্রাইভেট কার দ্রুতবেগে ওই স্থান থেকে সরে যাওয়ার সময় তোমারও এক্সিডেন্ট হয়। ভাগ্যক্রমে তুমি বেঁচে গেলেও অনা আপু বাঁচেনি। টানা পনেরোদিন তুমি অজ্ঞান ছিলে। দাদাই দেশে ফিরেছিল। অনা আপুর লাশ দেখতে না পারায় সে কতটা যন্ত্রনা পেয়েছিল তা আমি জানি। প্রথমে তোমার খবর কেউ দাদাইকে দেয়নি কিন্তু পরে যখন তোমার কথা জানলো দাদাই তখনই ছুটে গিয়েছিল তোমার কাছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। অরুনি আপুর বিয়ে হওয়ার পাঁচ মাস চলছিল। সে চিনতো দাদাইকে। তাই সে নিজেই তোমার কথা বলেছিল। বলেছিল তুমি গত দেড়বছরের সকল কথা ও তার আগের কয়েকমাসের কিছু কিছু কথা ভুলে গিয়েছো। তুমি বিশ্বাস করবে না অয়ন্তি আপু, দাদাই তাঁর কুসুমের জন্য পাগলপ্রায় হয়ে ঘুরছিল। যাক দাদাই’য়ের কথা এখন বাদ। তুমি তোমার কথা শোনো। তুমি সব ভুলে যাওয়ার পর ডাক্তাররা বলেছিলেন তোমাকে এবং তোমার মাথায় যেন কোনো প্রেসার না পড়ে। তাই কেউ তোমাকে জানায়নি তোমার বয়স সতেরো পার হয়ে যাচ্ছে। ষোলো সতেরো পার হওয়ার সময় তুমি আবারও টেনে ভর্তি হও। পূর্বের ন্যায় আবারও সবকিছু চলতে থাকে। তুমিও জানতে থাকো তোমার বয়স ষোলো! এরপর তুমি আগের মত থাকতে শুরু করো।
তুমি শুধু জানতে একটা এক্সিডেন্টে তোমার অনাপি মা’রা গেছে। এর বেশি কিছুও তোমাকে জানানো হয়নি। তুমি ভাবতে জার্নালিজম অনাপির প্যাশান, আবেগ, ইচ্ছে। তাই সেটা পূরণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলে। ম্যাট্রিক দেওয়ার পরই যখন এসব কথা তুললে তখন সবাই আবারও ভয় পায়। দাদাইয়ের কানে আসে কথাটা, অনাপির মৃ’ত্যুর সময় মাহিন ভাই নিজেও হার্টএট্যাক করেছিল। অনাথ ছেলেটার বাঁচার কোনো কারন হয়তো ছিল না, আত্মহত্যা মহাপাপ বলে হয়তো বিধাতা ওনার কষ্ট দেখে নিজেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। এসব দেখে সায়ন ভাইয়া ঘাবড়ে গিয়ে তোমাদের বাড়িতে সবটা বলে দেয়। কারন মাহিন ভাই অনাপিকে যতটা ভালোবাসতো, আমার দাদাই তার থেকেও অনেকগুন বেশি ভালোবাসতো তোমাকে। যদি তোমার কিছু হত তাহলে আমার দাদাই বেঁচেও মরে থাকতো অয়ন্তি আপু।
শুধুমাত্র তোমার জন্য তোমার পরিবার লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফেক সার্টিফিকেট, ফেক বার্থ সার্টিফিকেট বানায়, হিসেবে তোমার আসল নকল দুটো সার্টিফিকেটই আছে। নকলটা তোমাকে দেখানোর জন্য, তোমাকে অতিত থেকে দূরে রাখার জন্য, তোমার ব্রেনের চাপ কমানোর জন্য। আর আসলটা তোমার জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো ধরে রাখার জন্য ছিল। তোমার অনাপি সবসময় চাইত দাদাইয়ের সঙ্গে তাঁর বোনের সুখের সংসার দেখবে। তা আর হলো কই? তোমাকে দাদাই এই ক’মাসে যে কম কাছে পেয়েছে তা নয়। তোমাকে লুকিয়ে দেখেছে, তোমার কাছে গিয়েছে।তোমাকে মনের কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তোমার সজ্ঞানে তোমার সামনে যেতেই ওর প্রচন্ড ভয় করতো।এই শুক্রবার রাতে সে চাইলেই তোমাকে কাছে পেতে পারতো। ছুঁয়ে দিতে পারতো। এতগুলো বছরের যন্ত্রণার বদলে তা কমই হতো। তাঁর হাতে সময় সুযোগ দুটোই ছিল।তবুও তোমাকে একটুও স্পর্শ করতে পারেনি, চুঁমুর বদলে যখন চর খেল তখন বুঝলো সে ভুল। সে তো এমন করতে পারবে না। এটা অন্যায় করা হবে তোমার সঙ্গে, তোমার অনাপির সঙ্গে। কারন সে তোমার অনাপিকে কথা দিয়েছিল বিয়ের আগে কিছু করবে না, তোমাকে ছোঁবে না।তোমার সম্মতি ছাড়া কিছু হবে না।
তোমার বয়স এখন কুড়ি অয়ন্তি আপু। আঠারো নয়। মিথ্যা আকড়ে বাঁচা কঠিন। সত্য জানার পর যতটা কষ্ট পাবে তা কাটিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু দিনের পর দিন মিথ্যে নিয়ে কিভাবে থাকবে? দাদাই তোমার থেকে তেরো বছরের বড়, এটা তুমি সমস্যা মনে কর? যখন দাদাই শুনেছিল, মানে তোমার সার্টিফিকেটের বয়সটা শুনেছিল, ছয় বছরের একটা বাচ্চা ভেবে তোমাকে দেখেছিল তখন তাঁর কি হয়েছিল একবার ভাবো। সে নিজেকে ঘৃণা করতো, তোমাদের থেকে দূরে কলকাতা মানে তাঁর চাচার বাংলোয় থাকতো।সে কিন্তু নিজ থেকে আসেনি, তোমার অনাপি তাকে তোমার কাছে আসতে দিয়েছিল। তুমি তাকে এটা ফিল করিয়েছিলে যে তুমি তাকে পছন্দ করো। সে সবকিছু ভুলে শুধু তোমাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল, তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল এটা কি তাঁর ভুল? যদি ভুল হয় সে শাস্তির যোগ্য। তাকে ছেড়ে চলে যাও, এটাই তাঁর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। কিন্তু এই চারটা বছর, তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? আটবছর ধরে সে নিজেকে যতটা সামলেছিল এই চার বছরে সেই সামালটুকু তো গুড়িয়ে গেছে।
ভুলে যাওয়া মানুষের হিউম্যান ন্যাচার অয়ন্তি আপু। সে ভুলে যাওয়া’টা হতে পারে কিছু দিনের জন্য, মাসের জন্য, বছরের জন্য, যুগের জন্য অথবা সারাজীবনের জন্য। কিন্তু যদি মনে পড়ে? তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তো? আমি তোমার ছোট তবে বেশি না মাত্র দু বছরের। আমার আঠারো চলছে, তোমার সঙ্গেই ইন্টার দিলাম। তোমার সম্পর্কে জেনেছি বছরখানেক হয়েছে। দাদাই নিজে সবটা বলেছে আমাকে।সবাই বলে আমি বয়সের তুলনায় বেশি ম্যাচিউর। অনেকটা বুঝি। তাই সেই বুঝ থেকে বলছি দাদাইকে ছেড়ে যেও না। তাঁর হাত একবার ধরলে সে তোমাকে কখনও ছাড়বে না।
তোমার ব্যাপারে বিশ্লেষণ করে যে তথ্যগুলো, তোমার রোগ ও সমস্যা জেনেছি তা হচ্ছে। তোমার সাময়িকের জন্য মেমরি লস হয়েছে। তোমার মেমরি ফেরার সম্ভাবনা আছে। তবে সেটা পঁচিশ পার্সেন্ট। তখন যদি তোমার ওপর প্রেসার দেওয়া হত তাহলে হয়তো অনেক প্রবলেম হতো। তুমি ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল বলো না। সেই স্মৃতিগুলো তোমার চোখের সামনে অস্পষ্ট ভাসে। এটা যেমন ভালো লক্ষণ তেমনই আবার খারাপও। এক্সিডেন্টের সময় তোমার একটা মিনি অপারেশন করা হয়েছিল। তোমার মাথার পেছনে ছোট একটা কাঁচের টুকরো ঢুকে গিয়েছিল। তাই ডাক্তারদের ধারণা তোমার ব্রেনে চাপ পড়লে তোমার শর্টটার্ম মেমরি লস হতে পারে।এই মেমরি লস কতটা ভয়াবহ সেটা নিয়ে তোমার কোনো ধারনা নেই। এই মেমরি লস যাদের হয় তারা ১৫ মিনিট, কোনো কোনো সময় ৮০ মিনিট পর পর সব ভুলে যায়, কোনোকিছুই তাদের মনে থাকে না। নিজের পরিবার, ঠিকানা, এমনকি নাম অবধি সে মনে করতে পারে না। আর এগুলো হওয়ার কিছু কারন হলো, নির্ঘুম থেকে রাত জাগা, ক্লান্তি, অবসাদ, কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা। যদিও তোমাকে নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা নেই, তবে অতিরিক্ত মানসিক চাপে তোমার ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়া যেকোনো মুহূর্তেই তোমার স্মৃতি ফিরে আসতে পারে। সবাই শুধু সেই শুভক্ষণের অপেক্ষায় আছে।
কথাগুলো তোমাকে আমি বলতাম না। শুধুমাত্র দাদাই আর তোমার ভালোর জন্য বললাম। তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাও, আমার কথা তোমার ভালো লাগে। বারবার দাদাইকে রিকোয়েস্ট করেছো আমার সঙ্গে দেখা করবে বলে, তাই আজ দাদাই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তোমার ধারণা আমি স্পেশাল, কিন্তু তা একদমই সত্য নয়। আমি খুবই সাধারণ, তোমাদের থেকেও সারাধণ, তোমাদের মত সৌভাগ্য আমার নেই। ওহ হ্যাঁ, তুমি আমাকে নিয়ে দাদাইকে সন্দেহ করছিলে, সন্দেহ করার কিছু নেই আপু। আমাদের বাবারা বন্ধু ছিলেন। সেই সূত্রে আমরাও বন্ধু। আমি ওদের থেকে অনেক ছোট তাই আরসালান দাদাভাই আর আরশান দাদাই আমাকে একটু বেশি ভালোবাসে। রজনী ভাবিও তো জানে এটা, তুমি ভাবি হয়ে আসলে তুমিও জানতে পারতে। আর আমার ওপর ওরা বেশি কেয়ার করে কারন প্রায় পাঁচবছর আগে আমার বাবা-মা মা’রা গিয়েছেন। আমি অনাথ, আপনজন কেউ নেই সেজন্য।
জানো, ডাক্তার বলেছিল অতিতের পুনরাবৃত্তি করলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। আর তা না হলে সারাজীবনের জন্য হারাবো তোমাকে। তোমার পরিবার একবার মত দিয়েছিল এই কাজে। কিন্তু দাদাই তোমার বাবার কাছে গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করে। বুঝতে পারছ? ত্রিশ বছরের একজন কঠিন মনের পুরুষ তোমার বাবার হাত ধরে কেঁদেছিল। আমি বলছি না, তুমি অতিত মনে করো, বা অতিতের ব্যবহার পুনরায় করার চেষ্টা করো। তুমি যেমন আছো তেমনই থাকো। এভাবে যদি দাদাইকে ভালোবাসতে পারো, তাহলে ভালোবাসো। নাহলে আমাকে জানাও তোমার জীবনে দাদাইয়ের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার ব্যবস্থা আমি নিজে করে দিচ্ছি।
কাউকে ভালোবাসলে অতিত বর্তমান ম্যাটার করেনা অয়ন্তি আপু। কিন্তু যদি ভালোই না বাসো তাহলে এই সম্পর্ক এগিয়ে তুমি ও দাদাই নিজেদের জীবন কেন নষ্ট করবে? যদি বয়সটা ফ্যাক্ট হয় তাহলে একটা ছোট গল্প বলি। আমার দাদা ও দাদির বয়সের তফাৎ আঠারো কুড়ি ছিল, গ্রামের সময় ছিল তো। অল্প বয়সে দাদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আর দাদার আগের বিয়ে ছিলো। বড় দাদি মা’রা গেলে তিনি আমার দাদিকে বিয়ে করেন। তাঁর দুবছরের ছেলের জন্য। কিন্তু পরে তারা দিব্বি সংসার করেছে। আমার বাবা-মায়ের বয়সের গ্যাপ কম ছিল তবে সেই বড় চাচা ও চাচির বয়সের গ্যাপটাও ছিল পনেরো ষোলো। সবাই বলতো, বাবার ধারায় এমন করেছেন তিনি। তবুও তাদের সংসার সমান হিসেবেই চলেছিল। কারন কি জানো? তারা বয়সটাকে প্রাধান্য দেয়নি। তারা ভালোবেসেছিল। তারা অবশ্য দেখতে বুড়োও হয়ে গিয়েছিল। সেদিক থেকে তোমার কপাল তো বাঁধানো কপাল, যে দাদাইকে এখনও পঁচিশ’ছাব্বিশ বয়সের যুবকই লাগে। তুমি বাস্তবতা বোঝাতে চাইছ? বাস্তবে অনেকে সুখি হতে পারেনা বয়সের ব্যবধানে সেটা বলতে চাইছো। জীবন নষ্টও হয় এমন বিয়েতে সেটা বলতে চাচ্ছো!
বয়সের ব্যবধান কখনও সমস্যা হতে পারেনা যদি সেই মানুষ দুজনের মনের মিল থাকে। আমি আমার এই ছোট জীবনে অনেক ট্রাভেল করেছি। ছোট থেকে গ্রামে বেশি সময় কাটিয়েছি। তাই বয়সের ব্যবধানের সমস্যা সম্পর্কেও কিছুটা জানি। প্রধানত এখানে যদি কোনো সমস্যা হয় তা হচ্ছে চিন্তাধারা। জেনারেশনের ব্যবধান। স্বামীর বয়সের জেনারেশন বনাম স্ত্রীর জেনারেশন। যদি বয়স্ক কেউ বাচ্চাকে বিয়ে করে, অবশ্যই ভালো না বেসে, কিংবা এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। তাহলে মনের মিল হতে সময় তো লাগবেই। যদি সম্পর্কটাকে সময় দেওয়া না হয়,একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করা না হয়, একে অন্যকে হেয় করার চেষ্টা, কটাক্ষ করার চেষ্টা করা হয় তাহলে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে ওঠা মুশকিল। আমাকে দিয়ে উদাহরণ দিচ্ছি। আশা করবো এটা তুমি কাউকে বলবে না। দাদাইকেও না। আমি একজনকে ভালোবাসি। সে আমার থেকে বারো বছরের বড়। সে আমাকে বোঝেনি, বোঝার চেষ্টা করেনি, আমার ভালোবাসাকে গুরুত্ব দেয়নি। আমাকে ফেলে চলে গেছে। বয়সের ব্যবধানকে দোষ্ দিতে পারি আমি। কিন্তু দেবো না, কারন কি জানো এখানে বয়সের দোষ্ নেই। দোষ্ মনের। আমি তাকে ভালোবেসেছি। সে বাসেনি। তাই সম্পর্ক টেকেনি।সে যদি আমাকে বুঝতো তাহলে ছেড়ে যেত না। তবে বয়সের ব্যবধানের একটা বেনিফিট হচ্ছে আন্ডার্স্টান্ডিং। তোমার স্বামী যদি তোমার থেকে বড় হয়, তাঁর অভিজ্ঞতা তোমার থেকে বেশি থাকবে, তাঁর বোঝার ক্ষমতা বেশি থাকবে। সে যদি তোমাকে বোঝে তাহলে তোমার কিছু বলার প্রয়োজন পড়বে না। সে তোমাকে দেখেই তোমার মনের কথা বুঝে ফেলতে পারবে। আর একটা কঠিন, বিশ্রি তিক্ত সত্য হচ্ছে, তুমি তোমার অরুপির জীবন দেখে প্রভাবিত হচ্ছো। তুমি কি সত্যিই জানো তোমার অরুপির সংসার ভাঙার কারন কি?সে বয়সের ব্যবধানকে সম্মুখে প্রকাশ করছে তাই তোমরা ধরে নিচ্ছো সে ব্যবধানজনিত কারনে সংসার করতে পারছে না। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, সে আমার দাদাইকে ভালোবাসে। তুমি হয়তো জানো না,তাঁর সঙ্গে দাদাইয়ের বিয়ের একটা কথা হয়েছিল যেটা দাদাই প্রথম বারেই নাকোচ করে দেয় শুধু তোমার জন্য। তোমাকে দাদাই প্রচন্ড ভালোবাসে বলে। দাদাইয়ের এমন ভালোবাসার সামনে বয়সের ব্যবধান নিতান্তই তুচ্ছ অয়ন্তি আপু।
একটা মানুষ বারো বছর ধরে তোমাকে ভালোবাসে। এটা সহজ বিষয় নয় অয়ন্তি আপু। কঠিনের থেকে কঠিন একটা পরিস্থিতি পার করে দাদাই আবারও তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। তাঁর স্বপ্ন ভে’ঙে দেবে নাকি পূরণ করবে তা তুমি জানো।
আমি শুধু এটুকুই বলবো,ওকে ভালোবাসতে যদি তোমার সময়ের প্রয়োজন পড়ে, সময় নাও। তবুও ওকে ছেড়ে যেও না। ওকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে তখন। তোমার বাবা যখন নিজ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় তখন আঙ্কেল সরাসরি সে প্রস্তাব নাকোচ করে দেয়। প্রাপ্ত ছেলেটার চক্করে পড়ে যাচ্ছিলে, তোমার সৌন্দর্যে সবাই মুগ্ধ হচ্ছিল, বখাটে বাজে মানুষের নজর পড়ছিল দেখে তোমার বাবা নিজেই অনুরোধ করেন দাদাইকে যেন সে তোমার জীবনে আসে। অনাপি তোমার বাবাকে দাদাই সম্পর্কে সব বলে রেখেছিল, অনাপির চাওয়া একসময় তোমার বাবার চাওয়ায়ও পূর্ণ হয়। তোমার বাবাও চায় তাঁর মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকুক। আর তাঁর জন্য রাজা হিসেবে আরশানের থেকে বেটার কেউ নেই।
এখন বলো তুমি কি চাও? মানুষটাকে বেঁছে নিতে নাকি জার্নালিজম বেঁছে সবাইকে কষ্ট দিতে। তোমার অনাপি যদি থাকতো তাহলে সে হয়তো কখনই তোমাকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দিত না। “”
কথাগুলো বলে রোজ ওর শো শুরু করার প্রস্তুতি নেয়। আড়চোখে কয়েকবার অয়ন্তিকেও দেখল সে। অয়ন্তির কপালে ঘামের বিন্দু বিন্দু ফোটা জমছে। চিন্তিত দেখাচ্ছে অয়ন্তিকে। ভেতরে কিছু একটা তালগোল পাঁকাচ্ছে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না সে। রোজও ওকে জোর করল না। রোজের প্রতিটা কথা সত্য এবং অয়ন্তি তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছে। যতটুকু সন্দেহ আছে তা বাড়িতে গিয়ে সব সার্টিফিকেট চেক করলেই জানতে পারবে। রোজ কফি পান করে গলাকে আরাম প্রদান করে অয়ন্তির দিকে তাকালো। অয়ন্তির ঠোঁট কাঁপছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে সে। অবশেষে জড়তায় ঘেরা কন্ঠে অয়ন্তি বলে ওঠে,
-সব যদি সত্য হয় তাহলে আমি আরশানকে সুযোগ দিতে চাই। ভালোবাসতে চাই, কিন্তু যদি মিথ্যে হয় তবে সারাজীবনের মত আমাকে হারাবে সে।
-পরখ করে দেখতে পারো।রোজ কখনও মিথ্যা বলেনি। কারন সাইরাহ্ এ রোজা মিথ্যা বলার শিক্ষা পায়নি।
চলবে?