তি আমো পর্ব-০২

0
1815

#তি_আমো❤
পর্ব – ২
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ভদ্রমহিলা ঘাড় ঘুরিয়ে আবার ছেলেটার দিকে তাকালেন। তাকিয়ে বললেন,

ঈশান, এইটা তারিন। নিহার বেস্ট ফ্রেন্ড। খুব মিষ্টি মেয়ে তাইনা?

ছেলেটা মৃদু হাসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

হ্যা খুব মিষ্টি। কিন্তু এপেল জুসের মতো না।

ভদ্রমহিলা হাসিমুখেই ভ্রু কুচকে বললেন,

মানে?

মানে তোমার এপেল জুসে মিষ্টি ঠিক হয়েছে কিনা দেখো। বেশি মিষ্টি তো হলে তো আবার চেঞ্জ করে আনতে হবে।

ও, হ্যা দেখছি। ( গ্লাসে চুমুক দিয়ে) হ্যা ঠিকই তো আছে। বরং কম মিষ্টি হয়েছে। হালকা টক টক লাগছে।

ছেলেটা আবারো হাসলেন। হাসির সাথে ঝকঝকে সাদা দাতগুলোও বেরিয়ে আসল। আকাবাকা দাতের ঝলকানো হাসি, খুব সুন্দর দৃশ্য। আমার দিকে আঙুল ইশারা করে ছেলেটা বললেন,

ওইযে মিষ্টি মেয়ে আছে না? পুষিয়ে নাও।

ভদ্রমহিলা ছেলের গালে হালকা চড়ের মতো দিয়ে বললেন,

ঈশান! সবসময় ইয়ার্কি।( হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকালেন) তুমি কিন্তু কিছু মনে করোনা তারিন। ও এমনই।

আমি তো অনেক কিছুই মনে করছি। কিন্তু কিছু প্রকাশ করতে পারছি না। এই বেদনা লুকিয়ে রেখে খুশি ভাব দেখিয়ে বললাম,

না আন্টি। কিছু মনে করিনি।

ছেলেটা চলে যেতে নিচ্ছিলেন। কিন্তু আন্টি যেতে দিলেন না। টি শার্ট টেনে ধরে বসতে বললেন উনার পাশে। ছেলেটাও বসে পড়লেন। বাধ্য ছেলের মতো আন্টির বিপরীত পাশে। তবে আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা বসতেই চাইছিলেন, শুধু মায়ের অনুরোধের অপেক্ষায় ছিলেন। এখন অনুরোধ পেয়ে গেছে, তাই নির্দ্বিধায় বসেও পড়েছেন। আন্টি ছেলের কাধে হাত রেখে বললেন,

কিছুক্ষণ আগে একটা মেয়ের সাথে মিসবিহেভ হলো না? তারিনই কিন্তু সেই মেয়ে। কত বড় ফাজিল ছেলে একবার চিন্তা কর? আমার তো ইচ্ছে করছে এখনি ছেলেটাকে দু চার ঘা লাগিয়ে আসতে। হাতের কাছে পেলে না, কম হলেও চার পাচটা চড় মেরে বুঝিয়ে দিতাম একদম।

আন্টির কথায় ছেলেটা ভ্রু কুচকে কৌতুহল নিয়ে বললেন,

তাই নাকি? উনিই সেই মেয়েটা? ( আমার দিকে তাকালেন) আচ্ছা, আপনি কি ছেলেটার মুখ দেখেছিলেন?

আমি মাথা নাড়িয়ে না বুঝালাম। বললাম,

মুখ দেখিনি। মাস্ক পড়া ছিল। মাংকি মাস্ক।

মা ছেলে দুজনই উচ্চারণ করলেন, হোয়াট?

আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম,

হ্যা! থাকে না কতগুলো মাস্ক, একদম মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে যায় শুধু চোখ খোলা থাকে। অনেকটা বানরের মুখের শেপ। তাই বললাম মাংকি মাস্ক। আর একটা কোর্ট টাইপ কালো কাপড় গায়ে জড়ানো ছিল। তাই উল্লেখযোগ্য কিছু খেয়াল করিনি।

ছেলেটা ভ্রু নাচিয়ে ঠোট উল্টে বললেন,

ও আচ্ছা!

আন্টি বললেন,

তাহলে তো আমার মনে হয় ছেলেটা চোর-ডাকাত কিছু হবে। তার মুল উদ্দেশ্য ছিল তোমার ব্যাগ হাতিয়ে নেওয়া। দেখো তো তোমার ফোন, টাকা-পয়সা সব ঠিকঠাক আছে কিনা?

আন্টির কথায় ছেলেটা বিষম খেলেন। অনেকটা রাগী কণ্ঠে বললেন,

আরে কি আজাইরা কথা বলছো মম! চোর–ডাকাত হতে যাবে কেনো? আর চোর-ডাকাত কি এভাবে আসে? তাদের কাছে ধারালো ছুরি থাকে, পিস্তল থাকে, এসব দেখিয়ে তারা মানুষকে ভয় দেখায়। আপনার সাথে কি ছেলেটা এমন কিছু করেছে? ( আমার দিকে তাকিয়ে)

আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। ছেলেটা আন্টির দিকে তাকিয়ে বললেন,

দেখেছো? আসলে চোর ডাকাত কিছু না।

আন্টি বললেন,

তাহলে তুইই বল? কি উদ্দেশ্য নিয়ে ছেলেটা এমন করেছে?

ওই ছেলের উদ্দেশ্য আমি কিভাবে জানবো? তবে আমরা শুধু খারাপটাই চিন্তা করছি। ছেলেটার কোনো ভালো উদ্দেশ্যও তো থাকতে পারে।

আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

দেখেছো তারিন কি আজগুবি কথা বলে? ভালো উদ্দেশ্য থাকলে এভাবে লুকিয়ে আসতো নাকি?

আন্টির কথার উত্তরে আমি জোরপুর্বক ঠোট প্রসারিত করে হাসলাম। ভালো উদ্দেশ্য কি খারাপ উদ্দেশ্য জানিনা। তবে আমি যে উনার নিজের ছেলেকেই সন্দেহ করছি সেটা কিভাবে বলি? আর এখন তো আমার সন্দেহের মাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে। আমার সন্দেহের প্রথম কারণ তো হাত। আর দ্বিতীয়ত এই ছেলেটা আমায় জিজ্ঞেস করলেন আমি ওই ছেলের মুখ দেখেছিলাম কিনা। কিন্তু উনি কি করে বুঝলেন ছেলেটা আমার অচেনা ছিল? কিংবা আমি ছেলেটাকে চিনতে পারিনি? এই কথা তো আমি নিহা ছাড়া কাউকে বলিনি। আর তৃতীয়ত হল এইরকম একটা ঘটনাতেও উনি ভালো উদ্দেশ্য খুজছেন। কেবল নিজের দোষ ঢাকার জন্যই কেউ এমনটা বলতে পারে। রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি । এরই মধ্যে কেক কাটার পর্ব শেষ। স্টেজের ভীড় কমে আসছে। ক্যামেরা ম্যান রাও সরে যাচ্ছে। নিহা এক স্লাইস কেক নিয়ে হুট করেই দৌড়ে আসল। আমি ভাবলাম আমার দিকে আসছে। তাই প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছিলাম, কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নিহা আন্টিকে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী গলায় বলল,

আন্টি…!

আন্টি নিহার কাধে হাত নাড়িয়ে বললেন,

কনগ্রেটস নিহা! এংগেইজমেন্ট হয়ে গেল।

নিহা কেকের স্লাইস আন্টির মুখের সামনে এনে বলল,

টেক আ বাইট প্লিজ!

আন্টি এক কামড় কেক খেলেন। নিহা এবার ঈশানের দিকে ঘুরল। নেকামো হাসি দিয়ে বলল,

ঈশান ভাইয়া, টেক আ বাইট!

ছেলেটাও এক কামড় খেয়ে স্লাইসটা হাতে নিলেন।
নিহাকেও এক কামড় খাওয়ালেন। দুষ্টুমী হাসি দিয়ে হালকা একটু ক্রিম তুলে নিহার নাকের ডগায় লাগিয়ে দিলেন ছেলেটা। নিহা মুখ হা করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছেলেটার গালেও লাগিয়ে দিল ক্রিম। অতঃপর তিনজনই দুষ্টমী হাসিতে মেতে উঠল। আর আমি নিরব চোখে তাকিয়ে আছি। ওদের খুনশুটি আমার ন্যাকামো মনে হচ্ছে। কিছুসময় পর নিহা আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভ্রু নাচিয়ে বড় হাসি টেনে আমার দিকে আসতে আসতে নিহা বলল,

তারিন! হা কর হা কর।

আমি হাত ঠেকিয়ে বাধ সাধলাম। নাকে পেচকী কেটে বললাম,

খাবোনা দোস্ত! ভালো লাগছে না। আগে বল বাসায় কখন যাবো আমি?

নিহা ব্যস্ত হয়ে বলল,

ও হ্যা। তোকে তো যেতে হবে। আচ্ছা আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি তোকে বাসা পর্যন্ত পৌছে দিবে। তুই তৈরি হয়ে নে। খুব দ্রুত।

আমি মাথা হেলিয়ে উঠে যেতে নিবো তখন আন্টি আমায় আটকালেন। দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন,

এই ওয়েট, তুমি ড্রাইভারের সাথে একা যাবে নাকি? নিহা? ওকে ড্রাইভারের ভরসায় ছাড়া কি ঠিক হবে? এই রাতের বেলা? একা একটা মেয়ে!

নিহা আমার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। আন্টির দিকে তাকিয়ে বলল,

না আন্টি কিচ্ছু হবে না। ও বাসায় পৌছে আমাকে ফোন দিবে তো! তারিন তুই ফোন করিস হ্যা?

আমিও সম্মতি জানাতে চাইলাম কিন্তু আন্টি কড়া গলায় বললেন,

আরে আগে তো বাসায় সেইফলি পৌছাতে হবে নাকি? তারপরই না ফোন। রাস্তার মাঝে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে? এমনিতেও আজকে যেটা হল, মেয়েটার উপর ফাড়া যাচ্ছে। রিস্ক নেওয়ার কি দরকার? তার চেয়ে ভালো হয় ওর বাসা থেকে কাউকে ফোন কর। ওকে এসে নিয়ে যাক।

আন্টির কথা শুনে আমি আর নিহা চোখাচোখি করলাম। বাসায় কিছুতেই ফোন করা যাবেনা। তাহলে বাধবে আরেক বিপত্তি। আন্টি যেন আমাদের চোখের ভাষা বুঝে নিলেন। তাই আরেকবার বললেন,

আচ্ছা নাহলে আমরা যাওয়ার সময় তারিনকে ড্রপ করে দিবো। এটাই ভালো হবে। কি বলো নিহা? তারিন?

নিহা অবাকচোখে আন্টির দিকে তাকালো। আমার প্রতি আন্টির এতো কনসার্নড হওয়াটা হয়তো প্রত্যাশা করেনি সে। নিহা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল,

না আন্টি সেটা তো সম্ভব না। ওকে জলদি বাসায় যেতে হবে। ওর একটু সমস্যা আছে। আর আপনাদের যেতে তো এখনো অনেক দেরি। তাই হবে না।

আন্টি ভ্রু কুচকে কিছু একটা চিন্তা করে আবার বললেন,

মেয়েটাকে তো এভাবে একা ছাড়া যায়না। আমারই ভয় লাগছে ওর জন্য। আচ্ছা এক কাজ করি! ঈশানকে ওর সাথে পাঠিয়ে দেই।

কথাটা শুনে আমি নিহার কাধ খামচে ধরলাম। নিহা বলল,

ঈশান ভাইয়া যেতে রাজি হবে?

আন্টি ভ্রু নাড়িয়ে বললেন, দাড়াও আমি বলে দেখছি।

ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন উনি। ছেলেটা দূরে টেবিলে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে সাফিন ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলেন। কথা বলছিলেন বললে ভুল হবে আসলে হাসাহাসি করছিলেন। যেন হাসির ফোয়ারা খুলে বসেছেন। আন্টির ডাকে ছুটে আসল ছেলেটা। ছেলেটা আসতেই আমি নিহাকে টেনে খানিকটা দূরে গেলাম। ফিসফিস করে নিহাকে বললাম,

নিহু! আমি কিন্তু ওই ছেলেটার সাথে যাবো না।

কেনো গেলে কি হয়েছে? ঈশান ভাইয়ার সাথে গেলেই সেফটি বেশি তারু! আন্টি ভালোর জন্যই বলছে।

ভালোর দরকার নেই। তুই আমাকে একটা উবার কল করে দে আমি তাও চলে যাবো। তবুও প্লিজ উনার সাথে না।

পাগল নাকি? তোকে আমি উবারে ছেড়ে দেই তারপর আন্টি আমাকে ঝারুক তাইনা? আন্টি তোকে নিয়ে খুব চিন্তা করছে তারু! এইজন্যই তো নিজের ছেলেকে পাঠাচ্ছেন। তাহলে বোঝ কতটা কনসার্নড তোর প্রতি? এখন যদি তুই না করে দিস তাহলে মাইন্ড করবে না?

আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে অসহায়ের মতো তাকালাম। নিহা আমাকে একটা ঠেলা মেরে বলল,

ঢং করিস না যা তো ! চেঞ্জ করে আয়। যত দেরি করবি প্রবলেম তোরই হবে। যাহ!

অপারগ হয়ে মেকআপ রুমের দিকেই যাচ্ছিলাম আমি। এরই মাঝে দুজন বয়স্ক মহিলা আমায় আটকালেন। আমাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে একজন বলে উঠলেন,

তুমিই ওই মাইয়াটা না? রেপ হইতে নিসিলো যে?

উনাদের কথা শুনে আমি মুখে হাত রেখে নিহার দিকে তাকালাম। নিহা কোমরে হাত রেখে অনেকটা রাগেই তেড়ে আসল। দুই মুরব্বিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

কি আন্দাজী কথা বলেন আপনারা? রেপ হতে নিবে কেনো? দেখুন সেরকম কিছুই হয়নি ওর সাথে। যাস্ট একটা মিস আন্ডারস্টেন্ডিং হয়েছে। দয়া করে গুজব রটাবেন না।

বলতে বলতে আমার কাধে হাত রাখল নিহা। উনাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

তারু চল তো! দেরি হচ্ছে।

আমি আর নিহা দ্রুত হেটে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে দুজনই বিড়বিড় করে কি আলাপ শুরু করল। নিহা আমায় ইশারা করে বলল ওসবে কান না দিতে। আমিও আর রেসপন্স করলাম না। আপাতত নিজের উপরই সব থেকে বেশি রাগ হচ্ছে আমার। তখন ওইভাবে চিৎকার করে সবার সামনে এসব বলা একদমই উচিৎ হয়নি। সেইজন্য আমার নিজের গালেই চড় লাগাতে ইচ্ছে হচ্ছে। মানুষ এখন তিলকে তাল বানাবে। এই ঘটনা কোথায় গিয়ে শেষ হবে কে জানে?

ভারী মেকআপ, ভারী লেহেঙ্গা সব উপড়ে ফেলে নরমাল কামিজ পড়ে নিয়েছি আমি। উচু খোপার ভাজ খুলে চুল গুলো এলোমেলো ভাবে পেছনে ছেড়ে মাথায় ঘোমটা টেনে কাধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে পুরোপুরি ভদ্রবেশ ধারণ করেছি বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। এক প্রকার বাধ্য হয়েই এখন অপরিচিত ছেলেটার গাড়িতে উঠতে হবে আমায়। মহা ঝামেলায় ফেসে গেছি। ছেলেটার হাতের দিকে তাকালেই তো বুক ধুকপুক করে আমার। তার উপর সারারাস্তা আমায় উনার সাথে থাকতে হবে এটা ভাবতেই আমার হার্টবিট মিস হয়ে যাচ্ছে। আর এই সবই হচ্ছে আমার প্রতি আন্টির অতিরিক্ত কেয়ারিং হওয়ার কারণে। অতিরিক্ত কোনোকিছুই আসলে ভালো না। কেয়ারিংও না।
🍂

চলবে

( “তি আমো” মানে হল “আই লভ ইউ”। এটা একটা ইতালিয়ান ভাষা।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে