গল্পঃ তিলোত্তমা
পর্বঃ ১
★
-‘হিহি! ভাগ্য ভালো আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করার সময় বাচ্চার গায়ের রঙ জানা যায়না, নাইলে খালামনি বোধহয় তোকে এবর্ট-ই করে ফেলতো!’- হাসতে হাসতে বলল সাগুফতা। আমি গরুর মত বড়বড় চোখজোড়া মেলে কেবল নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলাম ওর হাস্যোজ্জ্বল, সুন্দর, দুধসাদা মুখটার দিকে। আচ্ছা, মানুষের গায়ের রঙ আর মনের রঙ এক হয়না কেন?
অবশ্য সাগুফতারই কী দোষ দেয়া যায়? সাগুফতার খালামনি, মানে আমার নিজের মা-ই যে বীজ বুনে গেছেন, সেই চারাগাছে সার-পানি দিচ্ছে বলে সাগুফতাকে আর কতটুকুইবা দায়ী করা যায়! বড়খালু, বড়খালা আর তাদের একমাত্র মেয়ে সাগুফতা সবে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছে কি ঢোকেনি, মায়ের সেই পুরনো রেকর্ডারটা বাজতে আরম্ভ করেছে-
‘ওমা সিফু! কী সুন্দর হচ্ছিস রে দিন দিন! এই এত রাস্তা জার্নি করে এসেও মেয়ে যেন ঝলকাচ্ছে! হ্যাঁ রে আপা, এমন একটা চাঁদপানা মেয়ে দেবে বলেই কিনা বিয়ের পর আট বচ্ছরেও খোদা কোল ভরায়নি তোর? আর আমারজনকে দেখ! বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল আলো করে এলেন, আলো না ছাই অন্ধকার!’- শেষ অংশটুকু বিড়বিড় করতে করতে সাগুফতাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেলেন মা। বড়খালার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে আমিও ওদের পেছন পেছন যাচ্ছি ঠিক তখনই মুখে হাতচাপা দিয়ে উদগত হাসিটাকে ফুলের পাপড়ির মত মেলে দিয়ে আমাকে কথাটা বললো সাগুফতা- আগেভাগে জানলে নাকি মা আমাকে পৃথিবীতে আসতেই দিতেন না! সাগুফতা মোটেও আস্তে বলেনি এসব।
আমি নিশ্চিত জানি পাশে থাকা মা’র কানেও এই কথাগুলো গেছে, অথচ কী নির্বিকারভাবে হাঁটছিলেন মা- যেন শুনতেই পাননি কিছু! ঘরে ঢুকে সাগুফতার পানপাতার মত ছোট্ট মুখটাকে আঙুলে ছুঁইয়ে দিয়ে মা বললেন- ‘চাঁদপানা মেয়ে আমার! থাকবি তো মা কিছুদিন এবার খালামনির বাসায়?’
★
আমার এখন প্রচণ্ড মনখারাপ! আর যেহেতু আমার তেমন কোনো বন্ধুও নেই, তাই মনখারাপ করলে আমি নিজের ঘরে বসে বসে ডায়েরি লিখি। আগে গান গাইতাম একলা একলা, তারপর একদিন খুব মনখারাপের সময় খেয়াল করলাম আনমনেই টেবিলে বসে খাতার ওপর আঁকিবুকি করছি, ভালো লাগছে করতে! এরপর থেকে মন ভালো না থাকলে ডায়েরিটা নিয়ে বসে যাই, হাবিজাবি লিখে ভরাই। ওহহো! এতকিছুর মধ্যে আমার নামটাই তো বলা হলোনা! আমি রাত্রি। যদিও মা দাবি করেন বাবার নামের সাথে মিলিয়ে এই নাম রাখা হয়েছে আমার কিন্তু আমি বেশ টের পাই গায়ের রঙ মিলিয়ে ঝিলিয়েই নামটা রেখেছিলেন মা আমার! সেই ছেলেবেলা থেকেই যে-ই আমার নাম শুনেছে সেই এই একই ইঙ্গিত দিয়েছে-
-‘বাহ! সুন্দর নাম, একেবারে তোমার মত!’
কিংবা,
-‘ওমা! এত মিলিয়ে নাম পেলো কইগো! কে রেখেছে এই নাম, তোমার মা না বাবা?’
কিংবা,
-‘রাত্রি? বাহ! তোমার সাথে বেশ যায় তো নামটা!’
প্রকাশভঙ্গি আলাদা, কিন্তু কথা ঐ একই! ছোটবেলায় এতকিছু বুঝতাম না, ভাবতাম হয়ত আসলেই আমার নামটা খুব সুন্দর আর আমিও! একটু বড় হবার পর যখন আয়নার ভেতর দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখলাম, আর জানলাম রাত্রি শব্দের মানে রাত- সেই প্রথম বুঝলাম কী ভীষণ বোকা ছিলাম এতকাল!
যাকগে, আমার কথা থাকুক! এবারের পহেলা বৈশাখের বন্ধটা পরেছে বৃহস্পতিবার। টানা তিনদিন ছুটি কাটাতে বুধবার রাতেই বড়খালারা আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। বড়খালার একটাই মাত্র মেয়ে এই সাগুফতা, আমার বয়েসী। আমি এবার ক্লাস নাইনে উঠেছি, সাগুফতাও তাই। আমরা থাকি ঢাকায় আর ওরা ঝিনাইদহে। ঐখানের যে স্কুলে সাগুফতা পড়ে সেখানের ই টিচার বড়খালা, আর সাগুফতার রেজাল্ট ও অনেক ভালো- ওদের ক্লাসে সবসময় প্রথম তিনজনের ভেতর থাকে ও। আমি ঢাকারই একটা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ি, রেজাল্ট মোটামুটি! ক্লাস এইটে আমার রোল ছিলো ৩৩, এবারে একটু এগিয়েছে।
সাগুফতা দেখতে সুন্দর, শুধু সুন্দর না- অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর! একবার তো বাসের মধ্যে এক মহিলা ওকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘মা, তোমাদের দেশ কি ইন্ডিয়ার ওদিকে?’ সাগুফতা অবাক হয়ে মাথা নাড়তেই তিনি আবার বলে উঠেছিলেন- ‘ওহ! আসলে তোমাকে দেখতে একদম সোনাক্ষী সিনহা বলে যে নায়িকাটা, ওর মত! তাই ভাবলাম ওর আত্নীয় টাত্নীয় হও কি না!’। আর কত্তবার যে রাস্তাঘাটে ওকে দেখে বড়খালার কাছে ওর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে মানুষজন, তার তো গোনা গুনতিও নেই!
তো যা বলছিলাম, সাগুফতা সুন্দর আর আমি কুৎসিত!
সাগুফতাকে ঝিনাইদহের ওর এলাকার লোকজন একনামে চেনে, আমাকে তো আমার স্কুলের মেয়েরাও চেনেনা ঠিকঠাক!
সাগুফতা বরাবর ভাল রেজাল্ট করে, আর আমার- মধ্যবিত্ত, যৎসামান্য রেজাল্ট!
সাগুফতাকে বড়খালা রোজ ভোরে উঠিয়ে পড়তে বসান, নিয়ম করে রোজ নিজের বাছাই করে দেয়া টিউশনে পাঠান- সে বাধ্য মেয়ের মত মায়ের কথা শোনে, বরাবর ভাল রেজাল্ট করে। আর আমি সুযোগ পেলেই বেলা পর্যন্ত ঘুমাই, নিজের পছন্দমত স্যারের বাসায় পড়তে যাই আর বরাবর মাঝামাঝি, না ভালো না খারাপ -একটা রেজাল্ট গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াই।
তাই সাগুফতাকে সবাই আদর করে আর আমাকে দূরছাই! ভাবছেন বাড়িয়ে বলছি? আচ্ছা, তবে কেবল একটা ঘটনাই শুনুন!
আমরা, মানে আমি আর সাগুফতা দু’জনেই তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। সাগুফতাদের গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে গেলেও আমাদের স্কুল তখনোও খোলা। বন্ধ পেয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে চলে এসেছে ও। খবর পেয়ে বড়মামাও চলে এসেছে, ঢাকাতেই একটা মেসে থাকতো মামা। তখন সাগুফতা আর আমার, আমাদের দু’জনের বেশ মিল ছিলো, সাদা-কালো-ফর্সা-শ্যামলা অতশত তখনোও বুঝতাম না কিনা! সাগুফতা এসেছে, কিছুদিনের জন্য খেলার সাথী পেয়েছি। একপ্রকার নাচতে নাচতেই সেদিন রোজকারের মত কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে গেলাম, সেদিনই শেষ ক্লাস ছিলো আমাদের। বন্ধে দু’জনে মিলে কতকিছু করব তার ছকটক সব কষতে কষতে বাড়ি এলাম। ওমা! সাগুফতা নেই! বড়মামা ওকে নিয়ে বৈশাখের মেলায় গেছেন ঘুরতে! অথচ… অথচ আমিও তো একই বাসায় ছিলাম! আজই তো আমার শেষ স্কুল ছিলো, ওরা কি কালকে আমাকে সহ মেলায় যেতে পারতো না?
এই এখনকার আমি হলে তখন ঠিকঠিক সব মনের ভেতর কবর দিয়ে রেখে দিতাম, হয়ত ডায়েরিটাতে এক-দু’পাতা লেখা যোগ হতো। কিন্তু কী ভীষণ ছেলেমানুষ ছিলাম তখন আমি! কান্নাকাটি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিলাম, কেন আমাকে ছাড়া ওরা মেলায় গেলো বলে! মেলা থেকে ওরা ফিরে এলো, সাগুফতার হাত ভর্তি খেলনাপাতি আর আমার জন্য কেবল দুটো তেঁতুলের চকলেট এনেছে বড়মামা! সাগুফতা উচ্ছ্বল গলায় বর্ণনা করছিলো মামার বন্ধুর বাইকে করে পুরো মেলা ঘুরেছে, মেলায় কত কী খেয়েছে ও, নাগরদোলায় চড়েছে, গ্যাস বেলুন উড়িয়েছে… আরও কতশত গল্প! তখন আমি ছেলেমানুষ, এতশত শুনে জেদ করে বসলাম আমাকেও মেলায় নিয়ে যেতে হবে! বাধ্য হয়ে পরদিন বড়মামা আমায় নিয়ে ফের মেলায় গেলেন ঠিকই, কিন্তু শেষমেশ যে চূড়ান্ত অবহেলা আর অনাদরে সেই দিনটুকু কেটেছিলো আমার… এইতো এখনো লিখতে যেয়ে টপটপ করে কাঁদছি! না মামার বন্ধুর বাইক-টাইকে নয়, লোকাল বাসে চড়ে মেলায় গিয়েছিলাম সেদিন। কীসের নাগরদোলা কীসের কী? হিড়হিড় করে টেনে বাস থেকে নামিয়ে ঘাড় ধরে মেলায় নিয়ে সেদিন বড়মামা আমায় বলেছিলো-
‘এই নে তোর মেলা! মেলায় যাব, মেলায় যাব! মাথার পোকা নাড়িয়ে দিলো একদম!’
সাড়ে তিনফুটের ছোট্ট আমি তখন বোকার মত তাকিয়ে ছিলাম কেবল ছয়ফুট তিন ইঞ্চির বড়মামার দিকে! কী ভীষণ রাগী দেখাচ্ছিলো ওঁকে সেদিন!
সেই প্রথম, সেই শেষ! এরপর আর বড়মামার কাছে কিছু চাইনি কোনোদিন। সেদিন ই প্রথম টের পেয়েছিলাম, কোথাও একটা পার্থক্য আছে রাত্রি আর সাগুফতায়! হয়ত বড়মামা আমায় সাগুফতার মত করে ভালোবাসেন না, সে কথা বুঝতে পেরে একটা জড়বস্তুর মত কুঁকড়ে ছিলাম সারাদিন। মেলায় যেয়ে সাগুফতা সেদিন বার্গার খেয়েছে বলেছিলো, আমি অত দামী খাবার কোনোদিন খাইনি! খাবারের দোকানগুলির পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বারবার চোখ আটকে যাচ্ছিলো কাঁচঘেরা গোল গোল বার্গারগুলোর দিকে। নাহ! সেদিন আর মেলায় কিছু খাওয়া হয়নি আমার, ঘন্টা চারেক বাদে বাড়ি ফিরে বুভুক্ষের মত একথালা ভাত নিয়ে বসেছিলাম।
তবু কাঁদিনি সেদিন একফোঁটাও! একটা অদ্ভুত কষ্ট দলা পাকিয়ে গলায় জমে ছিলো সারাদিন। তীক্ষ্ণ, তীব্র একটা অপমানবোধ সমস্ত মনটাকে তিতে করে রেখেছিলো। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে মায়ের কাছে যেয়ে বলেছিলাম-
‘জানো মা, বড়মামা না একদমই সাগুফতার মত আদর করেনা আমায়…’
আমার কথা শেষ না হতেই মা খেঁকিয়ে উঠেছিলেন-
‘সাগুফতার সাথে সারাদিন অত হিংসে কীসের রে তোর পোড়ারমুখী! হয়ে দেখা না আগে ওর মত, তারপর এসব কান ভাঙাতে আসিস!’
মুখের কথা আমার মুখেই রইল। মনে বুঝলাম, বড় বেশি পার্থক্য আছে রাত্রি আর সাগুফতার মধ্যে।
বড্ড বেশি!
★