#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৩
Writer তানিয়া শেখ
গম্ভীর গলায় নিকোলাস বলল,
“তুমি যা বলছ তাতে কোনো ভুল নেই তো?”
“একদম না, কাউন্ট।” পিয়েতর জবাব দিলেন। নিকোলাসের চোয়াল কঠিন, চোখ রক্তজবার মতো। অতি ক্রোধ মাঝে মাঝে বারুদের ন্যায় জমতে থাকে। কেবল বিস্ফোরণের অপেক্ষা। এই বিস্ফোরণ রিচার্ডের অস্তিত্ব ধ্বংসের কারণ হবে।
রিচার্ড শুধরায়নি। তিনি শুধরাবে এই আশা করাটাই কি বোকামি ছিল না নিকোলাসের? পিতা হয়েও কখনও পিতৃসুলভ আচরণ করেননি। “আমি তোমার পিতা, আমি তোমার পিতা” এই এক বাক্য হাতিয়ার করে নিকোলাসের জীবন নরক করেছে। সুখ, শান্তি সব কেড়ে নিয়েছিল। কীসের লোভে? একমাত্র ওই সিংহাসনের। শত বছরের শাস্তিতেও সে লোভ যায়নি। মিথ্যা নাটক করেছে এতটা কাল। কিন্তু ওই মিথ্যার নেকাবের আড়ালে বসে যে এতবড়ো ষড়যন্ত্রের জাল বুনছিল তা কি ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেয়েছিল নিকোলাস? একটু একটু করে ওকে বেষ্টন করে রাখা নিরাপত্তার দেওয়াল ভেঙেছে। প্রথমে আন্দ্রেই তারপর নোভা আর এখন পল। ক্রোধের সাথে সাথে নিকোলাসের ভেতর থেকে হতাশার বায়ু বেরিয়ে আসতে চায়। জীবন্মৃত বলেই হয়তো তা আর বেরিয়ে আসতে পারে না। চাপে চাপে বাইরেটা ভারি হতে লাগল। মুখটা আরও রাশভারি দেখায়।
“ওর ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্রই কি পাওয়া যায়নি?”
এবারও না বলল পিয়েতর। নিকোলাস আর কিছু বলল না। উদাস মুখে তাকিয়ে রইল জানালার বাইরে।
কাউন্টকে হতাশ করতে মোটেও ভালো লাগছে না। পিয়েতরই বা কী করবেন? পলের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এসেছে গুপ্তচর। পলটা বেজায় ভালো ছিল। প্রভুভক্ত ও বিশ্বস্ত। পিয়েতর মিথ্যা বলবে না। পলকে মনে মনে পছন্দ করতেন তিনি। সুযোগ পেলে ঠাট্টাও করতেন। আজ ওর মৃত্যু সংবাদ তাঁকেও ব্যথিত করেছে। তার ওপর রিচার্ডের বিশ্বাসঘাতকতায় চরমভাবে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হন। এ সময় সামনে কোনো শত্রুর দেখা হলে যা হয় ঘন্টা কয়েক আগে তাই ঘটেছে। বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন স্বভাবের দোষে পড়ে।
“কাউন্ট, আমি সত্যি দুঃখিত তখনকার ঘটনার জন্য।”
একটু বিলম্ব করে নিকোলাস বলল,
“আপনার কাছে এমনটা আশা করিনি পিয়েতর। আপনার একটা ভুল আমার বেলার কষ্টের কারণ হবে।”
পিয়েতর অনুতপ্ত। তবুও বললেন,
“রজারই প্রথম আক্রমণ করে আমার ওপর। নিজেকে বাঁচাতে ওকে হত্যা করা ছাড়া তখন আর পথ দেখতে পাইনি। এখানে দোষ আমারও আছে তা অস্বীকার করছি না। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে হয়তো ওকে হত্যা করা ছাড়া ভিন্ন পথ পেতাম। পলের মৃত্যু, নোভালির নিখোঁজ সংবাদ এবং রিচার্ডের বিশ্বাসঘাতকতার খবর একসাথে শুনে আমি ঠিক ছিলাম না। রজারের অতর্কিত আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পড়ি। ভুলটা তখনই হয়। আপনি অনুমতি দিলে কাউন্টেসের কাছে এ জন্য ক্ষমা চাইতেও রাজি আছি। আমার কারণে আপনাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হোক তা আমি চাই না।”
নিকোলাস এই ভুল বুঝাবুঝির ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছিল। পিয়েতর তবুও বুঝতে পেরেছেন। হাজার হোক রজার ইসাবেলার মামা। মনঃক্ষুণ্ন হবেই। আরও কিছু ঘটার প্রবল আংশকা রয়েছে। ইসাবেলা নিশ্চয় এতক্ষণে বাড়িতে ওদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দিয়েছে। এর মাঝে রজারের মৃত্যু। প্রত্যক্ষভাবে নিকোলাসের নাম জড়িত এই মৃত্যুর সাথে। ম্যাক্সওয়েলরা নিকোলাসকে সহজে ছাড়বে না। তা না ছাড়ুক। সে নিয়ে নিকোলাস ভয় পায় না। কিন্তু ইসাবেলার পরিবার ওরা। নিকোলাসের ভুলের শাস্তি ওর ওপর না পড়ে। বেচারি ওকে ভালোবেসে আর কত পরীক্ষা দেবে? পরিবারের বিচ্ছেদের ব্যথা না হয় সয়ে নিতো কিন্তু ঘৃণা সইতে পারবে? আরও একটি ভয় নিকোলাসকে তাড়া করছে। রজারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ইসাবেলার না ক্ষতি করে দেয়। এই মার্কোভিককে তো ও হাড়ে হাড়ে চেনে। স্বার্থ আর বংশ মর্যাদার গরিমায় অন্ধ সে। ওদের বৈবাহিক সম্পর্ক জানার পর ইসাবেলা আর নাতনি থাকবে না তাঁর কাছে, শত্রুর স্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত হবে।
নিকোলাস আর চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। পিয়েতরকে বিদায় দিয়ে সময়ের আগেই রওয়ানা হলো ম্যাক্সওয়েল মহলে দিকে।
এইমাত্র সূর্য ডুবল। কুয়াশাজড়ানো চারপাশ। ইসাবেলার কক্ষে তখনও আলো জ্বলেনি। পর্দা টানা নেই। জানালার কবাট খোলা। হু হু করে সাঁঝের বসন্তবায় প্রবেশ করছে অবাধে। নিকোলাসও ওদের সাথে প্রিয়তমার কক্ষে এলো। আজ আর ইসাবেলা কক্ষে নেই। এ ঘরে দাঁড়িয়ে হলঘরের মাতম শুনতে পায় নিকোলাস। মন বলছে ছুটে গিয়ে ইসাবেলার পাশে দাঁড়াতে। মামার মৃত্যু ওকে খুব কষ্ট দেবে৷ নিকোলাস না চাইতেও বারংবার ওর কষ্টের কারণ হয়। ওর তিমিরে আলো হতে গিয়ে পুড়ছে যেন ইসাবেলা। নিকোলাস উৎকণ্ঠা নিয়ে বিছানায় বসে অপেক্ষা করে। মিনিট, ঘণ্টা কেটে যায় কিন্তু ইসাবেলা আসে না। নিকোলাস আর পারছে না এখানে বসে অপেক্ষা করতে। যা হয় হোক এবার ও নিচে যাবে। ইসাবেলা ঠিক আছে কি না জানতে হবে ওর। যেই উঠে দাঁড়ায় অমনি সদর দরজা খুলে গেল। ইসাবেলা দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার পড়েছে ওর মুখে। নিকোলাসের বুকের ওপর থেকে দুশ্চিন্তার ভার কেটে যায় ওকে দেখতে পেয়ে। ছুটে গিয়ে বাহুবন্ধনীতে জড়িয়ে নিলো। মাথার ওপর চুলে চুমু খেয়ে বলল,
“বেলা, ঠিক আছো তুমি?”
ইসাবেলা টু শব্দটি করে না। নিকোলাসের বাহুর মাঝে অসাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মামার বিভৎস শব চোখে ভেসে উঠতে শিউরে ওঠে। মায়ের ঘৃণাভরা দৃষ্টি বিষবাণ হয়ে বিঁধেছিল হৃদয়ে। সমস্ত দেহে ছড়িয়ে জমেছে জিহ্বার ডগায়। কী অসহ্য যন্ত্রণা! দু’হাত মুঠ করে শক্তি জুগিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলো নিকোলাসকে। হতভম্ব হয়ে যায় নিকোলাস।
“বেলা!”
“কেন মারলে আমার মামাকে? কেন আমাকে ছোটো মামির বৈধব্যের কারণ বানালে? কাজিনরা যখন জানবে ওদের বাবা আমার কারণে মরেছে ঘৃণা করবে আমাকে। আমার মা, বড়ো মামা, নানার চোখে আজ স্নেহ বা মায়া কোনোটাই ছিল না। ঘৃণা ছিল, নিকোলাস। আমার কারণে তাঁরা কেউ ভাই হারিয়েছে, কেউ ছেলে। একটু ধৈর্য ধরতে পারলে না তুমি? তোমার রক্তের তৃষ্ণা পেয়েছিল আমার কাছে আসতে। আমার দেহের রক্ত সব শুষে নিলেও যে ভালো হতো। আপজনের মৃত্যুর কারণ, ঘৃণার কারণ হতে হতো না। তোমাকে ভালোবেসে এই কি পাওনা ছিল আমার নিকোলাস? মামার লাশ পাওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে মা আমার রুমে এসেছিল। তোমার সাথে সাক্ষাৎ করতে রাজি হয়েছিল সে। কিন্তু তুমি সব ভেস্তে দিলে। কেন এমন করলে নিকোলাস? তোমাকে পেতে আর কত ত্যাগ করতে হবে আমায়? আমি যে মানুষ নিকোলাস। দুর্বল মন আমার। এত ত্যাগের ভাব বহন করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছি।”
ইসাবেলার সজল চোখে স্থির তাকিয়ে রইল নিকোলাস। বিপন্ন চেহারা ইসাবেলার। টলতে টলতে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। ওর কথা আজ ভীষণ আঘাত করল নিকোলাসকে। এই বিশ্বাস ওর প্রতি ইসাবেলার? এত ঠুনকো?
“তাহলে তুমি বিশ্বাস করে নিয়েছ আমি রজারকে মেরেছি?”
ইসাবেলা ভুরু কুঁচকে তাকায়,
“মারোনি? নানা, বড়ো মামা মিথ্যা বলেছে? তোমার প্রাসাদে গিয়েছিল রজার মামা। তাহলে__”
“আমার প্রাসাদে গিয়েছিল সুতরাং আমি মেরেছি। বাহ! কেন গিয়েছিল তোমার মামা সেখানে প্রশ্ন করেছিলে নানাকে?”
ইসাবেলা জবাব খুঁজে পায় না। নিকোলাস কাষ্ঠ হাসল।
“আজ এখানে এসেছিলাম তোমার কষ্টের ভাগিদার হব। কিন্তু তুমি আমাকে কষ্টের কারণই বানিয়ে দিলে। এটাই তো সত্য। তবুও সত্যের মুখোমুখি হতে ভীতু ছিলাম। আমি তোমাকে দোষারোপ করছি না, বেলা। দোষ তো সব আমার। আমার অভিশপ্ত জীবনে তোমাকে জড়িয়ে পাপ করেছি আমি। যার মাশুল তোমাকে গুনতে হচ্ছে। এতকিছুর পরও আমি বলতে পারছি না ভুলে যাও আমাকে, চলো আলাদা করি দুজনের পথ। আমি তোমাকে ছাড়া এখন নিজেকে ভাবতে পারি না, বেলা। তাহলে এমন কাজ কী করে করি যার কারণে তোমার আমার মাঝে দুরত্ব তৈরি হয়?”
ইসাবেলা চোখে গড়িয়ে পড়ে জল। নিকোলাস এগিয়ে এলো। ওর চোখের জল মুছে কপালে চুমু দিয়ে কপালে কপাল রাখল। ইসাবেলার চোখে ফের অশ্রু নামে। মামার মৃত্যু, এ বাড়িতে নেমে আসা শোকের ছায়া, মায়ের বিরূপ আচরণে ও যেন স্থির হয়ে কিছুই ভাবতে পারছে না। মস্তিষ্ক ধাঁধায় পড়েছে। ধাঁধায় পড়লে মানুষ ভুল করে, করে না?
ভালোবাসা এত সহজে পরিণতি পায় না। কত পরীক্ষা দিতে হয়। এতদিন সগর্বে ভেবে এসেছে ভালোবাসার এই পথের সকল বাধা অতিক্রম করবে। কীসের জোরে বলেছিল? নিকোলাসের প্রতি বিশ্বাসের জোরে৷ ভেতর থেকে কেউ যেন বিদ্রুপ করে ওঠে,
“নাকানিচুবানি খেয়ে অবিশ্বাসের জলে ডুবলে তো? তোমাকে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে ও বেচারা হৃদয়ে জায়গা দিলো। আর তুমি কী করলে? নানার কথায় প্ররোচিত হয়ে, পরিবার বিচ্ছেদের ব্যথায় কাতর হয়ে তার মনটাই ভেঙে দিলে। এই তোমার ধৈর্য, এই তোমার ভালোবাসার ওপর আস্থা? ধিক!”
ইসাবেলার পা কাঁপছে। নিকোলাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত পারল না। অঝোরে চোখের জল পড়ছে। অসহায় বোবা অপরাধীরা এই বুঝি করে। নিকোলাস আঁজলা ভরে ওর মুখটা তুললো। ফের চোখের নিচের অশ্রু মুছে বলল,
“আমি রজারকে মারিনি, বেলা। না মারতে পারতাম।”
“নিকো_লাস!” অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলতে নিকোলাস ওর ঠোঁটে আঙুল তুলে বলল,
“কিছু বলো না, বেলা। আমি তোমাকে ভুল বুঝিনি।” ওর অগোছালো চুল দুহাতে পরিপাটি করে চোখের নিচের কালি দেখে আবার বলল, “এই মুহূর্তে বিশ্রামের প্রয়োজন তোমার। আজ বরং আমি যাই।”
নিকোলাস হাত সরাতে ইসাবেলা খপ করে ধরে ফেললো। ওর চোখে হারানোর ভয়। নিকোলাস হাসল নিঃশব্দে। তারপর জাপটে ধরল শক্ত করে ওকে।
“আমি আবার আসব, বেলা। আসতেই হবে। আমার সকল পথ তোমার দুয়ারের সম্মুখে এসেই যে শেষ হয়। অপেক্ষা কোরো আমার জন্য, বেলা।”
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৪
Writer তানিয়া শেখ
দিনরাত গা ঢাকা দিয়েছিলেন। এখন আর পারছেন না। সারাদিন অপেক্ষার পর আজ রাতে পথে নামলেন রিচার্ড। নামলেন বললে ভুল হবে। বাধ্য হয়েছেন আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে। ড্যামিয়ান তাঁকে বলেছিল রোজ নিয়ম মতো খাবার দিয়ে যাবে। ক’দিন খাবার ঠিকই এলো। খাবার মানে ওই মানুষ। জলজ্যান্ত যুবতি, শিশু মাঝেমাঝে বিভিন্ন জানোয়ার। ওদের রক্তে একরকম তৃষ্ণা মিটে যেত তাঁর এবং সোফিয়ার। কিন্তু তারপর হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে গেল। একেবারে বন্ধ।
নিকোলাসের ভয়ে বাইরে পা দিচ্ছেন না। পলের মৃত্যু সংবাদ ও তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার কথা নিশ্চয় ও জেনে গেছে। পিতাপুত্রের সম্পর্কের বাহ্যিক সম্মান যেটুকু ছিল তা কেবল নামেমাত্র। সেটুকুও তিনি নিজ হাতে শেষ করেছেন। এবার নিকোলাস তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে না তা তিনি ভালো করেই জানেন। নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে ওই সিংহাসনের কী হবে? ওই জিনিসটার জন্যই তো এতকিছু করলেন। ড্যামিয়ান আশ্বাস দিয়েছিল নিকোলাসকে বন্দি করে খবর পাঠাবে। এতদিন হয়ে গেলেও ড্যামিয়ান কোনো খবর পাঠায়নি। ধোঁকা দিলো না তো! ড্যামিয়ানকে বিশ্বাস করা খুব ভুল হয়েছে। সিংহাসন দখল করতে ড্যামিয়ানকে বিশ্বাস করা ছাড়া তখন উপায় ছিল না। কিন্তু আজ বিশ্বাস ভাঙার ভয় পেয়ে বসেছে।
“অ্যাই, শুনছ?”
সোফিয়ার হাত বাহু স্পর্শ করতে তাকালেন রিচার্ড। বিরক্ত গলায় বললেন,
“হয়েছে কী?”
“পথে তো একটা মশাও দেখছি না। বড্ড ত্যাষ্টা পেয়েছে যে।”
“এতই ত্যাষ্টা তাহলে আমায় খা। ঘিলু ছাড়া মহিলা, আমি আছি বিপদে আর ওর খালি খাওয়া আর খাওয়া। আমার রক্ত খা। আয়।”
রিচার্ডের এই হঠাৎ রেগে ওঠাতে সোফিয়া ঝাঁঝ চোখে তাকালেন। স্বামীর সকল কুকর্ম তাঁর জানা। এমনকি ছেলে আন্দ্রেইকে নির্বাসন পাঠাতে ষড়যন্ত্রের জাল সেই বিছিয়েছে। তবুও বেশি কিছু বলেননি৷ নির্বাসিত ছেলের জন্য ভেতরের হাহাকার দেখাননি। এমন বিপদেও ছায়া হয়ে আছেন। অথচ, তাঁর আচরণ দেখো!
“মরণ! একবার তো ওই রক্ত পান করে জীবন ধুয়ে দিলাম। যেটুকু আছে তাও ধুলে অবশিষ্ট থাকবে কী?”
স্বামীর ঝাড়ির পালটা জবাব তিক্ত স্বরেই দিলেন সোফিয়া। রিচার্ড সরোষে তাকিয়ে বিড়বিড় করে ফের কিছু বললেন। যত অশ্রাব্য গালি-গালাজ সবই এই মুহূর্তে স্ত্রীর নামে বিসর্জন দিচ্ছেন। সোফিয়ার ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি। মনে মনে,”অভ্যাস, অভ্যাস” বললেও ভেতরটা তেতো হয়ে যায়। খুব চটে গেলে রিচার্ড বিড়বিড় করেন। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা সয়ে গেছেন সোফিয়া। কিন্তু বয়সের সাথে এসব মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে ওঠে। এই যেমন এখন। গত কয়েকদিনের তৃষ্ণায় কাতর তিনি। তার ওপর স্বামীর এমন রূঢ়তায় মেজাজ কম খারাপ হলো না।
তেরাস্তার মোড়ে এসে থামলেন দুজন। সোফিয়া মান করে গাঁয়ের পথ ধরলেন। রিচার্ড চেঁচিয়ে উঠলেন। সোফিয়া কানেও তুললেন না। রিচার্ড ছুটে গিয়ে স্ত্রীর বাহু চেপে ধরলেন,
“থামো বলছি সোফি। ওদিক নিরাপদ নয়। ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণের একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নেবো। এসো আমার সাথে।”
ঝটকা মেরে রিচার্ডের হাত থেকে নিজের বাহু ছাড়িয়ে নিলেন সোফিয়া। কিন্তু মন ঠিকই নরম হয় রিচার্ডের মুখে”সোফি” ডাক শুনে। বুঝতে না দিয়ে অগ্নিচোখে চেয়ে বললেন,
“যাব না, আমার সান্নিধ্য তো কাঁটা লাগে তোমার। তা লাগবে না কেন? আমি যে আগাথা নই।”
“আহ! আবার ওই এক নাম। আগাথা কবে মরে ভূত হয়েছে। কিন্তু তোমার এখনও ওকে নিয়ে হিংসে।”
“হিংসে করব না? মরে ভূত হয়েও ও তোমার হৃদয়ে জীবন্ত। আর আমি তোমার পাশে থেকেও হৃদয়ে জায়গা করতে পারলাম না আজও।”
রিচার্ড এবার সত্যি মহাবিরক্ত হলেন। কিন্তু সেটা চেপে গিয়ে সোফিয়ার দু’কাঁধে হাত রাখলেন। ঘনিষ্ঠ হয়ে বললেন,
“কেন বিশ্বাস করতে পারো না তোমাকে সত্যি আমি ভালোবাসি।”
“আগাথার চেয়ে বেশি?”
রিচার্ড প্রতিবারের মতো সময় নিলেন জবাব দিতে। মুচকি হেসে বললেন,
“অবশ্যই।”
সোফিয়া অনিমেষ তাকিয়ে থাকেন রিচার্ডের চোখে। অপ্রতিভ হলেন রিচার্ড। তাঁকে চমকে দিয়ে সশব্দে হেসে ওঠেন সোফিয়া। কাঁধের ওপর রাখা হাত দুখানি সরিয়ে পিছিয়ে গেলেন,
“মিথ্যা, মিথ্যা। এতকাল পরে এসেও একই মিথ্যা বলছ।”
“সোফিয়া।” প্রতিবাদ করলেন রিচার্ড। সোফিয়া বিষণ্ণ মুখে তাকালেন,
“তুমি আপাদমস্তক একটা মিথ্যা রিচার্ড। তোমার চোখ এই কথায় বলে। পৃথিবীর সকল মিথ্যাবাদি, প্রতারককে আমি কী অবলীলায় ঘৃণা করতে পারি। তোমাকে ঘৃণা করতে গেলে ঘৃণা কেন না আসে বলতে পারো?”
“সোফি!” রিচার্ড হাত বাড়াতে আরও দূরে সরে যায় সোফিয়া।
“তোমাকে ঘৃণা করতে না পারার ব্যর্থতা আমার আমির প্রতি ঘৃণা বাড়িয়ে দেয়। তোমার ভালোবাসা আমায় নীচ, আত্মসম্মানহীন, রক্ষিতা ও পিশাচিনী বানিয়ে ছেড়েছে। তবুও তুমি আমায় ভালোবাসলে না। আজকাল খুব মনে হয় তোমায় ভালোবাসতে গিয়ে নিজের ওপর চরম অবিচার করেছি। প্রতিনিয়ত আমার অস্তিত্ব তাই আমাকে অভিশাপ দেয়।”
রিচার্ড গম্ভীর হয়ে ওঠেন। মন নামে কিছু তো একটা ছিল। ছিল! এখনও হয়তো আছে। লোভ, স্বার্থপরতা ও প্রতিহিংসার ছাইয়ে চাপা পড়েছে। সোফিয়ার এমন আবেগি কথা একসময় তাঁকে বেশ নাড়া দিতো। আজও দিলো। দেবেই বা না কেন। এই মহিলা সর্ব অবস্থায় তাঁর সঙ্গে থেকেছে। কত অপমান, অবহেলা, লাঞ্ছনার পরও রিচার্ডের হাত ছাড়েনি। এই কারণেই হয়তো তাঁর স্বার্থপর, লোভী মনে সোফিয়া জড়িয়ে আছে। অভ্যাসের মতো কি! হয়তো তার চেয়ে বেশি। সোফিয়া বিষণ্ণ মুখ করে সামনে হাঁটতে লাগলেন। বোকার মতো ভেবেছিলেন আজ বুঝি রিচার্ড মান ভাঙাতে আসবে। কিন্তু তিনি গ্রাহ্য করলেন না। বরাবর যা করেন তাই করলেন। একা ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ ধরলেন।
রিচার্ড রক্তের সন্ধানে এদিক-ওদিক প্রাণী খুঁজতে লাগলেন। দুটো মানুষ পেলে ভালো হতো। সোফিয়ার রাগটা সহজে ভাঙতে পারতেন। কিছু সময় একা থাকার পর রক্ত দেখলে ওর মন ঠিক ভালো হয়ে যাবে। অনেক খোঁজাখুজির পর পাশের জঙ্গলের মধ্যে হরিণ ও হরিণ শাবক পেলেন। স্ত্রীর জন্য আজ নিজে হরিণ শাবক দিয়েই কাজ চালিয়ে নিলেন। মা হরিণের গলা ছিঁড়ে ফিনকি দিয়ে বেরোনো লাল রক্ত একটা পাত্রে ভরেন। সামান্য হরিণ শাবকে তাঁর মতো প্রাপ্ত বয়স্ক পিশাচের চলে না। পাত্রের রক্ত দেখে লোভ হতে লাগল। খুব কষ্টে লোভ সংবরণ করলেন। সোফিয়াকে আজ তিনি বুঝাবেন ভালো তিনিও বেসেছেন। এইটুকু ত্যাগই সোফিয়ার প্রতি তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন।
যেখানে সোফিয়াকে রেখে গিয়েছিলেন সে স্থান জনমানবহীন। গেল কোথায়? সামনে ছোট্ট গাঁ। এগিয়ে গেলেন সেদিকে। কিছুদূর যেতে গ্রামবাসীর চিৎকার শুনে একটু থমকে দাঁড়ান। এতগুলো মানুষের চিৎকারের মাঝেও শুনতে পেলেন,
“পিশাচিনী, মার, মার।”
রিচার্ডের হাত থেকে খসে পড়ল রক্তের পাত্র। ছড়িয়ে গেল ঘাসের ওপর। রিচার্ড ছুটে গিয়ে একটা ঘরের আড়ালে দাঁড়ালেন। বহুকাল পরে তাঁর চোখে কিছু হারানোর ভয় প্রকাশ পায়। অত মানুষের ভিড়েও সোফিয়াকে তিনি দেখতে পেলেন। দুটো তীর বিঁধে আছে ওর বুকে। তীরদুটো ওকে হাঁটুর ওপর বসাতে পারিনি। এত দুর্বল নয় তাঁর সোফিয়া। শ্বাদন্ত বের করে মানুষগুলোর আঘাতের পালটা জবাব দিতে খিস্তি দিয়ে উঠছে। আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠছে মানুষেরা। ঘিরে ধরেছে ওকে। রিচার্ডকে কিছু করতে হবে। কিন্তু এক পা এগিয়েই থমকে গেলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে সময় লাগল তাঁর।
“ড্যামিয়ান, ড্যামিয়ান।”
তীর হাতে সোফিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে ড্যামিয়ান। পরনে ফাদারের ছদ্মবেশ। এতদূরে দাঁড়িয়ে রিচার্ডের ডাক শুনল এমন ভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তাঁর দিকে। সামনে ধরানো কাঠের আগুনের স্ফুলিঙ্গ ঝলসে উঠল ওর চোখে। ঠোঁটের কোণে ক্রুর কুটিল হাসি। রিচার্ডের হতবিহ্বল মুখে দৃষ্টি স্থির রেখে তীরটা ছুড়ল। সাথে সাথে আরও কয়েকটি তীর সোফিয়ার সমস্ত শরীরে গেঁথে গেল। আকাশ কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে মাটিতে ঢলে পড়ল সোফিয়া। ড্যামিয়ান দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ওর আহত দেহের দিকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সোফিয়ার আহত দেহে কাছে৷ চুলের মুঠি ধরে টেনে তুললো। রিচার্ড তাকালেন স্ত্রীর যন্ত্রণা কাতর মুখের ওপর। বাঁচার আকুতি কি জানাচ্ছে সোফিয়ার চোখ? ওর ঠোঁট কাঁপছে। কিছু বলছে। রিচার্ড পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই সোফিয়াকে টানতে টানতে কাঠের আগুনের কাছে নিয়ে গেল ড্যামিয়ান। দাউ দাউ করে জ্বলা সেই আগুনের মধ্যে টেনে নেয় সোফিয়ার শরীর। সোফিয়ার আত্মচিৎকার, বাঁচার আকুতি গাঁয়ের মানুষগুলোকে আরও হিংস্র করে তোলে। আগুনের তেজ আরও বাড়ে তাঁদের ঘৃণা বর্ষণে। পিশাচ বধের উল্লাসে ফেটে পড়ে গাঁয়ের আবাল বৃদ্ধ বনিতা। হতবাক হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রিচার্ড এতকালের সঙ্গিনী ও স্ত্রীকে পুড়ে ছাই হতে দেখেন। ওতদূরের ওই আগুনের শিখার তাপ খানিক তাঁর হৃদয়টাও ঝলসে দিলো। কেঁপে উঠলেন রিচার্ড। শোকের চেয়ে ক্রোধে বেশি। তাঁর রক্তলাল দুটি চোখ ড্যামিয়ানকে খুঁজছে। পেয়েও গেলেন। ভিড় ছেড়ে ফাঁকা বাড়ির দিকে যাচ্ছে। ছুটে গেলেন। গিয়ে দাঁড়ালেন ওর সামনে। জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বললেন,
“ধোঁকা! তুই আমাকে ধোঁকা দিয়ে বেঁচে যাবি ভেবেছিস?”
বলতে বলতে ড্যামিয়ানের গলা চেপে ধরেন। একটুও ভয় পেল না ড্যামিয়ান। উলটো হেসে ওঠে। তারপর অপরাধী সুরে বলল,
“পার্টনার, বিশ্বাস করো ইচ্ছে করে তোমার বউটিকে আমি মারিনি। বিশ্বাস করো।”
আবার শব্দ করে হেসে ওঠে ড্যামিয়ান। রিচার্ড রেগেমেগে ছুঁড়ে ফেলল পাশের বাড়ির দেওয়ালের দিকে ওকে।
“কেন করলি তবে বিশ্বাসের নাটক?”
উঠে বসে ড্যামিয়ান মুচকি হেসে বলল,
“বিশ্বাস অর্জনের পর ভাঙার যে মজা তা আর কীসে বলো?”
রিচার্ডের কঠিন চোয়াল। নিজের ওপর এখন যত ক্ষোভ। পাগলের মতো হেসে উঠলেন।
“তোকে আমি ছোটো করে দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম সহজে ম্যানুপুলেট করে তোকে দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নেব। কিন্তু দ্যাখ, কী রকম বোকাই না বানালি আমায়। আমাকেই এতদিন ব্যবহার করেছিস সুচতুরভাবে। কেন? নিকোলাসের থেকে প্রতিশোধ নিতে?”
ড্যামিয়ান উঠে দাঁড়ায়। এখনও হাসি লেগে আছে ঠোঁটের কোণে। পরনের ধুলোবালি ঝেড়ে কপালের রক্ত আঙুলের ডগায় মুছে বলে,
“তুই এখনও ভাবছিস তোকে কেবল নিকোলাসের থেকে প্রতিশোধ নিতে ব্যবহার করেছি? ভুল পার্টনার, ভুল তোর ভাবনা। প্রতিশোধ তোর ওপরও পাওনা আমার। তোকে শুধু ব্যবহারই করিনি আমি, তোকে ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছি। তুই এখন ধ্বংস হওয়ার পথে। আর তারপর তোর ছেলেরা।”
রিচার্ড ফের আক্রমণ করতে গেলে ড্যামিয়ান সরে যায়। ঠিক তখনই অন্ধকার থেকে পবিত্র জল মেশানো একটা তীর এসে বিঁধল রিচার্ডের হৃদপিণ্ড বরাবর। পরপর আরও চার পাঁচটা। আর্ত গর্জন করে উঠল রিচার্ড। অন্ধকারে প্রকাশিত হয় ম্যাক্সিম লুকিন ম্যাক্সওয়েল। সাথে অচেনা আরও কয়েকজন মানুষ। মানুষ! কিন্তু ওদের চোখগুলো অমন জন্তুর মতো কেন? তিনি জানেন না এরাই তাঁর সোফিয়ার করুণ পরিণতির জন্য দায়ী। পা টলতে টলতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে রিচার্ড। ড্যামিয়ান ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। চোয়াল চেপে ধরে বলে,
“প্রতারণার যন্ত্রণা কী ভীষণ, না? এই একই যন্ত্রণা অসংখ্য মানুষকে দিয়েছিস তুই। মনে পড়ে?”
“কে তুই?” রিচার্ড দাঁতে দাঁত কামড়ে বললেন। ড্যামিয়ান কোচ থেকে একটা রসুন বের করে আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
“কে আমি? আসলেই তো কে আমি? কী পরিচয় আমার?”
রসুন মুঠে পুরে রিচার্ডের দিকে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকাল।
“আমি এক তরুণীর লজ্জা, আমি এক মায়ের অসহায়ত্ব, আমি এক প্রতারিত পিতা-মাতার দুঃখ, আমি, আমি এক দুঃখিনী মায়ের মৃত্যুর কারণ, এই আমি এক জারজ, যার পিতৃ স্বীকৃতি নেই, অন্ধকারে মায়ের গলিত বিষাক্ত উদর থেকে যার জন্ম। এই..এইটুকুই আমার পরিচয়। চিনতে পেরেছিস না তুই? তুই আর তোর ছেলেই তো আমার এই পরিচয়ের কারণ।”
রিচার্ডের বিস্ময়ের সীমা রইল না। এতকাল পরেও তিনি সেই স্মৃতি স্পষ্ট মনে করতে পারছেন। সেই দরিদ্র অসহায় মেয়েটি, পরাজিত, প্রতারিত বিষণ্ণ ম্যাক্স। মুখ তুললেন। তাকালেন ড্যামিয়ানের দিকে। ওই তো মেয়েটির চোখ, ম্যাক্সের মুখের আদল। এতবড়ো ভুল কী করে হলো তাঁর! ড্যামিয়ান এগিয়ে এলো আরও কাছে।
“ভয় পেলি? কিন্তু এত সামান্য কেন? না, এত অল্পতে তো মন খুশি হলো না আমার। তোকে যে আরও ভয় পেতে হবে। আর, আর.. আরও নিঃস্ব হতে হবে তোকে। একে একে তোর বংশ ধ্বংস করার শপথ নিয়েছি আমি। আন্দ্রেই, যাকে ট্রিয়ের দুর্গে পাঠিয়ে ভেবেছিস নির্বাসিত করেছিস? মরণ ওরও ঘনিয়ে আসছে। নোভালি নেই, নিকোলাসও থাকবে না। আহ! এখনও কিন্তু সন্তুষ্ট হলাম না আমি।” রিচার্ডের চুল পেছন থেকে টেনে রসুন মুখের কাছে নিতে আতঙ্কিত হয়ে তাকায় সেদিকে রিচার্ড। ড্যামিয়ান মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে বলল,
“ভয় নেই, তোকে এত সহজে মারব না। মৃত্যুর আকুতি করবি একদিন তুই। নাহ! সেদিনও মারব না। তোকে আমি আমার সুখের জন্য বাঁচিয়ে তিল তিল করে মারব।”
বলামাত্রই ওর মুখে রসুন গুঁজে দেয়। রিচার্ডের সারা শরীর কেঁপে ওঠে। আর্ত গর্জন করলেন। সেই গর্জন গোঙানি শব্দ হয় একসময়। আস্তে আস্তে থেমে যায়। নিথর হয়ে পড়ে রইল তাঁর দেহ। কিন্তু তাঁর ঠোঁট, মুখ তারপর সমস্ত শরীর পুড়ছে। সোফিয়ার মতো ছাই হয়ে মুক্তি মেলে না। স্থির, অদৃশ্য শৃঙ্খলে বন্দি। এই দহন খালি চোখে দৃশ্যমান হয় না। এই যন্ত্রণা কেবল একা রিচার্ড টের পায়। ভেতরে ভেতরে আর্তনাদ করে। কিন্তু কারো কানে তা পৌঁছায় না।
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৫
Writer তানিয়া শেখ
দু’হাতে পেট চেপে ধরে বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে ইসাবেলা। গরমে শরীর ঘামে ভিজে একাকার। চোখ ফেটে পানি পড়ছে। কোনো ওষুধে কাজ হলো না। দিনকে দিন পেটের ব্যথা বাড়ছে যেন। ফুলেও উঠেছে। তবে তা চোখে পড়ার মতো না। তার সাথে যু্ক্ত হয়েছে বুকের ব্যথা। নিকোলাস আসবে বলেও এলো না। ইসাবেলা নিজের ব্যবহারে অনুতপ্ত। কিন্তু যে কষ্ট কথার বাণ ছুঁড়ে দিয়েছে তা লাঘবের উপায় যে আর নেই। নিকোলাস কেন আসে না? ওকে না দেখে ইসাবেলার কষ্ট আরও বাড়ে। এই চরম মুহূর্তে একমাত্র শান্তির স্থান ওর বুকেই তো। ওকে হারানোর ভয়, আপনজনদের বৈরী আচরণে ইসাবেলা দিশেহারা। নিকোলাস আর ওর সম্পর্কের কথা এখন বাড়িসুদ্ধ লোক জানে। আন্না মেরিওর কৃতিত্ব রয়েছে এ ব্যাপারে।
এ বাড়ির সকলে প্রথমে বিস্মিত হয়েছে তারপর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। নানা মার্কোভিক রেগে আগুন, মামা ম্যাক্সিমের চোখে ইসাবেলার জন্য মায়া, স্নেহ কিছুই ছিল না৷ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। সেই কঠিনতা এখনও বহাল রয়েছে। ওলেগ অ্যালেক্সিভ রক্তশূন্য মুখে স্তব্ধ চেয়ে ছিলেন। তারপর হায়! হায় করে উঠেছেন। আদুরে ছোটো মেয়েটির এহেন অধঃপতন তাঁকে শেষমেশ অসুস্থ করে ছাড়ল। ওই অবস্থায় মেয়ের হাতে ধরে অনুনয় করলেন, ইসাবেলা যেন নিকোলাসকে ভুলে যায়। ও ঠিক নয়। পিশাচ আর মানুষের মধ্যেকার প্রেমের সম্পর্ক সমাজে ও ধর্মে নিষিদ্ধ। ইসাবেলার বয়স আর কত৷ বয়সের দোষে ও বাস্তবতা ভুলে যাচ্ছে। এই দোষ কাটলে পস্তাবে কিংবা তার আগে নিকোলাস ওর বড়ো কোনো ক্ষতি করে দেবে। পিশাচেরা হয় নীচ, স্বার্থলোভী। আর তাঁর মেয়ে নিষ্পাপ ফুলের মতো। এমন ফুল পিশাচের স্পর্শে এলে মূর্ছা যাবে, ঝরে যাবে। তিনি তা কখনও হতে দেবেন না। মেয়েকে খুব বুঝালেন। বাবার মতের সরাসরি প্রতিবাদ করেনি ইসাবেলা। দুর্বল হৃদয়ের অধিকারী ওলেগ অ্যালেক্সিভ। পাছে কিছু হয়ে যায়! আর কোনো কাছের মানুষ হারাতে রাজি নয় ও। নীরবে প্রস্থান করেছিল বাবার সামনে থেকে।
ইসাবেলা এখনও অবুঝ। বয়সে, বুদ্ধিতে অপরিপক্ক। নয়তো পিশাচের মায়ায় পড়ে? আর সেটাকে ভালোবাসা বলার ভুল করে? ভ্লাদিমি ও তাতিয়ানাও তাই মনে করল। ইসাবেলা এমন কিছু করবে এ ওদের ধারণার বাইরে ছিল। ভ্লাদিমি তো ইদানীং কড়া নজরদারিতে রেখেছে বোনকে। নিকোলাসকে হাতে পেলে ছাড়বে না। খুব ধার্মিক নয় মোটেও সে। কিন্তু ক্রুশটা আজকাল পকেটে পুরে রাখে। ওর বিধবা মামি ও অনাথ কাজিনদের চোখের বিষ ইসাবেলা। রজারের হত্যাকারী যখন ওর স্বামী তখন ঘৃণার, অপরাধের ভাগ তো নিতেই হবে। এ বাড়ির সকলের চোখে ইসাবেলা অপরাধী। মামার হত্যাকারীকে কী করে প্রেমিক বলে, স্বামী বলে স্বীকার করতে পারল সে! এত নির্লজ্জ, এত নীচ!
সকলে প্রতিক্রিয়া দেখালেও মাতভেই নীরব ছিল। ইসাবেলা প্রতি সহমর্মিতা ফুটে উঠেছিল ওর চোখে। তাতিয়ানার সন্দেহ হয়। সবার আড়ালে মাতভেই ইসাবেলার কক্ষে গিয়েছিল। বন্ধু ও ছোটো বোন দুটোই ইসাবেলা ওর কাছে। সান্ত্বনা দেয়। ওকে ভীষণ রোগা আর দুর্বল দেখাচ্ছিল। মুখ ছিল ফ্যাকাশে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই তাতিয়ানা এসে পড়ে। সরাসরি প্রশ্ন করে সে ওর বোনের প্রেমের সম্পর্কের কথা আগে থেকে জানত কি না। ইসাবেলা মাথা দুদিকে নাড়িয়ে ইশারা করে মাতভেইকে। মাতভেই হবু স্ত্রীকে মিথ্যা বলবে কী করে? সত্যি বলেছে। এ নিয়ে দুজনের মনোমালিন্য শুরু হয়। এসব দেখে সেদিন ভীষণ কেঁদেছিল ইসাবেলা। এত অসহায় আর ছোটো লাগছিল নিজেকে। নিকোলাস ওর জীবনে না থাকলে সেদিন ও মরেই যেত। মৃত্যু বোধহয় সত্যি আসন্ন। অসহ্যকর পেট ব্যথায় ছটফট করতে করতে তাই ভাবল। দাঁতে দাঁত লেগে কাঁদত লাগল। অস্ফুটে একটা নামই নিলো কেবল,
“নিকোলাস, নিকোলাস।”
ব্যথা কমে গেল হঠাৎ। এই নাম নিলো বলে কি! অনেক্ক্ষণের ব্যথা উপশমের পরও রগে রগে ঝিমুনি রয়ে গেছে। ইসাবেলা থম ধরে শুয়ে রইল। সমস্ত শরীর ঘামে চিটচিট করছে। উঠে গোসল করলে বেশ হতো। কিন্তু শরীরটা অবশ অবশ ঠেকল বলে আর উঠল না। নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। একবেলা খায় তো দু’বেলা অভুক্ত থাকে। আজকাল সহজে ক্ষুধা পায় না। যদিও একটু পায় খেতে পারে না। খাবার সামনে দেখলে পেট উগলে আসে৷ বড়ো কোনো অসুখ করল না তো! ওর দিকে কেউ ভালো করে তাকায় না। কেউ ওর খোঁজ নিতে আসে না। এই ম্যাক্সওয়েল মহলের চার দেওয়ালের বাতাস বিষাক্ত লাগে। আপনজন পর হয়েছে। দমবন্ধ হয়ে আসে এখানে ইসাবেলার। এসব ভাবতে ভাবতে কয়েকদিনের নির্ঘুম চোখের পাতা ভারি হয়ে ওঠে। চোখটা লেগে এসেছিল। হঠাৎ ব্যথাটা ফের পেট কামড়ে ধরে। দু’হাতে চেপে কুঁকড়ে গেল ইসাবেলা আবার।
“আহ!” আর্তনাদ করে কেঁদে উঠল। এবার নিকোলাসের নামেও থামল না। বরং আগেরবারের চেয়ে বাড়ল। আর পারছে না সহ্য করতে। বিছানার চাদর কামড়ে ধরে কাঁদছে।
“মিউ, মিউ…”
ভেজা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল সামনে। তাশার পোষা রুপালী রঙের বেড়াল ভোলইয়া। চকচকে ধূসর বিড়ালটি তাকিয়ে আছে ইসাবেলার দিকে। বেশ আদুরে একটা বেড়াল। কিন্তু এখন আদর করার ইচ্ছে জাগল না ইসাবেলার। অদ্ভুত একটা অনুভূতি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। শুকনো গলায় বার কয়েক ঢোক গিললো। জিহ্বা বের করে শুষ্ক ঠোঁট ভিজালো। বিড়ালটি ওর লোলুপ চোখ দেখে পালাতে গেলেই ওটাকে এক লাফে ধরল ইসাবেলা। তারপর কামড় বসিয়ে দিলো গলায়। চাপা গোঙানি তুলে নিস্তেজ হয়ে গেল বেড়ালটি। রক্তমাখা ঠোঁটে পরম তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ইসাবেলা। মৃত বেড়ালটিকে কোলের ওপর রেখে খাটের একপাশে হেলান দিয়ে থম ধরে আছে। দূর থেকে দেখলে ঘুমন্ত মনে করে ভ্রম হতে পারে। কিছুক্ষণ এভাবে অতিবাহিত হলো। এর মধ্যে ইসাবেলা আর ব্যথায় কাঁদল না। ওর চেহারার রঙ ফিরে এলো, খসখসে হয়ে যাওয়া ত্বকে আগের মতো কোমলতা ফিরে এলো। সুস্থ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। ধীরে ধীরে চোখ খুললো। ভুরু কুঁচকে গেল সাথে সাথে। বিছানায় শুয়ে ছিল, এখানে এলো কীভাবে? সেই ব্যথা আর নেই। যেন কোনোদিন ছিলই না। মাথার ভেতর কেমন ভোঁতা যন্ত্রণা টের পাচ্ছে। কিছু ঘটেছে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে না। কেমন খাপছাড়া, ঝাপসা সব। হঠাৎ ওর হাতটা কোলের ওপর পড়তে নরম লোমশ কিছু স্পর্শ করতে আঁতকে উঠল। এবং এই আঁতকে ওঠা রীতিমতো ভয়াল আতঙ্কে রূপ নিলো বেড়ালের মৃত দেহ দেখে। রক্তাক্ত ছেঁড়া গলা ও ওর হাতের রক্ত ওকে ধাঁধায় ফেললো। সামনেই আয়না। তাকাতে শিউরে ওঠে। মুখে লেগে আছে তাজা রক্ত। কী বিভৎস দৃশ্য! বমির উদ্রেক হয় সাথে সাথে। মুখে হাত দিয়ে দৌড়ে গেল ওয়াশরুমে। বমি হলো। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল। ভোলইয়ার নিথর দেহ বার বার ভেসে উঠছে চোখে। থরথর করে কাঁপতে লাগল। এমন নিষ্ঠুর, ঘৃণিত কাজ কী করে হয়ে গেল! ফের বমি করল। দুর্বল শরীরে ওয়াশরুমের মেঝের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। কিছুই মনে করতে পারছে এই মুহূর্তে। কখন ভোলাইয়া এলো, কখন ইসাবেলা ওর..
“ছি!ছি!” মাথার দুপাশে সজোরে চেপে ধরে। আর ভাবতে পারছে না। কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে?
“ভোল, ভোল?” ওই যে ডাকছে তাশা। ও এদিকেই আসছে। ইসাবেলা এক লাফে উঠে দাঁড়ায়। ছুটে যায় ঘরে। তাড়াতাড়ি ভোলইয়ার মৃত শরীর জানালা দিয়ে যতটা সম্ভব দূরে ফেললো। তারপর রক্তাক্ত মেঝে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে। প্রায় শেষ তখন দরজায় এসে দাঁড়ায় রেইনি। ওর হাত ধরে আছে তাশা। রেইনি কক্ষে চোখ বুলিয়ে বলল,
“ইসাবেল, তুমি কি ভোলকে দেখেছ? সারা বাড়ি খুঁজেও ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।” হাতের রক্তভেজা কাপড়টা ঠেলে খাটের নিচে লুকিয়ে ফেললো ইসাবেলা। ওদের দিকে না তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না, দেখিনি।”
“ওহ! চলো প্রিন্সেস ভোলকে আমরা বাগানে খুঁজি গে।”
“আচ্ছা।”
রেইনি ঘুরে আবার থেমে যায়। ইসাবেলার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি অসুস্থ ইসাবেলা? তোমার হাত ওমন কাঁপছে কেন?”
“না, না তো। ও কিছু না।”
“হুম।” রেইনি যেন বিশ্বাস করল না। প্রশ্নও করে না আর। তাশার হাত ধরে চলে গেল। ইসাবেলার স্বস্তির নিঃশ্বাস ভেতরে আঁটকে যায় দরজায় দাঁড়ানো এ বাড়ির পালিত কালো বেড়াল কার্লকে দেখে। বড়ো বড়ো চোখ করে একবার ওর দিকে আরেকবার খাটের নিচে তাকায়। ও কী বুঝতে পেরেছে কিছু? ইসাবেলা ওর দিকে যেতে ভয় পেয়ে গেল কার্ল। ভূত দেখে পালানোর মতো পালিয়ে গেল সেখান থেকে। নিজেকে এই মুহূর্তে ঘৃণিত কোনো পিশাচিনী মনে হচ্ছে ওর। একটা নিষ্পাপ জীবকে মেরেছে। বিবেকের দংশনের জ্বালাও কম না।
শরীরটা অবসন্ন লাগছে। বিছানায় গা দিতে ঘুম নেমে এলো ইসাবেলার চোখে। সারাদিন আর হুঁশ ছিল না। সন্ধ্যায় যখন ঘুম ভাঙল নিকোলাস ওর শিওরে বসে। দুজনের কেউ-ই কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। তৃষ্ণিত চোখে পরস্পরকে দেখল। এই কয়েকদিনের বিরহে সমান ভাবে জ্বলেছে ওরা।
ইসাবেলার ইচ্ছে হলো ওর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে। কিন্তু চাপা অভিমান তেমন করতে বাধা দিলো। মুখ ফিরিয়ে নিলো নিকোলাসের দিক থেকে। নিকোলাস বিমর্ষ গলায় বলল,
“এখনও রেগে আছো আমার ওপর তুমি, প্রিয়তমা। বলবে না কথা, তাকাবেও না?”
ইসাবেলা ঠোঁট শক্ত করে আছে। নিকোলাস অনুনয় করে বলল,
“এভাবে শাস্তি দিয়ো না, বেলা। আমি নিরপরাধ, বিশ্বাস করো। এই বিরহকাল আর যে সহ্য করতে পারছি না। কথা বলো, তাকাও একটিবার। দোহাই।”
কেউ যেন খুব জোরে চপেটাঘাত করল ইসাবেলাকে। আস্তে আস্তে উঠে বসল। টলমল চোখে তাকাল নিকোলাসের দিকে। অভিমান নিয়ে বলল,
“এই কদিন এলে না কেন? আমি রোজ পথ চেয়ে ছিলাম৷ তোমার বিরহের ব্যথা আমাকে আধমরা করে ছেড়েছে নিকোলাস। আমার অভিযোগ দেখলে কিন্তু তার পরের অনুশোচনা দেখলে না। আমি পাগলি, নির্বোধ, না বুঝে রেগেমেগে যা বলেছি মনে নিয়ে চলে গেলে। আর এলে না। ফিরে দেখলে না তোমার নির্বোধ বেলা তোমাকে কষ্ট দিয়ে অনুতাপে জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছে।”
নিকোলাস ওকে জড়িয়ে ধরল।
“আমার বড়ো ভুল হয়েছে। ক্ষমা করো। রজারের মৃত্যুর দায় আমার ওপর। আমাকে দেখলে যদি তোমার কষ্ট বাড়ে। তাছাড়া নিজের ওপর রাগও কম ছিল না। আজ আমার জন্য এত কিছু সইতে হচ্ছে। তুমি বরং আমাকে ভুলে গেলেই ভালো হয়৷ পারবে না?”
ইসাবেলা পারবে বললে নিকোলাস শেষ হয়ে যাবে। নিজের জন্য ধরে রাখতে গিয়েও যে ওই বেচারিকে শেষ করে ফেলছে। ওর ভালোর জন্য শেষ হতেও বাধা নেই আজ নিকোলাসের। দুহাতে ঠেলে সরিয়ে দিলো ইসাবেলা। রাগে জ্বলছে ওর ভেজা চোখ।
“তোমাকে ভুলে গেলে ভালো হয়। কিন্তু ওই ভালোটাই আমার দরকার নেই নিকোলাস। তুমি ছাড়া কিছুই আমার দরকার নেই। আমার তো সব তুমিই, তোমাতেই।”
“বেলা!” নিকোলাস ইসাবেলার বাধা সত্ত্বেও জোর করে আবার জড়িয়ে ধরল। ভালো লাগে ওকে বাহুডোরে নিলে, বুকের ওপর রাখলে। এভাবেই যদি রাখা যেত। ইসাবেলা মান করে বুকে মৃদু আঘাত করল। তারপর একসময় শান্ত হয়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“আর বলো না ওই কথা। একবারো না। আমরা পরস্পরকে কথা দিয়েছি কখনও একে অপরকে ছাড়ব না, কোনো পরিস্থিতিতেই না।”
নিকোলাস চুপ রইল। ইসাবেলা কিছুক্ষণ নাক টেনে শান্ত হয়। দুজনে নীরবে একে অপরের সান্নিধ্য উপভোগ করল। ইসাবেলা গুটিশুটি মেরে থাকল নিকোলাসের বাহুর বেষ্টনীতে। মাথা রাখল ওর বুকের ওপর। বড্ড শান্তি এখানে। একটু পর নিকোলাসকে ডাকল,
“নিকোলাস।”
“হুম?” আলগোছে ইসাবেলার চুল নিয়ে খেলছিল নিকোলাস।
“আমাকে নিয়ে চলো এখান থেকে।” বলল ইসাবেলা। নিকোলাস বলল,
“আজই?”
একটু ভাবল ইসাবেলা। তারপর বলল,
“না, আজ থাক। কাল এই সময় এসো। আমি তৈরি থাকব।”
নিকোলাস সরে বসল। মুখোমুখি হয়ে ওর হাতটা মুঠোবন্দি করে বলল,
“আমি চাই না জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত নাও তুমি। এরা তোমার আপন…”
“এরা আমার আর আপন নেই নিকোলাস। পর করে দিয়েছে। আমার মুখ দর্শন করতেও বাধে ওদের৷ এই মহলে দমবন্ধ হয়ে আসে নিকোলাস। প্লিজ এখান থেকে নিয়ে যেয়ো। নয়ত মরে যাব।”
নিকোলাস ওর গালে হাত রাখল।
“শান্ত হও। তুমি যা চাও তাই হবে। কাল আসব আমি।”
“ওয়াদা?”
“ওয়াদা।”
ইসাবেলা এই কয়েকদিনে আজ হাসল। দু বাহু নিকোলাসের গলায় জড়িয়ে ঠোঁটে গাঢ় চুম্বন দিলো। একে অপরের কাছে এলে সব যেন ভুলে যায় ওরা। ইসাবেলা ভুলে গেল সেই ব্যথা, ভোলাইয়াকে হত্যা করে রক্ত খাওয়ার কথা। নিকোলাস ভুললো রিচার্ডের বিশ্বাসঘাতকতা, পলের মৃত্যু, নোভার লাপাত্তা হওয়ার কথা। আর দেখল না সদর দরজার পাশে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে একটি মনুষ্য ছায়া। ওদের নজরে আসার আগে যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
চলবে,,