#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯০
Writer তানিয়া শেখ
জেদ আর ঘোর এক নয়। কিন্তু এ দুটো তীব্র অনুভূতির শব্দ মাঝে মাঝে এক হয়ে যায়। পানিতে মিশে যাওয়া চিনির মতো পরস্পরে এমনই মিশে থাকে যে আলাদা করা যায় না। নোভার প্রতি ড্যামিয়ানের যে আকর্ষণ তা জেদ। আর ইসাবেলার প্রতি ঘোর। তাই কি? না, হয়তো উলটোটা। ইসাবেলা ওর জেদ আর নোভা ঘোর। আবার ভাবে দুটোই জেদ কিংবা ঘোর। যাই হোক না কেন এই দুজনকেই ওর চায়। এক পুরুষ কি একসাথে দুজন নারীকে চাইতে পারে না? ওদের সমাজ, ধর্মে নিষিদ্ধ হলেই মনে নিষিদ্ধ হবে কেন? তাছাড়া সমাজ, ধর্ম কবে মেনেছে ড্যামিয়ান? সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে চাওয়া এই দুই নারী ওকে ঘৃণা ছাড়া কিছু দেয়নি। জীবন ফের ওকে ঠকিয়েছে। শূন্য হাত শূন্যই রেখেছে। মাতৃগর্ভ থেকে ঠকছে ও। এবার যে আর ঠকবে না। দুহাতে লুটে নেবে। যারা ঠকিয়েছে তাদের পালা ঠকবার।
নিঝুম রাত। নির্ঘুম জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। আকাশে রুপোলী থালার মতো চাঁদ। কী অপূর্ব জ্যোৎস্না! তার মাঝে সেই তারাটা। ওটার নাম ইসাবেলা রেখেছে ড্যামিয়ান। জ্যোতিষী মহাশয় ইসাবেলার জন্মকুণ্ডলী ঘেঁটে দেখে ওই নক্ষত্র ইশারা করে বলেছিলেন,
“ওই তো সেই সমৃদ্ধি আর ক্ষমতার আশীর্বাদের চিহ্ন। ওকে হাসিল করো ড্যামিয়ান, হাসিল করো। ও তোমার ভাগ্য বদলে দেবে। তোমায় মহাক্ষমতাবান করবে। তোমার বংশে আগত সৌভাগ্য, তোমার পিতার প্রার্থনার ফল ও মেয়ে। ওকে পেলে সব পাবে, এমন কী পিতৃ স্বীকৃতি ও মাতৃহত্যার প্রতিশোধও।”
ড্যামিয়ানে এখন ইসাবেলাকে চায়। যে কোনোভাবে। প্রতিশোধের পালাটা শেষ হলে একান্ত নিজের করে নেবে। তারাটা নিবিষ্ট মনে দেখছিল। আচমকা সেটা হারিয়ে গেল! বিচলিত হয়ে পড়ে ড্যামিয়ান।
“ইসাবেলা, ইসাবেলা!”
যতদূর আকাশ দেখা যায় ও ওই উজ্জ্বল তারাটা খোঁজে। সব তারার মাঝে যেন এক হয়ে গেছে। আলাদা করা যাচ্ছে না। আশ্চর্য! এতদিন কিন্তু আলাদাভাবে চিনতে পারা যেত। এখন পারছে না কেন?
“কে কোথায় আছিস? জ্যোতিষীকে খবর দে। তাড়াতাড়ি ডেকে আন তাঁকে।”
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন জ্যোতিষী মহাশয়। বুক সমান দাড়ি, ঠোঁটের ওপর পুরু গোঁফ। মাথা টাক। চোখ দুটো তীক্ষ্ণ। মুখভাবে ধূর্ততা ও বিচক্ষণতা প্রকাশিত। পরনে ধূসর আলখেল্লা। কুর্নিশের ঢঙে বললেন,
“আমাকে ডেকেছেন জনাব?”
ড্যামিয়ান কম্পিত হাত আকাশের দিকে ইশারা করে বলল,
“ও নেই। আমার বেবিগার্ল ওখানে নেই মহাশয়।”
জ্যোতিষী বাইনোকুলার আনালেন। ধীরে ধীরে তাঁর মুখ বদলে যেতে লাগল। খানিক আশ্চর্য, খানিক ভয় আর হতবুদ্ধিভাবের মিশ্রণ দেখা যায়।
ড্যামিয়ান তাঁর রক্তশূন্য মুখে চেয়ে বলল,
“কী হয়েছে মহাশয়?”
শুকনো ঢোক গিললেন জ্যোতিষী। ভাবিত মুখে বিড়বিড় করে বললেন,
“ও সত্যি আর নেই। কিন্তু এ তো অসম্ভব!”
“কী অসম্ভব?”
রজার বলল। ম্যাক্সিম তার পেছন পেছন ড্যামিয়ানের কক্ষে প্রবেশ করে। তারাটা পূর্বে যেখানে ছিল সেখানে তাকিয়ে রইলেন জ্যোতিষী। তিনি যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। হঠাৎ কী দেখে তার মুখে আষাঢ়ে মেঘ জমে। থমথমে গলায় বলেন,
“হা প্রভু! এ কী অনাসৃষ্টি!”
“নিজে নিজে কী বক বক করছেন, মহাশয়? আপনাকে এখানে নিজ মনে বকবকানির জন্য আনা হয়নি। পরিস্কার করে বলুন হয়েছে কী?”
ধমকের সুরে বলল রজার। ম্যাক্সিম দেখছে ড্যামিয়ানকে। অস্বাভাবিক রকমের শান্ত এই মুহূর্তে ও। চোখ দুটো স্থির আকাশের সেই তারাটির দিকে। একটু আগে অদৃশ্য হয়ে গেলেও এখন আবার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পাশে নতুন আরেকটি কি জ্বলজ্বল করছে? ড্যামিয়ান জ্যোতিষীর দিকে গভীর চোখে তাকালো। তার মুখ পড়ে নিচ্ছে যেন। জ্যোতিষী কিছু বলার আগে এগিয়ে এলো। থমথমে গলায় বলল,
“ও আমার হবে তো?”
জ্যোতিষী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“সহজে না। ওই যে ওর পাশের নতুন উদিত নক্ষত্রটি ওর রক্ষাকবচ হয়েছে এখন। কিন্তু হঠাৎ করে ওটা এলো কেন? কারণটা আমাকে অনুসন্ধান করতে হবে।”
ড্যামিয়ান অপ্রকৃতস্থ মতো হয়ে বলল,
“ওকে আমার চাই কিন্তু মহাশয়। যেকোনো ভাবে।”
“আমি জানি জনাব। চিন্তা করবেন না। এই বাধা দূর করার একটা উপায় ঠিক বের করব আমি। একটু সময় দিন।”
ড্যামিয়ান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জামাতে জ্যোতিষী প্রস্থান করলেন। রজার ও ম্যাক্সিম রয়ে গেল। ম্যাক্সিম বলল,
“চিন্তা করো না ড্যামিয়ান। ইসাবেলা তোমারই হবে।”
সায় দিলো রজার তাতে,
“আলবাত।”
ড্যামিয়ান কেবল মাথা নাড়ায়। ওর দৃষ্টি ইসাবেলার নক্ষত্রের পাশে উদিত নতুন তারাটির দিকে। তীক্ষ্ণ ক্রুর চোখে ওটাকে দেখছে।
“তোমরা ঠিকঠাক খোঁজ রাখছো তো ভাগ্নির?” নীরবতা ভেঙে বলল ইসাবেলার মামাদের। দুজনেই একসাথে জবাব দিলো,
“খুব ভালোভাবে।”
“তবে আজ আমার কেন মনে হচ্ছে নিকোলাস আর ওর সম্পর্ক এখন আর হৃদয়ে হৃদয়ে নেই। আরও গভীরে গিয়েছে।”
“তোমার মনের ভয় ওটা। আমরা বেশ করে নজরদারিতে রেখেছি। তেমন কিছু ঘটলে অবশ্যই জানতাম। চিন্তার কারণ নেই।”
“হুঁ! চিন্তার কারণ নেই তবে ওই নক্ষত্রের উদয় হলো কী করে হঠাৎ, কুত্তার বাচ্চারা?”
চেঁচিয়ে উঠল ড্যামিয়ান। রজার ও ম্যাক্সিমের দিকে হুঙ্কার ছাড়ে।
“আমার সিক্স সেন্স বলছে তোদের কোথাও ভুল হয়েছে। যা আমার থাকার কথা তা এখন অন্য কারো দখলে গেছে। কসম করে বলছি যদি তাই হয় তবে তোদের ক্ষমা নেই। আপন রক্ত বলে ছেড়ে দেবো না। রক্তমাংস এক করে খাব। দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে অপদার্থের দল।”
ভয় পেল দুই ভাই। দুজনে দ্রুত প্রস্থান করল সেখান থেকে।
কয়েক গ্লাস ভদকা পান করার পরও নেশা হয়নি ড্যামিয়ানের। রাতটা আজ যেন ফুরাচ্ছেই না। ওই নক্ষত্রের দিকে তাকাবে না তাকাবে না করেও তাকাচ্ছে। এত বছরের অভ্যাস একরাতে পরিবর্তন হয়? রাগটা আগাগোড়াই একটু বেশি। এই কারণে তা যে আরও বাড়ল। এতটা বাড়ল যে অন্ধকার কক্ষে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। কিছুর ওপর তো রাগটা খাটানো চায়। এমনি এমনি যাবে না। মাথাটা ঘুরছে। সর্ব শরীর মনে হচ্ছে জ্বলছে। মাথার ভেতর নিষ্ঠুর সব ভাবনা চিন্তা। না, আর চুপচাপ থাকতে পারছে না। ঝড়ের মতো সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রহরীরা এতকাল দেখে আসছে মনিবকে। মনিবের রাগী মুখ ভালোভাবেই টের পায়। রাগলে এই লোক কী ঘটাতে সক্ষম তা কি ওরা জানে না? ভয়ে গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনিবকে গর্ভগৃহের দিকে যেতে দেখল।
গর্ভগৃহের ঘুটঘুটে অন্ধকার ম্লান হয় ড্যামিয়ানের হাতের মশালের আলোতে। অন্ধকারে পা পড়ে কয়েকটি ইঁদুর ও সাপের ওপর। ইঁদুরগুলো চিঁচিঁ করে উঠল। সাপগুলো অবশ্য পালটা আঘাত করেছে। মাতৃগর্ভ থেকেই যে বিষাক্ত এই সাপের বিষে তার আর কী হয়! রাত নামলে এই স্যাঁতসেঁতে পাতাল আঁধারে সাপ বিচ্ছুতে গিজগিজ করে। নোভার কাঁচের সেলের কাছাকাছি যেতে থেমে যায়। সামনে সাপ বিচ্ছুসহ বিষাক্ত প্রাণীরা শায়িত এক মানুষের আকৃতি নিয়েছে। আকৃতি নিয়েছে! শক্ত করে মশালের হাতল ধরল ড্যামিয়ান। কাউকে ছিঁড়ে কামড়ে,শুষে খাচ্ছে সরীসৃপগুলো। মশালের আগুনের তাপ লাগতে ছিটকে সরে গেল। ড্যামিয়ানের সেই চল্লিশোর্ধ্ব চাকরটির বিভৎস দেহ পড়ে আছে। কী হয়েছে বুঝতে যেন আর কষ্ট হলো না ড্যামিয়ানের। মৃত চাকরটির বোকামিকে গালি দিয়ে ছুটল সামনে। যা ভেবেছিল তাই। নোভা ফের একবার চালাকি করে পালিয়েছে। রাগে লাল হয়ে ওঠে ড্যামিয়ানের চোখ। উন্মাদের মতো হাসছে। রাগের আগুন মশালে আগুন এক হয়ে সমস্ত গর্ভগৃহে ছড়িয়ে পড়ে। মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে ড্যামিয়ান।
গতবার পালানো সহজ ছিল। কিন্তু এবার যে সহজ হবে না সে ও জানতো। ওই পাতাল বন্দিদশা ছেড়ে জঙ্গলে পথ খুঁজছে নোভা। কিন্তু বার বার ঘুরেফিরে একই স্থানে এসে দাঁড়াচ্ছে যেন। ঠিক যেন গোলকধাঁধা। এত সহজে হার মানবে না নোভা। এখান থেকে বেরোবেই। নতুন একটি রাস্তা ধরলো। কিন্তু হতাশ হলো। এই রাস্তাও ওকে আগের স্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। আশপাশে অস্থিরভাবে পায়চারি করল। একটা গাছ দেখতে থামে। তিন পাপড়ির ছোটো ছোটো নীল ফুলে ভরে আছে গাছটি। ফুলগুলো এখনো কুঁড়ি। এই গাছের বিশেষত্ব হলো কুঁড়িতে বিষ, ফুটলে নির্বিষ। কিন্তু নির্বিষ ওই কুঁড়ির বিষকে কাটে না। কুঁড়ি অবস্থায় সম্মোহনীয় ঘ্রাণে আশপাশের প্রাণীদের আকৃষ্ট করে। একবার এর মায়াজালে পড়লে তার আর রক্ষা নেই। ফুটলে কিন্তু এই ফুলে কোনো সুবাস থাকে না। তখন পৃথিবীর আর পাঁচটা সাধারণ ফুলের মতো। নোভা মানুষ নয়। ওকে ততখানি মায়াজালে ফেলতে সক্ষম নয় এই কুঁড়ি ও কুঁড়ির সুবাস। তবুও ছুঁয়ে দেখার লোভ আর সামলাতে পারল না নোভা।
“ভেবেছিলি এবারও পালিয়ে যাবি?”
পেছনে ড্যামিয়ানের বিকৃত হাসি শুনলো নোভা। ঘুরে তাকালো না। শয়তানটার মুখ দেখার চেয়ে এই ফুল দেখা ভালো। মনে শান্তি আসে। ড্যামিয়ানকে ও মনপ্রাণে ঘৃণা করে। ওর স্পর্শের কথা ভাবতে গা গুলিয়ে এলো। লড়ে যদি মুক্তির পথ দেখত তবে এই মুহূর্তে তাই করত। ড্যামিয়ান সে সুযোগ ওকে দেবে না। চোখ বন্ধ করল। প্রিয়জনদের মুখটা দেখতে পায়। দেখতে পায় তাকে যার ছবিটি হৃদয়ে অঙ্কিত৷ যাকে বলা হয়নি মনের কথা। হয়তো আর কোনোদিন বলা হবে না। তবুও শান্তি সে ওর হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। ড্যামিয়ানের নোংরা হাত ওই পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না। কোনোদিন না।
ড্যামিয়ান এগিয়ে যায় ওর দিকে।
“অনেক সময় দিয়েছি তোকে। মধুর মধুর কথা বলেছি। এবার ভয় দেখাইনি, অত্যাচারও আর করিনি। কিছুতেই তোর মন পেলাম না। বেশ। তোর মন আর চাই না। শুধু শরীরটা এখন চাই। প্রয়োজনে জোর করে হলেও তা আজ আমার চাই।”
ড্যামিয়ান ক্ষিপ্র হাতে বাহু ধরে ঘুরাতেই নোভার নিথর দেহখানি পায়ের কাছে উবু হয়ে পড়ল। কী ঘটল বুঝতে সময় লাগে। ধাতস্থ হতে নিচে তাকায়। হাঁটু ভেঙে বসল ওর শরীরের পাশে। পরাজয়ের আভাস পাচ্ছে ড্যামিয়ান। না, না। ফের পরাজয় চায় না ও।
“দ্যাখ, একদম নাটক করবি না নোভালি। ওঠ, ওঠ বলছি। এসব নাটক করে আমায় বোকা বানাতে পারবি না। ভালোই ভালোই বলছি ওঠ।”
নোভালি তেমনি পড়ে আছে। ধীরে ধীরে ওর দেহটাকে সোজা করল ড্যামিয়ান। দু-চোখ বিস্ফোরিত হয় নোভার নীলবর্ণ মুখ দেখে। এতক্ষণ পরে বিষাক্ত ফুলের সুবাস বুঝতে পারে। তাকায় সেদিকে। কুঁড়ি ছেঁড়া বৃন্তটি সহজে চোখে পড়ে। দুহাতে খামচে ধরে নোভার নিথর দেহখানির দুবাহু। সজোরে ঝাঁকায়।
“না, না। চোখ খোল। এই..এই নোভালি, এত সহজে আমাকে তোরা হারাতে পারবি না। বার বার কেন হারব আমি? তোর মুক্তি নেই। আমার স্বপ্ন পূরণ না করে তোর মুক্তি হবে না।”
ড্যামিয়ান ওর বিষাক্ত নীল ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দেয়। শুষে নিতে চায় সব বিষ। কিন্তু ব্যর্থ হয়। কারণ নোভা ওর জেদ, ভালোবাসা নয়। এই বিষ কেবল ভালোবাসাময় চুম্বনে শরীর ত্যাগ করবে।
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯১
Writer তানিয়া শেখ
সারি সারি সাজানো উইলো বৃক্ষ। বিকেলের সোনালি রোদ নিম্নমুখী ঝুলন্ত পাতার ফাঁকে শেষবেলার লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। নরম আলো চোখে প্রশান্তি এনে দেয়।
সামনে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত সমতল। খোলা সবুজ মাঠের মাঝে কাঠের ছোট্ট একটা টেবিল রাখা। দু’পাশে দুটো চেয়ার। ঝরণার জল পড়ার শব্দ কানে আসে। অদূরে উইলো বনের মাঝ দিয়ে বয়ে যায় ছোট্ট ঝিরি। ধীরে ধীরে। ইসাবেলার নজর কাড়ে এখানে সেখানে আগাছার আড়ালে, ঝিরির ধারে, গাছের কোটরের ফাঁকে জন্ম নেওয়া রঙ বেরঙের ফুলগুলো। ওর অভিভূত উজ্জ্বল চাহনিতে স্থির তাকিয়ে রয় নিকোলাস। এই প্রকৃতির সৌন্দর্য তুচ্ছ ঈশ্বরের সৃষ্ট এই মানবীর রূপের কাছে। ঈশ্বর! ও কি আবারও ইসাবেলার সূত্র ধরে তাঁর গুণকীর্তন করল? দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়। বড্ড দুর্বল প্রতিবাদ৷
“চলো বসি।” ইসাবেলার হাত ধরতে তাকাল নিকোলাসের দিকে। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছলে যে কার্যসিদ্ধি ছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি, আবার কাজও করেনি। ইসাবেলার মুখে এখনও বিমর্ষতার
ক্ষীণ ছায়া। সেই ছায়া কি ওর মুখের রং ওমন পাণ্ডুর করেছে? বৃদ্ধাঙ্গুল ওর মলিন নিষ্প্রভ গালে বুলিয়ে কপালে চুমু খেল। তারপর রাঙা ঠোঁটে।
“তুমি ঠিক আছো, সুইটহার্ট?”
নিকোলাসের বাহুবন্ধনীর মাঝে ইসাবেলা গোপনে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“ভালো আছি আমি।”
ওর ঠোঁটের মৃদু হাসি নিকোলাসের ঠোঁটেও ছোঁয়াচের ন্যায় পৌঁছে যায়। দুজনে সামনের চেয়ার দুটোতে মুখোমুখি বসল। টেবিলের একপাশে নানা পদের খাবারভর্তি ঝুড়ি। ইসাবেলা বুঝল আগেভাগেই এসব প্রস্তুত করেছে নিকোলাস। বিয়ের শপথে বলেছিল, প্রতিটি মুহূর্ত স্পেশাল করবে। নিকোলাস পাশে থাকলে তাই তো মনে হয় ওর। কিন্তু এই পাশে পাওয়ার জন্য চরম মূল্য দিতে হবে শীঘ্রই। ছাড়তে হবে আপনজনদের। এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিকোলাসের সাথে কথা হয়েছে। ও কিছুক্ষণ চুপ করে বলেছিল,
“ওদের ছেড়ে ভালো থাকবে তুমি?”
“হয়তো। না, এ আবেগের কথা নয়। সত্যি বলছি, ভেবেই বলছি। ওরা ছাড়া খারাপ লাগবে। আর তুমিহীন জীবন চলবে না মনে হয়। কী অকৃতজ্ঞ আমি, তাইনা? নিজের রক্তসম্পর্কীয় আপজনদের ঠকালাম আপন স্বার্থে। আমি বড্ড খারাপ মানুষ, বড্ড খারাপ।”
বলতে বলতে গলা ধরা এসেছিল ইসাবেলার। নিকোলাস ওকে বুকে টেনে বলে,
“তুমি ভীষণ ভালো বেলা। নির্দোষ, নিষ্পাপ। আমার ভালোবাসা তোমায় আজ খারাপ ভাবতে বাধ্য করল।”
“নিকোলাস!”
ইসাবেলা আহত মুখে সরে বসল। নিকোলাস মলিন মুখে বলেছিল,
“আমায় ভালো না বাসলেই তুমি বোধহয় ঠিক করতে।” ইসাবেলার চোখ ভরে এলো। রাগল মনে মনে। নিকোলাস বুঝতে পেরে ফের ওর মাথাটা বুকের ওপর টানে।
“মান করো না, বধূ। তোমাকে পাওয়ার নেশায় তোমার সুখ নিয়ে ভাবিনি।”
“তুমিই তো আমার সুখের কারণ নিকোলাস।”
“আর তোমার পরিবার? ওদের ছাড়া একা আমায় নিয়ে সুখ হবে তোমার?”
“একটা মানুষ কি জীবনে সব পায় বলো? না চাইতেও কিছু তো ত্যাগ করতেই হয় জীবন পথে। আমাকেও তাই করতে হবে। আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই, কিন্তু পরিবারকে ব্যথা দেবো এই অপরাধবোধ থেকেও রেহায় নেই।”
চুপ করে যায় নিকোলাস। ইসাবেলা আজ যে পরিস্থিতিতে পড়েছে তার কারণ ও। ওর অপরাধবোধের কারণ ও নিজে। সাধারণ মানুষকে ভালোবাসলে নিশ্চয় এদিন দেখতে হতো না ইসাবেলাকে। পরিবারকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হতো না। অথচ, প্রণয়ের প্রথম প্রহরে এসব যেন আমলেও আনেনি।
“প্রেমের সূচনালগ্নে আমরা এতটা মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকি যে দূরে তাকায় না। যখন বোধ হয় তখন আর উপায় থাকে না। তোমাকে পাবার নেশা আমায় স্বার্থপর করে তুলেছিল। একটুও ভাবিনি আমার জন্য কত কী-ই না ত্যাগ করতে হবে তোমাকে। আমার মতো পিশাচকে ভালোবেসে ব্যথা ছাড়া কী-বা পেলে, বধূ আমার।”
ইসাবেলা নিকোলাসের হাত ধরে মাথাটা কাঁধে রাখল।
“তুমি আমার সকল ব্যথা উপশমের ওষুধ নিকোলাস। এই দুর্দিনে আমার আশা হও, নিরাশার কথা বলো না। তাছাড়া এখনও মায়ের সাথে কথা বলিনি এ ব্যাপারে। কে জানে যদি মা আমাকে বোঝে!”
ওরা দুজনই জানে শেষ কথা স্রেফ কথার কথা। আন্না মেরিও কোনোদিন মানবে না। নিকোলাসের নামই যথেষ্ট তার অস্বীকৃতির জন্য।
প্লেটে নানান পদের খাবার৷ ইসাবেলা খাচ্ছে না। ক্ষুধা মরে গেছে। আজ মা’কে কীভাবে বলবে তাই নিয়েই ভাবছে ক্ষণে ক্ষণে। ওর মন ভালো করতে এত আয়োজন সব যেন বিফলে গেল। নিকোলাস তবুও চেষ্টা করল। চিন্তার ঘোর থেকে বের করতে বলল,
“কাল দূরে কোথাও যাবে?”
“হুম।”
“তোমার পছন্দের কোনো জায়গা থাকলে বলতে পারো।”
পছন্দের জায়গা আছে কি না মনে পড়ল না। বলল,
“তোমার যেখানে ভালো লাগে।”
“আমার তো শুধু তোমাকে ভালো লাগে। আমার মিষ্টি বউ।”
টুপ করে ঠোঁটে একটা চুমু দিয়ে দিলো সুযোগ বুঝে৷ লাজুক হাসল ইসাবেলা। তারপর বলল,
“তুমি আর তোমার ফ্লাটিং লেভেল। উফ! যুগ যুগ ধরে এভাবেই মেয়ে পটাতে?”
“এই! আমার বউপ্রীতিকে এসব ফ্লাটিং ট্লোটিং বলে অপমান করবে না। মেয়েরা আমাকে দেখে এমনিতেই পটে যেত। এমন সুদর্শন মুখ, বলিষ্ঠ দেহের যুবক দেখলে কোন মেয়েই না পটে। তুমি নিজেও তো পটেছ, হুঁ।” নিকোলাস ভুরু নাচায়।
“শাট আপ।” ইসাবেলা ঠোঁট টিপে হাসি সংবরণ করে বিড়বিড় করে বলে,
“কুকি বাস্টার্ড।”
“আমি কিন্তু শুনেছি বেলা।”
“ভেরি গুড।” নিষ্পাপ মুখ করে চোখ পিটপিটে তাকাল ওর দিকে ইসাবেলা। নিকোলাস মুখটা কানের কাছে এনে চাপা গলায় বলল,
“রাত হোক, দেখব এই নিষ্পাপ মুখ থাকে কোথায়।”
আলতো করে কানের লতিকা কামড়ে দিতে ইসাবেলার সর্বাঙ্গ শিরশির করে ওঠে। লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়।
“তুমি নির্লজ্জ।” গলা ঝেড়ে অভিযোগ করতে নিকোলাস দুষ্টু হাসি আড়াল করে বলল,
“ওহ! এখন আমি নির্লজ্জ? কে যেন বিয়ের রাতে আমাকে লাজুক বলেছিল? কে?”
সেই রাত মনে পড়তে ভীষণ লজ্জা পেল ইসাবেলা। আমতা আমতা করল, কিন্তু কথা খুঁজে পায় না। কিংবা লজ্জায় বলতে পারে না।
“তুমি সুন্দর, লজ্জার লাল রঙ সেই সৌন্দর্যে মিশে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। আমার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বেসামাল হয় তখন। এতটা, এতটা যে উফ! চলো প্রাসাদে ফিরি।” চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল নিকোলাস। ইসাবেলা চকিতে তাকায়। সলজ্জে বলে,
“একদম না। আমার ক্ষুধা পেয়েছে খাব।” বলেই সামনে যা পেল মুখে দিলো। মনে মনে স্বস্তি পায় নিকোলাস। ইসাবেলার চিন্তা দূরীকরণে সফল হয়েছে। ক্ষুধামন্দা কেটেছে। এই সফলতা শান্তি দেয়। কিন্তু সে শান্তি অচিরেই চলে যায়। খুব বেশি খাবার খেতে পারে না ইসাবেলা। পেটের ভেতর মুচড়ে ওঠে৷ নিকোলাসকে বুঝতে না দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
“চলো উঠি।”
“কিন্তু খেলে না তো_”
নিকোলাসের হাত টেনে ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
“পেট ভরে গেছে। আর পারব না। চলো পুব দিকটাতে একটু হাঁটি। এসো।”
একপ্রকার জোর করে টানতে টানতে নিয়ে গেল। হাতে হাত রেখে হাঁটতে শুরু করে সামনে। নিকোলাস উদ্বিগ্ন, গম্ভীর হয়ে আছে। কারণটা ইসাবেলা জানে। ঠিকমতো খেলো না বলেই ওমন মুখ ভার ওর। কদিন ধরেই নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে ইসাবেলা। এর মধ্যে একটা এই ক্ষুধামন্দা। খাবার দেখলে পেট গুলিয়ে আসে। পেটে কোনো সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়। নিকোলাসকে বললে চিন্তা করবে। ওষুধ খেলেই যখন সেরে যাবে। খামোখা নিকোলাসকে বলে চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কী?
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা পরিত্যক্ত জনপদে এলো। সম্ভবত যুদ্ধের ভয়াবহতায় মানুষ অন্যত্র চলে গেছে। লোকালয়ের পথে দু’একটা কুকুর ছাড়া কোনো জনমানব চোখে পড়ল না। লোকালয় পেরিয়ে যেতে সন্ধ্যা নামল। হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠেছে ইসাবেলা। কোথাও একটু বসবে। এমন সময় ঢং ঢং শব্দে সান্ধ্য ঘণ্টা বেজে ওঠে সামনের গির্জায়। এখান থেকে কয়েক কদমের পথ। সামনের খোলা মাঠটা পেরোলেই গির্জা। গির্জার ভেতরের আলো দেখতে পেল।
“চলো যা_”
বোধদয় হলো এমনভাবে পরক্ষণেই আবার ইসাবেলা বলল,
“না,আরেকটু সামনে হাঁটি। চলো।”
ইসাবেলার মুখ আগের তুলনায় এখন যেন আরও বেশি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। নিকোলাস হিসেব করে ওর রক্ত পান করে। হিসেবে কোথাও গড়মিল হলো কী? না, এখন থেকে নিয়ন্ত্রণ শক্তি আরও বাড়াতে হবে। গির্জার পাশ কাটিয়ে যেতে আরেকবার তাকালো ইসাবেলা। নিকোলাস থামল। ঘুরে দাঁড়ায় গির্জার দিকে। ভেবেছিল গির্জার দুয়ার কোনোদিন মাড়াবে না। এককালে রাগে, অভিমানে বিদ্রোহ করেছিল। ছেড়েছিল ধর্ম, ধর্মালয়। আজ দুটোই ওকে টানছে। প্রবলভাবে৷ নিকোলাস পা বাড়াতে ইসাবেলা খুব জোরে চেপে ধরে ওর হাত। নিকোলাস যেন ধাতস্থ হলো। হেসে বলল,
“মা বলতো প্রার্থনালয় দেখলে উপেক্ষা করতে নেই। কে জানে কোন প্রার্থনা কবুল হয়। চলো।”
“চলো! তুমি যাবে?”
“হুম।” প্রশ্ন করল না জবাব দিলো ইসাবেলা ঠিক বুঝতে পারে না। নিকোলাস নিজেও না। ইসাবেলা একটু জোর দিক। জোর করে টানুক সামনে। নিকোলাস পূর্বের সব ভুলে আজ প্রভুর গৃহে হাঁটু ভেঙে বসবে। ক্ষমা চাইবে? হয়তো। তিনি ইসাবেলাকে সঙ্গী করে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা তো রয়েছে।
এতদিন বাদে ইসাবেলার আগাথাকে স্মরণ হলো। স্মরণ হলো তাঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি। নিকোলাসকে আর কয়েক কদম এগিয়ে নিলেই আগাথাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়। শাপমোচন হয় নিকোলাসের। আর তারপর? ঈশ্বর ওকে নিজের কাছে ডেকে নেবেন। নিকোলাস শূন্যে মিলিয়ে যাবে। নিজেদের হাতের বন্ধনে তাকাল। নিকোলাসকে হারানোর ভয়ে মুহূর্তে স্বার্থপর, ওয়াদাভঙ্গকারী, পাপীতে পরিণত হয়। সৃষ্টিকর্তার দুয়ারে যেতে বাধা দিলে সে পাপী ছাড়া কী?
ওর গলা শুকিয়ে এলো। সভয়ে একবার গির্জার দিকে আরেকবার নিজেদের হাতের বন্ধনে তাকাল। নিকোলাস একদৃষ্টে গির্জার দিকে চেয়ে আছে। ইসাবেলার আচমকা টানে চমকে তাকায়।
“কী হলো?”
“চলো বাড়ি ফিরি।”
“গির্জার ভেতরে যাবে না?”
“এখন না। মাথাটা কেমন যেন করছে। চলো বাড়ি ফিরি, প্লীজ!”
নিকোলাস সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো। কিন্তু কিছু বলল না। ইসাবেলা আর হাঁটবে না। সুতরাং ওকে হাওয়ার বেগে নিয়ে চলে এলো ম্যাক্সওয়েল মহলের লনে। এদিক ওদিকে সতর্কে তাকালো। বরাবরের মতো লন নীরব, ওরা ছাড়া আর কেউ নেই। ওরা জানালা দিয়ে রুমে ঢুকতে একটা ছায়া পড়ল লনের ওপর। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সেটি।
আজ কৃষ্ণপক্ষের রাত। প্রাসাদের ভেতরকার আলো লনের মাঝ বরাবর পড়েছে। ছায়াটি ইসাবেলার জানালার ঠিক নিচে এসে দাঁড়ায়। ইসাবেলার রুমের ক্ষীণ আলো জ্বলে ওঠে৷ চুম্বনরত দুটো মানবীয় ছায়া পড়ে জানালার সাদা পর্দায়। সেদিকে তাকানো ছায়ামুখে কোথা থেকে এক ছটা আলো পড়ে। উদ্ভাসিত হয় কঠোর কঠিন আন্না মেরিওর চেহারা। বিহ্বলতা, ভয়, ক্রোধ ও ঘৃণা মিশ্রিত হয়ে ফুটে ওঠে তার চোখেমুখে।পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন ঠাঁই। হঠাৎ পেছনে পরিচিত সেই গলা শুনে টলে ওঠেন।
“বিশ্বাস হলো তো এবার?”
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯২
Writer তানিয়া শেখ
ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার আনন্দ ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানান দিতে চায় সকলে। ইসাবেলাও তো তাই চেয়েছিল। কিন্তু, পরিস্থিতিতে পড়ে ওর সেই ইচ্ছেটাকে বুকের গহীনে কোথাও চাপা দিতে হয়৷ কাওকে বলতে পারেনি কত চমৎকার একজনকে ও জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে, কত ভালোবাসে তাকে। কতটা যে চায় সে খুশিও জাহির করতে পারেনি। তার ওপর বিষ ফোঁড়া হয়ে আছে পরিবারকে এসব গোপন করার অপরাধবোধ। বিশেষ করে মা আন্না মেরিওকে নিয়ে ওর যত দুশ্চিন্তা। নিজ আদর্শ গড়া মেয়েটির অধঃপতন কীভাবে নেবেন? কীভাবে তাকাবে ইসাবেলা মায়ের চোখে?
মায়ের দরজা পর্যন্ত আসতে ওকে খুব সাহস যোগাতে হলো। এইটুকু এসে হাঁপ ধরেছে। বুক কাঁপছে। মায়ের মুখোমুখি হওয়ার কথা ভাবলে পা অসাড় হয়ে যায়। এত ভয় আগে কখনো পায়নি। কিন্তু মাকে ও ভয় পেয়েছে। মায়ের মতো। আজকের ভয় ভিন্ন রকম। এই ভয় আজ তরতরিয়ে বাড়ছে৷ সামনের দরজা ঠেলে মায়ের সামনা সামনি হতে পা চলছে না। অসাড় পা দুটোকে প্রাণশক্তি দিয়ে এগিয়ে নিয়ে এলো, কম্পিত হাতে ঠেলে সরালো দরজা।
“মা, আসব?”
গলা চিরে বেরোলো যেন শব্দ দুটো। আন্না মেরিও বিছানার ওপর বসে আছেন। হাতে রোজারিও। একমনে সেই মালা জপছেন তিনি। মেয়ের কথা শুনতে পেলেন না, কিংবা পেলেও পাননি এমন ভান ধরে রইলেন। ইসাবেলা এগিয়ে গেল। মায়ের মুখের দিকে তাকাতে লজ্জা হচ্ছে। এই মায়ের শিক্ষা ভালোবাসার জন্য জলাঞ্জলি দিয়েছে। কীভাবে বলবে কথাগুলো? কোথা থেকে শুরু করবে?
“মা!”
“বলো।” চোখ মেলে তাকালো না, বেলা বলে ডাকল না, কাছে বসতেও বলল না। কী হয়েছে মায়ের? উদ্বেগের ঢেউ ইসাবেলা মধ্যে।
“তোমার কী শরীর খারাপ মা?”
আন্না মেরিও একটু সময় নিয়ে দায়সারা ভাবে মাথা দুলালেন দুদিকে। ইসাবেলা একবার ভাবল মায়ের পাশে বসবে। কিন্তু বসল না। সেই যোগ্যতা আজ ওর নেই। একটু পর মা ওকে ঘৃণার চোখে দেখবে৷ হয়তো ত্যাজ্যও করতে পারে। দু’ঠোঁট চেপে লম্বা শ্বাস নিলো।
“বল, ইসাবেলা, বল। আজ না বললে যে আর বলাই হবে না। শাস্তি বা ভর্ৎসনা যা জোটে মায়ের আশীর্বাদ মনে করে নিস। বল, বল।” ভেতরের জনের অভয়ে ইসাবেলা মুখ খোলে।
“মা, আজ আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। জানি, সেইসব কথা শুনলে আমি আর তোমার কাছে আদরের থাকব না। কষ্ট পাবে তুমি। ভীষণ। বিশ্বাস করো ইচ্ছে করে তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি। কেমন করে যেন সব ঘটে গেল।….” ইসাবেলা একনাগাড়ে সব বলতে লাগল। ওর আর নিকোলাসের ভালোবাসার পূর্ণতার আদ্যোপান্ত বলা শেষে বসল বিছানার নিচে, ফ্লোরের ওপর। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না আর। মাথা ঘুরে উঠল হঠাৎ। দেহও দুর্বল ঠেকছে। এক গ্লাস পানি খুঁজল। এই মুহূর্তে চোখের সামনে সব যেন খরা আর হতাশা।
আন্না মেরিওর মুখ শান্ত। চেহারায় একফোঁটা ভাঁজ নেই। ইসাবেলা অবাক হলো। এতক্ষণে মা চিৎকার চেঁচামেচি করল না কেন? বকলোও না? অভিযোগও নেই? অতি আঘাতে কি মানুষ এমন হয়ে যায়? মায়ের এই অস্বাভাবিক নীরবতা ইসাবেলাকে আরও ভয় পাইয়ে দিলো। তারপর হঠাৎ ভাবল, মা কি তবে…? প্রশ্নটা ভাবতে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। এখন যে পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হবে ওর জন্য। ইসাবেলা কী বলবে বুঝে ওঠে না। সশব্দে কেঁদে ওঠে। একটু পর আন্না মেরিও ওর দিকে ফিরলেন। ইসাবেলা ভাবল এবার মা বকবে। কিন্তু না, মা ওকে ঠান্ডা গলায় কাছে ডাকলেন। ওর চোখের জল মুছিয়ে দুহাতে হাত রেখে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে অপলক। ইসাবেলার মনে হলো মা বুঝি কিছুই শোনেনি। শুনলে এমন শান্ত কেন?
আন্না মেরিওর এই নিশ্চুপ থাকা কেবল বাহিরের। ভেতরটা ক্রোধে, দুঃখে পুড়ছে। কিন্তু বিচ্ছুরণকে কৌশলে চেপে রেখেছেন। কীভাবে রেখেছেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। ইসাবেলার বয়স কম। এই বয়সে আবেগে ভেসে কত ভুল করে মেয়েরা। মা হিসেবে ঠান্ডা মাথায় এর প্রতিকার করতে হবে৷ ফিরিয়ে আনতে হবে ভুল পথ, মানুষরূপী ওই পিশাচটার মায়াজাল ছিঁড়ে। আনতেই হবে। মেয়েকে মনের অবস্থা বুঝতে না দিয়ে মমতাভরা গলায় বললেন,
“ও একটা পিশাচ, মা। পিশাচ আর মানুষে সম্পর্ক হয় না। ও তোমার ক্ষতি করবে। ও তোমার জন্য ঠিক না। বলো, আমার কথা শুনবে। আর যাবে না ওর কাছে। বলো, বেলা।”
“অসম্ভব।” ছিটকে সরে বসল ইসাবেলা। আন্না মেরিওর ভেতর রাগ ফুঁসে ওঠে। পিশাচটা তাঁর মেয়েকে একেবারে বশ করে ছেড়েছে। এত সহজে তো হার মানবেন না তিনি।
“বেলা, লক্ষী মা আমার, সোনা আমার। মায়ের কথা শোনো। মা তোমার ভালোর জন্য বলছে। ভুলে যাও ওকে। তুমি যাকে ভালোবাসা বলছো ও স্রেফ ছল। ও তোমার জন্য ঠিক না। পাপ, পঙ্কিল ও। তুমি তো আমার পবিত্র মেয়ে। ওর মায়াজাল থেকে বেরিয়ে এসো মা আমার।”
“ও আমাকে সত্যি ভালোবাসে মা। তুমি মায়া বলছো যে সম্পর্ককে তা তারচেয়েও গভীর। ওকে ছাড়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আমাকে প্লীজ বোঝো মা।”
মেয়ের একগুয়েমি দেখে আর ধৈর্য রাখতে পারেন না আন্না মেরিও। চোখ পাকিয়ে রাগত গলায় বললেন,
“অসম্ভব! তুমি ওকে ছাড়তে পারবে না, ভুলতে পারবে না। তবে কি আমাদের ছেড়ে দেবে?”
ইসাবেলা মাথা নিচু করে চুপ রইল। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা বিফল হয় আন্না মেরিওর। হঠাৎ কি মনে করে আর্ত হয়ে তাকালেন,
“ওর সাথে তুমি শুয়েছো?”
লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে ইসাবেলা। মুখ চিবুকে লেগে যায়। আন্না মেরিওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তিনি কপাল চাপড়ে বলেন,
“এ কি পাপ করেছো তুমি, বেলা? আমার শিক্ষা ভুলে গেলে ওই পিশাচের পাল্লায় পড়ে? হা! প্রভু! আমার মেয়েটা এ কী ভুল করল। এখন আমি কী করব? কী হবে তোমার, বেলা! যদি তোমার পেটে পিশাচের বাচ্চা আসে? স্বেচ্ছায় মৃত্যু ডেকে আনছো তুমি, বেলা। কী সর্বনাশই না করলে।”
“মা! আমার সন্তান কখনো পিশাচ হবে না, কখনোই না।” এবার সামান্য তেজ এলো ইসাবেলার গলায়। আন্না মেরিও শ্লেষের সাথে বললেন,
“পিশাচ হবে না! যার সাথে শুয়েছ সে একজন পিশাচ। সন্তান তোমার নয় ওর। আর পিশাচের সন্তান মানুষ হয় না পিশাচই হয়।”
“তুমি নিকোলাসকে জানো না মা। ও কেবল নামেই পিশাচ এখন। বদলে গেছে ও। আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে মা। একবার ওর সাথে কথা বলেই দেখো। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি তোমার এখনকার ধারণা বদলে দেবে। একটা সুযোগ দাও আমাদের মা।” ইসাবেলা মিনতি করে বলল। আন্না মেরিও বললেন,
“মানুষ সহজে বদলায় না বেলা। আর ও তো একটা পিশাচ। তোমাকে মায়াজালে ফাঁসিয়েছে। তাইতো সত্যিটা দেখতে পারছো না। পৃথিবীর অন্যতম নির্মম-নিষ্ঠুর পিশাচ ও। ওর হিংস্রতা সম্পর্কে কোনো ধারণা তোমার নেই। গ্যারান্টির কথা বলছো? হুহ! ওর মতো বহুরূপীর মিষ্টি কথায় আমি ভুলব না। আমাদের জাত শত্রু ও। তোমাকে ব্যবহার করছে নিজের স্বার্থে, আমাদের বিরুদ্ধে। শোনো আমার কথা বেলা, ভুলে যাও পিশাচটাকে। আমাকে আর কষ্ট দিয়ো না।”
ইসাবেলা জানত এমনই হবে। মা মানবে না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করো। আমি ওর সাথে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকার ওয়াদা করেছি। ও আমার স্বামী, সঙ্গী। ওকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। এর চেয়ে পারোতো আমায় গলা টিপে নয়তো বিষ দিয়ে মেরে ফেলো।”
মেয়ের এমন কথায় রেগে আগুন হলেন আন্না মেরিও। এত বুঝানোর পরেও সেই এক কথা! উঠে এসে মেয়ের গালে সজোরে চড় দিলেন।
“তোমাকে আমার সন্তান বলতে লজ্জা হচ্ছে।আমার সামনে থেকে দূর হও, তুমি। এক্ষুনি।”
ইসাবেলা অশ্রুসিক্ত চোখ মুছতে মুছতে মাথা নুয়ে বেরিয়ে গেল মায়ের ঘর থেকে। বুকের ওপর থেকে অপরাধবোধের ভার চড়ের আঘাতে কিছুটা হালকা হলো। আর কোনো সাফাই দেবে না। দিয়ে লাভ হবে না। মাকে ও চেনে। নিকোলাসের কাছে চিরতরের জন্য চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তই সঠিক। ওর পরিবার ওদের ভালোবাসা, সম্পর্ক কোনোদিন বুঝবে না।
যেই মেয়ের গায়ে ফুলের টোকা দেননি আজ তাকেই কি না মারলেন? কষ্টে বুক ভার হলেও রাগটা বেশি। মেয়ে তাঁর শিক্ষা ভুলে বিপথে গেছে। মনে পড়ে যায় দিদার বলা কথা। ইসাবেলা তাহলে সেই নেকড়ে মানবি? আর নিকোলাস পিশাচ! নিজের স্বার্থের জন্য ও তাঁর মেয়েকে ব্যবহার করছে! কিন্তু ও যে এ বংশের নয়। পিশাচ তো! পিশাচে বিশ্বাস কী? মানুষের রক্তে যে বেঁচে আছে, মানুষের প্রেমের দাম সে কতটুকু দেবে? মেয়েকে তিনি জেনেশুনে মৃত্যুর হাতে সোপর্দ করতে পারবেন না। যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে। এবার ওই পিশাচের মায়াজাল থেকে মেয়েকে তিনি মুক্ত করবেন। যে কোনোভাবে।
দ্বিপ্রহরের সূর্য ক্লান্ত হয়ে এলো। মস্কোর সেই নির্জন পিশাচ দুর্গে তখনও পিশাচেরা মৃত্যু ঘুমে আচ্ছন্ন। অদূরে কোথাও নেকড়ের আর্ত গর্জন শোনা গেল। দুর্গের অভ্যন্তরে ঝুলতে থাকা বাদুড়গুলো মৃদু নড়ে ওঠে সেই শব্দে। ভূতুড়ে নিস্তব্ধ দুর্গের চারপাশ হঠাৎ দুলে ওঠে। কিছু অচেনা ত্রস্ত পায়ের বিচরণ, হাতিয়ারের ধাতবের গায়ে গায়ে লেগে ওঠা শব্দ, ওদের রেখে যাওয়া পথের দু’ধারের পাতায় পাতায় ঘর্ষণ দুর্গ প্রহরী নেকড়েদের সজাগ করে তোলে। ওরা অচেনা শত্রুদের আক্রমণ করার আগেই নিজেরাই অতর্কিতে আক্রমণের স্বীকার হয়। একদল কালো আলখেল্লা পরিহিত মানুষ ও কিছু বিজাতীয়, শঠ নেকড়ে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে প্রহরী নেকড়েগুলোকে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চললো দু পক্ষে। শঠতা, হিংস্রতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রহরী নেকড়েগুলোকে হত্যা করল অচেনা শত্রু দল। ক্ষতি তাদেরও হয়েছে কিছু। অর্ধেক সৈন্য মরে পড়ে আছে সামনে। এই ক্ষতি জয়ের আনন্দে ভেসে গেল। নিজেদের বিজয়ী ভেবে যেই না দুর্গের দুয়ার মুখী হবে ওমনি কোথা থেকে আরেকদল নেকড়ে এসে আক্রমণ করে বসল। ছিঁড়ে, কামড়ে খন্ড, বিখন্ড করে ফেললো ওদের দেহ। রক্তে লাল দুর্গের মুখ। সেই রক্তের গালিচায় এখনও জীবিত দাঁড়িয়ে দুজন আপাদমস্তক কালো আলখেল্লা ঢাকা মানুষ। নেকড়েগুলো দাঁত খিঁচিয়ে ওদের দিকে এগোয়। মানুষ দুটোর হাত সহ তরবারি কাঁপছে। পিছিয়ে যাচ্ছে। দুটো নেকড়ে লাফিয়ে আসতে তরবারি গেঁথে দিলো দুটোর বুকের ভেতর। কিছুক্ষণ গোঙাতে গোঙাতে নিথর হয়ে গেল নেকড়েদুটোর দেহ। আক্রোশে ফেটে পড়ে বাকি নেকড়ের দল। মানুষ দুটো আর দিশা না পেয়ে উলটো দিকে দৌড়াতে শুরু করল। কিছুদূর গিয়ে একে ওপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একজন দুর্গের উলটো দিকের ঝোপে ঢুকে পড়ে। তারপর সাবধানে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় সামনে। এদিক ওদিক ঘুরার পর একটি সুরঙ্গের মতো রাস্তা পেল। বাইরে নেকড়ের গর্জন শোনা যাচ্ছে। এখন বাইরে বের হওয়া অনিরাপদ। সুরঙ্গের ভেতরটাও টানছে ওকে। দোনোমোনো করে এগিয়ে গেল সুরঙ্গের দিকে। দিনের বেলাও কী ভয়ানক অন্ধকার! বিষাক্ত প্রাণীও আছে। তবুও কোনোরকমে সুরঙ্গের শেষে এসে থামল। খুশিতে ওর চোখ চকচক করে ওঠে। দুর্গের ভেতরে ঢুকতে পেরেছে। নিকোলাসের কফিন বের করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। হাতিয়ারগুলো আরেকবার দেখে নিকোলাসের কফিন খুঁজতে শুরু করল। সময়ের হিসেবে খানিক গড়মিল হলো তা কিন্তু টেরই পেল না। হঠাৎ সুরঙ্গের ভেতর পায়ের শব্দ শুনতে পায়। চট করে লুকিয়ে পড়ল আড়ালে। আত্মরক্ষার হাতিয়ার তুলে নেয় হাতে। যে পথে এসেছিল সে পথে একটা ছায়া এগিয়ে আসতে দেখল। ধীরে ধীরে ছায়াটি পূর্ণরূপে প্রকাশ পেতে ও বেরিয়ে আসে।
“রজার, আমি ফার্নান্দেজ তোমার বন্ধু। ভয় নেই চলে এসো সামনে।”
ছায়াটি কয়েক কদম দূরে এসে স্থির হয়। ফার্নান্দেজ এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে ছিল। বন্ধুকে দেখে মনে সাহস পেল। মুখ থেকে হুড কাঁধে ঠেলে ফেললো। রজার কিন্তু একচুল নড়ল না। মুখের ওপর তেমনই রইল হুডে ঢাকা। ফার্নান্দেজ হাতিয়ার কোচের ভেতর রেখে বলল,
“পিশাচটার কফিন এবার খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। তোমার কাছে তো ম্যাপ রয়েছে। ওটা দেখে এগোলে সহজে কফিনটা পেয়ে যাব। তারপর শালার জনমের রক্ততৃষ্ণা মিটিয়ে দেবো। দেখি দাও তো ম্যাপখানা। কই দাও।”
রজার ভেবে যাকে এতকিছু বলছিল সেই লোকটি এবার অট্টহাসি দিয়ে ওঠে। দুর্গ কেঁপে ওঠে ওর কর্কশ হাসিতে।
“ম্যাপ? ওর আর দরকার নেই। আমি তো তোমায় স্বয়ং নিকোলাসের সাথে দেখা করিয়ে দেবো বন্ধু আমার।”
বলেই হুডি খুলে ফেলে। ফার্নান্দেজ দেখল এতক্ষণ যার সাথে কথা বলছিল সে রজার নয়, নিকোলাস। ভয়ে বিস্ফোরিত হলো ওর চোখ। প্রাণ গলায় উঠে এলো। কোচ থেকে হাতিয়ার বের করতে নিকোলাস মুহূর্তে কেড়ে নেয়। নিরস্ত্র ফার্নান্দেজ পেছনে দৌড়াতে গেলে নিকোলাস অদৃশ্য হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ায় আবার। মেকি দুঃখ করে বলল,
“পালাচ্ছ? কেন? একটু আগে না বলছিলে আমার রক্ততৃষ্ণা জনমের তরে মেটাবে। এসো। কাছে এসো বন্ধু।”
ফার্নান্দেজ পিছিয়ে যায় ভয়ে।
“আ..আম..র ভুল হয়েছে। ক্ষ..মা করো।”
নিকোলাস ক্রুর কুটিল হাসল। শ্বাদন্ত বেরিয়ে এলো ঠোঁটের দু’পাশ থেকে।
“ক্ষমা, হুঁ? ঠিক আছে করলাম ক্ষমা। যাও।”
নিকোলাস ঘুরে দাঁড়ায়। ঠিক এই সুযোগে শার্টের বুকের ভেতর থেকে ক্রুশটা বের করে আনল। অন্য হাতে নিলো ছুরি। পেছন থেকে আক্রমণ করতে গেলেই অদৃশ্য হয়ে যায় নিকোলাস। আবার সেই হিংস্র হাসি। ফার্নান্দেজ আবার ব্যর্থ হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অদৃশ্য থেকে কেউ ওকে শূন্যে ছুঁড়ে ফেললো সামনে৷ পড়ে গিয়ে হাত থেকে ক্রুশ ও ছুরি খসে পড়ে অদূরে। নিকোলাস ফের আবির্ভূত হয়।
“বেইমানি! নিকোলাস ঘৃণা করে বেইমানদের।”
নিকোলাসের হাত সাঁড়াশির মতো ফার্নান্দেজের গলা চেপে ধরে। চোখ রক্তবর্ণ।
“আমাকে শেষ করবি? নিকোলাস উইলিয়ামকে? বোকার দল। ড্যামিয়ানের ভোলানো কথায় খামোখা জানটা দিতে আসিস। ও একটা ভীরু, কাপুরুষ। সাহস থাকলে তোদের না পাঠিয়ে নিজে আমার মুখোমুখি হতো। জানে পেরে উঠবে না। দ্য নিকোলাস উইলিয়ামকে শেষ করা ড্যামিয়ান ম্যাক্সওয়েলের শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে, হতাশাজনক স্বপ্ন।”
ফার্নান্দেজ শেষ সময়ে এসে যেন নিজের ভুলটা বুঝতে পারে। ড্যামিয়ান ওকে ঠকিয়েছে। ভুল করেছে ওই শয়তানটাকে বিশ্বাস করে। নিকোলাসের কাছে কাকুতি মিনতি করল ও। এবার আর নিকোলাস সেসবে ভোলে না। ঘুম থেকে জাগলে বড্ড তৃষ্ণা পায়। শত্রুর রক্ত সেই তৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে দিলো। ফার্নান্দেজের গলায় ফুটিয়ে দেয় তৃষ্ণার্ত দুটো শ্বাদন্ত। দুর্গ কাঁপিয়ে চিৎকার করেও একফোঁটা রক্ত বাঁচাতে পারে না ফার্নান্দেজ। চামড়া আর হাড্ডির খোলসওয়ালা ওর সাদাটে শব সুরঙ্গের নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে নিকোলাস।
ড্যামিয়ান আজকাল বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে এসব করে। সরাসরি লড়াই করার সাহস নেই বলেই এমন কাপুরুষোচিত কাজ করছে। ওকে উদ্দেশ্য করে গালাগাল দিলো।
পলটার চিঠি পায় না অনেকদিন। লোক পাঠিয়েছে খবর আনতে। ইসাবেলা ওদিকে আন্না মেরিওকে জানানোর পর কী ঘটেছে সেসব চিন্তায় মাথা ধরে এলো নিকোলাসের। স্থান ত্যাগ করবে তখনই শুনতে পায় আরেকটি মনুষ্য চিৎকার! ক্রোধে চোখ লাল হয়ে ওঠে ফের। চাপা গর্জন করে বলে,
“ফাকিং ম্যাক্সওয়েল রজার!”
চলবে,,,,