তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৮+৯+১০

0
981

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ০৮
Writer Taniya Sheikh

শীতকে বিদায় দিতে এবং বসন্তকে সাদরে বরণ করে নিতে প্রতি বছর শীতের শেষ সময়ে পালিত হয় মাসলেনিৎসা উৎসব। ঐতিহ্য অনুসারে রাশিয়ার ঘরে ঘরে প্যানকেন তৈরি করা হয়। বাতাসে সেই মিষ্টি গন্ধ ভাসে। অতিথিদের আগমনে বাড়িতে বাড়িতে জমে ওঠে খুশির আমেজ। ইরুম (কাল্পনিক) গ্রামে এবার সেই আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই। গাঁয়ের লোকদের আতঙ্কে কেটেছে পুরো শীতের সময়টা। ফাদার জালোনভ তাদের কথা দিয়েছিলেন মাসলেনিৎসার আগেই সব ঠিক হয়ে যাবে। স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরবে সবাই। ফাদার জালোনভ সে কথা রাখতে পারলেন না। তাঁর সামনে এখন যেই গ্রামটির চিত্র- এ কোনো গ্রাম নয়, মৃত্যুপুরি। একে একে গায়ের লোকদের ওরা শেষ করে ফেলেছে। শয়তানের লালসায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হলো। ফাদার চেষ্টা করেও গ্রামের লোকদের বাঁচাতে পারলেন না। নিজেকে দোষারোপ করলেন ওদের করুন পরিণতির জন্য। নিজের ক্ষত-বিক্ষত শরীরের ব্যথা থেকে ওই নিরপরাধ মানুষগুলোর মৃত্যু তাঁকে বেশি পীড়িত করে। ওদের মৃত্যুর প্রতিশোধটুকুও বুঝি আর নেওয়া হলো না! এই অক্ষমতা, অসহায়ত্বের যন্ত্রণায় কাতর হলেন। অদূরে চার্চের উপর ক্রুশটার দিকে চোখ পড়তে উঠে বসতে চেষ্টা করলেন। পা দুটো অসাড়। প্রায় রক্তশূণ্য শরীরটা কনুয়ে হেঁচড়ে সামনে এগোতে চান। কিন্তু পারেন না। তাঁর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। পৃথিবীতে তাঁর জন্য বরাদ্দ অক্সিজেন কী তবে ফুরাল? কিন্তু এখনও কত কাজ বাকি। মাথা তুলে আকাশে চেয়ে বিড়বিড় করলেন,

“সাহায্য করো প্রভু, সাহায্য করো আমাদের।”

“ফাদার!”

ভ্যালেরিয়া অশ্রুসজল চোখে ফাদারের সামনে এসে হাঁটু ভেঙে বসল। মেয়েটার পরনের হ্যাবিট জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া, রক্তে রঞ্জিত। ডান বাহুতে গভীর তাজা ক্ষত। ঘাড়ের ওপাশটা থেকেও তাজা রক্ত পড়ছে। হাতের তলওয়ার ফেলে ফাদারের মাথাটা কোলে তুলে নিলো ভ্যালেরিয়া। গলা শুকিয়ে আসে ফাদারের। বড্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। শ্বাস- প্রশ্বাসের গতি অস্বাভাবিক হতে লাগল। ফাদারকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখে ভ্যালেরিয়া কাঁদছে।

“ফাদার, কথা বলুন, ফাদার।”

“আমরা বাঁচাতে পারলাম না কাওকে সিস্টার। ওরা নিরীহ মানুষগুলোকে শেষ করে ফেললো। সব দোষ আমার। আমার ভুলে ওরা মারা গেল।” ভগ্নকণ্ঠে বললেন ফাদার। ভ্যালেরিয়া তাকে বুঝাতে চেষ্টা করে,

“আপনার কোনো দোষ নেই ফাদার।”

“আমারই দোষ সিস্টার, আমারই দোষ। আমার অক্ষমতায় ওরা মারা পড়ল। এরচেয়ে শয়তানের বশ্যতাও বুঝি__”

বুকে ক্রুশ আঁকে ভ্যালেরিয়া।

“ফাদার! ও কথা মুখে আনবেন না। ঈশ্বর নারাজ হবে।”

“আমি জানি!” গলার স্বর ভাঙে ফাদারের। আকাশের দিকে মুখ তুলে কাতর কণ্ঠে বলেন,

“প্রভু, এই নিষ্ঠুরতা কী করে দেখলে? কী করে সইছ এখনও?”

ভ্যালেরিয়া ফাদারকে সান্ত্বনা দেয়,

“ফাদার, আপনিই বলেছিলেন প্রভু যা করে তাতেই মঙ্গল নিহিত। প্রভুর উপর বিশ্বাস হারাতে নেই। হয়তো ওদের মৃত্যুর মধ্যেই কল্যাণ নিহিত ছিল। এই বিপৎসংকুল পৃথিবী ছেড়ে ওরা প্রভুর কাছে ফিরে গেছে। এখন ওদের আর ভয় কী? শান্তিতে আছে ওরা সব।”

ফাদারের শ্বাসে টান ওঠে। শরীরের অঙ্গ প্রসঙ্গ বলহীন হয়ে পড়ে। দেহ রক্তশূণ্য ফ্যাকাশে। চোখ দু’টো বির্বণ, মৃত্যু যন্ত্রণায় অশ্রুসিক্ত। ভ্যালেরিয়া শঙ্কিত হয়। ফাদার বুকের বা’পাশ চেপে ধরে বলেন,

“সিস্টার, আমার সময় বুঝি শেষ হয়ে এলো। এবার আমাকেও ঈশ্বরের কাছে ফিরতে হবে।”

ভ্যালেরিয়া কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ায়,

“না, ফাদার__” অতি ক্রন্দনে কণ্ঠরোধ হয়ে আসে ভ্যালেরিয়ার। ফাদার শুকনো হেসে বলেন,

“আপনাকে এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না সিস্টার। অনেক দায়িত্ব আপনার। শক্ত হোন। শয়তানগুলোকে শেষ করার দায়িত্ব এবার আপনি নেবেন। আমার উত্তরসূরি হবেন আপনি।”

কাঁপা কাঁপা দূর্বল হাতে পকেট থেকে ছোট্ট একটা গোল বাক্স বের করলেন। বাক্সটি দেখতে বেশ রাজকীয়। চারপাশে লাল মখমল কাপড়ের লেছ আর সুন্দর জরি দেওয়া। বাক্সটির উপরে নীল জ্বলজ্বলে পাথর। ভ্যালেরিয়ার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

“এই বাক্সটা যেভাবেই হোক ফাদার কাজিমির পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে আপনাকে। এখন থেকে তিনিই আপনাকে দিকনির্দেশনা দেবেন। আর হ্যাঁ, ঘুণাক্ষরেও ওরা যেন বাক্সটা সম্পর্কে জানতে না পারে। এক্ষুনি রওনা দিন।”

ফাদারকে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে কী করে যাবে ভ্যালেরিয়া? সে যেতে রাজি নয়।

“আপনাকে এই অবস্থায় ফেলে কোথাও যাব না আমি।”

“বোকামির সময় নয় এখন সিস্টার। যা বলছি শুনুন। ওরা এখানে পুনরায় ফিরে আসার আগে প্রস্থান করুন। যান বলছি।”

ফাদার আদেশ করলেন। তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। ভ্যালেরিয়াকে ইশারায় যেতে বলার পরও ভ্যালেরিয়া বসে রইল। শব্দ করে কাঁদছে সে। ফাদার মুখ হা করেন কিন্তু শব্দ বেরোয় না। প্রাণটা মুক্ত হতেও কী পীড়া! হঠাৎ দুজনের কানে এলো নেকড়ের হিংস্র গর্জন। ওরা এদিকেই আসছে। আকাশে অমাবস্যার চাঁদ। অশুভ শক্তির উন্মত্ত নৃত্যে প্রকৃতি গম্ভীর।
ফাদার ঝাপসা চোখে পুবের জঙ্গলের দিকে তাকালেন। পরিচিত গলার আর্তচিৎকার ভেসে এলো। ফাদার আর্ত চোখে ভ্যালেরিয়ার দিকে তাকালেন। আঙুলে ইশারা করলেন মনুষ্য গলায় ভেসে আসা চিৎকার যেদিক থেকে আসছে সেদিকে। পুবের জঙ্গলের পরেই বরফে ঢাকা সমতল। লোকালয়ের সামনের দিকটাতে জায়গাটা। ফাদার আর ভ্যালেরিয়া পরিত্যক্ত বাড়ির লনে এমুহূর্তে। সামনের ঝোপঝাড় খানিকটা আড়াল করেছে দুজনকে। তিনটে মানুষ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ছুটে আসছে লোকালয়ের দিকে। ভ্যালেরিয়া ওদেরকে চেনে। ফাদার অগাস্টাস, ডক্টর বরিস আর নীনা। ভ্যালেরিয়ার দৃষ্টি গেল ওদের পেছনে। একদল হিংস্র নেকড়ে ছুটে আসছে। হঠাৎ ম্যাথিউ আর টনির কথা মনে পড়ল। ওরা কোথায়? ভ্যালেরিয়ার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল ছুটে আসা তিনজনের আর্তনাদে। নেকড়েগুলো শিকার ধরতে পেয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ওরা তো শুধু শিকার নয়, শত্রুও ছিল। শয়তানগুলোর বিজয় গর্জন, আর মানুষ তিনজনের মৃত্যু যন্ত্রণার গগনবিদারী আর্তনাদে উজাড় হওয়া এই গাঁ কেঁপে ওঠে। সাথীদের বাঁচাতে যাবে তখনই ফাদার ওর হাত চেপে ধরলেন। ওদের যন্ত্রণাকাতর চিৎকার থেমে গেছে। শয়তানগুলো লাশ তিনটে নিয়ে উল্লাস করছে। ভ্যালেরিয়ার বুকে ক্রুশ আঁকে আর কাঁদে। ফাদার অস্ফুট গোঙানির স্বরে আদেশ করলেন পালাতে। ভ্যালেরিয়া অশ্রুসিক্ত চোখে ফের মাথা নাড়ায়। ফাদারকে ছেড়ে, সাথীদের ছেড়ে একা পালাবে না সে। ম্যাথিউ আর টনিকেও খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো ওরা বেঁচে আছে। নেকড়ের গর্জন আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। লাশগুলোকে নখরাঘাতে খন্ড বিখন্ড করে ছুঁড়ে ফেলল পাশে। ফাদার ভ্যালেরিয়ার কর্তব্য মনে করিয়ে দিলেন। কর্তব্যের কাছে কোনো মায়ার স্থান নেই। এই মুহূর্তে পালানোর আদেশ করলেন। মুখ হা করে শ্বাস টানছেন ফাদার। কথা বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ৷ দূর্বল হাতে শেষবার বুকে ক্রুশ এঁকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পারি জমালেন। ভ্যালেরিয়া এর পূর্বেও মৃত্যু দেখেছে। কিন্তু ফাদার আর সাথীদের এই নির্মম মৃত্যুতে মুষড়ে পড়ল আজ। লড়াই করার শক্তি হারিয়ে ফেলল। উঠে দাঁড়াবে সেই সময় দৃষ্টি গেল জঙ্গলে উপর। একটা বাদুর উড়ছে সদর্পে। তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। শয়তানগুলো বিজয়ের আনন্দে মেতেছে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বিজয় নিশ্চিত ছিল তাদের। তবে কোথায় ভুল হলো? কোন ভুলে হলো এই অপূরণীয় ক্ষতি? ফাদারের লাশের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ভ্যালেরিয়া। শয়তানগুলো টের পাওয়ার আগেই তাকে পালাতে হবে। ফাদারের মুখটা শেষবার দেখে নিলো। মানুষটা তাকে স্নেহ করত খুব। সামনে নেকড়েগুলোকে ওর সাথীদের ছিন্ন ভিন্ন লাশ নিয়ে আনন্দ করতে দেখে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। ফাদার অগাস্টাসের হাসি, ডক্টর বরিসের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, নীনার চঞ্চলতা স্মরণে করে চোখের জল থামল না। ভগ্ন হৃদয়ে কোনোমতে সামনের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির ভেতরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। এত মৃত্যুতে ও হতবিহ্বল, স্তব্ধ। ভ্যালেরিয়া ভয় পায় মৃত্যুকে, ভীষণ ভয় পায়। হাঁটু মুড়ে ক্রুশটা মুঠোবন্দি করে নীরবে কাঁদতে লাগল। কান্না গলায় আঁটকে যায় কাছাকাছি বাদুরের ডানা ঝাপটানোর শব্দে। সমস্ত শরীর ভয়ে কাটা দিয়ে ওঠে। লড়াই করার মতো শক্তি ভ্যালেরিয়ার এই মুহূর্তে নেই। মনে মনে বিধাতাকে স্মরণ করল। এখন তিনিই ওর ভরসা। ইসাবেলার মুখটা মনে পড়ে। তিন দিনের স্থানে পাঁচদিন হয়ে গেল মাদামের বাড়িতে যেতে পারেনি ভ্যালেরিয়া। মেয়েটি হয়তো এখনো ওর পথ চেয়ে বসে আছে। হঠাৎ বাড়ির সামনে দরজা সশব্দে খুলে যায়। বুটের জুতার ভারী শব্দ এগোতে লাগল। ভ্যালেরিয়া দুচোখ বন্ধ করে। বন্ধ নেত্র দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। ঝাপসা চোখে ভেসে ওঠে ইসাবেলার মুখ। ভ্যালেরিয়া মনে মনে ওকেই স্মরণ করে।

“ক্রাসিভায়া”

অসুস্থ শরীর টেনে তুলে বিছানায় বসল ইসাবেলা। খিদে পেয়েছে খুব। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো, মাদামের খোঁজ নেই। সকালে খাবার নিয়ে আসেননি, ডাকেনওনি। ইসাবেলা দূর্বল গলায় ডাকল,

“মাদাম, মাদাম।”

না, কোনো সাড়াশব্দ নেই। গেল কোথায় মাদাম? ইসাবেলা বিছানায় ছেড়ে নামে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে মাথা ঘুরে ওঠে। দিনদিন শরীর আরো খারাপ হচ্ছে ওর। আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ত্বক। অথচ, এখন ও আর সেই দুঃস্বপ্নটা দেখে না। মাদামের তৈরি ঘুমের ওষুধ রোজ রাতে খায়। এক ঘুমে সকাল। কিন্তু ঘাড়ের ক্ষত তেমনই তাজা। ভয় এখানেই ইসাবেলার। আগে যা গোচরে ঘটত এখন অগোচরে ঘটে। কাকে বলবে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এই অদ্ভুত ঘটনার কথা? মাদামকে? কিন্তু তাঁর সময় কই? এতদিন নিকোলাসকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। গতরাতে সে বিদায় নিয়েছে। ভোরে মাদামের হা হুতাশ শুনে বুঝতে পেরেছে নিকোলাস চলে গেছে। নিকোলাসের বিদায়ের সময় অবশ্য ইসাবেলা জাগ্রত ছিল না। ওইদিন কিচেনের ঘটনার পর থেকে যথাসম্ভব নিজেকে আড়াল করেই রেখেছিল সে। শরীরটাও বেজায় অবসন্ন ছিল। বিছানা ছাড়তেই মন চায়নি। তবে মাদাম আর নিকোলাসের খোশগল্প নিজের রুমে শুয়ে একটু আধটু শুনতে পেয়েছিল। নিকোলাসের হাসির শব্দ ইসাবেলার কানে মধুর সুরের মতো বাজে। এত চমৎকার হাসি কারো হয়? পরক্ষণেই নিজেকে তিরস্কার করত। সে কেবল পিটারকে পছন্দ করে, পিটারকে ভালোবাসে। পিটারের হাসিই চমৎকার লাগবে। অন্য পুরুষের হাসি নয়। বেড়ালের গোঙানির আওয়াজে ভাবনার সুতো ছেঁড়ে। এ বাড়িতে বেড়াল কোথা থেকে এলো? মাদাম বেড়াল পছন্দ করেন না। সামনের বাড়ির ভদ্রমহিলার বেড়ালটা প্রায় উঁকিঝুঁকি দিতো। ইসাবেলা ওটাকে একবার কোলে তুলতে মাদাম চেঁচিয়ে উঠেছিলেন,

“ফেলো ওটাকে, ফেলো এক্ষুনি।”

যেন কোনো নোংরা বস্তু ইসাবেলা কোলে তুলেছে। মাদামের মুখ ঘৃণায় বিকৃত হয়ে উঠল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেড়ালটাকে কোল থেকে নামিয়েছিল সেদিন। বেড়ালটা মাদামকে দেখে ভীত চোখে ম্যাঁও ম্যাঁও করে ইসাবেলার পা ঘেঁষে দাঁড়ায়। মাদাম ওটাকে লক্ষ্য করে জুতো ছুঁড়ে মারতে পালিয়ে যায়। এরপর ইসাবেলাকে মাদাম সতর্ক করেছেন ওসব থেকে দূরে থাকার জন্য। অন্তত তাঁর বাড়িতে যতদিন আছে ততদিন। ইসাবেলার ভীষণ খারাপ লেগেছিল মাদামের ওই ব্যবহার। ওমন তুলতুলে, নিষ্পাপ প্রাণীর উপর মাদামের এহেন নিষ্ঠুরতা কষ্ট দিয়েছিল। আজ আবার বেড়ালটা এলো ভেবে আনন্দ হলো। মাদাম দেখার আগেই ওটাকে লুকিয়ে কোলে তুলে একটু আদর করবে বলে ভাবল। দেয়াল ধরে চলে এলো বসার ঘরে। সদর দরজা বন্ধ। বেড়ালটা কোথায়? এদিক ওদিক তাকাল। না, নেই। কিচেন থেকে ছুড়ি চালানোর শব্দ আসছে। মাদাম তাহলে ঘরেই আছে? ইসাবেলার ডাক কী তিনি শুনতে পাননি? ইসাবেলা কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। দরজার কাছাকাছি যেতে মাদামকে দেখল। হাতে ধারালো রক্তাক্ত চ্যাপ্টা ছুড়ি। দরজার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু একটা কাটছেন তিনি। আরেকটু এগিয়ে যেতে থমকে দাঁড়ায় ইসাবেলা। বেড়ালটার দ্বিখণ্ডিত দেহ পড়ে আছে মাদামের সামনে। গা শিউরে উঠল এ দৃশ্য দেখে। বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। মাদাম ঘুরে দাঁড়ালেন তখনই। তাঁর মুখে লেগে আছে তাজা রক্ত। কী বিভৎস, ভয়ংকর তাঁর মুখ! চিৎকার দিয়ে ছিটকে সরে দাঁড়াতে গিয়ে নিচে পড়ে গেল ইসাবেলা। মাদামের ঠোঁটে পৈশাচিক হাসি। ছুড়ি হাতে কয়েক কদম এগিয়ে এসে বললেন,

“ও ঠিকই বলেছিল। গরম রক্ত ভারী মজার। এই নচ্ছার বেড়ালটার রক্তও কম স্বাদের না। দারুন সুস্বাদু। একটু চেকে দেখবে না কি ইসাবেলা? নাও।”

রক্তমাখা হাতটা মুখের সামনে ধরতে ইসাবেলা ফের ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এক দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। কিচেন থেকে ভেসে আসছে মাদামের অট্টহাসি। ভয়ে, আতঙ্কে ইসাবেলার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মাদামের একি হলো হঠাৎ! ইসাবেলা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে তাঁর দৃষ্টির অস্বাভাবিকতা। কী ভয়ংকর, নিষ্ঠুর চাহনী! সেই মমতাময়ী মাদাম আর এই মাদামে আকাশ পাতাল ফারাক। এই ফারাক কীভাবে হলো? কোন অশুভ ছায়া নেমে এলো তাদের জীবনে? কাঁপতে কাঁপতে বিছানার কাছাকাছি যেতে অচেতন হয়ে পড়ে ইসাবেলা।

চলবে,,,

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ০৯
Writer Taniya Sheikh

ভয়!
মৃত্যুর ভয়, স্বজন হারানোর ভয়, প্রিয় মানুষ হারানোর ভয় আর নিজের স্বাভাবিকতা হারানোর ভয়। একটা মানুষ বোধ হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ভয়টাকে মাথায় করে বেঁচে থাকে। জীবনের সবখানে ভয় আর ভয়। ইসাবেলা চোখ খুলতেও এখন ভয় পায়, তেমনই চোখ বন্ধ করলেও। সে বুঝতে পারছে ভয় নামক অনুভূতি তার সকল অনুভূতিকে দূর্বল করে দিচ্ছে। জীবনের পথ হঠাৎ বাঁক পালটেছে। কিছুদিন আগেও সে ছিল সবচেয়ে সুখী মানবী। জীবনের এই কঠিন মুহূর্তগুলো থেকে মা তাকে আড়াল করে রেখেছিল। এক পিটারকে ভালোবেসে আজ ওর জীবনে ভয়ের আধিপত্য। এক পিটারের বিরহে আজ ইসাবেলা ভেঙেচুরে বিক্ষিপ্ত। ভালোবাসায় এত যন্ত্রণা কেন? সে তো পবিত্র মনে ভালোবেসেছিল। কোনো মিথ্যা, ছল কিছুই ছিল না। তাহলে কেন বিধাতা এই শাস্তি দিলেন? কেন পিটার ছেড়ে গেল? আজ সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ক’মাস আগেও কী ভেবেছিল জীবন তাকে টেনে এই ভয়ার্ত পরিস্থিতিতে ফেলবে! এত কাঁদাবে? পরিবারের আদরের ইসাবেলার জীবন ছিল নিরাপদ, সুন্দর। সতেরো বছরের তীরে এসে কেন আজ জীবন এই ক্রুরতা দেখাচ্ছে? দুচোখে কত স্বপ্ন, আশা দেখেছিল। সবই এখন ভয়ের শিশমহলে বন্দি। ভয়! এই শব্দটা অনুচ্চস্বরে আওড়াল কয়েকবার। ভয় উতরে যেতে পারবে কী ইসাবেলা? এখানেও ভয় ওর। সে বোধহয় পারবে না। ভয় প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। অন্যদিকে ইসাবেলা দূর্বল, ভীত। পা দুটো কাঁপছে ইসাবেলার। ভয় এই বুঝি ফের পড়ে যায়, চেতনা হারায়। টলতে টলতে জানালার পাশ ছেড়ে এসে বসল বিছানার কোণে। শীতে থরথরিয়ে কাঁপছে। লেপটা গায়ে জড়িয়ে জবুথুবু হয়ে বসল। গতরাতে চেতনা ফেরার পর রুম থেকে বের হয়নি। মাদামের ওই অস্বাভাবিক আচরণে ভীতসন্ত্রস্ত ইসাবেলা। শরীরটা আরো খারাপ লাগছে। রাতে শুয়ে শুয়ে খুব কেঁদেছে। মনে পড়েছে পরিবারের কথা। ভ্যালেরিয়ার কথা। কেন যে আসছে না সে? চিন্তায় চিন্তায় নির্ঘুম কাটিয়েছে রাত। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো গতরাতে দুঃস্বপ্নটা সে দেখেনি কিংবা বলা যায় সেই ভয়ংকর মুহূর্তের সম্মুখীন হতে হয়নি। সারারাত শঙ্কিত ছিল। ভোর হতে চোখের পাতা ঘুমে নেমে আসে। বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। দূর্বল, ক্ষুধার্ত ইসাবেলার অবস্থা বড়ো শোচনীয়। হাত দু’টো থরথর করে কাঁপছে। পেটে অসহনীয় যন্ত্রণা। গলা শুকিয়ে কাঠ। এভাবেই বুঝি মৃত্যু হবে ওর, মুক্তি হবে সকল যন্ত্রণা থেকে। তারপর আর দেখবে না পৃথিবীর এই নিষ্ঠুর, বিভৎস রূপ। কিন্তু মনের এককোণে এখনও একটুখানি বাঁচার সাধ। কেন এই সাধ? কীসের মায়া ইসাবেলার বাঁচার সাধ জাগায়? ইসাবেলার ফ্যাকাশে মুখশ্রী বেয়ে উষ্ণ নোনাস্রোত গড়িয়ে পড়ে। ভ্যালেরিয়া কী এবারও আসবে তাকে বাঁচাতে? অস্ফুটে ক্রন্দন করে সে।

“কোথায় তুমি ভ্যালেরি?”

মাদামের পদশব্দে চকিত হলো ইসাবেলা। জ্ঞান ফেরার পর থেকে মাদামের সাড়াশব্দ পায়নি। এই সময় হঠাৎ তাঁর অস্তিত্ব ইসাবেলার ভীতি বাড়িয়ে দেয়। ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। ঈশ্বর নাম জপছে বারংবার। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল জড়োসড়ো হয়ে। মাদামের পায়ের শব্দ দরজার কাছে এসে থামল। অনেকক্ষণ আর কোনো শব্দ পেল না ইসাবেলা। লেপটা সামান্য সরিয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকায়। দরজার ওপাশে মাদাম এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে স্থির হয়ে। হঠাৎ বাইরে পরিচিত গলার স্বর শুনতে পায়। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতে বুঝতে পারল প্রতিবেশিনী ভদ্রমহিলার গলার স্বর। মাসলেনিৎসা উৎসবের ধুম গাঁয়ের ঘরে ঘরে। একমাত্র মাদামের গৃহেই বুঝি এই ভয়ানক থমথমে ভাব। বাড়িতে এই সময় কত আনন্দ করেছে সে। সেসব স্মৃতি মনে পড়তে কান্না ঠেলে আসে। ইসাবেলা নিঃশব্দে উঠে বসল। জানালার পর্দা সামান্য সরাতে দেখল প্রতিবেশীদের লনে অতিথিদের হৈ হুল্লোড়। মনে খানিকটা সাহস হলো এবার। সদর দরজার বাইরে প্রতিবেশিনী এখনো ডাকছেন। মাদাম নয় এবার ইসাবেলার নাম ধরে ডাকছেন তিনি। ইসাবেলার দরজার সামনে থেকে মাদামের ছায়ামূর্তিটি তখন সরে গেল। প্রতিবেশিনী বার কয়েকবার ডেকে ক্ষান্ত দিলেন। ফিরে বাড়ির লনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভদ্রমহিলার স্বামী, মেয়ে আর একজন যুবকও সেখানে দাঁড়ান। যুবকের হাতে সুরার গ্লাস। ভদ্রমহিলা মাদামের বাড়ির দিকে লক্ষ্য করে বিমর্ষ মুখে ওদের কিছু বলছেন। ওদের দৃষ্টি জানালার দিকে পড়তে দ্রুত পর্দাটা ফেলে দিলো ইসাবেলা। তারপর মনে হলো, কেন ভয়ে ভয়ে আছে? জানালা খুলে চিৎকার করলেই সাহায্য পাবে। জানালা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। একটু খেয়াল করতেই দেখে বাইরে চিকন লম্বা কাঠ দ্বারা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে জানালার কবাট। কাজটা কে করেছে বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর। ভয়টা তাতে করে আরো বাড়ল। অনেকক্ষণ বসে রইল অসহায়ভাবে। ওর সামনে এখন দুটো পথ। হয় এভাবে বসে বসে মৃত্যুকে স্বাগত জানানো নয়তো সাহসের সাথে ভয়ের মোকাবেলা করা। সাহসের মৃত্যুতে সম্মান আছে। সে সিদ্ধান্ত নিলো দরজা খুলবে। ভয়ের মুখোমুখি হবে। বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। পা দুটো কম্পিত। দেয়াল ধরে দরজার কাছে গিয়ে থামে। লম্বা শ্বাস নিলো। মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপল কয়েকবার। আস্তে আস্তে দরজার ছিটকিনি খুলে উঁকি দিলো এদিক ওদিক। মাদাম নেই। ধীর পদে বাইরে বেরিয়ে এলো। ওই তো সদর দরজা। ইসাবেলা সেদিকে পা বাড়ায়। ভয়ে সর্ব শরীর কাঁপছে ওর। এই বুঝি মাদামের সেই ভয়ানক, অপ্রকৃতস্থ রূপটা আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। সে সদর দরজা খুলে আলোতে এসে পৌঁছেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। চোখে মুক্তির আনন্দ জল। প্রতিবেশিনী ভদ্রলোক প্রথম দেখলেন ইসাবেলাকে। তারপর একে একে বাকিরা। সকলে উদ্বিগ্ন মুখে এদিকেই আসছে। ইসাবেলাও ছুটছে সামনে। কিন্তু খুব বেশিদূর যাওয়ার শক্তি ওর মধ্যে নেই। মাদামের বাড়ির সামনের বরফে আচ্ছাদিত উঠোনের উপর মুখ থুবড়ে পড়ল। ভদ্রমহিলা ইসাবেলাকে ধরে তুললেন। ইসাবেলা ফুঁপিয়ে ওঠে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে মাদামের দরজার দিকে আঙুল তুলে ইসাবেলা বলল,

“মাদাম, মাদাম।” এর বেশি ওর গলা দিয়ে বের হলো না। কান্নায় জড়িয়ে যাচ্ছে শব্দ। ভদ্রমহিলা বুকে জড়িয়ে ধরলেন ইসাবেলার কম্পিত শরীরটা। ভদ্রলোক আর তাঁর সাথের যুবকটা ছুটে গেল মাদামের বাড়ির ভেতর। ইতোমধ্যে আশেপাশের বাড়ির অনেকে এসে কৌতূহলে ভিড় জমিয়েছে। অনেকে ঢুকলেন মাদামের বাড়ির অন্দরে। ইসাবেলার আর্ত দৃষ্টি দরজার দিকে। ভদ্রমহিলার মেয়ে ঘর থেকে গরম কাপড় এনে ওর গায়ে জড়িয়ে দিলো। কবোষ্ণ এক গ্লাস পানি দিলো পান করতে। একটু পর একটা রাগত গলার চিৎকার শোনা গেল। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে মাদামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক ছুটলেন। হাতে তাঁর মাদামের সেই রক্তমাখা ধারালো ছুরি। উচ্চৈঃস্বরে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছেন মাদামকে উদ্দেশ্যে। তাঁর স্ত্রী, সন্তানেরাও এসে যোগ দিলো। ওরা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে মাদামের বাড়ির ভেতর ঢুকল সবাই। তখনই ইসাবেলার মনে পড়ল বেড়ালটা কথা। বেড়ালটা ওই ভদ্রলোকের পালিত। মাদামের এই নিষ্ঠুরতা দেখে বাকরুদ্ধ গাঁয়ের লোক। প্রতিবেশিনী ভদ্রলোক এসে জানালেন, মাদাম বাড়ির ভেতর নেই। তাঁকে তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও পাওয়া গেল না। অথচ, এই খানিকক্ষণ আগেও ইসাবেলা তাঁকে দরজার বাইরে দেখেছে। ওটা কী মাদাম ছিলেন না?

প্রতিবেশিনী ভদ্রমহিলা ইসাবেলাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। ডাক্তার ডাকা হলো। ইসাবেলা ভীতসন্ত্রস্ত। ডাক্তারের কোনো কথার জবাবই সে ঠিকমতো দিতে পারল না। নিজের দুঃস্বপ্নের কথা অগোছালো ভাবে বলল। ডাক্তার সেটাকে অসুস্থতাজনিত ভ্রম ভেবে গুরুত্ব দিলেন না। ইসাবেলাকে পরীক্ষা করে দেখলেন, ওর শরীর প্রায় রক্তশূন্য। ইমার্জেন্সি রক্ত দিতে হবে জানালেন ডাক্তার। রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। এই বাড়ির সেই যুবকটি রক্ত দিলো। যুবক ভদ্রলোকের হবু জামাতা। ইসাবেলার মুখ থেকে সব শুনে চিন্তিত দেখায় তাকে। কিছু একটা আন্দাজ করছে সে। বেশিক্ষণ সেটা নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারল না। রক্ত দেওয়া হলে হবু শ্বশুর এবং ডাক্তারকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“মেয়েটার এই অবস্থার জন্য অতিপ্রাকৃত কিছু দায়ী নয়তো? ওই দুঃস্বপ্নটার কথা ভেবে দেখেছেন একবার?”

হবু শ্বশুরমশায় চিন্তিত মুখে বললেন,

“ওসব কিছু নয়। ইসাবেলা এমনিতেও অসুস্থ ছিল। তবে এতটা নয়। এই তো কিছুদিন আগেও বেশ হাসিখুশি দেখেছিলাম। হঠাৎ এমন কেন যে হলো? আপনার কী মনে হয় ডাক্তার সাহেব?”

ডাক্তার একটু ভেবে বললেন,

“শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মেয়েটি। খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করেনি। ওই বুড়ি কী ওষুধ দিয়েছে কে জানে? তার উপর বুড়ির ওই পাগলামি মেয়েটিকে ট্রমায় ফেলেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ভুল চিকিৎসা আর আতঙ্কে আজ ওর এই অবস্থা। প্রোপার টেক কেয়ার আর ট্রিটমেন্টের খুব বেশি প্রয়োজন এখন। আমি ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। জাগলে আমাকে জানাবেন।”

ডাক্তারের কথার সাথে যুবক কেন যেন সম্মত হতে পারল না। সে বলল,

“আর ওই যে রাতের ঘটনার কথা বলল। যা কয়েকরাত ধরে ঘটছিল ওর সাথে। ওর শরীরের রক্তশূন্যতা। আপনার মনে হয় না এসব অস্বাভাবিক?”

ডাক্তার মৃদু হাসলেন,

“ওসব ওর ভ্রম। মানসিকভাবে অসুস্থ হলে এমন হ্যালুসিনেশন হয়। সুস্থ হলে দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”

ডাক্তার আর তর্ক করার সুযোগ না দিয়ে বিদায় নিলেন। অযথা সময় নষ্ট করলে পকেটে টাকা আসবে কী করে? এই গাঁয়ের রোগীদের কাছে তাঁর যথেষ্ট চাহিদা। বুড়িটার কারণে একটু আকটু ঝামেলা হতো। এবার সেটাও বোধহয় মিটে গেল।
ডাক্তার চলে যেতে যুবক হবু শ্বশুরকে বলল,

“আমার একটু ভয় হচ্ছে।”

“কেন বলোতো!”

“আপনি রক্তচোষার কথা শুনেছেন?”

হবু শ্বশুরমশায় এত চিন্তার মধ্যেও হাসলেন। হবু জামাতার কাঁধ জড়িয়ে বললেন,

“শুনব না কেন? ওসব কল্পকাহিনি শুনেই তো বড়ো হয়েছি।”

“আপনি হাসছেন? আমি কিন্তু সিরিয়াসভাবেই বলছি। সতেরো শতকের দিকে জার্মানির একটি শহরে রক্তচোষার খুব প্রাদুর্ভাব বেড়েছিল। কথিত আছে, সেখানকটার একটি শহরের প্রায় সকলে মানুষ থেকে রক্তচোষাতে রূপান্তরিত হয়!”

“কোন শহরের কথা বলছ?”

যুবক একটু ভাবুক হয়ে বলল,

“বেসেলের কাছাকাছি একটি শহর। নামটি সঠিকভাবে কেউ বলতে পারে না। কেউ কেউ বলে কোনো অজানা কারণে শহরটিকে মানচিত্র থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, যারা কৌতূহল বশত শহরটি খুঁজতে বেরিয়েছিল তাদের কেউই আর ফিরে আসেনি। সুতরাং শহরটি সম্পর্কে গালগল্প থাকলেও সঠিক কোনো তথ্য জানা নেই।”

ভদ্রলোক এবারও হেসে উড়িয়ে দিলেন যুবকের কথা। বললেন,

“এগুলো মনগড়া কথা। আমার বয়স তো কম হলো না। কই আমি তো কখনও ওসব দেখলাম না বা শুনলাম না তেমন ঘটনার কথা। তোমাদের এই বয়সে কত ফ্যান্টাসি মাথায় ঘোরে। আদতে ওগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। না হলে ওই শহরে অস্তিত্ব থাকবে না কেন? রক্তচোষা বলতে তুমি যা বোঝাচ্ছ তেমন কিছু নেই। ডাক্তার বললেন না, ইসাবেলা মানসিকভাবে অসুস্থ। অযথা, চিন্তা করো না। চলো ভেতরে যাই।”

যুবকের মনের খুঁতখুঁত কিন্তু রয়েই গেল। অপেক্ষা করল ইসাবেলার জ্ঞান ফেরার জন্য। হয়তো তখন সবটা ভালোভাবে জানতে পারবে। কে জানে রক্তচোষাদের সেই কাহিনি যদি সত্যি হয়? যদি ইসাবেলার ভয়টা নিছক ভয় না হয়? দুজনে বাড়ির ভেতর প্রবেশই করবে ঠিক তখন মাদামের বাড়ির সামনে একটি কালো ফিটন এসে থামল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন সাদা হ্যাবিট পরনে যুবতি এক সিস্টার। ভদ্রলোক ভ্যালেরিয়াকে চিনতেন। এগিয়ে গেলেন তিনি। ভ্যালেরিয়া মাদামের বাড়ির সদর দরজা খোলা দেখে কপাল কুঁচকাল।

“সিস্টার”

ভ্যালেরিয়া পেছন ফিরে তাকাতে ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন। অভিবাদন জানালেন জোরপূর্বক সৌজন্যমূলক হাসি হেসে। ভদ্রলোক ভ্যালেরিয়াকে সবটা খুলে বলতে ভ্যালেরিয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ইসাবেলার কাছে ছুটে এলো সে। মাদামের হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যাওয়া, ইসাবেলার দুরবস্থা দেখে ভ্যালেরিয়ার বুঝতে বাকি থাকল না কী ঘটেছে। নিজেকে হাজারবার তিরস্কার করল। নীরবে চোখের জল ফেলে ইসাবেলার গালে হাত রেখে। ইসাবেলার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারত না সে। ওর জন্যই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। ভয়ে অসাড় হয়ে যাওয়া শরীরটাকে সেদিন টেনে বেসমেন্টের নোংরা নালায় আড়াল করাতে পিশাচটার হাত থেকে সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু বিপদ এখনও মাথার উপর। ইসাবেলাকে বাঁচাতে হলে এই মুহূর্তে এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। ভদ্রলোককে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তখনই অচেতন ইসাবেলাকে নিয়ে রওনা হলো রিগার উদ্দেশ্যে। যুবক এবং ভদ্রলোক বেশ অবাকই হলো সিস্টার ভ্যালেরিয়ার এই আচরণে। অন্তত এক রাত কাটানোর অনুরোধও সিস্টার ভ্যালেরিয়া রাখেনি। আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল তাকে। যুবক সন্দেহবশে রক্তচোষা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে ভ্যালেরিয়ার মুখের রঙ বদলে যায়। এতেই প্রবল হয় যুবকের সন্দেহ। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে তার কথা? নিজের জীবন বাঁচাতে সেও কাওকে কিছু না বলে পালিয়ে যায় ওই গ্রাম থেকে।

কোচওয়ানের জোরাল চাবুকের আঘাত পিঠে পড়তে ঘোড়া প্রাণপণে ছুটছে। লোকালয় পেরিয়ে ফিটন চলল তেপান্তরের পথ ধরে। ইসাবেলার মাথা ভ্যালেরিয়ার কোলে। ভ্যালেরিয়া ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ওর মুখটা ছুঁয়ে দিচ্ছে আলতো করে। মেয়েটার এই করুণ দশার জন্য নিজেকে দায়ী করল সে। আজ যদি ওর কিছু হয়ে যেত ভ্যালেরিয়া কীভাবে বাঁচত? ইসাবেলা ওর কতটা জুড়ে আছে তা কেবল সেই জানে। ইসাবেলার কোনো ক্ষতি সে হতে দেবে না।
রিগাতে পৌঁছাতে পারলে শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়বে ভ্যালেরিয়া। তার আগে ভয়টাকে কিছুতেই দূর করতে পারছে না। বিকেল পড়ে এসেছে। রাতে ভ্রমণ করার সাহস ওর নেই। কোচওয়ানকে বলল,

“আশেপাশে কোনো লোকালয় আছে?”

“না, তবে আরেকটু দূরে একটা পান্থশালা আছে।”

“সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারব সেখানে?”

“মনে হয় পারব।”

“তাহলে সেখানে আজ রাত থাকব। সকাল হলেই রওনা হব আবার।”

“জি, আচ্ছা।”

গোধূলির রক্তিম আভা ছড়িয়েছে পশ্চিমাকাশে। আলো যতই নিভছে ততই ভ্যালেরিয়ার আতঙ্ক বাড়ছে। কোচওয়ানকে বার বার তাগাদা দেয় দ্রুত গাড়ি হাঁকানোর জন্য। কোচওয়ান মনে মনে বেজায় বিরক্ত হয় সিস্টারের তাগাদায়। মুখে অবশ্য তা প্রকাশ করল না। দেখতে দেখতে সন্ধ্যার আঁধার নেমে এলো। ভ্যালেরিয়া আর্ত চোখে বাইরে তাকায়। বুকের ক্রুশটা মুঠোবন্দি করে ঈশ্বরের নাম জপে।

“ভ্যালেরি!”

ইসাবেলা পিটপিট করে চোখ মেলল। ভ্যালেরিয়া সকল শঙ্কা, ভয় এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল। হাসি মুখে ওর মুখ আঁজলা ভরে বলল,

“ক্রাসিভায়া__” ভ্যালেরিয়ার কথা অসমাপ্ত রয়ে যায় ফিটনের সামনের ঘোড়ার অস্বাভাবিক আচরণে। কোচওয়ান কিছুতেই ওটাকে বশে আনতে পারছে না। আচমকা হলো কী ঘোড়ার? ভ্যালেরিয়া এবং ইসাবেলা ভয়ার্ত মুখে পরস্পরের দিকে তাকাল। ইসাবেলার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বুকে জড়িয়ে ধরে ভ্যালেরিয়া।

“ভয় পেয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক__”

সব ঠিক হয় না। ঘোড়া বাঁধন ছেড়ে কোথাও দৌড়ে পালিয়ে গেল। কোচওয়ান নেমে চিৎকার করতে করতে ছুটল ঘোড়ার পেছনে। ভ্যালেরিয়া ফিটনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ঘোর অন্ধকার চারপাশে। ওরা যে এখন কোথায় বুঝতে পারছে না। মৃদু গলায় কয়েকবার কোচওয়ানকে ডাকল ভ্যালেরিয়া। কিন্তু তার সাড়া নেই। চারিদিকে নিগূঢ় নিস্তব্ধতা। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে ভেসে এলো নেকড়ের কর্কশ গর্জন। ভ্যালেরিয়ার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। গত দুই দিনে অনেক মৃত্যু দেখেছে সে। সব সাহস, বিশ্বাস ভয়ের শিকলে বাঁধা পড়েছে। লড়াই করার মতো শক্তি ওর নেই। কিন্তু ইসাবেলাকে বাঁচাতে তাকে লড়তে হবে। ভয়টাকে জয় করতেই হবে। ইসাবেলা ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আর্ত কণ্ঠে বলল,

“ওগুলো কীসের গর্জন? আমার ভীষণ ভয় করছে ভ্যালেরি।”

“ভয় পেয়ো না। কিছু হবে না তোমার। আমি বেঁচে থাকতে কিছু হতে দেবো না।”

গলার ক্রুশটা খুলে ইসাবেলার গলায় পরিয়ে দেয়। ইসাবেলা ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওর দিকে। ভ্যালেরিয়া ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে,

“যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো। শক্ত হতে হবে তোমাকে। আমি জানি অনেক সয়েছ এই কদিনে। অনেক শিখেছ তুমি। ক্রাসিভায়া, জীবনের এমন মুহূর্ত আসে যখন মানুষকে সার্ভাইব করা শিখতে হয়। কেউ থাকে না পাশে। তখন নিজেই নিজের শক্তি হতে হয়। তোমাকে আজ নিজের সেই শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সাহসী হতে হবে তোমাকে। আমাকে ছাড়াই রিগা পৌঁছাতে হবে। এখান থেকে অল্প কিছু দূরে পান্থশালা। এই রুবলগুলো রাখো। রাতটা সেখানে কাটিয়ে পান্থশালার কারো সাহায্যে রিগাগামী ট্রেনে চড়বে। পারবে না?”

ভ্যালেরিয়ার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। ইসাবেলা ওই চোখে চেয়ে কিছু একটা টের পায়। ভ্যালেরিয়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরে,

“আমি তোমাকে ছাড়ব না ভ্যালেরি। পারব না একা চলতে। পারব না সাহসী হতে। তোমাকে ছাড়া কিছুই পারব না। আমাকে একা ফেলে যেয়ো না ভ্যালেরি।” অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল ইসাবেলা। নেকড়ের কর্কশ গর্জন ক্রমশ এগোচ্ছে। ভ্যালেরিয়া সময় নষ্ট না করে ইসাবেলার হাত ধরে নেমে এলো। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। এক পাল নেকড়ের মাঝে জড়াজড়ি করে দুজনে দাঁড়ান। নেকড়েগুলোর রক্তাভ লোলুপ চোখে চেয়ে ওদের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল । ভ্যালেরিয়ার ভাবনা তখন ইসাবেলাকে নিয়ে। কী করে এই হায়েনাগুলোর হাত থেকে রক্ষা করবে প্রাণপ্রিয় ভাগ্নিকে সে! সম্মোহনী গলার একটা পুরুষ কণ্ঠের ডাক শুনে চমকে ওঠে।

“সিস্টার ভ্যালেরিয়া!”

বাম পাশে তাকাতেই দীর্ঘদেহী, সুদর্শন যুবককে দেখে স্তম্ভিত হয়। পরনের পোশাকে রাজকীয় ভাব। যুবকটি চোখের নিমেষে মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে ক্রুর কুটিল হাসি, চোখদুটো রক্তিম। ঘাড় বাঁকিয়ে ইসাবেলার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাতে ভ্যালেরিয়া ওকে পেছনে আড়াল করে। যুবকের কুটিল হাসি আরো প্রসস্থ হয় তা দেখে। ইসাবেলা দেখল তীক্ষ্ণ ফলার মতো সাদা চকচকে দু’টি দাঁত বেরিয়ে এলো যুবকের ঠোঁটের দু’পাশ থেকে। ওর লম্বা নখওয়ালা আঙুলগুলো ভ্যালেরিয়ার মুখ ছুঁয়ে আস্তে আস্তে ঠোঁটে নিচে থামল। ঝুঁকে ফিসফিসানি স্বরে বলল,

“ভেবেছিলে বেঁচে যাবে? আহ! তোমার জন্য ভারী দুঃখ হচ্ছে এখন আমার ভ্যা-লে-রি-য়া।”

ভ্যালেরিয়ার বুকের দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে যুবক নিচের ঠোঁট কামড়াল। রাগে, ঘৃণায় ভ্যালেরিয়ার শরীর রি রি করে ওঠে। কষে এক চড় বসাল ওর গালে। মুহূর্তে যুবকের রূপ বদলে যায়। গলা টিপে ধরল ভ্যালেরিয়ার। ইসাবেলা চিৎকার করার আগেই ভ্যালেরিয়ার গলা ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। ইসাবেলা চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে,

“ভ্যালেরি!”

এবার ইসাবেলার দিকে অগ্রসর হয় যুবক৷ কিন্তু ওর গলার ক্রুশটা দেখতে থমকে যায়। দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে। ইসাবেলা দৃষ্টি তখন ভ্যালেরিয়ার দিকে। একজন মধ্যবয়সী অতিব সুন্দরী রমণী ভ্যালেরিয়ার দিকে এগিয়ে আসছেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি। দৃষ্টিজোড়া বড়ো হিংস্র, নির্মম। রমণীর পোশাক এই যুবকের মতোই রাজকীয়। চলনেও রাজকীয় ভাব। যেন কোনো রাজ্যের রাণী তিনি। ভ্যালেরিয়ার আহত শরীরটাকে টেনে দাঁড় করালেন। যুবক সেদিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,

“বাঁচাতে চাও ওকে?”

“প্লিজ! তোমার পায়ে পড়ছি ছেড়ে দাও ভ্যালেরিকে।” ইসাবেলা মিনতি করে। যুবকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল,

“তবে গলার ওটা খুলে ফেলো। খোলো, খোলো।”

ইসাবেলা ক্রুশটা মুঠোবন্দি করে মাথা নাড়ায়। সে জানে এটা খুললে কী হবে। যুবক দাঁতে দাঁত পিষে খিঁচিয়ে ওঠে,

“তবে মরুক ও। মেরে ফেলো সিস্টারকে।”

“না, না। মেরো না ওকে। আমি খুলছি।”

ভ্যালেরিয়া নিষেধ করতে চায়। কিন্তু রমণী ওর গলা ধরে চেপে আছে। গোঙানি ছাড়া কিছুই যেন বের হলো না। ইসাবেলার পরিণতি স্মরণ করে কাঁদতে লাগল। সিস্টার ভ্যালেরিয়ার কান্না রমণীর আনন্দ আরো বাড়িয়ে দেয়। অদৃশ্য থেকে লাল চুলের অনিন্দ্য সুন্দরি এক যুবতি হেলেদুলে এসে থামল রমণীর পাশে। ওর মুখের আবেদনময়ী হাসি দপ করে নিভে গেল। খিঁচিয়ে উঠল হিংস্রতার সাথে,

“শেষ করে ফেলো এই মাগিটাকে। বড্ড জ্বালিয়েছে আমাদের। আজ ওর রক্ত দিয়ে হলি খেলে তবেই শান্তি হবে।”

“ভাষা সংযত করো ইভারলি। ভুলে যাচ্ছো কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ তুমি। বার বার একই ভুলের ক্ষমা মিলবে না। গলা থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে ফেলব পরবর্তীতে এহেন আচরণ করলে। নত হও আমার সামনে, নত হও।”

রমণী গর্জে ওঠেন। ইভারলি নাম্নি মেয়েটি অনিচ্ছা স্বত্বেও নত হয়। রমণীর দৃষ্টি আবার ফেরে ভ্যালেরিয়ার মুখের উপর। ভ্যালেরিয়ার এই ভয়, যন্ত্রণা তিনি ভীষণ উপভোগ করছেন। স্বীকারকে একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে শেষ করার আনন্দই অন্যরকম।

“তোমার মৃত্যু তোমার অন্য সকল সাথীদের মতোই হবে সিস্টার। স্বর্গে বসে তোমার এই মানব শরীরের অপমান দেখবে। তোমার ঔদ্ধত্যে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছি। আমার ক্ষুব্ধতা আজ তোমার রক্তপানে মিটবে। তারপর তোমার লাশটাকে ওই ক্ষুধার্ত নেকড়েগুলোর সামনে ফেলে দেবো। ছিঁড়ে খাবে ওরা তোমার শরীর।”

নিষ্ঠুর অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন রমণী। মুখ নামিয়ে এনে ফিসফিসিয়ে বলেন,
“আলবিদা সিস্টার। আর হ্যাঁ, তোমার সঙ্গীকে একটু পরেই পাঠাচ্ছি। অপেক্ষা করো উপরে বসে।”

রমণী ইসাবেলার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে তীক্ষ্ণ দাঁত দু’টি বসিয়ে দিলো ভ্যালেরিয়ার গলায়। ভ্যালেরিয়ার শরীর তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। গোঁ গোঁ শব্দ বের হয় ওর গলা দিয়ে।

“ভ্যালেরি! না, না, ওকে ছেড়ে দাও।”

ইসাবেলা ছুটে যেতে চায় কিন্তু যুবকটি তাকে দুবাহুতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। একটু দূরে পড়ে আছে ভ্যালেরিয়ার দেওয়া ক্রুশটা। ইসাবেলার চোখের সামনে ভ্যালেরিয়ার নিথর দেহটি বরফের উপর আছরে পড়ে। ইসাবেলা স্তব্ধ, বিমূঢ়। ওর চোখ দিয়ে অবাধে জল গড়াচ্ছে। গলার কাছে রক্তপিপাসু যুবকের উষ্ণ নিঃশ্বাস আর তীক্ষ্ণ দাঁতের স্পর্শ অনুভব করে। কিন্তু আজ আর ভয় নেই। দু-চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে মৃত্যুর। ভয়, মৃত্যু! আজ এই দুটি থেকে তার মুক্তি হবে।

চলবে,,

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১০
Writer Taniya Sheikh

চাঁদটা মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে জ্বলছে নেকড়েগুলোর রক্তজবার মতো টকটকে চোখগুলো। তিনটে মানুষরূপী পিশাচের রক্তাভ ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। ওদের দৈহিক সৌন্দর্য যেন চোরাবালির ফাঁদ। যে কেউ আকৃষ্ট হয়ে অজান্তেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ইসাবেলার। প্রথম দর্শনে সেও তো ওদের রূপের মোহে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন, ওই রূপের আড়ালের সত্যিটা সে দেখতে পাচ্ছে। নৃশংস, নির্মম ওরা। এদের কথায় কি বলেছিল ভ্যালেরিয়া তাকে? রমণী এবং যুবতির দৃষ্টি ওর দিকে স্থির। দুজনের চোখের বর্ণ এখন একই রকম, ভয়ানক রক্তিম। লাল ঠোঁটের পাশ দিয়ে চকচকে সরু দুটি দাঁত বেরোনো। রমণীর ঠোঁটের কোণে এখনও লেগে আছে ভ্যালেরিয়ার তাজা রক্ত। ভয়, আতঙ্কের অনুভূতি ম্লান হচ্ছে ঘৃণা আর রাগে। ভ্যালেরিয়ার নিথর দেহের দিকে তাকাতে ফুঁপিয়ে ওঠে ইসাবেলা। ভয়ের চাইতে তখন প্রিয় মানুষ হারানোর শোক বেশি। গলার কাছে অনুভব করছে যুবকের ভারী নিঃশ্বাস। ধারালো দাঁত দুটো ছুঁয়ে দিচ্ছে গলার ত্বকের উপর। ইসাবেলা দুহাতে খামচে ধরে আছে পরনের ঘাগরা । রমণী ইসাবেলার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গর্জন করা নেকড়েগুলোকে ইশারা করেন। পশুগুলোর গর্জনে আকাশ, জমিন ভারী হয়ে ওঠে। ওরা এগোচ্ছে ভ্যালেরিয়ার পড়ে দেহের দিকে। ভ্যালেরিয়ার দেহ ছিন্ন ভিন্ন হওয়ার দৃশ্য দেখতে পারবে না ইসাবেলা। দুচোখ বন্ধ করে কাঁদতে লাগল। আর কতক্ষণ করতে হবে মৃত্যুর অপেক্ষা? যুবকের হাত ধীরে ধীরে কোমর ছেড়ে ইসাবেলার ঘাড়ে এসে থামে। অন্য হাত এখনও কোমরের একপাশে। পরপুরুষের স্পর্শে ঘৃণায় রি রি করে উঠল ইসাবেলার শরীর। দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায় কিন্তু ও যেন রক্ত মাংসের শরীর নয় লোহার ইস্পাতে গড়া। ইসাবেলার মুখশ্রী ব্যথায় নীলবর্ণ ধারণ করে রক্ত পিপাসু যুবকটি ওর ঘাড়ের চামড়ায় দাঁত দুটো ফুটিয়ে দিতে। দু’হাতে আরো জোরে যুবকের দেহ ঠেলে সরাতে গিয়ে ফের ব্যর্থ হয়।

“ছাড়ো আমাকে। ছেড়ে দাও।”

ওর কাকুতিতে হাসে যুবক। ঠোঁট দুটো শামুকের মতো সজোরে চেপে ধরে আছে ইসাবেলার ঘাড়ের চামড়া। শরীর বিবশ হতে লাগল। তবুও জোর দিয়ে দুহাতে ঠেলতে লাগল যুবকের বুক। হঠাৎ আপনাতেই সরে গেল যুবকের দেহের ভার, ঘাড়ের উপরের উষ্ণ ঠোঁটজোড়া। ইসাবেলা ধপ করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। দেহের শক্তি বুঝি অনেকখানি শুষে নিয়েছে ওই পিশাচটা। নেকড়েগুলোর গর্জন থেমে গেল হঠাৎই। খানিক নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা পায়ের শব্দ ওর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছায়। চোখ মেলে চকিতে তাকাল। যুবক নেই সামনে। ওর শরীরটা পড়ে আছে রমণীর পায়ের কাছে। মুহূর্তে রাগে হিস হিস করে উঠে দাঁড়াল যুবক। রমণী এবং যুবতির দৃষ্টিতে বিস্ময়ভাব। পরক্ষণেই সেটা বদলে গেল। রমণীর দৃষ্টিজোড়া রাগে জ্বলছে ইসাবেলার দিকে চেয়ে। কিন্তু যুবকের মুখে এখন স্বাভাবিক হাসি। কেউ দেখলে ওকে মানুষ বলে ভুল করবে। যুবতী মুখে আবেদনময়ী হাসি। শরীরটা আরো আকর্ষণীয় করে তুললো। ইসাবেলা দেখল কালো বুটজুতো পরা দু’টো পা ওর সামনে। মানুষটার পরনের কালো আলখেল্লার নিচের অংশ থেকে আস্তে আস্তে উপরে তাকাল। চমকে ওঠল ও। উঠে দাঁড়ায় সাথে সাথে।

“নিকোলাস!” ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে কিন্তু তা আর হলো না। যে আশা আর ভরসা নিয়ে ছুটে এসেছিল এক নিমেষে হতাশায় পর্যবসিত হয়। নিকোলাসের রুক্ষ, বড়ো ডানহাতটা ওর গলা চেপে ধরেছে। দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। ইসাবেলা বিস্মিত নিকোলাসের আচরণই শুধু নয়, ওকে দেখেও। ঠিক যেই নিকোলাসকে সে দেখেছিল এ সে নয়। ওর সামনে দাঁড়ানো নিকোলাসের দৃষ্টি রুক্ষ। আগুনের লেলিহান শিখার ন্যায় জ্বলছে চোখ দুটো। সেই নীল মণিজোড়া কোথায়? যার মোহে বার বার সম্মোহিত হয়েছিল ইসাবেলা। নিকোলাসের রক্তলাল ঠোঁটজোড়া রাগে শক্ত হয়ে আছে। মুখের সেই শান্তভাব, মুগ্ধ করা হাসি কিছু নেই। নিকোলাসের দৃষ্টি ইসাবেলার দিকে পড়তে ভ্রু কুঁচকে ওঠে। জ্বলন্ত দৃষ্টিজোড়াতে অবিশ্বাস। গলায় চেপে ধরা হাতটা সামান্য শিথিল হলো এবার। নিকোলাসের ঠোঁটের দুপাশ থেকে বেরিয়ে এলো সরু সূঁচালো দুটো দাঁত। ঠিক ওই তিনজনের মতো। তবে কি নিকোলাসও ওদের একজন? ইসাবেলা বজ্রাহতের ন্যায় চেয়ে রইল। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় ওর হৃৎস্পন্দনের গতি। ইসাবেলার ঘাড়ের চামড়ার ছিদ্র থেকে তখনো রক্ত পড়ছে। নিকোলাস সেদিকে ঝুঁকে গিয়ে আবার মুখ তুলে ইসাবেলার স্তব্ধ মুখের চেয়ে থেমে গেল। ছুঁড়ে ফেলে দেয় ওর শরীরটা। এমনভাবে ফেলল যেন নোংরা কিছু ভুলে ধরে বসেছে সে। ইসাবেলা হাত এবং হাঁটুতে বেজায় ব্যথা পেল নিচে পড়ে।

“নিকোলাস!” ব্যথায় কাতরে উঠল ইসাবেলা। সে যেন নিজের চোখকে এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। নিকোলাস ওকে একপ্রকার উপেক্ষা করে সামনে তাকায়। গর্জে ওঠে ওর গলা,

“আন্দ্রেই”

“বড়ো ভাই”

বড়ো ভাই? ইসাবেলা চকিতে ফিরে তাকায় আন্দ্রেই নামক সেই পিশাচ যুবকের দিকে। তারপর আবার নিকোলাসের দিকে। এরা ভাই! ইসাবেলার ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠে। এত বড়ো ধোঁকা দিলো নিকোলাস ওদের? ছদ্মবেশী, প্রতারক! ইসাবেলা ভয়, ডর সব ভুলে গেল সেই মুহূর্তে। আন্দ্রেই হাসি মুখে দুহাত মেলে এগোতে লাগল। নেকড়েগুলো ভ্যালেরিয়ার পড়ে থাকা দেহের পাশ থেকে একটু দূরে ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। ঘর ঘর করে চাপা শব্দ বেরোচ্ছে ওদের গলা দিয়ে। নিকোলাসের দিকে ওগুলোর দৃষ্টি স্থির। নিকোলাস রাজার মতো মুখ তুলে দাঁড়িয়ে। মুখের ভাব আরো রুক্ষ, কঠিন। আন্দ্রেই কাছাকাছি আসতে নিকোলাস হাওয়ায় মিশে ওর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। আন্দ্রেই থেকে উচ্চতায় নিকোলাস একটু লম্বা। দৈহিক দিক থেকে পেশিবহুল। ওদের সুদর্শন চেহারায় বলে দেয় ওরা একই বাবার সন্তান। কিন্তু হিংস্র আন্দ্রেই থেকে নিকোলাস বেশি। ওর মধ্যে দয়া মায়ার রেশমাত্র নেই। না আপন বোঝে আর না পর। নিজেকে এবং নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয় সে। আন্দ্রেই ওর বিনা অনুমতিতে রাশিয়ায় এসেছে। ফাদার জালোনভের উপর নিকোলাস নিজেও ক্ষুব্ধ। সে শিকার ধরে তাড়িয়ে তাড়িয়ে। সময় নিচ্ছিল তাই। কিন্তু আন্দ্রেই তাকে না বলে ওই গাঁ দখলে গেছে। এত দুঃসাহস আন্দ্রেইর! নিকোলাসকে অমান্য করার, অসম্মান করার দুঃসাহস কেউ দেখালে তার আর রক্ষে থাকে না। আন্দ্রেইর উপর রাগান্বিত সে। নিকোলাস গলা চেপে ধরে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে তুলে ধরল আন্দ্রেইর শরীর। কর্কশ গলায় প্রশ্ন করে,

“কার হুকুমে এখানে এসেছিস তুই? কার হুকুমে?”

আন্দ্রেইকে এবার ভীত দেখাল। আন্দ্রেই ভাইয়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছে। নিকোলাস আবার ওকে ছুঁড়ে ফেলল নিচে। হাওয়ায় মিশে গিয়ে ওর গলার উপর এক পা চেপে ধরে। আন্দ্রেই ব্যথিত গলায় বলল,

“ভাই”

নিকোলাস কিছু শোনার ইচ্ছাতে বোধহয় নেই সেই মুহূর্তে। আন্দ্রেইর মাথাটা ধীরে ধীরে বরফ থেকে আরো নিচে ঢুকে যাচ্ছে। নিকোলাস হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,

“আমি তোকে বলেছি এখানে আসতে? কেন এসেছিস? কার হুকুমে আমাকে অবজ্ঞা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিস তুই? কার হুকুমে?”

“আমার”

রমণী সদর্পে এগিয়ে এলেন কয়েক কদম। নিকোলাস তাঁর দিকে ফিরল না। আন্দ্রেইর গলার উপর পা রেখেই বলল,

“তাহলে এই ব্যাপার? এখন তুইও আমার বিরুদ্ধাচারণ করছিস আন্দ্রে? ভুলে গেছিস কার অধীন তুই? ভুলে গেছিস কার পোষ্য তুই? বাহ! আমাকে ছোটো করছিস ওই মহিলার কথাতে?”

“সংযত হয়ে শব্দ ব্যবহার করো নিকোলাস। ভুলে যেয়ো না আমি তোমার মা। নিরিথের( কাল্পনিক) রাণী।”

রমণী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন। নিকোলাস কর্কশ কণ্ঠে জবাব দিলো,

“কতবার বলতে হবে, তুমি আমার মা নও সোফিয়া। আর না তুমি নিরিথের রাণী। তুমি কেবল আমার বাবার স্ত্রী। ও হ্যাঁ, দ্বিতীয় স্ত্রী কিংবা মিস্ট্রেস।”

“নিকোলাস!”

“রাজা নিকোলাস” নিকোলাস অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে সৎমায়ের বাক্য শুধরে দিলো। আন্দ্রেইর দিকে ফিরে বলল,

“বল আন্দ্রে, আমার হুকুম অমান্য করার জন্য কী শাস্তি তোর প্রাপ্য?”

আন্দ্রেই চোখ নামিয়ে চুপচাপ রইল। মুখে অপরাধী ভাব। নিকোলাস পা সরিয়ে ওর কলার মুঠোর মধ্যে ধরে বলল,

“ছোটো করেছিস আমাকে তুই। আজ বুঝিয়ে দিয়েছিস সৎ কোনোদিন আপন হয় না। বিশ্বাস ভেঙেছিস তুই আমার আন্দ্রেই। নিজের মায়ের জন্য এই ভাইকে অপমান করেছিস। আজ থেকে তুই আমার কাছে ওই মহিলার মতো__”

“উনি আমার মা ভাই। বার বার মহিলা, বাবার মিস্ট্রেস বলে তাকে তুমি অসম্মান করতে পারো না। ছেলে হয়ে আমি সেটা বরদাস্ত করব না।”

“কী করবি? আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবি? এই এভাবে?”

“আমি কোনোদিন তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাব না ভাই। আমি_”

“ব্যস। আর কথা না। একদম চুপ। প্রাসাদে ফেরার পর তোমাদের ব্যবস্থা হবে। এক্ষুণি এখান থেকে প্রস্থান করো। নয়তো তোমাদের প্রত্যেকের গলা থেকে মাথা ছিঁড়তে আমি দ্বিধা করব না।”

আন্দ্রেইর কলার ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় নিকোলাস। নত মাথা নাড়িয়ে পেছন ফিরে তাকায় আন্দ্রেই। ভাইয়ের বিরোধিতা করার ইচ্ছে কিংবা সাহস তার নেই। ওর ইশারা পেয়ে নেকড়েগুলো কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। সোফিয়া দাঁতে দাঁত পিষে দাঁড়িয়ে আছেন। আন্দ্রেইর এই ভাতৃভক্তিকে তিনি ঘৃণা করে। অপছন্দ করেন ছেলের এই ভীরুতা। নিকোলাসের গা ঘেঁষে বেড়ানো ইভারলিরও আজ সাহস হলো মুখ খোলার। ঠিক সেই মুহূর্তে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কষে নিকোলাসের গালে চড় বসিয়ে দেয় ইসাবেলা। শুধু একটা নয়। দুহাতে এলোপাতাড়ি চড় দিতে লাগল নিকোলাসকে। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,

“পিশাচ, শয়তান, ভণ্ড, তুই আমাদের সাথে ছল করেছিস। মাদামের উন্মাদ হওয়ার কারণ তুই। বেঈমান, মাদামের উপকারের এই প্রতিদিন দিলি? তোকে ঈশ্বর কোনোদিন ক্ষমা করবেন না। আমার ভ্যালেরির মৃত্যুর কারণ তুই। হারামজাদা, তোকে আমি মেরে ফেলব।”

সামান্য এক মানবীর এই ধৃষ্টতা দেখে নিকোলাস রেগে অগ্নিশর্মা। ইসাবেলার গলা টিপে ধরে কর্কশ গলায় বলে,

“এত স্পর্ধা তোর? তুচ্ছ এক মেয়ে মানুষ আমাকে চড় মারিস?”

গলা থেকে ওর হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করে ইসাবেলা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। খুক খুক করে কেশে বলল,
“এই তুচ্ছ মেয়ে মানুষই তোকে ধ্বংস করবে। আমার ভ্যালেরিকে মেরেছিস তোরা। পশু, তোরা নরকে যাবি। শেষ করে ফেলব তোদের আমি।”

নিকোলাসের রাগ মুহূর্তে উবে গেল। বিদ্রুপের হাসি ঠোঁটে। যেন মজা পেয়েছে। ইসাবেলার গলা ছেড়ে মাথার পেছনের চুল নিজের মুঠির মধ্যে টেনে ধরে। ওর ব্যথাভরা মুখটা দেখে নিকোলাস হেসে শান্ত গলায় বলল,

“তাই বুঝি? বেলা, বোকা মেয়ে তুমি। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে চোখ রাঙাচ্ছ? আগে আমার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে দেখাও বোকা মেয়ে। তারপর না হয়__”

নিকোলাসের মুখটা নেমে আসে ইসাবেলার ঘাড়ের সেই পুরোনো ক্ষতে। যেখানে নিকোলাসের দাঁত ফোটানো গর্তে রক্ত জমে রয়েছে। নিকোলাসের উষ্ণ নিঃশ্বাস সেখানে টের পায় ইসাবেলা। রক্ত হিম হয়ে আসে ওর। নিকোলাস ফিসফিসিয়ে পুনরায় বলে,

“তারপর না হয় আমাকে শেষ করার কথা ভেবো।”

সূক্ষ্ম দাঁত দুটো ফুটিয়ে দিতে ব্যথায় গোঙানি দিয়ে ওঠে ইসাবেলা। নিকোলাস মনে মনে হাসছে। এই দূর্বল, ভীতু মেয়ে ওকে হুমকি দেয়! বোকামি করে নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনল আজ ও। যদিও এমনিতেও বাঁচত না। অবাক হয়েছে মেয়েটাকে জীবিত দেখে। প্রায় রক্তশূণ্য করে এসেছিল শেষবারে। ভেবেছিল অল্পকিছুদিনে অক্কা পাবে। কিন্তু এখন দেখছে উলটো। নিকোলাস আরো গভীরে দাঁত দুটো ঢুকিয়ে দেয়। ওর রক্তের স্বাদ নিকোলাসকে মাতাল করে তোলে। কী মিষ্টি সুবাস মিশে আছে ইসাবেলার রক্তে! নিকোলাস আসক্ত হয়ে গিয়েছিল ওই কদিনে। আজ আবার সেই আসক্তি ফিরে এলো যেন। ইসাবেলা সুযোগে সাহস সঞ্চয় করে লুকানো ক্রুশটা বের করে বসিয়ে দেয় নিকোলাসের বুকের বামপাশে। ছিটকে সরে দাঁড়ায় নিকোলাস। বুক পুড়ে যাচ্ছে। কালো ধোঁয়া বের হতে লাগল সেখান থেকে। অসহ্য পীড়া হচ্ছে ওর। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সামনে। ইসাবেলা ঘাড়ের ক্ষতে হাত রেখে নির্ভয়ে বলল,

“আমার ভয়ই আমার সাহস আজ। আমার শোক আমার শক্তি। ভীতুর মতো মরব না। দ্যাখ হারামজাদা, দ্যাখ, তোকে আমি ভয় পাই না। তোকে হাঁটুর উপর বসিয়েছে এই তুচ্ছ, দূর্বল নারী। তোকে শেষও করব আমিই।”

ঘা খাওয়া হিংস্র পশুর ন্যায় গর্জন করে ওঠে নিকোলাস। আন্দ্রেই ছুটে আসে ভাইয়ের কাছে। সোফিয়া ছেলেকে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়। আন্দ্রেই ধ্বংস হবে জেনেও কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই ভাইয়ের বুকের ক্রুশটা টেনে তুলে সরে দাঁড়ায়। হাত পুড়ে যাচ্ছে আন্দ্রেইর। সর্ব শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো। ক্রুশটা ছুঁড়ে ফেলতে ওর নিস্পন্দ শরীরটা পড়ে যায় নিচে। সোফিয়া চিৎকার করে দৌড়ে এলো ছেলের নিথর দেহের কাছে। ইভারলি হাওয়ার বেগে ইসাবেলার উপর আক্রমণ করতে ছুটে আসে। নেকড়েগুলোও ছোটে। কিন্তু ইসাবেলা আগে থেকে সতর্ক হয়ে আছে। হাতে তুলে নিয়েছে পাশে পড়ে থাকা শুকনো মোটা ডালটা। ইভারলির অদৃশ্য প্রায় ছুটে আসা শরীরটাতে ডালটা দিয়ে সজোরে দিলো বাড়ি। বাড়ির চোটে দূরে গিয়ে পড়ল ইভারলির শরীর। চোখের নিমেষে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইসাবেলার দিকে। খিস্তি দিয়ে উঠল ইভারলি। নেকড়েগুলো ঘিরে ধরেছে ইসাবেলাকে। সবগুলো একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। ওদের আক্রমণ পুনরায় প্রতিহত করার জন্য তৈরি ইসাবেলা। জানে মৃত্যু নিশ্চিত। তবুও শেষ লড়াইটা সে লড়বে। ভীরুর মতো মরবে না। ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ ও নেবেই। অন্তত একটাকে শেষ করে হলেও। দূর্বল শরীরে এতকিছু সহজ হচ্ছে না মোটেও। জোরে জোরে মুখ দিয়ে শ্বাস টানছে। ইভারলির অদৃশ্য শরীর ফের ছুটে এলো, নেকড়ে গুলোও ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওদের নখের থাবায় ক্ষত বিক্ষত ইসাবেলার শরীর। চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে ওর গলা দিয়ে। সমস্ত শক্তি দিয়ে ডালটা দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বেশিক্ষণ আত্মরক্ষা করতে পারে না। ইভারলি আর নেকড়েগুলোর আক্রমনে বিপর্যস্ত ইসাবেলা। ওর হাত -পা, শরীরের এখানে ওখানে নেকড়েগুলো কামড়ে ধরেছে। ইভারলি ওর মুখের উপর পা দিয়ে চেপে ধরে আছে। ডায়নিটার হিলের আঘাতে ইসাবেলার নাক, মুখের চামড়া ছিঁড়ে যায়। মরেই যেত কিন্তু মৃত্যু এবারও প্রত্যাখ্যান করল। নিকোলাসের মুখ দেখতে পাচ্ছে। শয়তানটা হাসছে। ওর পদধ্বনি পেয়ে নেকড়েগুলো সরে গেল। ইভারলি লাথি মারল ওর পেটে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে ইসাবেলা। শরীরে একবিন্দু শক্তি নেই। পরনের গোলাপি ব্লাউজ, সাদা ঘাগড়া রক্তে ভেজা। নিকোলাস ওর ঘাড় চেপে ধরে মুখোমুখি দাঁড় করায়। ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে ইসাবেলা। নিকোলাসের হাসি আরো প্রসস্থ হয়। যেন সে মজা পাচ্ছে। ইভারলি ইসাবেলার রক্ত দেখে লকলকে জিহ্বা বের করে এগিয়ে এলো। ভেবেছিল নিকোলাস কিছু বলবে না। কিন্তু তর্জনী তুলে নিষেধ করল এগোতে নিকোলাস। ইভারলি দাঁত কটমট করে নিজেকে সংযত রাখে।নিকোলাস ঝুঁকে ইসাবেলার ঠোঁটের কোণের রক্ত শুষে নেয়। আঙুলে ওর গালের একপাশের রক্ত তুলে আঙুলটা মুখে পুরে সম্মোহনী গলায় বলল,

“তোমার সাহস আমাকে মুগ্ধ করেছে বেলা। আমি মুগ্ধ তোমাতে। এত সহজ মৃত্যু তোমাকে আমি দেবো না। তোমাকে আমার চাই। প্রতিদিন চাই। যতদিন আমার আসক্তি শেষ না হয় ততদিন চাই।”

ইসাবেলার ঘাড়ের গড়িয়ে পড়া তাজা রক্ত জিহ্বাতে চেটে নিলো। উষ্ণ ভেজা জিহ্বার স্পর্শে
শিহরিত হয় ইসাবেলা। ভয়ে ভেতরটা শুকিয়ে এসেছে। কিন্তু নিকোলাসের চোখে চোখ রাখল নির্ভয়ে। ভয়ই মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। আর ইসাবেলার দ্বিতীয় শত্রু নিকোলাস। দুটোকেই সে শেষ করবে। ওদের কিছুতেই আর প্রভাব খাটাতে দেবে না নিজের উপর। ইসাবেলার এই দুঃসাহসে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ নিকোলাস। আন্দ্রেইর নিথর শরীরটার দিকে চেয়ে মনে মনে ইসাবেলার শাস্তি নির্ধারণ করে ফেলল। একেবারে নয়, এই মেয়েকে নিকোলাস তিলে তিলে মারবে। যেই ভয়কে ও সাহস বানিয়েছে তাই ফিরিয়ে আনবে। ওর চোখে আবার সেই ভয় দেখার পরই শেষ করবে এই তুচ্ছ, দূর্বল মেয়েটাকে। নিরিথের রাজাকে
অসম্মান করার শাস্তি কতটা ভয়ানক হয় আজ থেকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করবে সে।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে